Skip to main content

Fabricare receipt 01 08 2024

হেলেনকে আমি ভালোবেসেছিলাম

ফইজত

রাহেলা গায়-গতরে ভালোই। দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। মানুষের বাড়ি কাজ করেই তার দিন যায়। কাজ বলতে নির্দিষ্ট কিছু নয়। এই ধান ভানা, উঠান ঝাড়– দেওয়া, গোবর দেওয়া, ঘইষা বানানো, হাড়ি পাতিল ধোয়া, পানি আনা-এসব আর কি। পাশাপাশি ছোট-খাট ফুট-ফরমাশ খাটা। মাঝে মাঝে অবশ্য কাঁথা সেলাই করা, ছেঁড়া কাপড় রিপু করা ইত্যাদি। কাজও জুটে যায়। কাজ যাই হোক রাহেলা না বলে না। অভাবের সংসার না যতটা তারও চেয়ে বেশি ভদ্রতার খাতিরে। রাহেলা মেয়েটাই এমন।  কারো মুখের উপর না বলতে পারে না।
এটা অবশ্য কম বলা হল। সে আসলে এতটা বিনয়ী আর লাজুক যে কারো দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায় না। তা সে মেয়ে মানুষই হোক আর ছেলে মানুষই হোক। কোন কাজেই রাহেলার না নেই। এ যেন পুরাণে বর্ণিত পৌরাণিক সেবাদাসী। সাত চড়ে রা নেই। নির্ভেজাল  মানুষ। রাহেলা যুবতী  মেয়ে। তাই তার পক্ষে কোন বাড়িতে স্থায়ীভাবে থেকে কাজ করা সম্ভব নয়। পাছে বদনাম হয়। আর একবার বদমান হয়ে গেলে মেয়ের বিয়ে দেওয়া সত্যিই কঠিন। একে তো গরীব তার উপর দাগ পড়লে এই মেয়ে কে বিয়ে করবে।
রাহেলাদের বাড়িটা বড় রাস্তার পাশে। ছোট্ট বাড়িটা গাছ-পালা দিয়ে ঘেরা। দিনের বেলায়ও কেমন যেন একটা অন্ধকার অন্ধকার  ভাব। অগভীর পুকুরে বারোমাসই পাতা-পচা ঘোলা পানি। শীতকালে এতটাই ঠাণ্ডা হয় যে মুখে নিলে দাঁতে খিল ধরে যায়। রাহেলার অবশ্য এসবে কোন সমস্যা হয় না। তার ইস্পাতের শরীর। ঐ ঠাণ্ডা পানিতেই সে পুরো শরীর ভিজিয়ে গোসল করে। শীতের দিনেও খালি পায়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। শীত-কাপড় না থাকায়  শাড়ি আর ব্লাউজেই শীত আটকায়। তবু রাহেলা সুখী।  কাজ-কর্ম করে দুবেলা খেয়ে না খেয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই তার জীবন কেটে যাচ্ছে। হিসেব মিলিয়ে দেখলে বলতেই হবে সে সুখী। কারণ জীবনের অতিরিক্ত যেটুকু মেদ মানুষের অশান্তির কারণ রাহেলা তা থেকে মুক্ত। সে আসলেই সুখী মানুষ।
রাহেলাদের বাড়ির পাশের বড় রাস্তা দিয়ে নানা লোকের আনাগোনা। রাহেলা অবশ্য সেদিকে ফিরেও তাকায় না। আর তাকালেই বা কি। বাড়ির চারপাশ ঘিরে যে  ঘন গাছপালা তার ফাঁক-ফোকর গলিয়ে যেটুকু চোখে পড়ে তাতে এমন কিছু দেখতে পায় না। তবু মাঝে মাঝে তার মন চায় খানিকটা সময়ের জন্যে হলেও বাড়ির কোনায় গিয়ে দাঁড়াতে। মানুষের আনাগোনা দেখতে। কিন্তু কেন জানি তা আর হয়ে ওঠে না। মানুষের বাড়িতে কাজ সেরে তারপর নিজের ঘরের টুকটাক রান্না-বান্না সবকিছু মিলিয়ে সময় যে তার হাতে খুব একটা থাকে  তা নয়। তবে তাতে মন খারাপ হয় না। কারণ তার পছন্দের তেমন কেউ নেই। যার মুখ দেখার জন্যে রাস্তার পাশে গিয়ে  দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
ইদানীং কেন যেন হঠাৎ হঠাৎ রাহেলার কান খাড়া হয়ে যায়। কে যেন বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় জোরে জোরে শিশ বাজায় । রাহেলার ভালোই লাগে। তার কেন জানি মনে হয় এই শিশ তার উদ্দেশ্যেই। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। একদিন হঠাৎ করে তার ইচ্ছে জাগে শিশ বাজানো মানুষটাকে দেখতে। শিশ আসতেই সে আলতো পায়ে ছুটে গিয়ে বাড়ির কোণায় দাঁড়ায় । তারপর অবাক হয়ে যায় ফজুকে দেখে । তাহলে ফজুই এই কাজ করে। রাহেলা মনে মনে ঠিক করে ফজুকে মজা দেখাতে হবে।
সে আলগোছে ফজুকে ডাক দেয়-
- ফজু ভাই! কোথায় গিয়েছিলেন?
- পশ্চিম পাড়ায়। গাছপালা দেখতে। সাথে ডাবেরও খোঁজ নিলাম।
- আপনার ব্যবসা-পাতির খরব কি?
- ভালোই চলছে আর কি?
- শুনলাম টেলিভিশন কিনেছেন ?
- হ্যাঁ। কিনছি একখান। সাদা-কালো। আসো একদিন। ছবি দেখাবো। শুক্রবার বিকালে একখান বাংলা ছবি হয়। মোটামুটি ভালোই । তয় সাদা-কালোতো। অতো মজা লাগে না। রঙিন হইলে ভালো হইতো।
- মন রঙিন হইলে সাদা-কালো ছবিও রঙিন লাগে। আপনার মনে তো  রং আছে। যে সুন্দর শিশ বাজান । কানে ভীষণ লাগে।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ। শিশ শুনেই তো আইলাম
- জীবনটা সার্থক হইলো। তুমি তাহলে কিছুটা বুঝবার পারছো?
- কি বুঝবার পারছি?
- না, মানে, মানে, এই আর কি? শিশের  মানে ...
- কেমনে বুঝবো। আমি কি লেখা পড়া জানি। নিজের নামটা ঠিকমতো লিখতে পারি না। তয় বুঝাইয়া কইলে বুঝতে পারুম।
- এর মধ্যে না বোঝার কি আছে ? আমি মানে, তোমারে!
- আমারে কি?
- এই একটু পছন্দ করি আর কি।
- একটু! বেশি না!
- না ,না, একটু বেশিই আর কি!
- একটু বেশিতে তো চলবে না। খুব বেশি লাগবে।
- তাইলে খুব বেশিই ধইরা লও।
- বাজানে শুনলে ছ্যাঁচা দেবে। আমি অহন যাই।
- কিছু কইলা না?
- পরে কমু।
- পরে কেন? এহনি কইয়া যাও।
- কওয়ার কিছু নাই। সব কিছু কি কইতে হয় ! আমি অহন যাই। আমার কাম আছে।
কথা বলতে বলতে মুহূর্তের মধ্যে ঘন গাছগাছালির আড়ালে মিলিয়ে যায় রাহেলা। ফজু তাকিয়ে থাকে এক পলকে। তার পা দুটো কেন জানি স্থির হয়ে মাটির সাথে লেগে থাকে। সে নড়তে ভুলে যায়। রাহেলা তাহলে রাজী। এই আনন্দ সে কোথায় রাখবে।

কাজের মধ্যে দিয়ে রাহেলার সময় কখন যে কেটে যায় তা সে টেরও পায় না। তবুও কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাহেলার মনটা জুড়ে ফজুর কথাগুলোই শুধু বাজে। ফজু কি তাকে আসলেই ভালোবাসে। হয়ত বাসে। আবার হয়ত বাসে না। ফজুটা ইদানীং দেখতে বেশ ভালোই হয়েছে। কালো চুলে তেল মেখে সুন্দর করে মাথা আচড়ানো। গায়ে দামী জামা। কাঁধে দামী শাল। পায়ে চামড়ার জুতো। পড়নে দামী সাদা প্লেকার্ড লুঙ্গী। গাছ আর ডাবের ব্যবসা করে পয়সা ভালোই কামায়। তাই চলা ফেরায় একটু ঠাঁট-বাট তো থাকবেই। তার উপর আবার এ এলাকার একমাত্র টেলিভিশনের মালিকও সে। অবশ্য সাদা কালো। কিন্তু তাতে কি। এই সাদা কালো টেলিভিশনই তো আর কারো নাই। সেই হিসেবে ফজু একটু অহংকার তো করতেই পারে।

রাহেলা মনে মনে হেসে ফেলে। ফজুর বউ হলে সে ঘরে বসে বসে টেলিভিশন দেখতে পারবে। যদিও সে লেখাপড়া তেমন কিছু জানে না। তবুও দেখতে দেখতে সে হয়ত সবকিছুই শিখে ফেলতে পারবে। তাছাড়া  ফজু বলেছে সে তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসায় সবই সম্ভব। ফজু তাকে শিখিয়ে নেবে।

লেখাপড়া ফজুও তেমন একটা জানে না। কিছুদিন প্রাইমারী স্কুলে গিয়েছিল আর কি। তবে সে হিসেবে পাকা। গাছের যে জটিল হিসাব তাও তার নখদর্পনে। গাছ দেখেই সে মনে মনে হিসেব করে ফেলে কতটুকু হবে। তারপর হিসেব করে দাম হাঁকায়। আন্দাজের উপর ভর করে কিনলে তাকেই হয়ত ঠকতে হতো। কিন্তু ফজুর বেলায় তা হবার যো নেই। সে পাকা ব্যবসায়ী।

গাছের মতো রমণী চিনতেও সে ভুল করে না। শক্ত সামর্থ গড়নের রাহেলাকে পছন্দ করাই তার প্রমাণ। নিতান্ত নিন্দুকেরাও রাহেলার গতরের প্রশংসা করতে বাধ্য। গায়-গতরে এরকম দেখা যায় না। ফজু ঢিলটা সঠিক জায়গাই মেরেছে। সে পাকা জহুরী।
ভালোবাসার এই অনুভূতি রাহেলার মনকে পুলকিত করলেও একটা কাঁটা ঠিকই তার মনকে বিদ্ধ করে। ফজু বিবাহিত। তার একটা ছোট ছেলে     সন্তানও আছে। সে কি তাহলে সতীনের ঘরেই যাবে? তা কেমন করে হয়। সে তো বিবাহিত নয়। সদ্য যৌবন প্রাপ্তা কুমারী মেয়ে। হোক না গরীব তাতে কি। বিয়ের বাজারে তার খানিকটা হলেও চাহিদা আছে। একটা না একটা পুরুষ মানুষ সে জোটাতে পারবে। অবশ্য যৌতুকের বিষয়টা তার মনকে ভাবিয়ে তোলে। তার গরীব বাপের সম্বল বলতে তেমন কিছু নেই। উল্টো কাশের রোগী। তাই কাজ কর্ম তেমন কিছু করতে পারে না। রাহেলার উপরই বসে বসে খায়। অবশ্য মানুষটা শান্ত প্রকৃতির। তেমন কোন ঝামেলা করে না। দিলে খাবে না দিলে না খেয়ে পড়ে থাকবে। হম্বি-তম্বি করবে না। এদিক দিয়ে ভালো। রাহেলা মানুষটাকে এমনিতেই একটু বেশিই পছন্দ করে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাবার দাবার যা কিছু পায় নিয়ে আসে। মানুষটার সাথে ভাগাভাগি করে খায়। রাহেলার চারকুলে আর আছেই বা কে এই বাপ ছাড়া। মা মরেছে অনেক আগেই। তখন রাহেলা অনেক ছোট। বাপ আর বিয়ে করেনি। মেয়েকে নিয়েই তার সংসার।

রাহেলা মনে মনে ভাবে বাপকে ফেলে রেখে সে কিভাবে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি যাবে। তার চেয়ে কাছাকাছি বিয়ে হলেই ভালোই হবে। সবসময় বাপকে চোখে চোখে রাখতে পারবে। এদিক দিয়ে ফজু হলে মন্দ হয় না। ফজুদের বাড়ি রাহেলাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক বাড়ি পর। ব্যবধান বলতে মাঝখানে একটা খাল।
বিবাহিত ফজুকে নিয়ে অবিবাহিতা রাহেলার ভাবনার অন্ত নেই। মনে মনে কত হিসেব কষে। কিন্তু সব হিসেব ঠিক ঠিক মেলে না। ফজুর  স্বচ্ছলতা আর তার অসামর্থ সে বোঝে । কিন্তু তাই বলে সতীনের ঘর। না, না, তা কেমন করে হয়। তাছাড়া ফজুর চরিত্রটাও তেমন একটা ভালো নয়। মেয়ে মানুষ দেখলে কেমন যেন ছোঁক ছোঁক করে। তার  নামে বেশ কিছু বদনামও আছে। কেতা দুরস্ত ফজু মেয়ে পটাতে  ওস্তাদ। সবচেয়ে বড় কথা ফজুটা যে কেন আগে-ভাগে বিয়ে করতে গেলো।

বড় রাস্তায় ইদানীং ফজুর আনাগোনা একটু বেড়ে গেছে। বিশেষ করে রাহেলার কাছ থেকে অনেকটা হ্যাঁ সূচক সম্মতি পাওয়ার পর তার আনন্দ  যেন আর ধরে না। সে তাই অতিমাত্রায় আগ্রহী। কারণে অকারণে রাহেলাদের বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করে। শিশ দেয়। রাহেলার যে ভালো লাগে না তা নয়। আবার একটু দুশ্চিন্তাও হয়। সবকিছু মিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি। তবে ভালোমন্দ, ভূত ভবিষ্যৎ বিচার বিবেচনা করার আগেই অবশ্য রাহেলা ইতোমধ্যে ফজুর সাথে দু’তিন বার তাদের ঘন বাগানটায় লুকিয়ে দেখা করে ফেলেছে । ফজু গাছের কারবারী । বাগানের মধ্যে সে দ্রুত পায়ে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে চলাচল করতে পারে। তাই তার উপস্থিতি কেউ টের পায় না।

রাহেলার তবু ভয় হয়। তার বাপ টের পেলে হয়তো তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। মুখের উপর বলে দেবে, এমন নষ্টা মেয়ে  আমার দরকার নেই। তুই বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। রাহেলা তখন তার বাপকে মুখ দেখাবে কেমন করে। আশেপাশের মানুষই বা কি বলবে। সবাই হয়ত তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। বলবে-‘ছিঃ রাহেলা, তুই এতো খারাপ, আগে জানতাম না।’
অবশ্য যারা এভাবে বলবে তারা রাহেলার চেয়েও অনেক জঘন্য কাজ করে অনায়সে তা হযম করে বহাল তবিয়তেই আছে । চোরের মায়ের বড় গলা। রাহেলা এদেরকেই ভয় পায়।
সময়ের চাকা সময়ের গতিতেই ঘোরে। দিনের পর রাত আসে। পূর্ণিমা পেরিয়ে অমাবশ্যা। ফজুর হৃদয়ের বসন্ত রাহেলাকে ছুঁয়ে যায় সবার অগোচরে। রাহেলার জীবনের বর্ষাও তাদের দুজনকে ভিজিয়ে দেয় বার বার। প্রকৃতির নিয়মেই সব কিছু  সামনে আগায়। জীবনের সময় নেই থেমে থাকার। সমস্ত নিয়ম আর অনিয়মের গণ্ডি পেরিয়ে তাদের চাওয়া পাওয়াগুলোই নিজস্ব পথ খুঁজে নেয় তার আপন নিয়মে। রাহেলা গর্ভবতী হয়ে পড়ে কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে।
রাহেলা বিষয়টা ফজুকে জানায়। তার আশা ছিল ফজু ভীষণ খুশি হবে। কিন্তু খবরটা শোনার পর কেন জানি ফজু খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বরং তাকে খানিকটা শীতলই মনে হয়। রাহেলা কিছুটা অবাক হয়। সেই সাথে খানিকটা দিশেহারাও। তাহলে কি সে নিজেই  নিজের সর্বনাশ করেছে? এখন ফজুর হাতে তার জীবনের ঘুড়ির নাটাই। ফজু চাইলে তাকে আকাশ থেকে নামিয়ে আনতে পারে। আবার চাইলে সুতা কেটে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারে। যদি তেমনটাই হয় তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে রাহেলা। রাহেলা দুচোখে অন্ধকার দেখে। জীবনে এর আগে কখনো এতটা জটিল কোন পরিস্থিতিতে পড়েনি সে। তবুও মুখ ফুটে কাউকে কিছুই বলে না। নিজে নিজে ভাবতে থাকে।
ফজু এখন আর তেমন একটা এদিকে আসে না। রাহেলাও তাকে তেমন কিছু বলে না। বলেই বা কি লাভ । ফজু কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না তাকে। উল্টো শহরে নিয়ে সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু ভালোবাসার এই অমূল্য ফসল নষ্ট করার জন্য রাহেলা মোটেই প্রস্তুত নয়। জীবনের অনেক জটিল রহস্য না বুঝলেও তার শরীরের ভেতর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা একটি অনাগত মানুষের পদধ্বনি সে ঠিকই তার হৃদয়ের গহীন ভেতরে শুনতে পায়। সেই বিমূর্ত আত্মা যেন তাকে কেঁদে কেঁদে বলে, মা, আমাকে নষ্ট করো না।
অনেক ভেবে চিন্তে শেষে রাহেলাই সিদ্ধান্ত নেয়। ফজু তাকে বিয়ে না করলেও সে তার এই সন্তান নষ্ট করবে না। ফজুকে সে তার এই মনের কথাটা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। ফজু কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখ থেকে কোন কথা বের হয় না। রাহেলা আলগোছে উঠে চলে যায়। এক সময় ফজুও উঠে আসে। দিবসের আলোও তখন তার কাছে অসহ্য ঠেকে । রাহেলাটা তাকে এ কোন সমস্যায় ফেলল।

ঘরে বউ বাচ্চা থাকায় রাহেলাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ফজু। দিন গড়িয়ে মাস যায় । রাহেলার তলপেট স্ফীত হতে হতে বালিশের আকার ধারণ করে । সে ধরা পড়ে যায়। মুখে কিছু না বললেও সবাই ঠিকই বুঝতে পারে ফজুই এই অপকর্মের হোতা। রাহেলার বদনাম মুহূর্তের মধ্যে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। কিন্তু সে পুরোপুরি স্থির থাকে।
গ্রাম্য মাতব্বররা ব্যাপারটা জানার পর শালিস বসায় । ফজু টাকা দিয়ে শালিসদারদের ঠিকই ম্যানেজ করে। রাহেলা ফজুকে কোন দোষারোপ করে না । সে সবাইকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ফজুর বিরুদ্ধে তার কোন নালিশ নেই। এই সন্তানের মা সে। তাই তার দায়িত্ব সে নিজেই বহন করবে। সবাই অবাক হয়। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত দেয় ফজু রাহেলাকে দশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে। রাহেলা সবকিছু ঠিক ঠাক করে নেবে। ফজুর বউ কিছুতেই রাহেলাকে সতীন হিসেবে মেনে নিতে রাজী হয় না।
সময়ের চাকা যেন একটু দ্রুতই ঘোরে। রাহেলার সন্তান তার ভেতরেই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু কেন জানি তার মনে হয় সে তার এই সন্তানের মুখ দেখতে পারবে তো। কেন যে তার এমনটা মনে হয় তা সে নিজেও জানে না। শুধু মনে হয় তার সন্তান হয়ত পৃথিবীর আলো বাতাসের মুখ দেখবে না।
রাহেলার ধারণাই সত্যি হয়। অন্যের বাড়ির কাজকর্ম সেরে ঘরে ফেরার পরই রাহেলার তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা ওঠে। সে মুখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যথা যেন কিছুতেই আর কমতে চায় না। বরং তীব্রতর হয়।
হঠাৎ করেই রাহেলা অনুভব করে তার দু’উরু গড়িয়ে রক্তের ধারা নেমে আসছে। সে একটি মৃত ছেলে-সন্তান প্রসব করে। রাহেলা জ্ঞান হারায়। যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন ঘর ভর্তি লোকজন । সে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে আবারও কেঁদে ওঠে। তার কানে ভেসে ওঠে মানুষের কণ্ঠস্বর, যাক বাবা! শেষমেশ এই পাপ থেকে তাহলে বাঁচা গেল।

বাড়ির যে কোণায় ফজুর জন্যে গিয়ে সে দাঁড়াত ঠিক সেই জায়গায় রাহেলার মৃত শিশু সন্তানটিকে কবর দেওয়ার হয়। সবার কাছে এটাই ছিল তার একমাত্র অনুরোধ।
জারজ সন্তানের হাড় যাদু-টোনার জন্য খুব মূল্যবান বিধায় কেউ লাশ তুলে নিতে পারে ভেবে অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রতিরাতে সে তার মৃত সন্তানের কবর পাহারা দেয়। রাহেলা মনে মনে ঠিক করে যতদিন এই হাড্ডি মাটিতে না মিশে যাবে ততদিন সে এই কবরের পাশেই বসে থাকবে।



হলুদ বৃষ্টির খোঁজে


স্কুল পালানোর অভ্যাস আমার কখনোই ছিলো না। হয় আমি স্কুলে যেতাম না-হয় একদমই যেতাম না। আর এ দুটোর যেটাই করতাম তা করতাম সিন্ধান্ত  নিয়েই। আমি বিশ্বাস করতাম প্রতিদিন স্কুলে যেতে হবে এমন কোন কথা যেমন নেই তেমনি বরাবর ফাঁকি দিতে হবে এমনটাও ঠিক নয়। আমার জীবন তাই স্কুল এবং স্কুলহীন- এই উভয় গতিধারায় চলছিল। কিন্তু স্কুল পালানোর সাথে পার্থক্য শুধু এইটুকু যে স্কুলে না গেলে বাড়িতেই থাকতাম। সেক্ষেত্রে নতুনত্ব কিছু ছিলো না। কিন্তু স্কুল পালানোর মধ্যে নাকি অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। আমার বন্ধু নয়নকে সাথে নিয়ে তাই স্কুল পালানোর সিন্ধান্ত নিলাম।

স্কুল থেকে কিছুটা দূরেই পাকা রাস্তা। সেই রাস্তায় বাস চলে, ট্রাক চলে, মাল বোঝাই ভ্যান চলে। রিক্সাও কিছু কিছু চলে বটে তবে তা নগণ্য। আমি নয়নকে বললাম, শুনেছিস, পাকা রাস্তা ধরে অনেক দূর গেলে লেবুখালী নামের একটা জায়গা আছে। সেখানে নদীতে মাইল খানেক চর পড়ে যাওয়ায় বেইলী ব্রিজের নিচে হোগল পাতার ঘন সবুজ সমারোহ। চল, স্কুল পালিয়ে সেখানে যাই। ব্রীজের রেলিং-এর উপর উঠে বসে নদীর বুকে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চরে হোগল পাতার সৌন্দর্য দেখব। ব্রীজের শেষে যেটুকু নদী অবশিষ্ট আছে তাতে ফেরিঘাট আছে। দারুণ মজা হবে। ফেরী দেখা যাবে। নয়নও ভীষণ খুশি হল। বর্ণনায় আমি বরাবরই ভালো।

অবশেষে একদিন ভীষণ সাহস বুকে নিয়ে সমস্ত বই খাতা ক্লাসে ফেলে রেখে নয়নকে সাথে নিয়ে রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাত তুলতেই বাস দাঁড়াল। মফস্বলের বাসগুলো অবশ্য লোক দেখলে এমনিতেই দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, যাবেন নাকি।

বাসের কন্ট্রাক্টর আমাদের দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, কোথায় যাবে? আমি বললাম, লেবুখালী যাব। বেইলি ব্রীজ দেখব।
- ভাড়া আছে?
- না, নেই।
- লাগবে না। ছাত্রদের ভাড়া লাগে না। এখানে বসো।

নয়ন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমিও হাসলাম। ওর একটু ভয় ভয় লাগছিল। আমারও যে লাগছিল না তা নয়। ক্লাসের ফার্স্ট বয় আমি। স্যার ক্লাসে এসে আমাকেই প্রথম খুঁঁজবে। তারপর যখন জানবে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বই খাতা ফেলে রেখে ঘুরতে গেছি নির্ঘাত বকাঝকা করবে। মেঝ ভাইকে ডেকে বলে দেবে নিশ্চয়। আমি অন্য যা কিছু করি মেঝ ভাই রাগ করবেন না। শুধু যেন কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। তিনি শুধু এটুকু নিয়েই চিন্তিত হবেন।

দেখতে দেখতে বাস লেবুখালী চলে এল। বেইলী ব্রীজের গোড়ায় কন্ট্রাক্টর আমাদের নামিয়ে দিলেন। আমরা রেলিং এর পাশ ধরে হাঁটতে লাগলাম। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল নামছে। দারুণ লাগছে জায়গাটা। আকাশে সোনালি সূর্য। ব্রীজের দুই পাশে হোগল পাতার বিস্তীর্ণ সবুজ অরণ্য। আমি আর নয়ন হাত ধরা-ধরি করে দৌড় দিলাম। জীবনে এই প্রথম স্কুল পালিয়ে এত দূর আসা। ভালো লাগা যেন সকল বন্ধন অতিক্রম করে গেল। সজোরে হেসে উঠলাম দুজন। ব্রীজের মাথার দিকে এগোতে লাগলাম। অনেক লম্বা ব্রীজ।

কিছুদূর গিয়ে রেলিং-এ উঠে পা ঝুলিয়ে বসলাম। নয়নকে বললাম, জীবন অনেক সুন্দর রে নয়ন, এখানে না এলে জানতাম না।
ও বলল, তুই এত অল্প বয়সে এত পাকা পাকা কথা কোথায় শিখেছিস। বড় হয়ে লেখক-টেখক হবি নাকি!

- জানি না। তবে শেষ বিকেলের সোনালি রোদ্দুর হতে পারলে ভীষণ মজা হতো। শেষ বিকেলের সোনালি রোদ্দুর। দেখেছিস কি দারুণ।
- কেমন একটা হলুদ হলুদ ভাব আছে, তাই না। নয়ন বলল।
- হয়ত আছে। সবার দেখবার চোখ নেই। যাদের আছে তারা হয়ত বেশি দিন বাঁচে না। দেখিস না জ্ঞানী মানুষগুলো হুটহাট মরে যায়।
- ঠিক বলেছিস। ও বলল।
- আমি ঠিকই বলি। আমি হলাম দুঃখের সন্তান। দুঃখই আমার উপলব্ধির মূল কারণ।
- এত দার্শনিকের মত কথা বলিস নাতো। ঘুরেেত এসেছি। তাও স্কুল পালিয়ে। বাসায় জানলে কি হবে তাই ভাবছি।
- বাদ দে তো এসব। যা হবার হবে। রোজ তো আসি না।

নয়ন হাসল। ওর হাসি খুব সুন্দর। আমিও হাসলাম।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল। সূর্যের সোনালি রশ্মি আরও হলুদাভ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশঃ। আমি নয়নকে বললাম, তাড়াতাড়ি চল, ব্রীজের শেষ প্রান্তে যেতে হবে। ফেরী ঘাট দেখব।

আমরা আবারও ছুটলাম। যখন ফেরীঘাট পৌঁছলাম তখন সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। একটা ফিরতি বাস এলো। আমরা দুজন উঠে পড়লাম। সন্ধ্যাসন্ধ্যি  এসে বাসায় পৌঁছলাম।

আমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় নয়ন বললো, বাসায় জিজ্ঞেস করলে কি বলব? আমি বললাম, বলবি হলুদ বৃষ্টির খোঁজে গিয়েছিলাম।

নয়ন হয়ত তাই বলেছিল। সেই রাতেই নয়ন মারা যায়।

আমার মনে পড়ল নয়নের সেই কথাটা। কেমন একটা হলুদ হলুদ ভাব আছে, তাই না। আমি বলেছিলাম, সবার দেখার চোখ নেই। যাদের আছে তারা হয়ত বেশিদিন বাঁচে না।

গেরাকুল লজ

গেরাকুল লজের নিস্তব্ধতাকে কবরের নিস্তব্ধতার সাথে তুলনা করলেও কম বলা হবে। চার চারটা যুবতী মেয়ে যে সংসারে সেখানে চূল আচড়ানোর শব্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গেরাকুল লজে কেউ কখনো চিরুনি পতনের শব্দও পেয়েছে কিনা সন্দেহ। অথচ মেয়েগুলো যখন বের হতো তখন মনে হতো ষাটের দশকের চিত্রাভিনেত্রী যেন তার নিপাট, নিভাজ তেলতেলে চুলে অভিনয় করতে যাচ্ছেন।

আমার নজর সব সময় পড়ে থাকত গেরাকুল লজের সামনের বারান্দার যে অংশটুকু পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত তার চকচকে মেঝের উপর। কেন যে পড়ে থাকত আমি নিজেও জানতাম না। জেনেছিলাম অনেক পরে। তখন আমার জীবনের অনেক কিছুই বদলে গেছে। আমিও ভুল পথে হাঁটতে হাঁটতে এমন একটা স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছি যার শেষ ট্রেনটাও অনেক আগে ছেড়ে গেছে। আর যাত্রী বলতেও আমি একা যার প্ল্যাটফরমে বসে থাকা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। আমিও অবশ্য ততদিনে আমার নিয়তিকে মেনে নিয়েছি।

গেরাকুল লজের ভদ্রলোক ছোট-খাট একটা চাকরি করতেন। তার বেতন ভাতা অত ভালো ছিল না বলেই হয়ত পাকা মেঝের উপর কাঠের ঘর তুলেছিলেন। দালান বানাতে পারেননি। জায়গাটাও পেয়েছিলেন পৈত্রিক সূত্রে। কিছু কিছু লোক যেমন সব সময়ই এমনি এমনিই কিছু জিনিস পায়। এতে তাদের কৃতিত্বের যেমন কিছু নেই আবার তাদেরকে অস্বীকার করারও উপায় নেই। সে যাই হোক আমরা আসলে আজ গেরাকুল লজের একটা ছোট-খাট বায়োকেমিক্যাল রিপোর্টের পাশাপাশি তার মানুষগুলোরও বায়োপসি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু ডাক্তারি শাস্ত্রের অসারতার মতো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতাই যেন আমাদের সিদ্ধান্ত না হয়। পাশাপাশি আর একটা ভয়ও আমার ভেতরে সংক্রমিত হচ্ছে। ইদানীং সবকিছুতে এত বেশি রাজনীতি ঢুকেছে যে আমার ভয় হচ্ছে ধীরে ধীরে মানুষ সকাল বেলার নাস্তায় পাউরুটির সাথে মাখন না মিশিয়ে রাজনীতি দিয়েই সেরে ফেলবে। সাহিত্যও এই ভয় থেকে নিরাপদ নয়। আসলে গেরাকুল লজ নিয়ে আমিও গল্প লিখতে চাইনি। কারণ এমনিতেই আমার একটা দোষ আছে এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার। পাশাপাশি অতিরিক্ত প্যাচাল পারা এবং সবশেষে মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গে মেতে ওঠা। তার উপরে গেরাকুলের লজের মত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে তো সমূহ বিপদের আশঙ্কা। আমি তবু নিজেকে নিরস্ত করতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত কাগজ কলম হাতের কাছে থাকায় বীর্যবান গোয়ারের মতই অর্থহীন চেষ্টা শুরু করে দিলাম। আর তখনি কে যেন বলে উঠল, গেরাকুল লজ নিয়ে বাপু তোমাকে এত মাতামাতি করতে বলেছে কে? নাকি ও বাড়ির ছোট মেয়েটি তোমার দিকে একটু কেমন করে যেন তাাকায় সেজন্যেই  তোমার এতো দরদ? আমি আর চোখ তুলে না তাকিয়ে পারলাম না। খুঁজতে চেষ্টা করলাম লেখার সময় এত কথা বলে কে? কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে। ঘড়িতে এখন রাত দুটো।

গেরাকুল লজের কথা বলছিলাম। বাড়িটি সদর রাস্তার পাশে। কাঠের ঘরে টিনের ছাউনি। মেঝেটা অবশ্য পাকা। চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ঢুকতে হয়। এই ঘরে চার চারটি মেয়ে। সবাই যুবতী। বিয়ে হয় হয়। হচ্ছে না একথা বলা যাবে না। অনেকেই আগ্রহী। অজানা কারণে আগাচ্ছে না। গেরাকুল লজের গেটে কলাগাছ পুতে লাল, নীল, হলুদ  কাগজ দিয়ে মুড়ে গেট সাজানোর জন্যে মহল্লার ছেলেরা তাদের টেকে পয়সা নিয়ে বসে আছে। কিন্তু কেন জানি কিছুই হচ্ছে না। গেরাকুল লজ তবু কবরের মত নিস্তব্ধ। কোন অস্থিরতা নেই। শীতের পাতা-পচা ঠাণ্ডা পুকুরের পানির মতই নিস্তরঙ্গ।  দুর্গন্ধ নেই।
গেরাকুল লজের গৃহকর্ত্রী বারোমাসই সংসার নিয়ে ব্যস্ত। অবশ্য কেউ তাকে কখনো বাড়ির বাইরে বেড়োতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। আমি তো দেখিই নি। যদিও বারোমাসই গেরাকুল লজের বারান্দার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের মেঝের যেটুকু দেখা যায় সেটুকু দেখার  জন্যেই সামনের বাসা থেকে কারণে অকারণে হা করে তাকিয়ে থাকি। তবুও দেখা মেলে না। গেরাকুল লজে আসলে গৃহকর্ত্রী আছে কিনা বোঝা যায় না। থাকলে তিনি হয়ত অশরীরী।

সবাই উৎসুক। কিন্তু তাতে কিইবা এসে যায়। গেরাকুল লজের বাসিন্দারা যেন কিছুই দেখেন না। তারা যেন এই পৃথিবীতে থেকেও নেই। মেয়েগুলো পরিপাটি হয়ে বাইরে যায়। আবার ফিরে আসে। রাত্রি আসে। বাতি জ্বলে। বাতি নেভে। লম্বা ঘুম। স্বাভাবিক ভাবেই বোঝা যায় ঘরের ভেতর মানুষ আছে। দিনের কর্মসূচি এগিয়ে চলে। সবাই ধরে নেয় গেরাকুল লজের জীবন ঠিক ঠিক চলছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বোঝার উপায় নেই। তারা কারও সাথে কথা বলে না।

আমি হঠাৎ করে কেন জানি একটু বেশিই আগ্রহী হয়ে উঠি। ছোট মেয়েটিকে যেতে দেখে ডেকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় যাচ্ছো? সে কিছুই বলে না। আমার জন্যে ব্যাপারটা অপমানজনক হলেও কেন জানি কোন অনুভূতি হয় না। গেরাকুল লজের সবকিছু এমনই। অপমানিত হওয়ার কিছু নেই।

আমার অপেক্ষা যেন দিন দিন আরও অর্থহীন হয়ে যায়। শত চেষ্টার পরও ছোট মেয়েটি আমাকে দেখে না। আমার মনে হয় তার কাছে আমার উপস্থিতি উড়ে যাওয়া মশা-মাছির চেয়ে বেশি কিছু নয়। এসব তুচ্ছ ঘটনা কেউ খেয়াল করে না। গেরাকুল লজে দিনে দিনে দৈন্য নামতে থাকে। তবে তা এত ধীর গতিতে যে সেই পরিবর্তন ধরতে বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন। বয়সের ভারে ভদ্রলোক শষ্যাশায়ী হন। মেয়েরা আগের মতই চুপচাপ থাকে। তাদের ঘরের কাঠের দেয়াল বিবর্ণ হতে হতে ক্ষয় হওয়া সমুদ্রের তীরের মতই দাঁড়িয়ে আছে। এসব পরিবর্তন কম-বেশি সবারই চোখে পড়ে। কিন্তু মানুষের নিজেরও তো ব্যস্ততা আছে। কার সময় আছে গেরাকুল লজের মত একটা সাধারণ কাঠের ঘর আর তার বাসিন্দাদের লক্ষ্য করা।
আমারও বয়স বাড়তে থাকে। বিয়ে হয়। ছেলে মেয়ে জন্মায়। গেরাকুল লজের তেলতেলে মেঝে ক্ষয় হতে হতে খসখসে হয়ে যায়। ছোট মেয়েটিকে এখন আর তেমন দেখা যায় না। গেরাকুল লজের তৃতীয় মেয়েটির বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শামুকের পথ চলার মতোই ধীরগতি। এখন আর কেউ অবশিষ্ট নেই এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার। গেরাকুল লজের শ্যাতোদইফের কারাগারের মতই নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে।

আমার ছেলে এবার কলেজের বারান্দায় পা রেখেছে। আমি অবশ্য তাকে নিয়ে মোটেই চিন্তিত নই। সে আধুনিক চটপটে। ঝকঝকে তরুণীদের দিকেই তার নজর। তার বান্ধবীরাও সে রকমই। অতএব আমি তো খানিকটা ভাবনাহীন হতেই পারি। আমি তাকে তার স্বাধীনতার উপরই ছেড়ে দিয়েছি।

কিছুদিন কলেজে যেতে না যেতেই সে কেমন যেন হয়ে উঠল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন সমস্যা। তোমার মন খারাপ কেন? আমার দিকে না তাকিয়েই সে বলল, কিছু না বাবা। আমি লক্ষ্য করলাম তার চোখ গেরাকুল লজের সামনের বারান্দার খসখসে মেঝের উপর। পর্দা সরে গেলে যার খানিকটা চোখে পড়ে।



বায়োস্কোপ

আমাদের মধ্যবিত্তের সংসারে যখনই কোন হাস-মুরগী, গরু-ছাগল কিংবা ছাগল ছানা ভীষণ রকম স্বাস্থ্যবতী  হয়ে ওঠে তখনই গেরস্থ ঘরের মেয়েরা সেটা বাজারে বিক্রি করে কত টাকা পাওয়া যাবে সে হিসেব কষতে থাকে। কারণ এই টাকায় তাদের স্কুল পড়–য়া ছেলে-মেয়েদের ফিসের বন্দোবস্ত হয়তো হয়ে যাবে। পরীক্ষাটা একটু বড় গোছের হলে যদি তার পুরোটার সঙ্কুলান নাও হয় সেক্ষেত্রে ক্ষেতের কলা, কচু; গাছের আম, জাম, লিচু বিক্রি করে বাকিটা সামলে নেওয়া যাবে। আর এসবই ঘটে ছেলেমেয়ের চোখের সামনেই তাদের চোখের জল, জিভের জল এক করে। তারা কাঁদে হয় মায়ায় পড়ে নতুবা লোভের তাড়নায়। তবু তাদের কে তা সংবরণ করে নিজের হাতেই প্রিয় জিনিসটিকে বাজারে নিয়ে যেতে হয় বিক্রি করার জন্যে।

আমাদের বাড়িতে একরকম ঘটনা অহরহ ঘটে। আমাদের দশ ভাই বোনের বিরাট সংসার। সারা বছর কারো না কারো পরীক্ষা লেগেই থাকত। পাশাপাশি বই, খাতা, কালি, কলম, ভীষণ প্রয়োজনীয় নতুন জামা (আর না হলেই নয়), এসবের দরকার তো বারোমাস লেগেই থাকত। এসব প্রয়োজনের কথা ভেবেই নাকি অকারণে কিংবা স্বভাব দোষে একটা মুরগী অন্য সব মুরগীর খাবার কেড়ে নিয়ে গলাধঃকরণ করে হৃষ্টপুষ্ট একটা খাসিতে পরিণত হলো। পাড়া-পড়সী সবাই বলল, এটাকে বাজারে নিলে কমপক্ষে একশ টাকা চাই কি বেশিও হতে পারে। সেই বাজারে একশ টাকার দাম ছিল। কারণ তখনো এ দেশে আহাম্মকের মত এতটা মুদ্রাস্ফীতি আর ঘন ঘন দেশি মুদ্রার দরপতন-এর কাহিনী শোনা যেত না।

অবশেষে কি আর করা। গায়ের হাট যেদিন বসে সেদিন বিকেলে মা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করালেন ঐ খাসী মুরগী হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে।

প্রথমে তিনি আমাকে বাজারে যাওয়ার উপযোগী করে তৈরি করলেন। সবচেয়ে ভালো জামাটি পড়িয়ে, লুঙ্গিটি কোমড়ে ভালো করে পেঁচিয়ে দিলেন। তারপর চকচকে শরীরে সরিষার তেলের বোতলটি এনে সেখান থেকে বেশ খানিকটা তেলের পুরোটা হাতের চেটোতে ঘষে নিয়ে ভালো করে মাথায়, চুলে আর সারা মুখে ঘঁষে মেজে দিলেন। এতে আমার অপরিচ্ছন্ন আর খসখসে মুখ কিছুটা লাবণ্য পেল এবং আামার মুখটাও দেখতে খানিকটা ঐ খাসী মুরগীর তেলতেলে শরীরের মতই মনে হলো। যাহোক আমিও আর দেরী না করে চোখের জল, নাকের জল এক করে খাসী মুরগী কোলে নিয়ে ছুটলাম বাজারের দিকে। পথে নানা জন নানা কথা বলল। তবে তার সবই দাম সংক্রান্ত। কিন্তু মনের মতো দাম না হওয়ায় খাসী মুরগী বিক্রির কোন সুযোগ তৈরি হলো না।

আমি বাজারে গিয়ে যে কোনায় মুরগীর হাট বসত সেখানে একটা শক্ত খুঁটি দিয়ে খাসী মুরগীর পায়ের সাথে বাঁধা রশি ভালো করে আটকে দিলাম। তারপর পাক্কা ব্যবসায়ীর ভান করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মধ্যে আলাদা একটা ভাব ছিলো। কারণ বাজারে আসা কোন মুরগীই আমারটার ধারে কাছে ছিলো না। খাসী মুরগী বলে কথা।

ঝানু ব্যবসায়ীর মতো সফল কৌশল অবলম্বন করা সত্ত্বেও দাম উঠছিল না। কারণ একটা। সেসময় মুরগীর মড়ক চলছিল। আর চুনা রোগে (মুরগীর এক ধরনের চুনের পানির মত পায়খানার রোগ যাতে শরীরে দুর্বল হয়ে যায় এবং এক সময় মুরগী মারা যায়) আক্রান্ত মুরগীতে বাজার ছেয়ে গিয়েছিল। আমি তবু হতাশ হলাম না। কারণ আমার খাসি মুরগী বেশ তরতাজা ছিল এবং কেউ কাছে আসলে কিংবা গায়ে হাত দিলে কড় কড় করে ডেকে উঠছিল। সবাই বলল, ভালোই তো দেখি। এখনো অসুস্থ হয়নি তাহলে। আমি সাফ সাফ জানিয়ে দিলাম, আমার মুরগী একদম সুস্থ।

মড়ক লাগায় অনেকেই সস্তায় মুরগী কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। সেই সব মুরগীর অনেকগুলো অবশ্য বাড়ি নিতে গিয়ে পথে বসেই মারা যাচ্ছিল। তবুও তো সস্তার মাল কে ছাড়ে।

দাম বেশি হাঁকানোয় কেউই আর কিনতে রাজী হলো না। স্থানীয় বাজার হওয়ায় ক্রেতাও মোটামুটি সীমিত। আমি খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লাম। এমন সময় শুনলাম বাজারে বায়োস্কোপ এসেছে। এক টাকায় পুরো এক শো বায়োস্কোপ দেখা যায়। আমার পকেটে এক টাকা ছিল। আমি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। আমি আমার পাশের লোকটাকে খাসী মুরগীর দিকে খেয়াল রাখতে বলে বায়োস্কোপ দেখতে গেলাম। বায়োস্কোপ দেখে আমার সেকি আনন্দ। শো শেষ হলে আমি দৌড়ে ছুটে এলাম খাসী মুরগীর কাছে। কিন্তু এসে দেখি খাসী মুরগী আর দড়িতে বাঁধা নেই। খালি খুঁটি পড়ে আছে।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম খাসী মুরগী দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে। সবাই ধারার জন্যে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কেউ তার সাথে পেরে ওঠেনি। বাজারের পাশ্ববর্তী ঘন জঙ্গলে সে হারিয়ে গেছে। আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল মুহূর্তে। বাড়ি ফিরে আমি কি জবাব দেব। এত দামী খাসী মুরগী। সেই মুরগী আমি বায়োস্কোপ দেখতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি শুনলে আরো ভীষণ রাগ করবেন। এদিকে ক্রমশঃ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। বাজারগুলো সাধারণতঃ বিকেলে বসে। আমি সাহস নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। খাসী মুরগীর কোন সাক্ষাত পেলাম না। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামল। গভীর অন্ধকারে চারিদিক ছেয়ে গেলো। আমি বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। খাসী মুরগী হারানোর শোকে তখন আামর পা আর চলছিল না।

বাড়ির কাছাকাছি এসে বাড়িতে ঢুকতে আর সাহস হলো না। খানিকটা দূরে মাঠের ভেতর বসে রইলাম। কারণ একটাই বাড়িতে গিয়ে আমি কি জবাব দেব। মুরগী হারানোর চাইতেও বড় কথা আমি বায়োস্কোপ দেখতে গেলাম কেন। আমি কি তাহলে নষ্ট হয়ে গেছি।

শেষমেশ বাড়িতে ফিরে আসার জন্যে মনস্থির করলাম। যুদ্ধের চেয়ে কঠিন সেই সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে এতক্ষণ মাঠে বসে থাকতে হলো। ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকছিলাম। আব্বা আমাকে দেখেই বলল, কি রে! মুরগী কোথায়?

আমি বললাম, হাত থেকে ছুটে জঙ্গলে পালিয়ে গেছে। ধরতে পারিনি, অনেক খুঁজেও পাইনি।

সে হেসে বলল, ভয়ের কিছু নেই। মুরগী পাওয়া গেছে। বাজারের পাশের এক বাড়ির গাছে উঠে বসেছিল। তারা খোঁজ নিয়ে শুনেছে আমাদের মুরগী। দেরী না করে তারাই দিয়ে গেছে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। গা বেয়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। মনে হলো বুকের উপরেরর চাপা পাথরটা মুহূর্তেই নেমে গেল। এত আনন্দ হলো যে তা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না। খাসী মুরগী তার এতো ভারী শরীর নিয়ে গাছে উঠল কি করে? বায়োস্কোপের দৃশ্যের কথা মনে পড়ল। সেখানে তাজমহল, হাওড়া ব্রিজ আর আহসান মঞ্জিলের সাথে হেমামালিনী নামক ধুমসী এক সুন্দরী নায়িকার গাছে চড়ার দৃশ্যও ছিল। আমি মুহূর্তেই বুঝে নিলাম জগতে সবই সম্ভব।



স্বর্গের ফোন নাম্বার

সাবের আলীর সম্ভবতঃ মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে তার বাসার সর্বত্র একটা  ফোন নম্বর খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার চোখে ছানি-পড়া অশীতিপর বৃদ্ধা স্ত্রী সাবেরা বেগম ভাঙা ক্যানক্যানে গলায় যখন তাকে জিজ্ঞেস করল, কি খুঁজছ? তার বিরক্তি যেন চরমে উঠল। জগতের যে আওয়াজ তার কাছে সব চেয়ে অসহনীয় ও বিরক্তিকর তা তারই স্ত্রী সাবেরা বেগমের আওয়াজ। পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী কণ্ঠের অধিকারী মানুষটির গানও সাবের সাহেব ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতে রাজি কিন্তু তিনি তার স্ত্রীর কণ্ঠটি একদম সহ্য করতে পারেন না। এই কণ্ঠের হাত থেকে বাঁচার জন্য পারলে তিনি অনেক আগে আত্মহত্যা করতেন। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ এবং কাপুরুষোচিত হওয়ায় তিনি সে সিদ্ধান্ত ত্যাগ করেন। আর এই কারণে বিগত তেষট্টি বছর তিনি এই বিরক্তিকর কণ্ঠটি সহ্য করে বেঁচে আছেন। তাদের যখন বিয়ে হয় তখন তার স্ত্রীর বয়স আঠার বছর। বর্তমানে সাবেরা বেগম একাশিতে পা রেখেছেন।

সাবের আলী সাবেরা বেগমকে পছন্দ করেছিলেন স্রেফ নামের মিল থাকার কারণে। কিন্তু নামের মিলটুকু ছাড়া এক জীবনে অন্য কোন মিল তিনি খুঁজে পাননি। পাওয়ার কথাও নয়। সাবের আলী বনেদী বংশের লোক। উদার নৈতিক মানুষ। বাপ দাদাদের হালকা একটু জমিদারী ভাব ছিল। তিনি দেশের বাহিরে পড়াশুনা করেছিলেন। এক সময় স্বপ্ন ছিল ঝানু অর্থনীতিবিদ হবেন। কিন্তু যে কোন কারণে হোক তার সে আশা পূরণ হয়নি। তবে একেবারে ব্যর্থ হননি তিনি। সরকারের বড় আমলা হতে পেরেছিলেন। তার দাপটও ছিল বেশ। বহু বছর আগে রিটায়ার্ড করেছেন। এখন বারান্দায় বসে বসে ঝিমোন।
সাবের আলী ভালো গাইতে পারতেন। ছোট-খাট কিছু গানের প্রোগামে গানও করেছেন। তাতে হাত তালিও বেশ জুটেছিল। এসব যৌবনের কথা। যৌবনে মানুষ অনেক কিছু করতে সাহস পায়। যৌবন বলে কথা।

সাবের আলী বরাবর স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। কি শীত, কি গ্রীষ্ম-বলতে  গেলে বারো মাসই সকালে উঠে হাঁটতে বের হন। রিটায়ারমেন্টের পর তার  কেন জানি কিছুই ভালো না লাগতে শুরু করে। তিনি নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যান। বারান্দায় পেতে রাখা ইজি চেয়ারে বসে শুধু ঝিমোন। আর এভাবেই তার মধ্যে আস্তে আস্তে এক ধরনের অস্থিরতা ধরা পড়তে থাকে। যা স্বাভাবিকতার সাথে ঠিক যায় না। তিনি নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। ত্রিশ বছর একটা বারান্দায় বসে একা একা ঝিমোনো একেবারে সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনি তা করতে পেরে মনে মনে এক ধরনের আত্মপ্রাসাদ লাভ করতে থাকেন। এটাই তার অস্বাভাবিকতার প্রথম প্রকাশ।

তার এই অস্বাভাবিকতা প্রথম ধরা পড়ে তাদের কাজের মেয়ে ফরিদার চোখে। ফরিদা কিছু একটা আঁচ করতে পেরে দৌড়ে ছুটে যান সাবেরা বেগমের কাছে। দারুণ একটা সংশয় আর চাপা একটা উত্তেজনায় তার চকচকে চোখ আর ফ্যাশফেশে কণ্ঠে সে সাবেরা বেগমকে বলতে থাকে, খালু মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ফরিদার এই কথায় সাবেরা বেগমকে নিস্পৃহ থাকতে দেখা যায়। সে আলগোছে জবাব দেয়, বয়স হলে মানুষ অনেক কিছু করে। তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই তোর কাজে যা।

কাজে ঠিকই যায় ফরিদা। কিন্তু কেন জানি কাজে তার মন বসে না। সারাক্ষণ শুধু ঘুরে ফিরে একই ভাবনা, খালু কি পাগল হয়ে গেল। সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারান্দায় উঁকি মারে। সাবের সাহেবের অবস্থা তার কাছে অপরিবর্তিত মনে হয়। ফরিদার মন সংশয়ে ভরে যায়। ফরিদার সংশয়ের পিছনে যৌক্তিক কারণও আছে। খালুকে নিয়ে সে ততটা চিন্তিত নয় যতটা চিন্তিত তার বিয়ে নিয়ে। খালু বুড়ো মানুষ। তার বয়স হয়েছে। পাগলতো হতেই পারে। কিন্তু খালু পাগল হলে তার বিয়ে দেবে কে। আর এক মাস পরে তার বিয়ে। পাত্র তার ঠিক করাই আছে। পাশের বাড়ির ড্রাইভার কাদের। কাদের ছেলে ভালো। ভীষণ হাসি খুশি। তবে সামান্য তেল চুরি আর ফাও ট্রিপের অভ্যাস আছে। এসব সব ড্রাইভারের থাকে।

বিয়ের ব্যাপারে তার তেমন কোন চাহিদা নেই। শুধু তার বাবা-মার ইচ্ছে মেয়েকে যেন একটু সাজিয়ে গুঁজিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে দেয়। তার খালু তাকে কথা দিয়েছিল, সে সব কিছুই ঠিক ঠাক মত করে দেবে। আর সেই খালুই যদি এখন এভাবে পাগল হয়ে যায় তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার চেয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটবে। কাদেরের বাবা-মা হয়তো অপেক্ষা করতে চাইবে না। এই সুযোগে তাকে অন্য কোথায় বিয়ে দিয়ে দেবে। এমনিতেই ফরিদাকে তাদের পছন্দ নয়। তার উপরে এমন একটা মোক্ষম সুযোগ পেলে সে অজুহাতে তারা কাদেরকে অন্যত্র বিয়ে দিতে পারে।

ফরিদার বুক ভেঙে কান্না আসে। সে কান্না তার বুকের পাটাতন ভেঙে দুকূল ছাপিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তার কি অবস্থা হবে। এই তার কপালে ছিল। যে বাড়িতে সে তার শৈশব কৈশোর আর যৌবনের প্রথম ভাগ কাটিয়েছে, যাদের সহযোগিতায় স্বপ্ন দেখেছে সংসার পাতানোর, যাদের জন্যে তার শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষয় করেছে, যাদেরকে ঘিরে তার সমস্ত চিন্তুা-ভাবনা, সেই বাড়ির মানুষটি যদি পাগল হয়ে যায় তাহলে তার কি গতি হবে। ফরিদার কয়েক দিন আগেই এরকম সন্দেহ হয়েছিল। কারণ তার খালু ইদানীং তার সাথেও কথা-বার্তা কমিয়ে দিয়েছিল। সে হঠাৎ করে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। তার কান্না শোনার মত এখানে অবশ্য কেউ নেই।

সাবের সাহেব ভুতগ্রস্থ মানুষের মত বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। ফরিদা তবু ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ফরিদাকে অবাক করে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তার খালু মিষ্টি করে হাসে। ফরিদাও ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে মিষ্টি করে হাসে। খালু তাকে আরও অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, স্বর্গের ফোন নম্বর কত বলতে পারিস। ফরিদা ভীষণ অবাক হয়ে যায়। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। আস্তে আস্তে সরে আসে। সে নিশ্চিত হয়ে যায় খালু তাহলে   পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে।

সাবের সাহেবের অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। তার স্ত্রী সাবেরার এসবে মন নেই। সে সারাক্ষণ অন্ধকার ঘরটায় পড়ে থাকে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে আসে না। তার প্রয়োজনও তেমন কিছু নেই। ফরিদা আর তেমন কোন আাশার আলো দেখতে পায় না।

একদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ করে সে খেয়াল করে, সাবের সাহেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। হাতের কাজ ফেলে ফরিদাও তার পিছ পিছু হাঁটতে থাকে। সাবের সাহেব যেন তার উপস্থিতি টের না পায় তার জন্যে নিরাপদ দূরত্ব বাজায় রেখে সে আগাতে থাকে। ফরিদাকে অবাক করে দিয়ে সাবের সাহেব মোড়ের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট এবং একটা দিয়াশলাই কেনেন। ফরিদা ভালো করে জানে যে তার খালুর ধূমপানের কোন নেশা নেই। এমন কি শখ করেও কোনদিন সিগারেট টানতে দেখেনি। খালুর কাণ্ড দেখে ফরিদার চোখ কাপালে উঠে যায়। তার ভীষণ ইচ্ছা করে দৌড়ে গিয়ে খালুকে সে নিরস্ত করে। কিন্তু পরক্ষণেই খালু টের পেলে বিরক্ত হবে ভেবে নিজেকে নিরস্ত করে।

ফরিদা তার খালুর পিছু পিছু হা্টঁতে থাকে। কিছু দূর গিয়ে সাবের সাহেব একটা ফোন ফ্যাক্স-এর দোকানে ঢ়ুকে পড়েন। ফরিদা একটু দূর থেকে লক্ষ্য করেন তিনি কি করছেন। সাবের সাহেব দোকানদারের কাছে স্বর্গের ফোন নম্বর চাইতে দোকানদার ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সে একটু হেসে বলে, কিছু মনে না করলে, স্যার, আপনি কি আমার সাথে তামাশা করছেন।
- তামাসা করব কেন? সাবের সাহেবের স্পষ্ট জবাব।
- স্যার, স্বর্গের কোন ফোন নম্বর নেই। আপানি ভুল করছেন।
- আছে। আমার কাছেই ছিল। কখন যেন হারিয়ে ফেলেছি। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার কাছে থাকলে দাও। না থাকলে না দাও। কিন্তু ফাযলামো করবে না। নাম্বারটা আমার খুব দরকার।
- সরি স্যার। এই নম্বরটা আমার কাছে নেই।
- ঠিক আছে। সরাসরি না বলেছো। ভদ্রলোকের মত কাজ করেছ। তোমাকে ধন্যবাদ। ঘোরপ্যাচ আমি একদম পছন্দ করি না।
সাবের সাহেব টলতে টলতে দোকান থেকে বাইরে বের হয়ে আসেন। হঠাৎ করে বৃষ্টি নামে। ফরিদা এগিয়ে এসে হাত ধরে। প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তারপর মুষলধারে পড়তে শুরু করেছে। তারা বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। সে রাতে ফরিদার আর ঘুম হয় না। শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে স্বর্গের নম্বরটা কোথায় পাওয়া যাবে। অবশেষে ভোর রাতে তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে তার বুদ্ধির কথা আর কাউকে বলে না। তখন তার চোখে রাজ্যের ঘুম।

পরদিন দোকানে গিয়ে একটা নতুন মোবাইল কিনে নিয়ে আসে ফরিদা। খালুর হাতে সেই নম্বরটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, খালু, স্বর্গের ফোন নম্বর পাওয়া গিয়েছে। আপনি ফোন করেন। কথা বলতে পারবেন।

সাবের সাহেব তার মোবাইলটা হাতে তুলে নেন। নম্বর টিপতে টিপতে ফরিদা তার শোবার ঘরে চলে আসে ফরিদার নতুন মোবাইলটা বেজে ওঠে। সাবের সাহেব অতি উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, হ্যালো, এটা কি স্বর্গের ফোন নম্বর?
ওদিক থেকে  ফরিদার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, হ্যাঁ, এটা স্বর্গের ফোন নম্বর। আপনাকে স্বাগতম। বলুন কি বলবেন।
সাবের সাহেব আরও উৎসুক কণ্ঠে বলেন, আমার জন্যে একটা ভালো সিটের ব্যবস্থা করা যাবে?
- হ্যাঁ, যাবে। ফরিদা উত্তর দেয়।
- আর শুনুন, একটা কথা। আমার স্ত্রী যদি কোন সিটের কথা বলে তাকে বলে দেবেন স্বর্গে আর কোন সিট খালি নাই। শেষ সিটটা আমি বুকিং দিয়েছি।
- জি স্যার। ওনার বুকিং নেওয়া হবে না। আমরা মার্ক করে রাখছি।
- ওকে। ধন্যবাদ।
- আপনাকেও ধন্যবাদ বুকিং দেওয়ার জন্যে। তবে স্বর্গের তরফ থেকে আপনার প্রতি একটা অনুরোধ আছে।
- কি অনুরোধ?
- ফরিদা নামের যে মেয়েটি আপনাদের কাছে থাকে তার সিটটা ক্যান্সেল করে আপনাকে দেওয়া হল। এর জন্যে ওর বিয়ের খরচ বাবদ এক লক্ষ টাকা দিয়ে দেবেন। আমরা ওটাকে আপনার সিটের মূল্য বাবদ ধরে নেব। আপনার কি আপত্তি আছে?
- না। কোন আপত্তি নাই। আমি ওকে চেক লিখে দেব।
- চেক নয়। নগদ টাকা দেবেন। বেচারীর চেক ভাঙ্গাতে সমস্যা হবে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। আলমারিতে নগদ টাকা আছে। ওখান থেকে দিয়ে  দেব। এবার তাহলে রাখি।
- হ্যাঁ, রাখুন। আর শুনুন, স্বর্গের নম্বরে দ্বিতীয় বার ফোন করলে শাস্তি স্বরূপ বুকিং ক্যান্সেল হয়ে যায়।
- ঠিক আছে। আর করব না।
- এবার তাহলে নম্বরটা ছিঁড়ে ফেলুন।

ফরিদা কাগজ ছেঁড়ার শব্দ শুনতে পায়। তারপর আস্তে করে ফোনটা রেখে দেয়।

কাদের আর ফরিদা পাশাপাশি শুয়ে আছে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ফরিদার হঠাৎ করে সে রাতের কথা মনে পড়ে যায়। যে রাতে তার খালু রাস্তায় বের হয়ে গিয়েছিল। ফরিদা গিয়েছিল তার পিছু পিছু। ফেরার সময় বৃষ্টি নেমেছিল। প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি। তার পর মুষলধারে। ঠিক আজকের রাতের মতোই। সে রাতের মাত্র এক সপ্তাহ পরে তার খালু মারা যায়। খালাম্মা মারা যান ঠিক তার এক সপ্তাহ পরে। নামের পাশাপাশি তাদের মৃত্যুর মধ্যেও অপূর্ব একটা মিল ছিল।


হেলেনকে আমি ভালোবেসেছিলাম


হেলেন কাজ করে একটা গার্মেন্টসে। আমি বাসের কন্ডাক্টর। আমরা একই বস্তিতে থাকি। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় দুজন দুজনের সুখ-দুঃখের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সাক্ষী। কিন্তু জীবন যাপনের এই সব অনুসঙ্গ নিয়ে আমাদের মধ্যে কখনো কথা হয় না। কারণ হেলেন বিবাহিতা। আমিও বিবাহিত পুরুষ। হেলেন আমাকে না বললেও আমি বাতাসে কান পেতে তার সর্ম্পকে যা কিছু জানতে পারি তার সারমর্ম মোটামুটি মন্দ নয়। হেলেনদের পরিবার গ্রামে বসবাস করে। অনেকগুলো ভাইবোন নিয়ে অভাবের সংসার। পেটের দায়ে আট দশটা মেয়ের মত সেও ঢাকায় আসে কাজের আশায়। গার্মেন্টসে তার কাজের জোগাড় হয়। তার দিন চলে যেতে থাকে। কাজের সুবাদে তার সাথে পরিচয় হয় জামালের। তার পর বিয়ে এবং সংসার। সে লেখাপড়ায় ভালো। বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ। এই জন্যে আমি তাকে  বেশ সম্মান করি। অবশ্য তা দূর থেকে। সে এসবের কিছুই জানে না।

আমার কাহিনী খুব একটা চমকপ্রদ কিছু নয়। টোকাই ছিলাম। ওস্তাদের সাথে পরিচয়। ধীরে ধীরে বাসের কন্ডাক্টর। আপনজন বলতে পৃথিবীতে তেমন কেউ নেই। দূরসম্পর্কের এক খালা আছে। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। মা বাবার সম্পর্কে অরিজিন্যাল কোন তথ্য আমার কাছে নেই। নানা জন নানা কথা বলে। আমি এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে  দেই। মালতিলতার সাথে পরিচয়ের পর কয়েকদিন এদিক ওদিক  ঘোরাঘুরি। তারপর সাদামাটা বিয়ের আয়োজন। আরও সাদামাটা সংসার। লেখা পড়া বলতে তেমন কিছু না। মানবিক বিভাগ থেকে মেট্রিক ফেল।

ডিউটির দিনগুলোতে আমি সকাল সকাল বের হয়ে যাই। ফিরতে অনেক রাত হয়। তখন কেবল মাত্র একজন তার বাসার সামনে মরা পেতে বসে থাকে। সে হেলেন। আমি জানি, সে আমি কেন, কারও জন্যেই বসে থাকে না। তার ঘুম কম। অনেক রাত অবধি একা একা খোলা আকাশের নিচে বসে থাকে। তারপর উঠে যাওয়ার সময় গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে। জীবনের সমস্ত পাওয়া, না পাওয়ার মিলিত হাহাকার এই গভীর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় হয়তোবা। আমার খুব ইচ্ছে করে এসব কথা তাকে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু কখনো হয়ে ওঠে না। আমার বউ টের পেলে যুদ্ধ  বেঁধে যাবে।

আমি যে ভাবে বেড়ে উঠেছি তাতে ভালো ছেলে হবার কথা ছিল না। কিন্তু  কেন জানি শত চেষ্টা করেও মন্দ ছেলে হতে পারিনি। সিগারেট ধরেছিলাম। গলা জ্বালা পোড়া করে বলে ছেড়ে দিয়েছিলাম। মদ ধরেছিলাম। ভালো লাগেনি। আমার যে লাইন তাতে অনেকেই দুঃখ কষ্ট ভুলতে হেরোইন খাই। আমার তেমন কোন দুঃখ কষ্ট নেই। হেরোইন খাওয়ার কোন যৌক্তিকতা কখনো খুঁজে পাইনি। অবশেষে কোন কারণ ছাড়াই আমি ভালো মানুষ রয়ে  গেলাম। এভাবে ভালো থাকারও কোন মানে হয় না। লাইফে কোন চার্ম থাকে না। বৈচিত্রহীন জীবন মাঝে মাঝে লোম ওঠা ধূসর গ্রীবার উট পাখির মত মনে হয়। আমি রঙিন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। হাওয়াই মিঠাইয়ের মত হাল্কা আর রঙিন। সনপাপড়ির মত মিষ্টি আর মিহি।

এখানে এসেছি প্রায় দুমাস হলো। এখনো হেলেনের সাথে আমার কোন কথা হয়নি। কথা হওয়ার জন্য কিছু কারণ দরকার হয়। তেমন কোন কারণ এখনো ঘটেনি। আমি অবশ্য বেহায়ার মত গায়ে পড়ে কথা বলতে অভ্যস্ত নই। অজুহাত সৃষ্টি করার মত অতটা বেহায়াও নই। তাই স্বাভাবিক ভাবে এখনো কথা হয় নি। তবে মনে মনে একটা গভীর আশা আমাকে দারুণ আন্দোলিত করে। একদিন না একদিন ওর সাথে আমার কথা হবে। মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে।


সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি শেষে রাতে বাসায় ফিরে শুরুতেই গোসল সেরে  ফ্রেস হয়ে নেই। তারপর ভাত খাই। সামনের বারান্দায় বসে সিগারেটে টান দিতে দিতে জীবনের ছোটখাট অঙ্ক কষি। আমার স্বপ্ন অবশ্য বেশি কিছু নয়। জীবনে এবং জগতে আমার প্রত্যাশা খুবই কম। একটু রঙিন জীবন। বিকেলের শুষ্ক বাতাসের মিহি আর পাখির পালকের মত হাল্কা। তখন আমার ভীষণ হাওয়ায় ভাসতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে হেলেনের পাশে গিয়ে বসি। ওর সাথে একটু কথা বলি। কিন্তু তা আর হয় না। ততক্ষণে বউ তার কাজ সেরে চলে আসে। আমরা ঘুমোতে যাই। মাথার উপরে তখনো পূর্ণিমার ভরা চাঁদ আকাশে জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। হেলেন বসে আছে একা একা তার ছোট্ট ঘরের সামনে। তার ঘরের ভেতর ততক্ষণে তার স্বামী জামাল নাক ডাকতে শুরু করেছে। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় আমরা পরস্পরের নিঃশ্বাসের আওয়াজটুকু শুনতে পাই। আমার জন্যে এইটুকুই যা সান্ত্বনা।

এক বন্ধের দিনে বাইরে ঘোরাঘুরি করে দুপুরের দিকটায় বাসায় ফিরে দেখি একটা হুলুস্থুল অবস্থা। আমার স্ত্রী মালতীলতা জানায়, জামাল ভাই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় পথে দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েছে। হেলেন আপা খুব কান্নাকাটি করছে। তাকে নিয়ে যাওয়ার মত কেউ নেই। আমার খুব ইচ্ছে করছিল বলি, আমি নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু মালতীলতার  ভয়ে এমন কথা মুখে আনতে পারলাম না। ইচ্ছে করছিল হেলেন-এর সাথে গিয়ে কথা বলি। কিন্তু কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তার সাথে কখনো কথা হয়নি। এমন দুর্বিপাকে কি কথা বলা যায় তা আমাকে কখনো শেখানো হয়নি। আসলে পৃথিবীতে আমাদের অনেক কিছু শেখানো হয় না। পৃথিবী হচ্ছে একটা অসমাপ্ত পাঠশালা।

মালতীলতাই সমস্যাটার একটা সমাধান করে দেয়। সে-ই একটা সমাধান খুঁজে বের করে। সে এসে আমাকে অনুরোধ করে, হেলেন কি নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্যে। আমি যেন আর রাজি না হয়ে পারি না। আমার মন এটাই চাইছিল। আমরা অল্প সময়ের মধ্যে রওয়ানা হয়ে যাই। রিক্সায় পাশাপাশি বসার মধ্যে দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। পথে যেতে যেতে তেমন কোন কথা হয় না আমাদের মধ্যে। কেবল দরকারী কথাটুকু ছাড়া। সে কথাও হয় কোন প্রকার সম্বোধন ছাড়াই। আসলে আমাদের মধ্যে কিভাবে যে কথা শুরু হয়েছিল তা আর এখন আমার মনে নেই। সে নাকি আমি শুরু করেছিলাম তাও বলতে পারব না। পুরো ব্যাপারটা ঘটেছিল ঘোরের মধ্যে। আমার এই জীবনে সেই প্রথম কোন তাৎপর্যপূর্ণ ভ্রমণ করেছিলাম। জীবনের আর সব ভ্রমণই আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছিল সেদিন।

জামাল ভাইকে যে হাসপাতালে রাখা হয়েছিল সেখানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত হয়ে যায়। তখনো তার জ্ঞান ফেরেনি। হেলেন তার মাথার কাছে বিছানার উপর বসে রইল। তার দুচোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই আপাতঃ করুণ দৃশ্য দেখছিলাম। আমার কাঁদা উচিত কিনা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বারান্দায় আসলাম। বাহিরে তখন ভরা জ্যোৎস্না। পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল চাঁদ আকাশের বুকে ভাসছিল। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল উড়তে। মানুষ উড়তে পারলে খুব ভালো হতো।

রাত গভীর হতে থাকে। কেন জানি আমার ভেতরের ক্ষুধা আর তৃষ্ণার ভাবটা উদাও হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে অন্য রকম একটা বিষণœতা বুকের ভেতর চেপে বসেছে। আমি আসলে স্থিরও নই, আবার অস্থিরও যে তাও বলা যাবে না। আমি আসলে জীবন ও জগতের মাঝখানে যে সরু সুতার সীমারেখা তার উপর দোদুল্যমান একটি ক্রমহ্রাসমান প্রাস্তিক বিন্দু যা শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে হেলেন এসে আমার পাশে  দাঁড়াল। আমি কেন জানি চমকালাম না। এই প্রথম হেলেন আমাকে উদ্দেশ্য করে স্পষ্ট করে কিছু বলল। স্পষ্ট উচ্চারণেই সে বলল, কিছু খাবেন? আপনার নিশ্চয়ই ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে।
আমি বললাম, তুমি কি খাবে? আমি নিয়ে আসছি।
- তেমন কিছু না। তারপরও একটা কিছু তো খেতে হবে। সারা রাত জেগে থাকতে হবে। এখানে ঘুমানোর কোন ব্যবস্থা নেই। আপনার ভাইয়ের হুঁশ কখন ফেরবে ডাক্তারও বলতে পারছে না।
- আমি যাচ্ছি। দেখি কি পাওয়া যায়।

হাসপাতাল থেকে বাইরে বের হয়ে এলাম। এখানে কি পাওয়া যাবে আমি নিজেও জানি না। অনেক ঘোরাঘুরি করে পাউরুটি ও কলার একটার দোকান পেলাম। ওখান থেকে রাত এবং ভোরের খাওয়ার উপযোগী কিছু খাবার কিনলাম। জীবনের প্রথম আয়োজন এত অনাড়ম্বর হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। ইচ্ছে ছিল একদিন হেলেনকে নিয়ে চাইনিজ খাব। তার বদলে শুকনো পাউরুটি আর কলা। বিধাতার ইচ্ছার সীমারেখা বোঝা মানুষের কর্ম নয়। আমার মত কন্ডাক্টর তো তেলাপোকার চেয়ে তুচ্ছ।

ধবল জ্যোৎস্নার নিচে ভীষণ বিষণœ একটা রাত মহাকালের কাছে অতি তুচ্ছ হলেও আমি আমার ভেতরে একটা ঐশ্বরিক যাতনা অনুভব করেছিলাম। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল যদি এ রাত প্রলম্ববিত হয় তাহলে আমাকে মৃত্যুর মতই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত বেছে নিতে হবে। আমি আসলে উজ্জ্বল আলো চাই। এই অস্থির রাত্রির পর দিবসের সেই প্রথম আলোতে আমরা দুজন খালি পায়ে শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে যাব। তাহলে জামাল ভাইকে হয়তো মরে যেতে হবে। কিন্তু আমি তো তার মৃত্যু চাই না। বেচারা ভালো মানুষ। সে বেঁচে থাকুক।

কোন রাত্রিই স্থায়ী হয় না। যেমন স্থায়ী হয় না দিনের আলো। ভোর রাতে জামাল ভাইয়ের হুঁশ ফেরে। হেলেন বারান্দায় এসে আমাকে খবরটা দিয়ে ভিতরে চলে যায়। আমি আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়াই। জামাল ভাই ভীষণ অবাক হয় আমাকে দেখে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তার দুচোখে জলের শতদ্রু। আমি সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলি। সেই বিষণœ রাতের শেষ প্রহরে একজন সস্তা কন্ডাক্টরের কান্নার জলে হাসপাতালের পবিত্র মেঝের ঈষৎ পাষাণ কয়েকটি শুষ্ক পাথরকণা খানিকটা ভিজে ওঠে।

ভোরের আলো ফুটতেই আমি রওয়ানা হওয়ার জন্য তৈরি হই। তৈরি হওয়া বলতে তেমন কিছু নয়। কিছু মানসিক আয়োজন। আমার আসলে চলে যাওয়া উচিত। হেলেনের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। নিয়তির হাতে সমর্পিত দুটো মানুষকে পেছনে ফেলে আসতে আসতে মনে হয়, পৃথিবীটা আসলে এমনই। কেউ কারো দুঃখের ভার খুব বেশিক্ষণ নিতে পারে না। আমিও পারছি না । কারণ আমি এর বাইরের কেউ নই। অবশ্য জামাল ভাইয়ের আপন জনেরা ততক্ষণে তার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে গেছে। তারাও ইতোমধ্যে রওয়ানা হয়েছে।
ঢাকায় ফিরেও নিজের শরীরটাকে কেমন যেন হাল্কা হাল্কা লাগছিল। কি যেন নেই। কেমন একটা ওজনহীন অনুভূতি। বুঝতে পারছিলাম না সমস্যাটা কোথায়। ভালোবাসায় আমার কোন বিশ্বাস নেই। আমি বিশ্বাস করি সময় এবং বাস্তবতায়। নির্ভর করি প্রয়োজনের উপর। পূরণ করি চাহিদা। স্বপ্ন দেখি ভেসে বেড়ানোর। আমি আসলে উড়তে চাই। খানিকটা স্বার্থপরের মত আমি। আসলে আমার সততাই আমার স্বার্থপরতা। আমার প্রত্যাশা বলেও তেমন কিছু নেই। যতটুকু পারি হাত বাড়িয়ে দেই। না পারলে সরে আসি। লোভ বলতে যা বুঝায় নিজের ভেতরে তেমন কিছু একটা অনুভব করিনি কখনো। না পাওয়ার কষ্ট আমাকে অত বেশি ছোঁয় না।

জামাল ভাই সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। হেলেনও তার আগের জীবনে ফিরে যায়। পঙ্গু জামাল ভাইয়ের হাত ধরে গার্মেন্টসে নিয়ে যায়। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। আমার ভীষণ ভালো লাগে। নিজের কষ্টগুলোকে আরও তুচ্ছ মনে হয়। আনমনে হেসে উঠি। পৃথিবী একটা আজব জায়গা। এখানে কি না ঘটে।
একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করে হেলেন আমার বারান্দায় আসে। আমি সিগারেট টানছিলাম। তাকে দেখে লুকিয়ে ফেলি। সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, একটু বসতে পারি।
- আরে বসো। কি যে বল। বসার জন্য কি অনুমতি লাগে। জামাল ভাই কই?
- বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেছে। একা একা ভালো লাগছিল না। আপনার সাথে সাথে একটু গল্প করতে এলাম।
- গল্পের শুরুতে তোমাকে একটা কথা বলি। আমি তোমাকে পছন্দ করি। আমার সাথে বেশি গল্প করা নিরাপদ নয়।
- আমি জানি।
- কেমন করে?
- মেয়েরা অনেক কিছু জানে?
- তাইতো দেখছি।
- মেয়েরা এত কিছু জানে আমি জানতাম না। জানলে পছন্দ করতাম না ধরা  খেয়ে যাওয়ার ভয়ে।
- ভয় নেই। তবে আশার কিছুও নেই। আমি আপনাকে নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখি না। পছন্দ তো কর।
- জানি না। এই যে পানি দেখছেন (সে জগের দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়) এর মুলে দুটো উপাদান-একটা হলো অক্সিজেন, অন্যটা হলো হাইড্রোজেন। এরা মিলেই পানি। তবে মিলনের শর্ত আছে। উপযুক্ত তাপ এবং উপযুক্ত চাপ আর যথাযথ পরিবেশ হতে হবে। তবেই সৃষ্টি হবে পানির। বিজ্ঞানের ভাষায় পানিকে লেখা হয় এইচ টু ও। এপাশে এইচ, ওপাশে ও। মাঝখানে টু। সেই এইচ হলাম আমি। আপনি হলেন ও। আমরা দুজন হলে ভালো হতো। কিন্তু মাঝখানে টু আছে। এই টু হলো আমাদের দুজনের দুজন। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন।
- বুঝতে পেরেছি।
- আমি তাহলে আসি।
- আবার এসো।
তারপর দিন যায়, রাত আসে। পৃথিবীর নিয়মে অমাবস্যা আসে, তারপর আবার পূর্ণিমা। সব কিছু এগিয়ে চলে যার যার নিজস্ব নিয়মে। আমার মাথার ভেতরে শুধু ঘুরপাক খায় প্রেম এবং পানির সেই গল্প। আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে শুরু করি ধীরে ধীরে। প্রেম তাহলে একটা বিশ্বাসের বস্তু।

তখন বর্ষাকাল সবে শুরু। হঠাৎ হঠাৎ করে বৃষ্টি নামছে। একদিন হঠাৎ করে ভীষণ বৃষ্টি নামল। আমি কেন জানি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলাম। হাঠাৎ দেখি হেলেন আসছে। আমার মনে পড়ে গেলো প্রেম এবং পানির সেই গল্প। রাস্তার পাশ থেকে একটা সবুজ পাতা ছিঁড়ে এনে দুহাতে মেলে ধরলাম। আকাশ থেকে ঝড়ে পড়া বৃষ্টির পানিতে মুহূর্তের মধ্যে পাতার বুকটা ভরে গেলো। ততক্ষণে হেলেন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। ছাতা না থাকায় সে-ও ভিজে একাকার। আমি আমার দুহাতে ধরা কচুর পাতার বুকে জমানো টলটলে জল তার দিকে এগিয়ে দিলাম। হেলেনের ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠল ।

বৃষ্টিস্নাত হরিণেরা

বর্ষার কোন এক সকালে হঠাৎ করেই আমার মন খুব উতলা হয় চিড়িয়াখানায় যাওয়ার জন্যে। আমি কোন বিখ্যাত পশু প্রেমিক নই। তবুও কেন জানি মাঝে মাঝে ভালো লাগে ঐ জায়গাটায় যেতে। যদিও ওখানেরও সবকিছু কৃত্রিম তবুও নগরের কোলাহল পেরিয়ে খাঁচায় বন্দি প্রাণীদের সাথে খানিকটা সময় কাটাতে কিছুটা হলেও ভালো লাগে। আর তাই মাঝে মাঝে অকারণে চলে যাই নগরীর উপকণ্ঠের এই মনুষ্য সৃষ্ট প্রাণীরাজ্যে। সেদিনের যাওয়ার পেছনেও তাই গতানুগতিক কারণই দায়ী। ভালোলাগা-মন্দ লাগার চাইতেও একটু স্বস্থিই যেন বেশি কাম্য।
সেদিন আকাশে খুব একটা মেঘ ছিল এমনটা বলা যায় না। সময়টা বর্ষাকাল হলেও আকাশ বেশ পরিচ্ছন্নই ছিল বলতে হবে। তবে সামান্য বাতাস বইছিল। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাবও ছিল সেই আবহাওয়ায়। সামান্য শীতল বাতাসে বৃক্ষের পত্ররাজি তির তির করে কাঁপছিল। সমস্ত কিছুর পরও আমি কিছুটা অস্থির এবং খানিকটা উষ্ণ ছিলাম। কারণ আর কিছুই নয়। আমি একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি। আর সেই কথা তাকে বলার কোন সুযোগ ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই আমার ভেতরটা তাই অস্থির ছিল। আমি যারপরনাই চেষ্টা করছিলাম স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে। কিন্তু তাতে তেমন কোন লাভই হচ্ছিল না। বরং মনে হচ্ছিল আমি কোনো ধোঁয়ায় ভরা কারখানার অনভ্যস্ত শ্রমিক, ধোঁয়ায় যার দম বন্ধ হয়ে আসছে। অথচ আবহাওয়া ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। বেশ নির্মল আর পরিচ্ছন্ন। কিন্তু মানুষের ভেতরটাই হলো আসল। বাইরের পৃথিবী তাকে খুব একটা স্পর্শ করে না।
চিড়িয়াখানায় ঢুকেই আমি কোন বিশেষ খাঁচার কাছে না দাঁড়িয়ে সরাসরি হেঁটে পিছনের দিকটায় চলে গেলাম। আমার ধারণা ওদিকটা খানিকটা নিরবই হবে অন্ততঃ সদর দরোজার আশেপাশের এলাকার চাইতে। মূলতঃ সদর দরোজা আর তার কাছাকাছি এলাকাটা যেন একটা মেলার মতই। লোকে থৈ থৈ করছে।
হাঁটতে ভালোই লাগছিল। সবকিছুই মোটামুটি পরিচিত। যেতে যেতে আলতো করে চোখ বুলিয়ে যা কিছু দেখলাম তাতে নতুন কিছু চোখে পড়ল বলে মনে হলো না। কয়েকটা নতুন প্রাণীর সংযোজন আর কিছুদিন আগে মারা যাওয়া জিরাফটার মমি করা মৃতদেহ দাঁড়িয়ে আছে অর্থহীন। পরিবর্তনের মধ্যে এটুকুই যা। দেখতে দেখতে ছোট চিড়িয়াখানাটার শেষ মাথায় পৌঁছে গেলাম। জায়গাটা আসলেই নির্জন। আমি আলগোছে ঘাসের উপর বসে পড়লাম।
নির্জনতার এই এক দোষ। সে আপনার ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে দেবে। শহরের কোলাহলে আপনার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা যে মানুষটার কণ্ঠস্বর তো দূরে থাকুক এমনকি চিৎকার চেঁচামেচিও আপনার কানে প্রবেশ করার সুযোগ থাকে না সে রাতারাতি আপনার উপর চেপে বসবে। আর তখনই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে আপনার ছোট্ট জীবনের অসমাপ্ত খেরো খাতা। যেখানে অজস্র না মেলানো হিসেবের পাশাপাশি বেশ কিছু সুখ দুঃখের কাটাকাটি খেলার ছক আপনাকে স্রেফ একটা বিমর্ষ পদ্ম-পাতার দিকেও কয়েক ঘণ্টা অপলক তাকিয়ে থাকতে সাহায্য করবে। আমারও তাই হলো। কল্পনায় জীবনের না মেলানো হিসেবের কাসুন্দি ঘেঁটে ঘেঁটে আমি অবলীলায় পার করে দিলাম কয়েক ঘণ্টা। মাঝখানে একবার সামান্য ক্ষুধা অনুভব করেছিলাম। কিন্তু নগর জীবনের ভুরি ভোজে অভ্যস্ত চর্বি জমানো পেটটাকে কেন জানি খানিকটা বিশ্রাম দেওয়া জরুরি মনে হলো সাময়িক সময়ের জন্য। এখানে বরং ভাবনার রাজ্যে হারানোই সুখ।
আকাশে তখনো মেঘের ছিটেফোটাও দেখা যায়নি। আলোকোজ্জ্বল পরিচ্ছন্ন আবহে ঈষৎ রৌদ্রের লুকোচুরিতে জায়গাটা আরও মনোহর হয়ে উঠেছিল। আমার ভালো লাগছিল বেশ। সামনের লেকে স্বচ্ছ পানিতে দুএকটা মাছ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে খেলা করছিল। আমি অর্থহীন হেসে উঠলাম। যে কেউ হাসতে পারে।
নির্জনতা উপভোগের এই ধারাবিহকতা ক্ষুণœ হলো যখন একদল ছেলেমেয়ে এসে আমার ঠিক খানিকটা দূরে বসে গল্প জুড়ে দিল। তারা এত বেশি বকবক করছিলো যে আমার ভাবনায় ছেদ পড়তে বাধ্য হলো। আমি তবুও কেন জানি বিরক্ত হলাম না। ওরা সংখ্যায় হয়ত পাঁচ-ছয় জন হবে। দুতিনটা মেয়ে। দুতিনটা ছেলে। ওরাও ভেঙে ভেঙে ওদের সুখ-দুঃখ ভাব ভালোবাসার কথা বলছিল। একটা মেয়েকে দেখলাম আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। সে দেখতে শুনতে মন্দ নয়। যে ছেলেগুলো এসেছিল তাদের বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী বলতে হবে। শুধুমাত্র একজন ছাড়া। সেই ছেলেটি বেশ খাটো আর রোগা পাতলা ছিলো। কিন্তু তাকে দারুণ চটপটে মনে হলো আমার। আর সে-ই ছিলো বিষণœ সুন্দরীটির সঙ্গী। আর সেই বিষণœ সুন্দরীটিই বারবার লুকিয়ে লুকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। আমি ব্যাপারটা খেয়াল করলেও অতটা গুরুত্ব না দেওয়ার ভান করলাম। আসলে সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলো।
তারা অনেকক্ষণ থাকল। বাদাম খেল, গল্প করল। রোগা পাতলা ছেলেটি তার কম দামী মোবাইলের দুর্বল ক্যামেরায় মেয়েটির ছবি তুলল। তাতে মেয়েটি খুব একটা খুশি হলো বলে মনে হলো না। ছেলেটি সেটা বুঝতে পেরে অবিলম্বেই একটা নতুন ক্যামেরা কেনার আশ্বাস দিলো। কিন্তু মেয়েটি তাতেও খুশি হলো বলে মনে হলো না। কারণ ছেলেটির অবয়ব দেখে মনে হলো তার আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। আর এরকম অনেক আশ্বাসই হয়তো বা মেয়েটিকে সে ইতিপূর্বে দিয়েছে।
হঠাৎ করেই তারা উঠে গেল। আমার ভালো লাগল না মন্দ লাগল ঠিক বলতে পারব না। তবে কেমন যেন লাগল। উঠে যাওয়ার সময় বিষণœ সুন্দরীটি বারবার ফিরে ফিরে তাকালো। তার মেদহীন পাতলা শরীর যেন বাতাসে দোল খাওয়া একটি জানালার সাদা পর্দার মত আমার চোখের সামনে দুলতে লাগল। আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হলাম। তার চোখ যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল।
আমি আরও কিছুক্ষণ অর্থহীন বসে রইলাম। হয়তো বা অর্থহীন ভালোলাগার ছোট দিঘিতে নিরব অবগাহন কিংবা বিস্তৃত চিন্তার না গোটানো জালের ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে খুঁজে নিয়ে আবারও নাগরিক জীবনের উপযুক্ত হয়ে ওঠা। এ ধরনের জায়গাগুলো আসলেই একজনকে এলোমেলো করে দেয়। নিজেকে মনে হয় পার্টসগুলো খুলে আলাদা হয়ে যাওয়া রোবটের মতই। জীবনের পথে চলতে হলে আবারও নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে।
হঠাৎ করে কেন জানি আর বসতে ইচ্ছে করল না। জায়গাটার কোন আকর্ষণই আর আমার চোখ দুটোকে ধরে রাখতে সক্ষম হলো না। আমি উঠে পড়লাম। শরীরটা বিশেষ করে পা দুটো কেন জানি ভারী হয়ে এসেছিল। হয়তো বা হঠাৎ করে পেয়ে বসা অলসতা। যা হোক কোন কিছু না ভেবেই তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। চিড়িয়াখানার প্রাণীদের সাথে একটু সময় কাটাবো। জলহস্তিটিকে দেখলাম পানির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে ঘাপটি মেরে আছে, শুধু নাকের ফুটো দুটো দেখা যাচ্ছে।
আকাশের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হলাম, কখন যে একটু একটু করে মেঘ জমতে শুরু করেছে টেরই পাইনি। কিন্তু তাই বলে নিজের ভেতর কোন তাড়া অনুভব করলাম না। আসলে আজ সত্যিই আমার অলস দিন। হাতে কোন কাজ রাখিনি ইচ্ছে করেই। বৃষ্টি হয়, হোক। ভিজতে না পারলেও দেখতে পারব। আমি আবার বৃষ্টির পানি গায়ে লাগাতে পারি না। জ্বর আসে। অদ্ভুত সমস্যা।
দেখতে দেখতে বর্ষা শুরু হলো। প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি। তারপর আস্তে আস্তে ঘন আকারে। ততক্ষণে আমি হরিণের বড় খোয়াড়টার কাছে এসে পৌঁছেছি। বৃষ্টি বেশ জোরেই নামল। মুষলধারে বলা যায়। কেন জানি কোথাও গিয়ে কোন ছাউনির নিচে দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না। হরিণগুলোও আমার সাথে ভিজছে। হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখলাম শুধু আমি একা নই। আমার সাথে আর একজন ভিজছে। সে আর কেউ নয় সেই ফিনফিনে বিষণœ সুন্দরী।



ভালোবাসার সংলাপ

শান্তুনু- গতরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে ছাদে চলে গিয়েছিলম। বাহ্! কি চমৎকার। তখন আকাশে চাঁদ ছিল। মৃদুমন্দ বাতাস ছিল। পেঁজা তুলোর মত ক্ষয়ে ক্ষয়ে পরছিল জ্যোৎস্না আকাশের গা থেকে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত বসেছিলাম। উহ্! তখন যদি তুমি পাশে থাকতে! সত্যিই আমি তোমাকে ভীষণ উপলদ্ধি করছিলাম।
সংগীতা-    আর আমি তখন বিছানায় ছটফট করছিলাম এক অতৃপ্ত কামনার উত্তাপে।
শান্তুনু - তাহলে তো ভারী অন্যায় হয়ে গেছে।
সংগীতা- উহ্! ওটা ছিল একটা স্বপ্ন।
শান্তুনু- যাক্! সেও ভালো।
সংগীতা- তবে সত্যিকারের স্বপ্ন নয়, দিবাস্বপ্ন।
শান্তুনু- সে আবার কেমন?
সংগীতা- তাও বুঝলে না। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা সাহেব। এবার বুঝেছ। আমি তোমার কথা কল্পনা করছিলাম গভীরভাবে। তুমি কাছে থাকলে তো আর তোমাকে কল্পনা করা যায় না। কল্পনার প্রথম শর্ত হচ্ছে দূরত্ব। সে দূরত্ব শুধু ভূগোলের নয়, সময়েরও। আসলে কল্পনার সুখই আলাদা। তাই না?
শান্তনু- ঠিক বলেছ।
সংগীতা- শুধু কি তাই? বললে না দার্শনিকের মত কথা বলেছি।
শান্তনু- আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সংগীতা- এ তো বহু পুরনো সংলাপ।
শান্তনু- হোক না পুরনো তবু তা শাশ্বত, সুন্দর।
সংগীতা- নতুন কিছু বল, অন্য কিছু।
শান্তনু- তোমার কি মনে পড়ে প্রথম যেদিন আমি তোমাকে দেখেছিলাম সেদিনের কথা।
সংগীতা- উহ্! মনে পড়ে না।
শান্তনু-    তুমি বসেছিলে একটা খাটের উপর হেলান দিয়ে। তোমার হাতে একটা বই। পাশেই গ্রামোফোনে বাজছিল সতীনাথের- ‘তোমারে ভুলিতে ওগো বলো না, বলো না মোরে...।’ আমি গিয়েছিলাম তোমার বাবার সাথে দেখা করতে। বসলাম খাটের উপরেই ঠিক তোমার পায়ের কাছাকাছি জায়গাটায়। তুমি মাত্র একবার মুখ তুলে তাকালে। তারপর আবার তোমার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে সেই বইয়ে। আমার মনে হল এই বই আমার চেয়ে অনেক সুন্দর, রহস্যময় আর আকর্ষণীয়। মজার তো বটেই। আমার ভীষণ বই হতে ইচ্ছে করছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম চলে আসার মুহূর্তের জন্যে। তখন আর তুমি একবারের জন্যেও না তাকিয়ে পারবে না। আমি যতটুকু অনুভব করেছিলাম তুমি তাকাওনি তবে আজও জানতে ইচ্ছে করে তুমি কি শেষ বারের মত একবারের জন্যেও আমার চলে আসা দেখেছিলে। নাকি অনুভবই করনি যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ এই মাত্র উঠে গেল। শুনেছি সুন্দরীদের অনুভূতি নাকি খুব ভোঁতা হয়। আমারও অনেকটা তাই মনে হয়েছিল। তবে কিছু একটা রহস্যের গন্ধ আমি পেয়েছিলাম যা আমাকে পুলকিত করেছিল।
সংগীতা - তোমার অভিযোগের সত্যতা কতটুকু জানি না। তবে রহস্যের গন্ধ কিন্তু আমিও পেয়েছিলাম।
শান্তুনু - কি সেই রহস্য?
সংগীতা- জানি না। জানলে কি তা রহস্য হতো।
শান্তুনু - সে তো তখনকার কথা। এখন নিশ্চয়ই জান?
সংগীতা- উহ্! এ রহস্য সারা জীবনের, সমগ্র সময়ের। তুমি আর আমি শুধু তার বাহনমাত্র।
শান্তুনু - তুমি খুব চমৎকার কথা বল।
সংগীতা- তুমিও কি খুব কম?
শান্তুনু - তোমার মিথ্যে বলার  অভ্যেসটা এখনো গেল না। আসলে সত্যি করে বলো তো অতীতের কথা তোমার মনে নেই। মনে নেই একদিন দুপুরবেলা তুমি গোসল করতে পুকুরে চলে এসেছিলে। সম্ভবতঃ তোমাদের বাসায় পানি ছিল না। তখন প্রচণ্ড গরমের সময়। আমি দুপুরে খেয়ে শীতল হতে বাগানের দিকটায় চলে এসেছিলাম। ঠিক এমন সময় তোমাকে দেখতে পাই। তুমি সপসপে ভিজে শরীরে দাঁড়িয়ে ছিলে পুকুরের পাড়ে। তোমার হাতে সুন্দর একটা গোলাপী তোয়ালে। সেই তোয়ালে দিয়ে তুমি তোমার বুক চেপে ধরেছিলে। ফোঁটা ফোঁটা মুক্তো বিন্দুর মত জল ঝরছিল তোমার শরীর বেয়ে। সেদিকে তোমার খেয়াল নেই। তুমি একদৃষ্টে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল। আমি ইতস্ততঃ করছিলাম। আচ্ছা, তুমিই বল, অমন সুন্দর একটা মেয়ে যদি হাঁ করে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে তোমার অস্বস্তি লাগবে না? ওহ্! তুমি কেমন করে বলবে। তুমিও তো একটা মেয়ে। একটু পর হঠাৎ তুমি নড়ে চড়ে উঠলে। মনে হল যেন প্রতিমার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হল এই মাত্র। তুমি তোমার শুকনো কাপড় চোপড় হাতে নিয়ে চলে গেলে। কাপড় পাল্টালে না কেন জানি। হয়ত আমি তখন নির্লজ্জের মত তাকিয়ে ছিলাম বলে। সত্যি বলতে কি তোমাকে দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। আসলে সুন্দরী রমণীদের সিক্ত রূপ যে এতটা স্বর্গীয় হয় জানতাম না। জানলাম সেদিন তোমাকে দেখে। দেবী দর্শনের পুণ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করছিল না। তোমার কি এসবের কিছু মনে নেই। একদম কিছু মনে নেই? আসলে তোমার কিছুই মনে থাকে না।
সংগীতা- সব মনে আছে, সব। আমার যে মনে আছে সে কথা  আমি এ পর্যন্ত কম করে হলেও হাজার বার বলেছি। আর তুমিও এ পর্যন্ত বহুবার আমাকে এ কাহিনী শুনিয়েছ। কিন্তু তোমারই মনে নেই। প্রচণ্ড আবেগের সময় তুমি এ কাহিনীটা শুনিয়ে ভীষণ তৃপ্তি পাও। আমারও শুনতে ভালো লাগে। তুমি চমৎকার ভাবে গুছিয়ে বল। মনে হয় এই মাত্র ঘটে যাওযা ঘটনা এবং এর আগে তো আমি শুনিইনি বরং এখনো না শুনলে এমন একটা মজার কাহিনী থেকে বঞ্চিত হতাম। তাই শুনতে ভালো লাগে। মনে থাকা সত্ত্বেও বলি, মনে নেই। একদম মনে নেই। আর তখনই তুমি বলতে শুরু কর। কি দারুন তাই না? হাজার বার শোনার পরেও আমার তৃপ্তি হয় না। কোনদিন হবেও না।
শান্তুনু- ঠিকই বলেছ সংগীতা।
সংগীতা- চা খাবে! চা করে নিয়ে আসি।
শান্তুনু- হলে মন্দ হতো না। অতীতের উষ্ণ সব স্মৃতির সাথে গরম চা। কিন্তু তোমাকে আবার শুধু শুধু কষ্ট দেওয়া।
সংগীতা- কষ্ট কিসের? তুমি আমার সব কিছুতেই কষ্ট মনে কর। অথচ নিজে যে কত কষ্ট কর আমার জন্যে তা কি মনে থাকে? আসলে ইচ্ছে করে তোমাকে হাজার কাপ চা বানিয়ে খাওয়াই। তুমি এত আরাম করে চা খাও যে দেখে ভীষণ ভালো লাগে। বানানোর কষ্টের কথা মনেই থাকে না।
শান্তুনু- নতুন করে কারো সাথে পরিচয় হয়েছে নাকি?
সংগীতা- আবার কার সাথে পরিচয় হবে?
শান্তুনু- তাহলে আমাকে মারার পরিকল্পনা করছ যে?
সংগীতা- আমি! তোমাকে ? কই?
শান্তুনু- ভয় পেয়ো না। ঐ যে হাজার কাপ চা খাওয়ার কথা বললে। এক সাথে হাজার কাপ চা খেলে আমি মরেই যাব।
সংগীতা- ওহ্! তাই? বাবা! তুমি এভাবে বলছিলে যে আমি একেবারে থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। ওভাবে বললে কে না চমকে যায়? তুমি মাঝে মাঝে হঠাৎ এমন মুডে কথা বলো যে রসিকতাগুলো মনে হয় রাগী পুলিশ অফিসারের সংলাপ। যা সে সাধারণত খুনী আসামীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন।
শান্তুনু- তাহলে বোঝাই যাচ্ছে পুলিশ হলেই ভালো করতাম।
সংগীতা- ভালোইতো করেছ। তোমার মন চোরকে আসামী বানিয়ে সারা জীবনের জন্যে হৃদয়ের কারাগারে বন্দি করে রেখেছো। ক’জন পুলিশ এমন পারে। সব আসামীরাই তো আজকাল খালাস হয়ে যায়।










Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে

NAZRUL ISLAM MAZUMDER : THE CHOICE OF THE TIME (a biography)

NAZRUL ISLAM MAZUMDER The choice of the time “The purpose of a business is to create a customer who creates customers.” -          Shiv Shing # NASSA GROUP # 30,000 employees #EXIM Bank # 3,000 employees And so on……….. A Biography By OMAR KHALED RUMI M. Sc., MBA, LL.B     ...................................................... “Patience, persistence and perspiration make an unbeatable combination for success.”    - Napoleon Hill   ...................................................... Prlogue Like another man Nazrul Islam Mazunder is also a man. But, how he has made some stories of success. Why people consider him as a special. Why he is applaused as Philanthropic in mind, dynamic in thinking, far-sighted in vision. There must some reasons. The reason is what he wanted himself he has been now. Mazumder, a conglomerate icon, in no way, a trifle name. His success, over years, mak