“পল্লীকবি”
উপাধি পাওয়া একজন সাহিত্যিকের সম্বন্ধে প্রথম দর্শনে হয়ত মনে হবে গ্রাম্য
কোন অশিক্ষিত লেখক বা কবি। কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণই উল্টো। আধুনিক
শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যারয়ের বাংলার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এই
কবিকে বলা হয় “আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ
আধুনিক কবি”। জসিম উদ্দীন কি তবে কবিতার বৈশ্বিক চিত্র বা চেহারা সম্পর্কে
অজ্ঞ ছিলেন? আর এজন্যেই কি তিনি পল্লীকে তার কবিতার পটভূমি হিসেবে বেছে
নিয়েছিলেন? মোটেই তা নয়। বিশ্বসাহিত্য আর তার গতিপ্রকৃতি ও রূপান্তর
সম্পর্কে কবি ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। তবু তিনি তার গতিপথ নির্ধারণ করেছিলেন
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক পল্লী গ্রামকে। জসীম উদ্দীন তাই রাখতে
সক্ষম হয়েছেন তার পদচিহ্ন।
আমার এই দাবীর সমর্থন পাই ইমরান মাহফুজের
“বাংলা ও বাঙালির কবি জসীম উদ্দীন” প্রবন্ধে। কবির লেখা অনবদ্য কবিতা
“পল্লী জননী”-র উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন,
“আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,
ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি, জড়ায়ে মায়ের ডানা।
ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,
মরণের দূত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দূর-দূর। (পল্লী জননী)
এটি
কি আমাদের চিরায়ত বাংলার দৃশ্য নয়? জীবন সংসারের শাশ্বতরূপ তো এমনি হয়। এক
কথায় জসীম উদ্দীন হতে চেয়েছেন গ্রামীণ মানুষের অলিখিত জীবনের রূপকার।
বরাবরই সফল- কী গদ্যে, কী পদ্যে। কারণ, সেসময়ে রবীন্দ্র বলয় থেকে বের হওয়া
দুরূহ ছিলো! সেই সঙ্গে ক্যালকুলেটিভ বুদ্ধদেব বসু যখন ইউরোপীয় সাহিত্য
অনুবাদ শুরু করেন। পরিকল্পনাহীন কাজী নজরুল ইসলাম অনুবাদ করেন ওমর খৈয়াম,
কাব্যে আমপারা। জসীম উদ্দীন স্বপ্ন-কল্পনার আচ্ছন্নতা কিংবা রূপকথার অলীক
মায়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেননি। শিল্পের ভেতর দিয়ে
নিঃস্ব-নিপীড়িত-রিক্ত-ভাগ্যহীন গ্রামীণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ও
সহমর্মিতা পোষণই ছিলো তার প্রতিজ্ঞা।”
তবে এক্ষেত্রেও আমরা
কবিকে যতোটা সফল দেখি তার দিক দিয়ে দেখলে কবিকে কিন্তু কিছুটা অতৃপ্তিতেই
ভুগতে দেখা যায়। আর এজন্যেই হয়তো তিনি তার আফসোস প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন,
“পাড়ার লোকেরা আমার কবিগান শুনে মন্তব্য করিত, কালে এই ছেলেটি চেষ্টা করিলে
একজন বড় কবিয়াল হইবে। কিন্তু তাহাদের সে ভবিষ্যৎবাণী সফল হইল না। আমি
কবিয়াল হইতে পারিলাম না, হইলাম কবি জসীম উদ্দীন।”
জসীম উদ্দীনের
জন্ম ১৯০৩ সালে আর মৃত্যু ১৯৭৬ সালে। সময়কালের বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ ও
নজরুলের প্রভাব বলয়ের অধীন বা সমসাময়িক। উপর্যুুপরি ত্রিশের কবি হিসেবে
যারা খ্যাত তাদেরও দোর্দন্ড প্রতাপের সময়। কবিতা নিয়ে প্রচুর গবেষণা বা
এক্সপেরিমেন্টও করা হচ্ছিলো। বাংলা কবিতাকে গতানুগতিকতার গন্ডী থেকে বের
করে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করছিলো অনেকে। তথাকথিত
প্রলেতারিয়েত কবি বা বাম ঘরাপার কবিদেরও যথেষ্ট উৎপাত ছিলো ঐ সময়টায়।
সর্বোপরি ব্রিটিশদের ভারত শাসনের শেষের দিকটার কয়েকটা দশকে যখন পুরো
উপমহাদেশ উন্মাতাল তখনই তার বেড়ে ওঠা ও বিকাশ।
এসবের পাশাপাশি
কবিকুলের রবীন্দ্র ঘরাণা থেকে বেরিয়ে এসে স্বকীয় ও আধুনিক বাংলা কবিতার
নতুন জগৎ নির্মানের তুমুল প্রচেষ্টা। কিন্তু এ ধরণের কোন স্রােতেই গা
ভাসালেন না কবি। তিনি তার চিরন্তন বাংলা সংস্কৃতিকেই বানালেন তার সাহিত্যের
পটভূমি। রচনা করলেন হৃদয় ছোঁয়া অমর কবিতা “কবর”। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র থাকাকালীনই তার কবিতা পাঠ্য হয়ে গেলো। কবি বুঝতে পারলেন সত্যিকারের
সাহিত্য রসেই তিনি ডুবে আছেন।
সাহিত্যে জসীম উদ্দীনের আবির্ভাব
ও তার বিষয় প্রকরণের ব্যাপারে বলতে গিয়ে ইমরান মাহফুজ তার “বাংলা ও
বাঙালির কবি জসীম উদ্দীন” প্রবন্ধে লিখেছেন, “লক্ষণীয় যে, আধুনিককালে শুধু
জসীম উদ্দীনই নন অনেকের হাতেই রচিত হয়েছে বিশেষ ধরণের কবিতা- বাংলায় আমরা
যাকে বলি গীতিকবিতা। বাংলাসাহিত্যে বিহারীলাল এজন্যই বিখ্যাত। খোদ
বিশ্বকবির হাতেও রচিত হয়েছে গীতিকবিতা। বিশ্বসাহিত্যের যেটুকু আলো আমাদের
কাছে পৌঁছেছে তাতেও রয়েছে কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, কিপলিং, অস্কার
ওয়াইল্ড, পুশকিন প্রমুখ লিরিক্যাল ব্যালাডস বা লৌকিক জীবনালেখ্য-ভিত্তিক
কাহিনীকাব্য রচয়িতার নাম। আবার, প্যাস্টোরাল বা রাখালি কবিতাও কম পরিচিত নয়
বিশ্বকাব্যের মানচিত্রে। জসীম উদ্দীন প্যারাডক্স হিসেবে আবির্ভূত হন ১৯২৮
সালে। সে বছর তার প্রথম ব্যালাডধর্মী কাব্য ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ প্রকাশিত
হয়।”
কবির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল হলো ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭
সাল। এই সময়টাতেই কবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অমর গবেষক দীনেশচন্দ্র সেনের
অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষেণা সহকারী হিসেবে কাজ করেন। হাত লাগান পূর্ব বঙ্গ
গীতিকার সংগ্রহের কাজে। এই সময়কালটাতে তিনি ১০,০০০-এর বেশী লোক সংগীত
সংগ্রহ করেন। কবির এসব দুর্লভ সংগ্রহ জারীগান ও মুর্শিদা গান-এ স্থান
পেয়েছে। বাংলা লোকসাহিত্যের বিশদ ব্যাখ্যা এবং দর্শন কবি খন্ড আকারেও
লিপিবদ্ধ করেছেন।
কবির সকল রচনাই উল্লেখের দাবীদার। তবে এর মধ্যে
“নকশী কাঁথার মাঠ” ও “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কবিকে অমরত্বের মর্যাদা এনে
দিয়েছে। ১৯২৯ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে নকশী কাঁথার মাঠ প্রকাশিত হয়েছিলো, আর
মাত্র ৩০ বছর বয়সেই প্রকাশিত হয় সোজন বাদিয়ার ঘাট।
এসব রচনা যদিও
বাংলা সাহিত্যের মৌলিক রচনা ও অমর সম্পদ কিন্তু জীবদ্দশায় কবির এইসব
অসামান্য সাহিত্য কর্মের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। কথাকথিত আধুনিকতার
ধ্বজাধারীরা কবিকে বরাবরই কোণঠাসা করে রেখেছেন। এর প্রমাণ মেলে যখন আমরা
দেখি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অর্থাৎ ৭০ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালে যখন কবিকে
বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয় তখন কবি তা অভিমান ভরে প্রত্যাখ্যান
করেছেন।
জসীম উদ্দীনের সাহিত্যকর্ম কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির
অপেক্ষা রাখে না। তার প্রমান আজও বাংলার ঘরে ঘরে তার সাহিত্য কর্মের
জনপ্রিয়তা। এতো আধুনিকতার মধ্যেও তার হৃদয় নিংড়ানো পল্লীর মধুমাখা
সাহিত্যকর্মের আবেদন একটুও কমেনি। তরুণ বয়সে তার রচিত কবর কবিতাই যখন আমরা
পড়ি আমাদের আজও মনে হয় এই তো মাত্র গতকালের রচনা। এর পঙক্তিগুলো আমাদের
যারপরনাই আবেগমথিত করে তোলে। এ যেন বাংলার প্রতিটি ঘরের প্রতিটি মানুষের
হৃদয়ের গল্প গাথা, আবেগ আর অনুভূতির অপূর্ব এক চিরন্তনী প্রকাশ। কবি
লিখেছেন,
এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
অথবা,
সোনালী ঊষার সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি,
লাঙ্গল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ওপথ ধরি।
সত্যিই
অপূর্ব। কি ভাবে, কি ছন্দে, কি অকৃত্রিম হৃদয়ানুভূতি মাখা আবেগের স্বচ্ছ ও
সাবলীল বহিঃ প্রকাশে - এই সব পঙক্তিগুলো আজও সমান আবেদনময়ী।
জসীম
উদ্দীন এর প্রতিভা বহুমুখী। তিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন বহুমুখী রচনাশৈলী
দ্বারা। যদি গানের কথা আসে তবে মনে পড়ে যায় তার অমর সব গানগুলোর কথা। “আমার
হার কালা করলাম রে,” আমায় ভাসাইলি রে, বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে, ইত্যাদি অমর
গানগুলো তার কথা মনে করিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত।
তার সমৃদ্ধ রচনাবলীর
মধ্যে রয়েছে অমর সব কাব্যগ্রন্থ, অসামান্য সব নাটক, এছাড়াও আত্মকথা,
ভ্রমনকাহিনী ও সংগীত বিষয়ক অজস্র গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। বোবা কাহিনী
নামে তার একখানা উপন্যাসও আছে। তার হাসির রচনা “বাঙলির হাসির গল্প ১ম ও ২য়
খন্ড” আজও হাস্যরসের খোরাক জোগায়। শিশুদের জন্য তার অমর সৃষ্টি ডালিম
কুমার। তার লেখা “বেদের মেয়ে” নাটকটি গ্রাম বাংলার আজও সমান জনপ্রিয়। কবির
লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
জসীম উদ্দীন এক অসামান্য প্রতিভার
নাম। যারা বিভিন্ন ধরণের সাহিত্য রচনায় পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছিলো তাদের
অনেকেই হারিয়ে গেলেও জসীম উদ্দীন আজও তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
জীবনের
শেষ প্রান্তে এসে এবং জীবনান্তেও কবি পেয়েছিলেন স্বীকৃতি। কিন্তু যতদূর
জানা যায় এতে তার কোন তৃপ্তি ছিলো না। কারণ কবি এসব স্বীকৃতির কাঙাল ছিলেন
না। ১৯৭৬ সালে অর্থাৎ তার মৃত্যুর বছর তাকে দেওয়া হয়েছিলো একুশে পদক এবং
তার মৃত্যুর দু’বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে তাকে দেওয়া হয়েছিলো মরোনোত্তর
স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার। এমন একজন মহান সাহিত্য চেষ্টার এই দেরীতে
মূল্যায়ন মোটেই সন্তোষজনক কিছু নয়। এটা বরং আমাদের সাংস্কৃতিক দৈন্যকেই
প্রকটভাবে প্রকাশ করেছিলো।
মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন মনের...
Comments
Post a Comment