“পূর্ব
পাকিস্তানের প্রত্যেকটি ন্যায়সঙ্গত দাবির সামন্যটুকু পর্যন্ত তোমাদের নিকট
থেকে অর্জন করতে হইলে আমাদের প্রচুর ত্যাগ স্বীকার এবং চরম মূল্য দিতে
হয়েছে। এ যেন একটি বিদেশী শাসকবর্গের নিকট থেকে অধিকারের করুণা মাত্র
ছিনিয়ে আনা। এজন্য কখনো কি তোমাদের মুখ লজ্জায় নত হয়েছে? না হয়নি।”
- শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বাঁচার অধিকার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
১৯৬৬
সালের ১০ই জানুয়ারি সম্পাদিত তাসখন্দ চুক্তির কারণে আইয়ুব খান পশ্চিম
পাকিস্তানে বেশ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য
তিনি ৬ই ফেব্রুয়ারি একটা সভা ডেকেছিলেন। শেখ মুজিব উক্ত সভায় যোগ দেওয়ার
জন্য ৪ঠা ফেব্রুয়ারি লাহোরের উদ্দ্যেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ৫ই ফেব্রুয়ারি
তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে তার ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন এই মর্মে যে তারা যেন
তা কনফারেন্সের এজেন্ডাভুক্ত করেন। কিন্তু তারা তা করতে অস্বীকার করলে শেখ
মুজিব সভা বর্জন করেন এবং দেশে ফিরে আসেন। ওদিকে এই ছয় দফা পশ্চিম
পাকিস্তানের বিভিন্ন কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের
পরিস্থিতিও ক্রমশঃ অস্থির হয়ে ওঠে এবং সাধারণ জনগণ ছয় দফার সাথে ঐক্যমত্য
পোষণ করে।
১৯৬৬ সালের
পহেলা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সেশনে পুনরায় তিনি তার
ঐতিহাসিক ৬ দফা উপস্থাপন করেন এবং এর জন্য আন্দোলনের স্বপক্ষে সম্মতি গ্রহণ
করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন আইয়ুব খান ক্যাবিনেটের মন্ত্রী। তিনি নিজেও
ছয় দফার কঠোর সমালোচনা করে এটিকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ
করেন।
মূলতঃ এই ছয় দফা ছিল
বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয় দফার ব্যাখ্যা সম্বলিত তার পুস্তিকা “আমাদের
বাঁচার অধিকার” - এ তিনি তার অগ্নিঝরা বক্তব্যের মাধ্যমে বাঙালির
দাবি-দাওয়া বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু একে ‘আওয়ার চার্টার ফর
সারভাইভাল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বস্তুতপক্ষে ছয় দফার মধ্যেই বাঙালির
স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সেটা তিলে তিলে বুঝতে
পেরেছিল। আর সে জন্যেই অতীতে তারা বঙ্গবন্ধুর ওপর যতটা না রূঢ় ছিল তার ছয়
দফা দাবি পেশ করার পর তার প্রতি পাকিস্তানী সরকারের রূঢ়তা অতীতের সকল
মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
এর
পিছনে অবশ্য আরও কারন ছিলো। শেখ মুজিব ছাড়া বাঙালীর আশা-ভরসার আর কোন
আশ্রয়স্থলও ছিলো না। তাই তাকেই সব কিছুর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। ১৯৫৭ সালের
৭ই ও ৮ই ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের অধিবেশনে
আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের প্রতি
ওয়াআলাইকুম আসসালাম বলে বিদায় সম্বোধন জানান। পরবর্তীতে ঐ বছরের ২৫শে জুলাই
তার নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।
১৯৬২
সালের ২৭শে এপ্রিলে পরলোকে পাড়ি জমান বাংলার বাঘ আবুল কাসেম ফজলুল হক। তার
ঠিক পরের বছর ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর তাকে অনুসরণ করে পরপারে চলে যান
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দুই মহান নেতার বিদায়ে বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গন তখন
অভিভাবক শূন্য। এই সময় বাংলার রাজনৈতিক দায়িত্বভার পুরোপুরি নিজ কাঁধে
তুলে নেন শেখ মুজিব। আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তা বহন করেছিলেন।
এখানে
আরও বলতে চাই, ৩০শে এপ্রিল ১৯৫১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকা অবস্থায়
মওলানা ভাসানী তার এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘দেশের মুক্তির সাথেই তোমার
মুক্তি।’ সেদিন মওলানা ভাসানী ঠিক কথাটিই বলেছিলেন। মুজিবের জীবন, তার
রক্ত-মাংস, চিন্তা-চেতনা সবকিছু বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছিল
এক অবিচ্ছিন্ন ও মহান মহিমায়।
ছয়
দফার সমর্থনে শেখ মুজিব টানা প্রায় তিন মাস ধরে গণসংযোগ করে অবশেষে
পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনে ৮ই মে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালের ১৭ই
জানুয়ারি মুক্ত হলেও জেল গেট থেকে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে ঢাকা
সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জেলে থাকা অবস্থায়ই তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯শে জুন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
(রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য) - এর শুনানি শুরু হয়।
এখানে
বলে রাখতে চাই, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে যে অস্থিরতার সৃষ্টি
হয়েছিল আইয়ুব খান তাকে প্রশমিত করার জন্য এর কুশীলবদের আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলায় জড়িয়ে দেন। কিন্তু হীতে বিপরীত হয়। বাঙ্গালী আরও বেশী ফুসে ওঠে।
১৯৬৯ এর শুরুতে এসে আন্দোলন যেন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ৪ঠা জানুয়ারী সর্বদলীয়
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফা পেশ করে। এই ১১ দফার মধ্যে ছয় দফার
দাবীগুলোও অন্তর্ভূক্ত ছিলো। ৭ ও ৮ই জানুয়ারী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য
গণতন্ত্র বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। ক্রমশঃ পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। ২০শে
জানুয়ারী ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। সারা
দেশে আগুন জ্বলে ওঠে। ১৫ই ফেব্রুয়ারী কুর্মিটোলার ক্যান্টনমেন্টে সার্জেন্ট
জহুরুল হক নিহত হন। ঘটনা প্রবাহ আরও জটিল আকার ধারণ করে। ১৮ই ফেব্রুয়ারী
রাজশাহীতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গুলি চালালে ডঃ সামসুজ্জোহা নিহত হন। অবশেষে
আইয়ুব খান ২১শে ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন এবং
২২শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব তাঁর সকল সঙ্গীসাথীসহ মুক্তিলাভ করেন। ২৩শে
ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে এক গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় যেখানে তোফায়েল আহমেদ তাকে
“বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করেন।
পরিস্থিতি
আগেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। আইয়ুব খান ১০ থেকে ১৩ই মার্চ এক
গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন। বৈঠকে শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করলেও মওলানা ভাসানী
ও ভুট্টো অংশগ্রহন করেননি। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানের শেষ রক্ষা হয়নি। ২৪শে
মার্চ তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা
তুলে দিয়ে পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে
দাঁড়ান।
১৯৬৯ সালের ২৮শে
নভেম্বর ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের ১ ইউনিট বাতিল করার প্রস্তাব “লিগ্যাল
ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার” ঘোষনা করেন। এতে বলা হয় “এক ব্যাক্তি, এক ভোট”। এর
অধীনেই ১৯৭০ সালের ৫ই অক্টোবরে জাতীয় গনপরিষদের নির্বাচনের ঘোষনা দেওয়া হয়।
এর
পর এলো ১৯৭০ সালের নির্বাচন। যুগান্তকারী এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার
শরিক দলগুলো সহ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। ন্যাশনাল এসেম্বলির ৩০০ টি আসনের
মধ্যে ১৮০টিতে প্রতিদ্বন্ধিতার ফলে ১৬৭টিতে বিজয় লাভ করে। প্রাদেশিক
পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টিতে জয়লাভ করে। অপরদিকে পাকিস্তান পিপলস
পার্টি ১৩৮টি আসনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে ৮১ টি আসনে জয়লাভ করে দ্বিতীয়
সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
নানা ঘটনার
প্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস এসে উপস্থিত হয়। জেনারেল ইয়াহিয়ার
১৪ই ফেব্রুয়ারির ঘোষনা অনুযায়ী ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা
ছিল। কিন্তু ১লা মার্চ রাষ্ট্রপতির পক্ষে আকস্মিক এক ঘোষনা বলে সেই অধিবেশন
বাতিল করা হয়। সময় যত আগাতে লাগলো সমস্যা তত গাঢ় হতে লাগলো। মূলতঃ ইয়াহিয়া
খানের দুমুখো নীতিই ছিলো প্রধান সমস্যা। তিনি শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা
চালিয়ে যাচ্ছিলেন আবার ভুট্টোকেও খুশি রাখছিলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা
যেতে পারে এই অসহযোগিতা আর কূটকৌশল নতুন কিছু ছিলো না। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান
সরকার কর্তৃক যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়া এবং ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালে
সরকারের অসহযোগিতার কারণে দ্বিতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলীর ব্যর্থতায়
এরকমই অসহযোগিতা আর কূটকৌশলের নজির ছিলো। অবশ্য এসব ঘটনাই বাংলাদেশের
জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। শেখ মুজিব এই উভয় সরকারের
একজন সদস্য ছিলেন এবং তিনি উক্ত পদ থেকে পদত্যাগ করে দলীয় কর্মকান্ডে
মনোযোগ দেন।
২রা মার্চ
সারাদেশে সকাল ৮টা থেকে ৭টার মধ্যেই তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির
কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানকারী ডাকসুর সভাপতি আ স ম আব্দুর রব এবং সাধারণ
সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকি এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখনের
নেতৃত্বে একটি র্যালী অনুষ্ঠিত হয়। র্যালী শেষে আ স ম আব্দুর রব বটতলায়
অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। বর্তমান পতাকা ঐ
পতাকার অনুরূপ। শুধু মাত্র তৎকালীন পতাকাটিতে সূর্যের মাঝখানে বাংলাদেশের
যে মানচিত্র ছিলো তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
৩রা মার্চ
পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে আ স ম আব্দুর রব এবং শাহজাহান
সিরাজ স্বাধীনতার ঘোষনা পড়ে শোনান। তাদের মনে হয়েছিল শেখ মুজিব হয়তো
আলোচনায় বসবেন আর স্বাধীনতার জন্যে জনতার এই তুমুল উত্তেজনা হয়তো সেই
আলোচনার নিচে চাপা পড়ে যেতে পারে। মুজিব অবশ্য শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আগানোর
কথা বললেন। ৪ঠা মার্চ শেখ মুজিব জনগণকে স্বাগতম জানালেন তার ডাকে সাড়া
দেওয়ার জন্য। তিনি সকল সরকারী, বেসরকারী কর্মচারীদের যারা বেতন ভাতা পাননি
তাদের বেতন ভাতা বরাদ্ধকরণের জন্য ২.৩০-৪.৩০ পর্যন্ত আগামী দুদিন হরতাল
চলাকালীন সময়ে অফিস খোলা রাখার জন্য বললেন। টানা হরতালে দেশব্যাপী বহুলোকের
প্রাণ গেল। অবশেষে এলো সে মহেন্দ্রক্ষণ। শেখ মুজিব লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে
রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন দিলেন। তিনি বললেন,
...আর
যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার
অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে
শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...
...
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ
গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত
যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব কিন্তু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা
আল্লাহ।...
...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।...
একটু
পিছনে ফিরে যাই। ২৭শে জানুয়ারি ভুট্টো তার দলবলসহ ঢাকায় এসেছিলেন শেখ
মুজিবের সাথে অধিবেশন পূর্ববর্তী আলোচনা এবং একটা আপসরফা করতে। তার
উদ্দেশ্য একটাই শেখ মুজিবের অধীনে তিনি উপপ্রধানমন্ত্রী হবেন না। তার চেয়ে
সেই ভালো যদি কোয়ালিশন করে মান রক্ষা করা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৬৯ সালের
দুই জার্মানির দুই প্রধান রাজনৈতিক দল এসডিপি এবং সিডিইউ এর মধ্যকার
কোয়ালিশনের কথাও টানলেন। “দুইটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল” -এর মতো উদ্ভট ধারণার
কথাও বললেন।
সবচেয়ে বড় কথা
এমনিতেই ৬ দফা তাদেরকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। তার উপর ১৯৭০ সালের
৭ই ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে
আত্মপ্রকাশ মূলতঃ তাদের সব আশা ভরসা শেষ করে দিয়েছিল। সর্বোপরি ৩ তারিখে
ঢাকায় যে অধিবেশন বসবে তাতে পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের
প্রতিনিধিদের এমনকি ভুট্টোর দল পিপিপি-রও অনেক প্রতিনিধির অংশগ্রহণের উদগ্র
বাসনা পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনে আতংক ধরিয়ে দিয়েছিল।
এরকম
একটা পরিস্থিতিতে তারা শেখ মুজিবকে ৬ দফা পুনর্বিন্যাসের জন্য চাপ দেওয়ার
পাশাপাশি কেন্দ্রের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার কৌশল নিয়েও কথা বলেছিলেন। ১৯৪৭
সালের ভারত ভাগের আইন অনুযায়ী ফেডারেশন গঠন করা যায় কিনা তারও উল্লেখ
করলেন। আওয়ামী লীগ যে খসড়া সংবিধান তৈরি করেছিল প্রেসিডেন্ট তাতে তিন দফা
সংশোধনীর প্রস্তাবও করেছিল। অধিবেশনের জন্য শেখ মুজিবের দেওয়ার চার দফা
শর্ত যদিও তাদের কাছে রাতারাতি বিরক্তিকর মনে হয়েছিল কিন্তু তারা তা সেভাবে
প্রকাশ করেনি। কারণ তাদের মুখে যা ছিল মনে তা ছিলো না।
পহেলা
মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত সময়কালে শেখ মুজিব পাকিস্তানের জন্য যখন
শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজছিলেন সেখানে তারা পূর্ব পাকিস্তানিদের সামরিক ভাবে
মোকাবেলা করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। আসলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে
আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর তারা এটা বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানের আর শেষ রক্ষা
হবে না। আমার মনে হয় এই প্রথম পৃথিবীর কোন দেশের জন্য তার জনসংখ্যার ভার
আশীর্বাদ হয়েছিল। বাঙালির স্বাধীন হওয়ার পেছনে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিরাট
ভূমিকা রেখেছিল।
আলোচনা
২৪শে মার্চ পর্যন্ত চলেছিল। যদিও তা ছিল লোক দেখানো। অতঃপর তারা তাদের
পরিকল্পনা মাফিক সামনে এগিয়ে ছিল। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের স্ত্রী
সন্তানদের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের কোটিপতি পরিবারগুলোর স্ত্রী
সন্তানদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হল। গণহত্যা আগেই শুরু
হয়েছিল। ২, ৩ ও ৪ঠা মার্চ সারাদেশে অনেক হতাহত হয়েছিল। তাছাড়া সর্বত্রই
ঝামেলা লেগেই ছিল। শেখ মুজিব তো প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, “বাঙালি যখন একবার
রক্ত দিতে শিখেছে স্বাধীনতা পেতে তখন আর কষ্ট হবে না।”
২৫শে
মার্চ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ছাব্বিশে মার্চের শুরুর লগ্নে পাক বাহিনী ঝাপিয়ে
পড়ল ঘুমন্ত ঢাকা নগরীর উপর। পুলিশ ও ইপিআর কিছুটা প্রতিরোধ করতে পারলেও
সাধারণ শহরবাসী মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করলো। শহর জুড়ে তান্ডব ছড়িয়ে পড়লো।
পুরো
পৃথিবী অবাক হয়ে দেখল একটা জাতিগত নিধনের মর্মান্তিক দৃশ্য। নারী ও শিশুরা
সবচেয়ে বেশি মারা গেল। শেখ মুজিবকে তার বাড়ি থেকে সশস্ত্র আক্রমনের পর
গ্রেফতার করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হল। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বদেশ
প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত কেউ জানতেও পারেনি সে বেঁচে আছে না মরে গেছে।
প্রাথমিক
ধাক্কা কাটিয়ে উঠে বাঙালি প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হল। তারপর নয় মাসের
যুদ্ধ। অনেক রক্তক্ষরণ। ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে
অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর এসেছিল চূড়ান্ত বিজয়। পুরো চিত্রটাই সুন্দরভাবে ফুটে
উঠেছে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা “স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো” তে।
তাই কবিতাটির কিছু অংশ উল্লেখ না করে পারলাম না,
... কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল
কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে
এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে
এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক, হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে
এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা,
ভবঘুরে আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।
'কখন আসবে কবি?' 'কখন আসবে কবি?'
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা- ;
কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি:
'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
সেই থেকে 'স্বাধীনতা' শব্দটি আমাদের।
Comments
Post a Comment