এ
কথাগুলো লেখার বড় বেশী প্রয়োজন মনে করছি আজ। প্রয়োজন মনে করছি বেশ কয়েকটি
কারণে। বাংলার এই জনপদের ইতিহাস শুধুমাত্র আমার একারই জানা নয়। আপনারাও কম
বেশী কিছু ইতিহাস সবাই জানেন। কিন্তু আমার মনে হয় বাংলার ইতিহাস বদলে যেতে
শুরু করেছিলো যখন দিল্লীতে মুহাম্মদ ঘোরী তার শাসন কায়েম করেছিলেন। ১৯৯২
খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করার মধ্যে
দিয়ে দিল্লীসহ উত্তর ভারতের বিরাট অংশের দখল পান। ১২০৩ সাল পর্যন্ত তিনি
তার ভাই গিয়াস আল দ্বীন এর সাথে যৌথভাবে উক্ত এলাকা
শাসন করেন। উক্ত সময়কালে তার বিখ্যাত জেনারেলদের একজন বখতিয়ার খিলজি পূর্ব
ভারতে বিজয় অভিযান চালান এবং ১২০০ সালের দিকে বিহার অধিকার করেন। ১২০৩ সালে
তিনি বাঙলা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং ১২০৪ সালে রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে
বাংলা দখল করেন। এই এলাকাটা মূলতঃ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। ওদিকে ১২০৩
সালে গিয়াস আল দ্বীনের মৃত্যু হলে মুহাম্মদ ঘোরীর একক শাসন কায়েম হয়। ১২০৬
খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসমাঈলীয়দের আক্রমনে নিহত হলে দিল্লীতে ঘোরী
সা¤্রাজ্যের শাসনের সমাপ্তি ঘটে এবং দিল্লী তারই প্রধান তিনি জেনারেলের
অন্যতম কুতুব উদ্দীন আইবেক এর হস্তগত হয়। (অন্য দুজন হলেন নাসিরুদ্দিন
কাবাচা এবং তাজউদ্দীন ইলদিজ)। আর এভাবেই ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে মামলুক
(তুর্কী দাস)- দের শাসন কায়েম হয় যা ১২৯০ পর্যন্ত টিকে ছিলো।
এই
আলোচনাটুকু করলাম এই জন্যে যে, এমনিতেই আগে ভাগে সুফী সাধক দরবেশ গাউস
কুতুব অলি আউলিয়া পীরদের হাত ধরে উপমহাদেশে ইসলামের প্রসার কিছুটা হলেও
হয়েছিলো। কিন্তু দিল্লীতে মুসলিম বিজেতাদের আগমন এই পথকে আরও প্রশস্ত
করেছিলো।
বিখ্যাত
সুফী সাধক খাজা মঈন উদ্দীন চিশ্তি (রহঃ) ভারতে এসেছিলেন ১১৯০
খ্রিস্টাব্দে। বলা হয় তিনি এখানে আসার পরই পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুহাম্মদ
ঘোরীকে ভারতে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। আর এরই ফলশ্রুতিতে ১১৯১ সালে তিনি
তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানের মুখোমুখি হন। কিন্তু যুদ্ধে
ঘোরীদের পরাজয় হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ১১৯২ সালে মুহাম্মদ ঘোরী শক্তি
সঞ্চয় করে দ্বিতীয় বার সেই একই যুদ্ধ ক্ষেত্র তরাইনে পৃথ্বিরাজ চৌহানের
মুখোমুখি হন এবং চৌহানকে পরাজিত করেন। আর এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বার
মুসলমানদের জন্যে উন্মুক্ত হয়।
একটা
কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে, সুফী সাধক খাজা বাবার আগমন হেতু যে
খায়ের ও বরকত পুরো উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো তার সুবাস আজও পুরো পৃথিবী
জুড়ে আলোচিত এবং বহাল। আজও প্রতিদিন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ হাজার হাজার
মানুষ তার সমাধি দর্শনের জন্য আজমীর গমন করেন। অতএব এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য
যে, তার আগমন এবং পরবর্তী কালে ঘোরীদের আগমন উপমহাদেশ তথা বাংলার সমাজ
ব্যবস্থা ও জীবনাচরনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিলো। পাশাপাশি ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে
মহান বিজেতা বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয় এ ধারাকে আরও বেগবান করেছিলো। মূলতঃ
মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসার যে গল্প পুরো উপমহাদেশ জুড়ে আজও চর্চা
করা হয় তা এই মুসলমানদের আগমনকে কেন্দ্র করেই।
এখানে
আরও একটা বিষয় উল্লেখ করে রাখতে চাই যে, যে নেহেরু ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ
পরবর্তী ভারতের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার পূর্বপুরুষেরাও ছিলেন মোঘল বাদশা
ফররুখশিয়ারের সময়কালে রাজদরবারের উচ্চ পদের সদস্য। বাদশা তাদেরকে নহর বা
ঝরনা ধারার কাছে বসতি স্থাপনের সুযোগ দিয়েছিলেন বলেই তাদের নামের সাথে ওখান
থেকেই নেহেরু যুক্ত হয়ে যায়।
ফররুখশিয়ার
ছিলেন বাদশাহ প্রথম শাহ আলম যিনি ইতিহাসে প্রথম বাহাদুর শাহ নামেও পরিচিত
তার পৌত্র। স¤্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র প্রথম শাহ আলম তার চাচা আজম শাহের
স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলো। আর আজম শাহ তার ভ্রাতা আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মাত্র
কয়েক মাসের জন্যে বাদশা হয়েছিলেন। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তার
স্থলাভিষিক্ত হন তারই পুত্র জাহান্দার শাহ। কিছুদিন পরই জাহান্দার শাহের
স্থলাভিষিক্ত হন তারই ভ্রাতুষ্পুত্র ফররুখশিয়ার। এখানে উল্লেখ থাকা দরকার
যে, প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তার চার পুত্র আজিম উশ শান, জাহান্দার
শাহ, জাহান শাহ ও রাফি উস শান এর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আজিম উশ শান
(যিনি ফররুখশিয়ারের পিতা) মারা যান এবং তার চাচা জাহান্দার শাহ বিজয়ী হন।
পরবর্তীতে ফররুখশিয়ার তার চাচাকে পরাজিত ও নিহত করলে সিংহাসন লাভ করেন।
ফররুখশিয়ার হলেন ১০ম মুঘল স¤্রাট।
৬. আওরঙ্গজেব
৭. আজম শাহ (আওরঙ্গজেবের ভ্রাতা)
৮. ১ম বাহাদুর শাহ (আওরঙ্গজেবের পুত্র)
৯. জাহান্দার শাহ (প্রথম বাহাদুর শাহের পুত্র)
১০. ফররুখশিয়ার (আজিম উশ সান যিনি প্রথম বাহাদুর শাহের পুত্র তার পুত্র)
যে
প্রসঙ্গে ছিলাম। দিল্লীতে মুসলিম শাসনই মূলতঃ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমনকি
রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছিলো। যদিও বখতিয়ার খিলজি ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে
নিহত হয়েছিলেন অথবা মৃত্যুবরণ করেছিলেন তারপর তার স্থলাভিষিক্ত হন শিরান
খিলজি। শিরান খিলজির পর ক্ষমতায় আসেন ইওয়াজ খিলজি। এখানে উল্লেখ করে রাখতে
চাই প্রথম দফায় ইওয়াজ খিলজি ক্ষমতায় ছিলেন ১২০৮ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত। এরপর তিনি আলী মর্দান খিলজীর কাছে ক্ষমতা হারান। পরবর্তীতে আলী
মর্দান খিলজিকে হারিয়ে ১২১২ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় বাংলার ক্ষমতায় বসেন এবং
১২১৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ওদিকে দিল্লীতে
তখন ১২১১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া ইলতুতমিশের শাসন চলছে যা ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত চলেছিলো।
একটু
খেয়াল করলেই দেখতে পাবো এই ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ একই বছর খাজা মাঈন
উদ্দীন চিশ্তি (রহঃ)-এও ইন্তেকাল করেন। আর এই দুজন মহান মানুষের যুগপৎ
মৃত্যুর মধ্য দিয়েই উপমহাদেশে ইসলামের আগমনের প্রথম ধাপ অর্থাৎ ঘোরীদের
আগমন থেকে শুরু করে মামলুকদের দিল্লীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি
বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের যে প্রক্রিয়া অর্থাৎ ১১৯০ খ্রিস্টাব্দের
তরাইনের প্রথম যুদ্ধের মাধ্যমে যার সূত্রপাত হয়েছিলো তার একটা কালতামামি
হয়েছিলো। জানিয়ে রাখছি ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর রুকন উদ্দিন ফিরুজ দিল্লীর
সিংহাসন বসেছিলেন ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দেই। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস ছিলেন। আর
তারপরই উত্থান হয়েছিলো স¤্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার। সে ইতিহাস অন্য কোথায়
আলোচিত হবে। তবে বাংলায় তখন চলছিলো তুগরিল তুগান খানের শাসন যিনি প্রথমবার
বাংলার ক্ষমতায় ছিলেন ১২৩৬ থেকে ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়বার
ক্ষমতায় ছিলেন ১২৭২ থেকে ১২৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
এই
জনপদের বদলে যাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে বার বার অতীতের কথাই চলে আসছে। আমরা
জানি দিল্লীর শাসনব্যবস্থার সাথে বাংলার শাসনব্যবস্থা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত
ছিলো। আমরা এও জানি দিল্লী সালতানাতের সমাপ্তি হয়েছিলা ১২২৬ খ্রিস্টাব্দে
মুঘলদের হাতে। তখন স¤্রাট বাবুর দিল্লী দখল করে নিয়েছিলেন পানিপথের প্রথম
যুদ্ধে লোদীবংশের শেষ শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। আর ১৮৫৭
সালে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ যিনি জাফর নামেও ইতিহাসে সমধিক পরিচিত শেষ মোঘল
বাদশাহ হিসেবে রেঙ্গুনে নির্বাসিত হলে মুঘল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়।
ইতোমধ্যে
অবশ্য ইংরেজরা চলে এসেছিলো তাও প্রায় একশ বছর হয়ে গিয়েছিলো ১৭৫৭ সালের
পলাশীর যুদ্ধের পর। মূলতঃ তারা এসেছিলো ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে দিল্লীতে
যখন মুঘল বাদশা স¤্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন চলছিলো। তাদের আগমনের ঠিক দেড়শ
বছরের মাথায় তারা পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলার কর্তৃত্ব লাভ করেছিলো।
পরবর্তীতে বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪) জয়লাভ করে তারা একই সাথে রাজস্ব ও শাসন
ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে। আর মোঘলরা ততদিনে বলতে গেলে প্রায় অস্তমিত সূর্য।
ইংরেজদের
আগমন উপমহােেদর সমাজব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি জীবনাচরনকে বড়
ধাক্কা দিয়েছিলো। তাদের ১৯০ বছরের শাসনামল যা শেষ হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের হৃদয়
বিদারক দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে তার বৃত্তান্ত এতো ব্যাপক যে তা এই লেখার
প্রকাশ করা অসম্ভব। তবে দেশভাগের পর আমরা যখন দ্বিখন্ডিত উপমহাদেশটা পেলাম
সেটার করুণ ইতিহাস আজও তার নিজ গতিতে প্রবাহমান। ১৯৪৭ থেকে ২০২২ - দীর্ঘ
সময় ৭৫টি বছর।
এই
সময়টার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা
যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ নামক একটা নতুন রাষ্ট্রের জন্ম। আমরা ইতোমধ্যে
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করেছি। এই সময়কালটাই মূলতঃ আমাদের বর্তমান
আলোচনার বিষয়বস্তু। তারপরও কথা প্রসঙ্গে অনেক অতীত কথা চলে আসলো। পাঠকের
বিরক্তির উদ্রোক হলে সত্যিই ক্ষমাপ্রার্থী।
স্বাধীনতার
অনুভূতির সাথে যেসব জিনিস মিশে ছিলো তার মধ্যে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা তা হলো
১৯০ বছরের ইংরেজ আমলে হিন্দুদের দ্বারা মুসলিমদের এক ধরনের নিপীড়ন মূলক
আচরণ থেকে জন্মানো তীব্র ক্ষোভ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো পাকিস্তান আন্দোলনের
মাধ্যমে। হ্যাঁ, একথা হয়তো সত্য এটা একসময় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো
কিন্তু এ ব্যাপারে তখনও ভিন্নমত ছিলো। উপমহাদেশের সকল ইসলামীক দল বা
জনগোষ্ঠী যে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল তা কিন্তু নয়। ভারত বিভাজনের
বিপক্ষেও অনেকের শক্ত অবস্থান ছিলো। তারপরও এই অনুভূতি যে কতোটা তীব্র ছিলো
তা ১৯৪৭-এর দেশভাগের মাধ্যমে জন্মানো দু’টো দেশের বাস্তবতাই এটা প্রমানের
জন্যে যথেষ্ট কিন্তু এটা অনেকে বুঝতে ব্যর্থ হয় যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই
চব্বিশ বছর সময়কালে আমরা আর একটা ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম এবং সেখান
থেকে জন্মানো অনুভূতি আমাদের আবারও পৃথক হওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দিচ্ছিলো।
সমস্যা এবং সংকট উভয়ই ছিলো তীব্র। স্বাধীনতার অনুভূতিকে অতো সহজে গ্রহণ করা
সবার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অনেক আতংক ও ভীতিকর অভিজ্ঞতা ছিলো। পরবর্তী পরিণতি
নিয়েও ছিলো সংশয়। যদি এক জনের অধীন থেকে বের হয়ে অন্যের খপ্পরে পড়তে হয়।
যদি আমরা আমাদের স্বকীয়তা ধরে না রাখতে পারি। তাছাড়া ভূগোলের হিসাব বলে এর
চারপাশটা এমন একটা দেশ দিয়ে ঘেরা যার কর্তাব্যক্তিদের সাথে আমাদের
পূর্বপুরুষেরা মানসিক দ্বন্দ্বের একটা দীর্ঘ সময় পার করেছে। তাই আদৌ কি
তাদের সাথে সুসম্পর্ক হবে। অতীতের সৃষ্ট ফাটল কতোটা জোড়া লাগবে। এছাড়া
সবচেয়ে যেটা বড় কথা ধর্মীয় অনুভূতির বিচারে বিদ্যমান পার্থক্য এমনতিইে তো
দুটো ধারা তৈরী করে দেয়। তাই মিলের প্রশ্নের চাইতে অমিলের সংশয়ই বড় হয়ে
দেখা দেয়।
এসব
কিছুকে ছাপিয়ে উদার আধুনিক চিন্তা-ভাবনা দ্বারা বিধৌত হয়ে একটা স্বাধীন
ভূখন্ড তৈরীর স্বপ্নের পথে সেই সময়কার কথা কথিত নেতৃস্থানীয় মানুষদের
অনেকেরই তো হৃদয়ের সেই ঐশ্বর্য বা উদারতাটুকুও ছিলো না। তারা কতোটা পারবে
তা তারা নিজেরাও জানতো না। সংকীর্ণ হৃদয় দ্বারা তাড়িত এদের অনেককেই তাই
পরবর্তীকালেও ইতিহাসের গতিপথে নানামুখী সংকীর্ণতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে
ইতিহাসের আন্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে দেখা যায়।
সময়
এবং বাস্তবতা তার সঠিক পথ ধরেই আগায়। যারা তাল মেলাতে পেরেছিলো বাঙালির
মুক্তিসংগ্রামের স্রােতে তাদের অনেকেই হয়তো তাদের জীবন দিয়ে মুক্তির সেই
অমৃতধারার সাথে সুবাস হয়ে মিশে গেছে। ভাষা আন্দোলনের সালাম, বরকত, রফিক,
জব্বার; ৬৯’ এর গণ অভ্যুত্থানের আসাদ, মতিউর, জহুরুল, জোহা; আর ১৯৭১ জুড়ে
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কালটার ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের এই মহান
আত্মত্যাগের অবিসংবাদিত কাহিনীতে ক’জনের নামই বা উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ করা সম্ভব। আইনে সবার প্রতি রইল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
যে
প্রসঙ্গে ছিলাম। স্বাধীনতা এলো বটে তবে তা অনেকের জন্যেই মানসিক আর বৈষয়িক
অস্বস্তির কারণ হলো। মুজিবের উদারতা ও ক্ষমাও তাদের জন্যে মানসিক শান্তির
যথেষ্ট কারণ হলো না। মূলতঃ ঐ যে বললাম হৃদয়ঘটিত সংকীর্ণতা। সত্যি কথা বলতে
কি - বিষ যার হৃদয়ে সে কোথায় গেলে মুক্তি পাবে? কোথাও না। এই দেশ, এই মাটি -
একে ভালো বাসতে হয়। এর জন্য ঘাম ঝরাতে হয়। নিজের জন্যে রাখা একটা রুটি
থেকে এর দুঃখী মানুষের জন্যে একটা ভাগ রাখতে হয়। তবেই ভালোবাসা যায় একে। এ
শুধু দিয়েই যাবে তাই কি হয়। কিন্তু একটা সামন্তবাদী গোষ্ঠী যারা আজীবন শুধু
কর্তৃত্বই করেছে, রুটি মাখন খেয়েছে, ভালো অবস্থানের সুফলটুকুই ভোগ করেছে,
শেরওয়ানী-আচকান পড়ে মাথায় তুর্কী টুপি লাগিয়ে ইসলামী জিহাদ আর জোশের
শ্লোগান দিয়েছে - এদের কথা বলে বোঝানো কঠিন। কারণ যাদু এদের কাজে নয়। কথার
বুলিতে। মানুষকে বোকা বানানো, খুঁজে খুঁজে বিতর্কিত বিষয় সামনে তুলে এনে
তার ফায়দা লোটাই এদের স্বভাব। এরা কোন কিছুর মুখোমুখি হতে তৈরী নয়। ১৯৭৫
সালের ১৫ই আগস্টের মর্মন্তুদ হত্যা কান্ডের পর যখন ৩রা নভেম্বরে জেলখানায়
জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে
কারা ত্যাগ আর কারা ভোগের পক্ষে। এই ভোগবাদীরা যারা সারাক্ষণই দেশের ওলান
চোষার ধান্ধায় থাকে এদের হাত দিয়ে দুটো ফুটো পয়সা কেউ কখনো গলাতে দেখেছে
কিনা আমার জানা নেই, তবে আমি যে দেখিনি তা চূড়ান্ত ও করুণ সত্য। এরা বাঁচেই
কৃমির চরিত্র নিয়ে। চুষে খাওয়ার আশায়। এসব মানুষের আকৃতির ঘৃণ্য জীবকে
ঘৃণা করা কতটুকু যৌক্তিক তার মাসয়ালা আমার জানা নেই তবে এদের জন্য যে করুণা
হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজও আমাদের চারপাশে এরকম ঘৃণ্য কীট-পতঙ্গ সদৃশ
মানুষের খুব একটা যে অভাব আছে তা আমার মনে হয় না। এরা শুধু সুযোগের
অপেক্ষায়।
পথ
পরিক্রমা লক্ষ্য করলে ভীষণভাবে স্পষ্ট হয়ে যাবে কারা কি ভূমিকা রেখেছে।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ের তিন মাসের মোস্তাক সরকার, জিয়ার আগমন এবং প্রায় ২১টি
সামরিক ক্যু সংঘটন ও দমন, তার সহকারী সাত্তারের ভেল্কিবাজী, অতঃপর একজন
ভীষণ চতুর এরশাদ (দারুণ ভাগ্যবান একটা মানুষ) এবং পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক
আন্দোলনের ফায়দা লোটা ছদ্মবেশী বিএনপির দুর্নীতির মহাসাগরে ডুব দেওয়ার
পাশাপাশি স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষদের নিধনের নীল নকশা বাস্তবায়নের ঘৃণ্য
খেলা - সবকিছু আমাদের ভেতরের যে পঙ্কিলতার চিত্র অংকন করেছে তার দায়ভার এ
জাতিকেই নিতে হবে।
অতঃপর
পাপ মোচনের দিন এলো। বিচার হলো মানবতাবাদী অপরাধ সংঘটনকারীদের, সপরিবারে
মুজিবের হত্যাকারীদের, গ্রেনেড হামলার আসামীদের - যদিও এই প্রক্রিয়া এখনও
অসমাপ্ত। এখনও এর অনেকটা বাকী। অনেকে ঘাপটি মেরে আছে, অনেকে লুকিয়ে আছে
বিদেশে, অনেকে এই সরকারের সাথে নানা ছলে বলে কলে কৌশলে মিশে আছে।
অন্তঃহীন
সমস্যার এই জনপদে সমস্যাকে সম্বল করে রাজনীতি করার মানুষের অভাব আগেও কখনো
ছিলো না- এখনও নেই। তবু কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ তাদের মেধা আর মননশীলতা
দ্বারা দেশপ্রেমের বহ্নিশিখা বুকে ধারণ করে এগিয়ে এসেছে বলে ২০০৯ সাল থেকে
শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করা শেখ হাসিনার সরকার অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও অজ¯্র
উন্নয়ন কর্মকান্ড সংঘটিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যারা আলগা সুবিধা
নেওয়ার অপেক্ষায়, গদিতে বসার ধান্ধায় বিরোধীতার ধ্বজা ধারণ করেছে, ক্ষমতার
আশায় বুক বেঁধেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক মাদ্রাসায় রূপান্তরিত
করেছে - এর পাশাপাশি যারা সমানে লাফাচ্ছে ও যারা মদদ দিচ্ছে (রেজা কিবরিয়া,
ভিপি নুরা সহ আরও অনেক ধান্ধাবাজ) এদের সত্যিকারের স্বরূপ উন্মোচন করার
মতো শক্তিশালী কাউকেই মাঠে দেখা যাচ্ছে না।
কেউ
কেউ বিদেশে বসে দল পরিচালনা করছেন হোয়াটসঅ্যাপে, কেউ আছেন চটকদার কথার
ঝুরি নিয়ে লাইভে, কেউ সমানে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে আর বাহবা কুড়াচ্ছে। একটা
সভ্য জাতির কি এটাই চিত্র। এদেশ কি তবে ভুলে গেছে সেই অন্ধকার রাত্রির কথা।
এদেশ কি তবে ভুলে গেছে সেই দুঃসহ দুর্বিসহ সময়ের কথা। লক্ষ প্রাণের
বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশ, লাল-সবুজের পতাকা কি আজও তার
মর্যাদা ফিরে পাবে না। কারা এরা? এভাবে শৃগালের মতো চিৎকার করছে। এদেরকে
থামানো যায় না।
আমরা
কতিপয় মানুষ আছি মুখ বুঝে শুধু সহ্য করে যাই। তবে তারা কিন্তু বসে নাই।
তারা ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে। ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। হঠাৎ করেই এক একটা
বিব্রতকর এজেন্ডা নিয়ে হজির হচ্ছে। রাজনীতির ভেতর এদের অনেক ঘাপটি মেরে
থাকা লোক আছে। ব্যবসার জগতে এরা বেশ শক্তিশালী যার দ্বারা সিন্ডিকেট গড়ে
এরা প্রায়ই একই সাথে সরকার ও জনগণকে বিব্রত করছে। আমাদের বুঝতে হবে এদের
সত্যিকারের স্বরূপ। ইসলামের দোহাই দেওয়া এসব ভন্ড মানুষ ইসলামকেই পুঁজি
করছে এদের ইহকালীন সাফল্যকে ত্বরান্বিত করতে। ভন্ড এই সব মানুষদের মুখোশ
উন্মোচন করেছিলেন একজন বীর বাঙালি। তিনি শেখ মুজিব। তাই তো তাকে সপরিবারে
মরতে হলো।
বলছিলাম
এই জনপদের বদলে যাওয়ার গল্প। বলছিলাম এর স্বরূপ পাল্টানোর আন্দোলন
সংগ্রামের ইতিহাসের সামান্য কিছু কথাবার্তা। এসব নিয়ে মাথা ব্যথা খুব কম
মানুষের। স্বার্থপরতার পঙ্কিল সাগরে ডুব দেওয়া কীটপতঙ্গের মতো জীবন যেসব
মানুষের তাদের ত্যাগের মহিমার মহান বাণী শোনানো অর্থহীন বৈকি।
আজকের
বাংলাদেশের যেটুকু অর্জন তার বৃত্তান্ত সবারই কম বেশী জানা। তবু একথাই
সত্য যে দিনশেষে বিগত প্রায় চৌদ্দ বছর যাবৎ এক ধরনের হৃদয়ের ক্ষতে চুলকানি
নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া একদল মানুষ আজও ঘুম থেকে এই স্বপ্ন নিয়ে জাগে যে, ঘুম
থেকে উঠে দেখবে রাজকুমার তারেক জিয়া সিংহাসনে বসেছে। পাশের চেয়ারে মাতারানী
খালেদা জিয়া সমাসীন। তাদের গায়ে সোনা জড়ানো, আর এটাই তাদের সোনার বাংলা।
Comments
Post a Comment