বলা হয় ১৯৬০-১৯৭০ এই সময়কালটাতে আমাদের রাজনৈতিক জাগরণের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলো ঘটেছিলো। এর মধ্যে ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪’র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী অবস্থান, ’৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধ এবং নির্বাচন আর ’৬৬ তে এসে ছয় দফা প্রণয়ন রাজনীতিকে দারুণ মাত্রা দিয়েছিলো। ’৬৮ তে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া হলো কেউ কেউ ধরে নিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি এখানেই শেষ। কিন্তু জাতি দেখল অন্য এক ঘটনা প্রবাহ। ’৬৯’র গণ-অভ্যূত্থান যা জোয়ারের মতো স্বৈরাচারকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো অবশ্য যার সাথে আসাদ জহুরুল হক এবং জোহার রক্ত মেশানো ছিলো তবু এর তাত্তি¡ক বিশ্লেষণ এটাই প্রমাণ করে যে বাঙালি ন্যায়ের জন্যে লড়তে জানে। তারপর যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো বাঙালি রক্ত গঙ্গায় ভেসে ভেসে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছালো। যদিও পেছনে পরে রইলো ৩০ লক্ষ মৃতদেহ আর ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত। এতো অল্প সময়ে এতো প্রাণহানি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
অবাক লাগে সেই বাঙালিই স্বাধীনতা হাতের মুঠোয় পাওয়ার পর এতোটা অস্থির আর স্বার্থপর হয়ে উঠলো কেমন করে? তবে কি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ভিনদেশীদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলো বটে কিন্তু তার মহত্ব আমাদের সৎ আর দেশপ্রেমিক করে তুলতে পারেনি। নাকি স্বাধীনতায় যাদের অবদান তারা সত্যি সত্যি চুপ করে গিয়েছিলো আর এটা ছিলো তাদের মহতের লজ্জা। আর যারা সুযোগে সংগ্রামী হয়ে উঠেছিলো তারাই মাঠের দখল নিয়েছিলো।
দেশ তো মায়ের মতো। এর পরিচর্যাই সন্তানের লক্ষ্য। সেখানে দেশের কাছ থেকেই যাদের এতো প্রত্যাশা ছিলো তাদের সম্পর্কে কোন বিশেষণটা খাটে। এক কথায় এদেরকে কি বলা যায়? মনে পড়ে যায় মীর জাফর আমাদেরই পূর্বপুরুষ। এই বাংলায় তাই কিছুই অসম্ভব নয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ক্রান্তিকালে প্রয়োজন ছিলো যুদ্ধকালীন সময়ের চাইতেও বেশী ত্যাগ আর ধৈর্য্য ধারণের। কিন্তু হয়েছিলো ঠিক তার উল্টোটা। সবাই উঠে পড়ে লাগলো যার যার অংশ বুঝে নিতে। মতবাদ বাস্তবায়ন আর স্বীকৃতির মিথ্যে মরীচিকার পিছনে ছুটলো। যারা বাম ছিলো তারা রাতারাতি ধরেই নিলো তাদের ধ্যান-ধারণাই বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু আজীবনের গণতন্ত্রী মুজিব সব সময়ই চেয়েছেন গণতান্ত্রিক অর্থে সমাজতন্ত্র যা সামাজিক ন্যায় বিচারকে নিশ্চিত করবে।
একটা কথা বলে রাখতে চাই বাংলাদেশের জন্যে রাশিয়া বা চীনের কায়দায় সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়া সম্ভব ছিলো না। তবে নিপীড়িত মানুষের ভাগ্য বদলের জন্যে গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে কাক্সিক্ষত সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন তার মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বেশীরভাগ মানুষ। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, যাদের মন ছিলো না দেশের সমৃদ্ধি আর উন্নয়নের দিকে, যাদের মন ছিলো না দেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের দিকে, তারাই বিরোধী ভূমিকায় নেমেছিলো ভিন্ন মতবাদের দোহাই দিয়ে। প্রচার করা হয়েছিলো বিভ্রান্তিকর তথ্য। ছড়ানো হয়েছিলো ভারত বিদ্বেষ। জনগণকে ভুল বোঝানো হয়েছিলো।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের মানসিক অবস্থার যে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে তা কিন্তু নয়। উন্নয়নে ঝলসে যাওয়া জাতির চোখের ভেতরেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো আবার ফিরিয়ে আনার অব্যক্ত আশা নিয়ে বহু জটিলপ্রাণ মানুষ এখনও ঘাপটি মেরে আছে। তারা সুযোগ পেলেই লাফিয়ে উঠবে, ঝাপিয়ে পড়বে। স্বার্থ আর মতবাদের কাছে পৃথিবীর কোন ভালো কথা আর ভালো কাজই টেকে না। মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেও সে তার মতবাদ আর নিজ স্বার্থের কথা ভুলবে না। মহামানব তাই বলেছিলেন যদি দু’জন লোকের একজন কারো পিতাকে হত্যা করে আর দ্বিতীয়জন তার সম্পদ লুন্ঠন করে তবে সে প্রথম জনকেই আগে ভুলে যাবে। নবচেতনায় উন্মেষের এই দিনে যাদের স্বার্থহানি হয়েছে সবচেয়ে বেশী তারা তাদের ক্ষত কখনওই ভুলতে পারবে না। এটাই জাতির পরিণতি। পৃথিবীতে এর ব্যতিক্রম আর একটাও হয়নি। ইসলাম আসার পরও আরবের ইতিহাস তাই গোত্র দ্ব›েদ্বরই ইতিহাস। সেখানে হিময়ার আর মুদারদের মধ্যের পারস্পরিক বিবাদ যেমন দেখা যায় তেমনি বনু হাসেম আর বনু উমাইয়াদের মধ্যবর্তী পারস্পরিক বিরোধও তেমনি তীব্রভাবেই চোখে পড়ে। আমাদের মধ্যেও যে ভিন্নমত পোষণকারী থাকবে এতে আর অবাক করার কি আছে?
পাকিস্তান আমলে যারা মুসলিম লীগ ছিলো, যারা ধনতান্ত্রিক ধ্যাণ-ধারণায় বিশ্বাস করত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যারা প্রভুভক্ত ছিলো, যখন ভারতের কল্যানে স্বাধীনতাটা এসেই গেলো তার কিছুটা হোঁচট খেলো বটে তবে খেই হারালো না। আওয়ামী লীগের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তীব্র ডানপন্থিদের ভেতরেই তারা আশার আলো দেখতে পেলো। ধীরে ধীরে পিপড়ার মতো জড়ো হলো। তারপর একটা ১৫ই আগস্ট তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পথকে একেবারেই কন্টকমুক্ত করে দিলো।
ঘটনাপ্রবাহ যে এই ধরনের পরিকল্পনা আর স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিয়ে এগিয়েছিলো তার প্রমাণ মেলে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। তারা তাদের মতবাদ বাস্তবায়নের জন্যে উঠে পড়ে লাগলো। পরবর্তীতে প্রতিটি সরকারের আমলেই এই সব মতবাদের মানুষগুলো স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের চেতনাকে ভুলুন্ঠিত করেছে নানা কায়দায়। ভারত প্রীতির বিরুদ্ধে কথা বলে তারা যে পাকিস্তান প্রীতি দেখিয়েছে তা যে কতোটা জঘন্য ছিলো তা তাদের কার্যকলাপ থেকেই স্পষ্ট। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো যে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তির জন্যে আমরা দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করেছিলাম সেই পাকিস্তানের কাছেই নিজেদেরকে পুনরায় সপে দেওয়ার এই জঘন্য প্রক্রিয়া এটাই মনে করিয়ে দেয় যে আমরা যুদ্ধে জয়ী হলেও আমাদের জাত্যাভিমান তৈরী হয়নি। আমরা নিজেদের মতো করে ভাবতে শিখিনি। আজও হয়তো শিখিনি।
ভারত বিদ্বেষের যে গুজব ছড়ানো হতো, ইসলাম গেলো বলে যারা হাহাকার করে উঠতো, অন্যায় আর অবিচার যেটুকু সংঘটিত হয়েছে তা তাদেরই অবদান। যারা স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী তারা তখনও দুর্ভাগা ছিলো এখনও দুর্ভাগা আছে। দেশপ্রেম কি তবে পাপ?
ভেতরে ভেতরে এই দেশের অস্তিত্বে অবিশ্বাসীরা আজও সক্রিয়। এখন উর্বর সময়ে তাদের অনেকেই গায়ে মুজিব কোট পড়েছে। তবে এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রতারণা। সুযোগ মতো তারা ঠিকই স্বাধীনতার চেতনাধারীদের শিকড় কাটছে। তাদের উত্তেজিত করছে প্রবাসে অবস্থানরত কতিপয় বেহায়া আর তথাকথিত বাক সর্বস্ব মানুষ।
লক্ষ্য যে তাদের কি তা তারা নিজেরাও জানে না। এদেশের মেহনতি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন নিয়ে তাদের কোন ভাবনা নেই। কিভাবে মানবতার মুক্তি হতে পারে তার কোন দিক নির্দেশনা নেই। শুধু নেগেিেটভ ভাবনা। দেশ গেলো দেশ গেলো বলে শোরগোল। হায়রে কপাল। এই সব অবস্থার মধ্যে দিয়েও বাংলাদেশ যে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার কৃতিত্ব স্বয়ং সৃষ্টিকর্তারই প্রাপ্য।
সময় বদলেছে ঠিকই। আমরা কতোটা বদলেছি তা প্রশ্নের দাবী রাখে। এই দেশ, এই মাটি, এই মানুষ, এই মানচিত্র, এই পতাকা তারই ভালো লাগবে যার প্রাণ এর সাথে এক সুতোয় গাঁথা। ত্রæটি কার নেই। আওয়ামী লীগের সব কিছুই কি ভুল ত্রæটির উর্ধ্বে? কখনও নয়। কারণ এই সংগ্রামী আর দেশপ্রেমিক দলটির বৃহৎ কলেবরের ভেতর, এর জামার আস্তিনের ভেতরে সব সময়ই অজ¯্র সাপ আশ্রয় নিয়েছিলো। সুযোগ পেলে ছোবলও মেরেছে। যারা ইতিহাস জানে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে ব্যর্থ করার জন্যে বাঙালির কল্যাণকামী সেজে যারা সেদিন আট দফা দাবী দাওয়া পেশ ও তা মেনে নেওয়ার নাটক করে বাঙালির শুভাকাক্সিক্ষ সেজেছিলো ইতিহাস সেই সত্য প্রমাণ করে দিয়েছে। কিন্তু কে ভাববে এসব নিয়ে। ইতিহাস বিস্মৃত এই জাতিকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দিতে হয় সত্য আর ত্যাগের পথ বড় কঠিন। এখানে প্রাপ্তির চাইতে দানের অংশটাই বড়। যতদিন আমরা মানবিক মানুষ না হবো আমাদের বার বার বদলে যাওয়া কোন বিচিত্র ঘটনা নয়।
মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন মনের আধুনিক অ
Comments
Post a Comment