Skip to main content

Setara bibi under the lamp post - Literature - observerbd.com

Setara bibi under the lamp post - Literature - observerbd.com : The glittering city aroundLife is rich with red, blue light of neonWide sky over the headPieces of moonlight, scatteredAnd in that splashed pieces of meteorThose are taken by the scientists of NASASo height the civilization reachesThis city is the flow of happiness nowSome men like us pass the wayWith frustration

 শেখ মুজিবুর রহমান (SHEIKH MUJIBUR RAHMAN) - একটি নাম, একটি ইতিহাস - ওমর খালেদ রুমি

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার গন্তব্যে অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পাড়ি দিতে হয়েছিলো দীর্ঘ পথ। ১৯৭১ সালের পরিস্থিতিটা কেমন ছিলো তা বুঝতে হলে বিনয় মিত্রের  “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : সত্য অসত্য অর্ধসত্য” - এর নিচের কথাগুলোই যথেষ্ট। তিনি ফিরে গেছেন ২১৩ বছর আগের পলাশীর যুদ্ধের সময়কালে। আর তুলনা করেছেন ১১৭৫৭ আর ১৯৭১ সময়কালের মধ্যে। তিনি লিখেছেন,
“যুদ্ধের আড়াল সংঘটিত যুদ্ধের প্রভাবে নবাব সিরাজ হেরে গিয়েছিলেন পলাশীর আম্রকাননে: ১৯৭১ সালে, পলাশীর অদূরে আ¤্রকাননবেষ্টিত এলাকা মুজিবনগর থেকে পরিচালিত যুদ্ধের সময়, যুদ্ধের আড়ালে সারাক্ষণ যুদ্ধ চলেছে, কখনো বহিঃশত্রæর বিপক্ষে, কখনো বা মীরজাফর-উমিচাঁদের মতো গৃহশত্রæর বিরুদ্ধে; নবাব সিরাজ ওই আড়ালের যুদ্ধকে মোকাবিলা করতে পারেননি, কিন্তু মুজিবনগরের প্রাজ্ঞ নেতৃবৃন্দ অতি দক্ষতার সাথে দৃশ্যমান ও আড়ালযুদ্ধ- দুটিকেই মোকাবিলা করতে পেরেছেন, তাই মাত্র ন’মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে একটা রক্তখেকো দানবশক্তিকে পরাজিত করে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র - বাংলাদেশ।”
কথা আসতে পারে কিভাবে সম্ভব হলো। সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যায় গোখলের মুখেই। বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও লেখক গোখলে বলেছেন, “বাঙালিরা আজ যা চিন্তা করে, ভারতের বাকি অংশ তা চিন্তা করে আগামীকাল। বস্তুত গোখলের এ কথা যে অসত্য নয় - এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে তাকালে। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষে যখন অন্য কোনো জাতি বা জাতিগোষ্ঠী পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার চিন্তাও করেনি, যখন আমরা রাষ্ট্রিক সুবিধাদি ও কৃপালাভের জন্য ব্যস্ত থেকেছি কর্তাভজনায় - তখন বাঙালিরা তিতুমীরের নেতৃত্বে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে দেশমুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। স্বাজাত্য বা স্বাধিকার বিষয়ে অন্যরা যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন বা অচেতনপ্রায় - বাঙালিরা তখন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয়, বাদল, দীনেশ হয়ে রাজশক্তির ভিত বারবার কাঁপিয়ে দিয়েছে, দেশমুক্তির জন্য হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করে ভারতের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সামনে ‘দেশপ্রেমিক’- এর আদর্শ উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে বাঙালি জাতি জন্ম দিতে পেরেছে সুভাষ বসুর  (পরবর্তী পর্যায়ে শেখ মুজিব) মতো অকুতোভয় জাতায়তাবাদী নেতার। মহাত্মা গান্ধী আর জিন্নাহ - যে দুই ভুখÐে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে ‘জাতির পিতা’ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন, সেই পতাকাশোভিত আলোকোজ্জ্বল অনুকূল মঞ্চের ক্ষেত্রটি কিন্তু তৈরি করে দিয়েছিল বাঙালিরাই, অগণিত প্রাণ ও অফুরন্ত ত্যাগের বিনিময়ে।”
শেখ মুজিব নিজেও অনেকটা এগিয়ে ছিলেন অন্যদের চাইতে। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহমদ ও মোনায়েম সরকার  প্রমুখ সম্পাদিত “বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস” নামক গ্রন্থে লেখা হয়েছে,
“.. মোহাম্মদ আলী বগুড়া (প্রথম বিয়ে খ্রিস্টান রমণী, দ্বিতীয় বিয়ে নিজের বাসার কাজের মহিলা), ফিরোজ খান নুন (বিয়ে করেছিলেন খ্রিস্টান মহিলাকে), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (বিয়ে করেছিলেন রাশিয়ান মহিলাকে), তারা রাজনীতির মাঠে গলা চড়িয়ে ধর্মের কথা বলতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকে ‘থোড়াই কেয়ার’ করতেন। সে তুলনায় বাঙালি নেতৃবৃন্দ অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ হলেও, তাঁরা পাক-নেতাদের কাছে গণ্য হতেন ‘হিন্দুঘেঁষা’ কাফের হিসেবে। অন্যদিকে পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলা এবং উভয় প্রদেশের সামন্ত অভিজাত মুসলিম সম্প্রদায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করলেও, ঘটনাচক্রে এর পুরো কৃতিত্ব চলে যায় জিন্নাহর কবজায় এবং এর ফলে যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ওই আন্দোলনের সূত্রপাত ও বিকাশ, ‘পাকিস্তান সৃষ্টিতে সর্বভারতীয় পর্যায়ের মুসলিম জনসংখ্যার সামগ্রিক প্রতিনিধিত্ব কিংবা আশা-আকাঙ্খার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।”

পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতেই অসংখ্য গোলমেলে ব্যাপার সৃষ্টি হয়। বিষয়টা বুঝতে হলে বিনয় মিত্রের  “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : সত্য অসত্য অর্ধসত্য” - এর নিচের কথাগুলোই যথেষ্ট। তিনি লিখেছেন,
“..নতুন রাষ্ট্র পাওয়া মাত্র পুরো স্বৈরাচারি কায়দায় নিজের (জিন্নাহর) খেয়াল-খুশিমতো করাচিকে পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। (পরবর্তীকালে এই ধারা অনুসরণ করেন জেনারেল আইয়ুব খান, তিনি নিজ প্রদেশের দুটি শহরে - প্রথমে রাওয়ালপিন্ডিতে, পরে ইসলামাবাদে দুবার রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন।)”
অথচ,
“..দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বসবাস পূর্ব পাকিস্তান, আবার সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে ঢাকাই সবচেয়ে বনেদি, বড় ও জনবহুল শহর, বিধায় ঢাকাকেই পাকিস্তানের রাজধানী করা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু অপরাষ্ট্র পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে না ছিল যুক্তিবোধ, না ছিল গণতান্ত্রিক মানসিকতা।”
আর ভাষার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন,
..প্রাদেশিক ভাষাগুলো হলো যথাক্রমে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচি, পশতু এবং বাংলা।..অথচ রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নে উর্দু নিয়েই শুরু হলো টানাটানি যা মূলত পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই ভাষা নয়।
ব্যাপারটা হাস্যকর তো বটেই। তবে হাস্যকর ব্যাপার কি শুধু এই একটাই? না। তিনি তাই লিখেছেন,
“..হাস্যকর ব্যাপার এই যে, জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহকে একই সাথে বলা হতো ‘মাদারে মিল্লাত’ বা ‘পাকিস্তানের মাতা’; ভাই-বোন কী করে একই জাতির পিতামাতা হয় - ব্যাপারটা খুব গোলমেলে বৈকি।”
কেন এমমনটা হয়েছিলো? এ প্রশ্নের জবাবও তিনি দিয়েছেন তার লেখাতে,
 “বস্তুত পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটি, যার জন্ম হয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে - বাস্তবে ওই রাষ্ট্রের আপাদমস্তকে ধর্মের কোনো ছোঁয়াও ছিল না। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা- জিন্নাহ, লিয়াকত আলী, নাজিমউদ্দীন- সবাই ছিলেন অসৎ, অধার্মিক, ক্ষমতালোভী, প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রে সিদ্ধহস্ত। জিন্নাহর মৃত্যুর পর ( সেপ্টেম্বর ১৯৪৮; ১৯৪৬ সালের মে মাসে ডাক্তার পটেলের চিকিৎসায় প্রথম ধরা পড়ে যে, জিন্নাহ ভয়াবহ য²ারোগে আক্রান্ত হয়ে সঙ্গিন অবস্থায় আছেন। এ খবরটি জানাজানি হয়ে গেলে কংগ্রেস বা মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেন - এই আশঙ্কায় জিন্নাহর ইচ্ছে অনুসারে খবরটি চেপে রাখা হয়েছিল (ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, পৃ. ১৩০), নতুন গভর্ণর জেনারল হন নাজিমউদ্দীন। এর এক বছর পরে (অক্টোবর’ ৪৯) লিয়াকত আলী খান নিহত হওয়ার পর নাজিমউদ্দীন ফিরলেন প্রধানমন্ত্রীর পদে, আর গভর্ণর জেনারেল পদে নিযুক্তি পান গোলাম মোহাম্মদ। কিন্তু ‘অতি পাকিস্তানি’ সেজেও নাজিমউদ্দীন তার পদ ধরে রাখতে পারলেন না। ১৮ এপ্রিল ’৫৩ তিনি ওই পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের নেতৃত্বে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি পান বগুড়ার মোহাম্মদ আলী।”
তার এই মতামতের সমর্থণ পাওয়া যায়, মজিবর রহমান - এর “মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ ও রাজনীতি” নামক গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন,
“জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান রাজনীতির মূল অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়, ‘কথায় কথায় ভারত বিরোধিতা’ আর ‘ইসলাম গেল, ইসলাম গেল’ বলে ভিত্তিবর্জিত উচ্চরব। এটা অবশ্য রাজনীতির বাইরের দিক, ভেতরের দিকটা আরো ভয়াবহ। কে কাকে ল্যাং মেরে গর্তে ফেলবে, কে কাকে উৎখাত করে ক্ষমতার চেয়ারে অধিষ্ঠিত হবে, সামরিক বাহিনীর সাথে কীভাবে সখ্য গড়া যাবে- এই ছিল রাজনীতিকদের মূল ভাবনা। সে সময়কার পাকিস্তানি রাজনীতির অস্থিতিশীলতা- তা বোঝা যাবে নি¤েœাক্ত পরিসংখ্যানে। ‘পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রিসভার আয়ুষ্কাল ছিল চার বছর, ১৫.৮.১৯৪৭ থেকে ১৮.৮.১৯৫১ পর্যন্ত।.. প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয় ১৯.১০.১৯৫১ তে, টিকে থাকে দুই বছরেরও কম সময়, ১৭.৪.১৯৫৩ পর্যন্ত। পরবর্তী দেড় বছর অর্থাৎ ১৭.৪.১৯৫৩ হতে ২৪.১০.১৯৫৪ পর্যন্ত কার্যকর থাকে প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর অধীন তৃতীয় মন্ত্রিপরিষদ। পরবর্তীতে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভা পুনগঠিত হয়ে টিকে থাকে এক বছরেরও কম সময় ১.৮.১৯৫৫ পর্যন্ত। পঞ্চম মন্ত্রিসভাটি গঠিত হয় চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে। তার আয়ুষ্কাল মাত্র এক বছর, ১১.৮.১৯৫৫ থেকে ১২.৯.১৯৫৬ পর্যন্ত। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বে গঠিত ষষ্ঠ মন্ত্রিপরিষদের মেয়াদকাল ১২.৯.১৯৫৬ থেকে ১৮.১০.১৯৫৭ পর্যন্ত, এক বছর। সপ্তম মন্ত্রিপরিষদের প্রধানমন্ত্রী হন আই. আই. চুন্ড্রিগর। সেটিও একবছর পার করে আর বেশি দূর এগোতে পারেনি, ১৬.১২.১৯৫৭-তেই ভেঙে পড়ে। বেসামরিক মন্ত্রিসভার শেষ প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নুন। তাঁর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ টিকে থাকে এক বছরেরও কম সময়, ১৬.১২.১৯৫৭ থেকে ৭.১০.১৮৫৮ পর্যন্ত।”
এ দাবীকে সমর্থন করে তিনি ড. মো. মাহবুবুর রহমান - এর “বাংলাদেশের ইতিহাস”গ্রন্থ থেকে আরও যোগ করেছেন,
“পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল বা প্রেসিডেন্ট পদের দখল নিয়ে বারবার হয়েছে অন্তহীন ষড়যন্ত্র আর অভ্যুত্থান। ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছে ছিল, দেশ বিভাগের পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন অন্তবর্তীকালের জন্য ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের গভর্ণর জেনারেলের পদে থেকে যাবেন। ভারত এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল, বাস্তবায়নও করেছিল; কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক জিন্নাহ ব্রিটিশ প্রস্তাব মেনে নেননি, পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মলাভের পরপরই তিনি হন নতুন রাষ্ট্রের গভর্ণর জেনারেল এবং দেশের রাজনৈতিক-শাসনতান্ত্রিক-সাংবিধানিক সকল ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। জিন্নাহর মৃত্যুর পর গভর্ণর জেনারেল হন নাজিমউদ্দীন, এর এক বছর পর গভর্ণর জেনারেল পদে নিযুক্তি পান গোলাম মোহাম্মদ (লিয়াকত আলী খান নিহত হওয়ার পর নাজিমউদ্দীন ফিরে পান প্রধানমন্ত্রীর পদে), এরপর ১৯৫৫ সালের ৫ আগস্ট, গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ বিদায় নেয়ার পর উক্ত পদে অধিষ্ঠিত হন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা। তিনি নতুন সংবিধানের আওতায় গভর্ণর জেনারেল পদবি পরিবর্তন করে সৃষ্টি করেন ‘প্রেসিডিন্ট’ পদ এবং নিজেই হন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। ইস্কান্দার মীর্জা পদচ্যুত জন আইয়ুব খান কর্তৃক ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ এবং দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর আইয়ুবকে সরিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়ার আগমন (২৬ মার্চ ১৯৬৯) আর ইয়াহিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে (২০ ডিসেম্বর’ ৭১) সামরিক বাহিনীর বেশ ক’জন কর্মকর্তা মিলে এবং তারা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বসায় প্রেসিডেন্টের পদে। সেই ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জিয়াউল হক.....।
গভর্ণর জেনারেল আর প্রধানমন্ত্রী, এ দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় পদ। তবে ওই দুটো পদ নিয়ে যত ষড়যন্ত্র হয়েছে, এর চেয়ে অনেক বেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের ‘মুখ্যমন্ত্র’র পদটি নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন (১৪.০৮.১৯৪৭-১১.০৯.১৯৪৮), দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন (১২.০৯.১৯৪৮-০২.০৪.১৯৫৪)। ’৫৪-এর নির্বাচনে এ কে ফজলুল হক বিজয়ী হয়ে শপথ গ্রহণের পর এক মাস সাতাশ দিনের মাথায় (৩০ মে ১৯৫৪) পদচ্যুত হন; এরপর তাঁরই অনুগত আবু হোসেন সরকার শপথ নেন ৫ জুন, ১৯৫৫ (মাঝখানের সময়টুকুতে ইস্কান্দার মীর্জা কর্তৃক গভর্ণরের শাসন চালু ছিল)। আওয়ামী লীগের অনাস্থা প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ৩০ আগস্ট ’৫৬-তে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আবু হোসেন সরকার। এরপর ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে বরখাস্ত করে (৩০ মার্চ’ ৫৮) আবু হোসেন সরকারকেও আবারও ওই পদে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ২২ জুন অনাস্থা ভোটে হেরে আবু হোসেন ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ২২ জুলাই আবারও মুখ্যমন্ত্রী পদে ফিরে আসেন আতাউর রহমান খান। বস্তুত কেন্দ্রের শাসন নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনায় সোহরাওয়ার্দী বা ফজলুল হক- দুজনেরই ভূমিকা ছিল সীমিত। কিন্তু তাঁরা যখনই কেন্দ্রীয় কোনো পদ বা প্রাদেশিক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তখন ক্ষমতাপ্রাপ্তির ভয়ানক কুপ্রভাব পড়েছে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে। তাঁদের দুজনের ‘ক্ষমতা-লড়াই’ এর বারবার বলি হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ, ফজলুল হকের আনুকুল্য পেয়েছেন আবু হোসেন সরকার আর আতাউর রহমান খান পেয়েছেন সোহরাওয়ার্দীর আনুকুল্য। ওই দুই নেতার আনুকুল্য বা বিরাগের প্রভাবে সরকার ও খান সাহেবরা ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হিসেবে বারবার শপথ নিয়েছেন এবং বারবার পদচ্যুত হয়েছেন।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে ব্যক্তিপরিবর্তন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফ্রেডরিক বোর্ন (১৯৪৭-১৯৫০), ফিরোজ খান নুন (১৯৫০-১৯৫৩), চৌধুরী খালিকুজ্জামান (১৯৫৩-১৯৫৪)। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা (১৭.৫.১৯৫৪-২৫.১০.১৯৫৪), জাস্টিস টমাস ইলিস (২৫.১০.১৯৫৪-২২.১২.১৯৫৪), এরপর বিচারপতি শাহাবউদ্দীন (২৩.১২.১৯৫৪-?), বিচারপতি আমির উদ্দীনর (?-০৪.০৩.১৯৫৬)। এ কে ফজলুল হক (০৫.০৩.১৯৫৬-০১.০৪.১৯৫৮), আব্দুল হামিদ (০১.০৪.১৯৫৮-০৩.০৫.১৯৫৮), সুলতান উদ্দিন আহমেদ (০৩.০৫.১৯৫৮-১১.১০.১৯৫৮), এরপর সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তা জাকির হোসেন (১৩.১০.১৯৫৮-১৪.০৪.১৯৬০), আজম খান (১৫.০৪.১৯৬০-১০.০৫.১৯৬২), গোলাম ফারুক (১১.০৫.১৯৬২-২৭.১০.১৯৬২), আবদুল মোমেন খান (২৮.১০.১৯৬২-২২.০৩.১৯৬৯), এম.এন.হুদা (২৩.০৩.১৯৬৯-২৫.০৩.১৯৬৯), রিয়াল এডমিরাল এস এম আহসান (২৬.০৩.১৯৬৯-০১.০৩.১৯৭১), লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান (০১.০৩.১৯৭১-০৬.০৩.১৯৭১), টিক্কা খান (০৭.০৩.১৯৭১-) ।”
মূলতঃ কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায়ই অর্থাৎ ছাত্রাবস্থায় তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। অতঃপর দেশ ভাগের পর চলে এলেন পূর্ব বাংলায়। গঠন করলেন ছাত্রলীগ। আরও পরে আওয়ামী লীগ। ভাষার প্রশ্নে তখন মাঠ উত্তপ্ত। তিনিও জড়িয়ে পড়লেন। দেশ ভাগের পর অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার জন্যে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতির কারণে কর্তৃপক্ষের রোষাণলে পড়ে ছাত্রত্ব হারালেন। বায়ান্নতে যখন ভাষার জন্যে তুমুল সংগ্রাম চলছে তাকে বন্দী করে রাখা হলো কারাগারে। সেখানে বসেই ভাষা সংগ্রামীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্যে অনশন করলেন। বের হলেন ২১শে ফেব্রæয়ারীরও বেশ কয়েকদিন পর। ১৯৫২র ২২শে ফেব্রæয়ারী। ১৯৫৪ তে এসে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে তার রাজনৈতিক ক্যারিশমায় মহান বিজয়ে রূপদান করলেন। আওয়ামী লীগকে তুলে আনলেন সবার উপরে। আওয়ামী লীগ একাই লাভ করেছিলো ১৪৩টি আসন। তার আগেই ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতাটা খুব একটা সুখকর ছিলো না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দের ভুলে সব মাটি হয়ে যায়। শপথ নেয়ার পর মাত্র ১৫ দিনের মাথায়ই এক অন্যায় আদেশ বলে জারি হয় গভর্ণরের শাসন। অবশ্য তাও যে স্থায়ী হয়েছিলো তা কিন্তু নয়। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় গভর্ণরের শাসন উঠে গেলে আবারও প্রধানমন্ত্রীর শাসন কায়েম হয়। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়েও টিকতে পারেননি হক সাহেব কিন্তু এবারও তার কৃষক-শ্রমিক পার্টিকেই সরকার বানাতে বলা হয়। যেহেতু কেন্দ্র তাকে “দেশদ্রোহী” অ্যাখ্যা দিয়েছিলো তাই তাকে না দিয়ে ক্ষমতা দেওয়া হয় তার প্রতিনিধি মিঃ আবু হোসেন সরকারকে। এখানে বলে রাখতে চাই যুক্তফ্রন্টের শরীকদলগুলোর মধ্যে এককভাবে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যাই বেশী ছিলো (১৪৩)। কিন্তু নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী হক সাহেবেরই নেতা হওয়ার কথা থাকায় তার দল কৃষক-শ্রমিক পার্টির আসন সংখ্যা (৪৮) কম হওয়া সত্তে¡ও তাকেই প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়েছিলো।

আবু হোসেন সরকারও বেশী দিন চালাতে পারেননি। টেনেটুনে বছর খানেক চলেছিলো। তারপরই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে। আতাউর রহমান খনের সরকারও সংসদে আস্থা ভোটে হেরে যায়। কারণ কৃষক-শ্রমিক পার্টির সাথে তাদের যে এ্যারেঞ্জমেন্ট হওয়ার কথা ছিলো তা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়। আর আওয়ামী লীগের আর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ন্যাপ ছিল দোটানার মধ্যে। তখন গভর্ণর ছিলেন শেরে বাংলা। তার প্রভাবে আবু হোসেন সরকার সরকার গঠন করেন। কিন্তু এ সরকারও মাত্র কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হয়। কারণ তখন কেন্দ্রের মন্ত্রী ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনকে বলে শেরে বাংলাকে গভর্ণরের পদ থেকে সরিয়ে দেন। এমতাবস্থায় যে অচলাবস্থা দেখা দেয় তার নিরসনের জন্যে কেন্দ্র উপয়ান্তর না দেখে আবারও আতাউর রহমান খানকে প্রধানমন্ত্রী হতে বলে।  
এ যাত্রা রাজনীতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। সংসদ অধিবেশন চলাকালে বিবোধীদের আক্রমণে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পরের দিন মারা গেলে পরিস্থিতির সুযোগ নেয় কেন্দ্র। গভর্ণর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারী করেন। আইয়ুব খান হন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এসময় কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ফিরোজ খান নুন। যিনি ১৯৫৯ সালে সাধারণ নির্বাচন হবে এই মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই ১৯৫৮ সালে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। মাত্র ২০ দিনের মাথায় আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে অপসারণ করে নিজে পাকিস্তানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে পাকিস্তান প্রবেশ করে সামরিক ব্যবস্থায়। অজুহাত হিসেবে বলা হয় যেহেতু সামনে নির্বাচন অথচ সংসদে ডেপুটি স্পিকারকে মেরে ফেলা হয়েছে এমতাবস্থায় রাজনীতিবিদদের অধীনে নির্বাচন হলে গন্ডগোল ও প্রাণহানি হবে।
পুরো বিষয়টা অত্যন্ত চমৎকারভাবে উঠে এসেছে বিনয় মিত্রের  “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : সত্য অসত্য অর্ধসত্য” গ্রন্থে,
“১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চে গৃহীত শাসনতন্ত্র অনুযায়ী পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে। পরে তা পিছিয়ে নেয়া হলো ১৯৫৮ সালে; কিন্তু না, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো না। বলা ভালো, গভর্ণর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা এবং সেনাপ্রধান আইয়ুব খান- ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দিলেন না। কারণ, ওই শাসনতন্ত্রের বিধি মোতাবেক গভর্ণর জেনারেলের পদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কাজেই ইস্কান্দার মীর্জা যদি রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ পদ- প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসীন হতে চান, তাহলে অবশ্যই তাকে নির্বাচনে জিতে আসতে হবে। কিন্তু নির্বাচনে যেতে ইস্কান্দার মীর্জা একদমই নারাজ; তাহলে রাষ্ট্রীয় শীর্ষপদ কবজায় রাখার উপায় কি? আইয়ুব-ইস্কান্দার মিলে উপায় একটা বের করলেন, সে উপায়ের নাম- ষড়যন্ত্র। দেশে এমন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যাতে নির্বাচন ঠেকিয়ে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, ইস্কান্দার মীর্জা যার সহায়তায় প্রেসিডেন্ট পদে স্থায়ী হতে যাচ্ছেন, সেই আইয়ুবের চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষ। কাজেই নিজের প্রয়োজনেই ইস্কান্দার মীর্জা (জুলাই ’৫৮) তার সহযোগী ও সেনাপতি আইয়ুব খানের চাকরিকাল আরো দু’বছর বাড়িয়ে দিলেন (এর আগে ’৫৬-তে আইয়ুবের চাকরিকাল দু’বছর বাড়ানো হয়েছিল)। ৭ অক্টোবর ’৫৮ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বানিয়ে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করলেন ইস্কান্দার মীর্জা। সেই সাথে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মন্ত্রিসভাও বাতিল করা হলো। কিন্তু যে আইনের ওপর ভর করে ইস্কান্দার মীর্জা প্রেসিডেন্ট হয়ে সামরিক শাসন জারি করলেন, সেই আইন (’৫৬-এর শাসনতন্ত্র) বাতিল করে দেয়ায় তিনি নতুন পদে থাকার আইনি অধিকার হারিয়ে ফেললেন, ফলে নিজের তৈরি করা ফাঁদে আটকে গেলেন ইস্কান্দার মীর্জা এবং নতুন দৃশ্যপটে নতুনভাবে হাজির হন জেনারেল (পরবর্তী পর্যায়ে নিজেই’ নিজেকে পদোন্নতি দিয়ে ফিল্ড মার্শাল পদবি গ্রহণ করেন) মোহাম্মদ আইয়ুব খান। ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মীর্জাকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। নতুন শাসনতন্ত্র এবং ঘোষিতব্য নির্বাচন সম্পর্কে জাতির কাছে ব্যাখ্যা দিলেন, ‘দেশ যা পেল তা কোন শাসনতন্ত্র নয়.... একটি হতাশাপীড়িত দলিল, একটি জগাখিচুড়ি....... একজন সৈনিকের অবস্থান থেকে আমার কাছে এ-কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাধারণ নির্বাচনে দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে। দেশজুড়ে ব্যাপক অরাজকতা দেখা দেবে....।’  (ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস, পৃ. ৫৪)।”
আইয়ুব খান কঠোর হস্তে রাজনীতিবিদদের দমন করেন। ১৯৬২ সালের গণ আন্দোলনের আগ পর্যন্ত কেউ টু-শব্দটি করতে পারলো না। অধিকাংশ নেতাই জেলে পড়ে রইল। যারা বাইরে ছিলো তাদেরও নানা অজুহাতে রাজনীতির অযোগ্য ঘোষণা করা হলো। কিন্তু এসব খেলা খেলতে খেলতে তিনি নিজেও অনেক ভুল করে বসলেন। বিনয় মিত্র লিখছেন,
“ক্ষমতার কেন্দ্রে অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাওয়ার পর সকল স্বৈরশাসক যেমন বিবেচনাবর্জিত ভুল পদক্ষেপ নিতে থাকেন, আইয়ুব তা-ই করলেন; জম্মু ও কাশ্মীর দখল করতে গিয়ে পরাজয়ের কালিমা গায়ে মাখলেন, শেখ মুজিব উত্থাপিত ছয় দফাকে অস্ত্রের ভাষায় পরাজিত করতে গিয়ে কোটি কোটি জনগণের চোখে ‘শত্রæ’ হিসেবে বিবেচিত হলেন এবং ইয়াহিয়া ও ভুট্টো যে দুজনকে তিনি খুবই বিশ্বাস করতেন, বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতেন- অবশেষে তাদেরই বিশ্বাসঘাতকতার ছুরিতে বিদ্ধ হয়েছেন এক সময়ের প্রবল পরাক্রমশালী শাসক- আইয়ুব খান।”

আরও একটা ভুল তিনি করলেন। বাংলার কৃষকের ঘরের সন্তান শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা পরিমাপ করতে ভুল করলেন তিনি। অবহেলা করলেন ছয় দফাকে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ -এর সাক্ষাৎকার থেকেও এর প্রমান মেলে,
“৬ দফা পরিকল্পনা পেশের সময় শেখ মুজিব তাঁকে এবং রুহুল কুদ্দুসকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আসলে এটা ৬ দফা নয়- এক দফাই, ঘুরিয়ে বললাম শুধু।...’৪৭ সালে কলকাতা থেকে এসেই শেখ মুজিব ‘পাঞ্জাবি খেদাও’... এর  ডাক দিয়েছিলেন। তিনি এটা প্রকাশ্যেই করতেন। মুজিব যা বিশ্বাস করতেন, তা অবশ্যই করে ছাড়তেন, তখনো নানা কৌশল করতেন; কিন্তু কাজটা তিনি ঠিকই করে ছাড়তেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদে মোজাফ্ফর আহমদ কর্তৃক উত্থাপিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্তে¡ও মুজিব তা প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন।”
বিনয় মিত্র আরও লিখছেন,
“বাস্তবিকপক্ষে, শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সমকালীন নেতৃবৃন্দ অপেক্ষা অনেক বেশি প্রাগ্রসর, দৃঢ়চিত্ত এবং স্বাধীনচেতা ছিলেন। নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ যখন গা বাঁচিয়ে চলতেন, স্পষ্টভাষী এবং প্রত্যায়ী শেখ মুজিবের সাথে তাঁদের তখন মতপার্থক্য দেখা দিত। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের তথ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা শামসুজ্জামান চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ১৯৬৬ সালে করাচিতে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করার সুযোগ না পেয়ে, ঢাকায় ফিরে এসে তিনি তাঁর বাসভবনে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে ডেকে পাঠান (১৩ এপ্রিল) এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এদের অধিকাংশই মুসলিম লীগ থেকে এসেছে-হতাশ হয়ে, সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে। তাদের দিয়ে ৬ দফার আদর্শ বাস্তবায়ন করা যাবে না। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের একটা বড় অংশ পাকিস্তানপন্থি বলে শেখ মুজিব এদিন তাঁর সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দখল করার জন্য ছাত্রলীগের তরুন নেতাদের নির্দেশ দেন এবং ৬ দফার ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে বলেন।’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃ. ১৩৩)। ৮ মে, নারায়ণগঞ্জ থেকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিধি ৩২ (১) ক ধারায় শেখ মুজিব, তাজউদ্দীনসহ বেশ ক’জন আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নেতৃবৃন্দের মুুক্তির দাবিতে তাঁদের অনুসারীরা ৭ জুন সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ওই ধর্মঘট বানচাল করার জন্য আইয়ুবি গুÐাবাহিনী ও পুলিশি হামলায় কমপক্ষে ১০ জন নিহত হন। শত নির্যাতনের মুখেও শেখ মুজিব নির্দেশিত ছয় দফার প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখা হয় এবং এ দাবির গ্রহনযোগ্যতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।”
ভুল যে শুধু আইয়ুব খান একাই করেছিলেন তা কিন্তু নয়। তার চারপাশে যারা ছিলো তারাও কম যাননি। বিনয় মিত্র লিখছেন,
“ এদিকে ২০ জুন ’৬৭ রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সংসদ চলাকালীন সরকারদলীয় নেতা খান আবদুর সবুর খান পুরনো বিতর্ককে নতুন করে টেনে আনেন। তিনি বলেন, ইদানিং পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের অশুভ তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পহেলা বৈশাখ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের নামে বিদেশি সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করে ইসলামী জীবনাদর্শের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের মুলে আঘাত হানছে। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূধন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বাঙালি মনীষীকে  ‘চক্রান্তকারী’ হিসেবে অভিহিত করেন। ২২ জুন সংসদ সদস্য ড. আলীম আল রাজীর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দীন জানান, ‘রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচার যথাসম্ভব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁর যে রচনা পাকিস্তানি আদর্শের পরিপন্থী বিবেচিত হবে, সেগুলোর প্রচার ভবিষ্যতে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হবে’ (পাকিস্তানি জাতীয় সংসদের রিপোর্ট, ১৯৬৭, পৃ. ১৯৪০)। পাকিস্তানের কয়েকজন মাওলানা এক বিবৃতিতে (৩০ জুন ’৬৭) বলেন,‘পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন হইতেই এই সকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও-টেলিভিশনকে পবিত্র রাখা প্রয়োজন ছিল।’ (দৈনিক আজাদ, ১ জুলাই ’৬৭)। রবীন্দ্র-বিষয়ে ওইসব নোংরা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে তখন বিবৃতি দিয়েছিলেন আবুল মনসুর আহমদ, ইবারাহিম খাঁ, তালিম হোসেন, ফররুখ আহমদ, মুজিবুর রহমান খান প্রমুখ সাহিত্যিক। আর এসব অপপ্রচারের বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন ড. কুদরত-ই-খূদা, জয়নুল আবেদীন, অধ্যাপক আবদুল হাই, হাসান হাফিজুর রহমান, মুনীর চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, সুফিয়া কামাল, শামসুর রহমান, ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ প্রগতিশীল লেখক ও চিন্তাবিদ। বস্তুত সংস্কৃতসেবীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দীন তার রবীন্দ্র-বিরোধী বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন (৪ জুলাই’ ৬৭)।”
এসব ভুল আর অদূরদর্র্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের বারোটা বাজিয়েছিলো। বিনয় মিত্র লিখছেন,
“আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের গোপন বিচার প্রক্রিয়া, বাঙালি জাতিকে নিরন্তর নির্যাতন-শোষণ, বেতার ও টিভিতে কড়াকড়িভাবে রবীন্দ্রবর্জন, বাংলা ভাষা-সংস্কারে তথাকথিত সরকারি উদ্যোগে ইত্যাদি অপচেষ্টা পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজকে অভিন্ন বিন্দুতে নিয়ে আসে। আন্দোলনের মত ও পথ ভুলে গোটা ছাত্রসমাজ শেখ মুজিব কর্তৃক ইতঃপূর্বে উত্থাপিত ছয় দফাতে যোজন-বিয়োজন ঘটিয়ে ১১ দফা দাবি পেশ করে। ওই ১১ দফাভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের একপর্যায়ে ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শাহাদাতবরণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদুজ্জামান। আসাদের মৃত্যুসংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, শহর থেকে গ্রামান্তরে। ছাত্র-জনতা জাগতে শুরু করে অবিনাশী চেতনায়।”
অবশেষে ’৬২র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪র গণ আন্দোলন, ’৬৬তে এসে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান আইয়ুব খানের অবস্থানকে নড়বড়ে করে দেয়। অবশ্য ততদিনে স্বৈরশাসক তার তথাকথিত উন্নয়নের দশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান পালন করে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে গেলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেকসুর খালাস পাওয়ায় জাতিও শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু খেতাব দেয়।
এখানেই শেষ নয়। শেখ মুজিবের সাফল্যের পেছনে তার আরও অনেক ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ছিলো যা তাকে সবার থেকে আলাদা করেছিলো। বিনয় মিত্র লিখেছেন,
“রাজনীতির ক্ষেত্রে সোহরাওয়ার্দীকে শুরু মানতেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানপন্থি, ক্ষমতালোভী সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক গৃহীত অনেক পদক্ষেপ শেখ মুজিবের মনঃপুত হয়নি, তবু তিনি নীরবে মেনে নিয়েছেন, গুরুর বিরুদ্ধে যাননি। আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল ধারাটি ভাসানীর নেতৃত্বে ’৫৭ সালে ন্যাপ গঠন করল, চিন্তায় মননে প্রগতিশীল হয়েও বঙ্গবন্ধু এ অংশের সাথে যাননি, তিনি থেকেছেন গুরু সোহরাওয়ার্দীর সাথেই। পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুবের আবির্ভাবের পর, সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুরের গোপন-নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে, মূলত ১৯৬১ সালের পর থেকে; তখণ থেকে শেখ মুজিবের রাষ্ট্রনৈতিক প্রগতিচেতনার মধ্যে জোর প্রভাব ফেলে রাজনীতির ‘বামদর্শন’ এবং এ দর্শনের সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাই সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু (৫ ডিসেম্বর ’৬৩) পরবর্তী শেখ মুজিবের রাজনীতিতে।”
আনুগত্যের কথা যদি বলি তৎকালীন অন্য নেতাদের সাথে তুলনা করলেই বোঝা যাবে শেখ মুজিব কেন অন্যের থেকে আলাদা ছিলেন। মাসুদুল হক তার “বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙন” গ্রন্থে লিখেছেন,
“১৯৬৫ সালে, ভুট্টো তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আইয়ুবের হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। ওই যুদ্ধে পাকিস্তান এমনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল যে, তাদের লাহোর শহরটি ভারতের দখলে যায় যায় অবস্থা। বিপদ বুঝতে পেরে ুরশ নেতা কোসিগিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মানতে সম্মত হন আইয়ুব। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ৪ জানুয়ারি ’৬৬ ‘তাসখন্দ’- এ বিস্তারিত আলোচনার প্রেক্ষিতে দুই প্রতিপক্ষ এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। ভারতের দাবি অনুযায়ী ওই আলোচ্যসূচিতে ‘কাশ্মীর’ প্রসঙ্গ রাখা হয়নি। কিন্তু যুদ্ধ-ক্ষতিগ্রস্থ আইয়ুব, নিজের জনগণকে ‘বুঝ’ দেয়ার জন্য আলোচ্যসূচিতে যাতে ‘কাশ্মীর’কে রাখা হয়, এ ব্যাপারে সোভিয়েত নেতৃত্বকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোকে মস্কো প্রেরণ করেন। আইয়ুবের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার অপেক্ষায় থাকা ভুট্টো মস্কোতে গেলেন, কিন্তু ‘কাশ্মীর’ প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলেই ফিরে গেলেন ইসলামাবাদে এবং প্রেসিডেন্টকে মিথ্যে বললেন, ‘আলোচনা চমৎকার হয়েছে।’ নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ৪ জানুয়ারি তাসখন্দে গিয়ে আইয়ুব বুঝতে পারেন যে, ভুট্টো তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। কিন্তু তখন কিচ্ছু করার উপায় নেই, যেন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন- এমন একটা দলিলে সই করতে বাধ্য হন আইয়ুব।
পাকিস্তানের জন্য লজ্জাকর এই চুক্তির খবর জানাজানি হতে দেরি হলো না। দেশে ফিরে আইয়ুব দেখতে পেলেন ওই তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে হাজার হাজার ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে এসেছে। এর ক’দিন পর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যেন বোমা ফাটালেন ভুট্টো। তাসখন্দ চুক্তির সমালোচনায় উচ্চকন্ঠ হয়ে উঠলেন। পাকিস্তানি জনগণ ভুট্টোর কথায় চমকে যায়। দেশের স্বার্থরক্ষার বিষয় নিয়ে একজন প্রভাবশালী প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে সরব হয়েছেন একজন মন্ত্রী; তার সাহস আছে বটে, সেই সাথে মোহবিস্তারী জ্যোতিষ্কে পরিণত হন ভুট্টো। মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন, দল গড়লেন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসীন হলেন। এরপর অনেক ঘটনা-উপঘটনার মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া-হামিদ-পীরজাদার সহায়তায় ভুট্টো তার মনের আশা পূরণ করতে সক্ষম হন, ২৪ মার্চ ’৬৯ আইয়ুবের পতনের মধ্য দিয়ে।
২৯ জানুয়ারি ’৬৮ আইয়ুব খান হৃদরোগে আক্রান্ত হন। খবরটি পাওয়া মাত্রই সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। প্রেসিডেন্টকে সুস্থ করে তোলার নাম করে ইয়াহিয়া তখন কোনো মন্ত্রী বা অন্য কোনো কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্টের ধারে-কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। ছ’ সপ্তাহ পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সুস্থ হয়ে উঠলেন, কিন্তু ততদিনে ইয়াহিয়া ক্ষমতার স্বাদটুকু বুঝে গেছেন, ফলে ক্ষমতার সবটুকু নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিলেন না আইয়ুবের কাছে। ইতোমধ্যে ক্ষমতালোভী বেশ ক’জন জেনারেল- হামিদ, গুল হাসান, পীরজাদা, ওমর এবং  হঠাৎ আইয়ুববিদ্বেষী বনে যাওয়া রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখ এসে ভিড় করলেন ইয়াহিয়ার পাশে। আইয়ুব জানতেই পারলেন না, তখন তার সন্তানতুল্য ইয়াহিয়া ক্ষমতালিপ্সায় আক্রান্ত হয়ে পিতার বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়তে শুরু করেছেন। পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে ইয়াহিয়ার বোধহয় চক্ষুলজ্জা একটু বেশিই ছিল, তা-ই হুট করে তিনি আইয়ুবকে ক্ষমতার চেয়ার থেকে ফেলে দিলেন না, সবই করেছেন ধীরে ধীরে, পরিকল্পনামতো, আর এক চূড়ান্তরূপ প্রকাশ পায় ২৪ মার্চ ’৬৯; ওইদিন পাকিস্তানের নতুন সামরিক শাসক হয়ে আবির্ভূত হন ইয়াহিয়া খান। ”
ইয়াহিয়া খানের চারিত্রিক-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রবার্ট পেইন তার “বাংলাদেশ- গণহত্যার ইতিহাসে ভয়ঙ্কর অধ্যায়” গ্রন্থে লিখেছেন, “নারীতে আসক্তি ছিল ইয়াহিয়া খানের। প্রায়ই নাইট ক্লাবে তার সাথে দেখা যেত জনচারেক মেয়েকে। সরকারি তহবিল থেকে টাকা-পয়সা নেয়ার ব্যাপারে তার জুড়ি ছিল না। শুধু নারী আসক্তি নয়, প্রচÐ মদখোরও ছিলেন ইয়াহিয়া খান। ব্যবহারে ভদ্রতা শব্দটি সম্ভবত তার অভিধানে ছিল না। রেডিও-টিভিতে তার ভাষণগুলো বেরিয়ে আসত ভাবলেশহীন কাটা কাটা শব্দ হিসেবেই। আবরণ দিয়ে ভান করেও ইয়াহিয়া খান তার বর্বরতাকে ঢাকতে পারেননি। কথাবার্তা মেধা মননে ইয়াহিয়া খানের সাধারণ যোগ্যতাও ছিল না। দেশের সার্বিক সামাজিক-রাজনীতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে তার অজ্ঞতা ছিল পাহাড়প্রমাণ। নিছক সৈনিক হিসেবেই বেড়ে ওঠে ইয়াহিয়া খানের জীবন। ক্ষমতা, সম্পদ, নারীসঙ্গ খুব চমৎকার উপভোগ করতেন ইয়াহিয়া খান। নিজে মদ খেতে পছন্দ তো করতেনই, আনন্দ পেতেন মদ খাইয়েও। বর্তমান যুগে এ ধরনের শাসক কীভাবে টিকে আছে সেটা ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার।”
সত্য, ন্যায় আর ন্যায্য দাবীর ক্ষেত্রে মুজিব ছিলেন অনমনীয়তার পাশাপাশি বিবেচকও। জি ডবিøউ চৌধুরীর “যুক্ত পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, “৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করে ইয়াহিয়া খান অনুরোধ করেছিলেন, পরদিনের জনসভায় তিনি যেন কঠোর কোনো কর্মসূচি না দেন। আবার ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোশেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে বলেন, কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন মার্কিন সরকার সমর্থন করে না, তাই এরকম আন্দোলনের সৃষ্টি হলে মার্কিন তরফ থেকে সহায়তা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”
কিন্তু মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণে তার কালজয়ী দিক-নির্দেশনাগুলো অমর হয়ে আছে।
দুটো বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। একটা ভাষা। অন্যটা অর্থনৈতিক বৈষম্য। ভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে “মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর : একটি নির্দলীয় ইতিহাস” গ্রন্থে গোলাম মুরশিদ লিখেছেন,
“বঙ্গদেশে মুসলমানদের শাসন আরম্ভ হয় ১২০৪ সালে। তখন থেকে এ দেশে বেশ জোরে শোরে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয় এবং দেশীয় লোকেদের মধ্যে অনেকেই এ ধর্ম গ্রহণ করেন। শিক্ষিত লোক তখন ছিলেন খুবই কম। কাজেই সবাই যে মুসলমান হয়ে সুরা-কালাম শিখে ইসলাম ধর্মের আচার অনুষ্ঠান ঠিকমতো পালন করতেন, তা নয়। বরং মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, দেশীয়রা নামে মাত্র মুসলমান ছিলেন। মুসলমান হয়েও আসলে পালন করতেন পূর্বপুরুষদের আচার-অনুষ্ঠান। বাংলায় কথা বলতেন এবং পুর্বপুরুষদের পেশা নিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন। নিজেরা আরব-ইরান থেকে এসেছেন, এ কথা চিন্তাও করতেন না। কিন্তু উনিশ শতকে এই চিন্তায় পরিবর্তন এলো যখন তাঁদের মধ্যে সামান্য পরিমাণে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়লো। তখন শিক্ষিত মুসলমানরা নিজেদের পরিচয় কী, সে বিষয়ে সচেতন হলেন।”
তেমনি বৈষম্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি তার একই গ্রন্থে রেহমান সোবহানের প্রদত্ত তথ্য উল্লেখ করে বলেছেন,
“রেহমান সোবহান তাঁর গ্রন্থে এই বৈষম্যের পরিমাপ কেমন ছিলো, তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাতে দেখা যয়, ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো শতকরা মাত্র ২৩ ভাগ। এ সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয় ৬২ বিলিয়ন টাকা। অপরপক্ষে, পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো ৩০ বিলিয়ন টাকা। এ ছাড়া ৪৯-৫০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় ছিলো যথাক্রমে ২৮৮ ও ৩৫১ টাকা। বছরে বছরে এই বৈষম্য আরও বাড়তে থাকে। ৬৯-৭০ সালে তা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৩১ ও ৫৩৩ টাকা। (সোবহান, ১৯৪৪) এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় কতো বেশি উন্নত হচ্ছিলো।”
এই যে দীর্ঘ পথ চলা এর মধ্যে কত যে চড়াই-উৎরাই এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অধীনে রাজনীতি করা যে কতোটা কঠিন ছিলো তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কিংবদন্তী নেতারা। গতানুগিতক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি বাঙালি জাতিকে তার আসল লক্ষ্য মুক্তি বা স্বাধীনতা এনে দেওয়ার কাজটাই ছিলো সবচেয়ে দুরূহ ব্যাপার।    
আর এটা সবচেয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি সমসময়ই চেয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে এমন একটা রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে যার হাত ধরে স্বাধীনতা আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত হয়েছিলোও তাই। কারণ তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে আজীবন রাজনীতি করে গেলে এমনকি মন্ত্রী হয়ে দেশের কিছু খেদমত করতে পারলেও তাতে বাঙালির সত্যিকারের মুক্তি মিলবে না। আর এজন্যেই তার দূরদর্শী ভাবনায় ছিলো বাঙালি জাতির মুক্তির ভাবনা।

দলকে শক্তিশালী করতে গিয়ে মাঝে মাঝে যে একটু আধটু ঝামেলা হয়নি তাও নয়। যেমন আতাউর রহমান খানের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে একদিকে আতাউর রহমান খান চাইতেন প্রশাসনিক শৃঙ্খলা কিন্তু আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী শেখ মুজিবুর রহমান চাইতেন সরকারের উপর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রাধান্য যাতে দল তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করে জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারে। যারা আমলাতন্ত্রের সাথে জড়িত তাদের এরকম কোন ভাবনা থাকে না। কারণ আর কিছু নয়। তারা তো আর মাঠে গিয়ে জনগণের কাছে উন্নয়নের ওয়াদা করে ভোট চেয়ে জনপ্রতিনিধি হয়নি।
শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আলোচনার কমতি নেই। যেটুকু সমালোচনা তার প্রতিপক্ষরাও করেছে তাও করেছে অত্যন্ত সমীহের সাথে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে সেদিন মুজিব যেটা চেয়েছিলো বা করেছিলো তা ভুল না সঠিক তা পরবর্তীকালে ইতিাহাসেই প্রমানিত হবে। হয়েছেও তাই। সমস্ত প্রশ্নের উর্ধ্বে উঠে তিনিই প্রমাণ করেছেন সেদিন বিভিন্ন সমালোচনা হলেও বা তাকে ভুল বুঝলেও তিনি ভুল ছিলেন না। ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে আছে। এ ব্যাপারে একটা কথা বলতে চাই। ধন্যবাদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে। তিনি হীরা চিনতে ভুল করেননি। তার প্রশ্রয়েই মূলত শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদাতা। বাঙালির জাতির জনক। আর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প অনেক দীর্ঘ আর বিচিত্র। ১৯৪৭-এর দেশভাগকে যদি আমরা তার রাজনৈতিক জীবনের সত্যিকারের শুরু ধরি তাহলে বলবো ১৯৬৯ সালে এসে অর্থাৎ দীর্ঘ ২২ বছরের সংগ্রামী জীবনের মাথায় এসে তিনি নিজেকে বাঙালির মাথার তাজে পরিণত করতে পেরেছিলেন। এই সময়কালের মধ্যে তিনি প্রায় একযুগ সময়ই জেলখানায় কাটিয়েছেন। ব্যাপারটা এতোটা সহজ ছিল না। যতোটা সহজে কলমের এক খোচায় এখন তা লিখে ফেলা যায়। মনে রাখতে হবে কারাগারের অন্তহীন কষ্ট, হতাশা আর অনিশ্চয়তার জীবনে একজন অমিত সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদ শামসুল হক শেষ পর্যন্ত উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।

Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

UCPDC - 600 Bangla

ইউসিপিডিসি-৬০০ ধারা-১ঃ ইউসিপিডিসি-এর প্রয়োগঃ ইউসিপিডিসি এর ২০০৭ সালের সংশোধনী আইসিসি পাবলিকেশন ৬০০ এর বিধি বা ধারাসমূহ (স্ট্যাণ্ড বাই লেটার অব ক্রেডিট সহ) সকল এলসিতে প্রয়োগ হবে। এলসিতে নির্দিষ্ট কোন স্থানে উল্লেখ না করলে তা সকল পক্ষের উপরই কার্যকর হবে। ধারা-২ঃ সংজ্ঞা ঃ অন্য কোন অর্থে ব্যবহার না করলে এই বিধিতে এ্যাডাভাইজিং ব্যাংক বলতে সেই ব্যাংককে বোঝাবে যে ইস্যুইং ব্যাংক এর অনুরোধে ঋণপত্র সুবিধা প্রদান করে। গ্রাহক বলতে সেই পক্ষকে বোঝাবে যার অনুরোধে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়। ব্যাংকিং কর্ম দিবস বলতে সেই দিনকেই বুঝাবে যেদিন ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট স্থানে উক্ত বিধি অনুযায়ী নিয়মিতভাবে তার প্রত্যাহিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বেনিফিসিয়ারী বলতে সেই পক্ষকে বুঝাবে যার পক্ষে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। কমপ্লাইং প্রেজেণ্টেশন বলতে সেই প্রেজেণ্টেশনকে বুঝাবে যা ঋণের সকল শর্তানুযায়ী করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আদর্শ ব্যাংকিং চর্চার আওতাধীন। কনফার্মেশন বলতে কনফার্মিং ব্যাংক এর পাশাপাশি ইস্যুইং ব্যাংক কর্তৃক সুনির্দিষ্টভাবে একটি কমপ্লাইং প্রেজেণ্টেশনকে অনুমোদন ঝুঝায়। কনফার্মিং ব্যাংক বলতে সেই ব্যাংককে ঝুঝা

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে