এসো স্বাধীনতার গল্প বলি (HISTORY OF BANGLADESH'S FREEDOM FIGHTING) - ওমর খালেদ রুমি (OMAR KHALED RUMI)
আমাদের এই ভূ-খন্ড এক সময় স্বাধীন ছিলো। আর আমাদের সবশেষ স্বাধীন নবাবের নাম ছিলো সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজউদ্দৌল্লা ছিলেন আলীবর্দী খাঁর নাতি। বাংলা বিহার উড়িষ্যার প্রতাপশালী নবাব আলীবর্দী খাঁর কোন পুত্রসন্তান ছিলো না। তার ছিলো তিনটি কন্যা সন্তান। এই কন্যাদের মধ্যে মেজ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র হলো নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজ ছিলো আলীবর্দী খাঁর অত্যন্ত প্রিয়। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন আজ থেকে ২৬৫ বছর আগে তিনি পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়ে নবাবী হারান।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে একটু অতীতে ফিরে যেতে চাই। ১২০২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ঘোরী দিল্লীর সিংহাসন দখল করলে উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। তখন থেকেই বাংলা কখনো দিল্লীর প্রত্যক্ষ শাসনে আবার কখনো পরোক্ষ শাসনে থাকে। দিল্লী টানা তিনশ বছর মুসলিম সালতানাতের অধীনে ছিলো এবং পরবর্তীতে টানা আড়াইশ বছর মোঘল শাসনের অধীনে ছিলো। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হলে ধীরে ধীরে মোঘল শাসন দুর্বল হয়ে যায়। আর এর পর থেকে বাংলা বলতে গেলে স্বাধীন এলাকায় পরিণত হয়। মূলত মুর্শীদ কুলি খাঁর (১৭১৭-১৭২৭) আমল থেকেই বাংলা এই স্বাধীনতার পথে হাঁটতে থাকে।
ইংরেজদের একজন সাধারণ সৈনিক রবার্ট ক্লাইভের বুদ্ধিমত্তা আর সাহসিকতার পাশাপাশি নবাবের আমির ওমরাহ যেমন মীর জাফর, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ প্রমুখের বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই ইংরেজরা সামান্যসংখ্যক সৈন্য নিয়েও নবাবের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে যুদ্ধে মীর জাফর, ইয়ার লতিফ ও রায়দুর্লভ বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে নবাবের অনুগত মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিঁনফ্রে সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেন। মীর মদন যুদ্ধক্ষেত্রেই জীবন দেন। মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিঁনফ্রের আক্রমণে যুদ্ধে নবাবের বিজয় হচ্ছে দেখে মীর জাফর সাময়িক যুদ্ধবিরতির ষড়যন্ত্র করেন। বৃষ্টিতে নবাবের গোলা বারুদ ভিজে গেলে ইংরেজদের কামানের আক্রমনের মুখে নবাবের বাহিনী আর দাঁড়াতে পারেনি। যুদ্ধে নবাবের পরাজয় হয়। সেই সাথে আমাদের এই ভূখন্ডও স্বাধীনতা হারাবার পথে পা বাড়ায়। যদিও সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতা হারানোর পর বাংলার নবাব হয়েছিলেন মীর জাফর কিন্তু তিনি ছিলেন মূলত ইংরেজদের হাতের পুতুল।
মীর জাফরের পর তার জামাতা মীর কাসিম নবাব হয়েছিলেন। তারপর আবার মীর জাফর। মীর কাসিমও এক পর্যায়ে ইংরেজদের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এই যুদ্ধ ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৭৬৪ সালের ২২শে অক্টোবর এই যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। যুদ্ধে মীর কাসিমের সাথে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলম যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হলে বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে যায়। এরপর আমাদের এই বাংলা চলে যায় মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে।
প্রশ্ন আসতে পারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কি? এটি একটি বৃটিশ বহুজাতিক কোম্পানী। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর লন্ডনে এর জন্ম হয়। লন্ডনের বড় বড় ব্যবসায়ীরা মিলে পৃথিবী ব্যাপী তাঁদের ব্যবসায়ীক কার্য পরিচালনার জন্য এর জন্ম দিয়েছিলো।
পৃথিবীতে তখন মসলার ব্যবসা জমজমাট। আর এই মসলার ব্যবসায় তখন প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো পর্তুগীজ আর ওলন্দাজরা। তাদের এই ব্যবসায় ভাগ বসাতেই ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া এই কোম্পানীটি মাত্র সাত থেকে আট বছরের মাথায়ই জাহাজ নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাভা, সুমাত্রা, বোর্ণিত্ততে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু সেখানে পর্তুগীজ আর ওলন্দাজদের সাথে যুদ্ধে মারাত্মক ভাবে পরাজিত হয়ে পিছু হটে ভারতের দিকে যাত্রা করে। আর এভাবেই তারা ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে আগস্ট ভারতের সুরাট বন্দরে এসে পৌঁছে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ঘাঁটি গড়ে তোলে।
এদের মধ্যে কালিকট, মাদ্রাজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তারা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন করে। ঐ বছরেরই ২রা ফেব্রæয়ারী তারা স¤্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে বাংলায় ব্যবসা করার ফরমান লাভ করে। এর একশত চব্বিশ বছর পর ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুনে তারা নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারের কতিপয় অমাত্যের বিশ^াসঘাতকতায় পলাশীর প্রান্তরে প্রহসনের যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। বাংলা থেকে যে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত হয়েছিলো তা পরবর্তীতে পুরো উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পরে এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ই আগস্ট ভারতের জন্ম লাভের মধ্যে দিয়ে এর পরিসমাপ্তি হয়।
এখানে বলে রাখা ভালো ১৮৫৭ সালে ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হলে ভারতের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে ব্রিটিশ রাজের হাতে চলে যায়। এখানে এও বলে রাখতে চাই তখনকার সময়ে ব্রিটেনের রানী ছিলেন ভিক্টোরিয়া। আর এটাও উল্লেখ থাকা প্রয়োজন যে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীটি ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ ২৬৪ বছর কার্যকর থাকার পর বন্ধ হয়ে যায়।
ইংরেজরা যুদ্ধ জয় করেছিলো সেই ১৭৫৭ সালে। তারা বিদায় নিয়েছিলো ১৯৪৭ সালে। সুদীর্ঘ ১৯০ বছর তারা আমাদের শাসন করেছিলো। তাহলে কথা আসতে পারে এই দীর্ঘ সময় ধরে আমরা কি তাদের শাসন মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলাম। না। প্রতিবাদ হয়েছিল। তবে তা ধাপে ধাপে। প্রথম প্রতিবাদটা করেছিল মীর কাসিম। আর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বক্সারের যুদ্ধে তিনি হেরে যান।
ইংরেজ শাসনের শুরু থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন ফকির সন্ন্যাসীরা। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তাতে অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটে। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রায় দেড়শত ফকির-সন্ন্যাসীকে ইংরেজরা মৃত্যুদন্ড দেয়। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন ফকির মজনু শাহ।
তার জন্ম হয়েছিল ভারতের উত্তর প্রদেশে। ১৭৮৬ সালের ৮ই ডিসেম্বর ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে আহত হলে ১৭৮৮ সালের ২৬শে জানুয়ারী তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার ভাইপো মুসা শাহ ফকির সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেন। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে মুসা ইংরেজদের সাথে এক খন্ড যুদ্ধে নিহত হলে আমাদের স্বাধীনতার প্রতিবাদের প্রথম অধ্যায় শেষ হয়। যদিও ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত এই আন্দোলনটি পরবর্তীতে কাংঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনটি হলো সৈয়দ আহমদ শহীদের পরিচালিত সংগ্রাম যাকে ভুল করে অনেকেই ওয়াহাবী আন্দোলন বলে থাকে। মক্কার নজদের ইসলামী পন্ডিত মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে সেখানে যে আন্দোলন হয়েছিলো তাই ওয়াহাবী আন্দোলন নামে পরিচিত। কিন্তু সত্যি বলতে কি সেই আন্দোলনের সাথে সৈয়দ আহমদ শহীদের এই বিদ্রোহের কোন সম্পর্ক ছিলো না।
প্রথমদিকে তার প্রতিবাদ ছিলো শিখদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তীতে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের এক যুদ্ধে তার মৃত্যু হলে ঐ আন্দোলন মূলত দিক হারায়। পরবর্তীতে বিচ্ছিন্নভাবে চললেও এটা আর তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
একই সময় আরও একজন সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কারক তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। তিনি নাড়িকেল বাড়িয়ায় বাশের কেল্লা নির্মান করেন। তিনিও ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এক খন্ডযুদ্ধে নিহত হন।
যে সময়টাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ ও তিতুমীর এর সংগ্রাম চলছিলো ঠিক সেই সময়টাতেই বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় একজন ধর্মীয় পন্ডিত হাজী শরিয়ত উল্লাহ তার ধর্মীয় সংষ্কার মূলক কর্মসূচী পরিচালনা করেন। ফরজ নিয়ে সংঘটিত হওয়ায় একে ফরায়েজী আন্দোলন বলা হয়। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হলে তার পুত্র দুদু মিয়া এই আন্দোলনের দায়িত্ব নেন। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে দুদু মিয়ার মৃত্যু হলে এ আন্দোলন আর আলোর মুখ দেখেনি। যদিও এটা ছিলো ধর্মীয় সংস্কারমূলক কর্মসূচী কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে এটা প্রমানিত যে এ ধরনের কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে মানুষের ভিতরে মুক্তির চেতনা জাগিয়ে তোলার যে চেষ্টা তাও কার্যকর হয়েছিলো।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ মিরাটের সামরিক ঘাঁটিতে সংঘটিত হলেও অর্থাৎ সৈন্যদের মধ্যে সংঘটিত হলেও পরবর্তীতে তার যে সর্বগ্রাসী রূপ তাতে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বেও ছিলো বিরাট অবদান। মূলত এই বিদ্রোহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব মৌলভী আহমদুল্লাহ ফৈজাবাদী ছিলেন তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তার ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলনকারীরা যেভাবে মারাত্মক ও বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিলো তা এক কথায় বলতে গেলে ইংরেজদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম প্রধান ও মারাত্মক বিদ্রোহের নাম সিপাহী বিদ্রোহ। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘঠিত এই বিদ্রোহ মূলত ব্যারাকে সংঘটিত হলেও পরবর্তীতে তা দিল্লী, আগ্রা, কানপুর ও লাক্ষেèৗতে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ মোঘল স¤্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে প্রধান করে বিদ্রোহীরা বিদ্রোহ শুরু করলেও নানা কারনে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ভারতীয়রা মাত্র ৬০০০ ব্রিটিশকে হত্যা করতে সক্ষম হয় যার বিপরীতে লড়াই ও দুর্ভিক্ষে প্রায় ৮ লক্ষ ভারতীয় নিহত হয়।
এই বিদ্রোহ এতোটাই বিপর্যয়ের যে পৃথিবীর ইতিহাসে এতোটা নৃশংসভাবে কোন বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। মূলত সঠিক নেতৃত্ব সঠিক পরিকল্পনা সঠিক লক্ষ্য না থাকায় বিদ্রোহীরা ও বিদ্রোহ উপদ্রæত এলাকার নিরপরাধ ও নিরীহ জনগোষ্ঠী করুণ ও গণহারে মৃত্যুর শিকার হয়।
সিপাহী বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য বীরদের মধ্যে তাঁতিয়া টোপী, ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাই, মৌলভী আহমদুল্লাহ ফৈজাবাদী, বেগম হযরত মহল, বিরজিস কদর প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
সিপাহী বিদ্রোহের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের কর্তৃত্ব হারায় এবং ভারতে ব্রিটিশ রাজের সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখের দাবীদার যে এর মাধ্যমে ভারতে মোঘলদের শাসনেরও অবসান হয়।
সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে ভারতীয়রা পরিকল্পিত রাজনৈতিক আন্দোলনের কথাই ভাবতে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন সমাজ সংষ্কারমূলক কাজেও হাত দেয়। এ সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমাজ সংষ্কারক স্যার সৈয়দ আহমদ। তিনি আলীগড় বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিখ্যাত। এই সময় কালেই অর্থাৎ ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হয় কংগ্রেসের। একজন জনদরদী ব্রিটিশ অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। কংগ্রেসের অন্যান্য প্রাথমিক সদস্যদের মধ্যে ছিলেন উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন, উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, মনমোহন ঘোষ, লালমোহন ঘোষ, বদরুদ্দীন তায়েবজি, এম জি রানাডে প্রমুখেরা।
এরপর ১৯০৬ সালে জন্ম হয় মুসলিম লীগের। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন ভারতের সম্ভ্রান্ত মুসলিম ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে তার বাড়ীতেই সংগঠনটির জন্ম হয়েছিলো। মুসলিম লীগের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন এম এ জিন্নাহ, এ কে ফজলুল হক, তৃতীয় আগা খান, নবাব ভিকার উল মুলক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফিরোজ খান নুন, খাজা নাজিমুদ্দীন, লিয়াকত আলী খান, চৌধুরী খালিকুজ্জামান, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আবুল মনসুর আহমেদ প্রমুখ।
আরও ছোট ছোট রাজনৈতিক দল থাকলেও পরবর্তীতে এই দুটো দলই ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল। এদের পাশাপাশি উপমহাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অরাজনৈতিক ব্যক্তিও নানা ধরনের ভূমিকা রাখছিলেন।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলে উপমহাদেশেও তার ঢেউ আসতে শুরু করে। বিপ্লবী এম এন রায় এবং পরবর্তীতে মাওলানা হসরত মোহানী, মোজাফফ্র আহমদ এবং এস এ ডাঙ্গের মতো নেতাদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। মোজাফফ্র আহমদ ও এস এ ডাঙ্গের নেতৃত্বে সশস্র কায়দায় ইংরেজ হটানোর যে ষড়যন্ত্র করা হয় তা “মিরাট ষড়যন্ত্র” নামে পরিচিত।
এখানে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। জার্মান চিন্তাবিদ ও লেখক কার্ল মার্ক্স ও তার বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসই মূলত এই মতবাদের প্রবক্তা। রাশিয়ায় ভøাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো যা বলশেভিক বিপ্লব নামে পরিচিত। এই বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিলো সামন্তবাদীদের শাসনক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে সমাজের বঞ্চিত মানুষদের পুঁজির মালিক হতে সাহায্য করা। এই বিপ্লবের আর এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব লিওন ট্রটস্কি।
সিপাহী বিদ্রোহের পরে ভারতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বঙ্গভঙ্গ। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ করা হলে তার প্রতিবাদে বর্ণ হিন্দুরা এক ধরনের আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত। ভারতীয় রাজনীতির বহু পুরোধা ব্যক্তিত্ব যেমন লালা লাজপত রাই, বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখেরা স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেন।
সতীশ চন্দ্র বসু ১৯০২ সালে যে অনুশীলন সমিতি গঠন করেছিলেন ১৯০৫ সালে ঢাকায় এর শাখা স্থাপন করেন বিপ্লবী পুলিন বিহারী দাশ। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষের কনিষ্ট ভ্রাতা বারীন্দ্র কুমার ঘোষ যুগান্তর সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তার সাথে ছিলো বিপ্লবী বাঘা যতিন। স্বদেশী আন্দোলন চলাকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অনেক সশস্ত্র হামলা হয়। এ ধরনের হামলার প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো আলিপুর বোমা হামলা যাতে বিখ্যাত ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর হয়।
পরবর্তীতে প্রায় ত্রিশ বছর এরকম অনেক সশ¯্র সংঘঠনের জন্ম হয় যারা তাদের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে ইংরেজ শাসকদের অস্থির করে তোলে। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হলে স্বদেশী আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়। এরপর ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আন্দোলনের গতি আরও কমে যায়। তবে এ সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আর তা হলো বিপ্লবী বাঘা যতিনের মৃত্যু। ১৯১৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর ইংরেজদের আক্রমনে বাঘা যতিনের মৃত্যু হয়।
এরপরও এরকম অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে বিপ্লবীরা। এদের মধ্যে কাকোরী ট্রেন ডাকাতি (১৯২৫), ভগত সিং ও চন্দ্রশেখর আজাদের একাধিক হামলা যেমন পুলিশ অফিসার সন্ডার্স হত্যা (১৯২৮) ও দিল্লিতে সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ এসেম্বলিতে হামলা (১৯২৯) উল্লেখযোগ্য। কাকোরী ট্রেন ডাকাতি (১৯২৫) হামলার জন্যে পন্ডিত রাম প্রসাদ বিসমিল ও আশফাকুল্লাহ খান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তারা এসব ডাকাতির টাকা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্যয় করতো।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিন আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে এলে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। তার নেতৃত্বে ১৯২০-২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয় তার প্রভাব পড়তে দেখা যায় ভারতীয় রাজনীতিতে। তিনি ১৯১৯ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ সময় কালে পরিচালিত খিলাফত আন্দোলনকেও সমর্থন করেন।
এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, মাওলানা শওকত আলী, ড. সাইফুদ্দিন কিচলু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরষ্ক পরাজিত হলে সেখানকার ইসলামী খিলাফতের অবসান ঘটানো হয়। আর এতেই ক্ষুদ্ধ হয় ভারতের মুসলমানরা। খিলাফত পুণঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশদের বিরূদ্ধে তারা যে আন্দোলনের ডাক দেয় তা-ই খিলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত। তবে এ আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভারতে না থাকায় সংগত কারণেই আন্দোলনটি ব্যর্থ হয়। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থনের ব্যাপারটি কায়েদ এ আযম এম এ জিন্নাহ সমর্থন করতে পারেননি।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তার পরিচালিত লবন সত্যাগ্রহ সারা উপমহাদেশে সাড়া ফেলে দেয়। তার শান্তিপূর্ণ আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলন সারা পৃথিবী জুড়ে প্রশংসিত হয়। ডেভিড হেনরি থরো নামের একজন আমেরিকান সমাজ বিজ্ঞানী ছিলেন এই আন্দোলনের মূল প্রবক্তা।
সিপাহী বিদ্রোহ ও তার পরবর্তী কালের ভারতের স¦াধীনতা আন্দোলনে অজস্র উল্লেখযোগ্য নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহেরু, এম এ জিন্নাহ, মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী, খান আব্দুল গফফার খান, তাতিয়া টোপী, নানা সাহেব, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, সুভাস চন্দ্র বোস, সুখদেব, বি আর আম্বেদকর, সরোজিনী নাইডু, মঙ্গল পান্ডে, ভগত সিং, মাস্টার দা সূর্যসেন, বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপৎ রাই, বিপিন চন্দ্র পাল, মাওলানা আহমদুল্লা শাহ ফৈজাবাদী, লক্ষী রাণী, আশফাকুল্লাহ খান, রাম প্রসাদ বিসমিল, ক্ষুদিরাম বসু, বাঘা যতিন, চন্দ্র শেখর আজাদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
আমাদের জানা দরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজরা কথা দিয়েছিলো যে যদি ভারতীয়রা তাদের পক্ষে জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে তবে তাদের স্বাধীনতা দেওয়া হবে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে তারা সেই কথা রাখেনি। তাই ভারতীয়রা ইংরেজদের পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে রাজী হয়নি।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিত্র রাতারাতি বদলে যায়। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির ভিত এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে তারা ভারত ছেড়ে যেতে মন স্থির করে ফেলে। ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্টে পাকিস্তান ও ১৫ই আগস্টে ভারত নামের দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
শুরু হয় পাকিস্তান পর্ব। আমাদের পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অধীনে থাকায় এক সময় এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। আমরা ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত হলেও সত্যিকারের মুক্তি আমাদের মেলেনি। দেশ ভাগের পর অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্ম লাভের পর আমাদের প্রথম সংকট দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার যে গভীর ষড়যন্ত্র হয় তা সত্যিই দুঃখজনক। ভাষা নিয়ে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে যে সংগ্রাম শুরু হয় তার ফলেই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারীতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরও অনেকে শহীদ হয়।
এখানে বলে রাখতে চাই ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হয়েছিলো এদেশের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যা বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামেই পরিচিত। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ যা বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত। এই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই রাজনৈতিক মঞ্চে উঠে আসে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের মাধ্যমে।
আরও একটা কথা বলে রাখতে চাই এই সময়কালে দুজন মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়ে বেড়াতেন। একজন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তার দলের নাম ছিলো কৃষক প্রজা পার্টি। আর একজন ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত ছিলেন।
এ সময়ের আরও একজনের রাজনৈতিক জীবন এতোটাই বর্ণাঢ্য যে তা এই সংক্ষিপ্ত লেখায় উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তিনি মওলানা ভাসানী বা লাল মওলানা। ১৯৪৯ সালে যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় তিনিই ছিলেন তার সভাপতি। মূলত ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর তিনি আসাম ছেড়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। পরবর্তীতে অজস্র রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিলো যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। এটি ছিলো পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচনে মুসলিম লীগ কে মোকাবেলা করার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল মিলে একটি জোট গঠন করে যা “যুক্তফ্রন্ট” নামে পরিচিত। এই নির্বাচনও তাই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন নামে পরিচিত। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় লিখেছে,
“পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিষদের ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে অন্যান্য দল মিলে যুক্তফ্রন্ট নামীয় একটি সমন্বিত বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৪ নভেম্বর, ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ (মওলানা ভাসানী) ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে কৃষক শ্রমিক পার্টি (শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক), পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, ও পাকিস্তান খিলাফত দল একসাথে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। সাথে আরো ছিল মৌলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি। বামপন্থী গনতন্ত্রী দলের নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলি সিলেটি।
যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ঐ ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া, ২১শে ফেব্রæয়ারি শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতিরক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল "নৌকা" আর মুসলিম লীগ এর নির্বাচনী প্রতীক ছিল "হারিকেন"।
১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম (মোট আসন ছিল ৩০৯ টি) আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জন করে। তন্মধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩টি, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮টি, নেজামী ইসলাম পার্টি ১৯টি, গণতন্ত্রী দল ১৩টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি ও পরে যোগ দেওয়া স্বতন্ত্র ৮ টি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাভূত হয়; তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়।
এ নির্বাচনে সংখ্যালঘু ধর্মীয় স¤প্রদায়ের জন্য ৭২টি আসন সংরক্ষিত ছিল। এগুলোর মধ্যে কংগ্রেস লাভ করেছিল ২৪টি আসন, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি, শিডিউল্ড কাস্ট ফাউন্ডেশন ২৭টি, গণতন্ত্রী দল ৩টি এবং ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি ১৩টি আসন লাভ করেছিল। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন।
১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের আসন প্রাপ্তির ছক:
সর্বমোট আসন মুসলিম আসন যুক্তফ্রন্টের প্রাপ্তি
যুক্তফ্রন্ট স্বতন্ত্র সমর্থন মোট
৩০৯ ২৩৭ ২১৫ ৮ ২২৩
১৯৫৪ সালের ৩রা এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুক হক চার সদস্য বিশিষ্ট যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয় ১৫ই মে তারিখে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।
১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করে দিয়ে শাসনতন্ত্রের ৯২ (ক) ধারা জারীর মাধ্যমে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করেন। যেই ধারা অনুসারে পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।”
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী ওয়াদা হিসাবে ২১টি দফা ঘোষণা করে। দফাগুলো হলো:
একুশ দফা :
নীতি : কোরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।
১.বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।
২.বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ত¡ উচ্ছেদ রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে। এবং উচ্চ হারের খাজনা ন্যায় সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সার্টিফিকেটযোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হইবে।
৩.পাট ব্যবসায়কে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে তাকে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাট চাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইবে। এবং লীগ মন্ত্রিসভার আমলের পাট কেলেঙ্কারী তদন্ত করিয়া সংশি¬ষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।
৪.কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে ও সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্ত শিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে।
৫.পূর্ববঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য সমুদ্র উপকূলে কুটির শিল্পের ও বৃহৎ শিল্পের লবণ তৈয়ারির কারখানা স্থাপন করা হইবে। এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলের লবণের কেলেঙ্কারী সম্পর্কে তদন্ত করিয়া সংশি¬ষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।
৬.শিল্প ও কারিগরি শ্রেণির গরীব মোহাজেরদের কাজের আশু ব্যবস্থা করিয়া তাহাদের পুনর্বসতির ব্যবস্থা করা হইবে।
৭.খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।
৮.পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করিয়া ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করিয়া শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হইবে। এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হইবে।
৯.দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইবে এবং শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।
১০. শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া কেবল মাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হইবে এবং সরকারি বেসরকারি বিদ্যালয় সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভূক্ত করিয়া সকল বিদ্যালয় সমূহকে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।
১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রক্রিয়াশীল কানুন বাতিল ও রহিত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হইবে এবং ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয়সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হইবে।
১২.শাসন ব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হইবে এবং এতদুদ্দেশ্যে উচ্চ বেতনভোগীদের বেতন কমাইয়া ও নিম্নবেতন ভোগীদের বেতন বাড়াইয়া তাহাদের আয়ের একটি সুসংগত সামঞ্জস্য বিধান করা হইবে। যুক্তফ্রন্টের কোন মন্ত্রী এক হাজারের বেশি বেতন গ্রহণ করিবেন না।
১৩. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, ঘুষ রিশওয়াত বন্ধ করার কার্যকরী ব্যবস্থা করা হইবে এবং এতদুদ্দেশ্যে সমস্ত সরকারি বেসরকারি পদাধিকারীর ব্যবসায়ির ১৯৪০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ লওয়া হইবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ দিতে না পারিলে তাহাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।
১৪. জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করতঃ বিনা বিচারে আটক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হইবে ও রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করিবার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে।
১৫. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হইতে পৃথক করা হইবে।
১৬. যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাততঃ ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।
১৭.বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যাহারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহীদ হইয়াছেন তাহাদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হইবে এবং তাহাদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে।
১৮. ২২ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করিয়া উহাকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হইবে।
১৯. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট ও মুদ্রা ব্যতিত আর সমস্ত বিষয় পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশ রক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণকরত পূর্বপাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।
২০. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াইবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবেন।
২১. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হইবে, তিন মাসের মধ্যে তাহা পূরণের জন্য উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইবে এবং পরপর তিনটি উপ-নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হইলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিবেন।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিলো। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটি ছিলো প্রথম সংবিধান। নানা কারণে সংবিধান প্রণয়নে এত দেরী হয়েছিলো। তবে এর মধ্যে মুসলিম লীগের গাফিলতি ছিলো সবচেয়ে বড় কারণ। এই সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের মাত্র দুবছরের মাথায় ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জেনারেল আইয়ুব খান অবৈধভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সামরিক শাসন কায়েম করেন। আর এভাবেই পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান হয়। পূর্ব পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য সকল রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকানো হয়। সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে একধরণের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। সংবিধান স্থগিত করা হয়।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পরবর্তী পাঁচ বছর পূর্ব পাকিস্তানীরা কোন প্রকার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এই সময়ের মধ্যে তিনি “মৌলিক গণতন্ত্র” নামে এক ধরণের উদ্ভট ধরণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করেন। সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। সময় গড়ায়। রাজনৈতিক চাপ বাড়ে। তাই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেতাদেরও তিনি মুক্তি দিতে থাকেন। ততদিনে অবশ্য পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে।
১৯৬২ সালে আইযুব খান রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা ভিত্তিক একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। এ বিষয়ে বাংলাপিডিয়া লিখেছে,
“১৯৬২ সালের ১লা মার্চ আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা ভিত্তিক একটি সংবিধান বহাল করেন এবং এতে করে তিনি দেশে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন। ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের উভয় অংশেই মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারি পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিপূর্বে নির্বাচিত ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রী এই নির্বাচনে নির্বাচকমন্ডলী হিসেবে কাজ করে। বিরোধী দলীয় প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।”
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা সংস্কারের জন্য “শরিফ কমিশন” গঠন করা হলে এর বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন গড়ে ওঠে। কারণ উক্ত কমিশনের অনেক সংস্কার প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছিলো। বলা হয়ে থাকে পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো তার বীজ নিহিত ছিলো ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলনের মধ্যেই। “শরিফ কমিশন” শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হয়েছিলো তার সম্পর্কে বাংলাপিডিয়া লিখেছে,
“পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব এস এম শরীফকে চেয়ারম্যান এবং দশজন শিক্ষাবিদকে সদস্য করে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর জাতীয় শিক্ষা বিষয়ক কমিশন কমিশন গঠন করে। চেয়ারম্যানের নামানুসারে এই কমিশন ‘শরীফ কমিশন’ নামেও পরিচিত। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে কমিশনের কার্যক্রম উদ্বোধনকালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কমিশনের ম্যান্ডেট নির্ধারণ করে দেন যেন এমন একটি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করে যাতে স্বাধীন পাকিস্তানের অন্তর্জাগতিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আরো স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় এবং এই শিক্ষা ব্যবস্থা কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নয়নে সহায়তা করে জাতির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পুরণ করতে পারে।
কমিশন ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে শিক্ষাকে একটি উৎপাদনমুখী কার্যক্রম এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে জাতীয় বিনিয়োগ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে নিম্নোক্ত সুপারিশ পেশ করা হয়:
(ক) আবাসিক মাধ্যমিক স্কুল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উৎসাহ দান করতে হবে;
(খ) মাধ্যমিক স্কুল কারিকুলামে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রবণতার কতিপয় ঐচ্ছিক বিষয়সহ গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
(গ) ইন্টারমিডিয়েট কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উপর ন্যস্ত করতে হবে;
(ঘ) ডিগ্রি কোর্স তিন বছর মেয়াদি করতে হবে;
(ঙ) প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য সমন্বিত বৃত্তি প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে;
(চ) নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশ্বের এ অংশে শিক্ষার স¤প্রসারণ অনেকাংশে ব্যাক্তি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফল এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা নেহাতই কম বিধায় কমিশন সরকার ও জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন যেন তারা এ যাবতকাল যে দায়িত্বভার বহন করে এসেছেন তার চেয়েও বেশি দায়ভার গ্রহণ করেন। কাজেই কমিশন প্রস্তাব দেয় যে, যেখানে সরকার ও কম্যুনিটিকে সমভাবে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে হবে, সেখানে মাধ্যমিক শিক্ষায় ব্যয়ের তিন-পঞ্চমাংশ সংগ্রহ করতে হবে ছাত্রবেতন থেকে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কম্যুনিটিকে আগের চেয়ে শিক্ষাব্যয়ের আরো বেশি অংশ বহন করতে হবে।
শরীফ কমিশনের রিপোর্ট ছিল শিক্ষার বহুতর বিষয় সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ। কমিশন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং জাতীয় ভাষার উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছে। কমিশন প্রশাসনিক কাঠামোতেও কতিপয় মৌলিক পরিবর্তনের সুপারিশ করে, যেমন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ, পরীক্ষা পদ্ধতির পুনর্বিন্যাস এবং কারিগরী শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন ব্যবস্থাপনা কাঠামো উদ্ভাবন। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এই রিপোর্টের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে এক কথায় বলা যায়:
‘(ক) একজন ভালো কর্মী, (খ) একজন ভালো নাগরিক, (গ) একজন ভালো ব্যক্তি এবং (ঘ) একজন ভালো দেশপ্রেমিক’ গড়ে তোলা। কমিশন একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও বাস্তবায়ন পরিকল্পনার অভাবের কারণে এ নীতিমালায় ঐসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পুরণে সুস্পষ্ট কর্মকৌশল নির্দেশে ব্যর্থ হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ শরীফ কমিশনের রিপোর্টকে সরাসরি প্রত্যাখান করে। তারা রিপোর্টের গোটা বক্তব্যকে গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল এবং বাঙালিদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলে চিহ্নিত করে। ছাত্রদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার অধিকারের অস্বীকৃতি, ভর্তি ও প্রমোশনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি শর্ত আরোপ এবং পাবলিক পরীক্ষার মান উন্নীত করে উচ্চতর শিক্ষালাভের সুযোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রি কোর্স, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি ভাষা কোর্সের গুরুভার, নতুন প্রস্তাবিত সিলেবাসে অধিকতর গুরুভার কোর্স আরোপ, স্কুল ও কলেজে ছাত্রবেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব, প্রভৃতি পদক্ষেপ ছাত্র সমাজকে শরীফ কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রলুদ্ধ করে। ১৯৬৪ সালে যখন ছাত্র আন্দোলন প্রকট রূপ নেয় তখন সরকার একটি সমঝোতায় এসে তাৎক্ষণিকভাবে কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়।”
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলনের পর রাজনীতির মাঠ আবার শীতল হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে এসে একাধিক ঘটনার কারণে রাজনীতির মাঠ আবারও গরম হয়ে ওঠে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ সহ আরও অনেক ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হয়েছিলো তার সম্পর্কে বাংলাপিডিয়া লিখেছে,
“গণমুখী শিক্ষানীতির অনুকূলে ছাত্রসমাজ কর্তৃক শরীফ কমিশন রিপোর্ট প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে ছাত্র সমস্যা ও ছাত্র কল্যাণ বিষয়ে একটি নতুন কমিশন নিয়োগ করে। কমিশন এর রিপোর্টে দেশের এলিট শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করে যা সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কমিশন মতপ্রকাশ করে যে, ‘উচ্চমান ও নিম্নমানের স্কুলের ধারণা একদিকে যেমন আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তেমনি সঙ্গতিপূর্ণ নয় ইসলামের সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতির সঙ্গে যা আমাদের সংবিধানের মুখবন্ধে রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি হিসেবে বিধৃত হয়েছে।”
আমাদের রাজনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়টা ছিলো ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ। এই বছরই শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে একটু বলে রাখতে চাই। তার জন্ম হয়েছিলো ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মার্চ। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হয়েছিলেন কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বর্তমানে যা আজাদ কলেজ নামে পরিচিত। এরপর ওখান থেকে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে আইএ ও ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিএ পাশ করে দেশ ভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন।
কোলকাতায় থাকা অবস্থায় ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ঢাকায় ফিরে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হলেও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের প্রতিবাদে যোগ দিলে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কারনে ছাত্রত্ব হারানোর কারনে তার আইন পড়া ওখানেই থেমে যায়। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠনেও তার অগ্রণী ভূমিকা ছিলো। এর পর যোগ দেন ভাষা আন্দোলনে। প্রায়ই জেলে যেতেন। সেখান থেকেই নেতৃত্ব দিতেন। প্রথমে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ও পরবর্তীতে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর পরই তিনি পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের রূপরেখা ছয় দফা পেশ করেন।
ঐতিহাসিক ছয় দফা :
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ফেব্রæয়ারী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন। ৬ দফা নিম্নরূপ :
১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি :
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হইবে। সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ণ প্রাদেশিক স¦ায়ত্তশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অঞ্চলগুলোকে পূর্ণ আঞ্চলিক স¦ায়ত্তশাসন দিতে হইবে। পাকিস্তানে সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হইবে এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন সভায় সার্বভৌমত্ব থাকিবে।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা :
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল দুইটি বিষয়, যথা- দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতিতে সীমাবদ্ধ থাকিবে।
৩. মুদ্রা ও অর্থ স¤¦ন্ধীয় ক্ষমতা :
(ক) দুটি প্রদেশের জন্য দুুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকিবে। অথবা
(খ) সমগ্র দেশের জন্য একটি মুদ্রাই রাখা যাইতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান হইতে পশ্চিম পাাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকর সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ এবং পৃথক অর্থ ও মুদ্রা বিষয়ক নীতি থাকিবে।
৪. রাজস¦, কর ও শুল্ক স¤¦ন্ধীয় ক্ষমতা :
কর ধার্যের কোনো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের থাকিবে না। এই ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলির হাতে ন্যস্ত থাকিবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্যের রাজস্বের একটা নির্দিষ্ট অংশ লাভ করিবে।
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা :
পাকিস্তান ফেডারেশনভুক্ত দুইটি অঙ্গরাজ্যের (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুইটি পৃথক খাত হিসেবে রাখা হইবে। বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত পূর্ব পাকিস্তানের আয় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে বা সর্বসম্মত কোনো হারে অঙ্গরাজ্যগুলিই মিটাইবে। অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোনো বাধা নিষেধ থাকিবে না। সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলির বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স¦-সার্থে বিদেশের সহিত বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হইবে।
৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা :
আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হইবে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ইহার নিজস¦ আধাসামরিক আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও পোষণ করার অধিকারী হইবে।
এই ছয় দফা সত্যি সত্যি একটা ঢেউ তুলে দেয়। নাড়িয়ে দেয় সামরিক শাসক আইয়ুব শাহীর সিংহাসন। ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সাল জুড়ে থেমে থেমে আন্দোলন চলতে থাকে।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকেই সেই আন্দোলন আগুনের মত দাউ দাউ করে জ¦লে ওঠে। জানুয়ারী ও ফেব্রæয়ারী এই দুই মাসেই শহীদ হন আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. জোহা প্রমুখেরা। অবশ্য এর সূত্রপাত হয়েছিলো সেই ১৯৬৬ সালে গ্রেফতার হওয়া বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অন্যায় অপরাধ মূলক মামলা যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামেই ইতিহাসে পরিচিত এবং এর বিরুদ্ধে অন্যায় বিচার প্রক্রিয়া চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে প্রতিবাদ স্বরূপ।
এখানে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এমন একটি রাষ্ট্রদ্রোহীতার অন্যায় অপরাধ মূলক মামলা যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা দাবী করে যে বিভিন্ন স্তরের বেশ কিছু মানুষ যাদের মধ্যে বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের সংখ্যাই বেশী শেখ মুজিবকে সাথে নিয়ে ভারতের সহযোগিতায় পাকিস্তান ভাঙ্গার গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো। আর এ ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলো ভারতের ত্রিপুরার অন্তর্গত আগরতলা নামক জায়গায়। অনেকেই শেষমেষ এটাই ধরে নিয়েছিলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের ফাঁসি না হলেও কম পক্ষে হলেও যাবজ্জীবন সাজা তো হবেই। কিন্তু বাঙালির ভালোবাসা তাকে আবারো বাঙালির মাঝে ফিরিয়ে আনে।
আন্দোলন একটা ভিন্ন মাত্রা পায় ২০শে জানুয়ারী ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামানের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলন আরও বেগবান হয় যখন ১৫ই ফেব্রæয়ারী ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে সেনা সদর দপ্তরে বন্দী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। আর এভাবেই পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। ১৮ই ফেব্রæয়ারী ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হলে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।
এখানে উল্লেখ করা দরকার ১৯৬৯ সালের শুরু থেকে যে আন্দোলন জমে উঠেছিলো তার মূল অবদান ছিলো ছাত্রদের। এ সময় ছাত্ররা ছয় দফাকে অন্তর্ভুক্ত করে ১১ দফা দাবী পেশ করে।
ছাত্রদের ১১ দফা
পাকিস্তানের আবালবৃদ্ধবনিতা, ছাত্র-জনতা, কৃষক-মজুর, মেহনতী শিক্ষক, ডাক্তার-কবিরাজ, রিকশাওয়ালা, ডোম-মেথর, মাঝি-কুলি, দেশের সকল শ্রেণি, সকল স্তরের মানুষ এক বাক্যে সমস্ত অন্তর দিয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফা সমর্থন করেছিল। ১১ দফাকে তাদের প্রাণের দফা বলে স্বীকার করে নিয়েছিল।
মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছাত্র জনতার ১১ দফার সমর্থনে সুস্পষ্ট এবং দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন, “ছাত্রদের ১১ দফা সারা পাকিস্তানের ১২ কোটি জনতার দাবি। এই ১১ দফা সঠিকভাবে কায়েম হলে আমাদের দলের ১৪ দফাও বহুলাংশে কায়েম হয়ে যাবে। সুতরাং ১১ দফার জন্যে শুধু ছাত্ররাই জীবন দেবে কেন? এই ১১ দফার জন্যে কৃষক-মজুর, মেহনতী মজলুম জনগণও অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিবে। ”
এই ১১ দফার আন্দোলনে কৃষক সমিতির সদস্য ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান প্রথম শহীদ হন। এই ১১ দফা দাবির ওপর তিনি রক্তের স্বাক্ষর অঙ্কিত করে অমর হয়ে রয়েছেন। শত শত ছাত্র-জনতার প্রাণরক্তে জনতার মুক্তিসনদ ১১ দফা লিখা হয়ে গেছে।
১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রæয়ারী বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভের পর পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান লক্ষাধিক জনতার সামনে সুস্পষ্টভাবে ওয়াদা করেছিলেন, “১১ দফা দাবির ভেতরে আমাদের দলের ৬ দফাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সুতরাং ছাত্রদের ১১ দফা কায়েম করার সংগ্রামে আমরাও শরীক হবো। তিনি প্রসঙ্গক্রমে আরও বলেন যে, ছাত্র-জনতা আমাকে ফাঁসির কবল থেকে মুক্ত করে এনেছে। তাদের সাথে আমি বিশ্বসঘাতকতা করব না, করতে পারি না। ”
জনতার রক্তের কালিতে লিখা সেই ঐতিহাসিক ১১ দফা নিম্নে দেওয়া হলো :
১।
ক) সচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং কলেজসহ প্রাদেশিকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিতে হবে।
খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং বেসরকারি উদ্দ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজসমূহকে সত্ত¡র অনুমোদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষা প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।
গ) প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আইএ, আইএসসি, আইকম ও বিএ, বিএসসি, বিকম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এমএ ও এমকম ক্লাস চালু করিতে হইবে।
ঘ) ছাত্র বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে। স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ডের সংখ্যা সৃষ্টি করিতে হইবে এবং ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না।
ঙ) হল, হোস্টেলের ডাইনিং হল, ক্যান্টিন খরচার শতকরা ৫০ ভাগ সরকার কর্তৃক সাবসিডি হিসাবে প্রদান করিতে হইবে।
চ) হল ও হোস্টেল সমস্যার সমাধাণ করিতে হবে।
ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হবে। অফিস-আদালতে মাতৃভাষা বাংলা চালু করিতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে।
জ) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে।
ঝ) মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশন ভর্তি প্রথা বন্ধ, মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের দাবি মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
ঞ) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ, ১০% ৭৫% রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সুব্যবস্থা, প্রকৌশলী ছাত্রীদের শেষ বর্ষেও ক্লাস দেওয়ার ব্যবস্থাসহ সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
ট) পলিটেকনিক ছাত্রদের কনডেন্স কোর্স-এর সুযোগ দিতে হইবে এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করিয়া একমাত্র সেমিস্টার পরীক্ষা ভিত্তিতেই ডিপ্লে¬ামা দিতে হইবে।
ঠ) টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনোলজি এবং আর্ট কলেজের ছাত্রদের সকল দাবি অবিলম্বে মানিয়া লইতে হইবে। আইইইআর ছাত্রদের দশ-দফা; সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্রদের, এমবিএ ছাত্রদের ও আইনের ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা ‘ফ্যাকাল্টি’ করিতে হইবে।
ড) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লে¬ামা ছাত্রদের কনডেন্স কোর্সের দাবিসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
ঢ) ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের আইডেন্টিকার্ড দেখাইয়া শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেশনে টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও এই কন্সেশন দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মতো বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোন স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাসে যাতায়েতের শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেশন দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেশন দিতে হইবে।
ণ) চাকুরীর নিশ্চয়তার বিধান নিশ্চিত করতে হবে।
ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে। এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দিতে হইবে।
থ) শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির প্রমাণ্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট সম্পূর্ণ বাতিল করিতে এবং ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হইবে।
২. প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে।
৩. নিম্নলিখিত দাবি সমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দিতে হইবে:
ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।
গ) দুই অঞ্চলের মধ্যে একটা মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে, যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেশন রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।
ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংক সমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।
ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বহিঃবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে। এবং বহিঃবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির প্রক্তিয়াধীন থাকিবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলি সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত ধারা অনুযায়ী প্রদান করিবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে অঙ্গরাষ্ট্রগলির মধ্যে আমদানী-রপ্তাণী চলিবে। এবং ব্যবসা বণিজ্য সম্পর্কে বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী-রপ্তানী করিবার অধিকার অঙ্গরাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতন্ত্রে বিধান করিতে হইবে।
চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করিতে হইবে।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতঃ সাব ফেডারেশন গঠন।
৫. ব্যাংক বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহত শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে।
৬. কৃষকের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করিতে হইবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণ প্রতি ৪০ টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে।
৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি বোনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কালাকানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান করিতে হইবে।
৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রন ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৯. জরুরি আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।
১০. সিয়াটো, সেন্টো, পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বহির্ভুত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে।
১১. দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারী পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহারের এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারীকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষে:
আবদুর রউফ, সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ।
খালেদ মোহাম্মদ, সাধারণ সম্পাদক
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ।
সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন।
সামসুদ্দোহা, সাধারণ সম্পাদক
পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন।
মোস্তফা জামাল হায়দার, সভাপতি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন।
দীপা দত্ত, সহ সম্পাদীকা
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন।
তোফায়েল আহমদ, সহ-সভাপতি
ডাকসু।
নাজিম কামরান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক
ডাকসু।
২২শে ফেব্রæয়ারী ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান এবং জেল থেকে মুক্ত হন। ২৩শে ফেব্রæয়ারী ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত হন।
সব চেয়ে মজার বিষয় এর কিছুদিন পর অর্থ্যাৎ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার স্থলাভিষিক্ত হন।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে সারা পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। পাকিস্তান জন্মের পর এটাই ছিলো সর্ব প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ১৬৭টি আসন লাভের মধ্য দিয়ে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অপর দিকে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮টি আসন লাভ করে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।
আওয়ামী লীগের এ বিজয় ছিলো এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। কারণ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা হস্তক্ষেপের টালবাহানা দেখা দিলে বিশ^ জনমত ও দেশের মানুষের একচেটিয়া সমর্থন লাভ করে আওয়ামী লীগ। যদিও তৎকালীন বিশে^র শ্রেষ্ঠ পরাশক্তি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট পাকিস্তানের পক্ষ নেয় কিন্তু ভারত ও রাশিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যে মিত্রশক্তি গড়ে তোলে তা আমেরিকা চীন পাকিস্তানের অক্ষশক্তির বিরূদ্ধে জয়ী হয়।
১৯৬৯ সালের ২৮শে নভেম্বর ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের ১ ইউনিট বাতিল করার প্রস্তাব “লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার” ঘোষনা করেন। এতে বলা হয় “এক ব্যাক্তি, এক ভোট”। এর অধীনেই ১৯৭০ সালের ৫ই অক্টোবরে জাতীয় গণপরিষদের নির্বাচনের ঘোষনা দেওয়া হয়।
এর পর এলো ১৯৭০ সালের নির্বাচন। যুগান্তকারী এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার শরিক দলগুলো সহ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। ন্যাশনাল এসেম্বলির ৩০০ টি আসনের মধ্যে ১৮০টিতে প্রতিদ্বন্ধিতার ফলে ১৬৭টিতে বিজয় লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টিতে জয়লাভ করে। অপরদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৩৮টি আসনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে ৮১টি আসনে জয়লাভ করে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
নানা ঘটনার প্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস এসে উপস্থিত হয়। জেনারেল ইয়াহিয়ার ১৪ই ফেব্রæয়ারির ঘোষণা অনুযায়ী ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু ১লা মার্চ রাষ্ট্রপতির পক্ষে আকস্মিক এক ঘোষনা বলে সেই অধিবেশন বাতিল করা হয়। সময় যত আগাতে লাগলো সমস্যা তত গাঢ় হতে লাগলো। মূলতঃ ইয়াহিয়া খানের দুমুখো নীতিই ছিলো প্রধান সমস্যা। তিনি শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন আবার ভুট্টোকেও খুশি রাখছিলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে এই অসহযোগিতা আর কূটকৌশল নতুন কিছু ছিলো না। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়া এবং ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালে সরকারের অসহযোগিতার কারণে দ্বিতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলীর ব্যর্থতায় এরকমই অসহযোগিতা আর কূটকৌশলের নজির ছিলো। অবশ্য এসব ঘটনাই বাংলাদেশের জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। শেখ মুজিব এই উভয় সরকারের একজন সদস্য ছিলেন এবং তিনি উক্ত পদ থেকে পদত্যাগ করে দলীয় কর্মকান্ডে মনোযোগ দেন।
২রা মার্চ সারাদেশে সকাল ৮টা থেকে ৭টার মধ্যেই তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানকারী ডাকসুর সভাপতি আ স ম আব্দুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে একটি র্যালী অনুষ্ঠিত হয়। র্যালী শেষে আ স ম আব্দুর রব বটতলায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। বর্তমান পতাকা ঐ পতাকার অনুরূপ। শুধুমাত্র তৎকালীন পতাকাটিতে সূর্যের মাঝখানে বাংলাদেশের যে মানচিত্র ছিলো তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
৩রা মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে আ স ম আব্দুর রব এবং শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ে শোনান। তাদের মনে হয়েছিল শেখ মুজিব হয়তো আলোচনায় বসবেন আর স্বাধীনতার জন্যে জনতার এই তুমুল উত্তেজনা হয়তো সেই আলোচনার নিচে চাপা পড়ে যেতে পারে। মুজিব অবশ্য শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আগানোর কথা বললেন। ৪ঠা মার্চ শেখ মুজিব জনগণকে স্বাগতম জানালেন তার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য। তিনি সকল সরকারী, বেসরকারী কর্মচারীদের যারা বেতন ভাতা পাননি তাদের বেতন ভাতা বরাদ্ধকরণের জন্য ২.৩০-৪.৩০ পর্যন্ত আগামী দুদিন হরতাল চলাকালীন সময়ে অফিস খোলা রাখার জন্য বললেন। টানা হরতালে দেশব্যাপী বহুলোকের প্রাণ গেল। অবশেষে এলো সে মহেন্দ্রক্ষণ। শেখ মুজিব লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন দিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
“ভায়েরা আমার,
আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসে¤¦লী বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলায় অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সনে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে জয় লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সনে আইয়ুব খান মার্শাল ’ল জারি করে ১০ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছিল। ১৯৬৬ সনের ছয় দফার আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সনের আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হবার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম ১০ই ফেব্রæয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভূট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন প্রথম সাপ্তাহের মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা অ্যাসে¤¦লিতে বসবো। আমি বললাম, যদি কেহ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভূট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন, বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ওদের সঙ্গে আলাপ করলাম; আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের মে¤¦াররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসে¤¦লী। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেহ অ্যাসে¤¦লিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসে¤¦লী চলবে। তারপরে হঠাৎ এক তারিখে অ্যাসে¤¦লি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসে¤¦লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাব। ভূট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। পঁয়ত্রিশ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেওয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো। আমি বললাম শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির-প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কী পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশক্রর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী আর্তমানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তাঁরা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান, কী ভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে? কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স¦ীকার করেছি যে, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলেছি কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন। বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন।
ভায়েরা আমার,
২৫ তারিখে অ্যাসে¤¦লী কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পারা দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসে¤¦লী কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব আমরা অ্যাসে¤¦লিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে অ্যাসে¤¦লীতে বসতে আমরা পারি না। আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাচারি, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিস্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোতে হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীম কোর্ট, হাই কোর্ট, জজ কোর্ট, সেমিগভর্নমেন্ট দফতরগুলো ওয়াপদা, কোনোকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো। পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্ত আর আমার বুকের উপরে গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যতদূর পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছায়া দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়া দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ দেবে না। শোনেন-মনে রাখবেন, শত্রæ বাহিনী ঢুকেছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও, টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমার নিউজ না দেয় কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা পত্র নেবার পারে। কিন্ত পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্ত যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব - এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের মধ্যরাতের পর পাকিস্তানী বাহিনীর অপারেশন “সার্চ লাইট” নামের গণ হত্যার অভিযানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে চূড়ান্তু পরিণতি পায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। আমরা লাভ করি একটি মানচিত্র এবং একটি লাল-সবুজের পতাকা। যুদ্ধ চলাকালীন সময়টাতে পাকিস্তানী বাহিনী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী করে রাখে। ২৫শে মার্চের মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের আগে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা
“এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহব্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।”
পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে বঙ্গবন্ধুর পূর্বের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ভারতে চলে যান। এই সময় বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে ও তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধান মন্ত্রী করে ১০ই এপ্রিল একটি অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৭ই এপ্রিল এই অস্থায়ী প্রবাসী সরকার কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহন করে। ভারতে অবস্থানরত এই প্রবাসী সরকারই মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেয়।
১০ই এপ্রিল এই অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করার পাশাপাশি একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরী করা হয়। ঘোষণাপত্রটি নি¤েœ দেওয়াহলো:
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
মুজিব নগর, বাংলাদেশ, ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১
“যেহেতু ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত একটি শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিল।
এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেন।
এবং
যেহেতু আহূত এ পরিষদ স্বেচ্ছাচার ও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
এবং
যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রæতি পালনের পরিবর্তে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতা মুলক যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এবং
যেহেতু উল্লে¬খিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জনান।
এবং
যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনাকালে বাংলাদেশের অসামরিক ও নিরস্ত্র জনসাধারণের বিরুদ্ধে অগুণিত গণহত্যা ও নজিরবিহীন নির্যাতন চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে।
এবং
যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একত্র হয়ে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে ও নিজেদের সরকার গঠন করতে সুযোগ করে দিয়েছেন।
এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসীকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের দ্বারা বাংলাদেশের ভূ-খন্ডের উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
সেহেতু
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন সে মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণ-পরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি। এবং এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
এবং
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমুহের সর্বাধিনায়ক হবেন, রাষ্ট্রপ্রধানই ক্ষমা প্রদর্শনসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন,
তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রয়োজনবোধে মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্য নিয়োগ করতে পারবেন,
রাষ্ট্রপ্রধানের কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের এবং গণপরিষদের অধিবেশন আহবান ও মুলতবির ক্ষমতা থাকবে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্যে আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে অন্যান্য সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, যে কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দ্বায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হয়েছে তা আমরা যথাযথভাবে পালন করব।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্যে আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ক্ষমতা দিলাম।
এবং রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলাম।”
অস্থায়ী সরকারের গঠন:
রাষ্ট্রপতি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী)
উপরাষ্ট্রপতি- সৈয়দ নজরুল ইসলাম (রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন)
প্রধানমন্ত্রী- তাজউদ্দীন আহমদ
মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীগণ:
মন্ত্রণালয়সমূহের নাম:
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
৩. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
৪. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়।
৫. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ।
৬. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
৭. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়।
৮. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়।
১০. সংসদ বিষয়ক বিভাগ।
১১. কৃষি বিভাগ।
১২. প্রকৌশল বিভাগ।
মন্ত্রীর নাম ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়:
১ তাজউদ্দীন আহমদ: ক- প্রধানমন্ত্রী, খ- প্রতিরক্ষা, গ- তথ্য ও বেতার এবং টেলিযোগাযোগ, ঘ- অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, ঙ- শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ, চ- সংস্থাপন ও প্রশাসন, ছ- যেসব বিষয়ের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদের অন্য কোন সদস্যকে প্রদান করা হয়নি।
২. খন্দকার মোশতাক আহমেদ: ক- পররাষ্ট্র বিষয়, খ- আইন ও সংসদ বিষয়
৩. এম মনসুর আলী: ক- অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব খ- বাণিজ্য ও শিল্প, গ- পরিবহন
৪. এ এইচ এম কামারুজ্জামান: ক- স্বরাষ্ট্র বিষয়ক খ- সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গ- কৃষি
মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরো কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত। যেমনঃ
- পরিকল্পনা কমিশন
- শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড
- নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
- ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
- শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড ।
১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ কালে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক যুগান্তকারী ভাষণ দান করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১-এর ভাষণ:
আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাবার জন্য বহু কষ্ট করে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।
আমি কিছু বলবার আগে প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সংবাদপত্র সেবী ও নিউজ এজেন্সির প্রতিনিধিদেরকে যে, তারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আগাগোড়া সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন এবং সত্য কথা প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। যদিও ইয়াহিয়া সরকার তাদেরকে এবং তার সেই দস্যুবাহিনী বিদেশী সাংবাদিকদেরকে ভিতরে আসতে দেয়নি, যারা ভিতরে ছিলেন তাদেরকেও জবরদস্তি করে ২৫ তারিখ রাতেই বের করে দিয়েছেন। আমি আপনাদেরকে আরও ধন্যবাদ দিচ্ছি, আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই জন্য যে, আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই সংগ্রাম কোন অবস্থাতেই যেন ব্যাহত না হয় এবং কোন অবস্থাতেই সে সংগ্রামকে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া না হয় সে জন্য আপনারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, সঠিক পথ দেখিয়েছেন।
আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে আবেদন জানাব ভবিষ্যতেও আপনারা দয়া করে চেষ্টা করবেন যাতে সঠিক সংবাদ পরিবেশিত হয়, যাতে কোন দু®কৃতিকারী বা কোন শত্রæ বা এজেন্ট ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের আন্দোলনের কোন ভুল ব্যাখ্যা করতে না পারে, ভুল বোঝাতে না পারে। সেই সাথে আমি আপনাদেরকে আরও অনুরোধ জানাব আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে হ্যান্ড আউট যাবে সেটাকেই বাংলাদেশ সরকারের সঠিক ভাষ্য বলে ধরে নিবেন, সেটাকেই ভিত্তি হিসাবে ধরে নিবেন। আর আমি আপনাদের আরও একটি অনুরোধ জানাব জানি না কিভাবে সেটা সম্ভব হবে, আমাদের বাংলাদেশের মাটি থেকে আপনারা কিভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন, কিভাবে বাংলাদেশ সরকারের সাথে লিয়াজোঁ করতে পারেন সেই ব্যাপারে আপনারা চিন্তা করে দেখবেন এবং সেই ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ আমরা অত্যন্ত সাদরে, আনন্দের সাথে গ্রহণ করব।
এখন আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমার ভাষ্য তুলে ধরব। বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের ঔপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশ গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে। কিভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তারা বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত আশা-আকাক্সক্ষাকে সত্যিকার ভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসাবে আওয়ামী লীগ পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ৬ দফার আলোকে বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ এই ৬ দফা নির্বাচনী ইসতেহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩ টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে মোট ১৬৭ টি আসন লাভ করেছিল। নির্বাচনী বিজয় এতই চূড়ান্ত ছিল যে, আওয়ামী লীগ মোট শতকরা ৮০ টি ভোট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
স্বভাবতই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন্য এক আশাময় দিন। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের এমনি চূড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। দুই প্রদেশের জনগণই বিশ্বাস করেছিলেন যে, এবার ৬ দফার ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু ও পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টি তাদের নির্বাচন অভিযানে ৬ দফাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। কাজেই ৬ দফাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার জন্যে জনগণের কাছে এই দলে জবাবদিহি ছিল না। বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল ৬ দফার পূর্ণ সমর্থক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও ৬ দফার আলোকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান গণতন্ত্রের আশাপ্রদ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করেছিল।
আশা করা গিয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদ আহবানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় বসবে। এমনি আলোচনার প্রস্তাব এবং পাল্টা প্রস্তাবের ওপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সবসময়ই সম্মত ছিল। তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে, যথার্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য গোপনীয় সম্মেলনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদেই গঠনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল যথাসত্বর জাতীয় পরিষদ আহবানের জন্য। আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে গেল এবং এধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও পরীক্ষা করে দেখল।
পকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলোচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ’৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে। এই বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের ৬ দফা ভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশে¬ষণ করলেন এবং ফল কী হতে পারে তারও নিশ্চিত ভরসা নিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন এক ভাব দেখালেন যে, ৬ দফায় সাংঘাতিক আপত্তি জনক কিছুই তিনি খুঁজে পাননি তবে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সাথে সমঝোতায় আসার উপর তিনি জোর দিলেন।
পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে ঢাকায় ২৭ জানুয়ারি ১৯৭১। জনাব ভুট্টো এবং তার দল আওয়ামী লীগের সাথে গঠনতন্ত্রের উপর আলোচনার জন্য এসময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন।
ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামো সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনয়ন করেননি। বরং তিনি এবং তার দল ৬ দফায় বাস্তব ফল কী হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনার প্রতিই অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল না সূচক এবং যেহেতু এ নিয়ে তাদের কোন তৈরি বক্তব্যও ছিল না সেহেতু এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপস ফর্মুলায় আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ দুই দলের মধ্য মতানৈক দূর করার জন্য প্রচেষ্ঠার দুয়ার সবসময়ই খোলা ছিল। এই আলোচনা বৈঠক থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোন পর্যায় থেকে আপস ফর্মুলায় আসা সম্ভব সে সম্পর্কেও জনাব ভুট্টোর নিজস্ব কোন বক্তব্য ছিল না।
এখানে একটি কথা আরও পরিষ্কার ভাবে বলে রাখা দরকার যে, আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের কোন আভাসও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যাননি। উপরন্তু তারা নিশ্চয়তা দিয়ে গেলেন যে, আলোচনার জন্য সব দরজাই খোলা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনার পর পাকিস্তান পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফায় আরো অধিক ফলপ্রসু আলোচনায় বসবেন। অথবা জাতীয় পরিষদে তারা ভিন্ন আলোচনায় বসার জন্য অনেক সুযোগ পাবেন।
পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিদ্ধান্ত এই জন্যই সবাইকে আরো বেশি বিস্মিত করে যে, শেখ মুজিবের দাবি মোতাবেক ১৫ই ফেব্রæয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতোই ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে সমস্ত দলের সদস্যের বিরুদ্ধে ভিতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত রাখা। এ কাজে ভুট্টোর হস্তকে শক্তিশালি করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ট সহচর লে. জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের উপর পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। জনাব ভুট্টো ও লে. জেনারেল ওমরের চাপ সত্তে¡ও পিপিপি ও কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পূর্ববাংলায় গমনের টিকিট বুক করেন। এমনকি কাইয়ুম লীগের অর্ধেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমনও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, পিপিপির বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোন কুলকিনার পাওয়া যাচ্ছিল না তখন ১লা মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া তার দোস্ত ভুট্টোকে খুশি করার জন্য। শুধু তাই নয় জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ববাংলার গভর্নর আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। গভর্নর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনের মধ্যপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালিদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারী জান্তুার হাতে তুলে দেওয়া হলো।
এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোন ক্রমেই ভুট্রোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণরায় বাঞ্চাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল একমাত্র স্থান। যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরী করতে পারত এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারত। এটাকে বাঞ্চাল করার চেষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমতার উৎস না করে একটা ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করার।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের স্থগিতের প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃফুর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারি রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এক পাকিস্তানের কাঠামো বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোন সম্ভবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহবান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাই তারা একবাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন।
শেখ মুজিব এতদসত্তে¡ও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩রা মার্চ অসহযোগ কর্মসূচির আহবান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখনো তিনি আশা করছিলেন যে, সামরিক চক্র তাদের জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২রা ও ৩রা মার্চ ঠান্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্র্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নজির প্রথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শেখ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকর অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণপ্রশাসন বিভাগের কর্মচারীগণ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারীগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকে ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকেরাও সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারও নির্দেশ মেনে চলবে না।
এ অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হলো। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী স¤প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলী সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সামাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলীর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্তে¡ও পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ই মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কনফ্রন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হলো। কেননা তার ঐদিনের প্ররোচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সঙ্কটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামী লীগের ওপর। অথচ যিনি ছিলেন সঙ্কটের স্থপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যেগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকার সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ। লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পাঠানো হলো লে. জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনোভাবের পরিচয়।
কিন্তু ইতিমধ্যেই মুক্তি পাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে উঠে। এ সত্তে¡ও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যোগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর জন্য ইয়াহিয়াকে দেওয়া হয় তার শেষ সুযোগ।
বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটা আজ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, অনুরূপ একটি গণহত্যা সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেয়া হয়েছিল।
১লা মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত ট্যাঙ্কগুলো ফেরত আনা হয়। ১লা মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানি কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবার সমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লোকদের পরিবার পরিজনদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে।
১লা মার্চের পর থেকে বাংলাদেশে সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পিআইয়ের কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পোশাকের সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের বাংলাদেশে আনা হলো। সি ১৩০ পরিবহন বিমানগুলোর সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশে স্থাপিত করা হয়।
হিসাব নিয়ে জানা গেছে, ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চের মধ্যে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানী করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরকে বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমানবন্দর এলাকায় আর্টিলারি ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন-নির্গমনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকান্ড সংগঠনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একদল এসজি কমান্ডো গ্রæপ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৫শে মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যেসব কুকান্ড ঘটে এরাই সেগুলো সংঘটন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এসবের উদ্দেশ্য।
প্রতারণা বা ভন্ডামির এই স্ট্রাটেজি গোপন করার অংশ হিসাবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আলোচনায় আপসমূলক মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ই মার্চ আলোচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪ দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাব কী? জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে, ৪ দফা শর্ত পূরণের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন।
আলোচনাকালে যেসব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলো হলো:
১। মার্শাল ল’ বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
২। প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
৩। ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন।
৪। জাতীয় পরিষদ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথক ভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন।
আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনোনয়নের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ৬ দফা হলো বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযোগ্য নীল নকশা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়োগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি এমএনএদের পৃথক ভাবে বসে ৬ দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলোপের আলোকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।
শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং তাহলো অন্তবর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বণ্টন। এক্ষত্রেও উভয় পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মোটামুটি তার আলোকেই কেন্দ্র বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হবে। অন্তবর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ আলোচনায় তিনি স্পষ্টভাবে একথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬ দফা কার্যকর করার প্রশ্নে দুর্লভ কোনো সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তবর্তী পর্যায়েও না।
আওয়ামী লীগের খসরার উপর তিনি যে তিনটি সংশোধনী পেশ করেছিলেন তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে তা নিয়ে। ২৪শে মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশোধনীগুলো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোন বাধাই ছিল না।
এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিস্কার করে বলতে হয়, কোন পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস ইঙ্গিতেও এমন কোন কথা বলেননি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না।
গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোচ্চুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি এবং তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাকড়া তুলেছেন ইয়াহিয়া তাই অনুমোদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার ইয়াহিয়া ঘুণাক্ষরেও এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার, ইয়াহিয়া যদি আভাস ইঙ্গিতেও একথা বলতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই আপত্তি করত না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা করে আলোচনা বাঞ্চাল করতে দেওয়া যায় না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশি করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোন সময়ই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না।
২৪শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে এম এম আহমদ তার সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এ খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহবানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোন চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং এম এম আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫শে মার্চ করাচি চলে গেলেন।
২৫শে মার্চ রাত ১১টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে পজিশন গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত নাগাদ ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হলো গণহত্যার এক পূর্বনির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোন চরমপত্র। অথবা মেশিনগান, আর্টিলারি সুসজ্জিত ট্যাঙ্কসমূহ যখন মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারি করা হয়নি কোন কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লে. জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারি করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লোক তার আগেই প্রাণ হারিয়েছেন বিনা প্রতিরোধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুন্ডে। প্রতিটি অলিগলি আনাচে কানাচে চলতে লাগল নির্বিচারে গুলি। সামরিক বাহিনীর লোকদের নির্বিচারে অগ্নিসংযোগের মুখে অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যে সব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করল তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয় মেশিনগানের গুলিতে।
আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ইপিআর বীরের মতো লড়ে গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোন প্রতিরোধ দিতে পারল না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটা নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং শিগগিরই তা প্রকাশ করব। মানুষ সভ্যতার ইতিহাসে যে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে ¤ø¬ান করে দিয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙালি হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসিকে জানাতে হলো এর কৈফিয়ত। এই বিবৃতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসিকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পরবিরোধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন সে দলের লোকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ-আলোচনায় কোন সঙ্গতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবাধ মত প্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারল না। তার বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো যে, ইয়াহিয়া আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন্য জঙ্গি আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর।
পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুলঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসাবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের উপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোন মতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতীকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদারি সৈনিকরা লঙ্ঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারি পশুর মতো। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এসব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে, ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো তাহলে তারা একই দেশের মানুষের উপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারত না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচারে গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানের বিয়োগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালির রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পোড়ামাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতীকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হলো আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলোকে ধুলিসাৎ করা, যাতে একটি জাতী হিসেবে কোন দিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।
ইতোমধ্যে এই লক্ষ্যপথে সেনাবাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শোষণ করেছে, তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার হিসেবে সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে পড়ল।
বেলসেন এবং অসউহজের পর গণহত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উটপাখির নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন যে, এতদ্বারা তার পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তাহলে তারা ভুল করেছেন। কেননা পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মোহমুক্ত। তাদের বোঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশের আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোন জাতী এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।
সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট বিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাব। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যহত রাখা সম্ভব নয়।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হলো বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সৃষ্ট ভস্ম ও ধ্বংসস্তুপের উপর একটা নতুন দেশ গড়ে তোলা। এ একটা দুরুহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দারিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ একটা ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণপণে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতেই হবে।
আমার বিশ্বাস যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এতো ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোন বাধা বিপত্তি টিকতে পারে না।
আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোন শক্তি, বøক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না। আমরা আশা করি শুধু শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারও তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এতো রক্ত দেয়নি, এতো ত্যাগ স্বীকার করে নি।
আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতি সমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন আর কালবিলম্ব করবেন না। এ মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুণ।
বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি।”
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রায় এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার এক বৎসর সময়কাল এদের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধে ভারত সরকার অস্থায়ী প্রবাসী সরকারকে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
বাংলার বীর সন্তানেরা কেউ কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করে, কেউ কেউ বিভিন্ন ধরণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে আমাদের যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ। এছাড়া সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ভূমিকাও চির স্মরণীয় হয়ে আছে।
১৯৭১ সালে সংগঠিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচলনায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র ভূখন্ডকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র বা সেক্টরে ভাগ করা হয়।
১নং সেক্টর: চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ (মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত) মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম
২নং সেক্টর এবং “কে” ফোর্স: ফরিদপুর এর পূর্বাঞ্চল, ঢাকা শহরসহ ঢাকা জেলার দক্ষিণাংশ, কুমিল্লা জেলা (আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেললাইনের উত্তরাংশ বাদে) এবং নোয়াখালী জেলা (মুহুরী নদীর পূর্বাঞ্চল বাদে) মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম
৩নং সেক্টর এবং “এস” ফোর্স: কুমিল্লা জেলার অংশবিশেষ (আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেললাইনের উত্তরাংশ), সিলেট জেলার অংশবিশেষ (লাখাই-শায়েস্তাগঞ্জ লাইনের দক্ষিণাংশ), ঢাকা জেলার উত্তরাংশ ও ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমা মেজর জেনারেল কে. এম. সফিউল্লাহ, বীর উত্তম
৪নং সেক্টর: সিলেট জেলার অংশবিশেষ (১) পশ্চিম সীমান্ত: তামাবিল-আজমিরীগঞ্জ-লাখাই লাইন এবং (২) দক্ষিণ সীমান্ত: লাখাই-শায়েস্তাগঞ্জ লাইন মেজর জেনারেল সি. আর. দত্ত, বীর উত্তম
৫নং সেক্টর: সিলেট জেলার বাকি অঞ্চল (তামাবিল-আজমিরীগঞ্জ লাইনের পশ্চিমাংশ) লেঃ জেনারেল মীর শওকত আলী, বীর উত্তম
৬নং সেক্টর: যমুনার পশ্চিমে রংপুর ও দিনাজপুর জেলা, দিনাজপুরের রাণীশঙ্কৈল-পীরগঞ্জ-বীরগঞ্জ লাইনের উত্তরাংশ ও রংপুর জেলার পীরগঞ্জ-পলাশবাড়ী লাইনের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল এয়ার ভাইস-মার্শাল এম. কে. বাশার, বীর উত্তম
৭নং সেক্টর: সমগ্র বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা জেলা, দিনাজপুর ও রংপুরের অংশবিশেষ (দিনাজপুরের রাণীশঙ্কৈল-পীরগঞ্জ লাইনের দক্ষিণাংশ ও রংপুরের পলাশবাড়ী-পীরগঞ্জ লাইনের দক্ষিণাংশ) লেঃ কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান, বীর উত্তম (আগষ্ট ১৯৭১ থেকে মেজর নাজমুল হক আগষ্ট ১৯৭১ পর্যন্ত)
৮নং সেক্টর: কুষ্টিয়া ও যশোর এর সমগ্র এলাকা, ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ, খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমা। সীমানাঃ উত্তরে পদ্মা নদী। পদ্মা-যমুনার মোহনা থেকে মাদারীপুর পর্যন্ত এর পূর্ব সীমান্ত এবং মাদারীপুর-সাতক্ষীরা কাল্পনিক লাইন ছিল দক্ষিণ সীমান্ত মেজর জেনারেল এম. এ. মনজুর, বীর উত্তম
৯নং সেক্টর: সমগ্র বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা জেলা (সাতক্ষীরা বাদে), ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ এবং গোপালগঞ্জ মেজর এম. এ. জলিল
১০নং সেক্টর: কোন আঞ্চলিক সীমানা ছিল না। কেবলমাত্র নৌ-কম্যান্ডোদের নিয়ে গঠিত। যে সেক্টরের এলাকায় কম্যান্ডো অভিযান চালানো হতো, কম্যান্ডোরা সেই সেক্টর কমান্ডারের অধীনে কাজ করত।
১১নং সেক্টর: কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা। উত্তরে যমুনা নদীর তীরে বাহাদুরাবাদ ঘাট ও ফুলছড়ি ঘাট কর্ণেল এম. আবু তাহের, বীর উত্তম
জেড্ ফোর্স: ১১ নং সেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সিলেট জেলায় যুদ্ধ করে লেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম
টাঙ্গাইল এলাকার স্বতন্ত্র সেক্টর: ১১ নং সেক্টর এলাকা কাদের সিদ্দিকী
আকাশপথ: বাংলাদেশের সমগ্র আকাশসীমা গ্রæপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার
মুক্তিযোদ্ধারা যেমন স্বাধীনতার পক্ষে লড়েছিলো তেমনি আমাদের দেশেরই কিছু লোক স্বাধীনতার বিপক্ষেও অবস্থান নিয়েছিলো। এরা অত্যন্ত নগ্নভাবে পাক হানাদার বাহিনীকে সমর্থন করেছিলো। মুক্তিবাহিনীর বিপরীতে এরা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস প্রভৃতি বাহিনীগুলো গড়ে তুলেছিলো। এই বাহিনীগুলোর সদস্যরা পাক বাহিনীর এ দেশীয় দোসর হিসেবে কাজ করেছিলো। এরা পাক বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ী চিনিয়ে দিত। মুক্তিযোদ্ধাদের মা বোনদের তুলে নিয়ে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে দিয়ে আসত তাদের আরাম আয়েশের জন্যে।
ডিসেম্বরের শুরুর দিকে ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একটি ভিন্ন মাত্রা পায়। জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে - সব ধরনের যুদ্ধেই পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় যৌথ বাহিনীর হাতে পরাজিত হতে থাকে। মাত্র দশদিনের যুদ্ধেই পাক বাহিনীর দফারফা হয়ে যায়। মূলত ১০ই ডিসেম্বর আসতে না আসতেই তাদের পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়।
এ সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। পাকিস্তানের মিত্র আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করার হুমকি দেয় এবং সেটা রওয়ানা হয়ে কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এসময় রাশিয়াও বঙ্গোপসাগরের মুখে যুদ্ধ জাহাজ প্রেরণ করে। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আগেভাগেই রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে নেয়। তার এই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত যে কতোটা কার্যকর হয়েছিলো তা পরবর্তীতে প্রমানিত হয়েছিলো।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাগুলোর একটি হলো বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে পাক বাহিনী যখন বুঝতে পারলো যে এদেশ তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তখনই তারা এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বাঙালি জাতিকে চিরদিনের জন্যে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্যে দেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষগুলোকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ করে ১৪ই ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশী বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।
১৬ই ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে রেসকোর্সের ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পরাজিত পাক বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়েই আমরা লাভ করেছিলাম আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যেমন একটি স্বাধীন দেশ ও একটি লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি তেমনি আবার অনেক কিছুই হারিয়েছি। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দু’লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার ইতিহাসই আজ বাঙালির সবচেয়ে গর্বের বিষয়।
মোট খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা (৬৭৬+১) =৬৭৭
বীরশ্রেষ্ঠ = ৭ জন
বীরশ্রেষ্ঠদের তালিকা নিচের সারণিতে দেয়া হল:
০১ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী)
০২ সিপাহী হামিদুর রহমান (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী)
০৩ সিপাহী মোস্তফা কামাল (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী)
০৪ ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন (বাংলাদেশ নৌবাহিনী)
০৫ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (বাংলাদেশ বিমান বাহিনী)
০৬ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ (বাংলাদেশ রাইফেলস)
০৭. ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ (বাংলাদেশ রাইফেলস)
বীর উত্তম (৬৮+১) = ৬৯ (সর্বশেষ= ব্রিগেডিয়ার জামিল উদ্দীন)
বীর বিক্রম = ১৭৫
বীর প্রতীক = ৪২৬ (মহিলা=২, নিখোজ= ৫৫। কিন্তু দেবদাস বিশ্বাস ওরফে খোকা বিশ্বাস বীর প্রতীক নামে ঝালকাঠির এক ব্যক্তিকে সনাক্ত করেন বিমল কান্তি দে। তাই বর্তমানে নিখোঁজ সংখ্যা হবে ৫৪)
.
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত ৬৮ জন। কিন্তু মোট বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্তের সংখ্যা ৬৯ জন। ২০১০ সালে ’৭৫ এর অভ্যুত্থানের সময় বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হওয়া ব্রিগেডিয়ার জামিলকে বীর উত্তম খেতাব দেয়া হয়। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোজাফ্ফর আহমেদ কে বীর বিক্রম খেতাব দেয়া হয়।
তাই মুক্তিযুদ্ধে ১৭৫ জন বীর বিক্রম খেতাব পেলেও মোট বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত ১৭৭ জন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত ২ জন সহ মোট বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত ১৭৭ জন। তবে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত ১৭৫ জন।
.
নারী মুক্তিযোদ্ধা- ২ জন (২ জনই বীরপ্রতীক) (সেতারা বেগম ও তারামন বিবি)
নারী মুক্তিযোদ্ধা- সেতারা বেগম, তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি
আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি যিনি খাসিয়া উপজাতির এবং তার আসল নাম কাকাত হেনইঞ্চিতা
সর্বকনিষ্ঠখেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা-শহীদুল ইসলাম চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধেও সময় তাঁর বয়স-১২ বছর)
একমাত্র আদিবাসী/উপজাতি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা- ইউ কে চিং (বীরবিক্রম)
একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক-ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড (অস্ট্রেলিয়া; জন্ম নেদারল্যান্ড) ওডারল্যান্ড মারা যান- ১৮ মে ২০০১ সালে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ৮ই জানুয়ারী তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেখান থেকে লন্ডন ও দিল্লী হয়ে ১০ই জানুয়রি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শুরু হল স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন অধ্যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সামনে আগানো হলো। একটা কথা বেমালুম এড়িয়ে যাওয়া হলো যে স্বাধীনতার পূর্বের পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তবতা আর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতা এক নয়। তাই সবকিছু নতুন আঙ্গিকে ভাববার প্রয়োজন ছিলো।
সে যাই হোক বঙ্গবন্ধু নতুন সরকার গঠন করে দেশ গড়ার কাজে হাত দিলেন। তার দেশে ফেরার আগেই ষড়যন্ত্র বা মতবিরোধ থেকে মতভেদ উদ্ভুত হয়ে গিয়েছিলো যা ছিলো অত্যন্ত লজ্জার। ছাত্রলীগের মধ্যবর্তী অন্তর্দ্ব›দ্ব, আওয়ামী লীগের মধ্যবর্তী ডান ও বাম ঘরাণার দুটো পৃথক মেরুর দুটো গ্রæপ, মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট, চীনপন্থি কমিউনিস্ট যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এবং নতুন সরকারকে ব্যর্থ করে তাদের শ্রেণী সংগ্রামকে বাস্তবায়ন করার স্বপ্নে বিভোর, পরবর্তীতে জাসদের জন্মলাভ ও আওয়ামী লীগের মুখোমুখি দাঁড়ানো এসব ঘটনাবলির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সব মিলিয়ে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে।
একই সময়ে যুগপৎ খাদ্য সরবরাহ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে ধারাবাহিক বন্যা, খরা, মহামারির পাশাপাশি অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের সিন্ডিকেট তৈরির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কিছু অতি লোভী ও অতি উৎসাহী লোকজনের সাথে আওয়ামী লীগে ছদ্দবেশে ঢুকে পড়া বহিরাগত স্বাধীনতা বিরোধীদের সূ² ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে।
সদ্য স্বাধীন দুর্বল অর্থনীতির দেশটির পুণর্গঠন ও পুনর্বাসন যেখানে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার যেখানে এ ধরনের বহুমুখী ও সাংঘর্ষিক উপাদানগুলো সরকারকে দিন দিন শুধু অসহায় করে ফেলাই নয় বরং অনেকের ভাষ্যমতে শেষের দিকে মুজিব কোন একটা মিরাক্ল আশা করেছিলেন। মিরাক্ল তো ঘটেইনি বরং কতিপয় বিপথগামী জেনারেল কর্তৃক ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্টের শেষরাতে অর্থাৎ ১৫ই আগস্টের ভোররাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন।
নিয়মিত সামরিক বাহিনী সহ রক্ষী বহিনী ও অন্য কোন বাহিনীই সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে শেখ মুজিব ও তার পরিবারকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে আসেনি। যাদের জন্যে মুজিব সারা জীবন কেঁদেছেন সেই বাঙালিরাই তার রক্তে তারই গড়া স্বদেশকে রক্তাক্ত করেছিল।
মূল অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন ফারুক ও ডালিম, তবে হত্যাকান্ডের পর রশিদকেই বেশী তৎপর হতে দেখা যায়। তারা মোশতাককে ক্ষমতায় বসায়। তবে মোশতাকও খুব বেশী দিন টিকতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহ করলে চতুর মোশতাক মুজিবের হত্যাকারীদের দ্বারা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে প্রতিবাদের শেষ আশ্রয়স্থলটুকুরও সমাপ্তি ঘটায়।
৬ই নভেম্বর তারিখে মোশতাককে বিদায় করেন খালেদ মোশাররফ। তার জায়গায় আসেন এ এস এম সায়েম। ৭ই নভেম্বর তাহেরের হস্তক্ষেপে জিয়া মুক্ত হলে এবং খালেদ মোশাররফ নিহত হলে জিয়াকেই রাজনীতির দৃশ্যপটে আবির্ভূত হতে দেখা যায়। এখানে বলে রাখতে চাই মোশতাক সামরিক বাহিনীর প্রধান সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াকে সামরিক বাহিনীর প্রধান করেছিলেন।
মোশতাক জিয়াকে অতো বেশী পছন্দ করতেন না। ফারুক রশিদের চাপেই তিনি একাজ করেছিলেন। জিয়াকে চাপে রাখার জন্যে তিনি তার মাথার উপর খলিল ও খলিলের মাথার উপর ওসমানীকে বসিয়ে দেন। খন্দকার সাহবের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ধীরে ধীরে জিয়া উঠে আসেন পাদপ্রদীপের আলোয়। বিদায় নেন এ এস এম সায়েম। চতুর মাথার অধিকারী সাত্তার হন তার উপ-রাষ্ট্রপতি।
১৯৮১ সালে এসে জিয়ার মৃত্যু হলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেইন মোঃ এরশাদ ক্ষমতায় বসেন। তিনি ছিলেন মূলত সৌভাগ্যের বরপুত্র। আইয়ুব বা জিয়ার সাথে সব দিক দিয়ে তুলনার অযোগ্য এই মানুষটি ছিলেন জিয়া হত্যার পরোক্ষ সুফল ভোগী। মঞ্জুর জিয়াকে হত্যা করেছে কি করেনি তা আর খোলাসা না হলেও জিয়া হত্যার দায় চপিয়ে জিয়া নিহত হওয়ার পরবর্তী নাটকের শুরুতেই তিনি মঞ্জুরকে বুলেটের আঘাতে দুনিয়া থেকে বিদায় করেছেন।
বেচারা মঞ্জুর তার আইনগতভাবে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগটুকুও পেলেন না। অনেকেরই ধারণা মঞ্জুরকে জনসমক্ষে আনা হলে হয়তো থলের বিড়াল বের হয়ে যেত। আর তাতে জিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে হয়তো এরশাদের নামটাই সবার আগেই চলে আসতো।
যা হোক জিয়াউর রহমান পরবর্তী সময়ে সাত্তারকেও এ এস এম সায়েমের মত সরে যেতে হয়। এরশাদ ক্ষমতায় বসেন। একটা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর এক সর্বাত্মক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার পতন হয়। এ সময় তাকে স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যায়িত হতে দেখা যায়।
Comments
Post a Comment