What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।
ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে যেমন কারো কবিকৃতি তৈরি হয় না, তেমনি কবিতাপাঠের মধ্যে দিয়েও আমরা ইতিহাস খুঁজতে যাই না। অথচ কবিতা পড়তে গিয়ে ইতিহাসের কতো ছোটো ঘটনা, চরিত্র ও সম্পর্ক অন্যমাত্রায় নতুন করে হাজির হয় আমাদের চোখের সামনে। কেউ কেউ একথাও বলে থাকেন যে অতীতের প্রতি কল্পনাপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গিই কাবে আধুনিকতার চরিত্রনির্ণয়ে সহায়ক হতে পারে।
ইতিহাসের গুরুত্ব বোঝাতে একথা বলা হয়েছে যে যদি প্রকৃতি সৃষ্টি করে থাকেন ঈশ্বর, তবে মানুষ রচনা করেছে ইতিহাস। একারণে ইতিহাসই মানুষের প্রকৃত চর্চার বিষয় হতে পারে। কবিতার মতোই মানুষের ইতিহাসের মধ্যে পুরোনো ও আদিম শক্তিই হল কল্পনা। ইতিহাসের গতি বিবর্তনের - দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েনর। এই গতিপথের বিশ্লেষণে পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে বিচিত্র তত্ত্বকথা ও ভাবনাচিন্তার সূত্র। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির তত্ত্ব আবেগগত কারণে এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল যে প্রাচ্য ও পাশ্চত্য নির্বিশেষে মানুষকে অস্তিত্বের চক্র থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হয়েছে। আর তা থেকে কতো ধর্মকথাই না তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, মার্কসবাদও সমাজ ও ইতিহাসের বিবর্তন ও তার চরিত্র বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কেউ পুনরাবর্তনে বিশ্বাসী, কেউ ডায়ালেকটিক মেটিরিয়ালিজম-এ। টি এস এলিয়টের মতো কবি আবার আশ্রয় খুঁজেছেন খ্রীষ্টিয় ধারণার ঐতিহ্যচেতনায়।
বলা হয়ে থাকে যে উনিশ শতকের ইংরেজি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল রোমান্টিক কবিদের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থেকে। ফরাসি বিপ্লবের পটভূমিতে এই কবিদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্সক্ষা রোমান্টিককাব্য আন্দোলনকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। কবিতায় জুগিয়েছে অদম্য শক্তি। যে শক্তি সাহায্য করেছে প্রকৃতির রহস্যময়তা খুঁজতে, মানবমনের জটিলতা পড়তেও বর্হিজগতকে ব্যাখ্যা করতে। পক্ষান্তরে, ভিক্টোরীয় কবিরা ইতিহাসের মধ্যে, ক্লাসিক কাহিনী ও আর্থারীয় রোমান্সের মধ্যে এত বেশি আত্মমগ্ন থেকেছেন যে বর্তমান থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। তবে আধুনিকদের মধ্যে এলিয়ট-ই প্রথম কবি যিনি জীবনের সবকিছুকে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে দেখতে চাননি। অবশ্য দর্শনের ও আন্দোলনের বিস্তার নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে, কিন্তু কিয়ের্কেগার্দ-ই প্রথম অস্তিত্ববাদী যিনি বললেন যে আমাদের জগৎ শুধু প্রবণতা ও চিন্তার জগৎ নয়, এ জগৎ মানুষের অস্তিত্বের রহস্যময়তা, উদ্বেগ ও ভীতিসহ ব্যক্তিমানুষেরও। বিশ্বাসের এক অজানা দিকে সে হাত বাড়ায়, কেননা সে উদ্বিগ্ন ও জীবনের রহস্য কুজঝটিকা বিদীর্ণ করতে ব্যর্থ প্রায়শই। ইতিহাস এক অর্থে তাই অপ্রাসঙ্গিকও। ‘বিচার’ ও ‘দুর্গ’ রচয়িতা কাফকায় এই অমোঘ ভাবনার লক্ষণগুলিই প্রস্ফুটিত হয়েছে।
ইতিহাসকে একমাত্র বিশ্লেষণাত্মক শক্তি হিসেবে না দেখার এই প্রবণতা যেমন সত্যি, তেমনি একথাও সত্যি যে আধুনিক সময়ের দুযের্যাগময় অস্থির সময়ে ইতিহাসচেতনার এজরা পাউন্ড প্রমুখ কবিদের মনে করিয়ে দিয়েছে ইতিহাসের সফলতার চিহ্নগুলোকে, সভ্যতার ‘হেরিটেজ’কে।
২
আর রবীন্দ্রনাথ? ভারতবর্ষের প্রাচীন গৌরবগাথাকে যিনি বারবার পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখেন, তাকে পুনরুজ্জীবনের সাধনায় যিনি আন্তরিক, তিনি ইতিহাসের প্রতি মোহবিষ্ট হবেন, এ তো স্বাভাবিক। কাব্যজগতের দিক থেকেও তিনি রোমান্টিকদের সমগোত্রীয়। উপনিষদের যুগ ও তার তপোবনের রূপ তাঁর কবিতায় দ্বিতীয় বিগ্রহ ধরে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে। রোমান্টিকদের মতোই তিনি বলেন-
আমি যদি জন্ম নিতেম
কালিদাসের কালে
কিংবা
দূরে বহু দূরে
স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনী পুরে
খুঁজিতে গেছিনু যবে শিপ্রা নদী পারে
মোর পুর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়ারে।
বৌদ্ধকাহিনীর উপস্থাপনায় ইতিহাস পুষ্পিত হয়ে উঠেছে তাঁর মানবিকতার ভাবনায়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের শিখ মারাঠা ও রাজপুতদের অনেক গৌরবের কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। শিবাজী ও গুরু গোবিন্দের ইতিহাসবিধৃত কাহিনিকে তিনি তাঁর কল্পনার স্পর্শে আমাদের কাছে স্মরণীয় করে রেখেছেন। বরণীয় করেছেন সিপাহি বিপ্লবের ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইকে। আর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় তিনি নির্ণিত করেছেন ভারতইতিহাসের মর্মকথা। শুধু ইতিহাসের কাহিনি নয়, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অতীত থেকে পৌঁছে গেছে আবহমানের কাছে। অনাদিকাল হয়েছে নিত্যকাল। অনন্ত সময়ের কবিতা- গানই লিখেছেন তিনি। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব যেন একাকার এই বিশাল কবিপ্রতিভার ভাবনায়। তাঁর প্রেমের অনুভূতিও নিত্যকালের :
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের ¯্রােতে
অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে। ক
ইতিহাস একইভাবে উঠে এসেছে এলিয়টের কবিতায় তার প্রবহমান সময়চেতনার ঐতিহ্যে। তিনি বললেন :
Time present and time past
Are both present in time future,
And time future contained in time past
এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন উইন্ডহ্যাম লুইস। তিনি বলেছেন- কবির অভিজ্ঞতা is deeper than civilisation and he only uses the phenomenon of civilisation in expressing it; আর বাংলাভাষী কবি জীবননানন্দ বললেন:
১. কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থি-র ভিতর থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।
২. দেশকাল সন্ততি (আজ পর্যন্ত মানুষের ধারণার তাদের যে রূপ আমরা পাই সেই রূপ) যে কোনো যুগের প্রাণবস্তু বলে পরিগণিত হবার সুযোগ লাভ করেছে, সে কবিতা আধুনিক।
লক্ষণীয়, তিনি শুধু ইতিহাসচেতনার কথাই বলেননি, তাকে আধুনিক কাব্যের সঙ্গেও সম্পর্কিত করে দেখালেন। এই ইতিহাস ও কালজ্ঞান একজন আধুনিক সময়ের কবির কাছে শুধু বস্তুনিষ্ঠ বা শারীরিক নয়। সময় ও সভ্যতার বিবর্তন তাকে অন্য এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে, আর ইতিহাসজ্ঞানও ক্রমশ কালরিপেক্ষ হয়ে ওঠে।
৩
মার্কসবাদে আস্থাশীল কবিরা ভেবেছেন যে খন্ড অস্তিত্বের সমস্যা ব্যক্তিগত নয়, তা সমাজ ও ইতিহাস সংশ্লিষ্ট। বিষ্ণু দে-র কবিতার সময় আসে তাঁর দ্বান্দ্বিক চিন্তার অভিঘাতে, শ্রেণির সীমা ভাঙার ইচ্ছায়, এবং নিজ শ্রেণির ইতিহাসের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে তিনি লেখেন-
মনে হয় চলে গেছি অথবা এসেছি
ঘরমুখো টানে সেই কালে,
যেখানে সমস্ত আণবিক অতীতের স্বপ্ন মিশে যায়,
সেই দেশে যেদেশে সন্তত এ দেশের পৃথিবীর
দীর্ঘ ইতিহাস
আমাদের হৃদয়ের গ্রানিটে যে গান
ইতিহাস গড়েছে ভাস্কর সত্তায় সত্তায় মানবিক
সংলগ্ন অথচ অন্তহীন আমাদের ভবিষ্যতে।
অতীতের স্মৃতি ও স্বপ্ন ভবিষ্যতের মধ্যে নতুন সত্তায় মিশে যায়। এ কল্পনা ভবিষ্যৎমুখী। এই সময়চেতনা জীবনানন্দের নয়। বিষ্ণু দে-র মতো তিনি কখনও বলবেন না ‘সময়ের থলি শতছিদ্র বিস্মৃতিকীট কাটে’। কারণ তাঁর ইতিহাস ছুঁয়ে থাকে প্রবহমান সময়কে, যেখানে তিনি হাজার হাজার বছর ধরে হেঁটে যেতে পারেন। ঝরাপালক কাব্যগ্রন্থের ‘অস্তচাঁদে’ করিতাটি লক্ষ করি। যেখানে কবি ত্রুবাদুর কবি ফ্রান্সের প্রভঁস প্রান্তরে থাকেন, কখনও স্পেনের অশ্বারোহী সদ্যু, কখনও ব্যাবিলন মিশরের মরুভূমিতে, পিরামিডতলে, কখনও বাংলাদেশের কদমতলার শিখীচূড়াধারী বাঁশিবাজানো প্রেমিক- এমনভাবেই রূপান্তর ঘটিয়েছেন কবি। এসবই অতীতের সঙ্গে কবির সম্পর্করক্ষঅর সূত্র। কেননা আধুনিক মানুষ তো এইসব অতীতের থেকে অনেক অনেক দূরে, কোনোভাবেই মেলানো যায় না। আর অতীতও শুরু হয়েছে মানবসভ্যতার সেই আদিকাল থেকে। যে অখন্ড সময়জ্ঞান ও ইতিহাসচেতনা জীবনান্দকে আধুনিক করেছে, তার জন্যই তিনি লিখতে পারেন-
বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার
ব্যস্ত বছরের পর
(পথ হাঁটা, বনলতা সেন)
ওই সময়চেতনাকে সঞ্চয় ভট্টাচার্য বলেছেন রিলকেসদৃশ। কারণ জার্মান কবি রিলকেও সময় সম্পর্ক এমন ধারণাই ব্যক্ত করেছেন-
We, of this earth and this today, are
not for a moment hedged in by the world
of time, not bound within it we are
incessantly flowing over and over to these
who preceded us and to those who
apparently come after us.
‘কবিতার কথা’-য় জীবনানন্দও বলেছেন তাঁর এই সময়চেতনার কথা :
সবই আছে সব সময়ের ভিতরে প্রতিফলিত হয়ে-
আজ কাল সব সময়েরই একটা একটা রঙ রয়েছে
নানা রঙের ভিতর বিম্বিত হয়ে- সব সময়কে
একই সময়গ্রন্থির ভিতর নিবিষ্ট করে রেখে-
‘মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে সময়চেতনা’ কবিকে অতীত ইতিহাসের অংশীদার করেছে। বস্তুত, এ-পরিক্রমণ কোনো ব্যক্তির নয়, মানবসভ্যতার। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি এই বিশ্বপরিক্রমণের মানবিক ইতিহাস হয়ে থেকেছে। মহাসময়ের সঙ্গে যে মহাজীবনের অনুভব কবির মনে ধরা দেয়, তার প্রেক্ষিতেই বর্তমান জীবনকে এমনভাবে দেখতে পারেন তিনি। এই কবিতায় অতীত ইতিহাসের অন্ধকার, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগৎ আছে, আছে ভবিষ্যতের অন্ধকারও, তবু তার মতে দুদন্ডের শান্তির ব্যবস্থাও বর্তমান। ইতিহাসের অতীতের জীবনবোধ কবি বহন করেছেন বলেই নাটোরের বনলতা সেনের মুখে তার চিহ্ন: ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য।’ মানবজীবনের ওপর ইতিহাসচেতনা আরোপের ফলেই এই যাত্রা একক মানুষের না হয়ে মানবের অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিষ্ণু দে-র কবিতায় সময় এসেছে দ্বান্দ্বিক চিন্তার অবয়বে। শ্রেণির সীমানা ভাঙতে চান, অথচ তা চ৮ান নিজ শ্রেণির ইতিহাসের মধ্যে সংলগ্ন থেকে। অত্যন্ত আত্মসচেতন কবি বলেই তাঁর অতীত দীর্ঘশ্বাসের আর ভবিষ্যৎ প্রগতির। জীবনানন্দ ইতিহাসের ক্রমাপ্রসর প্রগতিতে অবশ্য বিশ্বাসী নন, তাঁর বিচারে সে পুনরাবৃত্তময়, ঈুপরপধষ, ‘চক্রচর,’ ‘চক্রাকারে ঘোরা কাল’ (মহাপৃথিবী)। কবি ডব্লিউ-বি-ইয়েটস্-এরও এমন ধারণা ছিল। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন-
‘সময়ের শতকের মৃত্যু’ ‘অতীত থেকে উঠে এসে
তুমি আমি ওরা’র ‘নব পৃথিবীর দিকে’ যাত্রা
‘মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করা হবে/
জেনে তবু পৃখিবীর মৃত সভ্যতায়’ ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গ
আধুনিক একায়তনিক ইতিহাসবিশ্বাসের মতো।
(ভূমিকা, জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ)
‘সময়ের শতেক মৃত্যু’র কথা বলেও পুনরায় ‘অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগা’-র কথা বলেও বলেছেন জীবনানন্দ। আবহমান নৌশক্তি বিস্তারের ইতিহাসসূত্র উল্লেখ করে বলেছেন সেই অনুবর্তনের কথা-আর্গোনটদের কাহিনিপুরাণ, প্রতœ মিনোয়ান সভ্যতার কাল থেকে দ্বীপমালা অধ্যুষিত ঈজিয়ান সাগর পারাপার করা স্মৃতি, অসংখ্য রলতরীর কৃষœসাগরের বুকে ভেসে যাওয়া, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ফিনিশীদের টায়ার থেকে কার্থেজে নতুন নগর নির্মাণ সবই ইতিহাস-ধারণা সঞ্জাত। সময়ের এই অনুবর্তনেই লুকিয়ে আছে আবহমানের প্রাণবীজ, এ ধারণা জীবনানন্দেব:
সবিতা, মানুষজন্ম আমারা পেয়েছি
মনে হয় কোনো বসন্তের রাতে:
ভুমধ্যসাগর ঘিরে যেরে যেই সব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন
কিংবা
মানুষের বরাবর পৃথিবীর আয়ুতে জন্মছে
নবনব ইতিহাস-সৈকতে ভিড়েছে......
তবু সন্ধিগ্ধ মনের প্রশ্ন উসেন্ধিগ্ধ মনের প্রশ্ন উঠে আসে একে একে: তবুও কোথাও নেই সেই অনিবর্চনীয় স্বপ্নের সলফতা-নবীনতা, শুভ্র মানসিকতার ভোর?
প্রত্যাশা জাগে কবির, কেননা তিনি লক্ষ করেন- ‘ইতিহাসের ব্যাপক অবসাদের সময় এখন, তবু নরনারীদের ভিড়।’ একদিকে মৃত্যুর বিষণœতা, অন্যদিকে ভোরের জেগেওঠা- এই বিপরীতধর্মিতা ইতিহাসসঞ্জাত, তাই কবি এদের সংযোগ ঘটান ‘তবুও’ ‘যদিও’, ‘হয়তো’ শব্দের সহযোগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইতিহাস কোনো সুখের নিগড় ছিলনা, তাই আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব ও দ্বিধার ভিতর দিয়েই তিনি লালন করে চলেন ইতিহাসচক্রের পুনঃপ্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা। তাই পুনরাবৃত্তি নকশার মতো তাঁর কবিতায় আসে নাবিকবৃত্তি।
বস্তুত, ‘বনলতা সেন’ থেকে ‘সাতটি তারার তিমির’ পর্যন্ত অনেক শতাব্দীর নাবিকী ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়ের ওপরই নির্মিত জীবনানন্দের কবিতা।
হে নাবিক, হে নাবিক, কোথায় তোমার যাত্রা সূর্যকে লক্ষ্য করে শুধু?
বেবিলন, নিনেভে, মিশর, চীন, উরের আরসী থেকে ফেঁসে
অন্য এক সমুদ্রের দিকে চলে যায়.........
আরো দূরচক্রবাল হৃদয়ে পাবার
প্রয়োজন রয়ে গেছে।
(‘নাবিক’, সাতটি তারার তিমির)
খন্ডিত ইতিহাসের বিবর্ণ ছবিতে আচ্ছন্ন সাতটি তারার তিমির-এর কবিতা- বিশ্বাসের তীর ক্রমেই ছোটো হয়ে আসে, তবুও ‘নক্ষত্রের জ্যোৎ¯œা’র মতো কোনো স্থির পশ্চাৎভূমি চোখে পড়ে। ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ আগের কাব্যগ্রন্থের নৈরাশ্য বহন করেও উত্তরণকামী। এর মূল বিষয় সময় ও সমাজ ব্যক্তি ও সমষ্টির প্রেক্ষিতে বিধৃত। জীবনে পারিপার্শ্বিক অন্ধকারে রাহুগ্রস্ত, কবিকে তখন ইতিহাসচেতনার পুনরাবিস্কারে গিয়ে শ্বাস নিতে হয়:
ইতিহাসের সমস্ত রাত মিশে গিয়ে একটি রাত্রি আজ পৃথিবীর তীরে;
কথা ভাবায়, ভ্রান্তি ভাঙ্গে, ক্রমেই বীতশোক
করে দিতে পারে বুঝি মানবভাবনাকে।
(‘শতাব্দী’, বেলা অবেলা কালবেলা)
তাই আশা জাগে- ‘আজকে আলো গভীরতর হবে কি অন্ধাকের? ’ অথবা ‘এরপর আমাদের অন্তদীপ্ত হবার সময়’। এখানেই মানুষের অপরাজেয় সত্তা প্রাধান্য পেয়ে যায়। সমস্ত অনিশ্চিয়তা ও উদ্বেগ থেকে নিশ্চয়তা ও নিরুদ্বেগের বার্তা কবি পেয়ে যান তার ইতিহাসচেতনা থেকেই:
ইতিহাস খুললেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রুষার মতো শত শত
শত জল-ঝর্নার ধ্বনি
(‘হে হৃদয়’/ বেলা অবেলা কালবেলা)
ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে যেমন কারো কবিকৃতি তৈরি হয় না, তেমনি কবিতাপাঠের মধ্যে দিয়েও আমরা ইতিহাস খুঁজতে যাই না। অথচ কবিতা পড়তে গিয়ে ইতিহাসের কতো ছোটো ঘটনা, চরিত্র ও সম্পর্ক অন্যমাত্রায় নতুন করে হাজির হয় আমাদের চোখের সামনে। কেউ কেউ একথাও বলে থাকেন যে অতীতের প্রতি কল্পনাপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গিই কাবে আধুনিকতার চরিত্রনির্ণয়ে সহায়ক হতে পারে।
ইতিহাসের গুরুত্ব বোঝাতে একথা বলা হয়েছে যে যদি প্রকৃতি সৃষ্টি করে থাকেন ঈশ্বর, তবে মানুষ রচনা করেছে ইতিহাস। একারণে ইতিহাসই মানুষের প্রকৃত চর্চার বিষয় হতে পারে। কবিতার মতোই মানুষের ইতিহাসের মধ্যে পুরোনো ও আদিম শক্তিই হল কল্পনা। ইতিহাসের গতি বিবর্তনের - দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েনর। এই গতিপথের বিশ্লেষণে পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে বিচিত্র তত্ত্বকথা ও ভাবনাচিন্তার সূত্র। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির তত্ত্ব আবেগগত কারণে এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল যে প্রাচ্য ও পাশ্চত্য নির্বিশেষে মানুষকে অস্তিত্বের চক্র থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হয়েছে। আর তা থেকে কতো ধর্মকথাই না তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, মার্কসবাদও সমাজ ও ইতিহাসের বিবর্তন ও তার চরিত্র বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কেউ পুনরাবর্তনে বিশ্বাসী, কেউ ডায়ালেকটিক মেটিরিয়ালিজম-এ। টি এস এলিয়টের মতো কবি আবার আশ্রয় খুঁজেছেন খ্রীষ্টিয় ধারণার ঐতিহ্যচেতনায়।
বলা হয়ে থাকে যে উনিশ শতকের ইংরেজি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল রোমান্টিক কবিদের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থেকে। ফরাসি বিপ্লবের পটভূমিতে এই কবিদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্সক্ষা রোমান্টিককাব্য আন্দোলনকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। কবিতায় জুগিয়েছে অদম্য শক্তি। যে শক্তি সাহায্য করেছে প্রকৃতির রহস্যময়তা খুঁজতে, মানবমনের জটিলতা পড়তেও বর্হিজগতকে ব্যাখ্যা করতে। পক্ষান্তরে, ভিক্টোরীয় কবিরা ইতিহাসের মধ্যে, ক্লাসিক কাহিনী ও আর্থারীয় রোমান্সের মধ্যে এত বেশি আত্মমগ্ন থেকেছেন যে বর্তমান থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। তবে আধুনিকদের মধ্যে এলিয়ট-ই প্রথম কবি যিনি জীবনের সবকিছুকে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে দেখতে চাননি। অবশ্য দর্শনের ও আন্দোলনের বিস্তার নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে, কিন্তু কিয়ের্কেগার্দ-ই প্রথম অস্তিত্ববাদী যিনি বললেন যে আমাদের জগৎ শুধু প্রবণতা ও চিন্তার জগৎ নয়, এ জগৎ মানুষের অস্তিত্বের রহস্যময়তা, উদ্বেগ ও ভীতিসহ ব্যক্তিমানুষেরও। বিশ্বাসের এক অজানা দিকে সে হাত বাড়ায়, কেননা সে উদ্বিগ্ন ও জীবনের রহস্য কুজঝটিকা বিদীর্ণ করতে ব্যর্থ প্রায়শই। ইতিহাস এক অর্থে তাই অপ্রাসঙ্গিকও। ‘বিচার’ ও ‘দুর্গ’ রচয়িতা কাফকায় এই অমোঘ ভাবনার লক্ষণগুলিই প্রস্ফুটিত হয়েছে।
ইতিহাসকে একমাত্র বিশ্লেষণাত্মক শক্তি হিসেবে না দেখার এই প্রবণতা যেমন সত্যি, তেমনি একথাও সত্যি যে আধুনিক সময়ের দুযের্যাগময় অস্থির সময়ে ইতিহাসচেতনার এজরা পাউন্ড প্রমুখ কবিদের মনে করিয়ে দিয়েছে ইতিহাসের সফলতার চিহ্নগুলোকে, সভ্যতার ‘হেরিটেজ’কে।
২
আর রবীন্দ্রনাথ? ভারতবর্ষের প্রাচীন গৌরবগাথাকে যিনি বারবার পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখেন, তাকে পুনরুজ্জীবনের সাধনায় যিনি আন্তরিক, তিনি ইতিহাসের প্রতি মোহবিষ্ট হবেন, এ তো স্বাভাবিক। কাব্যজগতের দিক থেকেও তিনি রোমান্টিকদের সমগোত্রীয়। উপনিষদের যুগ ও তার তপোবনের রূপ তাঁর কবিতায় দ্বিতীয় বিগ্রহ ধরে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে। রোমান্টিকদের মতোই তিনি বলেন-
আমি যদি জন্ম নিতেম
কালিদাসের কালে
কিংবা
দূরে বহু দূরে
স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনী পুরে
খুঁজিতে গেছিনু যবে শিপ্রা নদী পারে
মোর পুর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়ারে।
বৌদ্ধকাহিনীর উপস্থাপনায় ইতিহাস পুষ্পিত হয়ে উঠেছে তাঁর মানবিকতার ভাবনায়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের শিখ মারাঠা ও রাজপুতদের অনেক গৌরবের কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। শিবাজী ও গুরু গোবিন্দের ইতিহাসবিধৃত কাহিনিকে তিনি তাঁর কল্পনার স্পর্শে আমাদের কাছে স্মরণীয় করে রেখেছেন। বরণীয় করেছেন সিপাহি বিপ্লবের ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইকে। আর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় তিনি নির্ণিত করেছেন ভারতইতিহাসের মর্মকথা। শুধু ইতিহাসের কাহিনি নয়, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অতীত থেকে পৌঁছে গেছে আবহমানের কাছে। অনাদিকাল হয়েছে নিত্যকাল। অনন্ত সময়ের কবিতা- গানই লিখেছেন তিনি। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব যেন একাকার এই বিশাল কবিপ্রতিভার ভাবনায়। তাঁর প্রেমের অনুভূতিও নিত্যকালের :
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের ¯্রােতে
অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে। ক
ইতিহাস একইভাবে উঠে এসেছে এলিয়টের কবিতায় তার প্রবহমান সময়চেতনার ঐতিহ্যে। তিনি বললেন :
Time present and time past
Are both present in time future,
And time future contained in time past
এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন উইন্ডহ্যাম লুইস। তিনি বলেছেন- কবির অভিজ্ঞতা is deeper than civilisation and he only uses the phenomenon of civilisation in expressing it; আর বাংলাভাষী কবি জীবননানন্দ বললেন:
১. কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থি-র ভিতর থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।
২. দেশকাল সন্ততি (আজ পর্যন্ত মানুষের ধারণার তাদের যে রূপ আমরা পাই সেই রূপ) যে কোনো যুগের প্রাণবস্তু বলে পরিগণিত হবার সুযোগ লাভ করেছে, সে কবিতা আধুনিক।
লক্ষণীয়, তিনি শুধু ইতিহাসচেতনার কথাই বলেননি, তাকে আধুনিক কাব্যের সঙ্গেও সম্পর্কিত করে দেখালেন। এই ইতিহাস ও কালজ্ঞান একজন আধুনিক সময়ের কবির কাছে শুধু বস্তুনিষ্ঠ বা শারীরিক নয়। সময় ও সভ্যতার বিবর্তন তাকে অন্য এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে, আর ইতিহাসজ্ঞানও ক্রমশ কালরিপেক্ষ হয়ে ওঠে।
৩
মার্কসবাদে আস্থাশীল কবিরা ভেবেছেন যে খন্ড অস্তিত্বের সমস্যা ব্যক্তিগত নয়, তা সমাজ ও ইতিহাস সংশ্লিষ্ট। বিষ্ণু দে-র কবিতার সময় আসে তাঁর দ্বান্দ্বিক চিন্তার অভিঘাতে, শ্রেণির সীমা ভাঙার ইচ্ছায়, এবং নিজ শ্রেণির ইতিহাসের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে তিনি লেখেন-
মনে হয় চলে গেছি অথবা এসেছি
ঘরমুখো টানে সেই কালে,
যেখানে সমস্ত আণবিক অতীতের স্বপ্ন মিশে যায়,
সেই দেশে যেদেশে সন্তত এ দেশের পৃথিবীর
দীর্ঘ ইতিহাস
আমাদের হৃদয়ের গ্রানিটে যে গান
ইতিহাস গড়েছে ভাস্কর সত্তায় সত্তায় মানবিক
সংলগ্ন অথচ অন্তহীন আমাদের ভবিষ্যতে।
অতীতের স্মৃতি ও স্বপ্ন ভবিষ্যতের মধ্যে নতুন সত্তায় মিশে যায়। এ কল্পনা ভবিষ্যৎমুখী। এই সময়চেতনা জীবনানন্দের নয়। বিষ্ণু দে-র মতো তিনি কখনও বলবেন না ‘সময়ের থলি শতছিদ্র বিস্মৃতিকীট কাটে’। কারণ তাঁর ইতিহাস ছুঁয়ে থাকে প্রবহমান সময়কে, যেখানে তিনি হাজার হাজার বছর ধরে হেঁটে যেতে পারেন। ঝরাপালক কাব্যগ্রন্থের ‘অস্তচাঁদে’ করিতাটি লক্ষ করি। যেখানে কবি ত্রুবাদুর কবি ফ্রান্সের প্রভঁস প্রান্তরে থাকেন, কখনও স্পেনের অশ্বারোহী সদ্যু, কখনও ব্যাবিলন মিশরের মরুভূমিতে, পিরামিডতলে, কখনও বাংলাদেশের কদমতলার শিখীচূড়াধারী বাঁশিবাজানো প্রেমিক- এমনভাবেই রূপান্তর ঘটিয়েছেন কবি। এসবই অতীতের সঙ্গে কবির সম্পর্করক্ষঅর সূত্র। কেননা আধুনিক মানুষ তো এইসব অতীতের থেকে অনেক অনেক দূরে, কোনোভাবেই মেলানো যায় না। আর অতীতও শুরু হয়েছে মানবসভ্যতার সেই আদিকাল থেকে। যে অখন্ড সময়জ্ঞান ও ইতিহাসচেতনা জীবনান্দকে আধুনিক করেছে, তার জন্যই তিনি লিখতে পারেন-
বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার
ব্যস্ত বছরের পর
(পথ হাঁটা, বনলতা সেন)
ওই সময়চেতনাকে সঞ্চয় ভট্টাচার্য বলেছেন রিলকেসদৃশ। কারণ জার্মান কবি রিলকেও সময় সম্পর্ক এমন ধারণাই ব্যক্ত করেছেন-
We, of this earth and this today, are
not for a moment hedged in by the world
of time, not bound within it we are
incessantly flowing over and over to these
who preceded us and to those who
apparently come after us.
‘কবিতার কথা’-য় জীবনানন্দও বলেছেন তাঁর এই সময়চেতনার কথা :
সবই আছে সব সময়ের ভিতরে প্রতিফলিত হয়ে-
আজ কাল সব সময়েরই একটা একটা রঙ রয়েছে
নানা রঙের ভিতর বিম্বিত হয়ে- সব সময়কে
একই সময়গ্রন্থির ভিতর নিবিষ্ট করে রেখে-
‘মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে সময়চেতনা’ কবিকে অতীত ইতিহাসের অংশীদার করেছে। বস্তুত, এ-পরিক্রমণ কোনো ব্যক্তির নয়, মানবসভ্যতার। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি এই বিশ্বপরিক্রমণের মানবিক ইতিহাস হয়ে থেকেছে। মহাসময়ের সঙ্গে যে মহাজীবনের অনুভব কবির মনে ধরা দেয়, তার প্রেক্ষিতেই বর্তমান জীবনকে এমনভাবে দেখতে পারেন তিনি। এই কবিতায় অতীত ইতিহাসের অন্ধকার, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগৎ আছে, আছে ভবিষ্যতের অন্ধকারও, তবু তার মতে দুদন্ডের শান্তির ব্যবস্থাও বর্তমান। ইতিহাসের অতীতের জীবনবোধ কবি বহন করেছেন বলেই নাটোরের বনলতা সেনের মুখে তার চিহ্ন: ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য।’ মানবজীবনের ওপর ইতিহাসচেতনা আরোপের ফলেই এই যাত্রা একক মানুষের না হয়ে মানবের অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিষ্ণু দে-র কবিতায় সময় এসেছে দ্বান্দ্বিক চিন্তার অবয়বে। শ্রেণির সীমানা ভাঙতে চান, অথচ তা চ৮ান নিজ শ্রেণির ইতিহাসের মধ্যে সংলগ্ন থেকে। অত্যন্ত আত্মসচেতন কবি বলেই তাঁর অতীত দীর্ঘশ্বাসের আর ভবিষ্যৎ প্রগতির। জীবনানন্দ ইতিহাসের ক্রমাপ্রসর প্রগতিতে অবশ্য বিশ্বাসী নন, তাঁর বিচারে সে পুনরাবৃত্তময়, ঈুপরপধষ, ‘চক্রচর,’ ‘চক্রাকারে ঘোরা কাল’ (মহাপৃথিবী)। কবি ডব্লিউ-বি-ইয়েটস্-এরও এমন ধারণা ছিল। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন-
‘সময়ের শতকের মৃত্যু’ ‘অতীত থেকে উঠে এসে
তুমি আমি ওরা’র ‘নব পৃথিবীর দিকে’ যাত্রা
‘মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করা হবে/
জেনে তবু পৃখিবীর মৃত সভ্যতায়’ ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গ
আধুনিক একায়তনিক ইতিহাসবিশ্বাসের মতো।
(ভূমিকা, জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ)
‘সময়ের শতেক মৃত্যু’র কথা বলেও পুনরায় ‘অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগা’-র কথা বলেও বলেছেন জীবনানন্দ। আবহমান নৌশক্তি বিস্তারের ইতিহাসসূত্র উল্লেখ করে বলেছেন সেই অনুবর্তনের কথা-আর্গোনটদের কাহিনিপুরাণ, প্রতœ মিনোয়ান সভ্যতার কাল থেকে দ্বীপমালা অধ্যুষিত ঈজিয়ান সাগর পারাপার করা স্মৃতি, অসংখ্য রলতরীর কৃষœসাগরের বুকে ভেসে যাওয়া, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ফিনিশীদের টায়ার থেকে কার্থেজে নতুন নগর নির্মাণ সবই ইতিহাস-ধারণা সঞ্জাত। সময়ের এই অনুবর্তনেই লুকিয়ে আছে আবহমানের প্রাণবীজ, এ ধারণা জীবনানন্দেব:
সবিতা, মানুষজন্ম আমারা পেয়েছি
মনে হয় কোনো বসন্তের রাতে:
ভুমধ্যসাগর ঘিরে যেরে যেই সব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন
কিংবা
মানুষের বরাবর পৃথিবীর আয়ুতে জন্মছে
নবনব ইতিহাস-সৈকতে ভিড়েছে......
তবু সন্ধিগ্ধ মনের প্রশ্ন উসেন্ধিগ্ধ মনের প্রশ্ন উঠে আসে একে একে: তবুও কোথাও নেই সেই অনিবর্চনীয় স্বপ্নের সলফতা-নবীনতা, শুভ্র মানসিকতার ভোর?
প্রত্যাশা জাগে কবির, কেননা তিনি লক্ষ করেন- ‘ইতিহাসের ব্যাপক অবসাদের সময় এখন, তবু নরনারীদের ভিড়।’ একদিকে মৃত্যুর বিষণœতা, অন্যদিকে ভোরের জেগেওঠা- এই বিপরীতধর্মিতা ইতিহাসসঞ্জাত, তাই কবি এদের সংযোগ ঘটান ‘তবুও’ ‘যদিও’, ‘হয়তো’ শব্দের সহযোগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইতিহাস কোনো সুখের নিগড় ছিলনা, তাই আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব ও দ্বিধার ভিতর দিয়েই তিনি লালন করে চলেন ইতিহাসচক্রের পুনঃপ্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা। তাই পুনরাবৃত্তি নকশার মতো তাঁর কবিতায় আসে নাবিকবৃত্তি।
বস্তুত, ‘বনলতা সেন’ থেকে ‘সাতটি তারার তিমির’ পর্যন্ত অনেক শতাব্দীর নাবিকী ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়ের ওপরই নির্মিত জীবনানন্দের কবিতা।
হে নাবিক, হে নাবিক, কোথায় তোমার যাত্রা সূর্যকে লক্ষ্য করে শুধু?
বেবিলন, নিনেভে, মিশর, চীন, উরের আরসী থেকে ফেঁসে
অন্য এক সমুদ্রের দিকে চলে যায়.........
আরো দূরচক্রবাল হৃদয়ে পাবার
প্রয়োজন রয়ে গেছে।
(‘নাবিক’, সাতটি তারার তিমির)
খন্ডিত ইতিহাসের বিবর্ণ ছবিতে আচ্ছন্ন সাতটি তারার তিমির-এর কবিতা- বিশ্বাসের তীর ক্রমেই ছোটো হয়ে আসে, তবুও ‘নক্ষত্রের জ্যোৎ¯œা’র মতো কোনো স্থির পশ্চাৎভূমি চোখে পড়ে। ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ আগের কাব্যগ্রন্থের নৈরাশ্য বহন করেও উত্তরণকামী। এর মূল বিষয় সময় ও সমাজ ব্যক্তি ও সমষ্টির প্রেক্ষিতে বিধৃত। জীবনে পারিপার্শ্বিক অন্ধকারে রাহুগ্রস্ত, কবিকে তখন ইতিহাসচেতনার পুনরাবিস্কারে গিয়ে শ্বাস নিতে হয়:
ইতিহাসের সমস্ত রাত মিশে গিয়ে একটি রাত্রি আজ পৃথিবীর তীরে;
কথা ভাবায়, ভ্রান্তি ভাঙ্গে, ক্রমেই বীতশোক
করে দিতে পারে বুঝি মানবভাবনাকে।
(‘শতাব্দী’, বেলা অবেলা কালবেলা)
তাই আশা জাগে- ‘আজকে আলো গভীরতর হবে কি অন্ধাকের? ’ অথবা ‘এরপর আমাদের অন্তদীপ্ত হবার সময়’। এখানেই মানুষের অপরাজেয় সত্তা প্রাধান্য পেয়ে যায়। সমস্ত অনিশ্চিয়তা ও উদ্বেগ থেকে নিশ্চয়তা ও নিরুদ্বেগের বার্তা কবি পেয়ে যান তার ইতিহাসচেতনা থেকেই:
ইতিহাস খুললেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রুষার মতো শত শত
শত জল-ঝর্নার ধ্বনি
(‘হে হৃদয়’/ বেলা অবেলা কালবেলা)
Comments
Post a Comment