কি ছিলো এই বাংলাদেশ। ১৯৪৭-এ যখন দেশভাগ হয় তখন পাকিস্তানের পূর্বপ্রান্ত যা তখন পূর্ববাংলা নামেই পরিচিত তা এক পরিত্যক্ত জনপদ। রাস্তাঘাট নেই, কলকারখানা নেই, বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানির ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। ডায়রিয়ায় প্রতি বছর শুধুমাত্র দক্ষিণাঞ্চলেই মারা যেত হাজার হাজার লোক। অশিক্ষা কুশিক্ষা কুসংস্কারে ভরা একটা জনপদ পাকিস্তানী দুঃশাসনের ২৩ বছরের মাথায় এসে এতোটাই করুণ আর নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়ালো যে এর আর আলাদ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইলো না।
অবশেষে ঘটলোও তাই। দীর্ঘ নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সহযোগিতা ও বিশ্ব জনমতের প্রবল সমর্থনের চাপে অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর দেশটা স্বাধীন হয়েই গেল। বঙ্গবন্ধু যিনি এর জাতির জনক আগেভাগেই এর নামকরণ করেছিলেন বাংলাদেশ। আমরা পেলাম একটি লাল সবুজের পতাকা। পেলাম ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক ছোট্ট ভূখন্ড যা আমাদের একান্ত নিজস্ব কিন্তু এ পাওয়াকে ধরে রাখাই যেন দিন দিন কঠিন হয়ে উঠলো। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সদ্য জন্ম নেওয়া এই রাষ্ট্রটির টুটি চেপে ধরতে চাইলো। জাতির পিতা পরিস্থিতি সামলানোর সব ধরনের চেষ্টাই করলেন। কিন্তু ঘরের শত্রæ বিভীষণ বাহিরের তথাকথিত মোড়ল মুরুব্বীদের রক্ত চক্ষু আর ষড়যন্ত্রের গোপন থাবায় অবশেষে তাকে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নিহত হতে হলো।
একটা কথা বলে রাখতে চাই যে, শুধু বঙ্গবন্ধুর পরিবারকেই নয় পাশাপাশি জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করা হলো ঠান্ডা মাথায়। উদ্দেশ্য একটাই যেন এই দেশ এই মাটি নিয়ে কথা বলার মতো আর কেউ অবশিষ্ট না থাকে। এই ভূখন্ড নিয়ে এই যে খেলা সেদিন সম্ভব হয়েছিলো তা শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছিলো এ কারণেই যে সেদিন এই দেশ এই মাটির বহু বিশ্বাসঘাতক সন্তান ষড়যন্ত্রকারীদের মদদ জুগিয়েছিলো। হায়রে বাঙালি! তোরা স্বাধীনতার কি মূল্য বুঝবি? স্বাধীনতার মূল্য তো বোঝে ফিলিস্তিনিরা। স্বাধীনতার মূল্য কি তা বুঝেছিলো ভিয়েতনামিরা। স্বাধীনতার মূল্য কি তা বোঝে লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার কালো মানুষেরা। কথায় বলে না, সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। বাঙালিকেও মাঝে মাঝে এই অতি প্রাচীন পাপ রোগ ধরে। তাই তারা মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে নিজের স্বাধীনতা আর সুখকে অন্যের হাতে জলাঞ্জলি দেওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে জিয়া মৃত্যুবরণ করলে একটা কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়। এরপর ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হলে দ্বিতীয় কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। তারপর গণতন্ত্রের যে পথচলা শুরু হওয়ার কথা ছিলো তা আরও কলংকিত হয়েছিলো বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর সরকার গঠনের মাধ্যমে।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে এই প্রক্রিয়ার ব্যবচ্ছেদ ঘটে। জনগণের মধ্যে কিছুটা হলেও সচেতনতা তৈরী হতে থাকে। শুরু হয় যুদ্ধাপরাধী ও জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার। তবে সে যাত্রা ২০০১ সালে বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে আওয়ামী লীগ আবারও ব্যর্থ হয়। বিএনপি যে সরকার গঠন করে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সময়কালটাতে সেই সরকার দুর্র্নীতি আর নির্লজ্জতার সব সীমা পার করে দেশে বিদেশে নিন্দিত হয়। তারেক, মামুন আর সিলভার সেলিম গং টাটার কর্ণধার রতন টাটার কাছে এদেশে টাটার শিল্প কারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে যে কমিশন দাবী করে তার রিপোর্ট রতন টাটা নিজে দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এটা যে একটা জাতির জন্যে কতো বড় লজ্জার তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে হ্যাঁ। সময় বদলায় তবে কাঠখড় পোড়াতে হয় অনেক। ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়কালটাতে সামরিক সরকার সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার যে সালতামামি দেখায় তা রাতারাতি দুঃখজনক ও হাস্যকর। অবশেষে সকল কাটা ধন্য করে, সকল আধার সরিয়ে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের শুরুতেই আবারও সরকার গঠন করতে সক্ষম হন। সেই যে শুরু হয় অবিচ্ছিন্ন পথচলা তা আজও চলছে।
Comments
Post a Comment