[উ ৎ স র্গ
জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু
শ্রদ্ধাভাজনেষু
জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ১লা জানুয়ারি ১৯৪৪ সালে পিরোজপুর জেলার একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আরও তিন বার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী ছিলেন ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এবং যোগাযোগ মন্ত্রী ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন।
মন্ত্রী হিসেবে তার সাফল্য ৭৪০ থেকে ২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর সফল সমাপ্তি। যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেলওয়ে এবং সড়ক পথে যোগাযোগ চালু হয়।
তিনি জিএস ও পরে ফজলুল হক হলের ছাত্রসংসদের ভিপি, ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তিনি পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়াÑ কাউখালী আসনে ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০১৪ সালে ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে অন্যতম সফল এক ব্যক্তি। ১৯৭২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত তিনি একটি জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেনÑতার পিতা তোফাজ্জল হোসেন ( মানিক মিয়া ) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। জনাব হোসেন এখন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান।
আনোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল, পদার্থবিদ্যা ও গণিতে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ওয়াশিংটন ডিসি হতে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিকÑসম্পর্ক বিভাগের বিশেষ ছাত্র হিসেবে এম.এস করেন।
জনাব হোসেন এর স্ত্রী তাসমিমা হোসেন এবং চার কন্যা সন্তানের জনক।]
সূচিপত্র
একটি ছোট্ট ভূমিকা
আমার দেশ আমার গর্ব
মুজিব মানে বাংলাদেশ
১৮৮৫ এবং কংগ্রেসের জন্ম
১৯০৫ এবং মুসলিম লীগের জন্ম
১৯৫২ সাল এবং ভাষা আন্দোলন
১৯৫৪ এবং যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন
৬৯’র গণ অভ্যুত্থান
৭০’র লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার
এক নজরে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ঘটনাবলি
১৯৭০ সালের নির্বাচনই মূলতঃ ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করেছিল
৭ই মার্চের ভাষণের পর পাক বাহিনির সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো
বিভক্ত ভাবনায় দ্বিখণ্ডিত স্বদেশ
তাত্তি¡ক বিশ্লেষণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম
বাংলাদেশে ছাত্র-রাজনীতির উত্থান
আমাদের বাম রাজনীতির সাফল্য ও ব্যর্থতা
পরিশিষ্ট
একটি ছোট্ট ভূমিকা
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। তার পর দেখতে দেখতে প্রায় ৪৮ বছর কেটে গেছে। আর মাত্র দুবছর পর আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করবো। তাই সময় হয়েছে এই ৪৮ বছর সময়কালের কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করার।
১৯৭১ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে আসেন। ১২ই জানুয়ারি তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২৪শে জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন। ২৫শে জানুয়ারি তিনি পুনরায় রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় আসেন খোন্দকার মোশতাক। তিনি ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৬ই নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে ক্ষমতায় ছিলেন। এর পর ক্ষমতায় আসেন এ এস এম সায়েম। ২১শে এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত তিনিই রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ৩০শে মে ১৯৮১ সালে নিহত হওয়ার পর আব্দুস সাত্তার ক্ষমতায় আসেন। ২৪শে মার্চ ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন এ এফ এম আহসানউদ্দীন চৌধুরী। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১০ই ডিসেম্বর ১৯৮৩ পর্যন্ত।
এর পরই আগমন ঘটে আর এক জেনারেলের। তিনি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বরে গণ আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আরোহন করেন। ২০শে মার্চ ১৯৯১ সালে তিনি প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন। তাকে পরাজিত করে ১৯৯৬ সালের ২৩শে জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন।
পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া তিন বার এবং শেখ হাসিনা চার বার ক্ষমতায় এসেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উলেখযোগ্য ব্যাপার হলো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারি ক্ষমতায় আরোহন করার টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আছেন।
এই ধারাবাহিকতার ইতিহাস সবারই জানা। তবুও উলেখ করলাম। কারণ এর দিকে চোখ বুলালে এই ৪৮ বছরে আমাদের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে যায়। একটা মোটামুটি চিত্রও চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এই বইটি লিখতে গিয়ে এমন কিছু বিষয় চলে এসেছে যা সবারই জানা। তবুও বইটি সাজানোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু চর্বিত চর্বণ পুনরায় উপস্থাপন করতে হলো। তার পরও কয়েকটি অধ্যায়ে যেমন “তাত্তি¡ক বিশ্লেষণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম”, বিভক্তির ভাবনায় দ্বিখণ্ডিত স্বদেশ”, “বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির উত্থান”, “আমাদের বাম রাজনীতির সাফল্য ও ব্যর্থতা” ইত্যাদিতে নতুন কিছু ভাবনার খোরাক দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
যদিও মূল আলোচনা “১৮৮৫ এবং কংগ্রেসের জন্ম” লেখার মাধ্যমে শুরু তবুও যেহেতু বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশÑতাই জাতির পিতার উপর একটি ছোট্ট পরিচিতিমূলক লেখা ইচ্ছে করেই শুরুতে লিখলাম। যাদের আগ্রহ আছে তাদের ভালো লাগবে আশাকরি।
সবশেষে বলবো আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা আপনাদের ভালো লাগলেই এটি সার্থক হয়েছে বলে মনে করবো।
আমার দেশ আমার গর্ব
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট উপমহাদেশে ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনের অবসান হয়। কিন্তু সেই অবসানের প্রক্রিয়া যেমন মধুর ছিল না তেমনি তার পরবর্তী ফলাফলও খুব একটা ভাল হয়নি।
আমার মনে হয় দেশ ভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যত লোক মারা গেছে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হলেও এত লোক মারা যেত কিনা সন্দেহ। মূলতঃ এটাই ঘটেছিল।
দেশভাগের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে অসম্প্রীতির বীজ বপন করেছিল তার রেশ দিনে দিনে শুধুই বেড়েছে। উপমহাদেশের দেশগুলো এখনও একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সময়কালে ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছিলো। ভারতীয় রাজনীতির উলেখযোগ্য পরিবর্তন ছিল হিন্দু মৌলবাদের উত্থান। পাকিস্তানের রাজনীতির মূল পরিবর্তন ছিল বাঙালির উপর শোষণ নির্যাতনের ধারাবাহিক বৃদ্ধি। দুটোই সমান ক্ষতিকর।
ফলাফল কারো জন্যেই ভালো হয়নি। ভারত ক্রমশঃ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। পাকিস্তান হয়েছে দ্বিখণ্ডিত। বরং নির্যাতিত বাঙালিই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার ত্যাগ আর সাধনার মহিমায়।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে অর্জিত স্বাধীনতা বাঙালির আবস্থান এবং উন্নয়নে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বিগত ৪৮ বছরে বাঙালির জাতীয় জীবনে অনেক উত্থান-পতন থাকলেও ২০০৯ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা সত্যিই অভ‚তপূর্ব।
এরপরও সমালোচনা হচ্ছে। হয়তো আগামীতেও হবে। কাজ করলেই সমালোচনা হয়। অতীতে যারা সরকারে ছিল তাদেরও কি সমালোচনা হয়নি। হয়েছে। আগামীতেও হবে। তবে যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতে হবে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো যারা জাতির সাথে বেঈমানি করেছিলো তারাও আজ জনতার ভিড়ে মিশে গেছে। আমার এই বইয়ে আমি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি বিগত ৪৮ বছরের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিরও কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।
সাফল্য আর ব্যর্থতা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু এর বিশ্লেষণ আগামীর পথ চলার জন্যে জরুরি। ভালো-মন্দ নিয়েই আমাদের নিরন্তর পথ চলা। সবকিছুর পরও আজও তাই বলতেই হবে আমার দেশ আমার গর্ব।
মুজিব মানে বাংলাদেশ
প্রতিবার আমি যখন সামনে এগিয়ে যাবার জন্য পা ফেলি আমার মনের মধ্যে একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয়Ñআমার পায়ের নিচের এই স্বাধীন ভূখণ্ড কে এনে দিলেন ? পৃথিবীর সব কালে সব দেশে স্বাধীনতার জন্য মানুষকে রক্ত ঝরাতে দেখা যায়। সইতে হয় ভয়াবহ নির্যাতন। স্বাধীনতা তাই বরাবরই অমূল্য, দুর্লভ। আমরাও স্বাধীন ছিলাম না। আমাদের জন্য এই অমূল্য স্বাধীনতা এনে দেওয়ার দায়িত্ব যিনি নির্ভয়ে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি আর যাই হোক কোনো সাধারণ মানুষ নন। প্রত্যেক সচেতন বিবেকবান মানুষের কাছে আমার প্রশ্ন, একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন, সেদিন কার কথায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি একাট্টা হয়েছিল স্বাধীনতার জন্যে? স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের? কে আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল? হঠাৎ করে আসা কোনো ভিন দেশি নয়। মাটি আর মানুষের জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করা একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি আর কেউ নন। তিনি আমাদের জাতির জনক। তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
উপমহাদেশে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা সুফিদের মধ্যে যে সকল সুফিগণ চট্টগ্রামে এসেছিলেন তাদের একজন ছিলেন শেখ আওয়াল। ধারণা করা হয়, তিনি প্রখ্যাত সুফি দরবেশ বায়েজীদ বোস্তামীর অনুগামী ছিলেন। এই শেখ আওয়ালের পুত্র হলেন শেখ মুজিবের অষ্টম পুরুষ। শেখ আওয়ালের পুত্র শেখ জহির উদ্দীন কলকাতার নিকটবর্তী কান্দাপাড়ায় থেকে পাটের আড়তদারি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। শেখ জহির উদ্দীনের পুত্র শেখ জান মাহমুদ। শেখ জান মাহমুদের পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন।
শেখ বোরহান উদ্দীন তার ব্যবসার কাজে মধুমতী নদীর পথ দিয়ে গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা ও ঘোপের ডাঙ্গায় আসেন। আর এখানেই তিনি টুঙ্গিপাড়ার কাজী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন। গোপালগঞ্জে শেখ পরিবারের বসবাস মূলত এখান থেকেই শুরু। শেখ বোরহানের তিন পুত্রের মধ্যে বড় পুত্র শেখ একরাম হোসেন। এই শেখ একরাম হোসেনের তিন পুত্রের মধ্যে মেঝ পুত্রের নাম শেখ আব্দুল হামিদ। এই শেখ আব্দুল হামিদই শেখ মুজিবের পিতামহ। তার পিতা ছিলেন শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা মোসাম্মৎ সায়রা বেগমÑযিনি সম্পর্কে শেখ লুৎফর রহমানের চাচাত বোন। শেখ মুজিব তার তৃতীয় সন্তান এবং পুত্র সন্তান হিসেবে প্রথম। শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সায়রা বেগমের ঘরে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করে বাঙালি জাতিকে ধন্য করেন। সেদিন কি কেউ বুঝতে পেরেছিল যে এই সন্তানই কালে কালে একদিন বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা হবেন। হবেন জাতির জনক। কিন্তু তার শিক্ষা ও বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে সেটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল।
১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিল সেই শিশুটিই একদিন তার প্রশস্ত কাঁধে পুরো বাঙালি জাতির বোঝা তুলে নিয়েছিল। ১৯২৯ সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। ১৯৩১ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে। ১৯৩৪ সালে চোখের অপারেশনের কারণে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে পুনরায় স্কুল জীবনে ফিরে আসেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ১৯৪৩ সালে যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। ১৯৪৬ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ইসলামিয়া কলেজ স্টুডেন্টস ইউনিয়নের। এই সময় তিনি তার রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনের পক্ষে কাজ করেন কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে তিনি বি এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে কায়েদ-এ-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং খাজা নাজিম উদ্দীন উর্দুকে বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ১৯৪৯ সালের ২৬ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার উর্দুকে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে তিনি জেলখানায় বসে ১৩ দিনের আমরণ অনশন পালন করেন। ভাষার দাবিতে ১৯৪৯ সালের ১১ই মার্চ তিনি খালেক নেওয়াজ, শামসুল হক প্রমুখসহ গ্রেপ্তার হন এবং কিছুদিন পর মুক্তি পান। এই বছরই তিনি ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হন। ১৯৫১ সালে ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন। ১৯৫৩ সালে ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের অধীনে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের কৃষি মন্ত্রী নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল ঘোষণা করলে তিনি তার প্রতিবাদ করেন এবং গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে সদস্য হন এবং অধিবেশনে পূর্ব বাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান কথাটি ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন।
১৯৫৭ সালে তিনি উক্ত পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি স্বাধীন বাংলা বিপ্ল¬বী পরিষদ গঠন করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরোধিতা করার কারণে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৩ সালে তার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলে তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে তিনি আইয়ুব খানের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দান করেন। ১৯৬৪ সালের ১৫ হতে ২১ সেপ্টেম্বর তিনি করাচিতে অবস্থান করেন। কথিত আছে এই সময় তিনি লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেনের আমন্ত্রণে বিএলএফ-এর গোপন মিটিং-এ অংশগ্রহণ করেন এবং এর জন্যেই ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি কর্তৃক গ্রেফতার হলে পরবর্তীতে তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
১৯৬৬ সালে তিনি লাহোরে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা পেশ করেন। ১৯৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নথিভুক্ত করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২১ শে ফেব্র“য়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নেয়া হলে ২২ ফেব্র“য়ারি তিনি সমস্ত সঙ্গীসাথীসহ মুক্তিলাভ করেন। এ সময় দশ লক্ষ লোকের এক সমাবেশে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়।
১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে তিনি উপক‚লবর্তী এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চালান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার দল পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচনেও তার দল ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর, সংবিধান প্রণয়ন ও স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি সংক্রান্ত মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ভেঙে গেলে তিনি তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ দান করেন এবং নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃক রাজনীতির মহাকবি হিসেবে আখ্যায়িত হন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে গ্রেপ্তারের পূর্বে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ঐতিহাসিক ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় শপথ নেন। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি তারিখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুনরায় শপথ নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে সপরিবারে নিহত হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি উক্ত দায়িত্বে বহাল ছিলেন।
শেখ মুজিবের জীবন পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূলত তার জীবনটাই বাঙালি জাতির ভাগ্য রচনার এক সুদীর্ঘ ফিরিস্তি। তিনি যে বাঙালির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তার প্রমাণ তার জীবনের প্রতিটি ঘটনা পরম্পরার মাঝেই সুস্পষ্ট। তিনি ছিলেন বাঙালির প্রাণের স্পন্দন। মুজিব মূলত একটি জাতির মানচিত্র। মুজিব মূলত একটি জাতির পতাকা। বাংলাদেশ নামটিও মূলত তার-ই দেয়া। তিনি নিজে তার সমস্ত চিন্তা, চেতনা, স্বপ্ন ও দর্শনে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে ধারণ করেছিলেন। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সজাগ। মুজিব তাই চেতনার অগ্নিস্ফ‚লিঙ্গ। মুজিব তাই একটি জ্বলন্ত সূর্যের মতোই দীপ্যমান।
বাঙালি জাতির আজকের যে অবস্থান, তার যে উন্মেষ ঘটেছিল সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে, তখনও তিনি ছিলেন পূর্ণ সোচ্চার। তার পর ১৯৭১ সালে বাঙালির রক্তস্নাত স্বাধীনতা সংগ্রামে তার নেতৃত্বেই ৯ মাসের যুদ্ধ জয় সম্ভব হয়েছিল। মুজিব মূলত মনে প্রাণে ছিলেন খাঁটি বাঙালি। নির্লোভ, নিরহঙ্কার মানুষটির সমস্ত জীবন জুড়ে ছিল এই বঞ্চিত জাতির ভাগ্যান্বেষণের অদম্য আকাক্সক্ষা। তিনি নিজের জন্য কিছু চেয়েছিলেন এমন কোনো কথা ইতিহাসের কোথাও লেখা নাই। জীবনে কোনোদিন নিজের জীবনের পরোয়া করেন নাই। তার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে কারান্তরালে। তবুও তিনি ছিলেন অকুতোভয়।
দীর্ঘদেহী এই মানুষটি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি ছিলেন একজন সুবক্তা। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণেই পেশ করা সম্ভব হয়েছিল ৬ দফার দাবি, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। মুজিব মূলত জানতেন এই ৬ দফাই হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় প্রভাবক। ইতিহাস তাকে অমর করেছে। কার সাধ্য তাকে মুছে ফেলে। তিনিই বঙ্গবন্ধু। তিনিই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনিই আমাদের জাতির জনক। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। সবার প্রিয় শেখ সাহেব।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে মেনে নিতে কিছু কিছু লোককে ইতস্ততঃ করতে দেখা যায়। এর কোন যুক্তিও তাদের কাছে নেই। আসলে একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদ দেশের জন্যে ভাবেন। মানুষের জন্যে ভাবেন। আর সে জন্যেই আমরা দেখতে পাই পাকিস্তান আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিককেÑপরবর্তীতে পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাঙালি জাতির স্বার্থরক্ষার তাগিদে একটা জীবন পার করতে হয় পাকিস্তানি ঘৃণ্য মানসিকতার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। আর তার ফলাফলই হলো আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৮৮৫ এবং কংগ্রেসের জন্ম
উপমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কংগ্রেসের জন্ম লাভই মূলতঃ উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠানিকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর পর স্বাধীকারের জন্য যে সব আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে উলেখযোগ্য ঘটনাগুলো ছিল বক্সারের যুদ্ধ, ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তিতুমিরের বাঁশের কেলা, হাজী শরীয়াতুলাহর ফরায়েজী আন্দোলন এবং শেষমেষ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। একটি ব্যর্থ বিদ্রোহের পরিণতি যে কি হতে পারে তার মূলতঃ প্রমাণ হয়ে আছে এই সিপাহী বিদ্রোহ। সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনা, বিদ্রোহকে সর্বস্তরে পৌঁছাতে না পারার ব্যর্থতা সিপাহী বিদ্রোহকে অংকুরে বিনষ্ট করছিল।
সবচেয়ে বড় কথা এই বিদ্রোহর মাধ্যমে দিলির মুঘল বাদশাহীর সমাধি রচিত হয়। উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের সর্বশেষ ঘাঁটিটুকুও শেষ হয়ে যায়। কোম্পানির শাসনের অবসান হয় এবং ব্রিটিশ রাজত্বের সরাসরি শাসন কায়েম হয়। সিপাহী বিদ্রোহের পর একটা দীর্ঘ সময় কেটে যায় স্থবিরতার মধ্য দিয়ে। তবে এই সময়ে যে সকল কর্মকাণ্ড থেমে থাকে তা কিন্তু নয়। স্যার সৈয়দ আহমেদ শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে আলীগড় মুসলিম সোসাইটি এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু এসব কোন রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম ছিল না। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেসই ছিল উপমহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দুু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের প্রধান প্ল্যাটফরম। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত কংগ্রেস এমনটাই মনে করত। কিন্তু শেষমেষ মুসলিম লীগের অব্যাহত দাবির মুখে কংগ্রেস মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বের দাবি থেকে সরে আসে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের জন্মের মধ্যে দিয়ে এই সুদীর্ঘ রশি টানাটানির অবসান হয়।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস রাজনীতির এই ৬২ বছরেই উপমহাদেশের পরবর্তী রাজনীতিরও সামাজিক গতিধারার স্বরূপ চিহ্নিত হয়েছিল। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এটা সৃষ্টি হয়েছিল যে, উপমহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দুু ও মুসলিম দুটি পৃথক ধারা। শিক্ষা, সংস্কৃতি কিংবা সামাজিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে নয়Ñসেদিন পার্থক্য রচিত হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। ১৯৪৭-এ এসে যে বিভক্ত উপমহাদেশ সৃষ্টি হয়েছিলÑধর্মই তার গতিপথ নির্ধারণ করেছিলো। অথচ নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। উপমহাদেশের কোন রাষ্ট্রই ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি।
১৯০৫ এবং মুসলিম লীগের জন্ম
উপমহাদেশে যখন ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করেছিলো তখন ক্ষমতায় ছিল মুসলমানরা। সেই সুবাদে মুসলমানদের সাথে ইংরেজদের একটা বিবাদ শুরু থেকেই ছিলো। ক্ষমতা হারানোর জ্বালা ইংরেজদেরকে মুসলমানদের প্রথম প্রতিপক্ষ করেছিলো। পলাশীর যুদ্ধের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় বক্সারের যুদ্ধেই মীর জাফরের জামাতা মীর কাসিম ইংরেজদের মুখোমুখি হয়। এরপর উত্তর ভারতে আহমদ শহীদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তিতুমির, হাজী শরীয়ত উলাহ এবং সর্বশেষ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে প্রায় ১০০ বছর ধরে চলমান বিদ্রোহের প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্মের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে সুবিধাভোগী হিন্দুু সম্প্রদায় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ইংরেজদের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তখন হিন্দু কিংবা মুসলিম উভয়ের জন্যে এই কংগ্রেসই ছিল একমাত্র প্ল্যাটফরম। ১৯০৫ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কংগ্রেসই ছিল একমাত্র আশ্রয়স্থল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ সংঘটিত হলে উপমহাদেশের মুসলমানরা এই প্রথম হালে পানি পায়। তারা নিজেদের জন্যে একটা পৃথক অস্তিত্বের কথা ভাবতে শুরু করে। এরই ফলশ্রতিতে ঐ বছরেরই ডিসেস্বর মাসে ঢাকার নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মুসলিম লীগ শুরু থেকেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন একটি সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ ও উদ্দেশ্যে ছিলো। তবে ১৯২০ সালে জিন্নাহর যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত এটি সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ভিন্ন মাত্রা পায়। ১৯৪০ সালে লাহোরে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পেশ করলে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ৪০ থেকে ৪৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগ এই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই দর কষাকষি করে। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতার ১ দিন পূর্বেই জিন্নাহ পাকিস্তান বুঝে নিতে সক্ষম হন।
১৯৫২ সাল এবং ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলনের কথা মনে পড়লেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৯৫২ সালের দৃশ্যপট। কিন্তু আমরা ভুলে যাই এই ভাষার প্রশ্ন প্রথম উলেখিত হয় ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের ঠিক আগেই। কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের ভাষার প্রশ্নে তখনই চিন্তিত হয়ে পড়ে। কারণ আর কিছুই নয়। পাকিস্তানের পূর্ব প্রান্তের ভাষা বাংলা। আবার তারা সংখ্যা গরিষ্ঠও। আবার পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষাও ছিল উর্দু। আবার তা শাসক গোষ্ঠীয় ভাষা। এরকম একটা জটিল পরিস্থিতিতে উভয় প্রান্তের মানুষের কাছে ভাষার প্রশ্ন বেশ বড় হয়ে দেখা দেয়। পাকিস্তানের ব্যাপারে এরকম সমস্যা আরও হয়েছিল। যেমন পাকিস্তান জন্মের পর নয় বছর লেগেছিল এর সংবিধান প্রণয়ন করতে।
১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশ ভাগের পরপরই তাই দেখা যায় কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানাস্তরিত হওয়া বুদ্ধিজীবীরা এখানে এসেই তমদ্দুন মজলিস গঠন করলেন। আর এই তমদ্দুন মজলিসই ভাষার প্রশ্নে প্রথম সোচ্চার হয়। তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা তমদ্দুন মজলিসের ব্যানারে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। ড. কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ শহীদুলাহর মতো শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা এই কাতারে শরিক হন। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম হলে ভাষা আন্দোলন আর সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাজনীতির হাত ধরে ভাষার প্রশ্ন রাজপথ ধরে সামনে আগাতে থাকে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই ৪ বছর অব্যাহত আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি অর্থাৎ ৮ই ফাল্গুনের কৃষ্ণচূড়ার রংধরা বিকেলে অজস্র শহীদের রক্ত স্নাত হয়ে ২১শে ফেব্র“য়ারি আমাদের প্রাণের সম্পদে পরিণত হয়। ২১ শে ফেব্র“য়ারির সেই বিকেলে যে রক্ত বয়ে গিয়েছিলো তার স্রোতও সেদিন ভাষার প্রশ্নের সমাধান আনতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা এরপরও প্রায় ৪টা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৫৫ সালে এসে আমরা সাংবিধানিকভাবে ২১শে ফেব্র“য়ারির স্বীকৃতি পাই। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়।
১৯৫৪ এবং যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র্রের জন্ম হলেও জন্মের পর একটা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায় প্রথম নির্বাচনটি করতে। অবশেষে ১৯৫১ সালে এসে পাকিস্তান সরকার প্রাদেশিক পর্যায়ে নির্বাচন দিতে সম্মত হয়। ১৯৫১ সালে পাঞ্জাবে এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্তে প্রদেশে এবং ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশে নির্বাচন দিতে সম্মত হয়। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই নির্বাচন ছিল লোক দেখানো প্রহসনের নির্বাচন। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগের মারাত্মক ভরাডুবি হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তারাও তাই অজুহাত খুঁজছিল। কোন একটা উপলক্ষ্য ধরে যদি সরকারকে উৎখাত করা যায়। কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা সেই অজুহাত পেয়েও যায়। কলকাতা সফরে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক কলকাতাকে নিয়ে তার অতীত স্মৃতিমূলক একটা বেফাঁস কথা বলে বসেন। কথাটা এমন কিছু না। এই যেমন-“এখানে এলে আবার আমার সেই পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ”
তখনকার প্রধান শহর এবং রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুু কলকাতায় বেশিরভাগ রাজনীতিকের জীবন কেটেছে। তাই কলকাতা নিয়ে ফজলুল হক তো স্মৃতিচারণ করতেই পারেন। ব্যস! আর যায় কোথায়। কেন্দ্র পাকিস্তানের প্রতি ফজলুল হকের আনুগত্যের প্রশ্ন তুলে মাত্র দেড় মাসের মাথায় যুক্তফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করে দেয়। আসল কারণ ছিল দুটো। প্রথমত মুসলিম লীগের ভরাডুবি। দ্বিতীয়ত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যে প্রধান দফাটিই ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। কেন্দ্রের পক্ষ এই দুটোই মেনে নেওয়া কঠিন ছিলো। ফলশ্র“তিতে যা হবার তাই হলো। ফজলুল হক সরকারকে বরখাস্ত করা হলো। গভর্নরের শাসন ব্যবস্থা কায়েম হলো। বছর দুই পরে অবশ্য পুনরায় সরকার গঠন করতে বলা হলো। কিন্তু তাতে আওয়ামী লীগ আর সাড়া দেয়নি। ১৯৫৮ সালে এসে সেই সরকারও পথে বসল। আইয়ুব খানের বুটের নীচে চাপা পড়ে গেল পাকিস্তানের সদ্য প্রণীত সংবিধান। তিনি তার বহুল বিতর্কিত মৌলিক গণতন্ত্র চালু করলেন। ১৯৬৫ সালে একটা নাম মাত্র নির্বাচন দিলেন। ফাতেমা জিন্নাহ তার বিপক্ষে শক্ত প্রার্থী ছিলো। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। আইয়ুব খান নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার পতনের আগ পর্যন্ত তিনি প্রায় ১১ বছর রাজত্ব করেছিলেন। এই সময়টার বেশির ভাগই পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের জেল জুলুম খাটতে হয়েছে।
৬৯’র গণ অভ্যুত্থান
৬৮’র শুরুতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খড়গ শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীদের উপর চেপে বসেছিলো। আন্দোলন জমাতে “পাকিস্তান ডেমোক্রেডিক মুভমেন্ট” (পিডিএম) গঠন করা হয়েছিল। তাতে খুব একটা ফল লাভ হয়নি। আন্দোলন জমে উঠল যখন ১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা “সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করলো এবং সরকারকে বেশ খানিকটা বেকায়দায় ফেলে দিলো তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা ঘোষণা করার মাধ্যমে। এই ১১ দফায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফাও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এরপর যা কিছু ঘটেছে তার পুরোটাই ইতিহাস। ৭ থেকে ৮ই জানুয়ারি “ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি” (ডিএসি) গঠন করা হলো। শুরু হলো পূর্ণ গতির আন্দোলন।
২০শে জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান শহীদ হলেন। ২৪শে জানুয়ারি কিশোর মতিউর শহীদ হলেন। ১৫ই ফেব্র“য়ারি ঘটল সবচেয়ে বড় অঘটন। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই বন্দী থাকা অবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হলেন। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ছিলেন। আর ১৮ই ফেব্র“য়ারিতে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ শামসুজ্জোহা প্রতিবাদ চলাকালীন সময়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন। আর এরই ফলশ্র“তিতে আন্দোলন এতটাই তীব্র হলো যে ২১শে ফেব্র“য়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিলেন এবং বঙ্গবন্ধুসহ সবাইকে বেকসুর খালাস দিলেন। ২৩শে ফেব্র“য়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে এক বিরাট জনসভায় গণসংবর্ধনা দেওয়া হলো এবং এই জনসভায় তোফায়েল আহমেদ সবার পক্ষ থেকে তাকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করেন।
আইয়ুব খান বুঝতে পেরেছিলেন তার সময় শেষ। তিনি ১০-১৩ মার্চের মধ্যে বিরোধীদের সাথে গোল টেবিল বৈঠক ডাকলেন। কিন্তু তাতে তেমন কোন লাভ হলো না। ২৪শে মার্চ তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সরে দাঁড়ালেন।
৭০’র লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার
১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার ঘোষণা করেন। এতে বলা হয় যে আইনসভায় ৩০০টি আসন থাকবে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সংখ্যাসাম্যের উলেখ ছিল। ফ্রেমওয়ার্কে রাষ্ট্র্রের দুই অংশের জন্য সংখ্যানুপাতের কথা বলা হয়। এই নিয়মের আওতায় পূর্ব পাকিস্তান ১৬২টি ও পশ্চিম পাকিস্তান ১৩৮টি আসন লাভ করে। আরো উলেখ করা হয় যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহŸানের ১২০ দিনের মধ্যে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে, কিন্তু প্রক্রিয়ার নিয়ম ভবিষ্যত আইনসভার হাতে অর্পণ করা হয়। ১২০ দিনের মধ্যে নতুন আইনসভা সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে নতুন নির্বাচন দেয়া হবে। রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রস্তাবিত সকল বক্তব্য ও সম্মতি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির সামনে সত্যায়িত করার জন্য পেশ করা হবে। এছাড়াও এক ইউনিট পদ্ধতি বাতিল করা হয়। পূর্বে এক ইউনিটের আওতায় পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশকে একত্রে একটি প্রদেশ গণ্য করা হত।
এক নজরে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ঘটনাবলি
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের জন্মলাভের মাত্র ১ মাসের মাথায় সেপ্টেম্বরেই জন্মলাভ করে তমদ্দুন মজলিস নামের একটি সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনই প্রথম ভাষার প্রশ্নে সোচ্চার হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে ভাষার প্রশ্নে তার অবস্থান উভয় পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম বিভক্তির সীমারেখা চিহ্নিত করে।
১৯৪৮ সালে জিন্নাহর মৃত্যুর পর গভর্নর জেনারেল নাজিমউদ্দিনও তার পূর্বসূরীকে অনুসরণ করেন। তাকে সহযোগিতা করেন জিন্নাহর লেফটেন্যান্ট সাহেবজাদা লিয়াকত আলী খান। তিনি ভাষার প্রশ্নে জিন্নাহর নীতি অনুসরণ করেন। ফলে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারিতে চলমান আন্দোলন সর্বোচ্চ মাত্রা পায়। বেশ কয়েকজন শহীদ হন রাজপথে। সরকার বিষয়টি অন্য ভাবে ভাবতে শুরু করে।
ভাষার প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়ে যায়। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নকে সামনে রেখে। যদিও ১৯৫৫ সালে এসে মাতৃভাষার প্রশ্নে একটা আপাতত গ্রহণযোগ্য সমাধান আসে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু চুয়ান্ন সালের এই যুক্তফ্রন্ট সরকার সবদিক দিয়েই ব্যর্থ। কেন্দ্রীয় সরকারও এই সুযোগ গ্রহণ করে। মূলতঃ ঘটনার পিছনে কেন্দ্রীয় সরকারই কলকাঠি নেড়েছিল। বাঙালিরা সেটা বুঝতে পারলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান জন্মের পর নির্বাচন বলতে যতটুকু হয়েছিল তা প্রাদেশিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫১ সালে পাঞ্জাব এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নির্বাচনের পর ১৯৫৪ সালে বাংলায় প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে বাঙালির একচেটিয়া সাফল্য এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবি কেন্দ্রকে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করে। তারা সেটা মুখে না বললেও প্রাদেশিক সরকার গঠনের মাত্র ২ মাসের মাথায় এর বহিষ্কার এটাই প্রমাণ করে। সেই সাথে সাথে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ২১ দফার প্রধান দফা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিও চাপা পড়ে যায়। পাকিস্তান সরকার বুঝতে পারে বাংলার রাজনৈতিক শাসন কর্তৃত্ব আর তাদের হাতে নেই।
এই সময় সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়নের সময় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে এড়িয়ে গিয়ে সংক্রান্ত রীতি অনুসরণ করা হয়।
অবশেষে ১৯৫৮ সালে আইয়ূব খান ক্ষমতায় এলে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে নতুন বিধানে শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিনিধির ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনের যে পদ্ধতি তিনি চালু করেন তাকে পুঁজি করেই তিনি ১৯৬২ সালের বৈতরণী পার হন।
কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় যখন মুজিব ১৯৬৬ সালে এসে ছয় দফা পেশ করেন। এই ছয় দফা মূলতঃ ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সার সংক্ষেপÑযার প্রথম দফা ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। আইয়ুব খান মুজিবকে একঘরে করার জন্য ১৯৬৮ তে এসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেনÑযা পরবর্তীতে আইয়ুব খানের পতনের কারণ হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনই মূলত:
ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করেছিল
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তানে আর কোন সর্বাত্মক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি কেবল মাত্র ১৯৬৫ সালের আইয়ুব খানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছাড়া। তাই এই নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় ছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান জন্মের পর এটাই সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনÑযা একই সাথে কেন্দ্রে ও প্রদেশে অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস সেই প্রথম সর্বাত্মক নির্বাচনই পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দিলো। মূলতঃ সহাবস্থানের মতো মানসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোন পরিস্থিতি যে বিরাজমান ছিল না তার প্রমাণ এই নির্বাচন। এই নির্বাচন তাই ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে দিলো। ইয়াহিয়া জানত পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভোট হলে মুজিবই হবেন প্রধানমন্ত্রী। সবকিছু জানার পরেও তিনি ওয়ান ইউনিট ব্যবস্থা বাতিল করলেন। লিগ্যাল ফ্রেম নেটওয়ার্ক চালু করলেন। অতঃপর নির্বাচন দিলেন। বিকল্পও হয়তো ছিল না। এমনিতেই পশ্চিম পাকিস্তানে আসন কম। তার উপর ভুট্টোর পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে সবগুলো আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। তাহলে আশা কোথায়। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ যে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তাতো সেই ১৯৫৪তেই জানা হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে দাবি দাওয়াও সেই পুরনোই ছিলো। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। আমার তো মনে হয় পাকিস্তানিদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে দেওয়ার চাইতে স্বায়ত্তশাসন প্রদানই মঙ্গল ছিলো। এখনও মনে হয় সবচেয়ে উত্তম হতো যদি মুজিবকে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানানো হতো। হয়তো পাকিস্তান বেঁচে যেত। এপার থেকে কেউ হয়ত প্রধানমন্ত্রী হতো। আবার পরবর্তীতে ওপার থেকেও কারো না কারো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ হত। নাকি পাকিস্তানিরা ধরেই নিয়েছিল কোন পাকিস্তানিই কখনও পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে না। আর তাদের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও সুযোগ নেই। এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে নির্বাচনেই বা যাওয়া কেন। এত পাকিস্তানিদের বুঝে শুনে বাঘের খাঁচায় ঢোকা। নাকি ইয়াহিয়া মুজিবকে তুচ্ছ করেছিলেন। ভেবেছিলেন নির্বাচনে হয়তো আওয়ামী লীগ এতটা আসন পাবে না। যদি তেমনটা আশা করেই থাকেন তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এরকম প্রতিপক্ষই বা তৈরি করলেন না কেন? অবশ্য করবেনই বা কে? আইয়ুবের পর ইয়াহিয়াÑদুজনই সামরিক শাসক। নিজেদের যদি নিয়েই টানাটানি। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া রাজনীতির খেলা খেলা যায় না। রাজনীতি হচ্ছে একটা স্কুল যেখানে অনেক রকমের ছাত্র থাকে। তাদের নিয়ে নানান দল সাজানো যায়। শুধুমাত্র সামরিক ছাত্র দিয়ে কি আর খেলা হয়।
আমার মাথায় আসে না ১৯৭০ এর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পর যেখানে কেন্দ্রের অবস্থা একেবারে নাজুক সেখানে ইয়াহিয়া কোন সাহসে নির্বাচন দিলেন। ক্ষমতা ধরে রাখার কোন্ তত্ত¡ বা তথ্য তার কাছে ছিল তা তিনি জানতেন কিনা আমার জানা নাই। ভুট্টোও বা কিসের আশায় এসব করেছিলেন। তার তো ছিল মাত্র ৮১ সিট যেখানে মুজিবের ১৬০ সিট। সবকিছু এলোমেলো লাগে। তাহলে কি ভুট্টোকে ওপারের প্রধানমন্ত্রী বানাতে এবং পাকিস্তানকে বাংলাদেশ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ভুট্টো-ইয়াহিয়া এই হেঁয়ালির আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনই ভালো ছিলো। ভুট্টো তার প্রদেশ শাসন করতো আর মুজিব তার প্রদেশ। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। তাহলে কেন্দ্রে কে বসবে এখানেই যত সমস্যা। পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানিদের কেন উপায়ই মূলত ছিল না।
৭ই মাচের্র ভাষণের পর পাক বাহিনির
সর্তক হওয়া উচিত ছিলো
অংযড়শ কধঢ়ঁৎ তার বিখ্যাত গ্রন্থ চধশরংঃধহ রহ পৎরংরং- এ লিখেছেন-
“...ঃযব পৎবধঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ংঢ়ধপব ড়ৎ ৎড়ড়স ভড়ৎ সধহড়বাঁৎব ভড়ৎ ইযঁঃঃড় ধহফ ইযঁঃঃড়রংস ধিং ংরফব বভভবপঃ ড়ভ ঃযব ণধযুধ বৎধ... ”
এটা ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও পরবর্তীতে এটাই পাকিস্তানের রাজনীতির প্রধান ক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় না বসিয়ে যখন ইয়াহিয়া ভুট্টো সামরিক বাহিনি জোট রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধান খুঁজতে গেলেন তখনি ঝামেলাটা বাঁধল। এটাই মোটা মাথার সামরিক শাসকদের প্রধান সমস্যা। তারা সব সময়ই রাজনীতিকে সামরিক কর্মকাণ্ডের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। অংযড়শ কধঢ়ঁৎ তার একই বইয়ে লেখেন, “...মবহবৎধষং ধৎব হড়ঃ হবপবংংধৎরষু পষবধৎ যবধফবফ ঃযরহশবৎং রহ ঢ়ড়ষরঃরপধষ পৎরংরং...”
জেনারেলদের মাথা এমনিতেই পরিষ্কার নয়। তার উপরে সেই মাথাকে আরও অপরিষ্কার করে তুলেছিলো ভুট্টোর ক্রমাগত পীড়াপীড়ি। মূলতঃ ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতাই প্রধান তাই পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্যে প্রয়োজন হলে অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানকে তার নিজের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। তার আগে সামরিক বাহিনিকে সন্তুষ্ট করার জন্যে একটা দমন পীড়নের চেষ্টা করা যাক। যতি তাতে কোন কাজ হয়। ভুট্টো জানতেন তাতে কাজ হবে না। বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে তো তিনি চাইলেও বদলাতে পারবেন না। তাহলে সামরিক আক্রমণে লাভটা কোথায়। ক্ষমতা তো তার হাতে থাকছে না। থাকছে সামরিক বাহিনির হাতে। তাহলে এই আক্রমণই বা কেন? এই প্রশ্নেরও কিছুটা সমাধান পাওয়া গেছে অংযড়শ শধঢ়ঁৎ এর লেখায়-
“...রঃ ষধপশবফ ধ ংঃৎধঃবমু ঃড় বরঃযবৎ ফরারফব ধহফ ৎঁষব ড়ৎ ঃড় ৎবঢ়ৎবংং ংঁপপবংংভঁষু...”
মূলতঃ এই প্রশ্নের সবচেয়ে চমৎকার উত্তর দেওয়া হয়েছে অংযড়শ কধঢ়ঁৎ এর এই লাইনে-
“...যবৎব ংবঢ়বৎধঃরড়হ ড়ভ ঊধংঃ ঢ়ধশরংঃধহ ধিং ঢ়ৎবভবৎধনষব ঃড় ঢ়ড়বিৎ ংযধৎরহম...”
যদি তাই হয় তাহলে ২৬৬ দিনের যুদ্ধে এতগুলো প্রাণহানী কেন? এর জবাবও আছে। জধপরংস. মূলতঃ পাকিস্তান রাষ্ট্র্রের জন্ম ধর্মের ভিত্তিতে হলেও এর প্রধান নিয়ামক ছিল জধপরংস. ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাশ্চিম পাকিস্তানিরা বিশেষ করে পাঞ্জাবি সামরিক আধিপত্যবাদীদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান কখনও পাত্তা পায়নি। তাই পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে পূর্ব পাকিস্তানিরা তাদের ধর্মীয় ভাই হলেও মূলতঃ শাসন ও শোষণের মূলে কাজ করেছে এই জধপরংস. এ প্রসঙ্গে আবারও অংযড়শ শধঢ়ঁৎ এর লাইন উলেখ করতে হচ্ছে। তিনি লিখেছেন,
ঃযব ১৯৭১ পৎরংরং রহ ঊধংঃ চধশরংঃধহ ৎবাবধষবফ ঃযব চধশরংঃধহর অৎসু’ং রিষষরহমহবংং ঃড় বহমধমব রহ মবহড়পরফব ধমধরহংঃ রঃং ড়হি ঢ়বড়ঢ়ষব; যবৎব ৎধপরধষ সড়ঃরাবং১ বিৎব রহ ঢ়ষধু ধহফ ঃযব পড়সসড়হ নড়হফ ড়ভ গঁংষরস নৎড়ঃযবৎযড়ড়ফ ংববসবফ ঁহরসঢ়ড়ৎঃধহঃ. ঞযব পৎরংরং ৎবাবধষবফ ঃযধঃ বঃযহরপরঃু ৎধঃযবৎ ঃযধহ ৎবষরমরড়হ ধিং ঃযব ফৎরারহম বষবসবহঃ ঃযধঃ যধফ ংযধঢ়বফ ঃযব নরম ফরারফব নবঃবিবহ ডবংঃ ধহফ ঊধংঃ চধশরংঃধহরং ংরহপব ঃযব সরফ-১৯৫০ং. ঞযব ১৯৭১ বাবহঃং পৎবধঃবফ ধ পৎরংরং রহ চধশরংঃধহ’ং ফড়সরহধহঃ ওংষধসরপ রফবড়ষড়মু যিরপয যধফ ড়ৎরমরহধষষু ংঃৎবংংবফ ঃযব পবহঃৎধষ ঢ়ষধপব ড়ভ ৎবষরমরড়হ রহ ঢ়ড়ষরঃরপধষ/ংঃধঃব ধভভধরৎং...”
বিভক্ত ভাবনায় দ্বিখণ্ডিত স্বদেশ
১৯৭১ সালের ২৪শে এবং ২৫শে মার্চ এই দুদিনে জনাব তাজউদ্দিন কমপক্ষে একাধিকবার শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। সাক্ষাত করেছিলেন বললে কথাটা মূলতঃ ভুল হবে। তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার অন্যান্য দিনের মতো এই দুদিন তাজউদ্দিনের দেখা সাক্ষাতের বিষয়টা একটু হলেও ভিন্ন ছিলো। কারণ আর কিছু নয়। তিনি জাতির জনকের কাছ থেকে কিছু একটা নির্দেশ আশা করেছিলেন। জাতির জনকের বিগত এক যুগের ছায়াসঙ্গী এবং প্রধান লেফটেন্যান্ট এমনটা আশা করতেই পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিশ্চুপ থাকলেন। এটা কোন অজ্ঞাত কারণে নয়। তিনি সবই জানতেন। শেখ মণিকে তিনি সব ধরনের নির্দেশ আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। তাহলে আওয়ামী লীগের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং সারা দেশবাসী এই মূল নির্দেশের বাইরে রয়ে গেল। এটা যে সত্য তার প্রমাণ আজ উজ্জ্বল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ইতিহাসের গর্ত খুঁজে খুঁজে এসব কথা আজ বের করে আনা হয়েছে। দেশি বিদেশি অজস্র লেখক ও গবেষকের লেখায় এর ভুড়ি ভুড়ি প্রমাণ মেলে। ভারতের ভুখণ্ডে বিএলএফ এর জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তখনই এই হাড্ডিসার বাস্তবতা তুলে ধরেছিল। আমরা একটা বিশেষ প্রবন্ধের চুম্বক অংশ তুলে ধরতে চাই। আহমেদ আব্দুল জামান তার প্রবন্ধ “গঁশঃর ইধযরহর ধহফ ঃযব খরনবৎধঃরড়হ ধিৎ ড়ভ ইধহমষধফবংয : অ জবারবি ড়ভ পড়হভষরপঃরহমারবংি এ লিখেছেন “...ওহফবঢ়বহফবহঃ ড়ভ ধষষ ঃযব ভড়ৎপবং ধিং ঃযব ইধহমষধফবংয খরনবৎধঃরড়হ ঋড়ৎপবং (ইখঋ) চড়ঢ়ঁষধৎষু কহড়হি ধং গঁলরন ইধযরহর. ঞযরং ভড়ৎপব, সবসনবৎরহম ধনড়ঁঃ ৫০০০, ধিং সধরহষু ফৎধহি ভৎড়স ঃযব অধিসর খবধমঁব ধহফ রঃং ংঃঁফবহঃ ভৎড়হঃ ঈযযধঃৎধ খবধমঁব, ধহফ ধিং ঃৎধরহবফ ঁহফবৎ ঃযব ফরৎবপঃ ংঁঢ়বৎারংরড়হ ড়ভ গধলড়ৎ এবহবৎধষ টনধহ ড়ভ ওহফরধহ অৎসু ধঃ উবৎধফঁহ যরষষং. ঞযব ভড়ৎসধঃরড়হ ধহফ ঃৎধরহরহম ড়ভ গঁলরন ইধযরহর ঃড়ড়শ ঢ়ষধপব ধমধরহংঃ ঃযব রিংয ড়ভ ঃযব ইধহমষধফবংয এড়াবৎহসবহঃ ধঁঃযড়ৎরঃরবং যিরপয ষবফ ঃড় ধ পড়হভষরপঃ ংরঃঁধঃরড়হ নবঃবিবহ ঃযব ঃড়ি. ঐড়বিাবৎ, গঁলরন ইধযরহর ৎবসধরহবফ ধ ঢ়ধৎঃ ড়ভ ঃযব নৎড়ধফবৎ ষরনবৎধঃরড়হ ভড়ৎপবং ধহফ ভড়ঁমযঃ ধমধরহংঃ ঃযব পড়সসড়হ বহবসু ঁহঃরষ ঃযব ষরনবৎধঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধফবংয...”
তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে মুজিব বাংলার আপামর জনসাধারণ এবং তৎকালীন কার্যকরী নেতৃবৃন্দের প্রতি আস্থাশীল হতে পারেননি। যাদেরকে নিয়ে তিনি সারাজীবন একসাথে হাঁটলেন, জন্ম-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বিশ্বাস করলেন, আওয়ামী লীগকে দাঁড় করালেন, দেশ বাসীকে একত্রিত করলেন তারাই হঠাৎ করে এতটা পর হয়ে গেল কেমন করে? তাহলে ঠিক এটাই বলতে হবে আধুনিক বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবার তন্ত্রের উদ্ভব এখান থেকেই হয়েছিল। নইলে সবার চেয়ে শেখ মণি কেন মুজিবের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলেন। মুজিবনগর সরকার এবং বিএলএফ-ই বা কেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। আমাদের মূল বিচ্ছেদের সুর মূলতঃ এখান থেকেই বেজে উঠেছিল। এই আলোচনা যত সামনে আগাবে ব্যাপারটা ততই স্পষ্ট হবে। এরপর আমরা দেখতে পাবো সেই ছোট্ট চিড় কত বড় ফাটল হয়ে দেখা দিয়েছে এবং শেষমেষ আমাদেরকে কোথায় নিয়ে গেছে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রে শেখ মুজিবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি ত্যাগ করার কথা ছিলো। কিন্তু তিনি কোন এক অজ্ঞাত টেলিফোন পেয়ে ৩২ নম্বরের বাড়িতেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন। কে সেই টেলিফোনটি করেছিলো তা আজও অজ্ঞাত। শেখ মণির দাবি এই টেলিফোনটি করেছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। শেখ মণির বিশ্বাস ছিল তাজউদ্দিনের এটা একটা কৌশল ছিলো। কারণ শেখ মুজিব গ্রেফতার হলে তিনিই নেতৃত্বের কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসবেন। পরবর্তীতে ১০ই জানুয়ারিতে শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন করলে শেখ মণি প্রথম রাতেই বিড়াল মেরেছিলেন। তিনি তাজউদ্দিনের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করেছিলেন। এখান থেকেই সমস্যার শুরু। বাংলাদেশ আর কখনোই ঐক্যের ক্ষেত্রে আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দিনের দূরত্বের সুযোগে তাহের উদ্দীন ঠাকুর, খোন্দকার মোশতাকের মতো বিতর্কিতদের কাছাকাছি নিয়ে আসে। সামরিক বাহিনির মধ্যে অস্থিরতার দ্রুত বিকাশ ঘটে। সমাজতন্ত্রীরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সবকিছু মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর চারপাশে তাকে সত্য কথা বলার মতো কেউ আর অবশিষ্ট ছিল না। নেতা পড়ে রইলেন নেতার জায়গায়। বাকিরা সবাই যে যার মতো ছুটল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। কিছুদিন পর তাজউদ্দিন আহমেদকেও বিনা নোটিশে পৃথিবী ত্যাগ করতে হলো। নিঃস্বার্থ এই মানুষটিকে কোন প্রকার সুবিধাভোগী পদে না থাকা সত্তে¡ও জেলখানায় নির্মমভাবে নিহত হতে হলো। বড় অদ্ভুত বাংলাদেশের রাজনীতি।
আমরা বিভক্তির আলোচনা দিয়ে শুরু করেছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত্রে শেখ মুজিবের গ্রেফতার হওয়া থেকে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। সমস্যা শুরু হলো শেখ মুজিবের দেশে ফেরার পর। এমনিতেই সবার আশার আলোর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন মুজিব। স্বাধীনতার পর দেশে ফেরার পর সেই আশা বহুমুখী রূপ ধারণ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রথমে প্রত্যেকেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন যুদ্ধের সময় কে কি ভূমিকা পালন করেছেন তা দেখানোর জন্যে। এর অবশ্য কারণ ছিলো। যাকে কেন্দ্র করে বাঙালির সমস্ত আশা আকাক্সক্ষা আবর্তিত সেই মহান নেতা যুদ্ধের পুরোটা সময় কারাগারে বন্দী ছিলেন। অতএব তিনি তো দেখতেই পাননি কে কি গলদঘর্ম পরিশ্রম করেছে। যাই হোক প্রথম দিককার সময়গুলো কেটে গেলো সবার সুখ দুঃখের কথা শুনতে শুনতে। তার পর যখন কিছুটা গুছিয়ে উঠলেন রহস্য ঘনীভূত হতে লাগল। ইতোমধ্যে প্রত্যেকে তার নিজের কৃতিত্ব জাহির করার পাশাপাশি অন্যের ব্যাপারেও নেতার কানভারী করার কাজটাও অত্যন্ত কৌশলে করে ফেলেছেন। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। নেতার বিরুক্তি তখন চরমে। কোথায় তিনি মাটির বাংলাকে সোনার বাংলা বানাবেন সেখানে নালিশ শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা। শেখ মুজিব অবশ্য সারা জীবন শুনে শুনে অভ্যস্ত। তার তাই ততটা সমস্যা হলো না। তিনি তার বিশাল বুকে সবাইকে জায়গা দিলেন। কামার, কুমার, মুচি থেকে শুরু করে রথী, মহারথী সবাইকে। যে তাজউদ্দিন তার জায়গা দখল করেছিল তাকেও ছোট একটা পদ দিয়ে সম্মানিত করলেন। শুধু কিছুটা বিপাকে পড়ল সমাজতন্ত্রীরা। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের যাবতীয় আন্দোলন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রীর মতো ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা উপনেতারা সফল করতেন। এমনকি মুজিবের চারপাশেও এরা ঘিরে রাখলেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। শেখ মুজিবের মন্ত্রণাদাতা রহস্যমানব সিরাজুল ইসলামের কথা না হয় বাদই দিলাম। চার খলিফা বলে স্বীকৃতরাও হালে পানি পেলেন না। সমস্যা দিনে দিনে ফাটল হতে লাগল। সমাজতন্ত্রী তাহের ভিড়ে গেলেন দারুণ দক্ষিনপন্থী জিয়ার সাথে। ইনু ঘুরতে থাকলেন ক্যান্টনমেন্টের চারপাশে। কোন সুখবর আসে কিনা। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি আর কি দরকার। শেখ মণি একাই একটা পক্ষ হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সম্ভবতঃ শেখ মুজিবের পর শেখ মণিরই একটা নিজস্ব পৃথক পৃথিবী ছিলো। আমি আস্তে আস্তে আপনাদের সেই পৃথিবীতে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবো।
জাতীয় সমস্যার জটিল আবর্তে নেতা যখন ঘুরপাক খাচ্ছিলেন তখন আন্তর্জাতিক সমস্যাও বসে ছিল না। পরাজিত আমেরিকার প্রেতাত্মা তখনও সম্পূর্ণ কার্যকর। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা তখনও পুরোপুরি সক্রিয়। ভারত ওঁৎ পেতে আছে কিভাবে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করবে। মহামতী ইন্দিরা গান্ধীর কারণে নোংরামীর মাত্রাটা ভীষণ রকমের কম হলো। তিনি নেহেরুর কন্যা। তার লম্বা নাকের মতো তার অন্তর এবং ভাবনার পৃথিবীটাও বড়। তিনি বাংলাদেশিদেরকে তাদের নিজেদের হাতে ছেড়ে দিলেন। যে দান দিয়েছিলেন তার প্রতিদান চাইলেন না। শেখ মুজিবের বেঁধে দেওয়া সময় সীমার মধ্যেই তিনি সৈন্য সামন্ত গুঁটিয়ে নিলেন। ভারতকে মোটামুটি সামলানো গেলো। কয়েকটা চুক্তিও হয়ে গেলো মাঝখান দিয়ে। সবগুলোই স্মারক চুক্তি। বাংলাদেশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু সমস্যা হলো অন্যত্র।
স্বাধীনতা যুদ্ধ একটা অনবদ্য ঘটনা। সর্বস্তরের লোকের সর্বাত্মক সহযোগিতায় এটা কত দ্রুত সম্পাদিত হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ঝামেলা শুরু হলো অন্যত্র। আমাদের বেশিরভাগ মানুষই তাদের ভেতরে যে পাকিস্তান প্রীতি পোষণ করত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সৃষ্টি অরাজকতায় তা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সবাই মুখে না বললেও বুকের ভেতর একটা কথাই ধুকপুক করতে থাকেÑ আগেই তে ভালো ছিলো। এই স্বাধীনতার কি কোন দরকার ছিলো। সামান্য দুর্যোগেই জাতি অর্ধেক হয়ে পড়ল। কারণ হয়ত ২১৩ বছরের পর পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর জাতির প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। এমনিতেই তো সব দেশে সব কালে এমন লোকের সংখ্যা ভীষণ বেশি যারা শুধু মাত্র প্রত্যশা করতে পছন্দ করে। না পেলে সমালোচনা করতে ছাড়ে না। আবার পেলেও অকৃজ্ঞ হতে সময় নেয় না।
এ ধরনের বহু সমস্যা যখন ঘনীভূত হচ্ছিলো তখন আরও সমস্যা যুক্ত হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা সদস্যরা সেনাবাহিনিতে একটা আলাদা দল হয়ে গেল। হওয়াটাই স্বাভাবিক। পাকিস্তানে আটক থাকাকালীন সময়ে তাদের দুঃখ দুর্দশা শোনার মত কেউ তো রইল না। উল্টো তাদের পদ মর্যাদা নিয়েই কথা উঠলো। ওঠাটাই স্বাভাবিক। জীবন বাজি রেখে জল, কাদায়, রৌদ্রে যুদ্ধ করা সৈনিক আর পাকিস্তানে আটক থাকা সৈনিক কি এক হলো।
সুতরাং পার্থক্য সূচিত হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককেই প্রমোশন দেওয়া হলো তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্যে। মেজররা এক ধাক্কায় হয়ে গেলো মেজর জেনারেল কিংবা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল। অসংগতি কাকে বলে। শত্র“তা এমনি এমনিই পয়দা হয়ে গেল। পদাধিকার দিয়েও যে সমস্যার সমাধান হলো তাও কিন্তু নয়। অনেককেই পদ দিয়ে সিনিয়র করে দেওয়া সত্তে¡ও পাকিস্তান ফেরত সৈনিকের চেয়ে তারা পদের দিক দিয়ে পিছিয়ে রইল। এ ক্ষত শুকোবার নয়।
সমস্যা এখানেই শুধু না। জল আরও ঘোলা হতে লাগল যখন সামরিক বাহিনির সদস্যবৃন্দরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি অস্ত্র উদ্ধারে নামল। তখন দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারাই বা ছিলো। সবচেয়ে বড় কথা কোন কিছু হলেও তারা রাজনীতির ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতো। শেখ মুজিব সবার পিতা। পিতা হয়ে সন্তানকে তো তার ক্ষমা করতেই হতো। অন্য কেউ কষ্ট পেয়ে যেতো। সমস্যা বাড়তে থাকত। গুরুতর থেকে আরও গুরুতর হতো। সামরিক বাহিনির সদস্যরা পদে পদে বাধার মুখে পড়তে থাকল। আবার সদ্য স্বাধীন দেশে যেখানে রাজতন্ত্রের বিকাশ হতে সেখানে সামাজিক বাহিনির দৌরাত্ম সাধারণ জনতা মানবে কেন। এদেশতো তারাই মুক্ত করেছে। সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করলো। সামরিক বাহিনির সদস্যের পরিবারের সদস্যরা ধর্ষণ আর হত্যার শিকার হওয়া সত্তে¡ও প্রতিকার পেলো না। ক্ষোভ বাড়তে থাকল জ্যামিতিক হারে।
এসব কিছুর মধ্য দিয়েই ১৯৭৩ সালের নির্বাচন হয়ে গেলো। আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলো। যদিও জনপ্রিয়তায় ভাটার টান ছিল তবুও নির্বাচনে তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠলো না। কিছুটা অবাক হওয়ারই ব্যাপার। অবশ্য এদেশে নির্বাচন কিংবা তার পূর্ববর্তী তারিখ কখনোই সঠিক ফলাফল দেয়নি। এটা আমাদের জাতীয় কালচারের বিষয়।
আমি বিভক্তির কথা বলতে শুরু করেছিলাম। মূলতঃ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়টা এতটা বহুমুখী ঘটনায় পরিপূর্ণ যে তা কোন কলেবরেই আনা সম্ভব নয়। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে এসে পরিস্থিতি আরও জটিল হলো। জটিলতা এতটাই ডালপালা ছাড়ালো যে মুজিবকে বাকশাল নামক জাতীয় সরকার গঠন করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হতে হলো। আসলে বাকশাল বোঝার মতো কেউ কি ছিলো।
বাকশাল গঠনের মাধ্যমে মুজিব পুরো দেশটাকে একই সুতোয় গাঁথতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফল হলো উল্টো। এটাকে বলা হলো একদলীয় শাসন। আর জাতীয় পর্যায়ে অপপ্রচার এমন একটা অসহনীয় পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল যে কিছু কিছু সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। এটাকে বলা হলো প্রচার মাধ্যমের গলা টিপে ধরা বা বাক স্বাধীনতার হরণ। আসলে দুর্জনের যুক্তির অভাব হয় না। সত্যি কথা বলতে কি বাঙালি তখন আর আগের সেই বাঙালি ছিল না। তখন সাবালক হয়ে গিয়েছিলো। তার তখন অনেক দাম।
ঘটনা মূলতঃ এখানে নয়। এর মূল ছিল অন্যত্র। একাত্তরের পরাজিত শক্তি আর তার দোসররা তখনও গর্তের ভেতর লুকিয়ে। তারা বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। যারা এতদিন ধরে কাজ করেছে তারা আর কতদিন গর্তে লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাদের বাইরে বেরিয়ে আসার সেই পরিবেশ ছিল না। সেই পরিবেশ তৈরি করার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছিলো। আর এর পিছনে দেশি বিদেশি নানা অপশক্তি নানা ছলে বলে কলে কৌশলে কাজ করছিলো। এখনও যেমন ইঙ্গ-আমেরিকান অপশক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি নস্যাৎ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় স্বার্থে আমাদের সাবধান থাকা প্রয়োজন।
যাহোক আমরা বিভক্তির রূপরেখা চিহ্নিত করতে বসেছি। তাজউদ্দিন আহমেদের প্রসঙ্গে ছিলাম। কিন্তু কথায় কথায় আমরা আমাদের মূল চরিত্র থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক গল্প হাজার মাইলের চেয়েও লম্বা।
তাজউদ্দিন আহমেদ মূলতঃ শেখ মুজিবের পর বাংলার রাজনীতির সবচেয়ে মুখ্য চরিত্র। যুদ্ধকালীন সময়ের ময়দানের অধিনায়ক। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ১৭ই এপ্রিল তার মুজিব নগরের ভাষণটি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর খুনীরা এরকম একজন নেতাকে বাঁচিয়ে রাখবেনই কেন? যদিও তাজউদ্দিন ছিলেন নির্বিষ সাপ তবুও তার মহান ব্যক্তিত্ব যে কারো জন্যই ভয়ংকর। হাতি বাঁচলেও লাখ টাকা, মরলেও লাখ টাকা। এই কথাটা তাজউদ্দিনের বেলায়ই খাটে। তাজউদ্দিনকে জাতির জনকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হলো কৌশলে। ফলাফল ভয়াবহ। একই জেলে পাশাপাশি সেলে আব্দুস সামাদ আজাদও ছিলেন। তাকে মরতে হয়নি রহস্যময় কারণে। তাজউদ্দিন আহমেদ নেগোসিয়েশনে যাওয়ার লোক নয়।
ইতিহাসের জল আপনা আপনিই গড়ায় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু না। কেউ না কেউ পেছনে বসে কলকাঠি নাড়ে। কর্নেল তাহের লেগে ছিলেন জিয়ার সাথে। দুজন ভিন্ন দর্শনের লোক। একজন সম্ভবতঃ প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে চলা লোক, অন্যজন ধর্মভীরু গতানুগতিক বাঙালি। এই অদ্ভুত মিশেল কিছু একটার জš§ দেবে এতে সন্দেহের কারণ নেই। ফলাফল আসলও তাই।
৩রা নভেম্বর বিগ্রেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে জেঁকে বসা সামরিক সদস্যদের উৎখাতের জন্যে ওঠে পড়ে লাগলেন। তার সাথে যোগ দিলেন পুরনো সুহৃদ শাফায়াত জামিল। প্রথম দিকটায় বল তার কোর্টেই ছিলো। খুনিরা দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। যাওয়ার আগে জেল খানায় চার নেতাকে খতম করে গেলেন। রক্ষী বাহিনি প্রধান নূরুজ্জামান এবং সেই সাথে শাফায়াত জামিল এবং বিপ্লবের মূল কাণ্ডারী খালেদ মোশাররফ মারা গেলেন নির্বোধের মত। সিপাহী জনতার যৌথ শক্তি প্রতিবিপ্লবের নামে একটা বিকৃত শিশুর জš§ দেয়। বাংলাদেশ ভিন্ন পথে হাঁটতে থাকে। সমাজতন্ত্রীরা যে আশায় বুক বেঁধে ছিল তাদের সে আশা অর্থহীন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পথ হারায় চোরাবালিতে। ইসলামপন্থীরাও আশায় বুক বেঁধে ছিলো। কিন্তু জিয়াউর রহমান সম্ভবতঃ সবচাইতে বেশি ঘৃণা করতেন জামায়াত ইসলামকে। জামায়াতে ইসলামের ইসলাম তার কাছে ইসলাম ছিল না। তিনি পুরনো পথ ধরেই হাঁটলেন। মূলতঃ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশই তিনি চেয়েছিলেন। তবে এদেশে ইসলাম প্রধান্য পাবে এটা ছিল তার প্রধান চাওয়া। একজন মুসলমান হিসেবে এটা চাওয়া তার জন্য অন্যরকম কিছু নয়। কিন্তু তিনি তার সেই কথা ধরে রাখতে পারেননি। ২২টি ক্যু সামলাতে গিয়ে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেন। শেষমেষ এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে মারা পড়েন। দায় পড়ে গিয়ে মঞ্জুরের উপর। মঞ্জুরও মারা পড়েন তখনই। মাঝখান দিয়ে লাভবান হন এরশাদ। এরশাদই সবেচেয়ে ভালো জানেন মূলতঃ দায়ি কে? সে না মঞ্জুর। যদি এরশাদ দায়ি না হন তাহলে তাকে ভাগ্যবান বলতে হবে। অন্যের প্রস্তুত করা ক্ষেত্রে তিনি ফসল তুলেছেন। এরশাদ অবশ্য দাবি করেছেন তার হাতে রক্তের দাগ নেই।
পথ চলতে চলতে একটা ভিন্ন মাত্রা আসে ১৯৮১ সালে যখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন। সত্যিকারের দেশপ্রেমিকরা যেন হলে পানি পান। তবে তার আগমনেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিলো তা কিন্তু নয়। বিগত ৩৬ বছর তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। সে এক ভিন্ন ইতিহাস। আমরা সেই পথে যাবো না। আমাদের আলোচনা বিভক্তির রূপরেখা আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
খুনীরা আলাদা বিমান যোগে দেশ ত্যাগ করলো। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসলেন। সবাইকে ক্ষমা করা হলো। কিন্তু ক্রাচের কর্নেলের ব্যাপারে তিনি অনড়। তাকে ক্ষমা করা যাবে না। অনেক অনুরোধ করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী বীর, আহত মুক্তিযোদ্ধা, খেতাবপ্রাপ্ত, দেশপ্রেমিক, প্রতিভাবান, জন্ম যার দেশকে সার্থক করার জন্য এমনি কত কথা। কিন্তু জিয়া অনড়। সবার ব্যাপারে তিনি নমনীয় হতে রাজি। কিন্তু নো মার্সি ফর তাহের। তাকে ঝুলতে হবে। জিয়ার পালনকর্তা তিনি। সেই জিয়ার হাতেই তাকে মরতে হলো। অসম্ভব কিছু না। ইতিহাসে এরকম আরও মানুষ আছে।
আসলে নিয়তির নির্মম পরিহাস। তাই পেছনে যেতে হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ইংরেজ বিদায় নিলো। আমরাই আমাদের রক্ত আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ ভাগ করলাম। এটাকে জঘন্য ঘটনাই বলতে হবে। যেটা ইংরেজদের করার কথা ছিল সেটা আমরা করলাম বললে ভুল হবে। জঘন্য ভাবে করলাম।
ভেবেছিলাম দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত হলো। কিন্তু না। সিন্দাবাদের ভূত এতকাল দূরে ছিলো। দূরে বসে ভয় দেখাচ্ছিল। এবার ঘাড়ে চেপে বসল। ১৯৫৪ সালে এসে প্রাদেশিক নির্বাচনের আয়োজন হলো। তাও সেই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ তে এসেও পাকিস্তান তার নিজের সংবিধান পেল না। অবাক করার ব্যাপার।
যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকলো না। টিকবে কেমন করে। কেন্দ্রেই তো কোন শৃঙ্খলা ছিল না। রাজনীতিতে শৃঙ্খলা না থাকলেও এমনটাই হয়। যা হোক শেষ মেষ ১৯৫৫তে এসে সংবিধান যাও হলো তাও ঠিক নামমাত্র। সংখ্যাসাম্য নীতিতে গড়া সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অগ্রাহ্যই রয়ে গেল। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা হয়ে রইল অধরা মাধুরী। তরপর আর হালে পানি পায়নি বাঙালিরা। বরং জুটেছে সামরিক শাসকের নির্যাতন। এখানে বলে রাখা ভালো ১৯৫৫র সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন বাঙালি যার নাম ছিল ইস্কান্দার মির্জা। কিন্তু ফলাফল কিছুই হয়নি। ১৯৫৮তে এসে আইয়ুব খান প্রমাণ করলেন পাঞ্জাবিরাই সেরা। তারাই রাজ করবে। চাষার ছেলে শেখ মুজিবকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠেই কাটাতে হলো বেশির ভাগ সময়। বিভক্তির রূপরেখা তো আর একদিনে চিত্রিত হয়নি। মুসলিম লীগের সবচেয়ে নিবেদিত প্রাণ কর্মী শামসুল হককে মুসলিম লীগের জেল জুলুমের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত পাগল হতে হয়েছিল। রাজনীতি কখনও দুশ্চরিত্রা রমণীর চাইতেও জঘন্য।
বাংলার রাজনীতিতে বিভক্তির ইতিহাস অনেক পুরনো। যে আলীবর্দি খাঁকে মুর্শীদ কুলী খান আশ্রয় দিয়েছিলো সেই আলীবর্দি খাঁ-ই তার বংশধরদের জগৎশেঠ, রায় দুর্লভদের সহযোগিতায় ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। পরবর্তীতে আবার তার-ই নাতি সিরাজউদ্দৌলাকে মীর জাফর সেই জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদের সহযোগিতায় ক্ষমতাচ্যুত করেন। অবশ্য পেছনে ইংরেজদেরও হাত ছিলো। মীর জাফরের লাভ না হলেও ইংরেজরা ১৯০ বছর রাজ করেছিলেন।
অবশ্য মীর কাসিম বুঝতে পেরেছিল বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। তাইতো ইংরেজদের পুতুল নওয়াব হওয়া সত্তে¡ও বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি বেঁকে বসেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ততদিনে তীর ধনুক থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। তাকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বাংলার শাসনভার চলে গিয়েছিল পুরোপুরিভাবে ইংরেজদের হাতে। অবশ্য ইংরেজরাও এর জন্যে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা করেন। সেই মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারের করুণা লাভের মধ্য দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু। তার পর কত চড়াই উৎরাই। শেষমেষ আলোর দেখা মিলল। না। সরাসরি ব্রিটিশ রাজের নয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। অবশেষে ১৮৫৭তে এলো সরাসরি ব্রিটিশ রাজ। একেবারে কম দীর্ঘ পথ নয়। কয়েক হাজার পৃষ্ঠার ইতিহাস। এখানে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক।
আমরা মূলতঃ বিভক্তির রূপরেখা নিয়ে কথা বলছিলাম। কিন্তু এই বিভক্তির রূপরেখার ভেতরে শুরু থেকেই পরিবার তন্ত্রের গন্ধ লুকিয়ে ছিলো। সেই কথা দিয়ে মূলতঃ আলোচনার সূত্রপাত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাঁচা হাতের নাজুক কলাম এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। চলে যায় প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে। সবচেয়ে বড় কথা অতীত থেকে কিন্তু সবসময় সবকিছু তুলে আনা সম্ভব হয় না। মানুষ মাত্রই সীমাবদ্ধতার অধীন। আমিও এর বাইরে নই।
একবার শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নেতা, আপনি কি আপনার কোন উত্তরাধিকার চিন্তা করে রেখেছেন। কে হতে পারে আপনার পরবর্তী কাণ্ডারী? আপনার কোন সহকর্মী? কোন জুনিয়র? পরিবারের কেউ? মুজিব হেসে বলেছিলেন, সময়ই নির্ধারণ করবে কে হবে সেই লোক। যোগ্য উত্তর। কিন্তু তিনিও ভুল করলেন। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রের তাণ্ডবে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য কাকে বেছে নিলেন তা তার কাছের মানুষগুলোও জানতে পারলো না। ধুম্রজালের সৃষ্টি ওখান থেকেই। সেই রাতেই আওয়ামী লীগের কোন নেতাই পরবর্তী কর্মসূচির কোন চূড়ান্ত নির্দেশ পাননি। অথচ মুজিব আসন্ন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতেন। এর প্রমাণ পরবর্তীতে শেখ মণির কথাতেও পাওয়া যায়। তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হলে শেখ মণি বলেছিলেন, কে তাকে এই দায়িত্বের জন্য মনোনীত করেছে।
তাত্তি¡ক বিশ্লেষণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম
১৯৭১ সালের যুদ্ধ আমাদের এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছিলো যখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো কারা এ দেশের সত্যিকারের আপনজন আর কারা পর। সত্যি কথা বলতে কি এরকম একটা পরিস্থিতির প্রয়োজন ছিলো। নইলে কোনদিনই এই দুটো স¤প্রদায়কে চিহ্নিত করা সম্ভব হতো না। যুদ্ধ আমাদের মাঝে এই সীমারেখা টেনে দিয়েছিলো।
ভাবতে অবাক লাগে সেদিন যারা অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল বিগত ৪৫ বছর ধরে তারাই বেশিরভাগ সময় রাজত্ব করেছে। হয়তো আগামীতেও করবে।
যদি সেদিন তারা চিহ্নিত না হতো তাহলে এই সব লোকগুলো আমাদের ভিতরেই এমন ভাবে মিলেমিশে থাকতো যাদের কখনোই সনাক্ত করা যেতো না। ছদ্মবেশী এইসব মানুষগুলো আজীবন এই দেশের শিকড় কেটে আগায় পানি ঢালতো। কিন্তু বোঝার কোন উপায় ছিল না। অবশ্য বুঝেও বা কী লাভ হলো। ৪৫টি বছর একটা ঘোরলাগা সময় পার করলাম আমরা। আর চিহ্নিত সেইসব লোকগুলো আমাদের চোখের সামনেই ঘোলাজলে মাছ শিকার করলো।
যুদ্ধের মধ্যে ধ্বংস অনিবার্য সত্য হিসেবে বরাবরই ছিলো। তবুও ঐ ধ্বংসাতœক যুদ্ধই অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব এনে দিয়েছে। জাতি অন্ততঃ তার আপনজনদের চিনতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় কথা বিভ্রান্ত সময় পার হলেও আজ আলোর দেখা মিলছে। সেদিন সেই যুদ্ধ সংগঠিত না হলে এটা হয়তো কোনদিনও সম্ভব ছিল না।
আমরা বারাবরই কলহ প্রবণ। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সব কলহ কোন তাৎপর্য বহন করে না। কারণ একটাই। বাঙালি জাতি হিসাবে বরাবরই ভঙ্গুর প্রকৃতির। আবেগ তাড়িত। অর্থহীন স্বপ্ন দেখা আমাদের বৈশিষ্ট্য। অযৌক্তিক প্রত্যাশা আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা আমাদের বেশির ভাগ লোকই শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে অসুস্থ। বিশ্বের যে কোন অঞ্চলের তুলনায় এই হার এই অঞ্চলে তীব্র। তবুও আমরা নির্বিকার। কারণ আমরা জানিও না যে আমরা সংকটের মধ্যে আছি। সামান্যতে উত্তেজিত। সামান্যতেই নির্বাপিত। বড় অদ্ভুত লাগে।
১৯৭১ সালে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হয়েছিল। ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ৯ বছরও লাগতে পারতো। দীর্ঘ মেয়াদি একটা গণযুদ্ধ হতে পারতো। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, ভারতের সহযোগিতা, পাকিস্তানের দুই প্রান্তের দূরত্ব, পাকিস্তানি সৈন্যদের আমাদের এলাকায় অনভ্যস্ততা, সর্বোপরি ২৫ মাচের্র কালো রাতের গণহত্যা, ক্রমাগত নিরপরাধ মানুষদের হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো বিকৃত বিষয়গুলো আমাদের যুদ্ধ জয়কে অতিমাত্রায় ত্বরান্বিত করেছিলো।
বেশির ভাগ লোকের ধারণার বাইরে ছিল বিষয়টা। বিশেষ করে ডিসেম্বরের ৪ তারিখের পর থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত এই সামান্য সময়টুকুতে ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে যে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছিলো তা পাকিস্তানের পরাজয়ের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিলো। তারা চাইলেও আর পরাজয় এড়ানোর উপায় ছিল না।
পাকিস্তানিদের সেই চিরাচরিত স্বার্থপরতা তাদের যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিলো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যদি সর্বাত্মক সহযোগিতা সময়মত করা হতো তাহলে হয়তো এখানে অবস্থানরত তাদের বাহিনি আরও কিছুদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু ইতিহাস বলে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় তারা পরাজয় মেনে নিয়েছিলো।
জেনারেল নিয়াজী তার অসহায় অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ৯০ হাজার সৈন্যদের স্ত্রীকে অযথা বিধবা করতে চাননি। কারণ যেখানে তিনি নিশ্চিত পূর্ব পাকিস্তান বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে তখনি একটি পরিত্যক্ত বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে সেখানে তিনি অযথা কেন ঝুঁকি নেবেন। ইতিহাসে এসবের সাক্ষী রয়ে গেছে।
যুদ্ধের পঠভূমি লেখা হয় মৃত্যু, ত্যাগ আর বীরত্বের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ এর যুদ্ধে এর সব উপাদানই ছিলো। আজও ভেবে পাই না এই অদ্ভুত সময় পার করা মানুষগুলো বিজয় অর্জনের পর আমূল বদলে গেলো। স্বার্থপরতার হানাহানিতে এমন ভাবে লিপ্ত হলো যে সেই সুযোগে সুবিধাবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। ছিনিয়ে নিলো বিজয়ের মাহাত্ম্য। তার পর একে একে সবকিছু বদলে দিতে লাগলো যাদুকরী সব কথার ফুলঝুড়িতে। তারা এটাই প্রমাণ করে ছাড়লো যে তারাই এদেশের প্রকৃত বন্ধু।
চোখ থাকতেও অন্ধ, হীনমনা, ঔপনিবেশিক শাসনের যাতাকলে পিষ্ট দাসের জাত আমরা। আমাদের আচরণ এর চেয়ে ভালো কি হবে।
দেশের জন্য যুদ্ধ করাকে আমরা যেভাবে একটা সুসংগঠিত কাজ মনে করেছিলাম দেশ গড়ার কাজকে আমরা ঠিক সেভাবে নিতে পারিনি। আমরা মনে করেছিলাম শুধু যুদ্ধের ময়দানেই আমাদেরকে সংগঠিত হয়ে লড়াই করলে চলবে। কারণ সেখানে চিহ্নিত বিদেশি শত্র“রা রয়েছে।
অথচ ভুলটা ছিল এখানেই। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যতটা না ক্ষতি করতে পেরেছিলো তার চেয়ে বেশি ক্ষতি সংগঠিত হয়েছিল পরবর্তীতে শান্তির সময়ে। আমরা দারুণভাবে পরাজিত হয়েছিলাম আমাদের ঘরের শত্র“র কাছে।
ইতিহাসে এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী আছে। কিন্তু আমরা সেখান থেকে কোন শিক্ষা নেইনি। ভুল পথে পা বাড়িয়েছি।
কেউ যে ভুলের ঊর্ধ্বে নয় তাও ভুলে গিয়েছিলাম। পরিণতি খুব একটা ভালো হয়নি। সময় আর পরিস্থিতি কাউকে ক্ষমা করে না। তা সে যত বড় মানুষই হোক না কেন। ভুলের স্রোতে অনেক অর্জন আর সাফল্য খড়কুটোর মতো ভেসে চলে যায়।
কেউ কেউ বলে ভালবাসা দিয়ে সবকিছু সম্ভব। দেশ চালানোর জন্যে একমাত্র কৌশলই কাজ করে। ভালবাসাকে বুকের মধ্যে রাখতে হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল। আমাদের জন্যে খুব বেশি বড় সময় না হলেও শুরু করার জন্যে তা যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু আমরা সেই শুরুটাই করতে পারিনি।
জ্বর সারাবার জন্য কুইনাইন লাগে। কুইনাইন যে তেতো তা শিশু মাত্রও জানে। আমরা সেই সত্যটা অস্বীকার করেছিলাম।
আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার জন্য ধমের্র বর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান। আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও মুসলমান। এই পদ্ধতি কতটা কাজ করবে তা ভাববার অবকাশ আছে। আওয়ামী লীগকে যদি মোকাবেলা করতেই হয় তাহলে তা রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। তার চেয়ে ভাল রাজনীতি করে দেখাতে হবে। তার চেয়ে ভাল উন্নয়ন করে দেখাতে হবে। প্রতিশ্র“তি পূরণ করে দেখাতে হবে। একজন ধর্মযাজককে সবার আগে প্রমাণ করতে হবে যে সে একজন ভালো মানুষ। অন্যথায় তার বাণী কেউ নেবে না। বিভ্রান্ত প্রজন্মের সামনে আজ আরও বেশি বিভ্রান্ত রাজনৈতিক দল এবং তার মতবাদ। গণতন্ত্রের সামনে তাই গাঢ় অন্ধকার। ভালো প্রতিপক্ষ ছাড়া গণতন্ত্রের স্বপ্ন এবং পথচলা দুটোই অর্থহীন।
জিয়াউর রহমান কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থার খুব একটা পরিবর্তন করেননি। সমাজতন্ত্রীদের কথা তিনি কানে তোলেননি। জামায়াতে ইসলামীর দর্শনও তিনি নেননি। বরং সমাজতন্ত্রীদের চাইতে জামায়াতে ইসলামকে বেশি অপছন্দ করতেন। এসব সত্য আজ চাপা দেওয়া হচ্ছে। জামায়াতকে বিএনপির সাথে জুড়ে দিয়ে একটা জগাখিচুড়ি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। রাজনীতি জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য নয়। বরং রাষ্ট্র এবং তার দর্শন সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে পরিষ্কার করার জন্যে।
বেশিরভাগ ধর্মভীরু লোকই বসে আছে এরা তাদের জন্যে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা নিয়ে আসবে। ইহকালে কল্যাণ ও পরকালের মুক্তির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তারা জানে না ইসলাম কোন হাইব্রিড গাছের ফসল না। এটা একটা একক এবং মৌলিক বৃক্ষের ফল। ইসলামী আন্দোলন এবং আজকের রাজনৈতিক দর্শন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। আমরা সবাই জানি কিভাবে ইসলামী শাসন কায়েম হতে পারে। কোরআন এবং হাদিসে এসব কথা সবই লেখা আছে। কুরআন স্বব্যাখ্যায়িত ধর্মগ্রন্থ। এর ব্যাখ্যার জন্যে যদু মধুর কাছে যাওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু আমাদের সমস্যা অন্যত্র। আমাদের বুকে সেই বল নেই। সেই সৎ সাহস নেই। ধমের্র পক্ষে কথা বলার।
কারণ একটাই। প্রথম যে শর্ত মুুসলমান হিসেবে আমাদের লেবাস তা-ই ঠিক নেই। আমরা দাড়ি রাখতে অস্বস্তি বোধ করি। মাথায় টুপি পরি না অসুন্দর আর আনস্মার্ট লাগার ভয়ে। আমাদের পক্ষে আর সামনে এগোনো সম্ভব না। যে মানুষ তার ইসলামী দর্শনের প্রথম ধাপ অর্থাৎ মুসলমান হিসেবে তার লেবাসকেই ঠিক করতে পারলো না তার মতো ছদ্মবেশী, বর্ণচোরার পক্ষে ইসলামী মুজাহিদ হওয়া কতটুকু সম্ভব। সেই প্রশ্নের উত্তর একজন খ্রিস্টান, ইহুদি কিংবা নাস্তিকও ভালো জানে। অথচ আমরা এটা নিয়ে তামাশা করছি। ছেলেখেলা মনে করছি।
আওয়ামী লীগের সমালোচকের অভাব নেই। প্রায় ৭০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে দলটি এদেশের মানুষের প্রয়োজনে যতটুকু পাশাপাশি দাঁড়াতে পেরেছে তার সিকিভাগও কি অন্যরা কেউ পেরেছে। এ দেশের মাটিতে যে কোন কিছু বাস্তবায়ন করা একমাত্র তাদের পক্ষেই সম্ভব। তা সে সমাজতন্ত্রই হোক, গণতন্ত্রই হোক, উন্নয়নই হোক কিংবা ইসলামী শাসন ব্যবস্থাই হোক।
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের গায়ে ধর্ম বিদ্বেষীর তক্মা লাগিয়ে ফায়দা অর্জনের দিন শেষ। আওয়ামী লীগ কোন ধর্ম বিদ্বেষী সংগঠন নয়। বরং সকল ধমের্র প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি দল। এখন তাকে দিয়েই ইসলামকে এগিয়ে নিতে হবে। এটা বোঝার বিষয়।
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে ভারত ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান নামে যে দুটো রাষ্ট্র তৈরির ধারণা কাজ করছিলÑআমাদের উপমহাদেশের আলেমদের কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ তা কখনো সমর্থন করেনি। এই জন্যেই তারা মুসলিম লীগের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলো। তেমনি ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সকল ধর্মের সমান গুরুত্ব তাদেরই মতবাদ। অথচ আজ এসবের ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে অতিক্রম করতে হলে তার চেয়ে ভালো কিছু করেই তা করতে হবে।
দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। আমরা প্রায়শই অনেককে ঈমানের বুলি আওড়াতে দেখি। এসব লোকগুলোই সর্বক্ষেত্রে দেশ ও জনগণের সব ধরনের হক নষ্ট করেছে। মুখে ভাল ভাল বুলি আওড়িয়ে মানুষকে খুব বেশি দিন ধোকা দেওয়া যায় না। কাজের মাধ্যমেই সেই পরিচয় দিতে হবে।
দেশ ও তার মানুষের জন্য সত্যিকার অর্থে কিছু ত্যাগ করা কঠিন। আপন জীবন, সম্পদ আর স্বার্থ ত্যাগ করে যারা দেশ ও জাতিকে মুক্ত করেছিল তাদেরকে যেন আমরা ভুলে না যাই।
অতীত ভুলে যাওয়া কোন জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। ইতিহাস বিস্মৃত জাতি খুব বেশি দূর যেতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা অনেকেই বলে ইতিহাস চর্চা কী আমাকে অন্ন বস্ত্র দেবে। এতটুকু বলতে পারি ইতিহাস কাউকে অন্ন বস্ত্র না দিতে পারলেও ইতিহাস আমার আপনার জন্য অন্ন বস্ত্রের যে ব্যবস্থা করেছে তাকে ভুলে গেলে তাও হারাতে হবে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই স্বাধীন ভূখণ্ড আপনা আপনি অর্জিত হয়নি। তার জন্যে রক্ত দিতে হয়েছে।
সমস্যা এখনো তার গোড়াতেই রয়ে গেছে। ভাশুরের নাম আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা কেউই তা মুখে আনতে চাইছি না। বিরুদ্ধবাদীরা আজও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ফলশ্র“তিতে বাংলাদেশের জন্মকে মেনে নিতে পারে না। তাহলে অন্যান্য আলোচনায় লাভ কি। আলোচনার শুরুতেই গলদ।
আলাহরÑ একত্ববাদকে মেনে না নেওয়া পর্যন্ত যেখানে একজন লোক মুসলমান হতে পারছে না সেখানে তাকে হাজারো ইসলামী আহকাম শেখানো কি কোন কাজে দেবে। বাড়তি আলোচনা। শুধু শুধু কালক্ষেপণ মাত্র।
বিরুদ্ধবাদীদের অনেকেই রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। এটা মোটেও ভাল কথা নয়। আবার আওয়ামী লীগও যদি এই বিরোধীতাকে পুঁজি করে রাজনীতি করে তাহলে তারাও ভুল করবে। মনে রাখতে হবে ইঁদুরের সাথে খেলা করতে করতে হাতির পা-ও গর্তে পড়তে পারে। তাতে ইঁদুর যতই ভুল করুক আর নাচানাচি করুক। প্রত্যেককেই তার নিজের ভুলের মাশুল আলাদা আলাদা গুনে গুনে দিতে হয়। কেউ কারো দায়ভার নেয় না।
বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এরা অর্থবিত্ত, সুযোগ-সুবিধা কিংবা ক্ষমতার ভার সহ্য করতে পারে না। তারা যেন আজীবনের শুষ্ক একখণ্ড জমি যাতে সামান্য একটু পানির ছোঁয়া লাগলেই তা ফুলে-ফলে শোভিত হয়ে ওঠে। এই অবস্থার পরিবর্তন যতদিন না হবে জাতির মুক্তি বড়ই কঠিন। সব রাজনৈতিক দলই এই সুযোগ নেবে। একটা কথা সব সময় মাথায় রাখতে হবে প্রজ্ঞা আর প্রাপ্তি কখনও এক সাথে চলতে পারে না। অর্থ বিত্ত আর খ্যাতি মানুষকে লোভী আর ভারি করে তোলে। তখন তার বুদ্ধিমত্তা লোপ পায়। সে শেখানো বুলি বলে। এইভাবেই সে নিজেকে বিক্রি করে। সবকিছুকেই নিজের অজান্তে জায়েয করে ফেলে। মানুষের নিকৃষ্ঠতম আচরণগুলোর মধ্যে সম্ভবতঃ এটি একটি। আমি নিজেও এর বাইরে নই। এর থেকে মুক্তি দরকার।
প্রত্যক্ষ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দেশকে গড়ে তোলা কোন অংশে কম বড় যুদ্ধ নয়। যুদ্ধকালীন আবেগকে পরবর্তীতে প্রেরণায় রূপান্তরিত করা উচিত ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে তার উল্টোটা হয়েছে।
সবাই যার যার মতো করে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছিল। ফলাফল ভালো কিছু হয়নি।
রাজনীতির সন্ত্রাসীকরণ দলগুলোর একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। লাঠির মোকাবেলা লাঠি দিয়ে করতে হয়। এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু যে হাতগুলো লাঠি ধরবে সেই শরীরে যে মাথাটা আছে তাতে যদি ভালো কিছু না থাকে লাঠির প্রয়োগ কখনোই সুফল আনবে না। ১৯৭১ সালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা অস্ত্র ধরেছিল বলেই ৯ মাসে দেশকে স্বাধীনতা এনে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সন্ত্রাসীদের পরিচালিত কোন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নয়।
বিগত ৪৫ বছর ধরে সত্যিকারের মেধাবী মানুষগুলোকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। আমাদের জাতির সবচেয়ে কোমল এবং অনুভূতিপ্রবণ জায়গাটায় আমাদের এভাবে আপোষ করা ঠিক হয় নি। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ ইসলামী ভাবধারায় উজ্জীবিত। আধুনিকতার নামে ধর্মহীনতা কিংবা নাস্তিকতা এখানে কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কখনো পাবেও না। দল মত নির্বিশেষে এই শিকড়ের প্রশ্নে সবাই এক মত। তাই এ ধরনের কালচারের প্রশ্রয় দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। যারা এরা সাথে জড়িত তাদেরও বোঝা উচিৎ যে এমন কিছু করা উচিৎ নয় যা অন্যকে উত্তেজিত হতে উৎসাহ দান করে।
ইসলাম বরাবরই একই রকম। যুগের সাথে সাথে এর কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং সব যুগের সব কালের জন্যই এটা সময়োপযোগী। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে ইসলাম যা ছিল এখনও তা-ই আছে। কালের বিবর্তনে এর কোন কিছুর পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন হয়নি। এটা কোন মানব রচিত বিধান নয়। আলাহর পাঠানো দ্বীন। আলাহরÑবিধানের পরিবর্তনের আপনি কিংবা আমি কে। একে মেনে নিতে হবে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলাম কিভাবে আসতে পারে এটা ভাববার বিষয়। আমার তো মনে হয় প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই ইসলামী অনুশাসন কায়েম হওয়া সম্ভব। কারণ বাংলাদেশ কোন বিধর্মীদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র নয়। তবে কিছু বিষয় গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। প্রথমেই দেখতে হবে রাষ্ট্র কী ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করছে কি না কিংবা এ ধরনের কোন আইন পাশ করছে কি না। যদি তা না করে তাহলে চেষ্টা করতে হবে ধীরে ধীরে অধিকতর ইসলামী আইন বা বিধানের প্রচলন করার। প্রচলিত ব্যবস্থাকে রাতারাতি বদলাতে হবে এমনটা ভাববার কোন কারণ নাই।
রাসুল (সাঃ) আরব সমাজ থেকে আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য বিষয়গুলো দূরীভূত করেছিলেন। আমাদের সেটাই করণীয়। কোন সরকার যদি ইসলামের সাথে বিপরীতমুখী কোন পদক্ষেপ হাতে নেয় তবে তা প্রতিহত করাই ঈমানী দায়িত্ব। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমরা যেন কাউকে ইসলাম বিদ্বেষী কিংবা ইসলামের অন্ধ সমর্থক বলে চালিয়ে না দেই।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির উত্থান
১৯৪৭ সালে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন :
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের জন্মের পর অক্টোবর মাসে টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেবকে আহবায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক যুব সংগঠন গঠিত হয়। এর কার্যালয় স্থাপন করা হয় ঢাকার ৫০ নম্বর মোঘলটুলির কর্মী শিবির অফিসে। এই গণতান্ত্রিক যুবলীগের ইংরেজি নাম ছিল ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগ। এই কমিটির যুগ্ম আহবায়ক হয়েছিলেন রাজশাহীর আতাউর রহমান। যিনি পরবর্তীতে একজন ন্যাপ নেতা ছিলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধুরী, সিলেটের তোছাদ্দেক হোসেন ও দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম প্রমুখ প্রগতিশীল যুবকর্মী। ১৯৪৭ সালে কলকাতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের কনভেনার ছিলেন মিস কানুনগো। এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের নবগঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগকে আহবান করা হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের পক্ষ থেকে বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্ব কলকাতায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে একটি ডেলিগেশন বা প্রতিনিধিদল যোগদান করে।
কলকাতার সম্মেলন শেষে গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ঢাকায় ফিরে এসে কলকাতা সম্মেলনের অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্ত বর্ণনা করেন। উলেখ্য, এই কলকাতা সম্মেলনে যোগদানকারী গণতান্ত্রিক যুবলীগ নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী পরবর্তী কর্মময় জীবনে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি রাজনৈতিক মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরে একজন মৌলবাদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অতঃপর যুবলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়। তখন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের খাজা নাজিমুদ্দিন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগ সংগঠনকে খাজা নাজিমুদ্দীনের মুসলিম লীগ সরকার মুসলিম লীগ বিরোধী কার্যকলাপের দায়ে রাজনৈতিক জুলুম, নির্যাতন, গ্রেফতার ও ধরপাকড় শুরু করে। মুসলিম লীগ সরকার গণতান্ত্রিক যুবলীগকে কমিউনিস্ট বলে আখ্যা দেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগের আহবায়ক শামসুল হক ও যুগ্ম আহবায়ক আতাউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগ ও কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখে। প্রকাশ থাকে, পাকিস্তানের জন্মের পর মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তানে কম্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারের নির্যাতন ও জুলুমের দরুন নবগঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগ বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। ফলে এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন :
অসা¤প্রদায়িক গণতান্ত্রিক যুবলীগ মুসলিম লীগ সরকার চালাতে না দেয়ার কৌশলগত কারণে যুক্তবাংলায় আবুল হাশিম সাহেবের অনুসারী কতিপয় ছাত্র ঢাকায় মিলিত হয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকার ফজলুল হক হলে পর্বূ পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামকরণে একটি ছাত্র সংগঠন গঠন করা হয়। যারা গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করেছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ছাত্র দিনাজপুরের নাইমুদ্দিন আহম্মেদকে এই নবগঠিত ছাত্র সংগঠনের আহবায়ক করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধুরী, ময়মনসিংহের খালেক নেওয়াজ, কুষ্টিয়ার আজিজুল হক, পাবনার আব্দুল মতিনসহ অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে সা¤প্রদায়িক থাকলেও কর্মসূচিতে অসা¤প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন ছিল। উলেখ্য, যারা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে তারা যুক্ত বাংলায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন। দেশ বিভাগের পর খাজা নাজিমুদ্দিন আকরাম খান গ্র“পের ছাত্রলীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান ঢাকায় এসে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামকরণে নিজেকে এই ছাত্র সংগঠনের সম্পাদক ঘোষণা করেন। শাহ আজিজুর রহমান এই নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠন মুসলিম লীগ সরকারের সমর্থন হিসেবে এই সংগঠন পরিচালনা করেন। অন্যদিকে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ মুসলিম লীগ সরকারের দুর্নীতি ও গণবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করতে থাকে। শাহ আজিজুর রহমান মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সুবাদে সিলেটের আব্দুস সামাদ তার ছাত্র সংগঠন নিয়ে মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার গণবিরোধী কার্যকলাপের সমর্থন দিতে থাকেন। এর ফলে এই নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগকে সরকারি দালাল ছাত্রলীগ বলা হতো।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের মাধ্যমে আমরা প্রথম ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ বাংলা রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করি। উলেখ্য, এই সময় ইউনাইটেড পার্টির কুমিলার ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি গণপরিষদে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তখন কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন। ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির সমর্থনে পূর্ব বাংলায় এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের উদ্যোগে ঢাকায় এই রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করতে গিয়ে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান ও নোয়াখালীর নির্দলীয় ছাত্র মোহাম্মদ তোহা প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিবস পালন করার উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে খুলনা ও বাগেরহাটে রওয়ানা দেন সবাই। বাগেরহাটে ১১ই মার্চ বাংলা রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে বাগেরহাট কো অপারেটিভ ব্যাংকের সম্মুখের মাঠে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বক্তৃতা করা হয়। অতঃপর সবার সম্মতিক্রমে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি গৃহীত হয়ে সভার কাজ শেষ হয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের পশ্চাৎ ভূমিকা :
১৯৪৮ সালের ১৯ শে মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আগমন করেন। ২১শে মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে এক নাগরিক সংবর্ধনায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুলাহর পুত্র নবাব হাবিবুলাহ। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্সে এই অভ্যর্থনা সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
এরপর ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আবদুল মতিন ও এ কে এম আহসান সহ কতিপয় ছাত্র জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার প্রতিবাদে নো, নো বলেন।
১৯৪৮ সালের ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল জিন্নাহ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই প্রতিনিধি দলে জগন্নাথ হলের দুইজন হিন্দু ছাত্র প্রতিনিধি ছিলেন। জিন্নাহ এই সাক্ষাতের পূর্বে ডাকসুর সহ-সভাপতি অরবিন্দ ঘোষ হিন্দু হওয়ার অজুহাতে তাকে সাক্ষাতের সুযোগ দেননি।
জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে যারা সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন অছাত্রও ছিল। তারা হচ্ছেন কমরুদ্দিন আহমেদ, টাংগাইলের শামসুল হক, আজিজ আহমেদÑএ তিনজন পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ভিপি এসএম হল (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) নাইমুদ্দিন আহমেদ আহবায়ক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। শামসুল আলম, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তোয়াহা, অলি আহাদ, লিলি খান (নির্দলীয়) ও আবুল কাশেম (তমদ্দনু মজলিস) এই প্রতিনিধিদল জিন্নাহকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানায়। যেহেতু
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষী অঞ্চল পূর্ববঙ্গ।
জিন্নাহ সাহেব মুসলিম ও ইসলামের দোহাই দিয়ে উর্দু পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানায়। অবশেষে প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে একটি স্মারক লিপি প্রদান করেন। সেখানে উলেখ থাকে দুনিয়ায় অনেক রাষ্ট্র্রে একাধিক রাষ্ট্রভাষা রয়েছে। জিন্নাহ সাহেব এই তথ্যে তাঁর গায়ের জোরে উড়িয়ে দেন। এছাড়া ২৪শে মার্চ একটি ছাত্র প্রতিনিধি দল জিন্নাহ সাহবের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন কর্তৃক পূর্ববাংলায় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ সদস্যদের গণপরিষদে বাংলা রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব সমর্থন করার চুক্তির উলেখ করেন। ১৫ই মার্চ সম্পাদিত চুক্তি হয়। জিন্নাহ সাহেব এই চুক্তি সম্বন্ধে মন্তব্য করেন যে, ছাত্ররা জোরপূর্বক খাজা নাজিমুদ্দিনকে দিয়ে এই চুক্তি সাক্ষর করিয়েছেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের গণপরিষদে বাংলা রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমনের পূর্বে ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্র“য়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে পূর্ববঙ্গের সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্বীকৃতির প্রস্তাব করেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিনষ্ট ও মুসলিম ঐক্য ধ্বংসের অজুহাতে বাংলা রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের প্রস্তাবের সমর্থন করেন নোয়াখালী থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী। যিনি তখন কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। গণপরিষদ স্পিকার তমিজুদ্দিন খান লিয়াকত আলী খানের বক্তৃতার ভিত্তি করে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব বাতিল করে দেন।
গণপরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বাংলার রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব পূর্ববাংলার অধিকাংশ মানুষ সমর্থন করেন এবং এই প্রস্তাবে বাঙালিদের মধ্যে অভূতপূর্ব জাতীয় আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখন ঢাকায় কোন দৈনিক পত্রিকা ছিল না। একমাত্র সিলেট থেকে প্রকাশিত নত্তবেলাল পত্রিকা এই প্রস্তাবের পক্ষে ব্যাপক প্রচার কাজ চালায়। তখন কলকাতা থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পত্রিকা দৈনিক ইত্তেহাদ আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকা জোরালোভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রচারাভিযান চালায়। এ সময় পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও মুসলিম দলীয় আইনসভার সদস্যরা রাষ্ট্রভাষার বিরোধিতা করেন।
এ সময় পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে ঢাকা ফজলুল হক হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় লেখক, শিক্ষকদের সমন্বয়ে ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ “রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটি” নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি ঐ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা দাবি দিবসের পক্ষে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তোহা, অলি আহাদ, শওকত আলী, অধ্যাপক অজিত গুহ, অদুদ, কাজী গোলাম মাহমুদ, নাঈমুদ্দিন আহমদ, আজিজ আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভিপি এস এম হল), শামসুল আলম (ফজলুল হক হল), সরদার ফজলুল করিম, আবুল কাশেম, কমরুদ্দিন ও আব্দুর রহমান চৌধুরী উলেখিত কর্মীরা ১১ই মার্চ দাবি দিবসের পক্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পিকেটিং করেন।
তখন জাকির হোসেন আইজিপি ছিলেন। ঢাকার এসপি ছিলেন গফুর। বাংলা রাষ্ট্রভাষা দাবির পক্ষে পিকেটিং করায় শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, তোয়াহা, অজিত গুহ, অলি আহাদ সহ অনেককে গ্রেফতার করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। ১১ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নাঈমুদ্দিনের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রতিবাদ ও গ্রেফতারকৃত বন্দীদের মুক্তি দাবি করা হয়। সেই সঙ্গে যেসব আইন পরিষদ সদস্য বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধাচারণ করেন তাদের আইনসভা থেকে পদত্যাগ দাবি করা হয়। ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দেশের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১২ই মার্চ পূর্ব বাংলা আইনসভার সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক ও সংগ্রাম কমিটির অন্যতম নেতা নাঈমুদ্দিন আহমেদ ১২ই মার্চ পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে এক বিবৃতি দেন। ১৩ থেকে ১৪ই মার্চ পর্যন্ত ঢাকার সর্বত্র পুলিশের বিরুদ্ধে হরতাল পালিত হয়। তাজউদ্দিন ও তোহা ১৪ই মার্চ আইন সভার সদস্য তোফাজ্জল আলীর বাসায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তোফাজ্জল হোসেন মন্ত্রী হওয়ার জন্য ছাত্রদের এই দাবির সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলতেন। তোহা ও তাজউদ্দিন তার সাথে দেখা করলে তোফাজ্জল হোসেন উৎসাহের সঙ্গে বললেন, তাদের জয় হয়েছে। কারণ তিনি ও আরো দুইজন মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত হতে যাচ্ছেন। তোহা তোফাজ্জল আলীর এই কথার উত্তরে বলেছিলেন ভাষা আন্দোলন করা হচ্ছে তাদের মন্ত্রী হওয়ার জন্য নয়।
ঢাকার অ্যাসেম্বলি হল ঘেরাও ও হরতালের জন্য মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন বিব্রত হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করে একটি আপোষের প্রস্তাব দেন। ফলে ১৫ই মার্চ কমরুদ্দিন, তোহা, নাঈমুদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ ও আবুল কাশেম খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের ফলে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে উক্ত নেতৃবৃন্দ একটি চুক্তিতে উপনীত হন। চুক্তির প্রধান শর্তগুলো ছিল তাৎক্ষণিকভাবে সকল বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। পুলিশী জুলুমের তদন্ত করে বিচার দাবি। পূর্ব বঙ্গের অফিস আদালতে সরকারি ভাষা বাংলা চালু করতে হবে। পূর্ব বঙ্গের মুসলিম লীগ দলীয় গণপরিষদ সদস্যরা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে সমর্থন করবে ইত্যাদি।
এই চুক্তির ফলে ১৫ই মার্চ সন্ধ্যায় শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তোহা, অলি আহাদ, রণেশ দাস গুপ্ত, শওকত আলী প্রমুখদের ৬ দিন পরে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এই চুক্তিতে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে সাক্ষর করেন কমরুদ্দিন আহমদ ও সরকার পক্ষে সাক্ষর করেন নাজিমুদ্দিন। পরবর্তীতে খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে চুক্তি বাতিল করেন।
১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন :
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে ২০শে ফেব্র“য়ারি ৯৪ নম্বর নওয়াবপুর রোডের আওয়ামী লীগ অফিসে সন্ধ্যায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন যুক্তবাংলা মুসলিম লীগ সম্পাদক জনাব আবুল হাসিম। সংগ্রাম কমিটির যারা সভায় উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন, আবুল হাসিম, খয়রাত হোসেন এমএলএ (আওয়ামী লীগ), শামসুল হক (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সম্পাদক) বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ (আওয়ামী মুসলিম লীগ), কাজী গোলাম মাহবুব (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) খালেক নেওয়াজ খান (সাধারণ সম্পাদক) আবদুল মতিন (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ), শামসুল হক চৌধুরী (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) নুরুল আলম, শওকত আলী, অধ্যাপক আবুল কাশেম, মুজিবুর হক, গোলাম মাওলা (ভিপি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ), ইশতিয়াক আহমেদ ও ইব্রাহিম তাহা, (ইসলামী ভ্রাতৃ সংঘ) এবং আখতার উদ্দিন আহমেদ (নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ)।
২০শে ফেব্র“য়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ অধিবেশনের পূর্বেই মুসলিম লীগ সরকার ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশীকে দিয়ে ঢাকা শহরে সর্বত্র শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ৯৪ নম্বর নওয়াবপুর রোডে আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা জারি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়।
আলোচনা সভার অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিমত দেন। মাত্র ২ জন যুবলীগের অলি আহাদ, ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে নানা প্রকার যুক্তি প্রদান করতে থাকেন। অবশেষে প্রধান নেতা আবুল হাশিমসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সবাই একমত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ হয়। উলেখ্য, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ সম্পাদক শামসুল হকও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুক্তি পূর্ণ তথ্য দিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তখনকার পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হঠকারিতার সামিল হবে। সরকার রাষ্টভাষা আন্দোলনকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে আসন্ন আইন সভা নির্বাচন স্থগিত করে দেবে। উপরন্তু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নিজ দায়িত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ঝুঁকি নেওয়ার মতো রাজনৈতিক ক্ষমতা তখনও অর্জন করেনি। এর ফলে যদি ছাত্র জনতার মূল্যবান প্রাণ হারায় তার দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ বহন করতে পারবে না। উলেখ্য, ২১ ফেব্র“য়ারি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যুবলীগের অলি আহাদ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আব্দুল মতিন ও ইসলামিক ব্রাদার হুডের ইব্রাহিম তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্র জনসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য জোরালো চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপের ফলে ছাত্ররা ভূতভবিষ্যত চিন্তা করে ভাবের আবেগে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উলেখ্য এর পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম সভাপতি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে তাদের অভিমত ও যুক্তি জানানোর জন্য শামসুল হক সাহেবকে ক্ষমতা প্রদান করেন। শামসুল হক সাহেব এ ক্ষমতাবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত ছাত্রদের বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য উপদেশ দেন। পূর্ব বাংলা ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রজনীর লেখক বদরুদিন ওমর সাহেব এ প্রসঙ্গে শামসুল হক সাহেবের প্রসঙ্গে যে অশ্লীল উক্তির পুনরাবৃত্তি করেছেন তা দুঃখজনক। তিনি বলেছেন, হাসান হাফিজুর রহমান শামসুল হক সাহেবের মাথার টুপি ছুঁড়ে দিয়ে তাকে ট্রেইটর বলেছিলেন। আমার অভিমত টুপি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি নোবেল বা গৌরবময় পরিধেয়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ টুপি পরতেন। তার জন্য মুসলমানরা টুপিকে একটি পবিত্র জিনিস বলে মনে করেন। কাজী গোলাম মাহবুব তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের একজন মধ্যমসারির নেতা ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক ছাত্র সভায় তার ই সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তাকে এড়িয়ে গায়ের জোরে যুবলীগের গাজীউল হককে সভাপতি করে গোলযোগের মধ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার নির্দেশ প্রচার করা হয় যা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্রকে তাদের মূল্যবান প্রাণ দিতে হয়েছিল। তাদের নিয়ে আজ আমরা শোকগাঁথা রচনা করি। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার পথে একধাপ অগ্রসর হয়েছিল সত্যি কিন্তু যে সেনাপতি যুদ্ধে কম সৈন্য হারিয়ে জয়লাভ করতে পারে তার কৃতিত্বই বেশি। আজ জাতিসংঘের ইউনেস্কো আমাদের ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালিত হচ্ছে। এটা আমাদের বিশ্ব দরবারে গৌরবান্বিত করেছে। এই মাতৃভাষা আন্দোলনে যারা জীবন দিয়ে গেছেন তাদের জন্য আমরা শুধু মুখে সহানুভূতি জানিয়েই আমাদের দায়িত্ব শেষ করি। কিন্তু তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য আজ পর্যন্ত স্মরণীয় কিছু করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
একুশে ফেব্র“য়ারিতে যাদের অবদান আজো সবার মনে বাজে তাদের কথা এখানে উলেখ্য করছি। যদি আরো অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ভাষা সৈনিকদের নাম ও তাদের কর্মকাণ্ড উলেখ করা হতো তাহলে আমার মতে সঠিক ইতিহাস প্রকাশিত হতো। যারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অবিম্মরণীয় অবদান রেখেছেন তাদের নাম এখানে উলেখ করছি।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, আবুল হাশিম, শামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামীলগ, শেখ মুজিবুর রহমান, রংপুরের খয়রাত হোসেন এমএলএ (আওয়ামী মুসলিম লীগ), মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ এমএল (আওয়ামী মুসিলম লীগ), খান সাহেব ওসমান এমএলএ (আওয়ামী মুসলিম লীগ) মোহাম্মদ তোয়াহা (যুবলীগ), শওকত আলী, পুর্ববঙ্গ কর্মী শিবির, অধ্যাপক আবুল কাশেম (তমদ্দুনমজলিশ), মুজিবুল হক (সহ সভাপতি, এসএম হল), মির্জা গোলাম হাফিজ (সিভিল লিবার্টি কমিটি) সৈয়দ আবদুর রহিম (সভাপতি, রিকশা ইউনিয়ন), আবদুল গফুর (সাপ্তাহিক সৈনিক), গোলাম মাওলা (ভিপি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ), ইশতিয়াক আহমেদ ও ইব্রাহিম তাহা (ইসলামি ভ্রাতৃ সংঘ), শহীদুলাহ্ কায়সার (যুব লীগ), আর যারা মহিলাদের মধ্যে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন, শাফিয়া খাতুন, উইমেন্স স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, লিলি খান, সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন্নাহার, আহসান, লায়লা তৈফুর, রওশান আরা বাচ্চু, প্রমুখদের নাম উলেখযাগ্য।
পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির ভূমিকা :
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পার্লমেন্টারী এক পার্টির সদস্যরা বাংলা রাষ্ট্র ভাষা সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে একটি বিবৃতি দেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। স্বরাষ্ট্র দফতরে অবাঙালি সেক্রেটারি আজফারের চাপে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এ বিবৃতি দানে বিরত থাকেন।
পূর্ববঙ্গ মুসিলীম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি :
২০শে ফেব্র“য়ারি পার্টির সভাপতি মাওলানা আবদুলাহেল বাকির সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাকি সাহেব তার দলীয় সদস্যদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সমর্থন করেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা এর বিরোধিতা করেন।
আমাদের বাম রাজনীতির সাফল্য ও ব্যর্থতা
১৯৯২-৯৩ শিক্ষা বর্ষে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হলে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। আমি ফজলুল হক হলের ছাত্র ছিলাম। স্বভাবিকভাবেই হল ইউনিটের সাথে সুক্ত হয়ে আমার নূতন রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে জাসদ ছাত্রলীগ সক্রিয় ছিলো। কিছুদিন পুর্বেই বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির সর্বশেষ সাড়া জাগানো ছাত্র নেতা কফিল উদ্দিন কফিল নিহত হন। ঐ সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৮০০/৯০০ ছাত্র এই রাজনীতির সমর্থক ছিলো। বর্তমানে এই সংখ্যা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু আমার সব সময়ই মনে হয়েছে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে বাম রাজনীতির ছাত্র সংগঠনগুলোর কোন বিকল্প নেই। এটা অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত মতামত। এই মতামত এখানে থাক। তার ফাঁকে আমরা আমার না দেখা অতীত থেকে কিছুটা হলেও ঘুরে আসতে চাই।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির সামনে যে সব চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জাতি আগামী দিনে কোন গতিধারায় পরিচালিত হবে। প্রথম যে প্রশ্নটা আসে বাংলাদেশ কি সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে নাকি গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী পৃথিবীর অধীন হবে। মুসলিম বিশ্বের বলয়ে চলে যাবে নাকি ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে ভারতের ছায়ায় অবস্থান করবে। সবচেয়ে বড় একটা বিষয় বাংলাদেশের জন্মের পূর্বে ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের ঘোষণায় পরিষ্কার করা হয়েছিল পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান। কারো সাথে শত্র“তা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব। কিন্তু এই জানানোতেও শেষ রক্ষা হয়নি। অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়াশীল গ্র“পগুলোর পাশাপশি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানও ওঁৎ পেতে থাকে সদ্যোজাত রাষ্ট্রটির সাথে সম্পর্ক কেমন হবে। পাশাপাশি তাকিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুশীলবরা। এর মধ্যে প্রথমেই আসে ক‚টনৈতিকভাবে পরাজিত আমেরিকার কথা। পাকিস্তানের সমর্থক মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী শক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীও হাত বাড়ায়। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়। এই যখন পরিস্থিতি তখন দেশের ভেতরেও নানা মত নানা পথের লোকের অভাব হয় না। সামরিক বাহিনির সদস্যদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসম্মানবোধ, পাকিস্তান ফেরত বন্দী সৈন্যদের মর্যাদার প্রশ্ন, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুবেলা দুমুঠো অন্ন, বস্ত্রের চিন্তা। সবকিছুর মাঝখানে মুজিব একা একটা নিঃসঙ্গ চিতা। ভাবলে অবাক লাগে তিনি কিভাবে পুরো পরিস্থিতিটা সামলেছেন। অবশ্য সামলাতে তিনি পারেননি শেষ পর্যন্ত। মরেছেন। অনেকেই বলেছেন মুজিব কে এ মেরেছে ও মেরেছে। আসলে বাস্তবতা আরও জটিল। আমরা কেউ কি বুঝতে চেয়েছি একা একটা মানুষের কাঁধে পুরো জাতির বোঝা। উনি যাবেনটা কোথায়। বাঙালির মেধা শূন্যতা আবারও প্রমাণিত হলো। আমরা শরীরী মুজিবকে সরিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতির উত্তরণ চাইলাম। কিন্তু সেটা যে কত বড় ভুল ইতহাস তা প্রমাণ করেছে। আজও মুজিবের বিকল্প নাই। লক্ষ বছরেও হবে না। রাজনীতির মহাকবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অমর রূপকার মুজিব শুধু একজনই। গোটা জাতিকে কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো এতটা প্রশস্ত কাঁধ যদি আর দ্বিতীয়টি থাকত তাহলে সেই কাঁধে ভর করে জাতি আরও অনেক আগেই স্বাধীনতার মুখ দেখত।
মুজিব নিহত হওয়ার পর চার দশক গড়িয়ে গেছে। বাঙালি জাতির ভাগ্য ভাল দীর্ঘ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ আবার তারা আলোর মুখ দেখছে। উন্নয়নের জোয়ার দেখছে। তাও সেই মুজিবের উত্তরসূরির কাঁধে ভর করে। শেখ হাসিনা আজ শুধু বাংলাদেশের আশা আলোর প্রতীকই নন। গোটা বিশ্বের জন্য আলোকবর্তিকা। শেখ হাসিনাই পারলেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ সফল করতে। বাকিরা শুধু মুখে বলেই খালাস।
যে আলোচনায় ছিলাম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং তার মোকাবেলায় রাজনীতিতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর একটা ছোট খাট রূপরেখা তুলে ধরতে চাই এজন্যে যে এর মধ্যে কোন ফাঁক গলিয়ে কি যে ঝরে গেল তা কিছুটা হলেও বোঝা যাবে। মুজিবকে যারা সেই ষাটের দশক থেকে বিদ্যা বুদ্ধি সঙ্গ দিয়ে ঘিরে রেখেছিল তার মধ্যে রাজ্জাক, তোফায়েল, সিরাজুল ইসলাম, রব, তাজউদ্দিন, কামাল হোসেন প্রমুখরা উলেখযোগ্য। কিন্তু ভেজাল হলো যুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলোতে। মুজিব সব দিক বিবেচনায় তাদের প্রত্যাশার হাতে দেশকে ছেড়ে দিতে পারলেন না। তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের উপর তিনি ভরসা রাখতে পারলেন না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ২রা মার্চ যারা তার হাতে বাংলাদেশের পাতাকা তুলে দিয়েছিলেন তারা দিশেহারা হয়ে গেলেন। কেউ কেউ খেই হারিয়ে মুজিবকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। আর যায় কোথায়। সিরাজ সিকদার তো রাতারাতি হিরো বনে গেলেন। কিন্তু ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র বড়। তাকে সরে যেতে হলো। পরিস্থিতি ঘোলাটে হলো। কিন্তু সমাধান হলো না। ১৯৭২ এ এসে যখন জাসদের জন্ম হয় তখনও কিন্তু কোনো অসুস্থ মনোভাব ছিল না। সমাজতান্ত্রিক দলগুলো সব সময়ই তাদের ঘরানায় আগাতে পছন্দ করে। বিপ্লবের উদ্দেশ্য তাদের ছিলো। তবে তা নিঃসন্দেহে অগোছালো বা কাঁচা কোনো পরিকল্পনা নিশ্চিত নয়। আমার কাছে তাদেরকে সবসময়ই লাতিন আমেরিকার ফুটবল খেলার মতো মনে হয়। ম্যাচ হেরে গেলেও তারা তাদের স্টাইল বদলাবে না। একটা ম্যাচ হারলে তাদের কিছু আসে যায় না। তাই বলে ইউরোপের ফুটবলের মতো এক ম্যাচে বার বার কৌশল পরিবর্তন লাতিনদের পছন্দ নয়। আর মাথায় রাখতে হবে বিপ্লব রাশিয়ায় হলেও বড় বড় বিপ্লবী যেমন চে গুয়েভারা, সিমন বলিভার কিন্তু লাতিন আমেরিকারই মানুষ। নেতার সাথে স্টাইলের একটা মিল বরাবরই পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষও কিন্তু ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত শেখ মুজিবের মতো করে ভাবতো। আর এ জন্যেই আমাদের পক্ষে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হয়েছিল। আমরা মূলতঃ ধরতে চেয়েছিলাম এর ফাঁক দিয়ে সমাজতন্ত্রীরা কখন ঝরে গেলো সেই সংকট কালকে।
১৯৭৩ সালে এসে নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা পেলেও জনপ্রিয়তায় যে ভাটার টান ছিল তা সবাই বুঝতে পারছিল। দেশ বিদেশের নানা জরিপেও তার প্রতিফলন ছিলো। যদিও ইতোমধ্যে জাসদ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা জাতীয় রাজনীতির ব্যারোমিটারে তেমন কোন প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে হয় না। সমস্যা ছিল অন্যত্র। মুজিবও সেটা জানতেন। তিনি স্টাইলের পরিবর্তন করলেন। ১৯৭৪ এ এসে বুঝলেন হাড় হাভাতে বাঙালির জন্যে আব্রাহাম লিংকনের “গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল” কাজ করবে না। এদেরকে সামলানোর জন্য খোঁয়াড়ে ঢোকাতে হবে। সেই খোঁয়াড়ের নাম বাকশাল। কিন্তু বাঙালি খোঁয়াড়ে ঢুকতে চাইল না। তারা বিকল্প চিন্তুা করতে শুরু করলো। তারা ওঁৎ পেতে রইল কি হয় দেখার জন্যে। শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হলো। ইতিহাস সাক্ষী সমাজতন্ত্রীদের জন্যে বাংলাদেশের মাটিতে মুজিবের পর তার চেয়ে আর কোনো ভালো বন্ধু পাওয়া যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিব নিহত হলো। তখনও তারা পুরোপুরি বুঝতে পারেনি তাদের কত বড়ো সর্বনাশ হয়ে গেছে। পরবর্তীতে যখন ৭ই নভেম্বরের আবির্ভাব হলো তারা আবারও নির্বোধের মতো ভূমিকা গ্রহণ করলো। এদিনে এসে তারা আবারও প্রমাণ করল যুদ্ধের কৌশল আর রাজনীতি এক জিনিস নয়। যুদ্ধের ময়দানে সামনের শত্র“কে মারতে হয়। রাজনীতিতে মারতে হয় ভবিষ্যতের শত্র“কে। তারা খালেদ মোশাররফকেই হজম করে ফেলল। শেষ আশ্রয়। খাঁচা ভেঙ্গে বাঘ বের করে আনল। সেই বাঘ তাদের সদল বলে খেয়ে ফেলল। নির্বুদ্ধিতার ফলাফল এমনই হয়। রাজনীতি দেখে দেখে শেখা যায় না। রাজনীতিতে প্রত্যেক সিদ্ধান্তই নতুন। এখানে মাথা খাঁটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সামরিক সদস্যরা বরাবরই সেই ভুলটাই করে। কতিপয় মাথা গরম সামরিক অফিসার জাতির জনককে হত্যার মতো একটা নারকীয় সিদ্ধান্ত নেয়। কতিপয় সামরিক সদস্য সেই ঘোলাজলে মাছ শিকারের সিদ্ধান্ত নেয়। শেষমেষ সবাই ব্যর্থ হয়। মাঝখান দিয়ে একটা স্বাধীন সোনার বাংলার স্বপ্ন বেহাত হয়ে যায়। প্রায় পনেরোটি বছর জাতি হাবুডুবু খায়। অতঃপর একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল যা নতুন আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু আমরা সেই পথে না গিয়ে বামদের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশে বাম রাজনীতির বিকাশ খুব বেশিদিনের নয়। মূলতঃ এর আমদানি হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকে। স্বাধীনতার বছর দুয়েক আগে হঠাৎ করে একটা নতুন আমদানিকৃত ধারণার মত এটা আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঢুকে পড়ে। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই এর আগমন ও বিকাশ। তৎকালীন সময়ের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র মৈত্রীই মূলতঃ এর ধারক ও বাহক ছিলো। অতঃপর ছাত্রলীগের মধ্যেও এর বিকাশ ঘটতে থাকে। তাদের কাছে তখন এটা নতুন একটা কিছুই মনে হয়েছিল। এ নিয়ে রাতারাতি পাঠচক্র করে এ বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট করার চেষ্টা চলতো। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র মৈত্রীর পাশাপাশি ছাত্রলীগও এই প্রক্রিয়ায় যোগ দেয়। তৎকালীন রাজনীতির তাত্তি¡ক গুরু সিরাজুল ইসলাম খানকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে এই বৃত্ত। তাতে যোগ দেন শেখ মণি, আ স ম আব্দুর রব, মতিয়া চৌধুরী, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ কিংবদন্তীরা। আলোচনা জমে ওঠে। শেষমেষ সেই আলোচনা গড়ায় বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু তরুণদের এই ভাবনাকে অবহেলা করেননি। তবে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন ওদের সমাজতন্ত্রের ভাবনার কেন্দ্র বিন্দুতে যা আছে তা যেহেতু আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়, তাই আমাদেরকে আমাদের মতো করেই এটা গ্রহণ করতে হবে। গণতান্ত্রিক অর্থে সমাজতন্ত্র। মুজিবের এই মতামত সমাজন্ত্রীদের সেদিন কিছুটা হলেও হতাশ করেছিল। কিন্তু তারা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি এই ছোট চিড় আস্তে আস্তে একসময় বড় ফাটলে রূপ নেবে যার মধ্যে তারা পথ হারিয়ে ফেলবে। এই ভবিষ্যতকে জানার আগে আমরা কিছু সময়ের জন্যে হলেও অতীত থেকে ঘুরে আসব।
কমিউনিট পার্টি অব ইন্ডিয়া পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর হয়ে গেল কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান। তার-ই একটা অংশ হলো কমিউনিস্ট পার্টি অব ইস্ট পাকিস্তান। সেই কমিউনিস্ট পার্টি অব ইস্ট পাকিস্তানই বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর হয়ে গেল কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাটা মূলতঃ এভাবেই প্রবাহিত হয়েছিল। মাঝখান দিয়ে ১৯৫২ সালে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়।
জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতির সাথে সংযুক্ত। সবচেয়ে বড় কথা ছাত্র সংগঠনগুলো মূলতঃ ছাত্র রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও আমাদের জাতীয় প্রয়োজনে এরাই এগিয়ে এসেছে সর্বাগ্রে। এর আরও প্রমাণ মেলে পাকিস্তান জন্মের পর আওয়ামী লীগের পূর্বে ছাত্রলীগের জন্ম। পরবর্তীতেও এই ছাত্রলীগই আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনীতিবিদরাও কোন না কোন ছাত্র সংগঠন থেকে উঠে আসা।
আমরা বাংলাদেশে বাম রাজনীতির বিকাশ, সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সবচেয়ে উলেখযোগ্য ঘটনা জাসদের জন্ম। জাসদের জন্ম মূলতঃ স্বাধীনতা পরবর্তী কালের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে শেখ মুজিব নিহত হলে বাংলাদেশের রাজনীতি মূলতঃ খেই হারিয়ে ফেলে। জাসদও তার বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। ১৯৮০ সালে এসে ছাত্র মৈত্রী গঠিত হয়। এই সংগঠনটিও ছাত্র ইউনিয়নের মতো একই ভাবধারার অনুসারী। শিক্ষাঙ্গনে গঠনমূলক রাজনীতির অঙ্গীকার নিয়ে ছাত্র মৈত্রী সামনে আগাতে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সব সময় মূলতঃ যা হয়। কোন কিছু বেড়ে ওঠার জন্য যতটুকু পরিবেশ দরকার বরাবরই তা ব্যাহত হয়। জাতীয় রাজনীতির চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হতে হতে শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ছাত্র সংগঠনই পথ হারিয়ে ফেলে। তবে প্রথম প্রথম ছাত্র সংগঠনগুলো বেশ নিরপেক্ষ ছিলো। তখন কেউ এটাকে গায়ে মাখেনি। পরবর্তীতে দেখা যায় বড় বড় ছাত্র সংগঠনগুলোও জাতীয় রাজনীতির আর্বতে ঘুরপাক খেতে খেতে এক সময় পথ হারিয়ে ফেলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। নিয়মিত কমিটি গঠন বন্ধ হয়ে যায়। বৃহত্তর দলগুলো তাদের প্রয়োজনে ছাত্র রাজনীতিকে ব্যবহার করতে থাকে। এ প্রক্রিয়া এতটা জটিল আকার ধারণ করে যে এক সময় দেখা যায় বেশির ভাগ দলগুলোই ছাত্র সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের জাতীয় রাজনীতিতে ছোট খাট পদ দিয়ে আত্মীকরণ করে নেয়। কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তারা ন্যূনতম হলেও কাউন্সিল প্রক্রিয়া ধরে রাখে এবং অন্ততঃ ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখতে চেষ্টা করে।
বাম রাজনীতির জন্যে সবচেয়ে বড় সংকট আসে ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে। দক্ষিণ পন্থীরা ক্ষমতায় গেড়ে বসলে বামদের স্থান সংকীর্ণ হতে থাকে। মূল ধারার বাইরে থেকে মূলতঃ খুব বেশি দিন রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া কঠিন। তাছাড়া রাশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট এবং পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর ক্রমাগত অর্থনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক ব্যর্থতা তাদের টিকে থাকার অবস্থানকে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে কয়েকটি সংগঠন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। আবার কয়েকটি সংগঠন মিলে একটা সংগঠনে পরিণত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এই যখন অবস্থা তখন পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক শাসন। জিয়া এবং এরশাদের দীর্ঘ সামরিক শাসন বামদের সবচেয়ে বেকায়দায় ফেলে। বরং এ সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ লাভ করে একটা ধারণার উপর গড়ে ওঠা মিথ্যে খোলসে ভর করে। দক্ষিণ পন্থীদের এই ধোকা সবাইকে বোকা বানায় এবং তারা ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অনায়াসে শাসন করে এবং সেই সাথে ক‚ট কৌশলের রাজনীতিও চালিয়ে যায়। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ধারা প্রচলনের চেষ্টা শুরু হয়। নতুন পরিস্থিতি বামদের জন্য নতুন পরিবেশ তৈরি করে। জাতীয় রাজনীতিতে সুযোগ পাওয়ার জন্যে বড় দলগুলোর সাথে গাটছড়া বাঁধে। এই গাটছড়া তাদেরকে সামায়িক লাভবান করলেও তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশকে সর্বাধিক ব্যাহত করে। মূলতঃ প্রতিক‚ল পরিবেশেই যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। কিন্তু এই পরিবেশ বামদের জন্যে না প্রতিক‚ল না অনুক‚ল ছিলো। বরং সুবিধা ভোগের এই পরিবেশে বামরা জাতীয় রাজনীতিতে শরিক দলে পরিণত হয়। সুবিধার লড়াই নেতৃত্বের মধ্যে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে দলগুলো হয়ে পড়ে সাইনবোর্ড সর্বস্ব। সবচেযে বড় কথা তারা নিজেদের দলীয় আদর্শ বা অবস্থান ভুলে গিয়ে জোটের মূল দলের আদর্শ ও ঐতিহ্য নিয়ে বেশি মেতে ওঠে।
বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে পশ্চিম বঙ্গের বাম আন্দোলনের ছায়া পরিলক্ষিত হয়। যদিও পশ্চিমবঙ্গে এটা যতটা ডালপালা বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে আমাদের এখানে ততটা সম্ভব হয়নি। কারণ আর কিছু নয়। কেউ কেউ মনে করতে পারেন আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মতো বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের চাপের মধ্যে পড়ে আমাদের বাম রাজনীতির বিকাশ হয়নি। কিন্তু কথাটা আদতে সত্য নয়। আমাদের এখানে বাম রাজনীতি বিকাশ না হওয়ার কারণ এর বৈশিষ্ট্যগত। যে কোন রাজনৈতিক দলই বিকাশ লাভ করে তার নিজস্ব আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যগত কারণে। বাম রাজনীতি সম্পর্কে বেশির ভাগ লোকেরই ধারণা এটা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। আর যায় কোথায়। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানদের দেশে তাদের ব্যক্তিগত বা সামাজিক কিংবা ধর্মীয় অবস্থা যাই হোক না কেন, এ ধরনের চিন্তা ভাবনা যদি একবার ডালপালা বিস্তার করে তাহলে আর যায় কোথায়। বাংলাদেশে বাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ এভাবেই অন্ধকার থেকে গভীরতর অন্ধকারে নিপতিত হতে থাকে। তাছাড়া একটি কথা না বললেই নয়। প্রচলিত এই মিথের সাথে যুক্ত হয় বাম আন্দোলনের কিছু কিছু নেতার ব্যক্তিগত জীবন দর্শন। তাদের নিজস্ব বিশ্বাস আর বাস্তবতা সামগ্রিক ভাবে দলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পশ্চিবঙ্গের বাম আন্দোলনের বিকাশ মূলতঃ হয়েছিল সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমে। নাট্য চর্চা, সাহিত্য রচনা, শরীর চর্চা থেকে শুরু করে বহুমুখী সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে এর বিকাশ ও চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে অরবিন্দ রায়ের অনুশীলন কেন্দ্রের কথা উলেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে আমরা উদীচী কিংবা চারণের মতো সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর বিকাশ ও বিস্তার লাভ দেখতে পাই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিগত পঁয়তালিশ বছরের গতিধারায় বাম আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত আকার সত্তে¡ও জাতীয় রাজনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখতে পাই। দক্ষিণপন্থীদের হাত থেকে বেরিয়ে এসে দেশ যখন মধ্য বামপন্থীদের হাতে পড়ে যায তখন আওয়ামী লীগ তার শরিক হিসেবে বামদেরকেই কাছে টেনে নেয়। যদিও অনেকের মতে ১৯৭১ এর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিতর্কিত ভূমিকা দেখতে পায় তবুও তারা এনিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মধ্য ডানপন্থীদের ঠেকাতে বামদের কাছেই ধর্না দেয়। আমার মনে হয় তাদের এই ছোটখাট ভোটব্যাংক ভোট আর ভাতের রাজনীতির লড়াইকে অতটা শক্তিশালী না করতে পারলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাম ঘরানার রাজনৈতিক ব্লকের একটা সুদৃষ্টি বরাবরই থেকে যায়। এটা ভীষণ কাজে দেয়। কারণ এতে ভারতীয় শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দলগুলোর দৃষ্টিও যেমন থাকে তেমনি আওয়ামী লীগের একটা উদারনৈতিক ভাবমূর্তি তৈরিতেও সক্ষম হয়। এ কারণে দিলিকেও সে তার অধিকতর কাছে পায়। সবচেয়ে বড় কথা ২০০৭ সালের পর এ পর্যন্ত প্রায় ৯ বছর বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে যে একটা মাথা তোলা দেশে পরিণত হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগের কৃতিত্বই আসল। কিন্তু উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় সহযাত্রী হিসেবে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বাম ঘরানার রাজনীতিবিদদের অবদানই সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় যারাই আজকের আপোষহীন, দুর্নীতিবিরোধী সৎ নেতা তারাই তাদের জীবনের কোন না কোন একটা পর্যায়ে বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। আমি নাম উলেখ না করেই বলতে চাই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের উত্তাল রাজপথে কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ঘোলাজলে মাছ শিকারের সময় বাম রাজনীতির ভূমিকাকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমার কখনওই এটাকে হাল্কা মনে হয়নি। বরং সব সময়ই মনে হয়েছে ছোট প্যাকেজে ধামাকা অফার। রাজনৈতিক বিল্পব তাদের বেহাত হয়ে গেলেও বিভিন্ন সময় এদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে লড়াকু সৈনিকের মতো সব সময়ই রাজপথে সক্রিয় ছিলো।
ভারতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ মূলতঃ হয় কলকাতা কেন্দ্রিক। রাশিয়ায় কার্ল মার্ক্সের যে সমাজতন্ত্র বিস্তার লাভ করেছিল তার মূলেও ছিল সেই একই মন্ত্র। কাল মার্ক্স নিজে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও সারা রাশিয়ার লোক কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মতবাদের ছায়াতলে এসে তাদের ঈশ্বর বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করেননি। ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারটা যার যার ব্যক্তিগত পর্যায়েই ছিলো। বর্তমানে এমন অজস্র নাস্তিক্যবাদী আছে যারা রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে সমাজতন্ত্রকে মানেন না। এমনটা ধারণা করার কোন যৌক্তিকতা নেই সমাজতন্ত্র মানে ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করা। মূলতঃ সমাজতন্ত্র একটা তত্ত¡ যেখানে শ্রেণি শত্র“র বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার মাধ্যমে সমাজে সাম্য ও সমতার নীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় বিচার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেহেতু ব্যক্তির একার পক্ষে এটা বাস্তবায়ন সম্বব নয়, তাই বৃহত্তর পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় ভাবে এটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯১৭র বিল্পব সেরকমই একটা ঘটনা। কিন্তু এই কাজটি করতে গিয়ে যেখানে ভুলটা হয়ে গেছে তাহলো ব্যক্তির অধিকার খর্ব করে সব কিছু রাষ্ট্র্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে যা ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী। আবার আজকের যারা প্রলেতারিয়েত বিজয়ী হওয়ার পর তারাই আবার শ্রেণিশত্র“তে পরিণত হয়েছে। মোট কথা উদ্দেশ্য ভালো হলেও তত্তে¡র ত্র“টির কারণে সমাজতন্ত্র মতবাদ পুরো একটা শতাব্দিও পুরো করতে পারেনি। অথচ এই সব সমস্যার সমাধান ইসলামী অর্থনীতিতে সেই ১৪০০ বছর আগেই সুন্দরভাবে ছিলো। বুঝতে না পারার কারণে ভুল মতবাদের মধ্যে সমাধান খুঁজতে গিয়ে কার্ল মার্ক্স পুরো পৃথিবীর একটা বিরাট অংশকে আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছেন। মার্ক্সের ক্রটির খেসারত দিয়েছে পুরো পৃথিবীর একটা বিরাট জনগোষ্ঠী।
তবে একটা কথা বলাই বাহুল্য। সমাজতন্ত্র বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে এমন একটা ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পেরেছিলো যা পুরো পৃথিবীকে এক মেরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করেছে। প্রায় ৮০ বছর ধরে পুরো পৃথিবীতে ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী পৃথিবীর পাশাপাশি তাদের মদদ দাতা রাজতন্ত্র শাসিত পৃথিবীর বিরুদ্ধে এত বড় চ্যালেঞ্জ আর কেউ ছুঁড়ে দিতে পারেনি। আর এই সুবাদে বিশ্বে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে যার উপর সমাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ছিলো। যেমন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এছাড়াও বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে অনেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র্রের স্বাধীনতা লাভ এবং শোষণের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়াবার বিশ্বব্যাপী অমোঘ এক মন্ত্র। এক্ষেত্রে কাল মার্ক্স, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, লেনিন, ট্রটস্কি, স্ট্যালিন, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ের হুগো শ্যাভেজের কথাই যদি বলি তাহলে এটার সাথেও অন্য কারো চ্যালেঞ্জকে তুলনা করে দেখার সুযোগ নেই। যদিও শেষ পর্যন্ত বিশ্ব থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে গেলে উঠে গেছে। বাজার অর্থনীতির নামে মার্ক্সের সেই দাস ক্যাপিটাল বা পুঁজিই বাজার দখল করেছে। বিশ্বের দেশে দেশে সমাজতন্ত্র কর্তৃক সৃষ্ট দেয়াল তুলে দেওয়া হচ্ছে যেমন পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি তবুও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিগত ১০০ বছর সমাজতন্ত্র আমাদের অনেক বড় ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছে। আজ যদি সমাজতন্ত্র বিজয়ী হতো তাহলে ২০১৭ সালে বিশ্বে সমাজতন্ত্রের ১০০ বছর পূর্তি করা হতো তা সবরাই জানা। কিন্তু প্রেক্ষাপট আজ পুরোপুরি ভিন্ন।
আমরা মূলতঃ বাংলাদেশে বাম রাজনীতির উত্থান পতন নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। আলোচনা করার কথা ছিল এর উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে। এর সাফল্য ও ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করার ভাবনাও আমাদের ছিলো। এই আলোচনা করতে গিয়ে অনেক প্রসঙ্গ চলে এসেছে যা সত্যিই প্রাসঙ্গিক। তার পরও অনেক সময় এমন অনেক বিষয়ও চলে এসেছ যা এই আলোচনার সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়। কিন্তু একথা অবশ্যই সত্য তার পরও কোন কোন বিষয় হয়তো আমরা আমাদের আলোচনায় আনতে পারিনি। যখনই কোন বিষয় এসেছে সে সম্পর্কে যে বিস্তারিত তথ্য দরকার আমরা চেষ্টা করেছি তা সংযুক্ত করার। অনেকের কাছে বিষয়টি হয়তো পছন্দের নাও হতে পারে কিন্তু যারা পরিপূর্ণ ধারণা পেতে চান তাদের হয়তো এটা কাজে লাগবে।
সবচেয়ে বড় কথা এই যে আমি কোথাও আমার মতামতকে আড়াল করার চেষ্টা করিনি। বিষয়টি সম্পর্কে সাদামাটা একটা ধারণা পাওয়ার জন্যে তাদের অনেক কাজে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি চেষ্টা করেছি যথা সময় বইটিকে প্রাসঙ্গিক রাখার।
পরিশিষ্ট
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ আইন
১. এই আইন “ভারত এবং পাকিস্তান” নামক দুইটা রাষ্ট্র্রের জন্য প্রযোজ্য।
২. ঘোষণার তারিখ ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ।
৩. রেডক্লিফ কমিশনের নির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী উভয় দেশের সীমারেখা নির্ধারিত।
৪. বাংলা এবং পাঞ্জাবকে তাদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ভাগ করা হল।
৫. পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু অঞ্চল, উত্তর পশ্চিমের সম্মুখভাগের অঞ্চল, আসামের সিলেট বিভাগ, ভাওয়ালপুর, খাইরপুর, বেলুচিস্তান এবং বেলুচিস্তানের আরও ৮টি এলাকা নিয়ে পাকিস্তানের সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়েছে।
৬. ১৯৩৫ সালের ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী বাংলা অঞ্চল চিহ্নিত।
৭. বিভক্ত বাংলার দুই অংশ পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
৮. বিশেষায়িত অঞ্চলসমুহকে পাকিস্তান কিংবা ভারত পছন্দ করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল।
৯. উভয় রাষ্ট্র্রের অন্যতম দায়িত্ব হবে নিজেদের জন্য আলাদা সংবিধান প্রণয়ন করা।
১০. নতুন সংবিধান প্রয়নয়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
১১. যেকোনো ধরনের পরিবর্তন গভর্নর জেনারেল কর্তৃক সাক্ষরিত হতে হবে।
১২. ব্রিটিশ সরকার উভয় রাষ্ট্র্রের উপর কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ রাখবে না।
১৩. ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত গভর্নর জেনারেল সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন।
১৪. এই আইন প্রণয়নের আগে যে সকল সরকারি কর্মচারি নিয়োগ পেয়েছিল তা অব্যাহত থাকবে।
১৫. ব্রিটিশ সংবিধান থেকে “ইন্ডিয়ান সম্রাজ্য” কথাটা বাদ দেয়া হয়েছে।
১৬. নতুন গঠিত রাষ্ট্রসমুহ থেকে ব্রিটিশ সরকার সব ধরনের দায় দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে।
যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা
নীতি : কোরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।
১. বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।
২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে। এবং উচ্চ হারের খাজনা ন্যায় সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সার্টিফিকেটযোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হবে।
৩. পাট ব্যবসায়কে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে তাকে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাট চাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইবে। এবং লীগ মন্ত্রিসভার আমলের পাট কেলেঙ্কারী তদন্ত করিয়া সংশ্লি¬ষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।
৪. কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে ও সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্ত শিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে।
৫. পূর্ববঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য সমুদ্র উপক‚লে কুটির শিল্পের ও বৃহৎ শিল্পের লবণ তৈয়ারির কারখানা স্থাপন করা হইবে। এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলের লবণের কেলেঙ্কারী সম্পর্কে তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।
৬. শিল্প ও কারিগরি শ্রেণির গরীব মোহাজেরদের কাজের আশু ব্যবস্থা করিয়া তাহাদের পুনর্বসতির ব্যবস্থা করা হইবে।
৭. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।
৮. পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করিয়া ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করিয়া শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হইবে। এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হইবে।
৯. দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইবে এবং শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।
১০. শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া কেবল মাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হইবে এবং সরকারি বেসরকারি বিদ্যালয় সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভুক্ত করিয়া সকল বিদ্যালয় সমূহকে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।
১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রক্রিয়াশীল কানুন বাতিল ও রহিত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হইবে এবং ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয়সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হইবে।
১২.শাসন ব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হইবে এবং এতদুদ্দেশ্যে উচ্চ বেতনভোগীদের বেতন কমাইয়া ও নিম্নবেতন ভোগীদের বেতন বাড়াইয়া তাহাদের আয়ের একটি সুসংগত সামঞ্জস্য বিধান করা হইবে। যুক্তফ্রন্টের কোন মন্ত্রী এক হাজারের বেশি বেতন গ্রহণ করিবেন না।
১৩. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, ঘুষ রিশওয়াত বন্ধ করার কার্যকরী ব্যবস্থা করা হইবে এবং এতদুদ্দেশ্যে সমস্ত সরকারি বেসরকারি পদাধিকারীর ব্যবসায়ির ১৯৪০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ লওয়া হইবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ দিতে না পারিলে তাহাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।
১৪. জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করতঃ বিনা বিচারে আটক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হইবে ও রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করিবার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে।
১৫. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হইতে পৃথক করা হইবে।
১৬. যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাততঃ ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।
১৭.বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যাহারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহীদ হইয়াছেন তাহাদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হইবে এবং তাহাদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে।
১৮. ২২ ফেব্র“য়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করিয়া উহাকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হইবে।
১৯. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট ও মুদ্রা ব্যতিত আর সমস্ত বিষয় পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশ রক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনির হেড কোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনির হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণকরত পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনিকে সশস্ত্র বাহিনিতে পরিণত করা হইবে।
২০. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াইবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবেন।
২১. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হইবে, তিন মাসের মধ্যে তাহা পূরণের জন্য উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইবে এবং পরপর তিনটি উপ-নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হইলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিবেন।
পাকিস্তানের সংবিধান, ১৯৫৬
পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে ২৩৪টি অনুচ্ছেদ, ১৩টি ভাগ এবং ৬টি তফসিল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পাকিস্তানের সংবিধানে ছিল একটি দীর্ঘ প্রস্তাবনা, যাতে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকাণ্ড সর্বশক্তিমান আলাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়।
সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কতিপয় মূলনীতি গ্রহণ করা হয়। তবে এ মূলনীতিসমূহ আইনের বিধানে ছিল না। পশ্চিমা গণতন্ত্রের সংবিধানের ন্যায় অধিকার বিল পাসের মাধ্যমে এ নীতিসমূহ গৃহীত হতো।
এ সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
বিচার বিভাগের প্রাধান্য ও স্বাধীনতা ছিল এ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের ব্যাখ্যা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
উর্দু ও বাংলা উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি লাভ করে।
এ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন ‘প্রেসিডেন্ট’, যাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হতো এবং চলিশ বছরের কম বয়সী কোন ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিধান ছিল না।
জাতীয় পরিষদ ছিল পাকিস্তানের আইনসভা। এ পরিষদ ৩০০ সদস্য নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে ১৫০ জন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এবং ১৫০ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন।
এ ছাড়া মহিলাদের জন্য ১০ বছর মেয়াদের ১০টি অতিরিক্ত আসন সংরক্ষিত ছিল। এই ১০ জন সদস্যের ৫ জন পূর্ব পাকিস্তান ও ৫ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হতেন।
সংবিধানে সমগ্র পাকিস্তানে একটি সুপ্রিম কোর্ট এবং দুই প্রদেশে দুটি হাইকোর্টের বিধান থাকে। কোর্টগুলির ওপর নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট ছিল সংবিধানের রক্ষাকবচ। জাতীয় পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধানের পরিপন্থী কোন আইনকে সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ বলে ঘোষণা করতে পারত।
প্রাদেশিক সরকারের প্রকৃতিও কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরূপ ছিল এবং একজন গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ একটি মন্ত্রিসভা দ্বারা সরকার পরিচালিত হতো। প্রাদেশিক আইন পরিষদের ৩০০ জন সদস্যও ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। এ ছাড়া মহিলাদের জন্য ১০ বছর মেয়াদের অতিরিক্ত ১০টি আসন সংরক্ষিত ছিল।
ঐতিহাসিক ছয় দফা
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই র্ফের“য়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। ৬ দফা নিম্নরূপ :
১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হইবে। সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ণ প্রাদেশিক স¦ায়ত্তশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অঞ্চলগুলোকে পূর্ণ আঞ্চলিক স¦ায়ত্তশাসন দিতে হইবে। পাকিস্তানে সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হইবে এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন সভায় সার্বভৌমত্ব থাকিবে।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা :
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল দুইটি বিষয়, যথাÑদেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতিতে সীমাবদ্ধ থাকিবে।
৩. মুদ্রা ও অর্থ স¤¦ন্ধীয় ক্ষমতা :
(ক) দুটি প্রদেশের জন্য দুুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকিবে।
অথবা
(খ) সমগ্র দেশের জন্য একটি মুদ্রাই রাখা যাইতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান হইতে পশ্চিম পাাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকর সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ এবং পৃথক অর্থ ও মুদ্রা বিষয়ক নীতি থাকিবে।
৪. রাজস¦, কর ও শুল্ক স¤¦ন্ধীয় ক্ষমতা :
কর ধার্যের কোনো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের থাকিবে না। এই ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র্রের অঙ্গরাজ্যগুলির হাতে ন্যস্ত থাকিবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্যের রাজসে¦র একটা নির্দিষ্ট অংশ লাভ করিবে।
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা :
পাকিস্তান ফেডারেশনভুক্ত দুইটি অঙ্গরাজ্যের (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুইটি পৃথক খাত হিসেবে রাখা হইবে। বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত পূর্ব পাকিস্তানের আয় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে বা সর্বসম্মত কোনো হারে অঙ্গরাজ্যগুলিই মিটাইবে। অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোনো বাধা নিষেধ থাকিবে না। সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলির বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং সস্বার্থে বিদেশের সহিত বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হইবে।
৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনি গঠনের ক্ষমতা :
আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলিকে স¦ীয় কর্র্তৃত্বাধীন আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনি গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হইবে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ইহার নিজস¦ আধাসামরিক আঞ্চলিক সেনাবাহিনি গঠন ও পোষণ করার অধিকারী হইবে।
ছয় দফার ব্যাখ্যা : আমাদের বাঁচার দাবি
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ৬ দফা কর্মসূচি দেশব্যাপী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থবাদীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনদের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবি যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈ হৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব পাক-জনগণের মুক্তি-সনদ একুশ দফা দাবি, যুক্ত-নির্বাচন প্রথার দাবি, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প-ব্যয়ে শিক্ষা লাভের দাবি, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি ইত্যাদি সকল প্রকার দাবির মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।
আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতেও এঁরা তেমনিভাবে পাকিস্তান দুই টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্ত—রের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, মিডিয়ার সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণির সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি। তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ৬ দফা দাবি অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬ দফা দাবি আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবিতে পরিণত হইয়াছে। এ অবস্থায় কায়েমি স্বার্র্থে শোষকদের প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হইবেন না, সে বিশ্বাস আমার আছে।
কিন্তু এও আমি জানি, জনগণের দুশনদের ক্ষমতা অসীম, তাঁদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এঁদের অফুরন্ত, মুখ এঁদের দশটা, গলার সুর এঁদের শতাধিক। এঁরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারি দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়া এঁরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলায় এঁরা সকলে একজোট। এঁরা নানা ছলা-কলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিস্কাম সেবার জন্য এঁরা ইতিমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এঁদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার-সচেতন দেশবাসী বিভ্রান্ত হইবেন না, তাতেও আমার কোনো সন্দেহ নাই। তথাপি ৬ দফা দাবির তাৎপর্য ও উহার অপরিহার্যতা জনগণের মধ্যে প্রচার করা সমস্ত গণতন্ত্রী, বিশেষত আওয়ামী লীগ কর্মীদের অবশ্য কর্তব্য। আশা করি, তাঁরা সকলে অবিলম্বে ৬ দফার ব্যাখ্যায় দেশময় ছড়াইয়া পড়িবেন। কর্মী ভাইদের সুবিধার জন্য ও দেশবাসী জনসাধারণের কাছে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে আমি ৬ দফার প্রতিটি দফার দফাওয়ারী সহজ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এই পুস্তিকাও প্রচার করিলাম। আওয়ামী লীগের তরফ হইতেও এ বিষয়ে আরও পুস্তিকা ও প্রচার পত্র প্রকাশ করা হইবে। আশা করি, সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী, বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের কর্মীগণ ছাড়াও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানি মাত্রেই এইসব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করিবেন।
১নং দফা
এই দফায় বলা হইয়াছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।
ইহাতে আপত্তির কী আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান জনগণের নিকট কায়েদে আজমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোট দিয়াছিলেন এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সনের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে সাতানব্বইটি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি। মুসলিম লীগ তখন কেন্দ্রের ও প্রদেশের সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সরকারি সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা লইয়া তারা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধতা করিয়াছিলেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে ইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধ্বংস হইবে, এসব যুক্তি তখনও দেওয়া ইহয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষের কথা বলিতে গেলে এই প্রশ্ন চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসিত হইয়াই গিয়াছে। কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক শাসনতন্ত্র পুরান দাবিরই পুনরুলেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁরা আঁৎকিয়া উঠেন, তাঁরা হয় পাকিস্তান-সংগ্রামে শরিক ছিলেন না, অথবা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি-দাওয়ার বিরোধিতা ও কায়েমী স্বার্থীদের দালালী করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।
এই দফায় পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার, সার্বজনীন ভোটে সরাসরি নির্বাচন ও আইন সভার সার্বভৌমত্বের যে দাবি করা হইয়াছে, তাহাতে আপত্তির কারণ কি? আমার প্রস্তাবই ভাল, না প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতির সরকার ও পরোক্ষ নির্বাচন এবং ক্ষমতাসীন আইন সভাই ভাল, এ বিচারভার জনগণের উপর ছাড়িয়া দেওয়াই কি উচিত নয়? তবে পাকিস্তানের ঐক্য-সংহতির এই তরফদারেরা এইসব প্রশ্নে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনমত যাচাই-এর প্রস্তাব না দিয়া আমার বিরুদ্ধে গালাগালি বর্ষণ করিতেছে কেন? তাঁরা যদি নিজেদের মতে এতই আস্থাবান, তবে আসুন, এই প্রশ্নের উপরই গণভোট হইয়া যাক।
২নং দফা
এই দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুইটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে।
এই প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার ওপর সর্বাপেক্ষা বেশি চটিয়াছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি ইহাদের এতই অন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে যে, ইহারা রাষ্ট্র-বিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলি পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। ইহারা ভুলিয়া যাইতেছেন যে, ব্রিটিশ সরকারের কেবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালে যে ‘প¬্যান’ দিয়াছিলেন এবং যে ‘প¬্যান’ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতে কন্দ্রেীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থাÑএই তিনটি মাত্র বিষয় ছিল এবং বাকি সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল। ইহা হইতে এটাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলের মত এই যে, এই তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকিলেই কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে পারে। অন্য কারণে কংগ্রেস চুক্তি-ভঙ্গ করায় কেবিনেট প¬্যান পরিত্যক্ত হয়। তা না হইলে এই তিন বিষয় লইয়াই আজও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে থাকিত। আমি আমার প্রস্তাবে কেবিনেট প¬্যানেরই অনুসরণ করিয়াছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা আমি বাদ দিয়াছি সত্য, কিন্তু তার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। অখণ্ড ভারতের বেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও অখণ্ডতা ছিল। ফেডারেশন গঠনের রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক মূলনীতি এই যে, যে যে বিষয়ে ফেডারেটিং স্টেটসমূহের স্বার্থ এক ও অবিভাজ্য, কেবল সেই সেই বিষয়ই ফেডারেশন এখতিয়ারে দেওয়া হয়। এই মূলনীতি অনুসারে অখণ্ড ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য ছিল। পেশওয়ার ইহতে চাটগাঁও পর্যন্ত একই রেল চলিতে পারিত। কিন্তু পাকিস্তান তা নয়। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য তো নয়ই, বরঞ্চ সম্পূর্ণ পৃথক। রেলওয়েকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ট্রান্সফার করিয়া বর্তমান সরকারও তা স্বীকার করিয়াছেন। টেলিফোন-টেলিগ্রাম, পোস্ট অফিসের ব্যাপারেও এ সত্য স্বীকার করিতেই হইবে। তবে বলা যাইতে পারে যে, একুশ দফায় যখন কেন্দ্রকে তিনটি বিষয় দিবার সুপারিশ ছিল, তখন আমি আমার বর্তমান প্রস্তাবে মাত্র দুই বিষয় দিলাম কেন? এই প্রশ্নের জবাবে আমি ৩নং দফার ব্যাখ্যায় দিয়াছি। এখানে আর পুনরুক্তি করিলাম না।
আরেকটা ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হইতে পারে। আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে ‘প্রদেশ’ না বলিয়া ‘স্টেট’ বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থবাদী শোষকরা জনগণকে এই বলিয়া ধোকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র সব বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস’ বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ফেডারেশন অথবা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানি, এমন কি আমদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাদের প্রদেশ সমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা ‘প্রদেশ’ নয় ‘স্টেট’। এরা যদি ভারত ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া ‘স্টেট’ হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেইবা কর্তারা এত এলার্জিক কেন?
৩নং দফা
এই দফায় আমি মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অলটারনেটিভ প্রস্তাব দিয়াছি। এই দুইটি প্রস্তাবের যে কোনো একটি গ্রহণ করিলেই চলিবে;
ক.
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সী কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট ব্যাঙ্ক’ থাকিবে।
খ.
দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সী থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তান পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে, দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে।
এই দুইটি বিকল্প প্রস্তাব হইতে দেখা যাইবে যে, মুদ্রাকে সরাসরি কেন্দ্রের হাত হইতে প্রদেশের হাতে আনিবার প্রস্তাব আমি করি নাই। যদি আমার দ্বিতীয় অলটারনেটিভ গৃহীত হয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থাকিয়া যাইবে। ঐ অবস্থায় আমি একুশ দফা প্রস্তাবের খেলাফে কোনো সুপারিশ করিয়াছি, এ কথা বলা চলে না।
যদি পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইরা আমার এই প্রস্তাবে রাজি না হন, তবে শুধু প্রথম বিকল্প অর্থাৎ কেন্দ্রের হাত হইতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনিতে হইবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হইলে আমাদের এবং উভয় অঞ্চলের সুবিধার খাতিরে পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইরা এই প্রস্তাবে রাজি হইবেন। আমরা তাঁদের খাতিরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ত্যাগ করিয়া সংখ্যাসাম্য মানিয়া লইয়াছি, তারা কি আমাদের খাতিরে এইটুকু করিবেন না?
আর যদি অবস্থা গতিকে মুদ্রাকে প্রদেশের এলাকায় আনিতেও হয়, তবু তাতে কেন্দ্র দুর্বল হইবে না, পাকিস্তানের কোনো অনিষ্ট হইবে না। কেবিনেট প¬্যানে নিখিল ভারতীয় কেন্দ্রের যে প্রস্তাব ছিল, তাতে মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। ঐ প্রস্তাব পেশ করিয়া বৃটিশ সরকার এবং ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ, সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করিয়া কেন্দ্র চলিতে পারে। কথাটা সত্য। রাষ্ট্রীয় অর্থ-বিজ্ঞানে এই ব্যবস্থার স্বীকৃতি আছে। কেন্দ্রের বদলে প্রদেশের হাতে অর্থনীতি রাখা এবং একই দেশে পৃথক পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকার নজীর দুনিয়ার বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্র্রেও আছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের অর্থনীতি চলে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মাধ্যমে পৃথক পৃথক স্টেট ব্যাঙ্কের দ্বারা। অত যে শক্তিশালী দোর্দণ্ড প্রতাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন, তাহাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দপ্তর নাই। শুধু প্রাদেশিক সরকারের অর্থাৎ স্টেট রিপাবলিক সমূহেরই অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দপ্তর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐসব প্রাদেশিক মন্ত্রী ও মন্ত্রীর দফতর দিয়াই মিটিয়া থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশেও আঞ্চলিক সুবিধার খাতিরে দুইটি পৃথক ও স্বতন্ত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বহুদিন আগে হইতে চালু আছে।
আমার প্রস্তাবের মর্ম এই যে, উপরোক্ত দুই বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হইলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত¡াবধানে থাকিবে। সে অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমনি থাকিবে। পার্থক্য শুধু এই হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘ঢাকা’ লেখা থাকিবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘লাহোর’ লেখা থাকিবে। পক্ষান্তরে, আমার প্রস্তাবের দ্বিতীয় বিকল্প না হইয়া যদি প্রথম বিকল্পও গৃহীত হয়, সে অবস্থাতেই উভয় অঞ্চলের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য থাকিবে এবং পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ও নিদর্শন স্বরূপ উভয় আঞ্চলিক সরকারের সহযোগিতায় একই নকশার মুদ্রা প্রচলন করা যাইবে।
একটু তলাইয়া চিন্তা করিলেই বুঝা যাইবে যে, এই দুই ব্যবস্থার একটি গ্রহণ করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানকে নিশ্চিত অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করার অন্য কোনো উপায় নাই। সারা পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা হওয়ায় ও দুই অঞ্চলের মুদ্রার মধ্যে কোনো পৃথক চিহ্ন না থাকায় আঞ্চলিক কারেন্সী সার্কুলেশনে কোনো বিধি-নিষেধ ও নির্ভুল হিসাব নাই। মুদ্রা ও অর্থনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকায় অতি সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তান চলিয়া যাইতেছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স ও বৈদেশিক মিশন সমূহের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় প্রতি মিনিটে এই পাচারের কাজ অবিরাম গতিতে চলিতেছে। সকলেই জানেন সরকারি স্টেট ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকসহ সমস্ত ব্যাংকের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে। এই সেদিন মাত্র প্রতিষ্ঠিত ছোট দু’এক খানি ব্যাংক ইহার সা¤প্রতিক ব্যতিক্রম মাত্র। এইসব ব্যাংকের ডিপোজিটের টাকা, শেয়ার মানি, সিকিউরিটি মানি, শিল্প-বাণিজ্যের আয়, মুনাফা ও শেয়ার মানি, এক কথায় পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সমস্ত আর্থিক লেনদেনের টাকা বালুচরে ঢালা পানির মতো একটানে তলদেশে হেড অফিসে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান চলিয়া যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তান শুকনো বালুচর হইয়া থাকিতেছে। বালুচরে পানির দরকার হইলে টিউবওয়েল খুদিয়া তলদেশ হইতে পানি তুলিতে হয়। অবশিষ্ট পানি তলদেশে জমা থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় অর্থও তেমনি চেকের টিউবওয়েলের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আনিতে হয়। উদ্বৃত্ত আর্থিক সেভিং তলদেশেই অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানেই জমা থাকে। এই কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাপিটেল ফর্মেশন হইতে পারে নাই। সব ক্যাপিটেল ফর্মেশন পশ্চিমে হইয়াছে। বর্তমান ব্যবস্থা চলিতে থাকিলে কোনোদিন পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গঠন হইবেও না। কারণ সেভিং মানেই ক্যাপিটেল ফর্মেশন।
শুধু ফ্লাইট-অব-ক্যাপিটেল বা মুদ্রা পাচারই নয়, মুদ্রাস্ফীতি ও হেতু পূর্ব পাকিস্তানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দুর্মূল্যতা, জনগণের বিশেষত পাট চাষীদের দুর্দশা, সমস্তের জন্য দায়ি এই মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনীতি। আমি ৫ নং দফার ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করিয়াছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে, এই ফ্লাইট-অব-ক্যাপিটেল বন্ধ করিতে না পারিলে পূর্ব পাকিস্তানিরা নিজেরা শিল্প-বাণিজ্যে এক পা-ও অগ্রসর হইতে পারিবে না। কারণ এ অবস্থায় মূলধন গড়িয়া উঠিতে পারে না।
৪নং দফা
এই দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ি রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিক্যালি জমা হইয়া যাইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংঙ্কসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাতেই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।
আমার এই প্রস্তাবেই কায়েমী স্বার্থের কালোবাজারি ও মুনাফাখোর শোষকরা সবচেয়ে বেশি চমকিয়া উঠিয়াছে। তারা বলিতেছে, ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের না থাকিলে সে সরকার চলিবে কিরূপে? কেন্দ্রীয় সরকার তাতে যে একেবারে খয়রাতী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবে। খয়রাতের উপর নির্ভর করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার দেশরক্ষা করিবেন কেমনে? পররাষ্ট্রনীতিই বা চালাইবেন কী দিয়া? প্রয়োজনের সময় চাঁদা না দিলে কেন্দ্রীয় সরকারতো অনাহারে মারা যাইবেন। অতএব এটা নিশ্চয়ই পাকিস্তান ধ্বংসেরই ষড়যন্ত্র।
কায়েমী স্বার্থবাদীরা এই ধরনের কত কথাই না বলিতেছেন। অথচ এর একটা আশঙ্কাও সত্য নয়। সত্য যে নয় সেটা বুঝিবার মতো বিদ্যাবুদ্ধি তাঁদের নিশ্চয়ই আছে। তবু যে তাঁরা একথা বলিতেছেন, তার একমাত্র কারণ তাদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণিগত স্বার্থ। সে স্বার্থ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অবাধে শোষণ ও লুণ্ঠন করার অধিকার। তারা জানেন যে, আমার এই প্রস্তাবে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের দায়িত্ব দেওয়া না হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিঘেœ চলার মতো যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সে ব্যবস্থা নিখুঁত করিবার শাসনতান্ত্রিক বিধান রচনার সুপারিশ করা হইয়াছে। এটাই সরকারী তহবিলে সবচেয়ে অমোঘ, অব্যর্থ ও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ উপায়। তাঁরা এটাও জানেন যে, কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্র-বিজ্ঞানে স্বীকৃত। তাঁরা এ খবরও রাখেন যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প¬্যান বৃটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতেও সমস্ত ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল; কেন্দ্রকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। ৩ নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। তার মধ্যে দুনিয়ায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী-দফতর বলিয়া কোনো বস্তুর অস্তিত্বই নাই। তাতে কি অর্থাভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে? তার দেশরক্ষা বাহিনি, পররাষ্ট্র-দফতর কি সেজন্য দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে? পড়ে নাই। আমার প্রস্তাব কার্যকরী হইলেও তেমনি পাকিস্তানের দেশরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হইবে না। কারণ আমার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় তহবিলের নিরাপত্তার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হইয়াছে। সে অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন বিধান থাকিবে যে, আঞ্চলিক সরকার যেখানে যখন যে খাতেই টাকা ট্যাক্স ধার্য ও আদায় করুন না কেন, শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত সে টাকার হারের অংশ রিজার্ভ ব্যাংকে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হইয়া যাইবে। সে টাকায় আঞ্চলিক সরকারের কোনো হাত থাকিবে না। এই অবস্থায় অনেক সুবিধা দেওয়া হইবে।
প্রথমত :
কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স আদায়ের ঝামেলা পোহাইতে হইবে না।
দ্বিতীয়ত :
ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের জন্য অন্য কোনো দফতর বা অফিসার বাহিনি রাখিতে হইবে না।
তৃতীয়ত :
অঞ্চলে ও কেন্দ্রের জন্য ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের মধ্যে ডুপ্লিকেশন হইবে না। তাতে আদায়ি খরচায় অপব্যয় ও অপচয় বন্ধ হইবে। ঐভাবে সঞ্চিত টাকার দ্বারা গঠন ও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করা যাইবে। অফিসারবাহিনিকেও উন্নততর সৎকাজে নিয়োজিত করা যাইবে।
চতুর্থত :
ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের একীকরণ সহজতর হইবে। সকলেই জানেন, অর্থ-বিজ্ঞানীরা এখন ক্রমেই সিংগাল ট্যাক্সেশনের দিকে আকৃষ্ট হইতেছেন। সিংগাল ট্যাক্সেশনের নীতিকে সকলেই অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসু বলিয়া অভিহীত করিতেছেন। ট্যাক্সেশনকে ফেডারেশনের এলাকা হইতে অঞ্চলের এখতিয়ারভুক্ত করা, এই সর্বোত্তম ও সর্বশেষ আর্থিক নীতি গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ বলা যাইতে পারে।
৫নং দফা
এই দফায় আমি বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করিয়াছি:
দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃৃথক হিসাব রাখিতে হইবে।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে।
ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে।
দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি চলিবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি রপ্তানি করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা করিবার জন্য এই ব্যবস্থা ৩ নং দফার মতোই অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের আঠার বছরের আর্থিক ইতিহাসের দিকে একটু নজর বুলালেই দেখা যাইবে যে :
পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প গড়িয়া তোলা হইয়াছে এবং হইতেছে। সেই সকল শিল্প জাত দ্রব্যের অর্জিত বিদেশি মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা বলা হইতেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের মূলধন গড়িয়া না ওঠায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নাই এই অজুহাতে পুর্ব পাকিস্তানের বিদেশি আয় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। এই ভাবে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত হইতে পারিতেছে না।
পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণে আয় করে সেই পরিমাণ ব্যয় করিতে পারে না। সকলেই জানেন, পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণ রপ্তানি করে, আমদানি করে সাধারণত তার অর্ধেকেরও কম। ফলে অর্থনীতির অমোঘ নিয়ম অনুসারেই পূর্ব পাকিস্তানে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ম্যালেরিয়া জ্বরের মতো লাগিয়াই আছে। তার ফলে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম এত বেশি। বিদেশ হতে আমদানি করা একই জিনিসের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি দামের তুলনা করিলেই এটা বোঝা যাইবে। বিদেশি মুদ্রা বণ্টনের দায়িত্ব এবং অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকার ফলেই আমাদের এই দুর্দশা।
পাকিস্তানের বিদেশি মুদ্রার তিন ভাগের দুই ভাগই অর্জিত হয় পাট হইতে। অথচ পাট চাষীকে পাটের ন্যায্য মূল্য তো দূরের কথা আবাদি খরচটাও দেওয়া হয় না। ফলে পাট চাষীদের ভাগ্য আজ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলার জিনিসে পরিণত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাটের চাষ নিয়ন্ত্রণ করেন কিন্তু চাষীকে পাটের ন্যায্য দাম দিতে পারেন না। এমন অদ্ভুত অর্থনীতি দুনিয়ার আর কোনো দেশে নাই। যতদিন পাট থাকে চাষীর ঘরে, ততদিন পাটের দাম থাকে পনের-বিশ টাকা। ব্যবসায়ীর গুদামে চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথে তার দাম হয় পঞ্চাশ। এ খেলা গরীব পাট চাষী চিরকাল দেখিয়া আসিতেছে। পাট ব্যবসায় জাতীয়করণ করিয়া পাট রপ্তানিকে সরকারি আয়ত্তে আনা ছাড়া এর আর কোনো প্রতিকার নাই, একথা আমরা বহুবার বলিয়াছি। এ উদ্দেশ্যে আমরা আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আমলে জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন গঠন করিয়াছিলাম। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে পুঁজিপতিরা আমাদের সে আরদ্ধ কাজ ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রাই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হইতেছে তা নয়, আমাদের অর্জিত বিদেশি মুদ্রার জোরে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশি লোন ও এইড আসিতেছে, তাও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হইতেছে। কিন্তু সে লোনের সুদ বহণ করিতে হইতেছে পূর্ব পাকিস্তানকেই। ঐ অবস্থার প্রতিকার করিয়া পাট চাষীকে পাটের ন্যায্য মূল্য দিতে হইলে, আমদানি রপ্তানি সমান করিয়া জনসাধারণকে সস্তা দামে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করিয়া তাদের জীবন সুখময় করিতে হইলে এবং সর্বোপরি আমাদের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের হাতে পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করিতে হইলে আমার প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থা ছাড়া উপায়ান্তর নাই।
৬নং দফা
এই দফায় আমি পূর্ব পাকিস্তান মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনি গঠনের সুপারিশ করিয়াছি। এ দাবি অন্যায়ও নয়, নতুনও নয়। একুশ দফার দাবিতে আমরা আনসার বাহিনিকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনিতে রূপান্তরিত করার দাবি করিয়াছিলাম। তাহাতো করা হয়ই নাই, বরঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ ইপিআর বাহিনিকে এখন কেন্দ্রের অধীনে নেওয়া হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান অস্ত্র কারখানা ও নৌ বাহিনির হেডকোয়ার্টার স্থাপন করতঃ এক অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবিও পুরণ করে নাই। পূর্ব পাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানির বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবি করিতে হইবে কেন? সরকার নিজ হইতে সে দায়িত্ব পালন করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তান আগে বাঁচাইয়া সময় ও সুযোগ থাকিলে পরে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচান হইবে, ইহাই কি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত? পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষা ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানই রহিয়াছে এমন সাংঘাতিক কথা শাসনকর্তারা বলেন কোন মুখে? মাত্র সতের দিনের পাক ভারত যুদ্ধই কি প্রমাণ করে নাই আমরা কত নিরূপায়। শত্র“র দয়া ও মর্জির উপরতো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যত আমাদের তাই করিয়া রাখিয়াছে।
তবু আমরা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির খাতিরে দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এও চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আত্মনির্ভর করিবার জন্য এখানে উপযুক্ত পরিমাণ দেশরক্ষা বাহিনি গঠন করুন। অস্ত্র কারখানা স্থাপন করুন। নৌ বাহিনির দফতর এখানে নিয়া আসুন। এসব কাজ সরকার কবে করিবেন জানি না। কিন্তু ইতিমধ্যে অল্প খরচে ছোটখাট অস্ত্র-শস্ত্র দিয়া আধা সামরিক বাহিনি গঠন করিতে দিতেও পশ্চিমা ভাইদের অত আপত্তি কেন? পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র যুদ্ধ তহবিলে চাঁদা উঠিলে তাও কেন্দ্রীয় রক্ষা তহবিলে নিয়া যাওয়া হয় কেন? ঐসব প্রশ্নের উত্তর নাই। তবু কেন্দ্রীয় ব্যাপারে অঞ্চলের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার আমরাও চাই না। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যেমন করিয়া পারে গরিবী হালেই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিবে, এমন দাবি কি অন্যায়? এই দাবি করিলেই সেটা হইবে দেশদ্রোহিতা? এ প্রসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি ভাই-বোনদের খেদমতে আমার কয়েকটি আরজ আছে?
এক
তারা মনে করিবেন না, আমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানিদের অধিকার দাবি করিতেছি। আমার ৬ দফা কর্মসূচিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাবিও সমভাবেই রহিয়াছে। এ দাবি স্বীকৃত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানিরাও সমভাবে উপকৃত হইবেন।
দুই
আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তান পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে, তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি যে, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা দায়ি নয়। আমি এও জানি যে, আমাদের মতো দরিদ্র পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক আছেন। যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততদিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে। এই আঞ্চলিক শোষণের জন্য দায়ি আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সে অবস্থানকে আগ্রাহ্য করিয়া যে অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চালাইবার চেষ্টা চলিতেছে সেই ব্যবস্থা। ধরুন, যদি পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তান না হইয়া পূর্ব পাকিস্তান হইত, পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনির তিনটি দফরতই যদি পূর্ব পাকিস্তানে হইত তবে কার কী অসুবিধা সুবিধা হইত একটা বিচার করুন। পাকিস্তানের মোট রাজস্বের শতকরা বাষট্টি টাকা খরচ হয় দেশরক্ষা বাহিনিতে এবং শতকরা বত্রিশ টাকা খরচ হয় কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায়। এই এখন শতকরা চুরানব্বই টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া তখন হইতে পূর্ব পাকিস্তানে। আপনারা জানেন অর্থ বিজ্ঞানের কথা: সরকারি আয় জনগণের ব্যয় এবং সরকারি ব্যয় জনগণের আয়। এই নিয়মে বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারের গোটা আয়ের অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয় ঠিকই, কিন্তু সরকারি ব্যয়ের সবটুকুই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তান অবস্থিত থাকায় সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বিদেশি মিশনসমূহ তাদের সমস্ত ব্যয় পশ্চিম পাকিস্তানেই করিতে বাধ্য হইতেছে। এই ব্যয়ের সাকুল্যই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। ফলে প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান তার মোকাবিলায় ঐ পরিমাণ গরীব হইতেছে। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে পূর্ব পাকিস্তান আমাদের রাজধানী হইত তবে এই সব খরচ পূর্ব পাকিস্তানে হইত। আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা এই পরিমাণে ধনী হইতাম। আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঐ পরিমাণে গরীব হইতেন। তখন আপনারা কী করিতেন? যেসব দাবি করার জন্য আমাকে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতার তহ্মত দিতেছেন সেই সব দাবি আপনারা নিজেরাই করিতেন। আমাদের চেয়ে জোরেই করিতেন। অনেক আগেই করিতেন। আমাদের মতো আঠারো বছর বসিয়া থাকিতেন না। সেটা করা আপনাদের অন্যায় ও হইত না।
তিন
আপনারা দাবি করিলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা কি করিতাম, জানেন? আপনাদের সব দাবি মানিয়া লইতাম। আপনাদিগকে প্রাদেশিকতাবাদী বলিয়া গাল দিতাম না। কারণ, আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, ওসব আপনাদের হক পাওনা। নিজের হক পাওনা দাবি করা অন্যায় নয়, কর্তব্য। এ বিশ্বাস আমাদের এতই আন্তরিক যে, সে অবস্থা হইলে আপনাদের দাবি করিতে হইত না। আপনাদের বুঝাইয়া দিতাম। আমরা নিজেদের হক দাবি করিতেছি বলিয়া আমাদের স্বার্থপর বলিতেছেন। আমাদের দিবার আওকাৎ থাকিলে বরঞ্চ পরকে কিছু দিয়াও দিই। দৃষ্টান্ত চান? শুনুন তবে :
১.
প্রথম গণপরিষদে আমার মেম্বার সংখ্যা ছিল ৪৪; আপনাদের ছিল ২৮। আমরা ইচ্ছা করিলে গণতান্ত্রিক শক্তিতে ভোটের জোরে রাজধানী ও দেশ রক্ষার সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে আনিতে পারিতাম। তা করি নাই।
২.
পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যাল্পতা দেখিয়া ভাইয়ের দরদ লইয়া আমাদের ৪৪ টা আসানের মধ্যে ৬টাতে পূর্ব পাকিস্তানিদের ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানি মেম্বার নির্বাচন করিয়াছিলাম।
৩.
ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করিতে পারিতাম। তা না করিয়া বাংলার সাথে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা দাবি করিয়াছিলাম।
৪.
ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাজনক শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারিতাম।
৫.
আপনাদের মন হইতে মেজরিটি ভয় দূর করিয়া সে স্থলে ভ্রাতৃত্ব ও সমতাবোধ সৃষ্টির জন্য উভয় অঞ্চলে সকল সমতা বিধানের আশ্বাসে আমারা সংখ্যাগুরুত্ব ত্যাগ করিয়া সংখ্যাসাম্য গ্রহণ করিয়াছিলাম।
চার
সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানি ভাই সাহেবান, আপনারা দেখিতেছেন, যেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল, আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয় দিতাম। যদি পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইত তবে আপনাদের দাবি করিবার আগেই আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে সত্য-সত্যই দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করিতাম। দ্বিতীয় রাজধানীর নামে ধোকা দিতাম না। সে অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রকার ব্যয় যাতে উভয় অঞ্চলে সমান হয় তার নিখুঁত ব্যবস্থা করিতাম। সকল ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে এবং প্রদেশসমূহকে পৃথক পৃথকভাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতাম। আমরা দেখাইতাম, পূর্ব পাকিস্তানিরা, মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানিদের নয়, ছোট বড় নির্বিশেষে তাহা সকল পাকিস্তানির। পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইলে তাহার সুযোগ লইয়া আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা সব অধিকার ও চাকরি গ্রাস করিতাম না। পাকিস্তানিদের শাসনসভার পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতেই দিতাম। আপনাদের কটন বোর্ডে আমরা চেয়ারম্যান হইতে যাইতাম না। আপনাদের প্রদেশের আমরা গভর্নর হইতেও চাহিতাম না। আপনাদের পিআইডিসি, আপনাদের ওয়াপদা, আপনাদের ডিআইটি আপনাদের পোর্ট ট্রাস্ট, আপনাদের রেলওয়ে ইত্যাদির চেয়ারম্যানি আমরা দখল করিতাম না। আপনাদেরই করিতে দিতাম। সমস্ত অল পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত করিতাম না। ফলত পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনীতিতে মোটা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সরু করিতাম না। দুই অঞ্চলের মধ্যে এই মারাত্মক ডিসপ্যারিটি সৃষ্টি হইতে দিতাম না।
এমনি উদারতা, এমন নিরপেক্ষতা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে এমন ইনসাফ বোধই পাকিস্তানি দেশপ্রেমের বুনিয়াদ। এটা যার মধ্যে আছে, কেবল তিনিই দেশপ্রেমিক। যে নেতার মধ্যে এই দেশপ্রেম আছে, কেবল তিনিই পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের উপর নেতৃত্বের যোগ্য। যে নেতা বিশ্বাস করেন, দুইটি অঞ্চল আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দেহের দুই চোখ, দুই কান, দুই নাসিকা, দুই পাটি দাঁত, দুই পা; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিতে হইলে এইসব জোড়ার দুটিকেই সমান সুস্থ ও শক্তিশালী করিতে হইবে; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের এক অঙ্গ দুর্বল হইলে গোটা পকিস্তানই দুর্বল হইয়া পড়ে; যে নেতা বিশ্বাস করেন ইচ্ছা করিয়া বা জানিয়া শুনিয়া যারা পাকিস্তানের এক অঙ্গকে দুর্বল করিতে চায় তারা পাকিস্তানের দুশমন; যে নেতা দৃঢ় ও সবল হস্তে সেই দুশমনদের শায়েস্তা করিতে প্রস্তুত আছেন, কেবল তিনিই পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হইবার অধিকারী। কেবল তার-ই নেতৃত্বে পাকিস্তানের ঐক্য অটুট ও শক্তি অপরাজেয় হইবে। পাকিস্তানের মতো বিশাল ও অসাধারণ রাষ্ট্র্রের নায়ক হইতে হইলে নায়কের অন্তরও হইতে হবে বিশাল ও অসাধারণ। আশা করি, আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইরা এই মাপকাঠিতে আমার ছয় দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি নয়, গোটা পাকিস্তানিরই বাঁচার দাবি।
আমার প্রিয় ভাই বোনেরা, আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ৬ দফা দাবিতে একটিও অন্যায়, অসঙ্গতি, পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্ক সহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমী স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার এলজাম লাগাইতেছেন। এটা নতুনও নয়, বিস্ময়ের কথাও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বলিতে গিয়া আমার বাপ-দাদার মতো মুরুব্বিরাই এদের কাছে গাল খাইয়াছেন, এদের হাতে লাঞ্চনা ভোগ করিয়াছেন, আর আমি কোনো ছার? দেশবাসীর মনে আছে, আমাদের নয়নমনি শেরে বাংলা ফজলুল হককে এরা দেশদ্রোহী বলিয়াছেন। দেশবাসী এও দেখিয়াছেন যে, পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজনমান্য জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহীতার অভিযোগে কারাবরণ করিতে হইয়াছিল এদেরই হাতে। অতএব দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায় দাবির কথা বলিতে গেলে দেশদ্রোহীতার বদনাম ও জেল জুলুমের তকদির আমার হইয়াছে। মুরুব্বীদের দোয়া, সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সেসব সহ্য করিবার মতো মনের বল আলাহ আমাদের দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির ভালবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার নগণ্য ব্যক্তি জীবনের মূল্যই বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহুম জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই, আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহুদিন আগেই পেছনে ফেলিয়া পৌঢ়ত্বে পৌঁছিয়াছি। আমার দেশের প্রিয় ভাই-বোনেরা আল¬াহর দরবারে শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকি জীবনটুকু আমি যেন তাহাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।
আপনাদের স্নেহধন্য খাদেমÑ
শেখ মুজিবুর রহমান
ছাত্রদের ১১ দফা
পাকিস্তানের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, ছাত্র-জনতা, কৃষক-মজুর, মেহনতি শিক্ষক, ডাক্তার-কবিরাজ, রিকশাওয়ালা, ডোম-মেথর, মাঝি-কুলি, দেশের সকল শ্রেণি, সকল স্তরের মানুষ এক বাক্যে সমস্ত অন্তর দিয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফা সমর্থন করেছিল। ১১ দফাকে তাদের প্রাণের দফা বলে স্বীকার করে নিয়েছিল।
মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছাত্র জনতার ১১ দফার সমর্থনে সুস্পষ্ট এবং দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন, ছাত্রদের ১১ দফা সারা পাকিস্তানের ১২ কোটি জনতার দাবি। এই ১১ দফা সঠিকভাবে কায়েম হলে আমাদের দলের ১৪ দফাও বহুলাংশে কায়েম হয়ে যাবে। সুতরাং ১১ দফার জন্যে শুধু ছাত্ররাই জীবন দেবে কেন? এই ১১ দফার জন্যে কৃষক-মজুর, মেহনতি মজলুম জনগণও অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিবে।
এই ১১ দফার আন্দোলনের কৃষক সমিতির সদস্য ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান প্রথম শহীদ হন। এই ১১ দফা দাবির ওপর তিনি রক্তের স্বাক্ষর অঙ্কিত করে অমর হয়ে রয়েছেন। শত শত ছাত্র-জনতার প্রাণরক্তে জনতার মুক্তিসনদ ১১ দফা লিখা হয়ে গেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান লক্ষাধিক জনতার সামনে সুস্পষ্টভাবে ওয়াদা করেছিলেন, ১১ দফা দাবির ভেতরে আমাদের দলের ৬ দফাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সুতরাং ছাত্রদের ১১ দফা কায়েম করার সংগ্রামে আমরাও শরীক হবো। তিনি প্রসঙ্গক্রমে আরও বলেন যে, ছাত্র-জনতা আমাকে ফাঁসির কবল থেকে মুক্ত করে এনেছে। তাদের সাথে আমি বিশ্বসঘাতকতা করব না, করতে পারি না।
জনতার রক্তের কালিতে লিখা সেই ঐতিহাসিক ১১ দফা নিম্নে দেওয়া হলো:
ক) স্বচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং কলেজসহ প্রাদেশিকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিতে হবে।
খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজসমূহকে সত্বর অনুমোদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষা প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।
গ) প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আইএ, আইএসসি, আইকম ও বিএ, বিএসসি, বিকম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এমএ ও এমকম ক্লাস চালু করিতে হইবে।
ঘ) ছাত্র বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে। স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ডের সংখ্যা সৃষ্টি করিতে হইবে এবং ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না।
ঙ) হল, হোস্টেলের ডাইনিং হল, ক্যান্টিন খরচার শতকরা ৫০ ভাগ সরকার কর্তৃক সাবসিডি হিসাবে প্রদান করিতে হইবে।
চ) হল ও হোস্টেল সমস্যার সমাধান করিতে হবে।
ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হবে। অফিস-আদালতে মাতৃভাষা বাংলা চালু করিতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে।
জ) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে।
ঝ) মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশন ভর্তি প্রথা বন্ধ, মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের দাবি মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
ঞ) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ, ১০% ৭৫% রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সুব্যবস্থা, প্রকৌশলী ছাত্রীদের শেষ বর্ষেও ক্লাস দেওয়ার ব্যবস্থাসহ সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
ট) পলিটেকনিক ছাত্রদের কনডেন্স কোর্স-এর সুযোগ দিতে হইবে এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করিয়া একমাত্র সেমিস্টার পরীক্ষা ভিত্তিতেই ডিপে¬ামা দিতে হইবে।
ঠ) টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনোলজি এবং আর্ট কলেজের ছাত্রদের সকল দাবি অবিলম্বে মানিয়া লইতে হইবে। আইইউআর ছাত্রদের দশ-দফা; সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্রদের, এমবিএ ছাত্রদের ও আইনের ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা ‘ফ্যাকাল্টি’ করিতে হইবে।
ড) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লে¬ামা ছাত্রদের কনডেন্স কোর্সের দাবিসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
ঢ) ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের আইডেন্টি কার্ড দেখাইয়া শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেশনে টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও এই কন্সেশন দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মতো বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোন স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাসে যাতায়েতের শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেশন দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যেগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেশন দিতে হইবে।
ণ) চাকরির নিশ্চয়তার বিধান নিশ্চিত করতে হবে।
ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে। এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে।
থ) শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির প্রমাণ্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামাদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট সম্পূর্ণ বাতিল করিতে এবং ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হইবে।
২. প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে।
৩. নিম্নলিখিত দাবি সমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে:
ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।
গ) দুই অঞ্চলের মধ্যে একটা মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে, যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেশন রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।
ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ি রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংক সমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।
ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বহিঃবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে। এবং বহিঃবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির প্রক্রিয়ারধীন থাকিবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলি সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত ধারা অনুযায়ী প্রদান করিবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে অঙ্গরাষ্ট্রগলির মধ্যে আমদানি-রপ্তানি চলিবে। এবং ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রপ্তানি করিবার অধিকার অঙ্গরাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতন্ত্রে বিধান করিতে হইবে।
চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি রক্ষীবাহিনি গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌবাহিনির সদর দপ্তর স্থাপন করিতে হইবে।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতঃ সাব ফেডারেশন গঠন।
৫. ব্যাংক বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহত শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে।
৬. কৃষকের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করিতে হইবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণ প্রতি ৪০ টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হবে।
৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি বোনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কালাকানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান করিতে হইবে।
৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৯. জরুরি আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।
১০. সিয়াটো, সেন্টো, পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে।
১১. দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহারের এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারীকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষে :
আবদুর রউফ
সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ
খালেদ মোহাম্মদ
সাধারণ সম্পাদক
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ
সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক
সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
সামসুদ্দোহা
সাধারণ সম্পাদক
পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
মোস্তফা জামাল হায়দার
সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
দীপা দত্ত
সহ সম্পাদীকা
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
তোফায়েল আহমদ
সহ-সভাপতি
ডাকসু
নাজিম কামরান চৌধুরী
সাধারণ সম্পাদক
ডাকসু
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বা রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলার সরকারী ভাষ্য তারিখ : ১৯ জুন ১৯৬৮
১৯৬৮ সালের সংশোধিত ফৌজদারি আইন অধ্যাদেশের ইউ/এস-৫ ধারামতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই মামলার ভাষ্য আদালতে উপস্থাপন করা হলো।
যথাযথ সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করা যাচ্ছে যে:
১. গোপনসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের অনুসরণে এমন একটি ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করা হয় যার মাধ্যমে ভারত কর্তৃক প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অর্থ ব্যবহার করে পাকিস্তানের একাংশে সামরিক বিদ্রোহের দ্বারা ভারতের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কতিপয় ব্যক্তিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় এবং কতিপয় ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চাকুরির সঙ্গে স্পৃক্ত আইনের আওতায় গ্রেফতার করা হয়।
২. ঐ সকল ব্যক্তির কয়েকজনের নিকট থেকে উদ্ধারকৃত তথ্য-প্রমাণাদিতে দেখা যায় যে, তার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এবং কিছু নির্দিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের ছদ্মনাম ব্যবহার করছে এবং একটি ডি ডে-তে করণীয় কার্যাদি সম্পর্কে ও অন্যান্য কিছু গুুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার অনুরূপ ছদ্ম শব্দাবলি ব্যবহার করছে।
৩. তাদের প্রধান কর্মপরিকল্পনা ছিল সামরিক ইউনিটগুলোর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে তাদেরকে অচল করে দেয়া। কমান্ডো স্টাইলে অভিযান চালিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে তারা অগ্রসর হয়:
ক) সামরিক বাহিনি থেকে আসা লোকদের এবং প্রাক্ত সৈনিক ও বেসামরিক চাকরিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন করা, যারা কার্যকরভাবে একটি অগ্রবাহিনির ভূমিকা পালন করে প্রচলিত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
খ) ভারত থেকে প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়াও স্থানীয় উৎসসমূহ থেকে প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিরাপদে রাখা।
গ) মিথ্যা প্রচারণার সাহায্যে সর্বসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক আনুগত্যহীনতা সৃষ্টি করা এবং
ঘ) জোরপূর্বক সামরিক কৌশলগত স্থানসমূহ দখল করার উদ্দেশ্যে ডি ডে এর মত একটি সুযোগের মুহূর্ত নির্ধারণ করা।
৪. এই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার জন্য একটি সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় পকিস্তানের যারা ঐ অভিযান কার্যকরী করার দায়িত্বে ছিলেন তাদের প্রতিনিধিরা এবং ভারতীয় পক্ষের যারা অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এই ষড়যন্ত্রকে সহায়তা করার উদ্যোগ নিয়েছিল তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১২ই জুলাই ভারতের আগরতলা এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
৫. এই ষড়যন্ত্র এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি এবং বিশেষ উলেখযোগ্য বিষয়গুলো নিচের অধ্যায়সমূহে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে, যখন অভিযুক্ত ষড়যন্ত্রকারীদের কোনো সভার বর্ণনা দেয়া হয়েছে তখন ষড়যন্ত্রের সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পুনরাবৃত্তি পরিহার করা হয়েছে। যদিও তার তাদের প্রায় প্রতিটি সভায়ই ঐ বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতো। এই অভিযোগনামার সঙ্গে পাঁচটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর শিরোনাম যথাক্রমে-তালিকা-এ অভিযুক্তদের তালিকা সাক্ষীর তালিকা, তথ্য-প্রমাণের তালিকা ও জিনিসপত্রের তালিকা সংযোজনী-১ এ এগুলোর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সংযোজনী-২ এ অভিযুক্তদের ছদ্মনাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কোনো একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম যখন প্রথমবার উলেখ করা হয়েছে তখনই তার সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে বলা হয়েছে এবং পরবর্তীতে যখন এ নামটি পুনরায় ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েছে তখন শুধুমাত্র যাতে ঐ নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বুঝায় সে রকমভাবেই তা উলেখ করা হয়েছে। উপরোক্ত তালিকাসমূহের যে কোনোটির অন্তর্ভুক্ত কোনো ব্যক্তির সম্পূর্ণ পরিচয় প্রদান করার বেলায় ঐ ব্যক্তি যে তালিকার অন্তর্ভুক্ত সেই তালিকার নাম এবং ঐ তালিকার কত নম্বর ক্রমিকে তার অবস্থান সেই নম্বরটি উলেখ করা হয়েছে। একইভাবে, যখন প্রথমবারের মত কোনো স্থানের নাম উলেখ করা হয়েছে তখন ঐ স্থানের অবস্থান প্রভৃতি বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং পরে যখন আবার ঐ স্থানটির নাম উলেখ করার প্রয়োজন পড়েছে তখন অন্যান্য স্থান থেকে ঐ স্থানটিকে আলাদা করে বুঝানোর জন্য যেটুকু উলেখ করা দরকার তা-ই করা হয়েছে।
৬. ১৯৬৪ সালের ১৫ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর এই মামলার ১ নম্বর আসামী শেখ মুজিবুর রহমান করাচি সফর করছিলেন। এই সফরকালে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনির লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন বর্তমান লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, আসামী নম্বর-২ কর্তৃক আহূত একটি সভায় যোগদানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এই লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯৬৪ সালের শুরুতে তার নিজ বাসভবন বাংলো নং-ডি/৭৭, কে.ডি.এ স্কীম নং ১ করাচিতে অনুষ্ঠিত একটি সভায় এই অভিযোগ নামার ৩নং আসামী স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, ৪নং আসামী প্রাক্তন বিশিষ্ট নাবিক সুলতান উদ্দিন আহমদ, ৫নং আসামী বিশিষ্ট নাবিক নূর মোহাম্মদ এবং ১নং সাক্ষী লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল হোসেনর সঙ্গে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য একটি বিপ্লবী সংগঠন সংগঠিত করার বিষয়ে তার শেখ মুজিবুর রহমানে সঙ্গে আলোচনা করবেন। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাদের এই সভা অনুষ্ঠিত হয় এই মামলার ২নং সাক্ষী মি. কামাল উদ্দিন আহমদের বাসায়, যার ঠিকানা-৩/৪৮, এম.এস.পি.পি. স্কুল টিচারস কো-অপারেটিভ সোসাইটি মালামা আবাদ নামে বহুল পরিচিত, করাচি এই সভায় নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
১. শেখ মুজিবুর রহমান, আসামী নং-১
২. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
৩. স্টুয়ার্ড মুজিব, আসামি নং-৩
৪. সুলতান, আসামি নং-৪
৫. নূর মোহাম্মদ, আসামি নং-৫
৬. মি: আহমদ ফজলুর রহমান, সি. এস. পি, আসামি নং-৬ এবং
৭. মোজাম্মেল, সাক্ষী নংÑ ১
এই সভায় সংগঠিত করেছে মেয়াজ্জেম বলেছেন যে, নৌ-বাহিনিতে অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্টিত করার লক্ষ্য একটি জঙ্গী বাহিনি সংগঠিত করেছে এবং সেনাবাহিনি ও বিমান বাহিনির পূর্বপাকিস্তানি কর্মকর্তারাও এই বাহিনিতে যোগদান করবেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সিভিল সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা অত্যাবশ্যক। তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ঐ বাহিনিকে পরিচালনা করার জন্য তহবিল দরকার। ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান এর সঙ্গে শুধুমাত্র একতই পোষণ করেন নি, উপরন্তু তিনি বলেছেন যে, তার নিজের ধারণা এবং পরিকল্পনাও এরকমই। তিনি ঐ পরিকল্পনার প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন এবং প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করে দেবার আশ্বাস প্রদান। ৬নং আসামী এ. এফ. রহমান যখন ২নং আসমী মোয়াজ্জেমের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত হন যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে বঞ্চনা ও বৈষম্য বিদ্যমান তার বিরুদ্ধে একমাত্র জবাব হচ্ছে সামরিক বিদ্রোহ। তখন তিনি একথাও উলেখ করেন যে, এ ধরনের সামরিক বিদ্রোহ সংঘটিত হলে ভারতের কি প্রতিক্রিয়া হবে তা তিনি বলতে পারবে না। এই পর্যায়ে ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, এ বিষয়টি তিনি শেখ মুজিবুর রহমান দেখবেন। তিনি আরও বলেন যে, তার যেন পরিকল্পনাটি কিছুদিনের জন্য ধীর গতিতে পরিচালনা করেন। কারণ, যদি আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থী জয়লাভ করতে পারে তাহলে এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ না-ও হতে পারে।
৭. ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর পুনরায় করাচি সফর করেন এবং ১৯৬৫ সালের ১৫ থেকে ২১ জানুয়ারি সেখানে অবস্থান করেন। ঐ সময়কালের মধ্যে একদিন ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের পূর্বোক্ত বাসভবনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন:
১. শেখ মুজিবুর রহমান, আসামী নং-১
২. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
৩. নূর মোহাম্মদ, আসামী নং-৫
৪. এ.এফ. রাহমান, আসামী নং-৬
৫. ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭ এবং
৬. লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল হোসেন, সাক্ষী নং-১
এছাড়া আরও কয়েকজন উপস্থিতের পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। এই সভায় ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, একমাত্র একটি উপায়েই পূর্ব পাকিস্তানিরা আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, তা হলো-পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তাদের আলাদা হয়ে যাওয়া। তিনি ঐ পরিকল্পনার প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন এবং ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে তার কার্যক্রমের সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর করে বিপ্লবী গ্র“পগুলোর তৎপরতা স¤প্রসারিত করতে বলেন।
৮. এই মামলার ৩নং সাক্ষী, করাচির কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অফিসে কর্মরত মি. মোহাম্মদ আমীর হোসেন মিয়া ছিলেন মামলার ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ৪নং আসামী সুলতান এবং ৮ নং আসামী প্রাক্তন কর্পোরাল আবুল বাশার মোহাম্মদ আব্দুস সামাদের ঘনিষ্ঠ পরিচিতজন। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসের কোন একদিন ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনকে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এতে ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন খুবই অভিভূত হন এবং ঐ গ্র“পের কার্যকরী সদস্য হয়ে ওঠেন।
৯. ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের বাসভবনে বেশ কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যে সভাগুলোতে নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা সাধারণভাবে উপস্থিত থাকতেন।
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২]
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৩. সুলতান, আসামী নং-৪
৪. নূর মোহাম্মাদ, আসামী নং-৫
৫. হাবিলদার দলিল উদ্দীন, আসামী নংÑ ৯ এবং
৬. আমীর হোসেন, আসামী নং-৩।
এরা ছিলেন সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। এই সভাগুলোতে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সাফল্য লাভের জন্য অনুসৃত পদ্বতিসমূহ নিয়ে আলোচনা হতো।
১০. পূর্বে পাকিস্তানে কাজকর্মের উদ্যোগ নেবার জন্য সংগঠনের কয়েকজন সক্রিয় সদস্যের স্থায়ীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে থাকা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের অনুরোধে একে একে ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ও ৪নং আসামী সুলতান ছুটি নিয়ে ঢাকায় চলে যান। তাদের স্থায়ীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করে দেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম, ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ও ৪নং আসামী সুলতানের মাধ্যামে ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে একটি গ্র“পসভার আয়োজন করে। এই সভায় গ্র“প সদস্যদের করাচি থেকে ঢাকায় আসার জন্য যাতায়াত খরচ বাবদ ৪নং আসামী সুলতান ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনের ঠিকানায় একটি রেজিস্টার্ড খামে করে ১৫০০ টাকা এবং টেলিগ্রাফ মানিঅর্ডার যোগে ৫নং আসামী নূর মোহাম্মদের কাছে ৫০০ টাকা পাঠায় এবং তাদের উভয়কেই ঐ টাকা ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের নিকট পৌঁছানোর জন্য বলে। এই টাকা যথাসময়ে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমর নিকট হস্তান্তর করা হয়েছিল।
১১. পূর্বোক্ত সভা ১৯৬৫ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে নির্ধারিত ছিল। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এবং ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন ঐ সভায় যোগদানের জন্য পি.আই.এ. বিমানযোগে ঢাকার উদ্দেশ্য করাচি ত্যাগ করেন।
১২. পূর্বোক্ত সভা নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় নিমোক্ত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন:
১. শেখ মুজিবুর রহমান, আসামী নং-১
২. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-৩
৩. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৪. সুলতান, আসামী নং-৪
৫. রুহুল ক্দ্দুুস, সি.এস.পি, আসামী নং-১০ এবং
৬. আমীর হোসেন, সাক্ষী নং-৩।
২নং আসামী মোয়াজ্জেম কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন এবং বলেন যে, ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের দক্ষ পরিচালনা ও সহায়তায় তিনি সেনাবাহিনির অনেক কর্মকর্তাকে সংগঠনের তালিকাভুক্ত করেছেন যারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র্রে পরিণত করার জন্য কাজ করবেন। সভায় উপস্থিত সকলেই কার্যক্রমের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম অর্থ, অস্ত্র এবং গোলাবারুদের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের কাছ থেকে যাবতীয় সাহায্য সংগ্রহের আশ্বাস দেন। সাময়িকভাবে তিনি ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে ১লাখ রুপী দেবার কথা বলেন যা ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ও ৪নং আসামী সুলতানের কাছ থেকে কিস্তিতে ২০০০ থেকে ৪০০০ টাকা করে সংগ্রহ করে নিতে বলেন।
১৩. ১৯৬৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকাস্থ ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে তার কাছ থেকে ৭০০ টাকা পান এবং তা মামলার ৩নং স্বাক্ষী আমীর হোসেনের নিকট প্রেরণ করেন।
১৪. ১৯৬৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকাস্থ ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে তার কাছ থেকে ৪০০০ টাকা পান এবং তা মামলার ৩নং স্বাক্ষী আমীর হোসেনের নিকট প্রেরণ করেন। আমীর হোসেন আবার ঐ টাকা থেকে ৩০০ টাকা মামলার ৩ ও ৪ নং আসামী যথাক্রমে স্টুয়ার্ট মুজিব ও সুলতানের ব্যক্তিগত খরচের জন্য পাঠান এবং বাকি টাকা ২ নং আসামী মোয়াজ্জেমের নিকট পৌঁছানোর জন্য নিজের কাছে রাখেন।
১৫. ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় সে সমস্ত প্রতিরক্ষা কর্মকর্ত ছুটিতে কিংবা অস্থায়ী কর্তব্য পালনের উদ্দেশ্য পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন তার পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের নির্ধরিত কর্মস্থলে যেতে পারছিলেন না। এই অবস্থায় তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানেই কাজে যোগ দিতে বলা হয়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ও ৪নং আসামী সুলতান চট্টগ্রাম নৌঘাঁটিতে কাজে যোগদান করেন। উক্ত আসামীদ্বয় চট্টগ্রামে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাদের ষড়যন্ত্রমূলক সাংগঠনিক কাজকর্ম চালিয়ে যান।
১৬. ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ৬নং আসামী এ.এফ. রহমানের বাসা-ফ্লাট নং ২১, ইলাকো হাউস, ভিক্টোরিয়া রোড, করাচিতে ষড়যন্ত্রকারী গ্র“পের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন:
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং- ২
২. নূর মোহাম্মাদ, আসামী নং-৫
৩. এ.এফ. রাহমান, আসামী নং-৬
৪. সামাদ, আসামী নংÑ ৮ এবং
৫. আমীর হোসেন, সাক্ষী নং-৩
এই সভায় কাজকর্মের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয় এবং ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়। ৬ নং আসামী এ.এফ. রহমান যুক্তরাজ্য থেকে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর করার জন্য চেষ্টা করা হবে। সংগঠনের যাবতীয় কাজের জন্য ঐ সময় ৬নং আসামী এ.এফ.রহমানের অতিথি হিসাবে অবস্থানরত মামলার ৪নং স্বাক্ষী মি. কে.জি আহমদের অফিসটি ব্যবহারের বিষয়টি সভায় স্থির করা হয়।
১৭.ঐ একই মাসে (ডিসেম্বর, ১৯৬৫) অন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় মামলার ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের বাসা অফির্সাস কোয়ার্টার, কারসায, করাচি এই ঠিকানায়। এই সভায়ও উপস্থিত ছিলেন পূর্বোক্ত ১৬ নং অধ্যায়ে উলিখিত ব্যক্তিবর্গ। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ব্যাখ্যা করে বলেন যে, স্টুয়ার্ট মুজিব, ৩নং আসামী এবং সুলতান, ৪নং আসামী পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করে চলেছেন এবং খুব শীঘ্রই ৮নং আসামী সামাদ এবং ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেকে গ্র“পের কাজকর্মের পরিধি বৃদ্ধি করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হবে। ২ নং আসামী মোয়াজ্জেম আরও বলেন যে, গ্র“পের কাজের সাফল্যের জন্য ৩০০০ স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ করা দরকার এবং তাদের সবাইকে অস্ত্র সজ্জিত করে যদি প্রতিরক্ষা বিভাগে কর্মরত কয়েকজন অফিসার দ্বারা পরিচালনা করা যায় তাহলে অবিলম্বে তার পূর্ব পাকিস্তানে থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদেরকে বিতাড়িত করতে পারবেন। পূর্বোক্ত ১৬ নং অধ্যায়ে বর্ণিত বিষয়গুলোও এই সভায় আলোচনা করা হয়।
১৮. একই মাসে (ডিসেম্বর ১৯৬৫) ৭ নং আসামী মাহফিজউলাহর আহŸানে তার বাসা-৩২৯/২, কোরাঙ্গী ক্রীক, করাচিতে আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় নিম্নোক্তরা উপস্থিত ছিলেন:
১. সুলতান, আসামী নং-৪
২. মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭
৩. ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুহাম্মদ ফজলুল হক, আসামী নং-১১
৪. ওয়ারেন্ট অফিসার মুশারফ এইচ. শেখ, সাক্ষী নং-৫
৫. সার্জেন্ট শামসুদ্দিন আহমেদ, সাক্ষী নং-৬ এবং আরও কয়েকজন যাদেরকে চিহ্নিত করা যায় নি।
এই সভায় ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ এবং ৪নং আসামী সুলতান বারবার বলছিলেন, যে, পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে ঐ অঞ্চলকে আলাদা করে ফেলা এবং একটি সফল সামরিক বিদ্রোহ ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব নয়। সভায় ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে কাজকর্মের অগ্রগতির পর্যালোচনা করে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
১৯. ১৯৬৬ সালের ২ ফেব্র“য়ারি ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনের করাচি থেকে বিদায় উপলক্ষে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম তাকে তিনটি টেবিল ডায়েরি প্রদান করেন। ঐ ডায়েরিগুলোর কয়েকটি পৃষ্টায় তিনি আমীর হোসেনকে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে তার কিছু নির্দেশাবলি এবং সব সময় মনে রাখার মত কিছু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখে দিয়েছিলেন। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম তাকে বলেছিলেন যে, ঐ কথাগুলো তিনি তার নোট বুক থেকে ওখানে লিখে দিয়েছেন। এই নোট বুকটি যে ডায়েরিগুলো দেখে আসামীদের ছদ্মনামগুলো সংযোজনী-২ এ ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে। তিনি ১ নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের চাহিদা অনুযায়ী তাকে পৌঁছে দেবার জন্যতার কাছে (আমীর হোসেনের কাছে) একটি মানচিত্র এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের দু’টি তালিকাও প্রদান করেন।
২নং আসামী মোয়াজ্জেম ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনকে কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে বলেন এবং গ্র“প পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করার অধিকার প্রদান করেন। তিনি তাকে আরও বলেন যে, সংগৃহীত অর্থ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় খরচ চালিয়ে বাকি অর্থ যেন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে করাচিতে তার কাছে পাঠানো হয়।
২০. ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন ঢাকায় পৌঁছে চট্টগ্রামে যান গ্র“পের কাজকর্মের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। সেখানে ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব এবং ৪নং আসামী সুলতান বিদ্রোহ সংঘটনে তাদের নির্ধারিত কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্র“য়ারি তিনি (৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন) চট্টগ্রামস্থ মিসকা হোটেলে তার কক্ষে একটি সভা আহবান করেন যেখানে নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন:
১. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
২. সুলতান, আসামী নং-৪
৩. মি. ভূপতিভুষণ চৌধুরী মানিক চৌধুরী নামে খ্যাত, আসামী নং-১২
৪. মি. বিধান কৃষ্ণ সেন, আসামী নং ১৩
৫. সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, ই.পি.আর. আসামী নং-১৪
৬. ডঃ সাইদুর রহামন চৌধুরী, সাক্ষী নং-৭ এবং
৭. প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কমান্ডর মুহাম্মদ শহীদুল হক (পি.এন.ভি.আর) সাক্ষী নং-৮।
১২ নং আসামী মানিক চৌধুরী এবং ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান যেখানে ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনকে বলেন যে, ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান গ্র“পের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দেবার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। তার এই গ্র“পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ১২নং আসামী মানিক চৌধুরীর গ্র“পের কাজে সহায়তার জন্য ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনের কাছে ৩০০০ টাকা প্রদান করেন।
২১. ১৯৬৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গ্র“পের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ৮নং আসামী সামাদকে ঢাকায় পাঠান। তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ায় তার জীবনধারণের জন্য ঢাকায় আসা তার ছিল একান্তই প্রয়োজন। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম একই সঙ্গে ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনর কাছে এই মর্মে একটি চিঠি লিখে দেন যে, যতদিন তার ৮নং আসামী সামাদের কোন চাকরির ব্যবস্থা না হয় ততদিন যেন তিনি তাকে মাসে ৩০০ টাকা করে প্রদান করেন। ১৯৬৬ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি লেখা এই চিঠিতে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম আর উলেখ করেন, যে, তিনি সবকিছুই পরশের সঙ্গে পরশ ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছদ্মনাম। আলোচনা করেছেন এবং ভয় করার কোনো কিছুই নেই।
২২. একই মাসে ৮নং আসামী সামাদ চারজন নতুন সদস্য সংগ্রহ করেন। এরা হচ্ছেনঃ
১. মুজিবুর রহমান, কেরানি ই.পি.আর.পি.সি আসামী নং-১৫
২. প্রাক্তন ফ্লাইট সার্জেন্ট মুহাম্মদ আবুর রাজ্জাক, আসামী নং -২৬
৩. প্রাক্তন নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী খান, আসামী নং -৯ এবং
৪. প্রাক্তন ল্যান্স নায়েক এ.বি.এম.ইউসুফ, সাক্ষী-১০
এই নতুন সদস্যদেরকে গ্র“পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে সম্পর্কে দীক্ষিত করেন ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন।
২৩. ১৯৬৬ সালের ২৫শে ফেব্র“য়ারি ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম সফর করেন এবং লালদিঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাষণ দেন। এই জনসভার পরে তিনি ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানের বাসা-১২, রফিক উদ্দিন সিদ্দিকী, বাইলেন এনায়েত বাজার, চট্টগ্রাম ঠিকানায় গ্র“পের একটি সভা ডাকেন। এই সভায় উপস্থিতরা হচ্ছেন:
১. শেখ মুজিবুর রহমান, আসামী নং-১
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৩. মানিক চৌধুরী আসামী নং-১২ এবং
৪. সাইদুর রহমান, সাক্ষী নং-৭
এই সভায় ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানকে গ্র“পের সভার জন্য একটি জায়গার ব্যবস্থার করতে বলেন।
২৪. ঐ একই মাসে ফেব্র“য়ালি ১৯৬৬ ১নং আসামী শেখ মুজিুবর রহমান গ্র“পের জন্য আর্থিক সহায়তা লাভের আরেকটি উৎস বের করেন। ১১নং সাক্ষী মুহাম্মদ মোহসিন যিনি ছিলেন ১০নং আসামী রুহুল কুদ্দুসের খালাত ভাই, ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান গ্র“পের সাহায্যে অর্থ প্রদান করার জন্য তাকে বলেন। এইরূপ কথাবার্তার পরে ১১নং সাক্ষী মোহসিন যখন ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের বসার ঘর থেকে বের হয়ে আসছিলেন তখন ৪নং আসামী সুলতান তাকে বলেন যে, ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা মোতাবেক তিনি যেন মুরাদ স্টুয়ার্ট (মুজিবের ছদ্মনাম)। নিকট টাকা দেন ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ১১নং সাক্ষী মোহসিনের নিকট থেকে দুই কিস্তিতে ৭০০ টাকা গ্রহণ করেন।
২৫. ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের পরামর্শ অনুযায়ী ৬নং আসামী এ.এফ. রহমান তার স্ত্রীর মালিকানাধীন পেট্রোল পাম্পে ৮নং আসামী সামাদকে ম্যানেজার পদে চাকরি প্রদান করেন। এই পেট্রোল পাম্পটির অবস্থান ঢাকাস্থ ভারতীয় সহকারী রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের কাছে। এই পেট্রোল পাম্পের নাম গ্রীনভিউ পেট্রোল পাম্প। ষড়যন্ত্রকারী গ্র“পের ব্যবস্থা অনুযায়ী ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ৬নং আসামী এ.এফ. রহমানের মাধ্যমে গ্র“পের সদস্যদের লিয়াজো রাখা হতো। ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা পেট্রোল নেবার অজুহাতে ঐ পাম্পে সব সময় যাতায়াত করতেন।
২৬. ১৯৬৬ সালের ৪ মার্চ ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনর কাছে একটি চিঠি লিখে জানান যে, সে যেন ৪নং সাক্ষী কে.জি-এর কাছে ঢাকাস্থ অভ্যন্তরীণ জল পরিবন সংস্থার কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার কথা বলেন। তিনি চিঠিতে ৩নং সাক্ষী আমীল হোসেনকে আরও নির্দেশ দেন যে, সে যেন চতুর্দিকে আঙ্গিনাসহ একটি বাড়ি ভাড়া করে রাখে যেখানে ভারত থেকে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্র রাখা হবে।
২৭. একই মাসে মার্চের প্রথম দিকে, ১৯৬৬, ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন ঢাকার মহাখালীতে একটি সভা আহŸান করেন, যেখানে নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন:
১. সামাদ, আসামী-৮
২. মুজিব, কেরানি, আসামী -১৫
৩. এম.এ রাজ্জাক, আসামী নং-১৬
৪. সার্জেন্ট জহুরুল হক, আসামী নং-১৭
৫. আশরাফ আলী, সাক্ষী নং-৯ বেং
৬. ইউসুফ, সাক্ষী নং-১০
ঐ সভায় উপস্থিত আরও কতিপয় ব্যক্তির নাম নিম্নলিখিতভাবে উলেখ করা হয়েছে:
১.এল.এ.সি.এম.এ নওয়াজ
২. এল.এ.সি.জেড.এ চৌধুরী এবং
৩. সার্জেন্ট মিয়া, পি.এ.এফ
(তদন্ত চলাকাীন সময়ে এই সকল ব্যক্তির পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি)
সভায় এ বিষয়ে খুবই জোর দেয়া হয়েছে যে, তাদের উদ্দেশ্যে সিদ্ধির একমাত্র পথ হচ্ছে সামরিক বিদ্রোহ। এ বিষয়টিও ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, ভারত সরকার তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করবে।
২৮. ১৯৬৬ সালের ১২ মার্চ ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান ষড়যন্ত্রকারীদের একটি সভা আহবান করেন। দিনটি ছিল শনিবার। ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের জন্য এই দিনটিই সবচেয়ে সুবিধাজনক। কারণ চাকরিস্থল থেকে ছুটি না নিয়েই তিনি সপ্তাহান্তে ঢাকায় গিয়ে সভায় যোগদান করতে পারেন। প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ মি. তাজউদ্দিনের বাসা নং ৬১৭, রোড নং-১৮, ধানমন্ডি, ঢাকাতে সভা শুরু হয়। মি. তাজউদ্দিন ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী। তিনি এই সভার উদ্দেশ্যে সম্বন্ধে ভালভাবেই জানতেন। কিন্তু তিনি নিজে এই সভায় উপস্থিত থাকেন নি। এই সভায় অংশগ্রহণকারীদের ১নং আসামীর শেখ মুজিবুর রহমান একটি বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পূর্বোক্ত বাড়িতে যান। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. শেখ মুজিবুর রহমান, আসামী নং-১
২. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
৩. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৪. রুহুল কুদ্দুস, আসামী নং-১০ এবং
৫. আমীর হোসেন, সাক্ষী নং-৩
এই সভায় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম আশা প্রকাশ করে বলেন যে, ডি দিবসে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনগণ তাদের সঙ্গে থাকবে। সভায় অংশগ্রহণকারী সকলেই এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন যে, ষড়যন্ত্রকারী গ্র“পের প্রতিটি সদস্য যেদিন অস্ত্রসজ্জিত হবে এবং প্রশিক্ষণ পাবে সেদিনেই চূড়ান্ত সময় উপস্থিত হবে। এইসভায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র প্রদান সংক্রান্ত আলোচনা করার জন্য তাদের একটি প্রতিনিধিদল ভারতে পাঠানোর আয়োজন করা হয়।
২৯. এর অল্প কয়েক দিন পরে ৯নং সাক্ষী আশরাফ আলী পূর্ব পাকিস্তানের একটি সেনানিবাসের একটি স্কেচ ৩নং আসামী আমীর হোসেনের কাছে প্রদান করেন।
৩০. ১৯৬৬ সালের ১৯ মার্চ ২নং আসামী মোয়াজ্জেম চিঠির মারফত ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনকে জানান যে, সে যেন ৬নং আসামী এ.এফ. রহমানকে টেলিফোনে জানিয়ে দেয় যে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ঢাকায় স্থানান্তরের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনকে আরও জানান যে, ৫নং আসামী নুর মোহাম্মদ কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা যাচ্ছে এবং সে তাকে আমীর হোসেনকে পশ্চিমাঞ্চলের কাজকর্ম সম্পর্কে খবরাখবর জানাবে। একই চিঠিতে তিনি ছদ্ম ভাষায় লিখেছেন যে, তিনি তার চাকর শফির আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি। মাধ্যমে তার আমীর হোসেনের কাছে একটি ছোট্ট অস্ত্র পাঠাবে এবং ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন যেন অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য আরও বেশি পরিমাণে অর্থের সংস্থানে মনোনিবেশ করে।
৩১. এর প্রায় এক সপ্তাহ পর ২নং আসামী মোয়াজ্জেম, ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনের নিকট আরেকটি চিঠি লিখে ৬নং আসামী এ.এফ. রহমানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংকড্রাফট করে তার নিকট পাঠাতে বলেন। যথানির্দেশ, ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন ৬নং আসামী এ.এফ. রহমানের কাছে থেকে নগদ ৫৫০০ টাকা গ্রহণ করেন। এ থেকে ৫০০০ টাকা ১৯৬৬ সালের ৩১ মার্চ ব্যাংক ড্রাফট করে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের নিকট পাঠান এবং বাকি ৫০০ টাকা আমীর হোসেন তার নিজের কাছে খরচের জন্য রাখেন।
৩২. ১৯৬৬ সালের ৩ এপ্রিল ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব এবং ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকাস্থ ধানমন্ডির বাড়িতে যান এবং ছোট ছোট অস্ত্র ক্রয়ের জন্য আরও টাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ২নং আসামী মোয়াজ্জেম কর্তৃক মনোনীত হয়েছিল ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট থেকে গ্র“পের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে। ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান তখন ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবের নিকট নগত ৪০০০ টাকা প্রদান করেন এবং ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব আবার ঐ টাকা ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনের কাছে প্রদান করেন।
৩৩. এর পরের দিন ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন ২ নং আসামী মোয়াজ্জেমের কাছ থেকে একটি চিঠি পান যাতে ছদ্ম ভাষায় আরও বেশি পরিমাণ টাকা জরুরি প্রয়োজনের কথা লেখা ছিল। ফলে ৩ নং সাক্ষী আমীর হোসেন ৩ নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবকে ১০ নং আসামী রুহুল কুদ্দুসের নিকট পাঠান আরও টাকার জন্য। ৩ নং আামী স্টুয়ার্ট মুজিব ১০ নং আসামী রুহুল কুদ্দুসের কাছ থেকে ২০০০ টাকা সংগ্রহ করেন এবং তা ৩ নং সাক্ষী আমীর হোসেনের নিকট প্রদান করেন। অতঃপর ৩ নং সাক্ষী আমীর হোসেন ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবকে ৬০০০ টাক দিয়ে চট্টগ্রাম পাঠান এবং চট্টগ্রাম থেকে ঐ টাকা ব্যবসায়দিরে জাহাজের মাধ্যমে ২ নং আসামী মোজ্জেমের নিকট পাঠানোর ব্যবস্তা করতে বলেন।
৩৪. প্রায় একই দিনে ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন গ্র“পের জন্য ১০৭ দীননাথ সেন রোড, ঢাকা এই ঠিকানায় একটি বাড়িভাড়া করেন। এই বাড়িতে যে টেলিফোনের ব্যবস্থা করা হয় তার নম্বর ৮২৪৫২।
৩৫. ১৯৬৬ সালের ৬ এপ্রিল ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনরে কাছে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠির সঙ্গে কয়েক দিন আগে তার কাছে ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে পাঠানো টাকার একনলেজমেন্ট রিসিপটিও ছিল এই চিটিতে তিনি ছদ্ম ভাষায় তাদের ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে সিদ্ধির জন্য যে পরিমাণ অর্থ ও অন্যান্য জিনিসপত্র প্রয়োজন তার কথা লেখেন এবং ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনকে একটি বাজেট তৈরি করতে বলেন। কিন্তু ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্ক বিস্তারিত অবগত না থাকার কারণে তিনি স্থির করলেন যে, যতদিন পর্যন্ত ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান বাজেট না চান ততদিন তিনি কোনো বাজেট করবেন না।
৩৬. এরপরই ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল ৩ নং সাক্ষী আমীর হোসেন ২ নং আসামী মোয়াজ্জেমের নিকট থেকে আরেকটি চিঠি পান যাতে তুষারকে (৬ নং আসামী এ.এফ. রহমানের ছদ্মনাম) জানাতে বলেন যে, তিনি ১৯৬৬ সালের ২২ এপ্রিল স্থানান্তরিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসছেন।
৩৭. ঐ একই মাসে এপ্রিল, ১৯৬৬, ১নং আসামী শেখ মুুজিবুর রহামন তার ধানমন্ডির বাড়িতে ১২নং আসামী মানিক চৌধুরীকে ডেকে পাঠান। মানিক চৌধুরী সেখানে গিয়ে দেখেন যে, ৪ নং আসামী সুলতান যেখানে আগেই উপস্থিত হয়েছে। ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান ১২নং আসামী মানিক চৌধুরীকে ৪নং আসামী সুলতানের নিকট টাকা দিতে বলেন এর তিন/চারদিন পরে ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী ৪১ রামজয় মহাজন লেন, চট্টগ্রাম ঠিকানায় তার বাসায় ৪নং আসামী সুলতানকে ডেকে পাঠান এবং ষঢ়যন্ত্রকে সফল করবার জন্য তার কাছে ১, ৫০০ টাকা প্রদান করেন।
৩৮. একই মাসে (এপ্রিল, ১৯৬৬) ১১নং সাক্ষী মোহসিনকে ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান তার ঢাকাস্থ ধানমন্ডি বাসভবনে ডেকে পাঠান এবং অত্যন্ত সর্তকতা ও গোপনীয়তার সঙ্গে বলেন যে, তিনি বর্তমান ও প্রাক্তন সৈনিকদের সহ একটি বিপ্লবী গ্র“প গঠন করছেন, তিনি যেন তার এ গ্র“প পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।
৩৯. ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষ কিংবা মে মাসের শুরুর দিকে কোনো এক সময় চট্টগ্রাম স্থানন্তরিত হবার পর ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনের সঙ্গে ঢাকাস্থ গেন্ডারিয়ার ১০৭, দীননাথ সেন রোডে তার বাসায় দেখা করণে। দু’জনের মধ্যে সেখানে গ্র“পের পক্ষ থেকে টাকা পয়সা সংগ্রহ এবং গ্র“পের কাজকর্মের খরচ সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে গ্র“পের নামে যে বিরাট অঙ্কের অর্থ খরচের হিসাব দেখা যায় তাকে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম সঠিক বলে মেনে নিতে পারেন না। ফলে ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন এবং ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ঐ দিন সন্ধায়ই ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন ডঃ খালেকের বাড়িতে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের নিকট নগত ৮০০০ টাকা, দুটি ক্যাশ বই এবং হিসাবের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য কাগজপত্র হস্তান্তর করেন। ডঃ খালেকের এই বাড়ির ঠিকানা: রোড নং ২, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ঢাকা এবং এই বাড়িতেই তখন ২নং আসামী মোয়াজ্জেম অবস্থান করছিলে। ঐ বাড়িটির নাম আলেয়া ২নং আসামী মোয়াজ্জেম তখন ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনকে তার দীননাথ সেনের বাসা ভাড়া মিটাবার জন্য ১৫০০ টাকা প্রদান করেন। এরপর ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেন এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
৪০. ১৯৬৬ সালের ১০ মে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম চট্টগ্রামের নৌঘাঁটিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। যেখানে নিয়োগ পাবার পরই তিনি গ্র“পের একটি সভা আহŸান করেন। এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানের আউটার হাউস-এ সাইদুর রহমান এই বাড়িটি গ্র“পের সভাস্থল হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। এই আউটার হাউস চট্টগ্রামের এনায়েত হোসেন মার্কেট এলাকায় অবস্থিত। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-০২
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৩. সুলতান, আসামী নং-৪
৪. মানিক চৌধুরী, আসামী নং -১২
৫. মুহাম্মদ খুরশীদ, আসামী নং-১৮ এবং
৬. সাইদুর রহমান, সাক্ষী নং-৭
১২ নং আসামী মানিক চৌধুরী এবং ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান এই সভার কার্যবিবরণীর বহির্ভূত ছিলেন।
৪১. ১৯৯৬ সালের ৬ মে, ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পকির্ত নয় এমন কিছু সুনির্দিষ্ট কার্যকলাপের দায়ে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পরই তাকে ডিটেনশন দেয়া হয় এবং এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার কারণে তাকে জেল পাঠানো হয়। পাকিস্তানে নিরাপত্তা আইনে ডিটেনশন খাটার সময়ও অন্যান্য কতিপয় মামলায় তার বিচার হয়।
৪২. ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বোক্ত গ্রেফতার বরণের পরে তিনি যে রাজনৈতিক দলের সদস্য সেই দল তার বাসভবনে ১৯৬৬ সালের ২০ মে একটি জরুরি সভার আয়োজন করে। ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী এই সভায় যোগদান করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যান। সভায় যোগদান করার পুর্বে ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানকে নিয়ে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারী মি. পি.এন. ওঝার অফিসে যান। মি: পি.এন. ওঝা সাইদুর রহমানের পরিচয় ইত্যাদি লিখে রাখেন এবং পরে আবার মাঝে মাঝে ওখানে যাবার জন্যবলেন। ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান সেখানে থেকে বের হয়ে আসার পরও ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী অনেকক্ষণ যেখানে আবস্থান করেন।
৪৩. ১৯৬৬ সালেল ২০ ও ২১ মে’র মধ্যবর্তী রাতে ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কতিপয় কার্যকলাপের দায়ে পকিস্তান নিরাপত্তা আইনে চট্টগ্রামে গ্রেফতার হন।
৪৪. ঐ একই মাসে মে, ১৯৬৬, ১২ নং আসামী মানিক চৌধুরীর গ্রেফতারের পর ২নং আসামী মোয়াজ্জেম পূর্বোক্ত আউটার হাউস এর ষড়যন্ত্রকারী গ্র“পের আরও দুটি সভা আহবান করেন। এই সভা দুটোতে উপস্থিত ছিলেন।
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৩. সুলতান, আসামী নং-৪
৪. খুরশীদ, আসামী নং-১৮ এবং
৫. সাইদুর রহমান, সাক্ষী নং-৭
এই সভাসমূহে গ্র“পের বিভিন্ন সদস্যের কাজ ভাগ করে দেওয়া হয় এবং কোন পদ্ধতিতে কাজ করলে সাফল্য নিশ্চিত সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। ঢাকা, কুমিলা, যশোর ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস এবং চট্টগ্রাম নৌঘাঁটির ম্যাপ মূল্যায়ন করা হয় এবং আরও বেশি অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়া হয়।
৪৫. ঐ একই মাসে (মে, ১৯৬৬) চট্টগ্রামে, পি.আই.এ-র জেলা ম্যানেজার ১২নং সাক্ষী মি. এম.এম. রজিম ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের সংস্পর্শে আসেন এবং ষড়যন্ত্রে যোগ দেন।
৪৬. ১২নং সাক্ষী রমিজের পরই ষড়যন্ত্রকারীদের দলে যোগ দেন ১৯নং আসামী মি. কে. এম. শামসুর রহমান সি.এস. পি। তিনি তখন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
৪৭. ঐ একই মাসে (মে, ১৯৬৬) নং সাক্ষী আশরাফ আলী এবং ৮নং আসামী সামাদ ১০০/৩, আজিমপুর রোড, ঢাকা ঠিকানায় গ্র“পের খরচে ‘সিটি’ নামে একটি বাড়ি ভাড়া করেন। এরপর ঐ দুই ব্যক্তিতাদের পূর্ববর্তী আবাসস্থল ৩নং সাক্ষী আমীর হোসেনের বাড়ি থেকে এই নতুন ভাড়া নেয়া বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়।
৪৮. ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির তার বাসায় ১২নং সাক্ষী রহিজকে একটি ডায়রি, একটি নোট বুক এবং একটি ফোল্ডার দিয়ে সেগুলো পড়তে বলেন। এই সমস্ত প্রমাণপত্রে প্রস্তাবিত স্বাধীন রাষ্ট্র্রের সরকারের রূপ ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বলা ছিল। এতে বলা হয় সে, সকল সম্পত্তি রাষ্ট্র্রের হাতে নিয়ে নেয়া হবে। শিল্প-কলকারখানা জাতীয়করণ করা হবে এবং মুদ্রার পরিবর্তে কুপন পদ্ধতি চালু করা হবে। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম তাকে নতুন রাষ্ট্র্রের সবুজ ও গোলাপী রংয়ের পতাকাও দেখিয়েছেন।
৪৯. এরপর ঐ মাসেই (জুন, ১৯৬৬) ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ১২নং সাক্ষী রমিজের বাসায় পি.আই.এ হাউস -৬০, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম ঠিকানায় একটি সভা আহবান করেন।
এই সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩]
৩. খুরশীদ, আামী নং-১৮
৪. রিসালদার শামসুল হক, এ.সি. আসামী নং-২০
৫. হাবিলদার আজিজল হক, এসএসজি, আসামী নং-২১এবং
৬. রজিম, সাক্ষী নং-১২
এই সভার উদ্দেশ্যে ছিল গ্র“পের প্রথম সারির কর্মীদের সঙ্গে রমিজকে পরিচয় করিয়ে দেয়া। উপরে যাদের নাম উলেখ করা হয়েছে তার ছাড়াও ঐ সভায় আরও অনেক কর্মী উপস্থিত ছিল। কিন্তু তাদের পরিচয় উদ্ধার করা যায় নি।
৫০. ঐ মাসেরই শেষ দিকে (জুন, ১৯৬৬) ২নং আসামী মোয়াজ্জেম তার বাসা নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, চট্টগ্রামে একটি সভা আহŸান করেন। নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৩. সুলতান, আামী নং-৪
৪. সুবেদার রাজ্জাক, আসামী নং-১৪
৫. জুহুরুল হক, আসামী নং-১৭
৬. খুরশীদ আসামী নং-১৮
৭. রিসালদার শামসুল হক আসামী নং-২০
৮. আশরাফ আলী, সাক্ষী নং ৯ এবং
৯. ইউসুফ, সাক্ষী নং ১০
এই সভায় আরও একজন উপস্থিত ছিল যার নাম দেয়া হয়েছিল সার্জেন্ট শফি। কিন্তু তার পরিচয় উদ্ঘাটন করা যায় নি।
এই সভায় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম সবাইকে তার ডায়েরি এবং নোট বুক দেখান যাতে ‘বাংলাদেশের’ নামে প্রস্তাবতি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র্রের প্রধান দিকগুলো লিপিবদ্ধ ছিল প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকাও সেখানে দেখানো হয়।
৫১. ১৯৬৬ সালের জুন/জুলাই মাসে ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ বিমান বাহিনির কর্মকর্তাদের মধ্যকার ষড়যন্ত্রকারীদের এই সভা আহŸান করেন। তার বাসা-কোয়ার্টার নং ২৫/৩, আবিসিনিয়া লাইন, করাচি ঠিকানায় আহূত এই সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. নূর মোহাম্মদ, আসামী নং-৫
২. মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭
৩. এস এ সি মাহফুজুল বারী আসামী নং-২২
৪. মোশারফ, সাক্ষী নং-৫
৫. কর্পোরাল জামাল উদ্দিন আহমেদ, সাক্ষী নং-১৪
৬. কর্পোরাল সিরাজুল ইসলাম, সাক্ষী নং-১৫
এই সভায়ও অন্যান্য কয়েকজন উপস্থিত ছিল যাদের পরিচয় উদ্ধার করা যায় নি। এ সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ৫নং আসামী নূর মোহাম্মদদের উপস্থিতি। কারণ তিনি এসেছিলেন নৌবাহিনি থেকে। ৭নং আসামী মাহফিজউলাহর অনুরোধে ঢাকা থেকে সদ্য প্রত্যাগত ১৪নং সাক্ষ কর্পোরাল জামাল এই সভায় উপস্থিত সদস্যদের সামনে পূর্ব পাকিস্তানে ষড়যন্ত্রকারীদের কাজকর্মের অগ্রগতি সম্পর্কে বলেন এবং উলেখ করেন যে, ১নং আসামী শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য কয়েকজন উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তা তাদের ভূমিকা আরও সক্রিয় করে তুলেছেন। ১৫নং সাক্ষী সিরাজ তখন ছুটিতে যাচ্ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ তাকে বলেন যে, তিনি যেন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানত ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য প্রথমে ঢাকাস্থ পি.এ.এফ স্টেশন ১১নং আসামী ফজলুল হক এবং ২৩নং আসামী সার্জেন্ট সামসুল হক পি.এ.এফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
৫২. ১৯৬৬ সালের জুন/জুলাই মাসের কোনো এক সময় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এবং ১২ নং সাক্ষী রহিম কুমিলা সফর করা আয়োজন করেন। তাই ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবকে প্রায়ই কুমিলা পাঠানো হয় এই খবরটি মেজর তৎকালীন ক্যাপটেন ২৪ নং আসামী শামসুল আলম এ.এম.সি-কে পৌঁছাবার জন্য। ২ আসামী মোয়াজ্জেম এবং ১২নং সাক্ষী রমিজ মোয়াজ্জেমের গাড়িতে, হিলম্যান আই এম পি নং ৯৫৯১ করে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। তার ২৪ আসামী শামসুল আলমের কুমিলা শহরস্থ বাসভবনে যান এবং সেখানে বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপটেন মোহাম্মদ আবুদল মোতালিবের সাক্ষাৎ পান। ২৪ আসামী শামসুল আলম কুমিলার সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালনের কথা বলেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝাচ্ছিলেন যে, পরিকল্পনা কার্যকরী করার সময় সামরিক ইউনিটসমূহের অস্ত্র ভান্ডারগুলো দখল করে ফেরে তাদের যুদ্ধ করার সামর্থ্যকে অচল করে দিতে হবে। কিন্তুও ক্ষেত্রে তিনি দক্ষ জনশক্তির অভাব অনুভব করেন। তিনি শামসুল আলমকে চাকরিরত ও প্রাক্তন সৈনিকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে বলেন। ২৫নং আসামী মোতালিব বলেন যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এর একজন সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন। পরে তাদের পাঁচজনকে একটি গাড়িতে করে কুমিলা সেনানিবাসে ২৬নং আসামী মোহাম্মদ শওকত আলী মিয়া এ.ও. সি-এর বাসায় নিয়ে আসা হয় এবং যেখানে তাদরে সঙ্গে ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবও যোগ দেন। ২৬নং আসামী শওকত ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে জানান যে, তিনি ঢাকাতে ১৩নং সাক্ষী ক্যাপটেন মোহাম্মদ আবদুল আলীম ভুঁইয়া এ.ও.সি এবং ২৭নং আসামী ক্যাপটেন খন্দকার নাজমুল হুদা এ.ও. সি-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং ঐ দু’জন অফিসারই সংগঠন সম্পর্কে আরও বেশি করে জানতে চেয়েছেন। এমতাবস্থায় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম কথা দেন যে, অবিলম্বে ঢাকাতে একটি সভা আহŸান করা হবে।
৫৩. একই মাসে জুলাই ১৯৬৬ ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানের সঙ্গে চট্টগ্রামের এক বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের হঠাৎ করে দেখা হয়ে যায়। সেখানে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানের কাছে প্রকাশ করেন যে, ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী গ্রেফতারের আগেই অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের জন্য ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনারের ফার্স্ট সেক্রেটারীর কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের একটি তালিকা পৌঁছে দেবার কথা। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এরপর ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানকে জিগ্যেস করেন যে, তিনি মি. পি.এন. ওঝাকে চিনেন কিনা। ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান এ প্রশ্নের হ্যাঁ-সূচক জাবাব দেন। ফলে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমতাকে অনুরোধ করেন, মি. পি, এন. ওজার কাছে অস্ত্রশস্ত্রের একটি তালিকা পৌঁছ দেবার জন্য। ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে তার উপর কড়া নজর রাখা ইচ্ছে বলে ঐ কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
৫৪. অল্প কয়েকদিন পরে একদিন সকালবেলা মি. পি.এন. ওঝ ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানের চট্টগ্রামের বাসভবনে এসে হাজির হন এবং অনুযোগের ভাষায় তাকে বলেন যে, তার অনুরোধ সত্তে¡ও সে ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান তার ঢাকাস্থ অফিসে দেখা করেন নি। তখন সেইখানে বসেই ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান মি. পি. এস. ওঝাকে অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা সংক্রান্ত ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের দেওয়া সংবাদটি জ্ঞাপন করান।
৫৫. পরের দিন মি. পি.এন. ওঝার কাছে নির্দেশমত ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের নিকট থেকে পূর্বোক্ত অস্ত্রশস্ত্রের তালিকাটি সংগ্রহ করেন এবং তা চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে মি. পি.এন. ওঝার কাছে হস্তান্তর করেন। সেই সময় মি. পি.এন.ওঝা ঢাকাতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানকে একটি কোড শব্দ প্রদান করেন এবং ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করতে বলার জন্য ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানকে বলেন।
৫৬. এর কয়েকদিন পরে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানের মাধ্যমে ঢাকার ধানমন্ডিস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনারের বাসভবনে মি. পি.এন.ওঝার সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার আয়োজন করেন। যেখানে পি.এন. ওঝা ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে আশ্বাস দেন যে, তিনি তার ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের প্রদত্ত অস্ত্রের তালিকা ভারত সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠাবেন। এবং তিনি সাময়িকভাবে ষড়যন্ত্রকারীদেরকে অর্থ সরবরাহ করতে অপরাগ বলে জানান।
৫৭. ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসের কোনো এক সময় ২৬নং আসামী শওকত ঢাকা সফর করেন এবং ১৩নং সাক্ষী আলীমের সঙ্গে অর্ডিন্যান্স মেসে অবস্থান করেন। ঐ সন্ধ্যায়ই ২নং আসামী মোয়াজ্জেম পূর্বোক্ত মেসে ১৩নং সাক্ষী আলীম এবং ২৬নং আসামী শওকতের সঙ্গে দেখা করণে। ঐখানে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ঘোষণা করেন যে, আগামীকাল সকালে ১২নং সাক্ষী রহিমজের মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের বাসায় তিনি একটি সভা আহŸান করেছেন। এই সভায় নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন:
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৩. সুলতান, আসামী নং-৪
৪. নাজমুল হুদা, আসামী নং-২৭
৫. শওকত, আসামী নং-২৬ এবং
৬.আলীম সাক্ষী নং-১৩
এই সভায় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ষড়যন্ত্রকারীদেরকে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা সম্বলিত একটি ডায়েরি এবং একটি নোটবুক দেখান। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এতে দাবি করেন যে, তিনি ষড়যন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ইতোমধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সভায় তিনি এই আশা ব্যক্ত করেন যে, উপস্থিত সদস্যরা যশোর এবং রংপুর অঞ্চলে কাজ পরিচানার জন্য গ্র“পে আরও কিছু সামরিক অফিসার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করবেন। তিনি দাবি-করেন যে, চট্টগ্রামের কাজ সমাধা করার জন্য ২৮নং আসামী ক্যাপটেন এ.এন.এম নুরুজ্জামান এবং তার নিজস্ব নৌবাহিনি যথেষ্ট ২৫নং আসামী মোতালেব এবং ২৪নং আসামী শামসুল আলম কুমিলায় যেভাবে কাজ করেছেন ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এই সভায় তার প্রশংসা করেন।
৫৮. ঐ একই মাসে আগস্ট ১৯৬৬ ২৭নং আসামী নাজমুল হুদা, ২৪নং আসামী শামসুল আলম ১৩নং সাক্ষী আলীম এবং ২৯নং আসামী শওকত দাউদকান্দি রেস্ট হাউসে মিলিত হন। তার উপলদ্ধি করেন যে, ষড়যন্ত্রকারীদের নেতৃত্ব কয়েকজন প্রবীণ সিনিয়র সামরিক অফিসারের ওপর অর্পিত হওয়া উচিত। তার স্থির করলেন যে, তার ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের কাছ থেকে গ্র“পের সংগঠনের সংখ্যা ও পরিচয় জেনে নিবেন।
৫৯. ঐ একই মাসে আগস্ট ১৯৬৬, ২নং আসামী মোয়াজ্জেম গ্র“পের তহবিল থেকে গ্র“পের কাজের সুবিধার্থে একটি গাড়ি কিনতে সাহায্য করার জন্য ১২নং সাক্ষী রমিজকে ৫,০০০ টাকা প্রদান করেন।
৬০. ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো এক সময় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ১২ নং সাক্ষী রমিজের মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের ১২-৮/৮ নং ফ্ল্যাটে একটি সভা আহবান করেন। নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ এ সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৩. সুলতান, আসামী নং-৪
৪. শামসুর রহমান, আসামী নং-১৯
৫. শামসুল আলম, আসামী নং-২৪
৬. মোতালেব, আসামী নং-২৫
৭. নাজমুল হুদা, আসামী নং-২৭
৮. রমিজ, সাক্ষী নং-১২ এবং
৯. আলী, সাক্ষী নং-১৩
এই সভায় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে প্রকাশ করেন যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। তিনি ২৫নং আসামী মোতালেবকে বিস্তৃতভাবে বুঝিয়ে বলেন যে, প্রাক্তন সৈনিকদেরকে বিভিন্ন গ্র“পে সংগঠিত করতে হবে এবং তাদেরকে নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। ২নং আসামী মোয়াজ্জেম বিভিন্ন সেক্টরের সেষ্টর কামান্ডারদের আর্থিক প্রয়োজনে বিষয়টি নোট করে নেন। ২৭নং আসামী নাজমুল হুদা, ২৪নং আসামী শামসুল আলম এবং ১৩নং সাক্ষী আলীম সভার কার্যবিবরণীতে হস্তক্ষেপ করে প্রস্তাব করেন যে, নেতৃত্ব কয়েজন প্রবীণ সিনিয়র সামরিক অফিসারের ওপর ন্যস্ত হওয়ায় প্রয়োজন। ১৯নং আসামী শামসুর রহমান ও বিষয়ক আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম.এ.জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেন ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ঘোষণা করেন যে, স্বাধীনতা লাভের পরই দেশে সামরিক আইন জারি করা হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার পর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১২নং সাক্ষী রমিজ মত প্রকাশ করে বলেন যে, সামরিক অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা হবে পি. আই.এ এবং পি.এ.এফ-এর বিমান এবং রেডিও’র মাধ্যমে। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে একজন এই মত ব্যক্ত করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে যে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানি রয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের সময় যে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানি বন্দী হবে তাদেরকে বিনিময় করা হবে।
৬১. ঐ একই মাসে (সেপ্টেম্বর ১৯৬৬) ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান দ্বিতীয়বারের মত ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এবং ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মি. পি.এন. ওঝার মধ্যে পূর্বোক্ত বাড়িতে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। মি. পি.এন. ওঝা ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে বলেন যে, ভারত সরকার ষড়যন্ত্রকারীকে অস্ত্র সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে এবং তিনি ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের তারিখ যথাসময়ে জানানো হবে বলে আশ্বাস দেন।
৬২. ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে ১৯নং আসামী শামসুর রহমানের পরামর্শে গ্র“পের প্রতি প্রবীণ সামরিক অফিসারদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য ২নং আসামী মোয়াজ্জেম চট্টগ্রামে তার বাসা ‘এ্যাংকরেজ’ এ এক সভা আহŸান করেন। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম.এ. জি ওসমানী এই সভায় আমন্ত্রিত ছিলেন। নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
২. শামসুর রহমান, আসামী -১৯
৩.রমিজ, সাক্ষী নং-১২
সভায় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ষড়যন্ত্রের প্রধান প্রধান দিক উলেখ করেন। এখানে তিনি একথাও প্রকাশ করেন যে, ভারতের সঙ্গে তিনি একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন (ধ মবহঃষবসবহ’ং ধমৎববসবহঃ) যার শর্ত অনুযায়ী তার স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সীমা অতিক্রম করবে না এবং পশ্চিম পাকিস্তানের যে-কোনো বাধা বা হস্তক্ষেপকে তার সমুদ্র ও আকাশপথে বাধা প্রদান করে পূর্বপাকিস্তানের সামরিক বিদ্রোহকে সমর্থন করবে। কর্নেল (অবঃ) এম.এ.জি. ওসমানী কথাবার্তাগুলো কেবল শুনেছিলেন।
৬৩. ১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এবং মি. পি. এন. ওঝার মধ্যে ঢাকাস্থ ধানমন্ডির পূর্বোক্ত বাড়িতে তৃতীয়বারের মত একটি সভার আয়োজন করেন। এই সভায় মি: পি.এন. ওঝা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, ভারতের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের কারণে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার তারিখ নির্ধারণ করা যায়নি। মি. ওঝা ষড়যন্ত্রকারীদেরকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ভারতের সাধারণ নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার উপদেশ দেন।
৬৪. ঐ একই মাসে (অক্টোবার, ১৯৬৬) ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ১১নং সাক্ষী মোহসিনের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য বলেন। ১১নং সাক্ষী মোহসিন তাকে ২, ০০০টাকা দেন। ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব বরেন যে, অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য তিন/চার লাখ টাকা প্রয়োজন এতে ১১নং সাক্ষী ভয় পেয়ে ক্ষেপে যান এবং ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবকে তক্ষুনি তার বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।
৬৫. ১৯৬৭ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি কিংবা তার দু’একদিন আগে পরে ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী ডিটেনশন আদেশ থেকে মুক্তি পান।
৬৬. ১৯৬৭ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ ঢাকা আসেন এবং গ্র“পভুক্ত বিমান বাহিনির কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ঢাকাস্থ আওলাদ হোসেন মার্কেটে ১৬নং আসামী এম.এ.রাজ্জাকের দোকানে।
নিম্নোক্তরা এই সভায় উপস্থিত ছিলেনঃ
১. মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭
২. এম.এ. রাজ্জাক, আসামী নং-১৬
৩. সার্জেন্ট শামসুল হক, আসামী নং ২৩ এবং
৪. সিরাজ, সাক্ষী নং-১৫
এই সভায় আরও কয়েজন উপস্থিত ছিলেন যাদের পরিচয় উদ্ধার করা যায় নি। ষড়যন্ত্রকারীদের সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ছিল এই সভার আলোচ্য বিষয়।
৬৭. ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে ২নং আসামি মোয়াজ্জেমের চাকরি পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ জল পরিবহন কর্তৃপক্ষের অধীনে স্থানান্তর করা হয় এবং তাকে বরিশালে পোস্টিং দেয়া হয়।
৬৮. ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে ১৫নং সাক্ষী সিরাজ এবং ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ উভয়েই করাচিতে ফিরে আসেন।
৬৯. ঐ একই মাসে (মার্চ, ১৯৬৭) ২ নং আসামী মোয়াজ্জেম ১২নং আসামী মানিক চৌধুরীর মাধ্যমে মি. পি.এন.ওঝার ঢাকাস্থ বাসভবনে তার সঙ্গে চতুর্থ বৈঠকের আয়োজন করেন। তিনি তাদেরকে জানান ষে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের তারিখ নির্ধারিত হবে না। মি. ওঝা তাদের কাজকর্মের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। সভার শেষে পি.এন. ওঝা তাদেরকে নগদ ৫, ০০০ টাকা প্রদান করেন।
৭০. ১৯৬৭ সালের ৩১ মার্চ ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী ও ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে পি.এন. ওঝার সঙ্গে তার ঢাকাস্থ বাসভবেন পঞ্চমবারের মত সাক্ষাৎ করেন। এই সভায় মিঃপি.এন. ওঝা বলেন যে, ভারত সরকার মনে করে যে, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার আগে ষড়যন্ত্রকারী গ্র“পের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েজন ভারতীয় কর্মকর্তার একটি বৈঠক হওয়া প্রয়োজন। মি. পি. এন. ওঝা ঐ বৈঠকের স্থান হিসেবে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে অনতিদূরে ভারতের আগরতলার কথা বলেন তিনি ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে ষড়যন্ত্রকারী গ্র“পের তিনজন প্রতিনিধির নাম প্রস্তাব করতে বলেন। এই সভার পর মি. ওঝা তাদেরকে ১০, ০০০ টাকা প্রদান করেন।
৭১. ঐ একই মাসে (মার্চ, ১৯৬৭) ২নং আসামী মোয়াজ্জেম, ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব এবং ১২নং সাক্ষী রমিজ ঢাকার মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের ১২নং সাক্ষী রমিজের বাসভবনে মিলিত হন। যেখানে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ১২নং সাক্ষী রমিজকে বলেন যে, তার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ টাকা রয়েছে যা পি. এন. ওঝার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, তার ১০নং আসামী রুহুল কুদ্দুস এবং ৬নং আসামী এ.এফ. রহমানের নিকট থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করেছে। এই সভায় ষড়যন্ত্রকারীরা সভা অনুষ্ঠান এবং সার্বক্ষণিক কর্মীদের থাকার জন্য আরেকটি বাড়ি ভাড়া করার কথা স্থির করেন। ষড়যন্ত্রকারীদের কার্যকলাপ গোপন রাখার জন্য একটি লোক দোখানো ব্যবসা খোলার বিষয়ও এখানে স্থির করা হয় ১২নং সাক্ষী রমিজ এ ধরনের একটি ব্যবসা চালু করতে সাহায্য করার জন্য ১৬নং আসামী, তার বন্ধু, আবু শামস লুৎফুল হুদার নাম প্রস্তাব করেন।
৭২. ঐ একই মাসে (মার্চ ১৯৬৭) আরেকটি গ্র“প সভা অনুষ্ঠিত হয় পূর্বোক্ত ফ্লেটেই
নিম্নোক্তরা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
৩. সামাদ, আসামী নং-৮
৪. শামসুর রহমান, আসামসী নং-১৯
৫. মোতালেব, আসামী নং-২৫
৬. রমিজ, সাক্ষী নং ১২ এবং
৭. লুৎফুল হুদা, সাক্ষী নং-১৬
এই সভায় একটি ট্রান্সমিটার সেট সংগ্রহ করা এবং ট্রান্সমিটার অপারেটরদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়। এখানে আরও একটি বিষয় স্থির করা হয় যে, গ্র“পের কার্যকালাপ ঢাকা দেবার জন্য যে ব্যবসা চালু করা হচ্ছে সে বাবদ ১২নং সাক্ষী রমিজের নিয়ন্ত্রণাধীনে একটি বড় অঙ্কের টাকা আলাদা করে রাখা হবে।
৭৩. অল্প কয়েকদিন পরই (মার্চ, ১৯৬৭) ১২নং সাক্ষী রমিজ ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের নিকট থেকে ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবের মাধ্যমে ২৫, ০০০ টাকা গ্রহণ করেন। এই টাকা থেকে ১২নং সাক্ষী রমিজ ব্যবসায়ে খাটানোর জন্য ১৬নং স্বাক্ষী লুৎফুল হুদাকে ৫, ০০০ টাকা প্রদান করেন। বাকি ২০, ০০০ টাকার মধ্যে ১৮, ৬৮৯ টাকা ১২নং সাক্ষী রমিজ ষড়যন্ত্রকারীদের বিবিধ পর্যায়ের কাজে খরচ হিসেবে দেখান।
৭৪. ১৯৬৭ সালে ১৪ মার্চ ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব সার্বক্ষণিকভাবে ষড়যন্ত্রমূলক কাজে নিয়োজিত থাকার দায়ে পাকিস্তান নৌবাহিনি থেকে পরিত্যক্ত হন।
৭৫. এর প্রায় পনের দিন পরে (মার্চ, ১৯৬৭) ১৯নং আসামী শামসুর রহমান ফরিদপুরের ডেপুটি কমিশনার মি. সিদ্দিকুর রহমানের নিকট তার বন্ধু মি. মুজিবুর রহমানকে সাহায্য করার জন্য একটি চিঠি লেখেন। ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব ১৬নং সাক্ষী লুৎফুল হুদাসহ ফরিদপুরে যান এবং মি. সিদ্দিকুর রহমানের নিকট ঐ চিঠি হস্তান্তর করেন।
৭৬. ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকাস্থ গ্রীন স্কোয়ারের ১৩নং বাড়িটি গ্র“পের জন্য ভাড়া নেয়া হয়। ১৯৬৭ সালের ১মে এই বাড়িতে ওঠা হয়। নিম্নোক্ত সার্বক্ষণিক কর্মীগণ সেই বাড়িতে থাকতেন।
১. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
২. সামাদ, আসামী নং-৮
৩. দলিল উদ্দিন, আসামী নং-৯
৪. প্রাক্তন সুবেদার জালাল উদ্দিন আহমেদ, সাক্ষী নং-১৭ এবং
৫. মোহাম্মদ গোলাম আহমেদ, সাক্ষী নং-১৮
২নং আসামী মোয়াজ্জেম তার হিলম্যান গাড়িটিও গ্র“পের কাজে ব্যবহারের জন্য ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবের নিয়ন্ত্রণাধীনে ঐ বাড়িতে রাখেন এই গাড়ির নম্বর হিলম্যান নং ইবিএ-৯৫৯১
৭৭. ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসের কোনো এক সময় ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ ১৯ নং সাক্ষী কর্পোরাল হাই এ.কে.এম.এ এর সঙ্গে তার কোয়ার্টার ডমেস্টিক এরিয়া পি.এ.এফ. কোরাঙ্গী ক্রিক করাচিতে সাক্ষাৎ করেন। ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ সেখানে ডেকোরেশন পিস হিসেবে একটি নকল হ্যান্ড গ্রেনেড দেখতে পান এবং ১৯ নং সাক্ষী হাই সাহেবের নিকট থেকে সেটি নিয়ে আসেন।
৭৮. ১৯৬৭ সালের মে মাসে ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ ২৯নং আসামী সার্জেন্ট জলিলের বাসায় একটি সভা আহŸান করেন। এই বাসায় ঠিকানা হচ্ছে ১৪/৪ জি, ক্লেটন কোয়ার্টার্স, করাচি। নিম্নেক্ত ব্যক্তিবর্গ এ সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭
২. বারি, আসামী নং-২২
৩. সার্জেন্ট শামসুল হক, আসামী নং-২৩
৪. সার্জেন্ট আবদুলজলির, আসামী নং-২৯
৫. মোহাম্মদ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, আসামী নং-৩০
৬. শামসুদ্দিন, সাক্ষী নং-৬
৭. কর্পোরাল জামাল, সাক্ষী নং-১৪ এবং
৮. সিরাজ, সাক্ষী নং-১৫
ঐ সভায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত এবং সেখানে গ্র“পের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ২৩নং আসামী সার্জেন্ট শামসুল হক উপস্থিত সবাইকে জানান যে, ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করা জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করার বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে সফল হয়েছেন। তিনি ঐ সভায় উপস্থিত ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ডি দিবসে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনগণ সামরিক অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকবে। সভার শেষে ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ তার পকেট থেকে একটি নকল হ্যান্ড গ্রেনেড বের করে এবং সবার সামনে সেটি নিক্ষেপ করার নিয়ম পদ্ধতি প্রদর্শন করেন। তিনি গ্র“পের সকল সদস্যকেও অনুরূপভাবে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ অনুশীলন করতে বলেন। ২৯নং আসামী জলিলের বাসায় রেখে যান। তিনি বলেন যে, তিনি হ্যান্ড গ্রেনেডটি যেভাবে সংগ্রহ করেছেন সেভাবে আরও ছোট ছোট অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে সেগুলোর ব্যবহারের প্রশিক্ষণ শুরু করবেন।
৭৯. ১৯৬৭ সালের মে মাসের কোনো এক সময় ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ ১৫ নং সাক্ষী সিরাজের কাছে প্রকাশ করেন যে, ৬নং আসামী শামসুদ্দিনও তাদের গ্র“পের একজন সদস্য ছিল এবং বিমান বাহিনির কর্মকর্তারা ৩১নং আসামী লেফটেন্যান্ট এস.এম.এম রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছেন। ৭নং আসামী মাহফিজউলাহ করাচিস্থ কারসায অফিসার্স কোয়ার্টারে ৩১নং আসামী লেফটেন্যান্ট রহমানের বাসায় অনুষ্ঠিতব্য সভায় ৬নং সাক্ষী সামসুদ্দিন এবং ৩০নং আসামী মাহবুব উদ্দিনকে হাজির করানোর জন্য ১৫নং সাক্ষী সিরাজকে নির্দেশ প্রদান করেন।
৮০. একই মাসের (মে, ১৬৬৭) নির্ধারিত দিনে নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ ৩১নং আসামী লেফটেন্যান্ট রহমানের বাসায় অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মাহফিজউলাহ্ আসামী নং-৭
২. লেঃ রহমান, আসামী নং-৩১
৩. মাহবুব উদ্দিন, আসামী নং-৩০
৪. সামসুদ্দিন, সাক্ষী নং-৬ এবং
৫. সিরাজ, সাক্ষী নং-১৫
এছাড়া কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন যাদের পরিচয় উদ্ঘাটন করা যায় নি। সভায় গ্র“পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা হবার পর ৩১নং আসামী লেঃ রহমান উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, আরও বেশি সংখ্যক বাঙালি চাকরিরত কিংবা প্রাক্তন সৈনিককে গ্র“পে সংগঠিত করতে হবে এবং তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর করার পথ ও পদ্ধতি বের করতে হবে।
৮১. ১৯৬৭ সালের জুন মাসের শেষদিকে কোনো একদিন ২নং আসামী মোয়াজ্জেম গ্র“পের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৭নং সাক্ষী জালাল এবং ৮নং আসামী সামাদকে এক সফরে পাঠান। এই সূত্রে উক্ত দুই ব্যক্তি কুমিলা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং যশোর সফর করেন। তার খুলনায় প্রাক্তন সুবেদার ৩২নং আসামী এ. কে. এম তাজুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সে অঞ্চলে গ্র“পের কাজকর্মের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। ৩২নং আসামী তাজুল ইসলাম তার সংগৃহীত ষড়যন্ত্রকারীদেরকে ঐ সফরকারী দলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
৮২. ১৯৬৭ সালের জুন মাসের ২য় কিংবা ৩য় সপ্তাহে ৩১নং আসামী লেঃ রহমান পূর্বোক্ত গ্র“পের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, তার বাসা-বাংলো নং-ই/১৬, অফিসার্স কোয়ার্টার, কায়সায, করাচিতে এক সভা অনুষ্ঠান করেন। নিম্নোক্ত ষড়যন্ত্রকারীরা ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭
২. বারি, আসামী নং-২২
৩. মাহবুব উদ্দিন, আসামী নং-৩০
৪. লেঃ রহমান, আসামী নং-৩১
৫. সার্জেন্ট সামসুদ্দিন, সাক্ষী নং ৩০
৬. সিরাজ, সাক্ষী নং-১৫
আরও অল্প কয়েজন এই সভায় উপস্থিত ছিলেন যাদেরকে চিহ্নিত করা যায়নি। সভায় ৩১নং আসামী লেঃ রহমান অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে বলেন যে, ২নং আসামী মোয়াজ্জেম গ্র“পে নতুন আন্তর্ভুক্তি বন্ধ রাখার নির্দেশ পাঠিয়েছে। ৩০নং আসামী মাহবুব উদ্দিন এবং ২২নং আসামী বারির পরামর্শক্রমে ৩১ আসামী লেঃ রহমান ৬নং সাক্ষী সামসুদ্দিনকে সে তখন ঢাকায় স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছিলো নির্দেশ দেন যে, সে যেনো ঢাকায় গিয়ে ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং জেনে নেয় যে তিনি (২নং আসামী মোয়াজ্জেম) ঢাকাতে তার ৩১নং আসামী লেঃ রহমানের উপস্থিতি কামনা করে কিনা। যদি তা করে তাহলে ৬নং আসামী সামসুদ্দিন যেন তাকে এই মর্মে একটি টেলিগ্রাম পাঠায় যে, বজলু গুরুতর অসুস্থ, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে। ২২ নং আসামী বারি এবং ৩০নং আসামী মাহবুব উদ্দিনের অনুসরণে গ্র“পের সদস্যরা সাময়িকভাবে করাচি গ্র“পের জন্য কেবল তহবিল সংগ্রহ করবে বলেও সভায় স্থির করা হয়।
৮৩. ১৯৬৭ সালের জুন মাসে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ১৩, গ্রীন স্কোয়ার, ঢাকাতে কয়েকটি সভা আহŸান করেন। এই সভাগুলোতে নিম্নোক্তরা উপস্থিত ছিলেন।
১. মোয়াজ্জেম, আসামী নং-২
২. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী-৩
৩. সুলতান, আসামী নং-৪
৪. দলিল উদ্দিন, আসামী নং-৯
৫. রিসালদার শামসুল হক, আসামী নং-২০
৬. এম.আলী রেজা, আসামী নং-৩৩
৭. ক্যাপটেন খুরশীদ উদ্দিন আহমদ, এ.এম.সি. আসামী নং-৩৪
৮. রমিজ, সাক্ষী নং-১২
৯. জালাল উদ্দিন, সাক্ষী নং-১৯ এবং
১০. আনোয়ার হোসাইন, সাক্ষী নং-২০
এই সভাগুলোর মূল উদ্দেশ্যে ছিল ভারতে যাবার জন্যে প্রতিনিধি নির্বাচন করা। এই সূত্রে ১৯নং আসামী শামসুর রহমানকে জাকার্তায় এবং ২৫নং আসামী মোতালেবকে পেশওয়ারে টেলিগ্রাম করা হয়। কিন্তু তার আসেননি।
৩৪নং আসামী খুরশীদ সদ্য করাচি থেকে টাকা পৌঁছেছেন। তিনি ভারতের আগরতলায় প্রতিনিধি প্রেরণের পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। পূর্বোক্ত সভাসমূহে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়:
ক. সীমান্তের ওপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকে ৩৩নং আসামী রেজা এবং তার সঙ্গে ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিব প্রতিনিধিত্ব করবে।
খ. প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিবেন ৩৩নং আসামী রেজা।
গ. ষড়যন্ত্রকারী গ্র“পের সদস্যদেরকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের যে তালিকা দেখিয়ে ৩৩নং আসামী রেজার নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে সেই তালিকাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হবে।
ঘ. আগরতলার সভায় অস্ত্র চুক্তি চূড়ান্ত করা হবে এবং বর্ধিত আর্থিক সাহায্যের কথা বলা হবে।
ঙ. প্রতিনিধিরা ফেনী সীমান্ত দিয়ে গোপনে আগরতলা যাবেন।
এবং
চ. ১৭নং আসামী জালাল উদ্দিন প্রতিনিধিদের সীমান্ত অতিক্রমের বিষয়টি তদারক করবেন এবং এ ব্যাপারে তার প্রভাব খাটাবেন, এমনকি প্রয়োজন হলে সীমান্তে কর্তব্যরত ই.পি.আর কর্মকর্তাদেরকে ঘুষ দিবেন যাতে প্রতিনিধিদের সীমান্ত অতিক্রম নিশ্চিত ও নিরাপদ করা যায়।
৮৪. ১৯৬৭ সালের জুন মাসের ৩য় কিংবা ৪র্থ সপ্তাহে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ১২নং আসামী মানিক চৌধুরীকে ঢাকায় ডেকে এনে তার হাতে একট খাম দিয়ে সেটি মি. পি.এন. ওঝাকে পৌঁছাতে বলেন। ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী ঐদিন সন্ধ্যায়ই তা করেন। এই খামের মধ্যে ছিল কতগুলো কোড শব্দ, প্রতিনিধিরা যে স্থান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করবেন তার নাম এবং উপরোলেখিত প্রতিনিধিদের নাম।
৮৫. পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৬৭ সালের ১১ জুলাই কথা অনুযায়ী ৩৩নং আসামী রেজা এবং ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবসহ নিম্নেক্ত ষড়যন্ত্রকারীরা ফেনী পৌঁছেন জেলা নোয়াখালী প্রতিনিধিরা যাতে নিরাপদে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছাতে পারেন সেজন্যই অন্যারা তাদের সঙ্গে সীমান্ত পর্যন্ত যান :
১. স্টুয়ার্ট মুজিব, আসামী নং-৩
২. সামাদ, আসামী নং-৮
৩. দলিল উদ্দিন, আসামী নং-৯
৪. রেজা, আসামী নং -৩৩ এবং
৫. জালাল, সাক্ষী নং -১৭
উপরোলেখিত ষড়যন্ত্রকারীরা ফেনী রেল স্টেশনের কাছে হোটেল ডিনোফায় অবস্থান করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায়ই ৩নং আসামী স্টুয়ার্ড মুজিব টেলিফোন করে ১২নং সাক্ষী রমিজকে ফেনী আসতে বলেন। ফলে, ১২নং সাক্ষী রমিজ ২০নং সাক্ষী আনোয়ার হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে পি.আই.এ’র একটি স্টাফ গাড়িতে করে ঐদিন রাতেই ফেনী পৌঁছেন।
৮৬. ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই রাত ২টা ৩০ মিনিট থেকে ৪ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে ১২নং সাক্ষী রমিজ ২০ নং সাক্ষী আনোয়ার হোসন এবং ৯নং আসামী দলিল উদ্দিন ছাড়া সাবইকে পি.আই. এ’র স্টাফ গাড়িতে করে নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি বড় রাস্তায় নামিয়ে দেন। এরপর ১২নং সাক্ষী রমিজ এবং ২০নং সাক্ষী আনোয়ার হোসেন ঐ রাতেই চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। ১৭নং সাক্ষী জালাল উদ্দিন প্রতিনিধিদ্বয়ের ভারতীয় স্থলভাগে প্রবেশ তদারক করেন।
৮৭. ১৯৬৭ সালের ১৩ জুলাই রাতে কোনো এক সময় ঐ প্রতিনিধিদ্বয় ৩৩নং আসামী রেজা এবং ৩ নং আসামী স্টুয়ার্ড মুজিব আগরতলা থেকে একটি ট্রাকে করে ফেনীতে হোটেল ডিনোফায় ফিরে আসেন।
৮৮. ১৯৬৭ সালের ১৫ জুলাই ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে উক্ত সভার ফলাফল জানানোর জন্য তার বরিশালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।
৮৯. ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে ২নং আসামী মোয়াজ্জেম ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী ও ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমানসহ মি. পি. এন. ওঝার সঙ্গে তার ঢাকাস্থ ধানমন্ডির পূর্বোক্ত বাড়িতে ষষ্ঠবারের মতো দেখা করণে। পি.এন.ওঝার ২নং আসামী মোয়াজ্জেমকে জানান যে, তিনি তখনও তার সরকারের পক্ষ থেকে আগরতলা বৈঠকের কোনো ফালাফল জানেন না। কিন্তু তিনি চুপিসারে ১২নং আসামী মানিক চৌধুরীকে জানিয়ে দেন যে, ভারতীয় কর্মকর্তারা এখানকার প্রতিনিধিদের যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তায় আস্থাবাদী নন।
৯০. ঐ একই মাসে জুলাই, ১৯৬৭ ৪নং আসামী সুলতান করাচি সফর করেন যেখানে ৩০নং আসামী মাহবুব উদ্দিনের বাসায় ষড়যন্ত্রকারীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ বাসায় ঠিকানা-১৪/৪জি, মার্টিন কোয়ার্টারস, করাচি। নিম্নোক্তরা এ সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. সুলতান, আসামী নং-৪
২. মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭
৩. জহুরুল হক, আসামী নং-৭
৪. সার্জেন্ট শামসুল হক, আসামী নং-১২
৫. লেঃ রহমান, আসামী নং ৩১ এবং
৬. সিরাজ, সাক্ষী নং-১৫
এছাড়া আরও তিন ব্যক্তি ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন যাদের নাম দেখা যায় পাইলট অফিসার মীর্জা এস.এম.আলী এবং জয়নুল আবেদীন এর মধ্যে শেষের দু’জনের পরিচয় উদ্ঘাটন করা যায় নি এবং প্রথমজন অসুস্থতাজনিত কারণে হাসপাতালে থাকার চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় নি।
৪নং আসামী সুলতান ঐ সভায় বলেন যে, তিনি কিউবার বিপ্লব স্বচক্ষে দেখেছেন এবং ঐ ধরনের একটি বিপ্লবে নিজদের উৎসর্গ করার জন্যেই তিনি বেঁচে আছেন। তিনি প্রধান প্রধান কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার ঘাটতি দেখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি এই বলে তার বক্তব্য শেষ করেন যে, এই সভায় উপস্থিত সকলে গ্র“পের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য, উদ্দেশ্যে সিদ্ধির জন্য নিজ নিজ জীবন উৎসর্গ করার শপথ করুন।
৯১. এর সপ্তাহ দুয়েক পরে, ১৯৬৭ সালের জুলাই/আগস্ট মাসে ৩১নং আসামী লেঃ রহমান ৩০নং আসামী মাহবুব উদ্দিনের পূর্বোক্ত বাসায় আরেকটি সভা আহŸান করেন।
নিম্নোক্তরা ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. লেঃ রহমান, আসামী নং-৩১
২. লেঃ আবদুর রউফ, আসামী নং-৩৫
৩. জহুরুল হক, আসামী নং-১৭
৪. সুলতান, আসামী নং-৪
৫. মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭
৬. বারি, আসামী নং-২২
৭. সিরাজ, সাক্ষী নং-১৫
এছাড়াও উপস্থিতদের মধ্যে দু’জনের নাম উলেখ করা হয়েছেÑজয়নুল আবেদীন ও এম.এস.আলী বলে এবং আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে অস্পষ্টভাবে লেখা। এদের কারোর পরিচয়ই উদ্ঘাটন করা যায় নি। ঐ সভায় ৩১নং আসামী লেঃ রহমান সদস্যদেরকে এই নির্দেশ দেন যে, ২নং আসামী মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে সংগঠকদের যে মূল অংশ কাজ করছে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে সবাই যেনো কাজ করেন। এরপর ৩৫নং আসামী লেঃ আবদুর রউফ উপস্থিত সদস্যদরকে বাংলায় শপথ বাক্য পাঠ করান। ঐ সভায় নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তসমূহও গ্রহণ করা হয়।
ক. ১৫নং সাক্ষী সিরাজুল ইসলাম মৌরিপুর এলাকা থেকে চাঁদা তুলবেন এবং সদস্য তালিকাভুক্তি করবেন।
খ. ৭ নং আসামী মাহফিজউলাহ ড্রিগ রোড থেকে চাঁদা ও সদস্য সংগ্রহ করবেন।
গ. ১৭ নং আসামী জহুরুল হক কোরাঙ্গী এলাকা থেকে চাঁদা ও সদস্য সংগ্রহ করবেন এবং ঐ একই উদ্দেশ্যে তিনি চাকলালা, পেশোয়ার, কোহাটা সারগোদা সফর করবেন।
৯২. ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে ১২নং আসামী মানিক চৌধুরী এবং ৭নং সাক্ষী সাইদুর রহমান ঢাকা সফর করেন। তার ৩নং আসামী স্টুয়ার্ট মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এরপরই তাদেরকে বলা হয় যে, তিনি স্টুয়ার্ট মুজিব এবং ৩৩নং আসামী রেজা আগরতলা গিয়েছিলেন।
৯৩. ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে ৩৫নং আসামী লেঃ আবদুর রউফ ২৯নং আসামী জলিলের ক্লেটন কোয়ার্টার্সের বাসায় একটি জরুরি সভা আহŸান করেন। নিম্নোক্তরা ঐসভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. মাহফিজউলাহ, আসামী নং-৭
২. বারি, আসামী নং২২
৩. জলিল, আসামী নং২৯
৪. লেঃ রহমান, আসামী নং-৩৫
৫. লেঃ রউফ আসামী নং-৬
৬. শামসুদ্দিন, সাক্ষী নং ৬ এবং
৭. সিরাজ, সাক্ষী নং-১৫
এই সভায় উপস্থিতদের মধ্যে আরও তিনজনের নাম দেখা যায়-ক্যাপ্টেন আফতাব চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন এবং সিদ্দিকুর রহমান। কিন্তু এদের পরিচয় উদ্ঘাটন করা যায় নি।
এই সভায় ৩৫নং আসামী লেঃ রউফ এবং ৩১নং আসামী লেঃ রহমান কতগুলো আশঙ্কাজনক প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তাদের সন্দেহ যে, তার সন্দেহভাজন হিসেবে কড়া নজরের মধ্যে আছেন। ৩৫নং আসামী লেঃ রউফ সভায় অংশগ্রহণকারীদেরকে আর কোনো নতুন সদস্য সংগ্রহ না করার নির্দেশ দেন। তিনি গ্র“পের সদস্যদেরকে ছুটি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাবার উদ্যোগ নিতে বলেন। ফলে, গ্র“পের সদস্যরা ছুটি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নিজস্ব শহরগুলোতে চলে যেতে থাকে।
৯৪. ৩নং আসামী সার্জেন্ট শামসুল হকের পরামর্শে ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক সময় ১৭ নং আসামী জহুরুল হক চাকলালা পি.এ. এফ. স্টেশন পরিদর্শন করেন এবং সেখানে তিনি ২১নং সাক্ষী সাজেন্ট রজব হোসেনের সাক্ষাৎ পান। ১৭নং আসামি জহুরুল হক ২১নং সাক্ষী রজব হোেেসনকে জানান যে, সামরিক বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি গ্র“পে গঠিত হয়েছে। তিনি ২১
নং সাক্ষী রজব হোসেনকে সেই গ্র“পে যোগদানর আহŸান জানান। কিন্তু ২১নং সাক্ষী রজব হোসেন এই ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করতে অস্বীকার করেন।
৯৫. ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে ৩৩নং আসামী রেজা ১২নং সাক্ষী রমিজের কাছ থেকে পি. আই.এ’র একটি ক্রেডিট টিকিট পান এবং এর মাধ্যমে ১০নং আসামী রুহুল কুদ্দুস ও ২৫নং আসামী ক্যাপ্টেন মোতালেবকে একথা জানাতে লাহোর পেশোয়ার যাত্রা করেন যে, তার মনে হয় ২নং আসামী মোয়াজ্জেম সংগঠনের তহবিল ব্যবহারে অনিয়ম করছেন। উলেখ্য, ইতোমধ্যে ১০নং আসামী রুহুল কুদ্দুস এবং ২৫নং আসামী ক্যাপ্টেন মোতালেব যথাক্রমে লাহোর ও পেশোয়ারে পোস্টিং পেয়ে চলে গিয়েছেন।
৯৬. ১৯৬৭ সালের নভেম্বর ১৫নং সাক্ষী সিরাজ ‘প্রিভিলেজ লিভ’-এ ঢাকা যান। ঠিক ঐ সময়ই ৩০নং আসামী মাহবুব উদ্দিন, ৩৫নং আসামী লেঃ রউফ এবং ৩১নং আসামী লেঃ রহমানও ছুটিতে ঢাকা পৌঁছে।
৭. ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে নিম্নোক্ত ষড়যন্ত্রকারীরা ২৪নং সাক্ষী প্রাক্তন স্কোয়াড্রন লিডার মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর বাসায় একটি সভায় মিলিত হন।
১. ফজলুল হক, আসামী নং -১১
২. এম.এ. রাজ্জাক, আসামী নং ১৬
৩. কর্পোরাল জামাল, সাক্ষী নং-১৪
৪. জাকির আহমদ, সাক্ষী নং-২২
৫. সার্জেন্ট এম.আবদুর হালিম, সাক্ষী নং ২৩ এবং
৬. চৌধুরী, সাক্ষী নং -২৪
এই সভায় আলোচনা হয় যে, ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এবং তার অনুসারী ব্যক্তিবর্গের স্বার্থপরতার কারণে গ্র“পের যে দুরবস্থা হয়েছে সেখানে থেকে গ্র“পকে উদ্ধার করে এর কাজকর্ম পুনরুজ্জীবিত করা দরকার।
৯৮. ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ২২নং সাক্ষী জাকির ২৫নং সাক্ষী উইং কমান্ডার আশফাক মিয়াকে জানান যে, কয়েদিন আগে ২৩নং সাক্ষী হালিম তাকে ২৪নং সাক্ষী চৌধুরীর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন ও সেখানে তিনি নিম্নোক্ত ব্যক্তিদেরকে সমবেত দেখেছেন:
১. ফজলুল হক, আসামী নং-১১
২. এম.এ. রাজ্জাক, আসামী নং-১৬
৩. চৌধুরী সাক্ষী-২৪
৪. কর্পোরাল জামাল, সাক্ষী নং ১৪ এবং
৫. হালিম, সাক্ষী নং -২৩
২২ নং সাক্ষী জাকির ২৫ নং সাক্ষী আশফাক খানের নিকট অভিযোগ করেন যে, উপরোলেখিত ব্যক্তিরা কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলন।
৯৯. ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ১৫নং সাক্ষী সিরাজের বন্ধু জনৈক মি. মালিকের ঢাকাস্থ শুক্রাবাদের বাসায় নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ একটি সভায় মিলিত হন: ১. লেঃ রউফ, আসামী নং ৩৫, ২ মাহবুব উদ্দিন, আসামী নং-৩০, ৩. সিরাজ, সাক্ষী নং ১৫ এবং আরো কয়েজন যাদেরকে চিহ্নিত করা যায় নি। এই সভায় গ্র“পের কর্মকর্তাকে আড়াল করে রাখার জন্য একটি কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টি আলোচনা হয়। ৩৫নং আসামী লেঃ রউফ গ্র“পের কাজকর্ম পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ২নং আসামী মোয়াজ্জেম এবং কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করার উদ্যোগ নেন।
১০০. এর অল্প কয়েকদিন পরেই ষড়যন্ত্রকারী গ্র“পের সদস্যদের গ্রেফতারকরা আরম্ভ হয় এবং এইভাবে তাদের কর্মকাণ্ড সমাপ্ত হয়।
এখন যথাবিহিত সম্মানপূর্বক প্রার্থনা এই যে, আসামীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে এবং এখানে তা সন্নিবেশিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে আসামীদের যেনো বিচার করা হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের জবানবন্দি
স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হইতেই আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে আমাকে আমার লেখাপড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে।
স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, এর ফলে, ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি। আওয়ামী লীগ পূর্বেও ছিল এবং খেনও সেইরূপ একটি নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক প্রতষ্ঠিান হিসাবে বিদ্যমান।
১৯৫৪ সালে আমি প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদে এবং পরে জাতীয় বিধানসভায় সদস্য নির্বাচিত হই। আমি দুইবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিত্ব লাভ করি। অধিকন্তু আমি গণচীনে প্রেরিত বিধান পরিষদের এক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করি। জনসাধারণের কল্যাণার্থে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীদল গঠন করার জন্য আমাকে ইতিমধ্যে কয়েক বৎসর কারা নির্যাতন ভোগ করিতে হইয়াছিলো।
সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর হইতেই বর্তমান সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে থাকে। ১৯৫৮ সালে ১২ই অক্টোবর তাহারা পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে আমাকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় দেড় বৎসরকাল বিনা বিচারে আটক রাখে। আমাকে একইভাবে আটক রাখা কালে তাহারা আমার বিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করে, কিন্তু আমি ঐ সকল অভিযোগ হইতে সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করি। ১৯৫৯ এর ডিসেম্বর কিংবা ১৯৬০ এর জানুয়ারিতে আমাকে উক্ত আটকাবস্থা হইতে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তিলাভ কালে আমার উপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ জারি করা হয় যেমন: ঢাকা ত্যাগ করিলে আমাকে গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে লিখিতভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাইতে হইবে এবং প্রত্যাবর্তনের পরেও একইভাবে যে বিষয় তাহাদিগকে অবগত করাইতে হইবে। গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা এই সময় সর্বদা ছায়ার মতো আমার পিছু লাগিয়া থাকিত।
অতঃপর ১৯৬২ সালে বর্তমান শাসনতন্ত্র জারির প্রাক্কালে যখন আমার নেতা মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়, তখন আমাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স বলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয় এবং প্রায় ছয় মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং আমরা সম্মিলিত বিরোধী দলের অঙ্গদল হিসাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সম্মিলিত বিরোধীদল এই সময় প্রেসিডেন্ট পদে জনাব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার জন্য মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহকে মনোনয়ন দান করে। আমরা নিবার্চনী অভিযান শুরু করি। সরকারী কর্তৃপক্ষও পুনরায় আমার বক্তৃতা সম্পর্কে কয়েকটি মামলা দায়ের করিয়া আমাকে মিথ্যা বিরক্ত ও লাঞ্ছিত করিতে থাকে।
১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহŸান জানাই।
যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য প্রদান করার জন্যও আমার দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ইহার সকল অঙ্গের নিকট নির্দেশ প্রেরণ করে। যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আবেদন জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করি। সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অন্য অংশসহ বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিলো।
আমি তাসখন্দ ঘোষণাকেও সমর্থন করিয়াছিলাম। কারণ আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান অগ্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে আস্থাবান আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হওয়া উচিত।
১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মিলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাাবলির নিয়মতান্ত্রিক সমাধান ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থিত করি। ছয় দফা কর্মসূচিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ওশাসনের দাবি করা হইয়াছে। অতঃপর আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের অনুক‚লে জনমত যাচাই ও গঠনের জন্য ছয় দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়।
ইহাতে প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সরকারী নেতৃবৃন্দ ও সরকারী প্রশাসনযন্ত্র আমাকে অস্ত্রের ভাষায় গৃহ যুদ্ধ ইত্যাদি হুমকি প্রদান করে এবং একযোগে এক ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে আমি যখন খুলনায় একটি জনসভা করিয়া যশোর হইয়া ঢাকা ফিরিতে ছিলাম তখন তাহারা যশোরে আমার পথরোধ করে এবং আপত্তিকর বক্তৃতা প্রদানে অভিযোগে ঢাকা হইতে প্রেরিত এক গ্রেফতারি পরোয়ানা বলে এইবারের মতো প্রথম গ্রেফতার করে।
আমাকে যশোরের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে উপস্থিত করা হইলে তিনি আমাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন প্রদান করেন। আমি ঢাকার সদর দক্ষিণ মহকুমা প্রশাসকের সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি আমার জামিনে অসম্মত হন, কিন্তু মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিন বলে আমি সেই দিনই মুক্তি পাই এবং সন্ধ্যা সাতটায় নিজ গৃহে গমন করি। সেই সন্ধায়ই আটটায়, পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতার উপর সিলেট হইতে প্রেরিত এক গ্রেফতারি পরোয়ানা বলে আমার বাসগৃহ হইতে আমাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ সেই রাত্রেই আমাকে সিলেট লইয়া যায়। পরদিন প্রভাতে আমাকে আদালতে উপস্থিত করা হইলে সিলেটের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিনের আবেদন বাতিল করিয়া আমাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। পরদিবস সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন প্রদান করেন। কিন্তু মুক্ত হইবার পূর্বেই পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতা প্রদানের অভিযোগে আমাকে কারা দরজায়ই গ্রেফতার করেন। এবারের গ্রেফতারপরোয়ানা মোহনশাহী হইতে প্রেরিত হইয়াছিলো। সেই রাত্রে আমাকে পুলিশ পাহারাধীনে মোমেনশাহী লইয়া যাওয়া হয় এবং একইভাবে মোমেনশাহীর মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিন প্রদানে অস্বীকৃত হন এবং পরে মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিনে মুক্তিলাভ করিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি। উপরিউক্ত সকল ধারাবাহিক গ্রেফতার প্রহসন ও হয়রানি ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে সংঘটিত হয়।
১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সম্ভবত আটই মে, আমি নারায়গঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করি এবং রাত্রে ঢাকায় নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করি। রাত একটার সময় পুলিশ ডিফেন্স অফ পাকিস্তান রুল এর ৩২ ধারায় আমাকে গ্রেফতার করে। একই সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানের বহুসংখ্যক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। ইহাদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোন্দকার মুশতাক আহম্মদ, প্রাক্তন সহ সভাপতি জনাব মুজিবর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদনক জনাব আজিজ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জনাব জহুর আহাম্মদ চৌধুরীসহ বহ নেতৃবৃন্দ। ইহার অল্প কয়েকদিন পরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম.এন.এ. প্রচার সম্পাদক জনাব মোমেন এডভোকেট, সমাজকল্যাণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুর রহমান, ঢাকা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শামসুল হক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য মোলা জালালউদ্দিন আহম্মদ এডভোকট, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও প্রাক্তন মন্ত্রী ক্যাপটেন মনসুর আলী, প্রাক্তন এম.এন. এ .জনাব আমজাদ হোসেন, এডভোকেট জনাব আমিনুদ্দিন আহম্মদ, পাবনার এডভোকেট জনাব আমজাদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব মুস্তফা সারওয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব মহিউদ্দিন আহম্মদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব মোহাম্মদুলাহ এডভোটে ও সংগ্রামী নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দিন আহম্মদ, রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি জনাব হারুনুর রশীদ, তেজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শাহাবুদ্দীন চৌধুরী, ঢাকা সদর উত্তর আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব আবদুল হাকিম, ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি জনাব রশিদ মোশারফ, শহর আওয়ামী লীগ কার্যকরী সম্পাদক জনাব সুলতান আহাম্মদ, অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগ অস্থায়ী সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান পাবনার এডভোকেট জনাব হাসনাইন, মোমেনশাহীর অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব আবদুর রহমান সিদ্দিকীসহ অন্যান্য বহু আওয়ামী লীগ কর্মী, ছাত্রনেতা ও শ্রমিক নেতাকে পাকিস্তান রক্ষা বিধি ৩২ ধারায় নিষ্ঠুর অত্যাচার বলে কারান্তারালে নিক্ষেপ করা হয়। আমার দুই ভাগিনেয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদুলকে কারারুদ্ধ করা হয়। অধিকন্তু পূর্ব পাকিস্তনের সার্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ইত্তেফাককেও বর্তমান শাসকগোষ্ঠী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইহার একমাত্র কারণ হইল যে, ইত্তেফাক মাঝে মাঝে আমার প্রতিষ্ঠানের নীতিসমূহ সমর্থন করিত। সরকার ইহার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে এবং ইহার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়াকে দীর্ঘকালের জন্য কারারুদ্ধ রাখিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলা দায়ের কর। যুগপৎ চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন সভাপতি, চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন সহ-সভাপতি ও অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা জনাব ইদ্রিসকেও পাকিস্তান রক্ষা বিধি বলে অন্ধ কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হয়।
আমাদের গ্রেফতার প্রতিবাদে আমার প্রতিষ্ঠান ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সাধারণ ধর্মঘট আহŸান করে। প্রদেশব্যাপী এই হরতালে দিন পুলিশের গুলিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১১ ব্যক্তি নিহত হয় পুলিশ প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেফতার করে এবং অসংখ্যা লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব মোনেম খান প্রায়শই তাঁহার লোকজন এবং সরকারী কর্মচারী সমক্ষে উন্মুক্তভাবে বলিয়া থাকেন যে, যতদিন তিনি গদিতে আসীন থাকিবেন ততদিন শেখ মুজিবকে শৃঙ্খলিত থাকিতে হইবে। ইহা অনেকেই অবগত আছেন। আটকাবস্থায় কারাকক্ষেই আমাকে বেশ কয়েকবার বিচারালয়ের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। প্রায় ২১ মাস আটক রাখিবার পর ১৯৬৮ সালের জানুয়ারির ১৭/১৮ তারিখ রাত একটায় সময় আমাকে তথাকথিত মুক্তি দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক হইতে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বল প্রয়োগ করিয়া আমাকে ঢাকা সেনানিবাসে লইয়া আসে এবং একটি রুদ্ধ কক্ষে আটক রাখে। আমাকে বহির্জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নির্জনে রাখা হয় এবং কাহারও সহিত সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আমাকে খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়িতে দেওয়া হইত না। বিশ্ব হইতে সকল যোগাযোগ বিহীন অবস্থায় এইভাবে আমাকে দীর্ঘ পাঁচ মাসকাল আটক থাকিতে হয়। এই সময় আমাকে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় এবং আমাকে সকল প্রকার দৈহিক সুযোগ-সুবিধা হইতে বঞ্চিত রাখা হয়। এই মানসিক অত্যাচার সম্বন্ধে যত অল্প প্রকাশ করিতে হয় ততই উত্তম।
এই বিচার কার্য শুরু হইবার মাত্র একদিন পূর্বে ১৯৬৮ সালের ১৮ ইং জুন, আমি প্রথম এডভোকেট জনাব আবদুস সালাম খানের সহিত সাক্ষাৎ করি এবং তাহাকে আমার অন্যতম কৌসুলি নিয়োগ করি।
কেবলমাত্র আমার উপর নির্যাতন চালাইবার জন্য এবং আমার দলকে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও আমাদিগকে কুখ্যাত করিবার জঘন্য মনোবৃত্তি লইয়া আমাকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে। ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ রাজনৈতক, অর্থনৈতিক, চাকরির সংখ্যা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমতার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পথে বিঘœ সৃষ্টি করা ও নিস্পেষণ করাই ইহার মূল উদ্দেশ্য।
এই আদালতে আসিবার পূর্বে আমি লেঃ কঃ মোয়াজ্জেম হোসেন, লেঃ মোজাম্মেল হোসেন, এক্স-কর্পোরাল আমির হোসেন, এল এস সুলতান উদ্দিন আহাম্মদ, কামালউদ্দিন আহাম্মদ স্টুয়ার্ট মুজিবর রহমান, ফ্লইট সার্জেন্ট মাহফুজ উলাহ ও এই মামলায় জড়িত অন্যান্য স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনি কর্মচারীদের কখনও দেখি নাই। জনাব আহমদ ফজলুর রহমান, জনাব রুহুল কুদ্দস ও জনাব খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান এই তিনজন সি.এস.পি অফিসারকে আমি জানি। আমি মন্ত্রী হিসেবে সরকারী কার্য সম্পাদনকালে তাঁহাদিগকে জানিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম এবং তাঁহারাও তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকাররের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাদের সঙ্গে কখনো রাজনীতি বিষয়ক আলোচনা করি নাই কিংবা কোনো ষড়যন্ত্রেও ব্যাপৃত হই নাই। আমি কোনোদিন লেঃ কঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসগৃহে অথবা করাচিতে জনাব কামালউদ্দিনের বাসগৃহে গমন করি নাই কিংবা আমার অথবা লেঃ কঃ মোয়াজ্জেম হোসেনের অথবা করাচিতে জনাব কামালউদ্দিনের বাসগৃহে কোনো সভাও অনুষ্ঠিত হয় নাই কিংবা এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোনো ব্যক্তির সহিত কোনো আলোচনা আমার অথবা জনাব তাজউদ্দিনের বাসায় সংঘটিত হয় নাই। ঐ সকল ব্যক্তি কোনোদিন আমার গৃহে গমন করে নাই এবং আমিও এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত কাহাকেও টাকা দিই নাই। আমি কখনও ডাঃ সাঈদুর রহমান কিংবা মানিক চৌধুরীকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের সাহায্য করিতে বলি নাই। তাঁহারা চট্টগ্রামে আমার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শত শত কর্মীদের ন্যায় মাত্র। আমার প্রতিষ্ঠানে তিনজন সহ-সভাপতি, ৪৪ জন কার্যকারী পরিষদ সদস্য, একজন সাধারণ সম্পাদক এবং আটজন সম্পাদক রহিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রাক্তন মন্ত্রী, এম.এন.এ ও এম.পি। বর্তমান কেন্দ্রীয় পরিষদের পাঁচজন ও প্রাদেশিক পরিষদের দশজন সদস্য আমার প্রতিষ্ঠানভুক্ত। চট্টগ্রামেও আমার প্রতিষ্ঠানের জেলা ও শহর সভাপতি ও সম্পাদকগণ প্রাক্তক এম.এন.এ, এম.পি.এও অনেক বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ বিদ্যামান। আমি তাহাদের কাহারও নিকট কোন প্রকার সাহায্যের কথা উলেখ করি নাই। ইহা অসম্ভব যে, আমি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী মানিক চৌধুরী ও একজন সাধারণ এল.এম.এফ ডাক্তার সাঈদুর রহমানকে কোনো সাহায্যের জন্য অনুরোধ করিতে পারি। ১৯৬৫ সালের জাতীয় পরিষদ আওয়ামী লীগ প্রাথী জনাব জহুর আহম্মদ চৌধুরীর বিরোধিতা করিবার জন্য ডাঃ সাইদুর রহমানকে বরং আওয়ামী লীগ হইতে বহিস্কার করা হইয়াছিলো। আমি ডাঃ সাইদুর রহমানের গৃহে তথাপি গমন করি নাই।
আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। ইহা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল-দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচি রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আস্থাশীল নই। আমি দেশের উভয় অংশের জন্য ন্যায়বিচার চাহিয়া ছিলাম ছয় দফা কর্মসূচিতে ইহাই বিধৃত হইয়াছে। দেশের জন্য আমি যাহাই মঙ্গলকর ভাবিয়াছি আমি সর্বদাই তাহার নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডির ভিতরে জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছি এবং এই নিমিত্ত আমাকে সর্বদাই শাসকগোষ্ঠী এবং স্বার্থবাদীদের হাতে নিগৃহীত হইতে হইয়াছে। তাহারা আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠানকে দমন করিয়া পাকিস্তানের জনগণের বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর শোষণ ও নিষ্পেষণ অব্যাহত রাখিতে চায়।
আমার উক্তির সমর্থনে আমি মহামান্য আদালতে আরো নিবেদন করিতে চাই যে, আমাকে প্রতিহিংসাবশত মিথ্যা এই মামলায় জড়িত করা হইয়াছে। পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক ১৯৬৮ সালের ৬ই জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে অভিযুক্ত বলিয়া কথিত ২৮ ব্যক্তির নাম লিপিবদ্ধ ছিল এবং উহার মধ্যে আমার নাম ছিল না। উক্ত প্রচারপত্রে ইহাও উলেখ হইয়াছিলো যে, সকল অভিযুক্তই অভিযোগ স্বীকার করিয়াছে তদন্ত প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে এবং শীঘ্রই বিষয়টি বিচারার্থে আদালতে প্রেরণ করা হইবে।
একজন প্রাক্তন মন্ত্রী হিসাবে অর্জিত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি স্বরাষ্ট্র বিভাগের উক্ত প্রচারপত্র সম্বন্ধে একথা জানাইতে চাই যে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সেক্রেটারী কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে দলিলপত্র পরীক্ষিত ও অনুমোদিত হওয়ায় ব্যতিরেকে কোনো বিভাগ হইতে কোনো প্রকার প্রচারপত্র প্রকাশ করা যায় না। এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রচারপত্র প্রকাশ করিতে হইলে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাভ আবশ্যক।
বর্তমান মামলা উলিখিত নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শোষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্রজাল বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিস্তার করিয়াছে এই মামলা তাহারই বিষময় প্রতিক্রিয়া। আমি কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য কোনো কিছু করি নাই কিংবা আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণরূপে অজ্ঞ। তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নামের তালিকা
১. শেখ মুজিবুর রহমান
২. পি নং ৫৭৪ লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন
৩. ও নং-৬৬৫০৮ স্টুয়ার্ট মুজিবুর রহমান
৪. প্রাক্তন এল/এস, সুলতান উদ্দিন আহমেদ
৫. ও নং-৬৪৬৭২ এল/এস সি ডি আই নূর মোহাম্মদ
৬. আহমেদ ফজলুর রহমান
সি এস পি
৭. পাক/৫১৩০১, এফ সার্জেন্ট মাহফিজউলাহ
৮. প্রাক্তন কর্পোরাল আবুল বাশার মোহাম্মদ আবদুস সামাদ
ক. গ্রাম-টুঙ্গিপাড়া, থানা: গোপালগঞ্জ জেলা-ফরিদপুর।
খ. ৬৭৭ ধানমন্ডি আ/এ, সড়ক ৩২, ঢাকা। গ্রাম-ধুসরীতাল, থানা-পিরোজপর, জেলাÑ বরিশাল। গ্রাম-ঘাটমাঝি, থানাÑ মাদারীপুর জেলা-ফরিদপুর। গ্রামÑ উত্তর খামার, থানাÑ কাপাসিয়া, জেলা-ঢাকা।
ক. গ্রাম-কুমারভোগ, থানাÑ লৌহজং তহশিল হলিদিয়া, জেলাÑ ঢাকা।
খ. ৭৩ ধানমন্ডি আ/এ সড়ক ৩০, ঢাকা। গ্রামÑ কাচিশার, থানাÑ দেবীদ্বার জেলা-কমিলা
গ্রামÑ মুরাদপুর, থানাÑ বেগমগঞ্জ জেলাÑ নোয়াখালী।
গ্রাম-মিঠাখারী, থানাÑ মঠবাড়িয়া
৯. প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন
১০ রুহুল কুদ্দুস সিএস পি
১১. পাক/৭২৮৭০, ফ্লাইট সার্জেন্ট মুহম্মদ ফজলুল হক
১২. ভূপতিভুষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী
১৩. বিধান কৃষ্ণ সেন
১৪. পি. জে. ও ২৬৮, সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক
১৫. প্রাক্তন হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান ই পি আর টি সি
১৬. প্রাক্তন ফ্লাইট সার্জেন্ট মুহম্মদ আবদুর রাজ্জাক
১৭. পাক/৭২৩২৪, সার্জেন্ট জহুরুল হক
জেলা-বরিশাল। গ্রাম-শ্যামপুর, থানা-বাকেরগঞ্জ জেলাÑ বরিশাল।
ক. গ্রাম-পাঁচরিখি, থানাÑ সাতক্ষীরা, জেলাÑ খুলনা।
খ. ৬১৮-এ ধানমন্ডি আ/এ সড়ক ১৮, ঢাকা। গ্রামÑ শায়েস্তাবাদ থানা-কোতায়ালী জেলাÑ বরিশাল। গ্রামÑ হবিলাল দ্বীপ, থানাÑ পটিয়া জেলাÑ চট্টগ্রাম বেং ৪১, রামজয় মহজান লেন, চট্টগ্রাম। গ্রামÑ সারোয়াতলা, থানা-বোয়ালখালী, জেলাÑ চট্টগ্রাম। গ্রাম-দক্ষিণ ভরসার, থানা-মতলব জেলা কুমিলা। গ্রামÑ গোপালপুর, থানাÑ নবীনগর জেলাÑ কুমিলা। গ্রাম-বাঞ্ছারামপুর, থানা-দাউদকান্দি জেলাÑ কুমিলা। গ্রামÑ সোনাপুর, থানাÑ সুধরাম জেলাÑ নোয়াখালী।
১৮. প্রাক্তন এ/বি মুহম্মদ খুরশীদ
১৯. খান শামসুর রহমান
২০. পি. জে.ও ৭৬৮, রিসালদার এ. কে.এম. শামসুল হক
২১. নং-৩০৩১০১৮ হাবিলদার আজিজুল হক
২২. পাক/৭৩০৪০ এস এ সি মাহফুজুল বারী
২৩. পাক/৭০৪১৫, সার্জেন্ট শামসুল হক
২৪. পি এস এস ১০০৫২০ মেজর শামসুল আলম এ.এম.সি
২৫. পি এস এস ৬১০০, ক্যাপটেন মোহাম্মদ আবুদল মোত্তালিব
২৬. পি টি সি ৫৭২৭, ক্যাপটেন এম.শওকত আলী মিয়া
২৭. পি এ ৬৫৬১, ক্যাপটেন খন্দকার নাজমুল হুদা এ.এস.সি
২৮. ক্যাপটেন এ.এন.এম নূরুজ্জামান ইবিআর
২৯. পাক/৭০৭০৪, সার্জেন্ট আবদুল জলিল
৩০. মুহম্মদ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী
৩১. পি নং-৯৫৮, আই লেঃ এস.এম. এম. রহমান
৩২. এক্স সুবেদার এ. কে. এম.তাজুল ইসলম
৩৩. মুহম্মদ আলী রেজা
৩৪. পি এস এস-২০০৪৭১, ক্যাপটেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ, এ.এম.সি
৩৫. পি নংÑ ৯৪৪, আই লেঃ আবদুর রউফ সাবের কটেজ, কোতোয়ালী, ফরিদপুর।
গ্রাম-লামুবাড়ি, থানা-মানিকগঞ্জ,
জেলা-ঢাকা
গ্রামÑ পুতাল
ডাকঘর-লামুবাড়ি
থানাÑ মানিকগঞ্জ, জেলাÑ ঢাকা
গ্রামÑ কাচিয়া, থানাÑ গৌড়নদী
জেলাÑ বরিশাল।
গ্রামÑ চরলক্ষী, থানাÑ রামগতি
জেলাÑ নোয়াখালী।
গ্রামÑ রৈাজপুর, থানাÑ ফেনী
জেলা-নোয়াখালী।
১৬ খাজে দেওয়ান
সেকেন্ড লেন, ঢাকা।
গ্রামÑ দরুনবাইরাতি, থানাÑ পূর্বধলা
জেলাÑ ময়মনসিংহ।
গ্রামÑ চকধা, থানাÑ নরিয়া
জেলাÑ ফরিদপুর।
পশ্চিম বগুড়া রোড
বরিশাল শহর
জেলাÑ বরিশাল।
গ্রামÑ সাইদাবাদ, থানা-রায়পুরা।
জেলাÑ ঢাকা।
গ্রামÑ সারাবাদ, থানাÑ নারায়নপুর,
ঢাকা।
গ্রাম-পাইয়াম, ডাকঘর-তৈতিয়ান
জেলা-সিলেট।
গ্রামÑ মাকরাইল, থানাÑ লোহাগড়
জেলা-যশোর।
গ্রাম-শ্রীপুর
থানাÑ ভাণ্ডারিয়া
জেলাÑ বরিশাল।
গ্রামÑ লাহিনি, থাকা-কোতোয়ালী
জেলাÑ কুষ্টিয়া।
গ্রামÑ বাঁশিয়া
থানাÑ গফরগাঁও
জেলাÑ ময়মনসিংহ।
পাকিস্তান হাউজ
থানাÑ ভৈরব
জেলাÑ ময়মনসিংহ।
লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার, ১৯৭০
১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার ঘোষণা করেন। এতে বলা হয় যে আইনসভায় ৩০০টি আসন থাকবে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সংখ্যাসাম্যের উলেখ ছিল। ফ্রেমওয়ার্কে রাষ্ট্র্রের দুই অংশের জন্য সংখ্যানুপাতের কথা বলা হয়। এই নিয়মের আওতায় পূর্ব পাকিস্তান ১৬২টি ও পশ্চিম পাকিস্তান ১৩৮টি আসন লাভ করে। আরো উলেখ করা হয় যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহŸানের ১২০ দিনের মধ্যে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে, কিন্তু প্রক্রিয়ার নিয়ম ভবিষ্যত আইনসভার হাতে অর্পণ করা হয়। ১২০ দিনের মধ্যে নতুন আইনসভা সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে নতুন নির্বাচন দেয়া হবে। রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রস্তাবিত সকল বক্তব্য ও সম্মতি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির সামনে সত্যায়িত করার জন্য পেশ করা হবে। এছাড়াও এক ইউনিট পদ্ধতি বাতিল করা হয়। পূর্বে এক ইউনিটের আওতায় পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশকে একত্রে একটি প্রদেশ গণ্য করা হত।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
ভায়েরা আমার,
আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসে¤¦লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলায় অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর ও নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সনে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে জয় লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সনে আইয়ুব খান মার্শাল ’ল জারি করে ১০ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছিল। ১৯৬৬ সনের ছয় দফার আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সনের আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হবার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তার পরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম ১০ই ফেব্র“য়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন প্রথম সাপ্তাহের মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা অ্যাসে¤¦লিতে বসবো। আমি বললাম, যদি কেহ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন, বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তার পরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ওদের সঙ্গে আলাপ করলাম; আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের মে¤¦াররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসে¤¦লি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেহ অ্যাসে¤¦লিতে আসে তাহলে পেশেয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসে¤¦লি চলবে। তারপরে হঠাৎ এক তারিখে অ্যাসে¤¦লি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসে¤¦লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। পঁয়ত্রিশ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তার পরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেওয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো। আমি বললাম শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কী পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশক্রর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব ও দুঃখী আর্তমানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তাঁরা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান, কী ভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে? কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স¦ীকার করেছি যে, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলেছি কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন। বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন।
ভায়েরা আমার,
২৫ তারিখে অ্যাসে¤¦লি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পারা দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসে¤¦লি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনির লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তার পরে বিবেচনা করে দেখব আমরা অ্যাসে¤¦লিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে অ্যাসে¤¦লিতে বসতে আমরা পারি না। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাচারি, আদালত ও ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোতে হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীম কোর্ট, হাই কোর্ট, জজ কোর্ট, সেমিগভর্নমেন্ট দফতরগুলো ওয়াপদা, কোনোকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয় শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো। পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্ত আর আমার বুকের উপরে গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যতদূর পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছায়া দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়া দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ দেবে না। শোনেন-মনে রাখবেন, শত্র“ বাহিনি ঢুকেছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও, টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমার নিউজ না দেয় কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা পত্র নেবার পারে। কিন্ত পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্ত যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহলায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবÑএদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল¬াহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা।
স্বাধীনতার ঘোষণা
এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনির দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহব্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনির শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
মুজিব নগর, বাংলাদেশ, ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১
যেহেতু ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত একটি শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিল।
এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেন।
এবং
যেহেতু আহূত এ পরিষদ স্বেচ্ছাচার ও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
এবং
যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্র“তি পালনের পরিবর্তে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এবং
যেহেতু উলে¬খিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্যে উদ্ভুত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জনান।
এবং
যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনাকালে বাংলাদেশের অসামরিক ও নিরস্ত্র জনসাধারণের বিরুদ্ধে অগুণিত গণহত্যা ও নজিরবিহীন নির্যাতন চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে।
এবং
যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একত্র হয়ে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে ও নিজেদের সরকার গঠন করতে সুযোগ করে দিয়েছেন।
এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্ল¬বী কার্যক্রমের দ্বারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
সেহেতু
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন সে মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণ-পরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্র্রে রূপান্তরিত করা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি। এবং এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
এবং
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনিসমূহের সর্বাধিনায়ক হবেন, রাষ্ট্রপ্রধানই ক্ষমা প্রদর্শনসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন, তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রয়োজনবোধে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য নিয়োগ করতে পারবেনÑরাষ্ট্রপ্রধানের কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের এবং গণপরিষদের অধিবেশন আহবান ও মুলতবির ক্ষমতা থাকবে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্যে আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে অন্যান্য সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, যে কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দ্বায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হয়েছে তা আমরা যথাযথভাবে পালন করব।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্যে আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ক্ষমতা দিলাম।
এবং রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলাম।
তাজউদ্দিন আহমদের ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১-এর ভাষণ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ:
আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাবার জন্য বহু কষ্ট করে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।
আমি কিছু বলবার আগে প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সংবাদপত্র সেবী ও নিউজ এজেন্সির প্রতিনিধিদেরকে যে, তারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আগাগোড়া সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন এবং সত্য কথা প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। যদিও ইয়াহিয়া সরকার তাদেরকে এবং তার সেই দস্যুবাহিনি বিদেশি সাংবাদিকদেরকে ভিতরে আসতে দেয়নি, যারা ভিতরে ছিলেন তাদেরকেও জবরদস্তি করে ২৫ তারিখ রাতেই বের করে দিয়েছেন। আমি আপনাদেরকে আরও ধন্যবাদ দিচ্ছি, আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই জন্য যে, আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই সংগ্রাম কোন অবস্থাতেই যেন ব্যাহত না হয় এবং কোন অবস্থাতেই সে সংগ্রামকে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া না হয় সে জন্য আপনারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, সঠিক পথ দেখিয়েছেন।
আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে আবেদন জানাব ভবিষ্যতেও আপনারা দয়া করে চেষ্টা করবেন যাতে সঠিক সংবাদ পরিবেশিত হয়, যাতে কোন দুষ্কৃতিকারী বা কোন শত্র“ বা এজেন্ট ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের আন্দোলনের কোন ভুল ব্যাখ্যা করতে না পারে, ভুল বোঝাতে না পারে। সেই সাথে আমি আপনাদেরকে আরও অনুরোধ জানাব আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে হ্যান্ড আউট যাবে সেটাকেই বাংলাদেশ সরকারের সঠিক ভাষ্য বলে ধরে নিবেন, সেটাকেই ভিত্তি হিসাবে ধরে নিবেন। আর আমি আপনাদের আরও একটি অনুরোধ জানাব জানি না কিভাবে সেটা সম্ভব হবে, আমাদের বাংলাদেশের মাটি থেকে আপনারা কিভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন, কিভাবে বাংলাদেশ সরকারের সাথে লিয়াজো করতে পারেন সেই ব্যাপারে আপনারা চিন্তা করে দেখবেন এবং সেই ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ আমরা অত্যন্ত সাদরে, আনন্দের সাথে গ্রহণ করব।
এখন আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমার ভাষ্য তুলে ধরব। বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের ঔপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশ গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে। কিভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তারা বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত আশা-আকাক্সক্ষাকে সত্যিকার ভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসাবে আওয়ামী লীগ পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ৬ দফার আলোকে বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ এই ৬ দফা নির্বাচনী ইসতেহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩ টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে মোট ১৬৭ টি আসন লাভ করেছিল। নির্বাচনী বিজয় এতই চূড়ান্ত ছিল যে, আওয়ামী লীগ মোট শতকরা ৮০ টি ভোট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
স্বভাবতই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন্য এক আশাময় দিন। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের এমনি চূড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। দুই প্রদেশের জনগণই বিশ্বাস করেছিলেন যে, এবার ৬ দফার ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু ও পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টি তাদের নির্বাচন অভিযানে ৬ দফাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। কাজেই ৬ দফাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার জন্যে জনগণের কাছে এই দলে জবাবদিহি ছিল না। বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল ৬ দফার পূর্ণ সমর্থক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও ৬ দফার আলোকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান গণতন্ত্রের আশাপ্রদ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করেছিল।
আশা করা গিয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদ আহবানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় বসবে। এমনি আলোচনার প্রস্তাব এবং পাল্টা প্রস্তাবের ওপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সবসময়ই সম্মত ছিল। তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে, যথার্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য গোপনীয় সম্মেলনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদেই গঠনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল যথাসত্বর জাতীয় পরিষদ আহবানের জন্য। আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে গেল এবং এ ধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও পরীক্ষা করে দেখল।
পকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলোচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে। এই বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামীলীগের ৬ দফা ভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশে¬ষণ করলেন এবং ফল কী হতে পারে তার ও নিশ্চিত ভরসা নিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন এক ভাব দেখালেন যে, ৬ দফায় সাংঘাতিক আপত্তি জনক। কিছুই তিনি খুঁজে পাননি তবে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সাথে সমঝোতায় আসার উপর তিনি জোর দিলেন।
পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে ঢাকায় ২৭ জানুয়ারি ১৯৭১। জনাব ভুট্টো এবং তার দল আওয়ামী লীগের সাথে গঠনতন্ত্রের উপর আলোচনার জন্য এসময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন।
ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামো সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনয়ন করেননি। বরং তিনি এবং তার দল ৬ দফায় বাস্তব ফল কী হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনার প্রতিই অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল না সূচক এবং যেহেতু এ নিয়ে তাদের কোন তৈরি বক্তব্যও ছিল না সেহেতু এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপস ফর্মুলায় আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ দুই দলের মধ্য মতানৈক দূর করার জন্য প্রচেষ্টার দুয়ার সবসময়ই খোলা ছিল। এই আলোচনা বৈঠক থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোন পর্যায় থেকে আপস ফর্মুলায় আসা সম্ভব সে সম্পর্কেও জনাব ভুট্টোর নিজস্ব কোন বক্তব্য ছিল না।
এখানে একটি কথা আরও পরিষ্কার ভাবে বলে রাখা দরকার যে, আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের কোন আভাসও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যাননি। উপরন্তু তারা নিশ্চয়তা দিয়ে গেলেন যে, আলোচনার জন্য সব দরজাই খোলা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনার পর পাকিস্তান পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফায় আরো অধিক ফলপ্রসু আলোচনায় বসবেন। অথবা জাতীয় পরিষদের তারা ভিন্ন আলোচনার বসার জন্য অনেক সুযোগ পাবেন।
পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিদ্ধান্ত এই জন্যই সবাইকে আরো বেশি বিস্মিত করে যে, শেখ মুজিবের দাবি মোতাবেক ১৫ই ফেব্র“য়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতোই ৩ই মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলন। পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে সমস্ত দলের সদস্যের বিরুদ্ধে ভিতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত রাখা। এ কজে ভুট্টোর হস্তকে শক্তিশালি করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহোচর লে. জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের উপর পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। জনাব ভুট্টো ও লে. জেনারেল ওমরের চাপ সত্তে¡ও পিপিপি ও কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পূর্ববাংলায় গমনের টিকিট বুক করেন। এমনকি কাইয়ুম লীগের অর্ধেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমনও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, পিপিপির বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোন কুলকিনার পাওয়া যাচ্ছিল না তখন ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া তার দোস্ত ভুট্টোকে খুশি করার জন্য। শুধু তাই নয় জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ববাংলার গভর্নর আহাসানকেও বরখাস্ত করলেন। গভর্নর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনের মধ্যপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালিদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার হাতে তুলে দেওয়া হলো।
এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোন ক্রমেই ভুট্রোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণরায় বানচাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদেই ছিল একমাত্র স্থান। যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরী করতে পারত এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারত। এটাকে বানচাল করার চেষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমতার উৎস না করে একটা ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করার।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের স্থগিতের প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারি রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এক পাকিস্তানের কাঠামো বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোন সম্ভবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহবান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাই তারা একবাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন।
শেখ মুজিব এতদসত্তে¡ও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩ মার্চ অসহযোগ কর্মসূচির আহবান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনিকে মোকাবিলার জন্য শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখনো তিনি আশা করছিলেন যে, সামরিক চক্র তাদের জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২ ও ৩ মার্চ ঠান্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নজির প্রথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শেখ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকর অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণপ্রশাসন বিভাগের কর্মচারীগণ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনির সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারীগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকে ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকেরাও সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারও নির্দেশ মেনে চলবে না।
এ অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামীলীগ বাধ্য হলো। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী স¤প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলি সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলির সামাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দূরহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলির মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্তে¡ও পুলিশের সহযোগীতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কনফ্রন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হলো। কেননা তার ঐদিনের প্ররোচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সঙ্কটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামী লীগের ওপর। অথচ যিনি ছিলেন সঙ্কটের স্থপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকার সেনাবাহিনিকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ। লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পাঠানো হলো লে. জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনোভাবের পরিচয়।
কিন্তু ইতিমধ্যেই মুক্তি পাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে উঠে। এ সত্তে¡ও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যোগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর জন্য ইয়াহিয়াকে দেওয়া হয় তার শেষ সুযোগ।
বর্তমান অবস্থায় পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটা আজ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, অনুরূপ একটি সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেয়া হয়েছিল।
১ মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত ট্যাঙ্কগুলো ফেরত আনা হয়। ১ মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানি কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবার সমূহের সাথে সেনাবাহিনির লোকদের পরিবার পরিজনদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে।
১ লা মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পিআইয়ের কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পোশাকের সশস্ত্র বাহিনির লোকদের বাংলাদেশে আনা হলো। সি ১৩০ পরিবহন বিমানগুলোর সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশে স্তাপিত করা হয়।
হিসাব নিয়ে জানা গেছে, ১লা মার্চ থেকে ২৫ শে মার্চের মধ্যে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরকে বিমানবাহিনির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমানবন্দর এলাকায় আর্টিলারি ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন-নির্গমনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ড সংগঠনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একদল এসজি কমান্ডো গ্র“প বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৫ শে মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যেসব কুকাণ্ড ঘটে এরাই সেগুলো সংঘটন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এসবের উদ্দেশ্য।
প্রতারণা বা ভণ্ডামির এই স্ট্রাটেজি গোপন করার অংশ হিসাবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আলোচনায় আপসমূলক মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ই মার্চ আলোচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪ দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাব কী? জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে, ৪ দফা শর্ত পূরণের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের উপদেষ্টগণ একটা অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন।
আলোচনাকালে যেসব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলো হলো:
১। মার্শাল’ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটি বেসামরিক সরাকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
২। প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
৩। ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন।
৪। জাতীয় পরিষদ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথক ভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন।
আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনোনয়নের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ৬ দফা হলো বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযোগ্য নীল নকশা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়োগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি এমএনএদের পৃথক ভাবে বসে ৬ দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলোপের আলোকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।
শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং তাহলো অন্তবর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বণ্টন। এক্ষত্রেও উভয় পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মোটামোটি তার আলোকেই কেন্দ্র বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হবে। অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এমএম আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ আলোচনায় তিনি স্পষ্টভাবে একথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬ দফা কার্যকর করার প্রশ্নে দুর্লভ কোনো সমস্য দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না।
আওয়ামী লীগের খসরার উপর তিনি যে তিনটি সংশোধনী পেশ করেছিলেন তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে তা নিয়ে। ২৪ শে মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশোধনীগুলো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোন বাধাই ছিল না।
এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিস্কার করে বলতে হয়, কোন পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস ইঙ্গিতেও এমন কোন কথা বলেননি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না।
গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোচ্চুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি এবং তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাঁকড়া তুলেছেন ইয়াহিয়া তাই অনুমোদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার ইয়াহিয়া ঘুণাক্ষরেও এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার, ইয়াহিয়া যদি আভাস ইঙ্গিতেও একথা বলতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই আপত্তি করত না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা করে আলোচনা বানচাল করতে দেওয়া যায় না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশি করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোন সময়ই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না।
২৪ শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে এম এম আহমদ তার সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এ খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহবানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোন চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং এম.এম আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫ শে মার্চ করাচি চলে গেলেন।
২৫ শে মার্চ রাত ১১টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনি শহরে পজিশন গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত নাগাদ ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হলো গণহত্যার এক পূর্বনির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোন চরমপত্র। অথবা মেশিনগান, আর্টিলারি সুসজ্জিত ট্যাঙ্কসমূহ যখন মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারি করা হয়নি কোন কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লে. জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারি করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লোক তার আগেই প্রাণ হারিয়েছেন বিনা প্রতিরোধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুণ্ডে। প্রতিটি অলিগলি আনাচে কানাচে চলতে লাগল নির্বিচারে গুলি। সামরিক বাহিনির লোকদের নির্বিচারে অগ্নিসংযোগের মুখে অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যে সব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করল তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয় মেশিনগানের গুলিতে।
আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ইপিআর বীরের মতো লড়ে গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোন প্রতিরোধ দিতে পারল না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনি যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটা নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং শিগগিরই তা প্রকাশ করব। মানুষ সভ্যতার ইতিহাসে যে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনি আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে মান করে দিয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনিকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫ শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙালি হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসীকে জানাতে হলো এর কৈফিয়ত। এই বিবৃতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পরবিরোধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন সে দলের লোকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ-আলোচনায় কোন সঙ্গতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবাধ মতপ্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারল না। তার বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো যে, ইয়াহিয়া আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন্য জঙ্গি আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর।
পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুলঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসাবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তার ই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের উপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোন মতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুক‚ল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদারি সৈনিকরা লঙ্ঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারি পশুর মতো। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এসব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে, ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো তাহলে তারা একই দেশের মানুষের উপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারত না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচারে গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানের বিয়োগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালির রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পোড়ামাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হলো আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলোকে ধূলিসাৎ করা, যাতে একটি জাতি হিসেবে কোন দিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।
ইতোমধ্যে এই লক্ষ্যপথে সেনাবাহিনি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শোষণ করেছে, তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার হিসেবে সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে পড়ল।
বেলসেন এবং অসউহজের পর গণহত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটানার ব্যাপারে উটপাখির নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন যে, এতদ্বারা তার পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তাহলে তারা ভুল করেছেন। কেননা পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মোহমুক্ত। তাদের বোঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশের আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।
সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট বিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাব। প্রত্যেকটি রাষ্ট্র্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যহত রাখা সম্ভব নয়।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হলো বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সৃষ্ট ভস্ম ও ধ্বংসস্তূপের উপর একটা নতুন দেশ গড়ে তোলা। এ একটা দূরুহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দারিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ একটা ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণপণে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতেই হবে।
আমার বিশ্বাস যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোন বাধা বিপত্তি টিকতে পারে না।
আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোপট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোন শক্তি, ব¬ক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না। আমরা আশা করি শুধু শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারও তবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।
আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতি সমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন আর কালবিলম্ব করবেন না। এ মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুণ।
বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনির জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনি নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনিসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনির ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনিগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনিগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে।
স্বাক্ষর
(জগজিৎ সিং অরোরা )
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল
জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলা দেশ যৌথবাহিনি
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
স্বাক্ষর
(আমির আবদুলাহ খান নিয়াজি)
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল
সামরিক আইন প্রশাসক অঞ্চল বি
অধিনায়ক পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড (পাকিস্তান)
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ২৫ বছর মেয়াদী একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের সময় এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তিটিতে মোট ১২টি ধারা ছিল : (১) চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয় ঘোষণা করছে যে, দু’দেশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও সৌহার্দ বজায় থাকবে, এক পক্ষ অন্য পক্ষের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং এক পক্ষ অন্য পক্ষের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না; (২) চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয় সব ধরনের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের নিন্দা করছে এবং তার অবসানের লক্ষ্যে কাজ করে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে; (৩) চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করছে এবং মনে করে যে, জোটনিরপেক্ষ নীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব; (৪) কোনো আন্তর্জাতিক সমস্যার কারণে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ দুটির স্বার্থ বিঘিœত হলে তারা নিজেদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবে ও মত বিনিময় করবে; (৫) চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয় অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরি ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা প্রদান করবে এবং সমতা ও পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে বাণিজ্য, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করবে; (৬) উভয় পক্ষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীর অববাহিকা উন্নয়ন, জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন ও সেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে যৌথ গবেষণা পরিচালনা ও যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করবে; (৭) উভয় পক্ষ শিল্পকলা, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন সাধন করবে; (৮) দু’দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পক্ষ অন্য কোনো দেশের সঙ্গে এমন কোনো সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে না, যা চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাতে পারবে না এবং অন্য পক্ষের সামরিক ক্ষতি হতে পারে কিংবা নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে এমন কোনো কাজে নিজ দেশের ভূমি ব্যবহারের জন্য তৃতীয় কোনো পক্ষকে অনুমতি দিতে পারবে না; (৯) চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে যদি তৃতীয় কোনো দেশ সামরিক আগ্রাসন চালায়, তাহলে চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনো পক্ষ ঐ তৃতীয় দেশটিকে সমর্থন করতে পারবে না বরং স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করে সেই হুমকি মোকাবেলার ব্যাপারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং নিজ নিজ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে; (১০) চুক্তি স্বাক্ষরকারী প্রত্যেক পক্ষ তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে গোপনে বা প্রকাশ্যে এমন কোনো চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে না, যা বর্তমান চুক্তির স্বার্থকে বিঘিœত করে; (১১) বর্তমান চুক্তির মেয়াদ ২৫ বছর। তবে চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষদ্বয়ের পরস্পরের সম্মতিতে এর নবায়ন করা যাবে; (১২) চুক্তির কোনো ধারা নিয়ে আপত্তি উঠলে তা দ্বিপাক্ষিকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পারস্পরিক সম্মান ও সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান করা হবে।
১৯৯৭ সালের ১৯ মার্চ চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং অতঃপর আর এ চুক্তির নবায়ন করা হয় নি।
গ্রন্থপঞ্জি
১. বাংলাদেশ―রাজনীতির চার দশক―সম্পাদনা তারেক শামসুর রেহমান।
২. কিশোর মুক্তিযুদ্ধ কোষ―সম্পাদনা মুনতাসীর মামুন।
৩. ইতিহাসের মহানায়ক―বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর-জয়শ্রী জামান।
৪. একটি গণহত্যার অপ্রকাশিত দলিল-হিমু অধিকারী
৫. আওয়ামী লীগের ইতিহাস-(১৯৪৯-১৯৭১) ―আবু আল সাঈদ
৬. ঞযব অধিসর খবধমঁব (১৯৪৯-১৯৭১)–ঝযুধসধষর এযড়ংয
৭. মহাকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি―বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) মো: আশরাফুল ইসলাম খান এবং মো: লুৎফর রহমান
৮. ৮. স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু-সম্পাদনা প্রফেসর ড. মো: মাহবুব-উলÑইসলাম এবং সাইফুল¬াহ আল-মামুন
৯. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে-মুক্তিযুদ্ধ―১৯৭১―মেজর রফিকুল ইসলাম
১০. বাংলাদেশ-রক্তাক্ত অধ্যায় (১৯৭৫-৮১) ―বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন এনডিসি, পিএসসি (অব.)।
১১. বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, লক্ষ্য ও সংগ্রাম―নুরুল ইসলাম নাহিদ
১২. একাত্তরের ডায়েরি―সুলতানা কামাল।
১৩. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা―লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি।
১৪. একাত্তরের ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা-মোহাম্মদ শাহজাহান।
১৫. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান―সম্পাদনা ড. শাহাদাত হোসেন।
১৬. মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনি―অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী।
১৭. ঝযবরশয গঁলরন’ং ঘরহব গড়হঃযং ওহ চধশরংঃধহ চৎরংড়হ―ইষড়ড়ফ ইবধঃবহ ঞৎধপশ–অযসবফ ঝধষরস
১৮. সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা―বাংলাদেশের সচিত্র ইতিহাস (১২০৪-১৯৭১)
১৯. দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ―অ্যান্থনী মাসকারেনহাস।
২০. বাংলাদেশ-রক্তের ঋণ―অ্যান্থনী মাসকারেনহাস।
২১. দি ইস্ট পাকিস্তান ট্রাজেডি―এল. রাশব্র“ক উইলিয়ামস।
২২. হক-ভাসানীÑসোহরাওয়ার্দী-মুজিব―রামেন্দ্র চৌধুরী।
২৩. রক্তের বদলে―মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম।
২৪. ১৫ আগস্ট মর্মন্তুদ মৃত্যুচিন্তা―সম্পাদনা আহম্মেদ ফিরোজ।
২৫. বাংলাদেশ-জয় পরাজয়ের রাজনীতি (১৯৫৪-১৯৮৩)―সরদার আমজাদ হোসেন।
২৬. বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা―এডভোকেট চিত্ত রঞ্জন দত্ত
২৭. মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১―মুনতাসীর মামুন।
২৮. বাংলার বিদ্রোহ (১৯৪৭Ñ১৯৭১)―হোসেন উদ্দীন হোসেন
২৯. চলি¬শ থেকে একাত্তর―এম আর আখতার মুকুল।
৩০. দাঙ্গার ইতিহাস―শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩১. অ এষড়নধষ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঞযব ঈৎবধঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধফবংয– ঝৎরহধঃয জধমযধাধহ.
৩২. গুঃয ভধপঃং-ইধহমষধফবংয খরনবৎধঃরড়হ ডধৎ―ঐড়ি ওহফরধ, টঝ, ঈযরহধ ধহফ ঃযব টঝঝজ ঝযধঢ়বফ ঃযব ড়ঁঃপড়সব–ই ত কযধংৎঁ.
৩৩. মুজিবুরের রচনা সংগ্রহ―শেখ মুজিবুর রহমান।
৩৪. উরারফব ধহফ ছঁরঃব–চবহফবৎবষ গড়ড়হ.
৩৫. ঝঁৎৎবহফবৎ ধঃ উধপপধ–ইরৎঃয ড়ভ ধ ঘধঃরড়হ–খঃ. এবহ. ঔঋজ ঔধপড়ন.
৩৬. ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ–ঝরফফরশ ঝধষরশ.
৩৭. ঞড়ধিৎফং ওহফরধ’ং ঋৎববফড়স ধহফ চধৎঃরঃরড়হ―ঝ. জ. গবযবৎড়ঃৎধ.
৩৮. ঝরহপব ১৯৪৭-চধৎঃরঃরড়হ ঘধৎৎধঃরাবং নু ঃযব গরমৎধহঃং ড়ভ উবষযর–জধারহফবৎ কধঁৎ.
৩৯. বাংলাদেশের তারিখ―মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
৪০. ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের আসল চেহারা―মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন।
৪১. বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম―শেখ হাসিনা।
৪২. ঙহ ঐরংঃড়ৎু – ঊৎরপ ঐড়নংনধসি.
৪৩. অহপরবহঃ ওহফরধহ ঐরংঃড়ৎু ধহফ ঈরারষ খরমধঃরধ – ঝ ঘ ঝবহ.
৪৪. শত মনীষীর জীবনী―ড. হুমায়ুন কবীর।
৪৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান―জীবন ও রাজনীতি-(১ম ও ২য় খণ্ড) সম্পাদকÑমোনায়েম সরকার
৪৬. বাঙলা ভাগ হলো―হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ বিভাগ (১৯৩২Ñ ১৯৪৭)-জয়া চ্যাটার্জী
৪৭. গৌরবের ৫৫ বছর-বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
৪৮. ভারতবর্ষের ইতিহাস (প্রাচীন যুগ) ―গোপাল চন্দ্র সিনহা।
৪৯. আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস―ড. সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও ড. সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।
৫০. বাঙালির অপর নাম শেখ মুজিবুর রহমান―সম্পাদনা রোকন জহুর।
৫১. রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দর্শন―বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।
৫২. বাংলাদেশের ইতিহাস―প্রাচীন যুগ-রমেশ চন্দ্র রায়।
৫৩. স্বাধীনতা অর্জনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-(১৮৮৫-১৯৪৭)Ñ অমলেশ ত্রিপাঠী।
৫৪. ভারত স্বাধীন হলো―মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।
৫৫. শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক―সিরাজ উদ্দিন আহ্মেদ।
৫৬. উপমহাদেশের রাজনীতি ও ব্যক্তিত্ব ―অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম।
৫৭. ঋৎববফড়স ধঃ গরফহরমযঃ―খধৎু ঈড়ষষরহং অহফ উড়সরহরয়ঁব খধঢ়রবৎৎব.
৫৮. গাজীপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস―বিলু কবীর।
৫৯. জিন্নাহ ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা―যশোবন্ত সিংহ।
৬০. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী―সিরাজ উদ্দীন আহম্মেদ।
৬১. অংংধংরহধঃরড়হ ড়ভ তরধঁৎ জধযসধহ ধহফ অভঃবৎসধঃয―তরধঁফফরহ গ. ঈযড়ফিযঁৎু.
৬২. ইধহমষধফবংয ঘধঃরড়হধষরংধস―ঐরংঃড়ৎু ড়ভ উরধষবপঃরপং ধহফ উরসবহংরড়হং ―ঝযরৎববহ ঐধংধহ ঙংসধহু.
৬৩. অহসড়ষ উরপঃরড়হধৎু ড়ভ ঐরংঃড়ৎু―ঝধঃরংয এধহলড়ড়.
৬৪. আমার রাজনীতির রূপরেখা―জিয়াউর রহমান।
৬৫. বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব)-নীহাররঞ্জন রায়।
৬৬. ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রমবিকাশÑসরল চট্টোপাধ্যায়।
৬৭. ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ঋধৎধরফর গড়াবসবহঃ―উৎ. গঁরহ-ঁফ-উরহ অযসবফ কযধহ.
৬৮. বাংলার ইতিহাস―গোলাম হোসায়ন সলীম।
৬৯. বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি-রাজনীতি―সুনীতি কুমার ঘোষ।
৭০. ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন―মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক।
৭১. ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি―তারাপদ লাহিড়ী।
৭২. জিন্না/পাকিস্তান-নতুন ভাষা―শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
৭৩. মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-(জাতীয়তাবাদের সন্ধানে)―শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
৭৪. স¦াধীনতার মুখ―অমলেশ ত্রিপাঠী।
৭৫. ঞযব গুঃয ড়ভ ওহফবঢ়বফবহপব–তঁষভরশধৎ অষর ইযঁঃঃড়.
৭৬. ঔরহহধয–ঈৎবধঃড়ৎ ড়ভ চধশরংঃধহ–ঐবপঃড়ৎ ইড়ষরঃযড়.
৭৭. গ অ ঔরহহধয-ঠরবংি ধহফ জবারবংি―গ. জ. কধুরসর.
৭৮. ঞযব ইধহমষধফবংয গরষরঃধৎু ঈড়ঁঢ় ধহফ ঃযব ঈওঅ খরহশ– ই ত কযধংৎঁ.
৭৯. ঞযব ইষড়ড়ফ ঞবষবমৎধস–ওহফরধহং ঝবপৎবঃ ডধৎ রহ ঊধংঃ চধশরংঃধহ–এধৎু ঔ. ইধংং.
৮০. মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস-বাঙালির ইতিহাস―এস এম আজিজুল হক শাহজাহান।
৮১. চধশরংঃধহ ঝঃঁফরবং―গ জ কধুরসর.
৮২. ঔরহহধয, চধশরংঃধহ ধহফ ওংষধসরপ ওফবহঃরঃু–ঞযব ঝবধৎপয ভড়ৎ ঝধষধফরহ–গ জ কধুরসর.
৮৩. ঞযব খধংঃ ফধুং ড়ভ টহরঃবফ চধশরংঃধহ–এ গ ঈযড়ঁফযঁৎু.
৮৪. এ স্ট্রেন্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি-ইস্ট পাকিস্তান (১৯৬৯-১৯৭১)।
৮৫. ঞযব ঝবঢ়বৎধঃরড়হ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ―ঞযব জরংব ড়ভ ইধহমধষর গঁংষরস ঘধঃরড়হধষরংস–ঐধংধহ তধযববৎ.
৮৬. আমার একাত্তর―আনিসুজ্জামান
৮৭. ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরন–অ খবধফবৎ রিঃয ধ উরভভবৎবহপব-ঙনধরফঁষ ঐধয়.
৮৮. রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং তাতে কি ছিল―আব্দুল মতিন।
৮৯. ঘধঃরড়হধষরংহ, ঋঁহফধসবহঃধষরংস ধহফ উবসড়পৎধপু রহ ইধহমষধফবংয -ই ক ঔধযধহমরৎ.
৯০. ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ―বদরুদ্দীন ওমর।
৯১. ঝঢ়ড়ঃষরমযঃ ড়হ ইধহমষধফবংয–ঊফরঃবফ নু এ ঝ চড়যবশধৎ
৯২. অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা―মেজর (অব.) এম এ জলিল।
৯৩. ইধহমষধফবংয ভৎড়স গঁলরন ঃড় ঊৎংযধফ―অহ ওহঃবৎঢ়ৎবঃরাব ঝঃঁফু–খধৎিবহপব তরৎরহম.
৯৪. একাত্তরের দিনগুলি―জাহানারা ইমাম।
৯৫. চড়ষরঃরপং ধহফ ঝবপঁৎরঃু ড়ভ ইধহমষধফবংয–ঞধষঁশফধৎ গধহরৎুুঁধসধহ.
৯৬. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব―বাঙালি জাতীয়তাবাদ―কবীর চৌধুরী।
৯৭. ভারতে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার ইতিবৃত্ত―ধীরেন বন্দ্যোপাধ্যায়।
৯৮. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর―আবুল মনসুর আহমেদ।
৯৯. দুঃশাসনে বন্দি স্বদেশ―মারুফ কালাম খান।
১০০. ভারতবর্ষের ইতিহাস―রোমিলা থাপার।
১০১. বাঙলার ইতিহাস―চার্লস স্টুয়ার্ট―অনুবাদ-আবু জাফর।
১০২. নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া―সৈয়দ আবদাল আহমেদ।
১০৩. ইবমঁস কযধষবফধ তরধ ড়ভ ইধহমষধফবংয―ঝ অনফঁষ ঐধশরস.
১০৪. বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস―ফজলুল কাদের কাদেরী।
১০৫. ইধহমষধফবংয ঊসবৎমবৎপু ধহফ ঃযব অভঃবৎসধঃয–২০০৭-২০০৮–গড়ঁফঁফ অযসবফ.
১০৬. ঝযবরশয গঁলরন –ঞৎরঁসঢ়য ধহফ ঞৎধমবফু–ঝ অ কধৎরস.
১০৭. দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানÑলে. জে. এ এ কে নিয়াজি।
১০৮. ইধহমষধফবংয ধহফ চধশরংঃধহ–ঋষরৎঃরহম রিঃয ঋধরষঁৎবং রহ ঝড়ঁঃয অংরধ–ডরষষরধস ই গরষধস.
১০৯. ঞযব ঈৎঁবষ ইরৎঃয ড়ভ ইধহমষধফবংয–গবসড়ৎরবং ড়ভ ধহ অসবৎরপধহ উরঢ়ষড়সধঃ–অৎপযবৎ ক ইষড়ড়ফ.
ওমর খালেদ রুমির প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ :
উপন্যাস
১. নীতুর চোখে জল
২. স্বপ্নের উল্টো পিঠ
৩. আমার অমৃত সত্তা
৪. সেলফি
৫. কষ্টের ক্যাম্পাস
৬. আশায় তুমি নিরাশায়ও তুমি
৭. ভালোবাসা ভালো নয়
৮. জোনাকির গল্প
৯. দ্য আদার সাইড অব ড্রিমস
কবিতা
১. নির্বাসনে প্রেম
২. কাগজ ছেঁড়ার খেলা
৩. কালার অব রোজ
৪. হেলেনের কবিতার খাতা
৫. কাচঘরে আমি
৬. অলৌকিক দহন
৭. একদিন প্রেম এসে হঠাৎ দরোজায় কড়া নেড়েছিল
৮. তারার নিচে হাঁটাহাঁটি
৯. তোমার আয়নায় আমার মুখ
১০. নাজুক প্রেমের পদ্য
১১. এই প্রেম তোমার আমার
১২. এ সময়ের প্রেমের কবিতা
১৩. কেউ নেয়নি আমায় জলের কাছে
১৪. পোয়েমস অব লাভ অ্যান্ড লাইফ
ছোটগল্প
১. সোনালি দিনের সোনালি বালিকারা
২. হেলেনকে আমি ভালোবেসেছিলাম
৩. জলমহল অ্যান্ড আদার স্টোরিস
৪. সে আসবে
৫. কৃষ্ণচূড়া ও অন্যান্য প্রেমের গল্প
৬. কুয়াশার কাফন
৭. সুকান্তর হাতে তিনটি গোলাপ
৮. হারানো চাবিওয়ালা
৯. এই শহরে তোমার কখনও প্রেম হয়নি
১০. শতাব্দীর সৌরভ
১১. স্টোরী অব এন ইভিনিং
১২. জ্যোৎস্না ও জনকের গল্প
১৩. কারবালাÑ২০১৬
রাজনৈতিক
১. দ্য হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান মুসলিমস
২. স্বাধীনতা একদিনে আসেনি
৩. বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
৪. জনগণের নয়নের মনি জননেত্রী শেখ হাসিনা
৫. আমাদের আগামীর নেতা সজিব ওয়াজেদ জয়
৬. বাংলার রাজনীতির সেকাল একাল
৭. স্বাধীনতার ৪৪ বছর : ফিরে দেখা বাংলাদেশ
৮. পলিটিক্যাল এসেস অন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ
৯. রক্তে কেনা বাংলাদেশ
১০. মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র
১১. তাত্তি¡ক বিশ্লেষণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম
১২. সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স
১৩. বাংলাদেশ কোন পথে
১৪. কুয়াশার কাফন
১৫. বিষয় যখন স্বাধীনতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ
১৬. বুকপকেটের আততায়ী ও অন্যান্য রাজনৈতিক প্রবন্ধ
১৭. ভারতীয় উপমহাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদের উত্থান
১৮. ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান
ব্যাংকিং
১. মোডস অব ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ইটস কোয়ালিটি
২. গল্পে গল্পে ব্যাংকিং
৩. জেনারেল ব্যাংকিং গ্লোসারী
৪. ইসলামিক ব্যাংকিং গ্লোসারী
৫. এ টু জেড ব্যাংকিং গ্লোসারী ফর অল
৬. ইস্যুস অফ ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং
৭. ইসলামিক ব্যাংকিং একোর্ডিং টু মাকাসিদ আল শরিয়াহ্
অনুবাদ
১. সফল ম্যানেজার
২. আমার বিষণœ প্রেয়সীদের গল্প
৩. দ্যা গ্রেট গ্যাটস্বি
অন্যান্য
১. আমার যত প্রেম
২. ফিফটি বুকস দ্যাট চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড
ওমর খালেদ রুমি
ওমর খালেদ রুমির জন্ম ১০ই জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে। তার পিতা মরহুম মোহাম্মদ আইয়ুব আলী হাওলাদার এবং মাতা মরহুমা রহিমা খাতুন। শিক্ষক পিতা এবং গৃহিণী মাতার নবম সন্তান তিনি। তার জন্মস্থান পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানি উপজেলা। গ্রামেই তার শৈশব কেটেছে। খেজুরতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮৩ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ইন্দুরকানী মেহেউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৯ সালে মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে কেন্দ্রে প্রথম হন। বাগেরহাট সরকারী পি, সি, কলেজ থেকে ১৯৯১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ (১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত) সালে পরিসংখ্যানে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৯৭ (১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত) সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে ফাইন্যান্সে ৪ এর মধ্যে ৩.২৫ সিজিপিএ লাভ করে ইএমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৭ সালে সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে ২০০৯ সলে ঢাকা বারের সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ২২তম এবং ২৪তম বিসিএস-এ জেনারেল ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বর্তমানে এক্সিম ব্যাংকে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত আছেন।
তার স্ত্রী শামিমা আক্তার শিউলি প্রাইম ব্যাংকে কর্মরত আছেন। নুবা এবং উমায়না নামে তাদের দুটি কণ্যা সন্তান আছে।
২০০১ সালে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার পর একে একে প্রায় শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
ওমর খালেদ রুমির প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে উপন্যাসÑনীতুর চোখে জল, স্বপ্নের উল্টো পিঠ, আমার অমৃত সত্তা, সেলফি, কষ্টের ক্যাম্পাস, আশায় তুমি নিরাশায়ও তুমি, ভালোবাসা ভালো নয়, জোনাকির গল্প, দ্য আদার সাইড অব ড্রিমস;
কবিতাÑনির্বাসনে প্রেম, কাগজ ছেঁড়ার খেলা, কালার অব রোজ, হেলেনের কবিতার খাতা, কাচঘরে আমি, অলৌকিক দহন, একদিন প্রেম এসে হঠাৎ দরোজায় কড়া নেড়েছিল, তারার নিচে হাঁটাহাঁটি, তোমার আয়নায় আমার মুখ, নাজুক প্রেমের পদ্য, এই প্রেম তোমার আমার, এ সময়ের প্রেমের কবিতা, কেউ নেয়নি আমায় জলের কাছে, পোয়েমস অব লাভ এন্ড লাইফ, মায়াবী হরিণ, বিষ কবিতা; চলো যাই নির্বাসনে, এপার বাংলা ওপার বাংলা (সম্পাদনা), প্রিয় কবির প্রিয় কবিতা (সম্পাদনা);
ছোটগল্পÑসোনালি দিনের সোনালি বালিকারা, হেলেনকে আমি ভালোবেসেছিলাম, জলমহল এন্ড আদার স্টোরিস, সে আসবে, কৃষ্ণচূড়া ও অন্যান্য প্রেমের গল্প, কুয়াশার কাফন, সুকান্তর হাতে তিনটি গোলাপ, হারানো চাবিওয়ালা, এই শহরে তোমার কখনও প্রেম হয়নি, শতাব্দীর সৌরভ, স্টোরী অব এন ইভিনিং, জ্যোৎস্না ও জনকের গল্প, কারবালাÑ ২০১৬;
রাজনৈতিকÑযে বিজয় জনতার, দ্য হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান মুসলিমস, স্বাধীনতা একদিনে আসেনি, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, জনগণের নয়নের মনি জননেত্রী শেখ হাসিনা, আমাদের আগামীর নেতা সজিব ওয়াজেদ জয়, বাংলার রাজনীতির সেকাল একাল, স্বাধীনতার ৪৮ বছর ঃ ফিরে দেখা বাংলাদেশ, পলিটিক্যাল এসেস অন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান এন্ড বাংলাদেশ, রক্তে কেনা বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, তাত্তি¡ক বিশ্লেষণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স, বাংলাদেশ কোন পথে, কুয়াশার কাফন, বিষয় যখন স্বাধীনতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, বুকপকেটের আততায়ী ও অন্যান্য রাজনৈতিক প্রবন্ধ, ভারতীয় উপমহাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদের উত্থান, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম;
ব্যাংকিংÑমোডস অব ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট এন্ড ইটস কোয়ালিটি, গল্পে গল্পে ব্যাংকিং, জেনারেল ব্যাংকিং গ্লোসারী, ইসলামিক ব্যাংকিং গ্লোসারী, এ টু জেড ব্যাংকিং গ্লোসারী ফর অল, ইস্যুস অফ ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, ইসলামিক ব্যাংকিং একোর্ডিং টু মাকাসিদ আল শরিয়াহ্;
প্রবন্ধÑকবি ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ (সম্পাদনা);
অনুবাদÑসফল ম্যানেজার, আমার বিষণœ প্রেয়সীদের গল্প, দ্যা গ্রেট গ্যাটস্বি;
ইসলামিকÑছড়ায় ছড়ায় চলিশ হাদীস, ছোটদের বিশ্বনবী, আল কোরআনে বর্ণিত নবীদের কাহিনি, আল কোরআনের জীবনঘনিষ্ঠ আয়াতসমূহ, আলাহর নিরানব্বই নাম ও তার ফজিলত, নামাজের গুরুত্বপূর্ণ মাসালাসমূহ;
অন্যান্যÑআমার যত প্রেম, ফিফটি বুকস দ্যাট চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড ইত্যাদি।
প্রখ্যাত চারণ সাংবাদিক কাজী রফিকুল ইসলাম তার জীবন ও কর্মের উপর “প্রিয় কবি ওমর খালেদ রুমি” শিরোনামে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন।
Comments
Post a Comment