মিথ কী ও কেন
মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন মনের আধুনিক অনুসন্ধানের সুত্র হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে মিথ সাহিত্য মর্যাদা পেয়েছে। মিথ ধর্মীয় আচারের ব্যাখ্যা করেছে, এবং অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মিথের বর্ণনা নাট্যরূপ পেয়েছে।
কিন্তু সাহিত্য ও শিল্পকর্মে ব্যবহৃত মিথকে বুঝে ওঠার জন্য মিথের সংজ্ঞা নির্ধারণ অবশ্যই জরুরী। In literary criticism myth means ultimately mythos, a structural organizing principle of literary form’ (নরথ্রপ ফ্রাই) একথা বলেও সবটা বোঝানো যায না। বস্তুত, সাহিত্যসমালোচকেরা যখন মিথের কথা বলেন, তখন তারা মিথ ও সাহিত্যে ব্যবহৃত মিথের পার্থক্যের কথা মাথায় রাখেন না। ব্রনিস্ক মলিনোয়াস্কি মিথের সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে- a narrative resurrection of a primeval reality, told in satisfaction of deep religious wants, moral cravings, social submissions, assertions, even practical requirements (মিথ ইন প্রিমিটিভ সাইকোলজি); সাধারণভাবে মিথের এই সংজ্ঞা গ্রহণে আমাদের বাধা থাকে না, কেননা এখানে আদিম সমাজের এক শক্তিশালী উপাদান হিসেবে মিথকে দেখা হয়েছে। একই রকমভাবে ই. ও. জেম্স মিথের সংজ্ঞা দিয়েছেন: True myth...... is not a product of imagination in the sense of speculative thought or philosophizings about the origins of phenomena in the form of an aetiological tale invented to explain objects and events that arouse attention, It is not idealized history or allerorized philosophy, ethics ics or theology All these may retain elements of the myth, but the myth itself is distinct from the fantasy, poetry, philosophy and psychology with which it has become associated in its ramifica-tions, developments and degenerations, and their interpretations. (মিথ অ্যান্ড রিচুয়াল ইন এনসিয়েন্ট নিয়ার ইস্ট) জেম্স বলছেন, আদিম মানুষ দুর্যোগের সময় আধিভৌতিক নানা শক্তির সাহায্যে চেয়েছে এবং পৃথিবীর সৃষ্টি, নশ্বরতা, মানুষের ভাগ্য, প্রাকৃতিক ঋতুচক্র, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নানা বিষয় সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এক sacred narrative- এর আকার পেয়েছে। এটাই হল মিথ, আর এর উদ্দেশ্য হল ‘প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা’ অনুসন্ধানের চেষ্টা।
মিথের মৌলিক শক্তি হল এই যে বিঙ্গান ও প্রযুক্তির কল্যাণে প্রকৃতি ও সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবতির্ত পরিস্থিতিতেও তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি, বরং ক্রমশই স্থান করে নিয়েছে সাহিত্যে। হোমার ও সফোক্লিসের কাহিনিতে যেসব দেবতা ও বীরের দেখা মেলে, তারা আক্ষরিক অর্থেই আগে পূজিত হয়েছে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অবশিষ্টংশ কিছু থেকে গেছে কিংবদন্তিতে ও গাথায়। কিংবদন্তি, লোকগাথা ও মিথ মিলেমিশে গেছে ইলিয়াডে। ট্রোজান যুদ্ধোর কিংবদন্তি বা বীরগাথাকে দেবতার উদ্দেশ অনুষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িত জড়িত মিথকে আলাদা করা যাবে না। মিথের মধ্যে দিয়ে এই আবেগ ও অচেতন সংযোগ প্রকাশ পায়। ফ্রয়েড মিথকে অচেতন কামনার প্রকাশ হিসেবে দেখেছেন, এ ফলে মানুষের মনোজগতের বিশ্নেষণে সাহায্য করেছে মিথ। মিথ ও স্বপ্নের মধেও সম্পর্ক স্থাপন করে ফ্রয়েড মেটাফিজিক্সকে মেটাসাইকোলজিতে উন্নীত করতে চেয়েছেন। তিনি প্রাচীন গ্রিক ও লাটিন সাহিত্যে পুরাণের ব্যবহারকে প্রবৃত্তিজাত কাজ ও অচেতনতার অন্তর্গত বিরোধের প্রকাশ হিসেবে মেনে করেছেন। ফলত, পুরাণব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে মানবজাতির মনোজগতের ইতিহাসে প্রবেশের একটা চাবিকাঠি মেলে।
মিথের যেকোনো সংজ্ঞা নির্ধারণে আদিম সমাজের ধর্ম ও জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলোকে যেমন মনে রাখা দরকার, তেমনি মিথকে যুক্তি ও নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টিতে দেখে শিল্প-সাহিত্যে তার প্রয়োগের দিকটিও মনে রাখতে হবে। লিলিয়ান ফেডার এই কারণে মিথের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা অনেকাংশেই মেনে নিতে আমাদের বাধা থাকে না। তিনি বলেছেন- Myth is a narrative structure of two basic areas of unconscious experience which are, of course, related. First, it expresses instinctual drives and the repressed wishes, fears, and conflicts that they motivate, these appear in the themes of myth. Second, myth also conveys the remnants within the individual consciousness of the early stage of phylogenetic development in which myths were created. (এনসিয়েন্ট মিথ ইন মডার্ণ পোয়োট্টি)।
মিথ ও পুরাণের চরিত্রেরা প্রায়শই দেবতা, অমিতশক্তিধর মানুষ বা অতিমানুষ, কিন্তু তাদের বর্ণনার উপাদানে যে দ্বন্দ্ব ও দুঃখ, যে সংকল্প, তাতে প্রকাশ পেয়েছে মানুষের আবেগসঞ্জাত। বিষয়গুলোই। পুরাণের মূল বিষয় হয়েছে মৃত্যুর রহস্যময় চক্র, ঋতুচক্রে বছরের পুনরাগমন, জন্ম, প্রকৃতি ও মৃত্যুর জন্য উৎকণ্ঠা ও ভীতি। মানুষের এই অসহায়তা যেমন সত্যি। পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের এই চেতনা থেকে মানুষ আয়োজন করেছে ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক আচারের। এই কারণে এইসব আচার অনুষ্ঠান পুরাণের অঙ্গীভূত হয়ে আছে। ফেডার বলেছেন: We identify with the hero of myth not only because he acts out our unconscious wishes and fears but also because in doing so he performs a continual rite of service for the rest of mankind he asks our essential questions and he answers them. (এনসিয়েন্ট মিথ ইন মডার্ণ পোয়োট্টি)।
কবিতায় মিথ পুরাণ
কল্পনা ও বাস্তব, নশ্বরতা ও অমরত্ব, প্রকৃতির কাছে অসহায়তা ও প্রকৃতি বিজয়ের আকাঙ্খায় ইউরোপীয় মিথ ও ভারতীয় পুরাণের এই সামাজিক ও মানবিক সংযোগ প্রথম থেকেই কবিদের প্রিয় বিষয়। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যে যেমন, ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যেও তেমনি পুরাণের প্রসঙ্গ বারবার উল্লেখিত হয়েছে। কবিতায় পুরাণ কবিদের বাস্তব ও কল্পনার পরিপার্শ্বকে বিস্তৃত করেছে। কবিতায় পুরাণ বা পুরাণের কবিতা কাব্যভাবনার নিরিখে ভিন্ন তাৎপর্য সৃষ্টি করেছে। পুরাণের এই ব্যবহার কখনও স্মৃতির অচেতন থেকে আহরিত, কখনও তা সক্রিয় কবিচৈতেন্যর প্রয়োগ। ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিকতার রূপ যথাযথ না থাকলেও আচার- অনুষ্ঠানের তাৎপর্য পুরোপুরি অপসৃত হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে যতো ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে দিয়েছে, মানুষকে তার অসহায়তার মুল ভূখন্ড থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নশ্বরতা ও প্রকৃতির কাছে অসহায়তা শুধু নয়, জটিল জীবনের ফাঁসে মানুষ নিজেকে নানা শৃঙ্খলে অবরুদ্ধ দ্যাখে। একদিকে সামাজিক অগ্রগতি, বিত্ত ও ঐশ্বর্যের উপকরণ, অন্যদিকে মুক্তির চিরায়ত আকাঙ্খা। এসবের কাব্যিক প্রকাশে মিথ বা পুরাণ যেন স্বতঃপ্রবৃত্ত ও সহজলভ্য উপকরণ হিসেবে কবিদের সামনে উপস্থিত। পার্থক্য যা কিছু, তা তাদের প্রয়োগে- আর এতে অবশ্যই নতুন করে অর্থবহ হয়ে উঠেছে পুরাণের দেবদেবীরা, বাস্তব ও কল্পনার সেই বীরেরা। উনিশ শতকের কিটস, টেনিসন ও মেরিডিথ হয়ে রবীন্দ্রনাথ, এজরা পাউন্ড, রবার্ট গ্রেভ্স, ইয়েটস, এলিয়ট, রেইন, রবার্ট লাওয়েল প্রমুখ বিখ্যাত কবিরাই নানাভাবে, নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরাণের প্রয়োগ করে তাঁদের কাব্যের ভৌগোলিক ও ইতিহাসের পরিধি বাড়িয়েছেন।
আমরা এখানে একটি মিথের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। গ্রিক পুরাণের দেবী ডিমিটার ও তার কন্যা পার্সিফোনি। পাতালের রাজা হেডিস পার্সিফোনিকে হরণ করে নিয়ে যায়। ডিমিটার অনেক অন্বেষণের পর একথা জানতে পারেন। দেবতার অনুরোধে হেডিস বছরে ছ’মাস স্ত্রী পার্সিফোনিকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়। অনেক কবিই এই মিথটিকে ব্যবহার করেছেন। পার্সিফোনির রোমান নাম প্রসার্পিনা বা প্রসার্পিন। প্রসার্পিন নামের সঙ্গে যে দুঃখবোধ জড়িয়ে থাকে, তাকে অস্বীকার করার জন্যই যেন ক্রিটস- এর Ode to Melancholy : Nor suffer thy pale forehead to be kiss’d By nightshade, ruby grape of Proserpine.
রবার্টস গ্রেভস-এর Dear lady Prosepine.........stooping over for Henna’s sakeএবং কবির প্রাণ ফিরিয়ে দিচ্ছে। পার্সিফোনির মিথটিকে তার আচারের দিকটিসহ ব্যবহার করেছেন ক্যাথারিন রেইন তাঁর The Transit of the Gods কবিতায়:
And I who haveeen Vig and Aphrodite
The mourning isis and the queen of corn
Wait for the last nummer, dread Pesephone
To dance my dust at last iftta the tomb.
এখানে বলার কথা এটাই যে একই মিথ বিভিন্নি কবির দৃষ্টিতে কিভাবে আলাদা রূপ পরিগ্রহ করছে। আমাদের আলোচিত কবি বিষ্ণু দে-ও এই প্রসার্পিনার মিথটিকে ব্যবহার করেছেন, এবং আমরা যথাযথ স্থানে তার বিচার করব।
জেমস জয়েস ও ইয়েট্স- এর রচনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এলিয়ট ও অডেন দুজনেই মিথিক্যাল মেথড-এর তাৎপর্যের কথা বলেছেন। বস্তুত, এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে তাঁরা কবি হিসেবে নিজেদের কাব্যভাবনার কথাই বলেছেন। ‘ইউলিসিস’ উপন্যাস প্রসঙ্গে এলিয়ট বলেছেন- In using the myth, in manipulating a continuous parallel between contemporaneity poraneity and antiquity, Mr Joyce is pursuing a method which others must pursue after him It is simply a way of controlling, of ordering, of giving a shape and a significance to the immense paronoma of futility and anarchy which is contemporary history. (সিলেক্টড প্রোজ)
ইয়েটস-এর আলোচনায় অডেনও একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জানিয়েছেন পৌরাণিক কাঠামো কবিতায় কেন প্রয়োজন। তাঁর বিশ্বাস- any poet today, even if he denies the importance of dogma to life, can see how useful myths are to poetry—how much, for instance, they helped Yeats to make his private experiences public and his vision of public events personal. (সিলেক্টড প্রোজ)
বস্তুত, এলিয়ট ও অডেন নিজেদের কবিতাতেও পুরাণের দ্বারস্থ হতে চেয়েছেন এভাবেই। বিশ শতকের কবিরা পৌঁছতে চেয়েছেন শৃঙ্খলা ও বিশ্বাসের তটভূমিতে, যা ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর। তাই চোখ ফেরাতে হয় ঐতিহ্যের মধ্যে থেকে আহরিত প্রতীকের দিকে। মিথ একদিকে মিথ্যা, অন্যদিকে সত্য। কারণ এইসব মিথ ‘express man’s deepest self-deception—his creation of gods in his own image his attribution to himself, or to a creature formed to mirror his marvelous fantasies, of powers of control beyond those of any human being ever born. (লিলিয়ান ফেডার)
অবিশ্বাস, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের প্রেক্ষিতে পুরাণের ব্যবহারই কল্পনাপ্রবণ কবিকে দেয় কাব্যিক প্রতিরোধের শক্তি। দুই বিশ্বযুদ্ধ-মধ্যবর্তী সময়ে যন্ত্রসভ্যতার পীড়নে বিচ্ছিন্ন মানুষের যন্ত্রণা অভিব্যক্তি খুঁজে পায় এলিয়টের পোড়োজমির বর্ণনায়, আসে, পুরাণ, সংযোগ তৈরি হয় ঐতিহ্যের সঙ্গে। নৈরাশ্যের মধ্যে জাগে নৈরাশ্য নিয়ন্ত্রণের বিশ্বাস। পুরাণ কবিকে এই আত্মসচেতনতা প্রদান করে।
বিষ্ণু দে
বাঙালি কবি বিষ্ণু দে ও ইংরাজ কবি এলিয়টের কাব্যভাবনার নৈকট্য প্রসঙ্গে বাংলা কবিতার ইতিহাসকার এলিয়টের কাছে বিষ্ণু দে-র তিনটি ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন। এক, ঐতিহ্যচেতনা দুই, নৈর্ব্যক্তিকতা এবং তিন, আত্মসচেতনতা। বস্তুত বিষ্ণু দে নিজেই এ সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন:
১. নেতির সংযেমের শিক্ষা শুরু হল, ঐতিহ্য ও ব্যক্তির সম্বন্ধ হল কর্মিষ্ঠ সচল, ব্যাখ্যা থেকে পরিবর্তনের, পুনগ্রহণের নির্মাণের।
২. নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি কাব্যজগতে এলিয়টের দান।
৩. এলিয়টের কাছে বাংলা লেখকদের ঋণগ্রহণ মুখ্যত এই আত্মসচেতনতার ক্ষেত্রে। আত্মসচেতনতা হয়ে উঠল কবিমার্গে প্রত্যক্ষ সত্তাসম্পন্ন।
এলিয়টের কাব্যভাবনার সঙ্গে বিষ্ণু দে-র কাব্যভাবনার মিল ও অমিল স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। আমরা এখানে শুধু এটুকুই মনে রাখব যে বিষ্ণু দে-র কবিতায় পুরাণ প্রসঙ্গে উপরোক্ত তিনটি দিকনির্দেশই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং একে অপরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে বিষ্ণু দে-কে পৌঁছতে হয়েছে ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট চেতনায়, যা এলিয়টের ভাষায় ধ ঢ়ৎবপবঢ়ঃরড়হ, হড়ঃ ড়হষু ড়ভ ঃযব ঢ়ধংঃহবংং, নঁঃ রঃং ঢ়ৎবংবহপব, তাই তাঁর কবিতায় হাতধরাধরি করে চলেছে অর্জুনের প্রতীকের সঙ্গে হ্যামলেটের প্রতীক, উর্বশীর সঙ্গে আর্টেমিসের চিত্রকল্প। তৈরি করেছেন প্রাচ্যের পুরাণের সঙ্গে প্রতীচ্যের পুরাণের মেলবন্ধন। এসবের জন্য তাঁকে অর্জন করতে হয়েছে নৈর্ব্যক্তিক তন্ময়তা। ক্যাটালিষ্টের ভূমিকা কবির। আর আত্মসচেতনতা বিষ্ণু দে-র সমগ্র কবিব্যক্তিত্বেরই অঙ্গ। এমন আত্মসচেতন কবি যখন পুরাণ ব্যবহার করেন, তখন তা শুধুমাত্র ব্যক্তিচেতনার কেন্দ্রে আবর্তিত হয় না, দেশ ও সময়ের আলোকে তার স্ফুরণ ঘটে। এলিয়ট যখন ধর্মীয় চেতনার কাছে শান্তি খোঁজেন, বিষ্ণু দে তখন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিস্বরূপের দর্শনের গভীরে। মানবচৈতন্যের আপাত বিচ্ছিন্নতার সমস্যা তাঁর কাব্যভাবনায় বহুমুখী পরিণতি লাভ করে। তাই তাঁর পুরাণপ্রয়োগেও সচেতনভাবে তিনি দেশকাল-সমাজের চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে এগোন।
কবিতায় মিথের ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছেন যেসব আলোচক, তাঁদের বক্তব্য হল, পুরাণের প্রতি আগ্রহ আসলে ইতিহাসের পরিবর্তন ও জয়যাত্রার ক্ষেত্র থেকে দুরে সরে থাকা মাত্র। বিষ্ণু দে-র পুরাণব্যবহার প্রসঙ্গে একথা খাটে না, কারণ ইতিহাসের প্রগতির দিকে নিজস্ব অভিমুখ নির্দিষ্ট রেখেই তাঁর পুরাণপ্রসঙ্গ। পুরাণকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন ইতিহাসের অগ্রগতির স্বার্থে। বর্তমান সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে তাঁর কবিতা আবর্তিত হওয়ার ফলে ব্যক্তিগত প্রেম- প্রকৃতি চিন্তাও সমাজের সামাগ্রিক পটে উদ্ভাসিত। পুরাণের ব্যবহারও এই প্রেক্ষাপটটিকে আরো নির্দিষ্ট, অর্থবহ ও তাৎপর্যময় করার লক্ষ্যেই নিয়োজিত। প্রেমের যন্ত্রণা ও শ্রেণিভিত্তিক সমাজের অসহায়তা এবং সেইসঙ্গে বেঁচে থাকার ভালো শর্তগুলোকে আয়ত্ত করার আকাঙ্খা তাঁর পুরাণকাহিনির অভিমুখ। যেসব গ্রিক ও রোমান মিথ বিভিন্ন ইউরোপীয় কবিদের হাতে ব্যবহৃত হয়েছে নানা তাৎপর্যের অনুষঙ্গে, বিষ্ণু দে সেইসব মিথকে ব্যবহার করে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। ইতিহাসসচেতন বিষ্ণু দে-র পুরাণনির্ভর চরিত্রেরা বর্তমান যুগযন্ত্রণার প্রতীক হয়ে উঠেছে। পুরাণ থেকে যে চিত্রকল্প ও অনুষঙ্গ তিনি অনুসন্ধান করেছেন, আধুনিক সচেতনতার বিষয় করেই তাদের উপলব্ধি করেছেন। তার মূল প্রবণতা রোমান্টিকতার দিকে হলেও প্রতি-রোমান্টিকতার মেজাজ প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে হয়তো একধরণের দ্বৈততা সৃষ্টি হয়েছে তাঁর চেতনায়, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি।
উর্বশী ও আর্টেমিস
দেখি মুহূর্ত-বিম্বে চিরন্তনেরই ছবি
উর্বশী আর উমাকে পেয়েছি এ প্রেমপুটে।
উর্বশী ও আর্টেমিস কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘পলায়ন’-এ আছে এই লাইনদুটি।
‘অর্ধনারীশ্বর’ কবিতায় দেখি-
উলঙ্গপর্বতে কভু উর্বশীর পড়ে নাই শ্বাস
চালিয়াছি পূজিবারে মন্দিরের অর্ধনারীশ্বর
‘উর্বশী’ কবিতায়
আর রাত্রি রবে কি উর্বশী
আকাশের নক্ষত্রআভায়, রজনীর শব্দহীনতায়
রাহুগ্রস্ত হয়ে রবে বাহুবন্ধে পৃথিবীর নারী
পরশ কম্পিত দেহ সলজ্জ উৎসুক?
উর্বশী ও পুরবার বিরহের অনুযঙ্গ এভাবেই উজ্জীবিত করেছেন কবি। আর এভাবেই ‘ছুটে চলে অপ্সরারমনী’ বিষ্ণু দে-র কবিতায়- উর্বশী এক আর্কেটাইপ তৈরি হয়। ‘ভাষা তার কী-বা বলে- ডায়ানা? উর্বশী?’ বন্য প্রকৃতির দেবী ডায়ানা, যা আর্টেমিসেরই রোমান নাম, উর্বশীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ কবিতায় দু’দেশের দুই মিথ একত্রগামী আর এখানেই দেশজ স্থাণিকতা কবি অতিক্রম করে যান-
তপোবন নেই আর কণ¦মুনির
আজো তবু বিপুল পৃথিবী
আজো এই আমাদের কাল
আজো এই জ্ঞানবিজ্ঞ জারাবৃদ্ধ অভিজ্ঞ ভুবন
পলাতকা উর্বশীর প্রতি পদপাতে
দুলে দুলে ওঠে ¯œায়ু আলোড়িত উতলা কম্পনে।
আজো তাই পরিশ্রান্ত ম্যামন-মলিন
জলস্থল কেঁপে ওঠে উর্বশীর দেহের আস্বাদে।
উর্বশীর স্বপ্নমায়া ছিন্ন করার জন্যই যেন কবি এনেছেন কৌমার্য ও উর্বরতার দেবী আর্টেমিসের নাম। বন্ধ্যা রোমান্টিকতা পরিত্যাক্ত করে নতুন সৃষ্টির পথ খুঁজতেই কি আর্টেমিসের স্মরণ ? বিষ্ণু দে নিজেই বলেছেন-
‘উর্বশীর প্রতীকের কেন্দ্রের বিপরীত কাব্যবেগ দানা বেঁধেছিল আর্টেমিসের রূপে, শুচিকৌমার্য্যরে তণুদেবী, চন্দ্রের হিম অধিষ্ঠাত্রী, শিকারের দেবতা আর্টেমিসেই।’
উর্বশী ও আর্টেমিস-এ প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অনেক মিথ পুরাণ, মধ্যযুগের ইউরোপের উপাখ্যান, উপনিষদের উদ্বৃতি কবিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বৃহৎ ঐতিহ্যের অন্তর্গত করেছে। উর্বশী, উমা, পুরুরবা, বজ্রপাণি, ডায়ানা, ওরায়নপ্রিয়া, ট্রিস্টার্ন ও ঈসোলডে, অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা, ক্লিয়োপেট্রো, বাতিচেল্লির ভেনাস, এরস-মাতা ইত্যাদির অভূতপূর্ব সহাবস্থান, যা কবির নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জনে সাহায্য করেছে।
ক্রেসিডা প্রসার্পিনা মহাশ্বেতা
মিথ বা পুরাণের সন্ধানে আমরা এই পর্যায়ে বিষ্ণু দে-র চোরাবালি কাব্যগ্রন্থের ‘ওফেলিয়া’, ‘যযাতি’, ‘মহাশ্বেতা’ কবিতাগুলোর দিকে লক্ষ রাখব। বস্তুত, চোরাবালির কবিতাগুলোতে রোমান্টিক প্রেমের আদর্শ ও বিগতমোহ আধুনিক কবির প্রেমভাবনার পার্থক্য সস্পষ্ট হতে দেকি। ‘ওফেলিয়া’ কবিতায় বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় কাতর হ্যামলেট-
রুন্ধ্রহীন আর্তনাদে এ আঁধার হেডিসের মতো
হৃদয় ধরেছে চেপে।
প্রেমের মুক্তিই তার আর্তি, অথচ এ প্রেম অধরা। ক্ষণপ্রভার মতো মুহূর্তের আলোয় ছিন্নভিন্ন তার আশা। গ্রিক মিথ থেকে নেওয়া হেডিসের উল্লেখ পংক্তিগুলোকে অর্থবহ করেছে নরকসম অন্ধকারের তীব্রতায়। বিষ্ণু দে এই কবিতায় দেবযানীর উল্লেখ করেছেন, অবশ্য তা যতটা না পুরাণের, তার চেয়ে বেশি রবীন্দ্রনাথের :
দেবযানী ! সাঁঝে তোমার প্রণাম মাঝে
ক্লিষ্ট আমার দিবসের ক্ষমা বাজে
শাপমোচনের সুরভি সুরের পাকে পাকে এই সাধনা আমার। পরবর্তী স্তবকেই আসে প্রসার্পিনার কথা। এই মিথটির কথা আগেই বলেছি। বলেছি, তাকে হেডিসের হরণ করার কথা। এলিসিনোরের এই পাতালরাজ্যের বর্ণনজা-
প্রসার্পিনা কুসুমে ছায়, বৈতরণী পাশে
ছড়ায় আহা!
পার্সিফোনির মূল মিথটিকে যেভাবে অন্য কবিরা ব্যবহার করেছেন, তাতে মাতা ডিমিটারের কন্যা পার্সিফোনির সন্ধানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এলিউসিসের রিচুয়াল। বিষ্ণু দে খুব সংক্ষেপে ওফেলিয়া কবিতায় পুষ্পচয়নে রত প্রসার্পিনার যে চিত্রকল্প আভাসে এনেছেন, তা মিলটনকে স্মরণ করায়। ‘যযাতি’ কবিতাতেও ‘প্রসার্পিনার মুঠিতেও তাই প্রণয়রতি’ পংক্তিটি সেই অর্থে নামের উল্লেখমাত্র, কোনো বিশেষ অর্থ বহন করছে না। সংস্কৃত সাহিত্যের পুন্ডরীক-মহাশ্বেতার কাহিনি, জন্মান্তর, পুনর্মিলন ও পুনরুজ্জীবনের কাহিনি। ‘মহাশ্বেতা’ কবিতায় পুন্ডরীকও প্রেমের হৃদয়পথে মুক্তির অন্বেষণ করে- ‘আজ কি আমাকে ভুলেছে মহাশ্বেতা?’ এই নাটকীয়তার সঙ্গে এসে মিশেছে সমসাময়িকতার দীর্ঘ ছায়া:
পশ্চাতে ধায় মরণ-চাঁদের আলো
দিগন্তফণা, তুহিন, পান্ডু, কালো।
প্রেম ও জীবনের প্রতীক মহাশ্বেতা দেশ ও সময়চেতনার আধারে প্রোথিত। ‘মুদ্রিত বরাভয়’ কি অভয়দাত্রী দেবী দুর্গার পৌরাণিক আভাস?
‘ক্রেসিডা’ কবিতাটি সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন- ‘এখানে তিনি বাদী, বিবাদী ও অনুভাবী ভাবের নাটকীয় প্রতিসাম্যা ঘটিয়েই সন্তুষ্ট হন নি, যে-প্রশস্ত পরিমন্ডল গড়ে তুলেছেন, তার মধ্যে চসর হেনরিসন ও শেক্সপীয়র তুল্যমূল্য।’ (‘চোরাবালি’, স্বগত)। গ্রিক পুরাণের নারী ক্রেসিডা ট্রয়ের রাজপুরোহিত কন্যা, রাজপুত্র ট্রয়লাসের প্রণয়িনী হয়েও শত্রুপক্ষের শিবিরে গিয়ে গ্রিক যোদ্ধা ডায়ামিডিসের প্রেমের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। চসার, হেনরিসন ও সেক্সপিয়র এই কাহিনি অবলম্বনে কাব্যরচনা করেছেন এবং প্রত্যেক কবির হাতেই ক্রেসিডা চরিত্র আলাদা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। তবু থিমটি এক-প্রেমে একনিষ্ঠতার অভাব। ক্রেসিডা বিশ্বাসঘাতিনী হলেও চসার ও শেক্সপিয়ার তার কোনো শান্তিবিধান করেন নি, কিন্তু স্কটিশ কবি হেনরিসন তার প্রায়শ্চিত্ত বিধান করেছেন তাকে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ভিখারিনি করে- যে হাত পেতেছে ট্রয়লাসের কাছে। ট্রয়লাস তাকে চিনতে না পারলেও ক্রেডিসা জেনেছে ভিক্ষাদাতার নাম, তাই প্রণয়ের আভিজ্ঞান অঙ্গুরি ফেরৎ পাঠায় ট্রয়লারের কাছে। এরপর তার মৃত্যু হয়।
বিষ্ণু দে-র কবিতাটি উত্তমপুরুষে বর্ণিত, সে ট্রয়লাস, কিংবা কবি, যে চিনেছে ক্রেসিডাকে, এবং তার মনের বিচিত্র প্রতিক্রিয়াই কবিতাটির বিষয়বস্তু হয়েছে।
বিদ্যুৎ নেভে ঈশানবিষাণে, বজ্রও দিশাহারা
এলোমেলো পাখা ঝাপটি তবুও কথা ওড়ে ক্রেসিডার।
‘পাখির চিত্রকল্পটি এখানে অব্যর্থ। তার পাখা ঝাপটানি, ওড়ার মধ্যেই প্রতিবাদ আছে, আছে কালোত্তর যাত্রা।
‘কান্ডারীহীন বালুকাবেলায় চোখ পুড়ে মরে দূরে’- এই স্বপ্ন ও প্রেমের অনিশ্চিয়তার মধ্যেও কবি বলেন :
ক্রেসিডা তোমার থমকানো চোখে চমকায় বরাভয়
তোমার বাহুতে অনন্ত স্মৃতি ক্রতুকৃতমের শেষ।
মত্তপ্রলয় তোমাতেই করি জয়।
ট্রয়লাস ও ক্রেসিডার প্রণয় যেমন ট্রয়ের যুদ্ধের সময় বিপর্যস্ত হয়েছে, বর্তমান সময়ের সংকটও একইভাবে বিপর্যস্ত করছে প্রেমকে-
হেলেনের প্রেমে আকাশে বাতাসে ঝঞ্চার করতাল।
দ্যুলোকে ভুগোলে দিশাহারা দেবদেশী।
পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ও প্রেমের প্রতীক হেলেন, তার প্রেমের আকর্ষণের অভিঘাতে বিনষ্ট দেশ- ‘স্বপ্নগোধুলি ডুবে গেল খর রক্তের কোলাহলে’। অন্যদিকে, প্রেমে নিষ্ঠাহীন ক্রেসিডা, হয়তো সে আহত করেছে পুরুষ-হৃদয়, কিন্তু তাকে বিনষ্ট করতে পারে না: ‘উদ্বায়ু আজো হয়নি আমার মন’। এখন ক্রেসিডার প্রতি তার আকুলতা, অনিঃশোষিত জীবন ও প্রেমের মোহময় হাতছানি।
হেলেনের বুকে শবসাধনার বিশ্রাম আর নেই।
আমার হৃদয়-ঘটাকাশে শুধু জীবনের আরাধনা।
এই বৈপরীত্য প্রতীচ্যের হেলেন ও প্রাচ্যের শবসাধনা ও তন্ত্রচর্চার ইঙ্গিতে কবিতাটি নাট্যাবেগে চঞ্চল হয়েছে। স্বগতোক্তি, প্রেমের তীব্র আবেগ ও উচ্চারণের নাটকীয়তায় বিষ্ণু দে-র কলমে মিথ আলাদা মাত্রা অর্জন করে। জীবনে পুনরুজ্জীবনের আশা ও প্রেমের ধ্রুবসংকেত শেষ অব্দি জয়ী হয়- ‘উল্লাসে গায় পালে পালে ক্রীতদাস।’
সুভদ্রা অর্জুন ধনঞ্জয়
মহাশ্বেতা ও ক্রেসিডার মিথে, ওফেলিয়ার কাহিনিতে, এবং প্রসার্পিনার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে সামাজিক অথচ ব্যক্তিমানুষেরই প্রেমাকাঙ্খা ও মুক্তির তৃষ্ণা। কিন্তু ‘পূর্বলেখ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রেম ও প্রত্যয়ের ভরকেন্দ্র পুরাণের নারীদের থেকে সমাজ ও সময়ের দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। কবির ভাষায়, যেন ‘¯œায়ুর জ্যামুক্তি’ ঘটল মার্কসবাদের তাত্ত্বিক দীক্ষায়, জনগণের প্রত্যক্ষা সংযোগে। বিষ্ণু দে বলেছেন: ‘সাহিত্যিকের চোখ সমসাময়িক সমাজ সবসময়েই বোধহয় জিজ্ঞাসায় পরিগ্রহণে উত্তেজনায় উদ্ভ্রান্তিতে বিদ্রোহে কমবেশি চাঞ্চল্যকর, অথচ সাহিত্যিকও এই মিশ্র সমাজেরই ভবিষ্যতোন্মুখ অথবা অতীত-নির্ভর সরব সরিক।’ (সাহিত্যিকের চোখে আজকের সমাজ, প্রবন্ধ সংগ্রহ-২)
প্রথম কবিতা ‘বিভীষণের গান’-
কবে যে আমি ছেড়েছি স্বর্গজয়ের দুরাশা যত!
বক্ষে আঁকড়ি ধরেছি স্বর্ণসীতারেই,
তেত্রিশ কোটি ছেড়ে সসাগর পিতারেই
পাকড়ি, বিষম রুদ্রের বিষ উগারি দেখি
ঈষার আকাশে শ্মশানগোধুলি কুয়াশাহত।
পুরাণের কথা ভারতীয় কাহিনিজাত। গ্রিক তথা ইউরোপীয় মিথ এখন আর কবিকে আকর্ষণ করছেনা। কন্যাহীন শিবসওদাগর, উদাসীন বজ্রপাণি, শীতকম্প অমরা, শিবের গাজন, সগরসন্তান, জটায়ুর পাখা, উন্মত্ত অপ্সরা, কিন্নবীর দল, চিত্রগুপ্ত, কৈলাশ ইত্যাদির উল্লেখ দেশীয় পুরাণ থেকে সংগৃহীত।
দুটি কবিতা আমরা বিশেষভাবে লক্ষ করব- একটি ‘পদধ্বনি’ অন্যটি ‘জন্মাষ্টমী’। ‘পদধ্বনি’ অর্জুন ও সুভদ্রার কাহিনি সঞ্জাত। অর্জুনের প্রতীকে কবি আসন্ন বিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে সুবিধাভোগী বুর্জোয়ার ক্লীবতার ছবি এঁকেছেন। দস্যুর পদধ্বনি সমাজবিপ্লবেরই প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে। এই অনিবার্য পরিবর্তন সম্ভাবনা বোধের ক্ষমতা বুর্জোয়া সমাজের নেই। যে অর্জুন বলরামকে পরাজিত করেছে, আজ তার গান্ডীব ব্যর্থ। পুরাণের প্রতীকে এই সামাজিক চিত্রপট, কোনো ব্যক্তিমানুষের কথা নয়। ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ জাতীয় স্মৃতিতে বিস্তার লাভ করেছে।
কার পদধ্বনি আসে? কার?
এ কি হল যুগান্তর! নব অবতার!
ট্রয়লাস, হ্যামলেট ও পুন্ডরীকের মতো ধনঞ্জয় এখানে আর শুধু ব্যক্তিমাত্র নয়, সমগ্র সমাজেরই প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিষ্ণু দে এখানে দ্বান্দ্বিক ইতিহাসের চেতনায় সম্পৃক্ত, ব্যক্তিমানুষ আজ আর নির্দিষ্ট নয়, তাই পুরাণের ব্যবহারও ক্ষীণ।
‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর কবি পুরাণ ও বর্তমান সময়চেতনায় নিরিখে নতুনভাবে অন্বিত হন ‘জন্মাষ্টমী’ কবিতায়। চোরাবালির ব্যঙ্গ, পুরাণনির্ভরতা, উর্বশী ও আর্টেমিসের ব্যর্থতা ও শূন্যতার পটভূমি শ্রেণিচেতনার পরিসরে এখানে ব্যঞ্জনা পেল। অবক্ষয়ের টানে ‘ব্যর্থ ধনঞ্জয়, ব্যর্থ গান্ডীব’।
এই ঝড়ে উর্ধ্বশ্বাসে অপচেতা বক্রবেশী আবর্তবিহীন
কবন্ধ দুঃস্বপ্ন ঘোরে
মোক্ষহীন ভিক্ষুকের বিষণœ আবেগ।
হে বন্ধু, এ নাচিকেত মেঘ
আসন্ন মুমূর্ষাক্ষুব্ধ আমার পাতাল
ধুয়ে দিক বজ্রযোগে বিদ্যুৎ অঙ্গারে
উড়ায়ে পুড়ায়ে দিক বিষঙ্গের উজ্জীবনে
সঞ্চীবনী প্রতিষেধে, সাবিত্রীকে সম্পুরকে
বেঁধে দিক হে সুশ্রুত, উদগতির হিরণ¥য় জালে।
হাহাকার নেই, উত্তেজনা ও আক্ষেপ নেই, আছে সন্ধান, প্রশ্ন ও প্রত্যয়। ‘ঠিক জানো ধনঞ্জয়, তুমিও ছুটবে না?’ কেননা ধনঞ্জয়কে কাজ করতে হবে জনতার সঙ্গে, সমিতির পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে তাকে দেশ ও দশের সেবায়।
তুমি বুঝি শোননিকো গায়ত্রীর গুহাগুপ্ত গানে
তৃপ্তিহীন সংকটের তীব্র আর্তনাদ
দিবারাত্রি বিশ্বামিত্র করে যায় একা?
তবু তো হাহাকার নেই। প্রত্যয়ের সুরে কবি বলেন:
আনন্দের যে ভৈরবী মীড়ে মীড়ে
সুষু¤œার শিরে শিরে
সাযুজ্যসংগীতে
আর সেই সংগীত চেয়ে
অঘমর্ষী জনতার উদ্গীথ-মুখর
এ কুৎসিত জীবনের ক্লৈব্যগামী স্বার্থপর ব্যর্থতা জানাই,
কুম্ভীরক তাই।
কাসান্দ্রা আইসায়া টাইটেরিয়স
আবার এসেছে বিদেশি মিথ। দুটি কবিতায় বিষ্ণু দে অ্যাস্কাইলাস ও ইউরিপিডিস প্রমুখ কবিদের ব্যবহৃত মিথে আশ্রয় নিয়েছেন- সন্দীপের চর কাব্যগ্রন্থের ‘কাসান্ড্রা’ ও নাম রেখেছি কোমল গান্ধার-এর ‘কাসান্দ্রা’। কাসান্দ্রার মিথটি এইরকম- ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম ও হেকুবার কন্যা কাসান্দ্রার শক্তি ছিল অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করবার। সূর্যদেবতা অ্যাপোলো তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে কাসান্দ্রা অসম্মতি জানায়। অ্যাপোলো ক্রোধে কাসান্দ্রার ভবিষ্যৎবাণী করার শক্তি নষ্ট করে দেন এই বলে যে সত্যতা থাকলেও কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। কাসান্দ্রা ট্রয় ধ্বংসের কথা আগেই জানিয়েছিল, বিশ্বাস করেনি কেউ। ট্রয়ের পতনের পর তাকে অ্যাথেনার মন্দিরের আশ্রয় থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিষ্ণু দে কাসান্দ্রা ও অ্যাপোলোর সম্পর্ককে দুদিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। ‘কাসান্দ্রা’ শুরু হচ্ছে এইভাবে-
বলো কাসান্ড্রা, এত দুর্যোগ ছিল কোথায়
সকলে ভাবছি- প্রায় সারা দেশ, কয়েকজনাকে
বাদ দিই। মুখ খোলো কাসান্ড্রা, সূর্যালোকে
ঝলসিয়ে চোখ বলো কী পাপের শাসন এ হায়
কাসান্দ্রার কথা বিশ্বাস করার প্রতিশ্রুতি করিব- দেশটা ট্রয় নয়, ভারতবর্ষ, আর সময়ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকাল। তবু অ্যাপোলোর চোখ ঝলসানো তাপ। সমকালীন বাস্তবতার ছবি কবিতার প্রতি ছত্রে। সুবিধাভোগী বিত্তশালী কিছু মানুষ অবশ্যই এ দুর্যোগের বাইরে, তারা ‘হিরন্ময়েরই পাত্রে ঢোকে’। ট্রয়ের যুদ্ধের কারণ যদি হেলেন, ভারতবর্ষের মানুষ ‘তবু কেন মরি ঘরে বসে লোভী ট্রয়ের রণে?’ কেন ‘বিশ্বের ভার ও ঘাড়েই পড়ে?’ ’ঘর থেকে টেনে আনে সংক্রাম দুঃশাসনে’? এভাবেই তো কাসান্ড্রাকে অ্যাথেনার মন্দির থেকে টেনে আনা হয়েছিল: অ্যাপোলোর বিধ্বংসী ‘সূর্যালোকের নগ্নতা পায় তার যত ক্ষত’। মনে রাখতে হবে, ভারতের মানুষের সূর্যের পূজারী, তবে কেন সূর্যালোকেই ধ্বংস অনিবার্য হবে, এ প্রশ্ন করিব। এর মধ্যে বেড়ে ওঠে কিছু সুবিধাভোগী মানুষ, যারা মনুষ্যত্বের অভাবে হীন। এইভাবে সমগ্র কবিতাটিতে কাসান্ড্রার দুর্গতির সঙ্গে দেশীয় পরিস্থিতির সাযুজ্য তৈরি করা হয়েছে। নৈরাজ্যের স্বরূপ উদঘাটনে কাসান্দ্রা সচেষ্ট হবে, এ বিশ্বাস করিব।
কাসান্দ্রা মিথ ফিরে আসে পুনরায়। সময়কাল ১৯৪৬-১৯৫৩। পরিস্থিতি একই। মন্বন্তর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে মানুষ। তবু মানুষের যাত্রা রুদ্ধ হয় না। কাসান্দ্রাও সূর্যদেবতার ক্রোধের কাছে অবশ্য স্বীকার করেনি। তবু বাস্তবের দিতে কাসান্দ্রাকে চোখ ফেরাতে হয়-
আমার অস্তসূর্য আমার অরুণাশ্বের রথী
তাই কাসান্দ্রা ঘর ভাঙা উদ্ভ্রান্ত
লুব্ধ সূর্য, তাই ট্রয় জুড়ে চলে
গুপ্তঘাতক, মৃত্যুর রুষ্ট ক্লান্ত
অমর প্রাণের মর জীবনের
ফসল ফলানো আলোর গানের
অমর সূর্য ভুলে গেছে আজ
জীবনে মরণ হেনে কতোটুকু কার ক্ষতি?
সূর্যালোক জীবনদায়ী, আবার সূর্যালোকেই মানুষকে অন্ধ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখানে বিষ্ণু দে অ্যাপোলো-মিথের সঙ্গে যুক্ত করেছেন ভারতীয় চেতনাবাহিত সূর্যের জীবনরক্ষার ভাবনা। কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে:
কাসান্দ্রা ঘুরি অতন্দ্রচোখ পথে পথে বন্ধুর
ইনিয়স যাক লোভন ভবিষ্যতে!
অজেয় আমার আলুলিত বেণী, যুগান্তে সংহতি।
কাসান্দ্রার মধ্যে দিয়ে আর ব্যক্তিচেতনার আধারে স্বীয় পুনরুজ্জীবনের কথা নয়, গোটা দেশ ও সমাজ মূর্ত হয়ে উঠেছে। কাসান্দ্রা হয়ে উঠেছে দেশ ও সময়কালের বিশ্লেষক। কাসান্দ্রার মতোই যেন কবির ভবিষ্যৎবাণী, এই দুঃসময়ের কথা তিনি বারবার বর্ণনা করে যাচ্ছেন।
এই কবিতাটির সূত্রেই দেখা মিলেছে পুরাণের হেক্টরের:
হেক্টর বুঝি ঐ বুঝি বাঁধা রথে
ঘুরে ঘুরে গেছে রথের চাকার পাকে
মৃত হেক্টর হতাহত হেক্টর!
ট্রয়ের রাজকুমার হেকটর। গ্রিক বীর অ্যাকিলিস তাকে যুদ্ধে হত্যা করে। নৈরাশ্যের বর্ণনা প্রসঙ্গেই হেকটরের প্রসঙ্গ এনেছেন বিষ্ণু দে। ইয়েট্স- এর ‘আ ভিশন’ কবিতায় এই প্রসঙ্গ দেখি-
অঃযবহব ঃধশবং অপযরষষবং নু যধরৎ,
ঐবপঃড়ৎ রং রহ ঃযব ফঁংঃ, ঘরবঃুংপযব রং নড়ৎহ
ইয়েটস এখানে মানুষের ব্যক্তিত্বের বীরোচিত দিকটির সঙ্গে ট্রাজিক দিকটিকেও ইতিহাসগত সময়ের প্রতীক করে তুলেছেন।
সন্দ্বীপের চর-এর কবিতা ‘আইসায়ার খেদ’, আর নাম রেখেছি কোমল গান্ধার-এর অন্তর্গত ‘টাইটেরিয়স’। বাইবেল ওল্ড টেস্টামেন্টের মহাপুরুষ আইসায়া আর টাইটেরিয়স গ্রিক পুরাণের দীর্ঘায়ু অন্ধ ভবিষ্যদ্দর্শী। টাইটেরিয়াস সফোক্লিসের অয়দিপাউস নাটকের অন্যতম চরিত্র। দুটি চরিত্রই কবিতায় কথকের ভূমিকায়- যেন মহাভারতের সঞ্চয় অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এ বর্ণনা দেশের, সমকালের। আইসায়া এখানে পঁচিশ বছর ধরে পেনসনভোগী বৃদ্ধ, সে দ্যাখে-
চাষিরা চালায় কাস্তে, মজুরেরা মুষ্টিবদ্ধ খাটে।
তারপরে কালযুদ্ধ মৃত্যু আর মৃত্যু মন্বন্তর
ক্রমান্বয়ে মহামারী নরকের নবান্ন উৎসবে।
তার কণ্ঠে কমেন্টারির মতো শোনায় এই কথা ঃ
যুদ্ধ দেয় পক্ষপাত, বলে আজ কালের ঘর্ঘর
এ যুদ্ধে এনেছে ফের পাঞ্জজন্য, দাবি পক্ষপাত
বলে বিশ্ব এক, বলে শনিগ্রহদের কক্ষপাত
সেও নাকি মানুষের হাতে
বয়সের অভিজ্ঞতার কথা বারবার আসে, অনেক দেখেছে বলে আশার আলো অন্তর্হিত হয়নি তার চোখ থেকে ঃ
দেখি নয়নে ভাস্বর
তার নীল নদী বয়, দুই তট সবুজ উর্বর।
টাইটেরিয়াস গ্রিক মিথের অন্তর্গত হলেও সেফোক্লিসের নাটকের সৌজন্যে পরিচিত নাম। কাসান্দ্রা মিথ থেকেই দেখা যাচ্ছে, বিষ্ণু দে বারবার ভবিষ্যৎবাণীর থিমটিকে ব্যবহার করছেন। অবশ্য টাইটেরিয়স শুধু ভবিষ্যতের কথাই বলছেনা, সে দেশ ও দশের ব্যাখ্যাকারও। ভাষার তির্যকতা পাঠকের কান এড়ায় না-
আমার দুচোখ অন্ধ, অতীত ও ভবিষ্যৎ স্মৃতি শ্রুতি
তোমার উলঙ্গরূপ তাই দেখি রোজ
তুমি তো দেখনি দেশ অনাহার কাকে বলে
দেখনি তো সারাদিন ঘুরে ঘুরে
নঙরখানার পাশে সন্ধ্যার নৈরাশে
নিজের শিশুর মুখ
পরবর্তী পংক্তিুগুলোতে তির্যকতা গাঢ় হয়, ব্যঙ্গের পর্যায়ে পৌঁছে যায়-
তুমি তো দেখনি দেশ, এই দেশ
বিরাট, উদার, উর্বর, প্রাচীন, রঙীন, উজ্জ্বল আসমুদ্র হিমাচল
তুমি জান শেয়ার-বাজার বোর্ডের মিটিং
তবু বুর্জোয়া সুবিধাভোগীর যে নিস্তার নেই আর, তাও সে জানাতে ভোলে না।
ইনফার্নো থেকে পারাদিজো
বিষ্ণু দে-র কবিতায় উর্বরতার কথা, জীবনের পুনরুজ্জীবনের কথা, নরকের পরিবেশ থেকে উত্তরণের কথা বারেবারে আসে। ‘আমি তো যেতে চাই’ বলে যেখানে পৌঁছতে চাইছেন, তা স্বপ্নস্বর্গেরই এক ছবি, যেখানে ‘নির্ঝর স্ফটিক চঞ্চল আর ষড়ঋতুই মধুর-মুখর’- এই স্বর্গের আভাস প্রেমের পথে, জনজোয়ারের পরিবর্তনে মেলে। এই কল্পনাস্বর্গের সঙ্গে প্রায়শই সংশ্লিষ্ট হয়ে যায় পুরাণের প্রসঙ্গ। সপ্তম পারাদিজোর প্রান্ত থেকে তাঁর অনামা বিয়াত্রিচে তাকে স্বর্গের পথে আহ্বান জানায় ঃ
আমিও সৌভাগ্যবেশে তোমাকে দেখেছি বিয়াত্রিচে,
নবসামন্তীর কুঞ্জে নিজে পরিয়েছি গুঞ্জামালা
তোমার অমরকণ্ঠে, তৃতীয় স্বর্গের আলো-জ্বালা
নভোদয় এ হৃদয়ে
তবুও তিনি ‘ছদ্মবেশী নরকের কোলাহলে বেসুর বেতালা,’ স্মৃতি যে অতীত ইনফার্নো, সত্তা যেন বর্তমানের উদ্ধার-উন্মুখ পুরগাতোরিও, আর ভবিষ্যৎ তো সাম্যবাদী সমাজপ্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল পারাদিজো। যে পর্যায়ের কবিতা থেকে শুরু হতে দেখি পুনরুজ্জীবনের আকাঙ্খা, সেখানেই ধরা পড়ে নরকের বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার। ঘুরে ফিরে এই নরকের কথা আসে পুরাণের অনুষঙ্গ নিয়ে ঃ
১. দিকে দিকে বক্রগতি উদ্ধত কৌরব
চলে সূর্য বিতারিত অন্ধকার ঘরে।
নীরন্ধ্র অধীচি আর দুর্গন্ধ রৌরব
মর্ত্যে এ কে কালহেতু জনতায় ভরে! (চতুর্দশপদী-২)
২. নরক কি এরকম? বাংলার গ্রাম ও শহরে
লক্ষ লক্ষ দগ্ধগৃহ, কারো বৃদ্ধি ওসারে বহরে
নরকে জানে না শুনি আছে আছে তারা দুরন্ত নরকে
রৌরব প্রাসাদে হাসে শাদাকালো গৌরব-প্রহরে!
দধীচির হাড় জ্বলে, কী দেওয়ালি বিবস্ত্র মড়কে! (আইসায়ার খেদ)
৩. নরকে আমারও যাত্রা অলকার গন্ধ গায়ে
আমিও শুঁকেছি শকুনের শিরার আহার (অন্বিষ্ট)
৪. এলসিনোরের নরকে দিয়ো না বলি
তোমার এ দিনেমারে। (এনসিনোর)
৫. নরকের হিম অন্ধকারে
বিবর্ণ তুষার এই হৃদয়ের বহু পদপাতে (বহুবড়বা)
৬. ত্রিশঙ্কুর ঘূর্ণমান নরকের দ্বারে
চলো চিত্রগুপ্তের দরবারে
দেখে আসি তোমাদের ভবিষ্যৎ দিন
আমার অতীত রাত্রি বর্তমান নরক কিনারে (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)
৭. এ নরকে
মনে হয় আমা নেই জীবনের ভাষা নেই
আমরা নরকে আছি, অথচ সে জ্ঞান নেই মনে,
তাই বিবাহসভায় প্রচ্ছন্ন নরকে আজ রব নেই। (স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত)
৮. অনর্থক খুঁজে ফিরি জল। জল?
নরকে যে আমাদের নির্জলা ভুগোল (নির্জলা ভুগোল)
হোমার ও দান্তের নরক বিষ্ণু দে-র নরক প্রসঙ্গে মোটিফের কাজ করেছে। ফলে তার নরকও বস্তুত সমকাল ও দেশের আর্কেটাইপ হয়ে উঠেছে। হোমার তেমনভাবে হয়তো নয়, দান্তের উত্তরাধিকার বিষ্ণু দে-র কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে। উত্তরণ ঘটে না, তবু এই নরক পেরিয়েই পুরগাতোরিয়োতে পৌঁছতে চেয়েছেন। ইনফার্নো না পেরোলে তো সেখানে পৌঁছানো যায় না। তাই ‘নরকের পথে গান করে চলি মৃত্যুঞ্জয় যাত্রায়’।
পুরাণ থেকে লোকপুরাণ
বিষ্ণু দে-র কবিতায় বিদেশি মিথের ব্যবহার প্রসঙ্গে সমালোচক একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ ‘চতুর্দিকে যখন বিসংগতি দেখেছিলেন বিষ্ণু দে, তখন তিনি বারবার বিদেশী পুরাণ উল্লেখে বিচ্ছিন্নতার বোধকেই সাকার করেছিলেন, আবার যখন তিনি সংগতি ও সাযুজ্যের সন্ধানী হলেন তখন কানে এলো বিদেশী পুরাণের ব্যবহার। অনেকগুণে বেড়ে গেল স্বদেশী পুরাণের ব্যবহার।’ (অশ্রুকুমার শিকদার)
বিদেশি পুরাণের ব্যবহার কবির প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থগুলোতেই অত্যাধিক ঘটেছে। ব্যক্তিমানুষের বিচ্ছিন্নতা ও সাযুজ্যহীনতার ব্যাখ্যায় মিথ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একথাও আমাদের মনে রাখা দরকার যে বিসংগতি ও বিচ্ছিন্নতার পর্যায়েও নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি বিদেশি মিথ ব্যবহার করেননি- বিদেশি মিথের সঙ্গেও দেশি পুরাণের সহাবস্থান ঘটেছে। আর্টেমিসের সঙ্গে উর্বশী, ওফেলিয়ার সঙ্গে মহাশ্বেতা অবিচ্ছিন্ন থেকেছে। আবার যে পর্যায়ে দেশজ পুরাণের আধিক্য সেখানেও বিদেশি মিথ অপ্রতুল হয়নি। এসেছে কাসান্দ্রা মিথ। বস্তুত, সর্বতোভাবে ধ্রুপদি যাথার্থ্যরে অনুসারী বিষ্ণু দে বিদেশি মিথের ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই অনুভূতির আত্মস্থতা অর্জনের চেষ্টা করেছেন, এবং সেইসঙ্গে ছিল আত্মসচেতন তরুণ কবির নিজস্ব কাব্যপরিধি প্রশস্ত করার ঝোঁক- শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতার বোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে নয়। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে ‘দেশসমাজের পরিচয় সত্তার চৈতন্যে ধনী প্রজ্ঞাকে স্মৃতিতে সংহত করে দেশজ পুরাণের মধ্যে।’ এই কারণে পান্ডব-কৌরবদের কথা, বিভীষণ, হিরণ্যকশিপু, কংস, সুভদ্রা, বাসুকি, চাঁদসদাগর, সত্যভামা, দুর্বাসা ইত্যাদির সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিত পাঠকও স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে। মোটিফ হিসেবে এইসব ব্যবহার সহজেই পাঠকের দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। কংস ফ্যাসিজম, বিভীষণ ও যুযুৎসু সাম্যপন্থী মধ্যবিত্তের প্রতীক হয়ে ওঠে। বুর্জোয়া ধনিক শ্রেণির পরাজয় দেখাতে আসে কৃষ্ণের জন্মষ্টমীর প্রসঙ্গ।
কবিকৃতির সামগ্রিক বিবর্তনের পথ ধরেই ধ্রুপদি পুরাণের পাশাপাশি বিষ্ণু দে মনোযোগী হয়েছেন লোকপুরাণ, রূপকথা ও লোকসাহিত্যের অমূল্য উপাদান সংগ্রহ করে কবিতার পরিসর বাড়াতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে মার্কসীয় চেতনার প্রেক্ষিত থেকে তিনি ব্যবহার করেছেন এইসব দেশজ উপাদান। সাত ভাই চম্পার মতো রূপকথাও মানুষের মুক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। সমগ্র রূপকথার জগৎ ধারা দেয় কবির চোখে, অবশ্যই ভিন্ন অর্থে, সমাজচেতনার প্রজ্ঞায়। ধ্রুপদি পুরাণের জগৎ থেকে যাত্রা করে লোকজীবনের অন্দরমহলে প্রবেশ বিষ্ণু দে-র সামগ্রিক কবিসত্তার বিবর্তনের সম্পূর্ণতা নির্দিষ্ট করেছে।
মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন মনের আধুনিক অনুসন্ধানের সুত্র হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে মিথ সাহিত্য মর্যাদা পেয়েছে। মিথ ধর্মীয় আচারের ব্যাখ্যা করেছে, এবং অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মিথের বর্ণনা নাট্যরূপ পেয়েছে।
কিন্তু সাহিত্য ও শিল্পকর্মে ব্যবহৃত মিথকে বুঝে ওঠার জন্য মিথের সংজ্ঞা নির্ধারণ অবশ্যই জরুরী। In literary criticism myth means ultimately mythos, a structural organizing principle of literary form’ (নরথ্রপ ফ্রাই) একথা বলেও সবটা বোঝানো যায না। বস্তুত, সাহিত্যসমালোচকেরা যখন মিথের কথা বলেন, তখন তারা মিথ ও সাহিত্যে ব্যবহৃত মিথের পার্থক্যের কথা মাথায় রাখেন না। ব্রনিস্ক মলিনোয়াস্কি মিথের সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে- a narrative resurrection of a primeval reality, told in satisfaction of deep religious wants, moral cravings, social submissions, assertions, even practical requirements (মিথ ইন প্রিমিটিভ সাইকোলজি); সাধারণভাবে মিথের এই সংজ্ঞা গ্রহণে আমাদের বাধা থাকে না, কেননা এখানে আদিম সমাজের এক শক্তিশালী উপাদান হিসেবে মিথকে দেখা হয়েছে। একই রকমভাবে ই. ও. জেম্স মিথের সংজ্ঞা দিয়েছেন: True myth...... is not a product of imagination in the sense of speculative thought or philosophizings about the origins of phenomena in the form of an aetiological tale invented to explain objects and events that arouse attention, It is not idealized history or allerorized philosophy, ethics ics or theology All these may retain elements of the myth, but the myth itself is distinct from the fantasy, poetry, philosophy and psychology with which it has become associated in its ramifica-tions, developments and degenerations, and their interpretations. (মিথ অ্যান্ড রিচুয়াল ইন এনসিয়েন্ট নিয়ার ইস্ট) জেম্স বলছেন, আদিম মানুষ দুর্যোগের সময় আধিভৌতিক নানা শক্তির সাহায্যে চেয়েছে এবং পৃথিবীর সৃষ্টি, নশ্বরতা, মানুষের ভাগ্য, প্রাকৃতিক ঋতুচক্র, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নানা বিষয় সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এক sacred narrative- এর আকার পেয়েছে। এটাই হল মিথ, আর এর উদ্দেশ্য হল ‘প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা’ অনুসন্ধানের চেষ্টা।
মিথের মৌলিক শক্তি হল এই যে বিঙ্গান ও প্রযুক্তির কল্যাণে প্রকৃতি ও সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবতির্ত পরিস্থিতিতেও তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি, বরং ক্রমশই স্থান করে নিয়েছে সাহিত্যে। হোমার ও সফোক্লিসের কাহিনিতে যেসব দেবতা ও বীরের দেখা মেলে, তারা আক্ষরিক অর্থেই আগে পূজিত হয়েছে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অবশিষ্টংশ কিছু থেকে গেছে কিংবদন্তিতে ও গাথায়। কিংবদন্তি, লোকগাথা ও মিথ মিলেমিশে গেছে ইলিয়াডে। ট্রোজান যুদ্ধোর কিংবদন্তি বা বীরগাথাকে দেবতার উদ্দেশ অনুষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িত জড়িত মিথকে আলাদা করা যাবে না। মিথের মধ্যে দিয়ে এই আবেগ ও অচেতন সংযোগ প্রকাশ পায়। ফ্রয়েড মিথকে অচেতন কামনার প্রকাশ হিসেবে দেখেছেন, এ ফলে মানুষের মনোজগতের বিশ্নেষণে সাহায্য করেছে মিথ। মিথ ও স্বপ্নের মধেও সম্পর্ক স্থাপন করে ফ্রয়েড মেটাফিজিক্সকে মেটাসাইকোলজিতে উন্নীত করতে চেয়েছেন। তিনি প্রাচীন গ্রিক ও লাটিন সাহিত্যে পুরাণের ব্যবহারকে প্রবৃত্তিজাত কাজ ও অচেতনতার অন্তর্গত বিরোধের প্রকাশ হিসেবে মেনে করেছেন। ফলত, পুরাণব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে মানবজাতির মনোজগতের ইতিহাসে প্রবেশের একটা চাবিকাঠি মেলে।
মিথের যেকোনো সংজ্ঞা নির্ধারণে আদিম সমাজের ধর্ম ও জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলোকে যেমন মনে রাখা দরকার, তেমনি মিথকে যুক্তি ও নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টিতে দেখে শিল্প-সাহিত্যে তার প্রয়োগের দিকটিও মনে রাখতে হবে। লিলিয়ান ফেডার এই কারণে মিথের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা অনেকাংশেই মেনে নিতে আমাদের বাধা থাকে না। তিনি বলেছেন- Myth is a narrative structure of two basic areas of unconscious experience which are, of course, related. First, it expresses instinctual drives and the repressed wishes, fears, and conflicts that they motivate, these appear in the themes of myth. Second, myth also conveys the remnants within the individual consciousness of the early stage of phylogenetic development in which myths were created. (এনসিয়েন্ট মিথ ইন মডার্ণ পোয়োট্টি)।
মিথ ও পুরাণের চরিত্রেরা প্রায়শই দেবতা, অমিতশক্তিধর মানুষ বা অতিমানুষ, কিন্তু তাদের বর্ণনার উপাদানে যে দ্বন্দ্ব ও দুঃখ, যে সংকল্প, তাতে প্রকাশ পেয়েছে মানুষের আবেগসঞ্জাত। বিষয়গুলোই। পুরাণের মূল বিষয় হয়েছে মৃত্যুর রহস্যময় চক্র, ঋতুচক্রে বছরের পুনরাগমন, জন্ম, প্রকৃতি ও মৃত্যুর জন্য উৎকণ্ঠা ও ভীতি। মানুষের এই অসহায়তা যেমন সত্যি। পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের এই চেতনা থেকে মানুষ আয়োজন করেছে ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক আচারের। এই কারণে এইসব আচার অনুষ্ঠান পুরাণের অঙ্গীভূত হয়ে আছে। ফেডার বলেছেন: We identify with the hero of myth not only because he acts out our unconscious wishes and fears but also because in doing so he performs a continual rite of service for the rest of mankind he asks our essential questions and he answers them. (এনসিয়েন্ট মিথ ইন মডার্ণ পোয়োট্টি)।
কবিতায় মিথ পুরাণ
কল্পনা ও বাস্তব, নশ্বরতা ও অমরত্ব, প্রকৃতির কাছে অসহায়তা ও প্রকৃতি বিজয়ের আকাঙ্খায় ইউরোপীয় মিথ ও ভারতীয় পুরাণের এই সামাজিক ও মানবিক সংযোগ প্রথম থেকেই কবিদের প্রিয় বিষয়। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যে যেমন, ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যেও তেমনি পুরাণের প্রসঙ্গ বারবার উল্লেখিত হয়েছে। কবিতায় পুরাণ কবিদের বাস্তব ও কল্পনার পরিপার্শ্বকে বিস্তৃত করেছে। কবিতায় পুরাণ বা পুরাণের কবিতা কাব্যভাবনার নিরিখে ভিন্ন তাৎপর্য সৃষ্টি করেছে। পুরাণের এই ব্যবহার কখনও স্মৃতির অচেতন থেকে আহরিত, কখনও তা সক্রিয় কবিচৈতেন্যর প্রয়োগ। ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিকতার রূপ যথাযথ না থাকলেও আচার- অনুষ্ঠানের তাৎপর্য পুরোপুরি অপসৃত হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে যতো ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে দিয়েছে, মানুষকে তার অসহায়তার মুল ভূখন্ড থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নশ্বরতা ও প্রকৃতির কাছে অসহায়তা শুধু নয়, জটিল জীবনের ফাঁসে মানুষ নিজেকে নানা শৃঙ্খলে অবরুদ্ধ দ্যাখে। একদিকে সামাজিক অগ্রগতি, বিত্ত ও ঐশ্বর্যের উপকরণ, অন্যদিকে মুক্তির চিরায়ত আকাঙ্খা। এসবের কাব্যিক প্রকাশে মিথ বা পুরাণ যেন স্বতঃপ্রবৃত্ত ও সহজলভ্য উপকরণ হিসেবে কবিদের সামনে উপস্থিত। পার্থক্য যা কিছু, তা তাদের প্রয়োগে- আর এতে অবশ্যই নতুন করে অর্থবহ হয়ে উঠেছে পুরাণের দেবদেবীরা, বাস্তব ও কল্পনার সেই বীরেরা। উনিশ শতকের কিটস, টেনিসন ও মেরিডিথ হয়ে রবীন্দ্রনাথ, এজরা পাউন্ড, রবার্ট গ্রেভ্স, ইয়েটস, এলিয়ট, রেইন, রবার্ট লাওয়েল প্রমুখ বিখ্যাত কবিরাই নানাভাবে, নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরাণের প্রয়োগ করে তাঁদের কাব্যের ভৌগোলিক ও ইতিহাসের পরিধি বাড়িয়েছেন।
আমরা এখানে একটি মিথের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। গ্রিক পুরাণের দেবী ডিমিটার ও তার কন্যা পার্সিফোনি। পাতালের রাজা হেডিস পার্সিফোনিকে হরণ করে নিয়ে যায়। ডিমিটার অনেক অন্বেষণের পর একথা জানতে পারেন। দেবতার অনুরোধে হেডিস বছরে ছ’মাস স্ত্রী পার্সিফোনিকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়। অনেক কবিই এই মিথটিকে ব্যবহার করেছেন। পার্সিফোনির রোমান নাম প্রসার্পিনা বা প্রসার্পিন। প্রসার্পিন নামের সঙ্গে যে দুঃখবোধ জড়িয়ে থাকে, তাকে অস্বীকার করার জন্যই যেন ক্রিটস- এর Ode to Melancholy : Nor suffer thy pale forehead to be kiss’d By nightshade, ruby grape of Proserpine.
রবার্টস গ্রেভস-এর Dear lady Prosepine.........stooping over for Henna’s sakeএবং কবির প্রাণ ফিরিয়ে দিচ্ছে। পার্সিফোনির মিথটিকে তার আচারের দিকটিসহ ব্যবহার করেছেন ক্যাথারিন রেইন তাঁর The Transit of the Gods কবিতায়:
And I who haveeen Vig and Aphrodite
The mourning isis and the queen of corn
Wait for the last nummer, dread Pesephone
To dance my dust at last iftta the tomb.
এখানে বলার কথা এটাই যে একই মিথ বিভিন্নি কবির দৃষ্টিতে কিভাবে আলাদা রূপ পরিগ্রহ করছে। আমাদের আলোচিত কবি বিষ্ণু দে-ও এই প্রসার্পিনার মিথটিকে ব্যবহার করেছেন, এবং আমরা যথাযথ স্থানে তার বিচার করব।
জেমস জয়েস ও ইয়েট্স- এর রচনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এলিয়ট ও অডেন দুজনেই মিথিক্যাল মেথড-এর তাৎপর্যের কথা বলেছেন। বস্তুত, এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে তাঁরা কবি হিসেবে নিজেদের কাব্যভাবনার কথাই বলেছেন। ‘ইউলিসিস’ উপন্যাস প্রসঙ্গে এলিয়ট বলেছেন- In using the myth, in manipulating a continuous parallel between contemporaneity poraneity and antiquity, Mr Joyce is pursuing a method which others must pursue after him It is simply a way of controlling, of ordering, of giving a shape and a significance to the immense paronoma of futility and anarchy which is contemporary history. (সিলেক্টড প্রোজ)
ইয়েটস-এর আলোচনায় অডেনও একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জানিয়েছেন পৌরাণিক কাঠামো কবিতায় কেন প্রয়োজন। তাঁর বিশ্বাস- any poet today, even if he denies the importance of dogma to life, can see how useful myths are to poetry—how much, for instance, they helped Yeats to make his private experiences public and his vision of public events personal. (সিলেক্টড প্রোজ)
বস্তুত, এলিয়ট ও অডেন নিজেদের কবিতাতেও পুরাণের দ্বারস্থ হতে চেয়েছেন এভাবেই। বিশ শতকের কবিরা পৌঁছতে চেয়েছেন শৃঙ্খলা ও বিশ্বাসের তটভূমিতে, যা ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর। তাই চোখ ফেরাতে হয় ঐতিহ্যের মধ্যে থেকে আহরিত প্রতীকের দিকে। মিথ একদিকে মিথ্যা, অন্যদিকে সত্য। কারণ এইসব মিথ ‘express man’s deepest self-deception—his creation of gods in his own image his attribution to himself, or to a creature formed to mirror his marvelous fantasies, of powers of control beyond those of any human being ever born. (লিলিয়ান ফেডার)
অবিশ্বাস, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের প্রেক্ষিতে পুরাণের ব্যবহারই কল্পনাপ্রবণ কবিকে দেয় কাব্যিক প্রতিরোধের শক্তি। দুই বিশ্বযুদ্ধ-মধ্যবর্তী সময়ে যন্ত্রসভ্যতার পীড়নে বিচ্ছিন্ন মানুষের যন্ত্রণা অভিব্যক্তি খুঁজে পায় এলিয়টের পোড়োজমির বর্ণনায়, আসে, পুরাণ, সংযোগ তৈরি হয় ঐতিহ্যের সঙ্গে। নৈরাশ্যের মধ্যে জাগে নৈরাশ্য নিয়ন্ত্রণের বিশ্বাস। পুরাণ কবিকে এই আত্মসচেতনতা প্রদান করে।
বিষ্ণু দে
বাঙালি কবি বিষ্ণু দে ও ইংরাজ কবি এলিয়টের কাব্যভাবনার নৈকট্য প্রসঙ্গে বাংলা কবিতার ইতিহাসকার এলিয়টের কাছে বিষ্ণু দে-র তিনটি ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন। এক, ঐতিহ্যচেতনা দুই, নৈর্ব্যক্তিকতা এবং তিন, আত্মসচেতনতা। বস্তুত বিষ্ণু দে নিজেই এ সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন:
১. নেতির সংযেমের শিক্ষা শুরু হল, ঐতিহ্য ও ব্যক্তির সম্বন্ধ হল কর্মিষ্ঠ সচল, ব্যাখ্যা থেকে পরিবর্তনের, পুনগ্রহণের নির্মাণের।
২. নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি কাব্যজগতে এলিয়টের দান।
৩. এলিয়টের কাছে বাংলা লেখকদের ঋণগ্রহণ মুখ্যত এই আত্মসচেতনতার ক্ষেত্রে। আত্মসচেতনতা হয়ে উঠল কবিমার্গে প্রত্যক্ষ সত্তাসম্পন্ন।
এলিয়টের কাব্যভাবনার সঙ্গে বিষ্ণু দে-র কাব্যভাবনার মিল ও অমিল স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। আমরা এখানে শুধু এটুকুই মনে রাখব যে বিষ্ণু দে-র কবিতায় পুরাণ প্রসঙ্গে উপরোক্ত তিনটি দিকনির্দেশই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং একে অপরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে বিষ্ণু দে-কে পৌঁছতে হয়েছে ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট চেতনায়, যা এলিয়টের ভাষায় ধ ঢ়ৎবপবঢ়ঃরড়হ, হড়ঃ ড়হষু ড়ভ ঃযব ঢ়ধংঃহবংং, নঁঃ রঃং ঢ়ৎবংবহপব, তাই তাঁর কবিতায় হাতধরাধরি করে চলেছে অর্জুনের প্রতীকের সঙ্গে হ্যামলেটের প্রতীক, উর্বশীর সঙ্গে আর্টেমিসের চিত্রকল্প। তৈরি করেছেন প্রাচ্যের পুরাণের সঙ্গে প্রতীচ্যের পুরাণের মেলবন্ধন। এসবের জন্য তাঁকে অর্জন করতে হয়েছে নৈর্ব্যক্তিক তন্ময়তা। ক্যাটালিষ্টের ভূমিকা কবির। আর আত্মসচেতনতা বিষ্ণু দে-র সমগ্র কবিব্যক্তিত্বেরই অঙ্গ। এমন আত্মসচেতন কবি যখন পুরাণ ব্যবহার করেন, তখন তা শুধুমাত্র ব্যক্তিচেতনার কেন্দ্রে আবর্তিত হয় না, দেশ ও সময়ের আলোকে তার স্ফুরণ ঘটে। এলিয়ট যখন ধর্মীয় চেতনার কাছে শান্তি খোঁজেন, বিষ্ণু দে তখন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিস্বরূপের দর্শনের গভীরে। মানবচৈতন্যের আপাত বিচ্ছিন্নতার সমস্যা তাঁর কাব্যভাবনায় বহুমুখী পরিণতি লাভ করে। তাই তাঁর পুরাণপ্রয়োগেও সচেতনভাবে তিনি দেশকাল-সমাজের চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে এগোন।
কবিতায় মিথের ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছেন যেসব আলোচক, তাঁদের বক্তব্য হল, পুরাণের প্রতি আগ্রহ আসলে ইতিহাসের পরিবর্তন ও জয়যাত্রার ক্ষেত্র থেকে দুরে সরে থাকা মাত্র। বিষ্ণু দে-র পুরাণব্যবহার প্রসঙ্গে একথা খাটে না, কারণ ইতিহাসের প্রগতির দিকে নিজস্ব অভিমুখ নির্দিষ্ট রেখেই তাঁর পুরাণপ্রসঙ্গ। পুরাণকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন ইতিহাসের অগ্রগতির স্বার্থে। বর্তমান সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে তাঁর কবিতা আবর্তিত হওয়ার ফলে ব্যক্তিগত প্রেম- প্রকৃতি চিন্তাও সমাজের সামাগ্রিক পটে উদ্ভাসিত। পুরাণের ব্যবহারও এই প্রেক্ষাপটটিকে আরো নির্দিষ্ট, অর্থবহ ও তাৎপর্যময় করার লক্ষ্যেই নিয়োজিত। প্রেমের যন্ত্রণা ও শ্রেণিভিত্তিক সমাজের অসহায়তা এবং সেইসঙ্গে বেঁচে থাকার ভালো শর্তগুলোকে আয়ত্ত করার আকাঙ্খা তাঁর পুরাণকাহিনির অভিমুখ। যেসব গ্রিক ও রোমান মিথ বিভিন্ন ইউরোপীয় কবিদের হাতে ব্যবহৃত হয়েছে নানা তাৎপর্যের অনুষঙ্গে, বিষ্ণু দে সেইসব মিথকে ব্যবহার করে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। ইতিহাসসচেতন বিষ্ণু দে-র পুরাণনির্ভর চরিত্রেরা বর্তমান যুগযন্ত্রণার প্রতীক হয়ে উঠেছে। পুরাণ থেকে যে চিত্রকল্প ও অনুষঙ্গ তিনি অনুসন্ধান করেছেন, আধুনিক সচেতনতার বিষয় করেই তাদের উপলব্ধি করেছেন। তার মূল প্রবণতা রোমান্টিকতার দিকে হলেও প্রতি-রোমান্টিকতার মেজাজ প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে হয়তো একধরণের দ্বৈততা সৃষ্টি হয়েছে তাঁর চেতনায়, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি।
উর্বশী ও আর্টেমিস
দেখি মুহূর্ত-বিম্বে চিরন্তনেরই ছবি
উর্বশী আর উমাকে পেয়েছি এ প্রেমপুটে।
উর্বশী ও আর্টেমিস কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘পলায়ন’-এ আছে এই লাইনদুটি।
‘অর্ধনারীশ্বর’ কবিতায় দেখি-
উলঙ্গপর্বতে কভু উর্বশীর পড়ে নাই শ্বাস
চালিয়াছি পূজিবারে মন্দিরের অর্ধনারীশ্বর
‘উর্বশী’ কবিতায়
আর রাত্রি রবে কি উর্বশী
আকাশের নক্ষত্রআভায়, রজনীর শব্দহীনতায়
রাহুগ্রস্ত হয়ে রবে বাহুবন্ধে পৃথিবীর নারী
পরশ কম্পিত দেহ সলজ্জ উৎসুক?
উর্বশী ও পুরবার বিরহের অনুযঙ্গ এভাবেই উজ্জীবিত করেছেন কবি। আর এভাবেই ‘ছুটে চলে অপ্সরারমনী’ বিষ্ণু দে-র কবিতায়- উর্বশী এক আর্কেটাইপ তৈরি হয়। ‘ভাষা তার কী-বা বলে- ডায়ানা? উর্বশী?’ বন্য প্রকৃতির দেবী ডায়ানা, যা আর্টেমিসেরই রোমান নাম, উর্বশীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ কবিতায় দু’দেশের দুই মিথ একত্রগামী আর এখানেই দেশজ স্থাণিকতা কবি অতিক্রম করে যান-
তপোবন নেই আর কণ¦মুনির
আজো তবু বিপুল পৃথিবী
আজো এই আমাদের কাল
আজো এই জ্ঞানবিজ্ঞ জারাবৃদ্ধ অভিজ্ঞ ভুবন
পলাতকা উর্বশীর প্রতি পদপাতে
দুলে দুলে ওঠে ¯œায়ু আলোড়িত উতলা কম্পনে।
আজো তাই পরিশ্রান্ত ম্যামন-মলিন
জলস্থল কেঁপে ওঠে উর্বশীর দেহের আস্বাদে।
উর্বশীর স্বপ্নমায়া ছিন্ন করার জন্যই যেন কবি এনেছেন কৌমার্য ও উর্বরতার দেবী আর্টেমিসের নাম। বন্ধ্যা রোমান্টিকতা পরিত্যাক্ত করে নতুন সৃষ্টির পথ খুঁজতেই কি আর্টেমিসের স্মরণ ? বিষ্ণু দে নিজেই বলেছেন-
‘উর্বশীর প্রতীকের কেন্দ্রের বিপরীত কাব্যবেগ দানা বেঁধেছিল আর্টেমিসের রূপে, শুচিকৌমার্য্যরে তণুদেবী, চন্দ্রের হিম অধিষ্ঠাত্রী, শিকারের দেবতা আর্টেমিসেই।’
উর্বশী ও আর্টেমিস-এ প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অনেক মিথ পুরাণ, মধ্যযুগের ইউরোপের উপাখ্যান, উপনিষদের উদ্বৃতি কবিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বৃহৎ ঐতিহ্যের অন্তর্গত করেছে। উর্বশী, উমা, পুরুরবা, বজ্রপাণি, ডায়ানা, ওরায়নপ্রিয়া, ট্রিস্টার্ন ও ঈসোলডে, অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা, ক্লিয়োপেট্রো, বাতিচেল্লির ভেনাস, এরস-মাতা ইত্যাদির অভূতপূর্ব সহাবস্থান, যা কবির নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জনে সাহায্য করেছে।
ক্রেসিডা প্রসার্পিনা মহাশ্বেতা
মিথ বা পুরাণের সন্ধানে আমরা এই পর্যায়ে বিষ্ণু দে-র চোরাবালি কাব্যগ্রন্থের ‘ওফেলিয়া’, ‘যযাতি’, ‘মহাশ্বেতা’ কবিতাগুলোর দিকে লক্ষ রাখব। বস্তুত, চোরাবালির কবিতাগুলোতে রোমান্টিক প্রেমের আদর্শ ও বিগতমোহ আধুনিক কবির প্রেমভাবনার পার্থক্য সস্পষ্ট হতে দেকি। ‘ওফেলিয়া’ কবিতায় বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় কাতর হ্যামলেট-
রুন্ধ্রহীন আর্তনাদে এ আঁধার হেডিসের মতো
হৃদয় ধরেছে চেপে।
প্রেমের মুক্তিই তার আর্তি, অথচ এ প্রেম অধরা। ক্ষণপ্রভার মতো মুহূর্তের আলোয় ছিন্নভিন্ন তার আশা। গ্রিক মিথ থেকে নেওয়া হেডিসের উল্লেখ পংক্তিগুলোকে অর্থবহ করেছে নরকসম অন্ধকারের তীব্রতায়। বিষ্ণু দে এই কবিতায় দেবযানীর উল্লেখ করেছেন, অবশ্য তা যতটা না পুরাণের, তার চেয়ে বেশি রবীন্দ্রনাথের :
দেবযানী ! সাঁঝে তোমার প্রণাম মাঝে
ক্লিষ্ট আমার দিবসের ক্ষমা বাজে
শাপমোচনের সুরভি সুরের পাকে পাকে এই সাধনা আমার। পরবর্তী স্তবকেই আসে প্রসার্পিনার কথা। এই মিথটির কথা আগেই বলেছি। বলেছি, তাকে হেডিসের হরণ করার কথা। এলিসিনোরের এই পাতালরাজ্যের বর্ণনজা-
প্রসার্পিনা কুসুমে ছায়, বৈতরণী পাশে
ছড়ায় আহা!
পার্সিফোনির মূল মিথটিকে যেভাবে অন্য কবিরা ব্যবহার করেছেন, তাতে মাতা ডিমিটারের কন্যা পার্সিফোনির সন্ধানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এলিউসিসের রিচুয়াল। বিষ্ণু দে খুব সংক্ষেপে ওফেলিয়া কবিতায় পুষ্পচয়নে রত প্রসার্পিনার যে চিত্রকল্প আভাসে এনেছেন, তা মিলটনকে স্মরণ করায়। ‘যযাতি’ কবিতাতেও ‘প্রসার্পিনার মুঠিতেও তাই প্রণয়রতি’ পংক্তিটি সেই অর্থে নামের উল্লেখমাত্র, কোনো বিশেষ অর্থ বহন করছে না। সংস্কৃত সাহিত্যের পুন্ডরীক-মহাশ্বেতার কাহিনি, জন্মান্তর, পুনর্মিলন ও পুনরুজ্জীবনের কাহিনি। ‘মহাশ্বেতা’ কবিতায় পুন্ডরীকও প্রেমের হৃদয়পথে মুক্তির অন্বেষণ করে- ‘আজ কি আমাকে ভুলেছে মহাশ্বেতা?’ এই নাটকীয়তার সঙ্গে এসে মিশেছে সমসাময়িকতার দীর্ঘ ছায়া:
পশ্চাতে ধায় মরণ-চাঁদের আলো
দিগন্তফণা, তুহিন, পান্ডু, কালো।
প্রেম ও জীবনের প্রতীক মহাশ্বেতা দেশ ও সময়চেতনার আধারে প্রোথিত। ‘মুদ্রিত বরাভয়’ কি অভয়দাত্রী দেবী দুর্গার পৌরাণিক আভাস?
‘ক্রেসিডা’ কবিতাটি সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন- ‘এখানে তিনি বাদী, বিবাদী ও অনুভাবী ভাবের নাটকীয় প্রতিসাম্যা ঘটিয়েই সন্তুষ্ট হন নি, যে-প্রশস্ত পরিমন্ডল গড়ে তুলেছেন, তার মধ্যে চসর হেনরিসন ও শেক্সপীয়র তুল্যমূল্য।’ (‘চোরাবালি’, স্বগত)। গ্রিক পুরাণের নারী ক্রেসিডা ট্রয়ের রাজপুরোহিত কন্যা, রাজপুত্র ট্রয়লাসের প্রণয়িনী হয়েও শত্রুপক্ষের শিবিরে গিয়ে গ্রিক যোদ্ধা ডায়ামিডিসের প্রেমের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। চসার, হেনরিসন ও সেক্সপিয়র এই কাহিনি অবলম্বনে কাব্যরচনা করেছেন এবং প্রত্যেক কবির হাতেই ক্রেসিডা চরিত্র আলাদা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। তবু থিমটি এক-প্রেমে একনিষ্ঠতার অভাব। ক্রেসিডা বিশ্বাসঘাতিনী হলেও চসার ও শেক্সপিয়ার তার কোনো শান্তিবিধান করেন নি, কিন্তু স্কটিশ কবি হেনরিসন তার প্রায়শ্চিত্ত বিধান করেছেন তাকে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ভিখারিনি করে- যে হাত পেতেছে ট্রয়লাসের কাছে। ট্রয়লাস তাকে চিনতে না পারলেও ক্রেডিসা জেনেছে ভিক্ষাদাতার নাম, তাই প্রণয়ের আভিজ্ঞান অঙ্গুরি ফেরৎ পাঠায় ট্রয়লারের কাছে। এরপর তার মৃত্যু হয়।
বিষ্ণু দে-র কবিতাটি উত্তমপুরুষে বর্ণিত, সে ট্রয়লাস, কিংবা কবি, যে চিনেছে ক্রেসিডাকে, এবং তার মনের বিচিত্র প্রতিক্রিয়াই কবিতাটির বিষয়বস্তু হয়েছে।
বিদ্যুৎ নেভে ঈশানবিষাণে, বজ্রও দিশাহারা
এলোমেলো পাখা ঝাপটি তবুও কথা ওড়ে ক্রেসিডার।
‘পাখির চিত্রকল্পটি এখানে অব্যর্থ। তার পাখা ঝাপটানি, ওড়ার মধ্যেই প্রতিবাদ আছে, আছে কালোত্তর যাত্রা।
‘কান্ডারীহীন বালুকাবেলায় চোখ পুড়ে মরে দূরে’- এই স্বপ্ন ও প্রেমের অনিশ্চিয়তার মধ্যেও কবি বলেন :
ক্রেসিডা তোমার থমকানো চোখে চমকায় বরাভয়
তোমার বাহুতে অনন্ত স্মৃতি ক্রতুকৃতমের শেষ।
মত্তপ্রলয় তোমাতেই করি জয়।
ট্রয়লাস ও ক্রেসিডার প্রণয় যেমন ট্রয়ের যুদ্ধের সময় বিপর্যস্ত হয়েছে, বর্তমান সময়ের সংকটও একইভাবে বিপর্যস্ত করছে প্রেমকে-
হেলেনের প্রেমে আকাশে বাতাসে ঝঞ্চার করতাল।
দ্যুলোকে ভুগোলে দিশাহারা দেবদেশী।
পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ও প্রেমের প্রতীক হেলেন, তার প্রেমের আকর্ষণের অভিঘাতে বিনষ্ট দেশ- ‘স্বপ্নগোধুলি ডুবে গেল খর রক্তের কোলাহলে’। অন্যদিকে, প্রেমে নিষ্ঠাহীন ক্রেসিডা, হয়তো সে আহত করেছে পুরুষ-হৃদয়, কিন্তু তাকে বিনষ্ট করতে পারে না: ‘উদ্বায়ু আজো হয়নি আমার মন’। এখন ক্রেসিডার প্রতি তার আকুলতা, অনিঃশোষিত জীবন ও প্রেমের মোহময় হাতছানি।
হেলেনের বুকে শবসাধনার বিশ্রাম আর নেই।
আমার হৃদয়-ঘটাকাশে শুধু জীবনের আরাধনা।
এই বৈপরীত্য প্রতীচ্যের হেলেন ও প্রাচ্যের শবসাধনা ও তন্ত্রচর্চার ইঙ্গিতে কবিতাটি নাট্যাবেগে চঞ্চল হয়েছে। স্বগতোক্তি, প্রেমের তীব্র আবেগ ও উচ্চারণের নাটকীয়তায় বিষ্ণু দে-র কলমে মিথ আলাদা মাত্রা অর্জন করে। জীবনে পুনরুজ্জীবনের আশা ও প্রেমের ধ্রুবসংকেত শেষ অব্দি জয়ী হয়- ‘উল্লাসে গায় পালে পালে ক্রীতদাস।’
সুভদ্রা অর্জুন ধনঞ্জয়
মহাশ্বেতা ও ক্রেসিডার মিথে, ওফেলিয়ার কাহিনিতে, এবং প্রসার্পিনার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে সামাজিক অথচ ব্যক্তিমানুষেরই প্রেমাকাঙ্খা ও মুক্তির তৃষ্ণা। কিন্তু ‘পূর্বলেখ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রেম ও প্রত্যয়ের ভরকেন্দ্র পুরাণের নারীদের থেকে সমাজ ও সময়ের দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। কবির ভাষায়, যেন ‘¯œায়ুর জ্যামুক্তি’ ঘটল মার্কসবাদের তাত্ত্বিক দীক্ষায়, জনগণের প্রত্যক্ষা সংযোগে। বিষ্ণু দে বলেছেন: ‘সাহিত্যিকের চোখ সমসাময়িক সমাজ সবসময়েই বোধহয় জিজ্ঞাসায় পরিগ্রহণে উত্তেজনায় উদ্ভ্রান্তিতে বিদ্রোহে কমবেশি চাঞ্চল্যকর, অথচ সাহিত্যিকও এই মিশ্র সমাজেরই ভবিষ্যতোন্মুখ অথবা অতীত-নির্ভর সরব সরিক।’ (সাহিত্যিকের চোখে আজকের সমাজ, প্রবন্ধ সংগ্রহ-২)
প্রথম কবিতা ‘বিভীষণের গান’-
কবে যে আমি ছেড়েছি স্বর্গজয়ের দুরাশা যত!
বক্ষে আঁকড়ি ধরেছি স্বর্ণসীতারেই,
তেত্রিশ কোটি ছেড়ে সসাগর পিতারেই
পাকড়ি, বিষম রুদ্রের বিষ উগারি দেখি
ঈষার আকাশে শ্মশানগোধুলি কুয়াশাহত।
পুরাণের কথা ভারতীয় কাহিনিজাত। গ্রিক তথা ইউরোপীয় মিথ এখন আর কবিকে আকর্ষণ করছেনা। কন্যাহীন শিবসওদাগর, উদাসীন বজ্রপাণি, শীতকম্প অমরা, শিবের গাজন, সগরসন্তান, জটায়ুর পাখা, উন্মত্ত অপ্সরা, কিন্নবীর দল, চিত্রগুপ্ত, কৈলাশ ইত্যাদির উল্লেখ দেশীয় পুরাণ থেকে সংগৃহীত।
দুটি কবিতা আমরা বিশেষভাবে লক্ষ করব- একটি ‘পদধ্বনি’ অন্যটি ‘জন্মাষ্টমী’। ‘পদধ্বনি’ অর্জুন ও সুভদ্রার কাহিনি সঞ্জাত। অর্জুনের প্রতীকে কবি আসন্ন বিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে সুবিধাভোগী বুর্জোয়ার ক্লীবতার ছবি এঁকেছেন। দস্যুর পদধ্বনি সমাজবিপ্লবেরই প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে। এই অনিবার্য পরিবর্তন সম্ভাবনা বোধের ক্ষমতা বুর্জোয়া সমাজের নেই। যে অর্জুন বলরামকে পরাজিত করেছে, আজ তার গান্ডীব ব্যর্থ। পুরাণের প্রতীকে এই সামাজিক চিত্রপট, কোনো ব্যক্তিমানুষের কথা নয়। ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ জাতীয় স্মৃতিতে বিস্তার লাভ করেছে।
কার পদধ্বনি আসে? কার?
এ কি হল যুগান্তর! নব অবতার!
ট্রয়লাস, হ্যামলেট ও পুন্ডরীকের মতো ধনঞ্জয় এখানে আর শুধু ব্যক্তিমাত্র নয়, সমগ্র সমাজেরই প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিষ্ণু দে এখানে দ্বান্দ্বিক ইতিহাসের চেতনায় সম্পৃক্ত, ব্যক্তিমানুষ আজ আর নির্দিষ্ট নয়, তাই পুরাণের ব্যবহারও ক্ষীণ।
‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর কবি পুরাণ ও বর্তমান সময়চেতনায় নিরিখে নতুনভাবে অন্বিত হন ‘জন্মাষ্টমী’ কবিতায়। চোরাবালির ব্যঙ্গ, পুরাণনির্ভরতা, উর্বশী ও আর্টেমিসের ব্যর্থতা ও শূন্যতার পটভূমি শ্রেণিচেতনার পরিসরে এখানে ব্যঞ্জনা পেল। অবক্ষয়ের টানে ‘ব্যর্থ ধনঞ্জয়, ব্যর্থ গান্ডীব’।
এই ঝড়ে উর্ধ্বশ্বাসে অপচেতা বক্রবেশী আবর্তবিহীন
কবন্ধ দুঃস্বপ্ন ঘোরে
মোক্ষহীন ভিক্ষুকের বিষণœ আবেগ।
হে বন্ধু, এ নাচিকেত মেঘ
আসন্ন মুমূর্ষাক্ষুব্ধ আমার পাতাল
ধুয়ে দিক বজ্রযোগে বিদ্যুৎ অঙ্গারে
উড়ায়ে পুড়ায়ে দিক বিষঙ্গের উজ্জীবনে
সঞ্চীবনী প্রতিষেধে, সাবিত্রীকে সম্পুরকে
বেঁধে দিক হে সুশ্রুত, উদগতির হিরণ¥য় জালে।
হাহাকার নেই, উত্তেজনা ও আক্ষেপ নেই, আছে সন্ধান, প্রশ্ন ও প্রত্যয়। ‘ঠিক জানো ধনঞ্জয়, তুমিও ছুটবে না?’ কেননা ধনঞ্জয়কে কাজ করতে হবে জনতার সঙ্গে, সমিতির পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে তাকে দেশ ও দশের সেবায়।
তুমি বুঝি শোননিকো গায়ত্রীর গুহাগুপ্ত গানে
তৃপ্তিহীন সংকটের তীব্র আর্তনাদ
দিবারাত্রি বিশ্বামিত্র করে যায় একা?
তবু তো হাহাকার নেই। প্রত্যয়ের সুরে কবি বলেন:
আনন্দের যে ভৈরবী মীড়ে মীড়ে
সুষু¤œার শিরে শিরে
সাযুজ্যসংগীতে
আর সেই সংগীত চেয়ে
অঘমর্ষী জনতার উদ্গীথ-মুখর
এ কুৎসিত জীবনের ক্লৈব্যগামী স্বার্থপর ব্যর্থতা জানাই,
কুম্ভীরক তাই।
কাসান্দ্রা আইসায়া টাইটেরিয়স
আবার এসেছে বিদেশি মিথ। দুটি কবিতায় বিষ্ণু দে অ্যাস্কাইলাস ও ইউরিপিডিস প্রমুখ কবিদের ব্যবহৃত মিথে আশ্রয় নিয়েছেন- সন্দীপের চর কাব্যগ্রন্থের ‘কাসান্ড্রা’ ও নাম রেখেছি কোমল গান্ধার-এর ‘কাসান্দ্রা’। কাসান্দ্রার মিথটি এইরকম- ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম ও হেকুবার কন্যা কাসান্দ্রার শক্তি ছিল অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করবার। সূর্যদেবতা অ্যাপোলো তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে কাসান্দ্রা অসম্মতি জানায়। অ্যাপোলো ক্রোধে কাসান্দ্রার ভবিষ্যৎবাণী করার শক্তি নষ্ট করে দেন এই বলে যে সত্যতা থাকলেও কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। কাসান্দ্রা ট্রয় ধ্বংসের কথা আগেই জানিয়েছিল, বিশ্বাস করেনি কেউ। ট্রয়ের পতনের পর তাকে অ্যাথেনার মন্দিরের আশ্রয় থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিষ্ণু দে কাসান্দ্রা ও অ্যাপোলোর সম্পর্ককে দুদিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। ‘কাসান্দ্রা’ শুরু হচ্ছে এইভাবে-
বলো কাসান্ড্রা, এত দুর্যোগ ছিল কোথায়
সকলে ভাবছি- প্রায় সারা দেশ, কয়েকজনাকে
বাদ দিই। মুখ খোলো কাসান্ড্রা, সূর্যালোকে
ঝলসিয়ে চোখ বলো কী পাপের শাসন এ হায়
কাসান্দ্রার কথা বিশ্বাস করার প্রতিশ্রুতি করিব- দেশটা ট্রয় নয়, ভারতবর্ষ, আর সময়ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকাল। তবু অ্যাপোলোর চোখ ঝলসানো তাপ। সমকালীন বাস্তবতার ছবি কবিতার প্রতি ছত্রে। সুবিধাভোগী বিত্তশালী কিছু মানুষ অবশ্যই এ দুর্যোগের বাইরে, তারা ‘হিরন্ময়েরই পাত্রে ঢোকে’। ট্রয়ের যুদ্ধের কারণ যদি হেলেন, ভারতবর্ষের মানুষ ‘তবু কেন মরি ঘরে বসে লোভী ট্রয়ের রণে?’ কেন ‘বিশ্বের ভার ও ঘাড়েই পড়ে?’ ’ঘর থেকে টেনে আনে সংক্রাম দুঃশাসনে’? এভাবেই তো কাসান্ড্রাকে অ্যাথেনার মন্দির থেকে টেনে আনা হয়েছিল: অ্যাপোলোর বিধ্বংসী ‘সূর্যালোকের নগ্নতা পায় তার যত ক্ষত’। মনে রাখতে হবে, ভারতের মানুষের সূর্যের পূজারী, তবে কেন সূর্যালোকেই ধ্বংস অনিবার্য হবে, এ প্রশ্ন করিব। এর মধ্যে বেড়ে ওঠে কিছু সুবিধাভোগী মানুষ, যারা মনুষ্যত্বের অভাবে হীন। এইভাবে সমগ্র কবিতাটিতে কাসান্ড্রার দুর্গতির সঙ্গে দেশীয় পরিস্থিতির সাযুজ্য তৈরি করা হয়েছে। নৈরাজ্যের স্বরূপ উদঘাটনে কাসান্দ্রা সচেষ্ট হবে, এ বিশ্বাস করিব।
কাসান্দ্রা মিথ ফিরে আসে পুনরায়। সময়কাল ১৯৪৬-১৯৫৩। পরিস্থিতি একই। মন্বন্তর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে মানুষ। তবু মানুষের যাত্রা রুদ্ধ হয় না। কাসান্দ্রাও সূর্যদেবতার ক্রোধের কাছে অবশ্য স্বীকার করেনি। তবু বাস্তবের দিতে কাসান্দ্রাকে চোখ ফেরাতে হয়-
আমার অস্তসূর্য আমার অরুণাশ্বের রথী
তাই কাসান্দ্রা ঘর ভাঙা উদ্ভ্রান্ত
লুব্ধ সূর্য, তাই ট্রয় জুড়ে চলে
গুপ্তঘাতক, মৃত্যুর রুষ্ট ক্লান্ত
অমর প্রাণের মর জীবনের
ফসল ফলানো আলোর গানের
অমর সূর্য ভুলে গেছে আজ
জীবনে মরণ হেনে কতোটুকু কার ক্ষতি?
সূর্যালোক জীবনদায়ী, আবার সূর্যালোকেই মানুষকে অন্ধ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখানে বিষ্ণু দে অ্যাপোলো-মিথের সঙ্গে যুক্ত করেছেন ভারতীয় চেতনাবাহিত সূর্যের জীবনরক্ষার ভাবনা। কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে:
কাসান্দ্রা ঘুরি অতন্দ্রচোখ পথে পথে বন্ধুর
ইনিয়স যাক লোভন ভবিষ্যতে!
অজেয় আমার আলুলিত বেণী, যুগান্তে সংহতি।
কাসান্দ্রার মধ্যে দিয়ে আর ব্যক্তিচেতনার আধারে স্বীয় পুনরুজ্জীবনের কথা নয়, গোটা দেশ ও সমাজ মূর্ত হয়ে উঠেছে। কাসান্দ্রা হয়ে উঠেছে দেশ ও সময়কালের বিশ্লেষক। কাসান্দ্রার মতোই যেন কবির ভবিষ্যৎবাণী, এই দুঃসময়ের কথা তিনি বারবার বর্ণনা করে যাচ্ছেন।
এই কবিতাটির সূত্রেই দেখা মিলেছে পুরাণের হেক্টরের:
হেক্টর বুঝি ঐ বুঝি বাঁধা রথে
ঘুরে ঘুরে গেছে রথের চাকার পাকে
মৃত হেক্টর হতাহত হেক্টর!
ট্রয়ের রাজকুমার হেকটর। গ্রিক বীর অ্যাকিলিস তাকে যুদ্ধে হত্যা করে। নৈরাশ্যের বর্ণনা প্রসঙ্গেই হেকটরের প্রসঙ্গ এনেছেন বিষ্ণু দে। ইয়েট্স- এর ‘আ ভিশন’ কবিতায় এই প্রসঙ্গ দেখি-
অঃযবহব ঃধশবং অপযরষষবং নু যধরৎ,
ঐবপঃড়ৎ রং রহ ঃযব ফঁংঃ, ঘরবঃুংপযব রং নড়ৎহ
ইয়েটস এখানে মানুষের ব্যক্তিত্বের বীরোচিত দিকটির সঙ্গে ট্রাজিক দিকটিকেও ইতিহাসগত সময়ের প্রতীক করে তুলেছেন।
সন্দ্বীপের চর-এর কবিতা ‘আইসায়ার খেদ’, আর নাম রেখেছি কোমল গান্ধার-এর অন্তর্গত ‘টাইটেরিয়স’। বাইবেল ওল্ড টেস্টামেন্টের মহাপুরুষ আইসায়া আর টাইটেরিয়স গ্রিক পুরাণের দীর্ঘায়ু অন্ধ ভবিষ্যদ্দর্শী। টাইটেরিয়াস সফোক্লিসের অয়দিপাউস নাটকের অন্যতম চরিত্র। দুটি চরিত্রই কবিতায় কথকের ভূমিকায়- যেন মহাভারতের সঞ্চয় অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এ বর্ণনা দেশের, সমকালের। আইসায়া এখানে পঁচিশ বছর ধরে পেনসনভোগী বৃদ্ধ, সে দ্যাখে-
চাষিরা চালায় কাস্তে, মজুরেরা মুষ্টিবদ্ধ খাটে।
তারপরে কালযুদ্ধ মৃত্যু আর মৃত্যু মন্বন্তর
ক্রমান্বয়ে মহামারী নরকের নবান্ন উৎসবে।
তার কণ্ঠে কমেন্টারির মতো শোনায় এই কথা ঃ
যুদ্ধ দেয় পক্ষপাত, বলে আজ কালের ঘর্ঘর
এ যুদ্ধে এনেছে ফের পাঞ্জজন্য, দাবি পক্ষপাত
বলে বিশ্ব এক, বলে শনিগ্রহদের কক্ষপাত
সেও নাকি মানুষের হাতে
বয়সের অভিজ্ঞতার কথা বারবার আসে, অনেক দেখেছে বলে আশার আলো অন্তর্হিত হয়নি তার চোখ থেকে ঃ
দেখি নয়নে ভাস্বর
তার নীল নদী বয়, দুই তট সবুজ উর্বর।
টাইটেরিয়াস গ্রিক মিথের অন্তর্গত হলেও সেফোক্লিসের নাটকের সৌজন্যে পরিচিত নাম। কাসান্দ্রা মিথ থেকেই দেখা যাচ্ছে, বিষ্ণু দে বারবার ভবিষ্যৎবাণীর থিমটিকে ব্যবহার করছেন। অবশ্য টাইটেরিয়স শুধু ভবিষ্যতের কথাই বলছেনা, সে দেশ ও দশের ব্যাখ্যাকারও। ভাষার তির্যকতা পাঠকের কান এড়ায় না-
আমার দুচোখ অন্ধ, অতীত ও ভবিষ্যৎ স্মৃতি শ্রুতি
তোমার উলঙ্গরূপ তাই দেখি রোজ
তুমি তো দেখনি দেশ অনাহার কাকে বলে
দেখনি তো সারাদিন ঘুরে ঘুরে
নঙরখানার পাশে সন্ধ্যার নৈরাশে
নিজের শিশুর মুখ
পরবর্তী পংক্তিুগুলোতে তির্যকতা গাঢ় হয়, ব্যঙ্গের পর্যায়ে পৌঁছে যায়-
তুমি তো দেখনি দেশ, এই দেশ
বিরাট, উদার, উর্বর, প্রাচীন, রঙীন, উজ্জ্বল আসমুদ্র হিমাচল
তুমি জান শেয়ার-বাজার বোর্ডের মিটিং
তবু বুর্জোয়া সুবিধাভোগীর যে নিস্তার নেই আর, তাও সে জানাতে ভোলে না।
ইনফার্নো থেকে পারাদিজো
বিষ্ণু দে-র কবিতায় উর্বরতার কথা, জীবনের পুনরুজ্জীবনের কথা, নরকের পরিবেশ থেকে উত্তরণের কথা বারেবারে আসে। ‘আমি তো যেতে চাই’ বলে যেখানে পৌঁছতে চাইছেন, তা স্বপ্নস্বর্গেরই এক ছবি, যেখানে ‘নির্ঝর স্ফটিক চঞ্চল আর ষড়ঋতুই মধুর-মুখর’- এই স্বর্গের আভাস প্রেমের পথে, জনজোয়ারের পরিবর্তনে মেলে। এই কল্পনাস্বর্গের সঙ্গে প্রায়শই সংশ্লিষ্ট হয়ে যায় পুরাণের প্রসঙ্গ। সপ্তম পারাদিজোর প্রান্ত থেকে তাঁর অনামা বিয়াত্রিচে তাকে স্বর্গের পথে আহ্বান জানায় ঃ
আমিও সৌভাগ্যবেশে তোমাকে দেখেছি বিয়াত্রিচে,
নবসামন্তীর কুঞ্জে নিজে পরিয়েছি গুঞ্জামালা
তোমার অমরকণ্ঠে, তৃতীয় স্বর্গের আলো-জ্বালা
নভোদয় এ হৃদয়ে
তবুও তিনি ‘ছদ্মবেশী নরকের কোলাহলে বেসুর বেতালা,’ স্মৃতি যে অতীত ইনফার্নো, সত্তা যেন বর্তমানের উদ্ধার-উন্মুখ পুরগাতোরিও, আর ভবিষ্যৎ তো সাম্যবাদী সমাজপ্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল পারাদিজো। যে পর্যায়ের কবিতা থেকে শুরু হতে দেখি পুনরুজ্জীবনের আকাঙ্খা, সেখানেই ধরা পড়ে নরকের বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার। ঘুরে ফিরে এই নরকের কথা আসে পুরাণের অনুষঙ্গ নিয়ে ঃ
১. দিকে দিকে বক্রগতি উদ্ধত কৌরব
চলে সূর্য বিতারিত অন্ধকার ঘরে।
নীরন্ধ্র অধীচি আর দুর্গন্ধ রৌরব
মর্ত্যে এ কে কালহেতু জনতায় ভরে! (চতুর্দশপদী-২)
২. নরক কি এরকম? বাংলার গ্রাম ও শহরে
লক্ষ লক্ষ দগ্ধগৃহ, কারো বৃদ্ধি ওসারে বহরে
নরকে জানে না শুনি আছে আছে তারা দুরন্ত নরকে
রৌরব প্রাসাদে হাসে শাদাকালো গৌরব-প্রহরে!
দধীচির হাড় জ্বলে, কী দেওয়ালি বিবস্ত্র মড়কে! (আইসায়ার খেদ)
৩. নরকে আমারও যাত্রা অলকার গন্ধ গায়ে
আমিও শুঁকেছি শকুনের শিরার আহার (অন্বিষ্ট)
৪. এলসিনোরের নরকে দিয়ো না বলি
তোমার এ দিনেমারে। (এনসিনোর)
৫. নরকের হিম অন্ধকারে
বিবর্ণ তুষার এই হৃদয়ের বহু পদপাতে (বহুবড়বা)
৬. ত্রিশঙ্কুর ঘূর্ণমান নরকের দ্বারে
চলো চিত্রগুপ্তের দরবারে
দেখে আসি তোমাদের ভবিষ্যৎ দিন
আমার অতীত রাত্রি বর্তমান নরক কিনারে (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)
৭. এ নরকে
মনে হয় আমা নেই জীবনের ভাষা নেই
আমরা নরকে আছি, অথচ সে জ্ঞান নেই মনে,
তাই বিবাহসভায় প্রচ্ছন্ন নরকে আজ রব নেই। (স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত)
৮. অনর্থক খুঁজে ফিরি জল। জল?
নরকে যে আমাদের নির্জলা ভুগোল (নির্জলা ভুগোল)
হোমার ও দান্তের নরক বিষ্ণু দে-র নরক প্রসঙ্গে মোটিফের কাজ করেছে। ফলে তার নরকও বস্তুত সমকাল ও দেশের আর্কেটাইপ হয়ে উঠেছে। হোমার তেমনভাবে হয়তো নয়, দান্তের উত্তরাধিকার বিষ্ণু দে-র কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে। উত্তরণ ঘটে না, তবু এই নরক পেরিয়েই পুরগাতোরিয়োতে পৌঁছতে চেয়েছেন। ইনফার্নো না পেরোলে তো সেখানে পৌঁছানো যায় না। তাই ‘নরকের পথে গান করে চলি মৃত্যুঞ্জয় যাত্রায়’।
পুরাণ থেকে লোকপুরাণ
বিষ্ণু দে-র কবিতায় বিদেশি মিথের ব্যবহার প্রসঙ্গে সমালোচক একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ ‘চতুর্দিকে যখন বিসংগতি দেখেছিলেন বিষ্ণু দে, তখন তিনি বারবার বিদেশী পুরাণ উল্লেখে বিচ্ছিন্নতার বোধকেই সাকার করেছিলেন, আবার যখন তিনি সংগতি ও সাযুজ্যের সন্ধানী হলেন তখন কানে এলো বিদেশী পুরাণের ব্যবহার। অনেকগুণে বেড়ে গেল স্বদেশী পুরাণের ব্যবহার।’ (অশ্রুকুমার শিকদার)
বিদেশি পুরাণের ব্যবহার কবির প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থগুলোতেই অত্যাধিক ঘটেছে। ব্যক্তিমানুষের বিচ্ছিন্নতা ও সাযুজ্যহীনতার ব্যাখ্যায় মিথ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একথাও আমাদের মনে রাখা দরকার যে বিসংগতি ও বিচ্ছিন্নতার পর্যায়েও নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি বিদেশি মিথ ব্যবহার করেননি- বিদেশি মিথের সঙ্গেও দেশি পুরাণের সহাবস্থান ঘটেছে। আর্টেমিসের সঙ্গে উর্বশী, ওফেলিয়ার সঙ্গে মহাশ্বেতা অবিচ্ছিন্ন থেকেছে। আবার যে পর্যায়ে দেশজ পুরাণের আধিক্য সেখানেও বিদেশি মিথ অপ্রতুল হয়নি। এসেছে কাসান্দ্রা মিথ। বস্তুত, সর্বতোভাবে ধ্রুপদি যাথার্থ্যরে অনুসারী বিষ্ণু দে বিদেশি মিথের ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই অনুভূতির আত্মস্থতা অর্জনের চেষ্টা করেছেন, এবং সেইসঙ্গে ছিল আত্মসচেতন তরুণ কবির নিজস্ব কাব্যপরিধি প্রশস্ত করার ঝোঁক- শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতার বোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে নয়। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে ‘দেশসমাজের পরিচয় সত্তার চৈতন্যে ধনী প্রজ্ঞাকে স্মৃতিতে সংহত করে দেশজ পুরাণের মধ্যে।’ এই কারণে পান্ডব-কৌরবদের কথা, বিভীষণ, হিরণ্যকশিপু, কংস, সুভদ্রা, বাসুকি, চাঁদসদাগর, সত্যভামা, দুর্বাসা ইত্যাদির সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিত পাঠকও স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে। মোটিফ হিসেবে এইসব ব্যবহার সহজেই পাঠকের দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। কংস ফ্যাসিজম, বিভীষণ ও যুযুৎসু সাম্যপন্থী মধ্যবিত্তের প্রতীক হয়ে ওঠে। বুর্জোয়া ধনিক শ্রেণির পরাজয় দেখাতে আসে কৃষ্ণের জন্মষ্টমীর প্রসঙ্গ।
কবিকৃতির সামগ্রিক বিবর্তনের পথ ধরেই ধ্রুপদি পুরাণের পাশাপাশি বিষ্ণু দে মনোযোগী হয়েছেন লোকপুরাণ, রূপকথা ও লোকসাহিত্যের অমূল্য উপাদান সংগ্রহ করে কবিতার পরিসর বাড়াতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে মার্কসীয় চেতনার প্রেক্ষিত থেকে তিনি ব্যবহার করেছেন এইসব দেশজ উপাদান। সাত ভাই চম্পার মতো রূপকথাও মানুষের মুক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। সমগ্র রূপকথার জগৎ ধারা দেয় কবির চোখে, অবশ্যই ভিন্ন অর্থে, সমাজচেতনার প্রজ্ঞায়। ধ্রুপদি পুরাণের জগৎ থেকে যাত্রা করে লোকজীবনের অন্দরমহলে প্রবেশ বিষ্ণু দে-র সামগ্রিক কবিসত্তার বিবর্তনের সম্পূর্ণতা নির্দিষ্ট করেছে।
Comments
Post a Comment