Skip to main content

Setara bibi under the lamp post - Literature - observerbd.com

Setara bibi under the lamp post - Literature - observerbd.com : The glittering city aroundLife is rich with red, blue light of neonWide sky over the headPieces of moonlight, scatteredAnd in that splashed pieces of meteorThose are taken by the scientists of NASASo height the civilization reachesThis city is the flow of happiness nowSome men like us pass the wayWith frustration

আমার অমৃত সত্তা


প্রথম পর্ব ঃ আমার অমৃত সত্তা


ছোট ছেলেটি ঘুমের ঘোরে হঠাৎ কেঁদে উঠেছে। একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে পুরোপুরি উঠে গেল। তার চোখের কোণে এখনো পানি। আমি তাকে উঠে বসতে সাহায্য করলাম। সে উঠে বসল। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলাম। সে ইশরায় জানিয়ে দিল পানি খাবে না। আমি তার পানে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ওকে এখনো ভীষণ অসহায় লাগছে। স্বাভাবিক হতে ওর হয়ত খানিকটা সময় লাগছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-স্বপ্ন দেখেছ? সে ভাবলেশহীন মুখে উত্তর দিল-হ্যাঁ। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম না সে কি স্বপ্নে দেখেছে। কিন্তু তার নিরুত্তাপ মুখ দেখে তবু কেন জানি মনে হলো সে হয়ত তার স্বপ্নের ঘটনাটা বলতে আগ্রহী। আমি একটু থেমে কি জানি ভেবে তার স্বপ্নের কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। সে আমাকে বলল-স্বপ্নের কথা নাকি রাতে বলতে নেই। মা বলেছে।

তোমার মা কখন তোমাকে এ কথা বলেছেন। তুমি যা কিছু জানো তার সবটাই দেখছি তোমার মায়ের শেখানো। আমার তো মনে হয় তুমি তোমার মায়ের পেট থেকেই এত কথা শিখে বেরিয়েছ।

সে নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিল-হতে পারে। তার এই জবাবের ভঙ্গিটা আমার কাছে একটা অভিজ্ঞ লোকের মতোই মনে হলো। যদিও তার বেশির ভাগ আচরণই ছেলেমানুষের মতোই।

আমি তাকে বললাম, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আমি আরো কিছুক্ষণ লিখব। সে আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে এরপর আর ঘুম আসবে না। সে এখন জেগে জেগে আমার লেখালেখি দেখবে। কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি কিছুক্ষণ পরই সে ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে জানতে চাইবে সে কতক্ষণ জেগে ছিল। রাতে কি কি লিখেছি। তার মায়ের সম্পর্কে কিছু লিখেছি কিনা। লিখলে কি লিখেছি, কেন এমনটা লিখলাম। সব কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত তার সন্তুষ্টি নেই।

আমার ছোট ছেলের নাম মুরাদ। সে অত্যন্ত মেধাবী। তাকে জন্ম দিতে গিয়েই বলতে গেলে আমার স্ত্রী এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। মুরাদের জন্মের আগ পর্যন্ত বলতে গেলে সে সুস্থই ছিল। কিন্তু ওর জন্মের সময়ে কি সব ঝামেলা হলো। সে যাত্রা কোন মতে বেঁচে গেলেও আর সুস্থ হয়ে বিছানা ছাড়তে পারলো না। দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সে চলে গেল। পাঁচ বছর আগের কথা। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিল মুরাদ। তার তখন মাত্র সাত বছর।

বড় ছেলে দারা। সে এখন হার্ভার্ডে ল’ পড়ছে। এই কলেজেই আইন পড়াতেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বারাক ওবামা। ছেলে আমার পড়াশুনায় অত্যন্ত মনোযোগী। সরকারি ও বেসরকারি অনেক বৃত্তি পেয়েছে। প্রায়ই ফোনে কথা বলে। আমিও বলি মাঝে মাঝে। মায়ের কথা বলতেই কথা হারিয়ে যায়, কেঁদে ওঠে। আটলান্টিকের ওপারে বসে ক্রদনরত      সন্তানের তপ্ত নিঃশ্বাস যেন আমার পোড় খাওয়া গালে এসে লাগে। আমিও আর কথা বলতে পারি না। ফোন এমনিতেই শেষ হয়ে যায়।

মেঝ ছেলে সুজা। সে আছে জাপানে। মোবাইল প্রযুক্তির উপর উচ্চতর পড়াশুনার জন্য এবছরই জাপান সরকারের একটা বৃত্তি নিয়ে টোকিওর একটা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছে। সে খুবই স্বল্পভাষী। তবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তাকে খুব সমঝদারও বলতে হবে। একদিনের একটা গল্প বলি। আমি একটা অপরিচিত মহিলার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। মহিলা ভীষণ সুন্দরী না হলেও বেশ ছিমছাম। যে কারো দৃষ্টি কাড়ার জন্য তা যথেষ্ট বটে। সে ব্যাপরটা লক্ষ্য করল। মৃদু হেসে বললো-বাবা, ওনার সাথে মায়ের অনেক মিল আছে। আমি তার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম। চোখ নামিয়ে নিলাম। আমার রেবেকা অনেকটা এরকমই ছিল। তবু আমি আর তাকালাম না। ছেলেরা চায় আমি আবার বিয়ে করি। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। আমি রেবেকাকে ভালোবাসি।
স্ত্রীকে আমি প্রায়ই বলতাম-তুলনা যদি করো তো আমাকে মোগল বাদশাহদের সাথেই করো। নিজেকে আমার মোগল বাদশাহ ভাবতেই ভালো লাগে। রেবেকা এই কথা শুনে খুব হাসত। সে ইতিহাসের ছাত্রী ছিল। তাই মজা পেত। আমার সাথে মজা করতে করতে নাকি ভালোবেসেই ছেলেদের নাম মোগল শাহজাদাদের নামে রেখেছিল বলতে পারব না। তবে ব্যাপারটা আমার কাছেও যেহেতু মন্দ লাগেনি তাই আপত্তি তোলার তো প্রশ্নই আসে না।


ভোরে ঘুম ভাঙতেই আমি মুরাদকে ডাকলাম। সে কাছে আসতেই বললাম-বসো, নাস্তা খাবে। সে আমাকে জানিয়ে দিল-আজ তার খুব মন খারাপ। তাই নাস্তা খাবে না। আমি খানিকটা অবাক হলাম। তার মন খারাপের কারণ জানতে চাইলেই সে স্পষ্ট জানিয়ে দিল-গত রাতে সে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। আমি তার কাছে তার স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলাম। সে বলল-শুনলে তোমার মন খারপ হবে। এমন কি রাগও করতে পারো। আমি তাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে  জানিয়ে দিলাম-আমার মনও খারাপ হবে না, রাগও করব না। তুমি বলো। সে বললো-সে স্বপ্ন দেখেছে যে তার মা তাকে বলছে-‘মুরাদ, তুমি কি জানো, তোমার বাবা আর একটা বিয়ে করতে যাচ্ছে। এবং এই মহিলা তোমার মায়ের জায়গা দখল করার পায়তারা করছে।’

আমি ছেলের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। সে কেমন করে এমন একটা বিষয় স্বপ্নে টের পেল। আমার ইচ্ছের কথা তার জানার কথা নয়। তবুও কৌতুহলী হয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-তোমার মা কি তোমাকে অন্য কিছুও বলেছে? সে বলল-হ্যাঁ, বলেছে। আমি বললাম-কি বলেছে?
সে বলল-মা বলেছেন, এই মহিলা তোমাকে অনেক আদর করবে। তোমাকে নিজের ছেলে বানাতে চাইবে। কিন্তু তুমি তা হবে না। তুমি আমার ছেলে। এই কথা তুমি সব সময় মনে রেখো।


আমি মুরাদকে কি বলবো বুঝতে পারলাম না। তবে তাকে আর নাস্তা খেতে ডাকতে পারলাম না। সে নিজেই এসে আমাকে বললো-বাবা, আসো। দুজন মিলে নাস্তা খাই। আমি হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেয়ালে রেবেকার ছবিটা এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

মুরাদের স্বপ্ন মিথ্যে নয়। সুজাকে যে মেয়েটি পড়াতো সে কখন যে আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল তা সে নিজেও টের পায়নি। যখন টের পেয়েছে তখন নাকি অনেক দূর চলে এসেছে। যেখান থেকে তার আর ফেরা সম্ভব নয়। তার দুর্বলতার কারণ যতটা না আমি তার চেয়ে হাজার গুণ মুরাদ। মুরাদকে সে ভীষণ ভালোবাসে। মুরাদও যে তাকে কম ভালোবাসে তা নয়। কিন্তু কখনই মায়ের জায়গায় সে কাউকে ভাবতে পারে না। মুরাদ বিশ্বাস করে তার মা-ই হলো জগতের একমাত্র মহিলা যাকে সে মা বলে ডাকতে পারে। অন্য কাউকেই নয়। হাজার আদর দিলেও সুজাতা কখনো মুরাদের মুখে মা ডাক শুনতে পারেনি। এটা তার কষ্ট।

সুজাতা দারাকেও পড়িয়েছিল। এখন মুরাদকে পড়াচ্ছে। সে চমৎকার মেয়ে। এক সময় দারুণ মেধাবী ছাত্রী ছিল। পরবর্তীতে কলেজে যোগ দেয় শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে। তারই তত্ত্বাবধানে দারা, সুজা এতটা ভালো ফলাফল করতে পেরেছিল। মুরাদও দিনে দিনে ভাইদের পথেই হাঁটছে। তাকে নিয়েও তাই আমার আর কোন ভাবনা নেই। সুজাতা এতদিন বিয়ের কথা ভাবেনি নানা কারণে। এখন ভাবতেই সে জানিয়ে দিয়েছে এই পঞ্চাশ বছরের আমিই তার প্রথম ও শেষ পছন্দ। আমাকে না পেলে সে বিয়েই করবেনা। মুরাদকে সে ছেলে হিসাবে পেতে চায়।

দারা আজ ফোন করেছিল। ফোন তুলতেই সে বেশ চাঙ্গা গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করল-কেমন আছো বাবা? আমিও দরাজ গলায় বললাম-ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

সে ফুরফুরে গলায় বললো-খুব একটা ভালো নেই। আমি বললাম-ভালো নেই তো সেটা এত ফুরফুরে গলায় বলার দরকার কি। কি সমস্যা বলো? সে যা বললো তাতে বুঝলাম সমস্যা তেমন কিছু নয়।

আগামীকাল থেকে পরীক্ষা শুরু। কিন্তু তার বান্ধবী লিন্ডা এখনো আসছে না। আর লিন্ডা না এলে তার পড়াশুনা জমে না। লিন্ডা এসে তাকে পুরো কোর্সের উপর একটা ছবক দেবে। তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করবে। সে তখনই বুঝতে পারবে তার প্রস্তুতিটা কেমন হয়েছে। তার আগে বোঝার কোনো উপায় নেই। কারণ সে এভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আমি বললাম-অপেক্ষা করো, এসে যাবে। আমি যতটুকু জানি, সে খুব সিনসিয়ার। অতএব সে মিস করবে না। তুমি চাইলে বিষয়গুলোতে আরও একটু চোখ বুলিয়ে নাও। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মনে আছে কিনা কিংবা কোনোটা আদৌ বাদ পড়েছে কিনা তাও দেখে নিতে পার। সে সাথে সাথে বলল, বাবা তুমি ঠিকই বলেছ। একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার এখনো শেখা হয়নি। লিন্ডা আসলেই ধরা খেয়ে যেতাম। থ্যাঙ্ক ইউ বাবা। তুমি আসলেই জিনিয়াস। আমি তাকে বললাম-মনে রাখবে আমি তোমার বাবা। এবার পড়ায় মনোযোগ দাও।

মুরাদ এতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এবার ফোন রাখতেই সে বলে উঠল-ভাইয়া কি বললো? আমি বললাম-আগামীকাল থেকে তার পরীক্ষা। তুমি তার জন্য দোয়া করো। সে অত্যন্ত শীতল গলায় বললো-কিন্তু কই! ভাইয়া তো আমার কাছে দোয়া চাইল না। আমার দোয়া তার কাছে জরুরি নয়। আমি বললাম- না চাইলেও করতে হয়। সে এখন পড়া নিয়ে ব্যস্ত। তাই হয়ত খেয়াল নেই। কিন্তু তাতে কি? তুমি করো।
সে বললো-সে এখন লিন্ডাকে নিয়ে ব্যস্ত!
আমি মৃদু হাসলাম। সে-ও হাসল। তারপর ঠোঁট টিপে বললো-লিন্ডা মেয়েটা কিন্তু মন্দ নয়। ভাইয়ার সাথে বেশ মানাবে। ওদের বিয়ে দিয়ে দাও। আমি মুরাদকে কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু আবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেয়ালের ছবিতে রেবেকা যেন হেসে উঠল তার ছোট্ট ছেলের কথা শুনে।

সুজার সাথে গত তিন দিনে কোন কথা হয়নি। সুজা খানিকটা মুডি। কথা কম বলে। তবে সে ভীষণ আন্তরিক। আর তার এই আন্তরিকতার প্রকাশ তার স্বল্পবাক অথচ গভীর উচ্চারণে। তিনদিন আগে সে যখন ফোন করেছিল তখনই সে আমাকে বলেছিল- বাবা, আমি একটা গবেষণার কাজে আগামী তিন-চার দিন খুব ব্যস্ত থাকব। এই সময়ে হয়ত তোমাকে কোন ফোন নাও করতে পারি। তুমি কিন্তু মন খারাপ করো না। কাজ শেষ হলে সুখবরসহ ফোন দিতে চাই। আমি বলেছিলাম- ব্যর্থ হলেও ফোন দিও। জীবনের সমাপ্তি এখানেই নয়। ব্যর্থতায়ও জীবনের শুরু আছে। তবে কাজে লাগাতে পারলে।

সে আর কোন কথা বাড়ায়নি। শুধু বলেছিল- দোয়া করো। যেন কামিয়াব হই। তারপর আস্তে করে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। আমি মনে মনে বললাম-কামিয়াব হও মোগল সাম্রাজ্যের কাল্পনিক দ্বিতীয় শাহজাদা। খবরটা মুরাদকে দিতেই সে জায়নামাজে বসল চোখ বন্ধ করে। গভীর মনোযোগ সহকার আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলো। আমি তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলাম। মুরাদ এখন তার ভাইয়ের জন্য কাঁদছে। আঁখি পল্লব নিমীলিত। মুখশ্রীতে একটা সৌম্য ভাব যা কেবল দরবেশদেরই মানায়। সে ধীর, স্থির, শান্ত। আমার চোখের কোণে পানি চলে এলো। রেবেকার ছবির দিকে তাকালাম। সে হাসছে। আমি খানিকটা অবাক হলাম। এই অবস্থায় মুখে হাসি। পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম-আমার কান্না দেখেই সে হাসছে। আমি তাকে বলেছিলাম-আমি কাঁদতে জানি না। দুঃখ আমার সব কান্না নিয়ে গেছে। আমার চোখ দুটো যেন শুষ্ক মরুভূমি, দুখণ্ড পাথর, তাতে জল নেই।
হঠাৎ করেই মুরাদ এসে আমাকে বললো-আচ্ছা বাবা, তুমি কি বব বিমনের নাম শুনেছ? ১৯৬৮-এর মেক্সিকো অলিম্পিকে উনি ৮.৯ ফিট লাফিয়ে যে বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন তাকে মানব জাতির সবচেয়ে বড় লাফ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তার এই রেকর্ড ২৩ বছর পর্যন্ত অক্ষুণœ ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি হঠাৎ এই তথ্য কোথায় পেলে?
- তোমার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে। সেখানে একটি পাতায় বিমনের সেই ঐতিহাসিক লাফের একটা ছবির নিচে ক্যাপশনে তুমি নিজের হাতে এই কথাগুলো লিখেছ। তুমি কি মনে মনে কখনো এরকম একটা দীর্ঘ লম্ফ দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছো?
আমি বললাম-হ্যাঁ। কিন্তু পারিনি। সবাই সব কিছু পারে না। আমি বব বিমন নই। তাই পারিনি।
সে বললো-কিন্তু তুমি অন্য একটা জিনিস পেরেছ, সবাইকে একই জিনিস পারতে হবে এমন কোন কথা নেই। তোমার নামও পৃথিবীর মানুষ জানে। এটাও কম কিছু নয়।

সুজাতা মুরাদকে পড়াতে এসেছে। পড়ানো শেষ হলে সে আমার সাথে   নাস্তা খাবে। মুরাদ যাবে তার বন্ধু ফারদিনের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতে। বাড়ির ভিতরেই কোর্ট বানিয়ে নিয়েছে সে। খুবই ভালো খেলে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সাথেও খেলেছে। তারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলেছে ফাইনেস্ট হ্যান্ডস্। কিন্তু মুরাদের তাতে কোন মাথা ব্যথা নেই। সে কোন কিছু নিয়েই ভাবতে রাজী নয়। ভালো সে ফুটবল কিংবা ক্রিকেটেও। দাবাও খেলতে পারে। আর  টেবিল টেনিস খেলার সময় তার হাত দেখাই মুশকিল। কিন্তু কোন লাভ নেই। তার আগ্রহ যে কোথায় বোঝা কষ্ট। আমি তাকে কখনো কোন কিছুতে স্থির হতে দেখিনি। সে হলো সকল কাজের কাজী।

আমি নিউইয়র্ক টাইমস পড়ছিলাম। হিলারী যে বারাক ওবামাকে সমর্থন দিয়েছে এবং সবাইকে একযোগে কাজ করতে বলেছে দলের বিজয় নিশ্চিত করতে এই বিষয়ের উপর অনেক কিছু লেখা হয়েছে। মূল বিষয়টি হচ্ছে বারাকের সাথে প্রার্থীতা নিয়ে এতদিনের দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে তা এই হঠাৎ করে একটি ঘোষণায় কতটা অন্তর্হিত হবে। ব্যাপারটা ভাববার বিষয়। তবুও সুজাতা বললো-বিষয়টি পজিটিভ। পজিটিভ ইফেক্টই পড়বে। তাছাড়া ভালো কিছুর জন্যে মানুষ খুব দ্রুত নিজেদেরকে শুধরে নিতে পারে। আমি চা খেতে খেতে সুজাতার সাথে গল্প করছিলাম। মুরাদ খেলা শেষ করে ফিরে এলো। এসেই বললো-তোমরা এখনো গল্প করছ আন্টি? সুজাতা বললো-হ্যাঁ। তুমিও আসো। মজা হবে। সে বললো-আমি এখন ক্লান্ত। খেলে একদম ঘেমে নেয়ে গেছি। আজ ওদেরকে দারুণভাবে হারিয়েছি। সেদিনের হারের শোধ নিলাম। ফারদিনও খুব ভালো খেলেছে। ভুল কম হয়েছে। তোমরা দেখলে মজা পেতে। সুজাতা বললো-অন্য একদিন দেখব।

সুজার ফোন পেলাম। সুজা বললো-সুখবর বাবা। আমার মিশন সাকসেসফুল। তবে আর একটা  সুখবর আছে। জাপান শীঘ্রই সৌর শক্তি চালিত জাহাজ পানিতে ছাড়তে যাচ্ছে। এতে জ্বালানীর সমস্যা অনেক সমাধান হয়ে যাবে। ব্যাপারটা দারুণ। সারা বিশ্বে জ্বালানি নিয়ে ক্রমশঃ বেড়ে ওঠা অনিশ্চয়তার একটা সুরাহা হতে পারে। একটা অস্থিরতা আর একটা অস্থিরতার জন্ম দেয়। অভাব হচ্ছে সমস্ত সমস্যার মূল।

আমি সুজাকে স্বাগত জানালাম। সেও গ্রহণ করল। মুরাদের সাথেও কথা বললো। মুরাদ ভীষণ খুশি হলো। দারার  সাথে কথা বলতে বললাম। সে জানাল তোমাকে রেখেই ভাইয়াকে ফোন দেব। আমি ভীষণ খুশি হলাম। ছেলে আমার পরিপক্ক হচ্ছে। রেবেকার ছবির দিকে তাকালাম। তার মন খারাপ। বুঝতে পারলাম তাকে আমরা খেয়াল করিনি বলেই তার অভিমান। মুরাদ বললো-বাবা, মা মনে হয় রাগ করেছে। তাকে বলা হয়নি। সে বললো-মা, ভাইয়া, তার প্রথম এসাইনমেন্টে সাকসেসফুল হয়েছে। তুমি তার জন্য দোয়া করো। রেবেকার মুখে হাসি ফুটলো। মুরাদ আমার দিকে তাকালো। আমি তাকে মৃদু হেসে জবাব দিলাম। মুরাদও হাসল। সে হাসিতে কুয়াশা ঘেরা শীতের রাত্রির কোমল জ্যোৎস্না ভেজা একটা বিষণœ সজীবতা মাখা। আমার অস্তিত্ব তার পরশে ভিজে গেল।

দেশের অবস্থা একদিক দিয়ে ভালো নয় বলতে হবে। সর্বত্র একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সেই অনিশ্চয়তার মূল যে কোথায় তাও যেমন কারো জানা নেই তেমনি এর ডালপালাগুলো যে কোথায় বিস্তৃত হবে তাও কেউ বুঝতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রসঙ্গ বাদ দিলে বাকি অনেক বিষয়েই পরিস্থিতি সহনশীল। সবচেয়ে বড় কথা অনেকগুলো চিরাচরিত উটকো ঝামেলা থেকে দেশবাসী এখন মুক্ত। সন্ত্রাস, ফুটপাত দখল, চাঁদাবাজদের উৎপাত, অস্থিরতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তারপরও কিছু কিছু বিষয় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- যা কিছু অগ্রগতি তা হচ্ছে জরুরি আইনের ফসল। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা নয়। অর্থাৎ স্থায়ী কোন সুফল এটা নয়। এ হচ্ছে মারের ভয়ে চুপ থাকার মত একটা অবস্থা। তাছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তাই যেন সবাইকে বেশি স্পর্শ করে। বড় দলগুলোতে ভাঙ্গন অবিশ্বাস আর ধরপাকড়ের ভয়ে রাজনীতিবিদদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা মোটামুটি একটা ঝড়ের চিত্র দাড় করিয়ে দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আর সামরিক বাহিনীর প্রধান যেন পঞ্চ পাণ্ডব আর দেশের সব অপশক্তিই যেন ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্রের দলে।

আমি অপেক্ষা করছি কি ঘটে দেখার জন্যে। সুজাতাও কিছুটা শঙ্কিত। মুরাদ বললো-এখনই কিছু বলব না। আগে দেখি কি হয়। দারা আর সুজার কণ্ঠেও সংশয়। আমাকে সাবধানে থাকতে বললো। গাড়িতে আগুন দেওয়ার কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা দুটি বিষয়কে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। এক-অস্থিরতা, দুই-নকল গ্যাস সিলিন্ডারের সরবরাহ। দুটোই জীবনের জন্য ঝঁকিপূর্ণ। আমি শুধু মনে মনে বললাম-ব্যবসায়ী লোকটা তো কোনো দোষ করেনি। তাহলে তাকে কেন মারা হলো। প্রতিক্রিয়া প্রকাশের আর কি কোন ভাষা ছিলো না।
সুজাতা বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করছে না। সে আসলে অপেক্ষা করছে আমার জবাবের আশায়। আমি যা বলব তাতেই সে রাজী। মুরাদকে অখুশি করে সে কিছুই করবে না। কারণ মুরাদের সুখের জন্যেই সে এখানে আসতে চায়। পঞ্চাশ বছর বয়সী বিগতা স্ত্রীর শোকে ক্লান্ত একজন ক্ষয়িষ্ণু মানুষের শরীরে নারীর প্রত্যাশার যে কিছু নেই তা স্কুল বালিকারও না বোঝার কথা নয়। তবুও সে আমার জীবনে আসতে চায়। সে নিজেও হয়ত এই চাওয়ার সবটুকু অর্থ জানে না। হয়তোবা খানিকটা মায়ার পাশাপাশি একটা অদম্য আবেগ দ্বারাই আচ্ছন্ন তার সারাটি তনুমন।

দারার সাথে ফোনে কথা বললাম। পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চাইতেই সে চমৎকার একটা হাসি হেসে উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করলো-কেমন হতে পারে তুমিই বলোতো বাবা? আমি বললাম-আশাকরি ভালো হয়েছে। সে বললো-মজার ব্যাপার কি জানো লিন্ডাই একটা ভুল করে ফেলেছে। অথচ ও-ই আমাকে ওটা শিখিয়েছিল। আমি খানিকটা রাগতস্বরে বললাম-তার জন্য তুমি হাসছ! তোমার মন খারাপ করা উচিত। সে তোমার জন্যে সারাক্ষণ সময় দিচ্ছে। দারা বললো-কিন্তু লিন্ডা দুঃখিত নয়। কারণ ভুলটা সামান্য আর এটা তার গ্রেডে কোন প্রভাব ফেলবে না। তুমি আপসেট হয়ো না। আমি বললাম-ওকে। লিন্ডা পাশে থাকলে ওকে দাও। আমি ওর সাথে কথা বলবো। ফোনে লিন্ডার কণ্ঠ ভেসে আসল।

লিন্ডা মেয়েটাকে অত্যন্ত ভালো বলতে হবে। আমেরিকান মেয়ে। কিন্তু অনেকটা ভারতীয় ঘরানার। দারুণ সংসারী হবে এমনটাই মনে হয়। পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। কোন প্রকার উগ্রতা নেই। পড়াশুনায় ভালো। লিন্ডার অনেকগুলো ভিডিও পাঠিয়েছে দারা। আমার দেখার জন্যে। লিন্ডার বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। মা-ও একজন আইনজীবী। পাশাপাশি সমাজসেবীও। সম্পদশালী পরিবারে বেড়ে ওঠা সত্বেও সে আর দশটা মেয়ের মতো মাথা গরম নয়। অত্যন্ত ধীর স্থির শান্ত। পড়াশুনায় অত্যন্ত মনোযোগী। ভবিষ্যতে সিনেটর হতে চায়। এখন থেকেই তার জন্যে সে নিজেকে তৈরি করছে। আমি লিন্ডাকে সবসময় মনোবল যোগাই। সে খুশি হয়। আমাকে গভীর আবেগ ভরা কণ্ঠে বলে-হ্যালো ড্যাড, বাংলায় বলে বাবা। তারপর খটখট করে হাসে। মিষ্টি মেয়ে। চোখের সামনে মুখটা ভেসে ওঠে। দারার সাথে মানাবে।

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোর্স শেষ হলেই ওদের বিয়ে দিয়ে দেব। দারার মনোভাবটা অবশ্য পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না। তবে মনে হয় না ও আপত্তি করবে। কথাবর্তায় তো তাই মনে হয়।


খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বের হই। নির্দিষ্ট কারো সাথেই আমার রুটিন মাফিক হাঁটা হয় না। যখন যার সাথে দেখা হয় সে-ই সাথী হয়ে যায়। আসলে আমিই বানিয়ে নেই। আমার ধরণটাই চিরকাল এমন। কাউকে আপন করে নিতে আমার সময় লাগে না। এমনকি অপরিচতি মানুষের সাথেও দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারি সময়। সমস্যা হয় না কখনো। আমাকে প্রকৃতি এমন করেই তৈরি করেছে।

তবে এই এলোমেলোমির মধ্যেও একটা কিছু তো গোছালো থাকেই। যেমন-সাব্বির সাহেব। তিনি আমার সাথে প্রায়ই হাঁটতে বের হন। কারণ তার ভালো লাগে। আমারও লোকটাকে মন্দ লাগে না। সদালাপী, হাসি খুশি মানুষ। সফল জীবনই বলতে হবে। সন্তানদের মানুষ করেছেন। গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। সমাজ সেবাও যে করেন না তাও নয়। এই অঢেল সম্পদের মধ্যে অবৈধ বলতে যা বুঝায় তেমন কিছু নেই। ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন। ব্যবসা করেছেন সততার সাথে। দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন নাক-চোখ বন্ধ করে। নির্ঘুম কাটিয়েছেন অনেক রাত। ব্যাবসা তাকে ধরা দিয়েছিল। সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাই বলে তার মধ্যে কখনো অহঙ্কার দেখিনি। আমার সাথে বলে কথা নয়। গরীবের প্রতি তিনি আরও বিনয়ী।

সাব্বির সাহেবকে এক কথায় ভালো মানুষই বলতে হবে। নিয়মিত একত্রে হাঁটার সুযোগ না হলেও মাঝে মধ্যেই দেখা হয়। অনিয়মটা হয় আমার পক্ষ থেকেই। রাত জেগে লেখার পর সকালে উঠতে পারি না সবসময়। উনি এসে ডেকে চলে যান। শুনে খারাপ লাগে। দেখা হলে মৃদু হাসেন। লেখক হিসেবে ক্ষমা করে দেন।

এই সাব্বির সাহবেই সেদিন হাঁটার সময় আমার দিকে না তাকিয়েই একটা কিছু বলার ভূমিকা স্বরূপ কাশি দিয়ে খানিকটা থেমে হঠাৎ করে বলতে শুরু করলেন-কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম। আমি বললাম-বলুন।
- মেয়েটি কিন্তু মন্দ নয়।
- কার কথা বলছেন?
- মুরাদের টিচার মেয়েটি।
- কার জন্যে?
- কার জন্যে আবার। আপনার জন্যে।
- কিছু বুঝতে পেরেছেন?
- হ্যাঁ পেরেছি।
- কেমন করে?
- ওদের তিন ভাইকেই তো মানুষ করলো। জীবনটা তো আপনার সংসারেই উৎসর্গ করলো। প্রতিদান দেওয়া উচিত।
- আমি অবশ্য তেমন কিছু ভাবিনি।
- ভাবা উচিত। মন্দ হবে না।
- আপনি কখনো কথা বলেছেন।
- হ্যাঁ। বলেছি। আসার সময় পথে দেখা হয়ে যায় মাঝে মাঝে। ডেকে দু’একদিন কথা বলেছি। অত্যন্ত ভদ্র মেয়ে।
- কিন্তু আমার মতো একজন বুড়োকে পছন্দ করবে নিশ্চিত হলেন কেমন করে?
- কবিরা বুড়ো হয় না।
- তাই নাকি!

আমি হাসলাম। তিনিও হাসলেন। আর কোন কথা হলো না। আসার সময় বললো-ভেবে দেখবেন। যদিও অনধিকার চর্চা তবুও অনুরোধ করছি। খালি বাড়িতে একজন মানুষ হলে মন্দ হতো না। ফারদিনের কাছ থেকে আমি কিছুটা জেনেছি। ওকে বলেছে মুরাদ। ব্যাপারটা মন্দ নয়। ছেলের মত আছে। যদিও মায়ের জন্যে তার কষ্ট হয়। তবুও সেও চায় এ বাড়িতে কেউ আসুক। একটা খালিবাড়ি কারোরই পছন্দ নয়। তাছাড়া ও তো বলতে গেলে মায়ের øেহটা পেলোই না।

গড়গড় করে সাব্বির সাহেব কথাগুলো বলে থামলেন। তারপর হেসে চলে গেলেন।
কয়েক পা হেঁটে গিয়ে থেমে আবার ঘুরলেন। হাতের পাঁচটি আঙুল উচিয়ে হাসিমাখা মুখে বললেন-আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব আমার। আপনি শুধু বর সাজতে রাজী হলেই হবে।

আমি না হেসে পারলাম না।

কুতুব উদ্দিন গ্রামের বাড়ি থেকে একটু আগেই ঢাকায় এসে পেঁৗঁছেছে। স্টেশনে নেমে সোজা বাসায়। প্রতিবার অবশ্য সে বড় আপাদের বাসা হয়ে তারপর আসে। এর কারণ হলো একবার এখানে এসে উঠলে তার নাকি আর নামতে ইচ্ছে করে না। কুতুব উদ্দিন আমার শালা। লোকটা অত্যন্ত সাদা সিধে। ভালোমানুষ বলতে যা বোঝায় সে আসলে তাই। মুরাদ তার মামাকে ভীষণ পছন্দ করে। সে এলে তার খুশির অন্ত নেই। মামাও ভাগ্নে বলতে অজ্ঞান। দারা, সুজাও যে কম পছন্দ করে তা নয়। কিন্তু ওরা তো এখন কাছে নেই। তাই মুরাদকে নিয়েই তার যত লাফালাফি।

কুতুব উদ্দিন লোকটা কিছুটা নিরস প্রকৃতির। তবে তার এই নিরস প্রকৃতির ভেতরে একটা আমুদে ভাব লুকিয়ে আছে। যা হঠাৎ করেই জাগ্রত হয়। তখন সে মজার মানুষ।

কুতুব উদ্দিন কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করল-দুলাভাই, শুনলাম আপনি নাকি বিয়ে করছেন। সত্যিই? আমি জিজ্ঞেস করলাম-
- কে বলেছে?
- কেউ না।
- তাহলে শুনলে কেমন করে। ফেরেস্তা মারফত।
- তা হবে কেন, মুরাদ বলেছে।
- তাই নাকি।
- আমি সিরিয়াস দুলাভাই। তেমন কোন ব্যাপার হলে আলহামদুলিল্লাহ। আমার কোন আপত্তি নাই। বরং খুশিই হবো। মুরাদের কথা অনেক আগেই ভাবা উচিত ছিল। আমি আপনার সাথে আছি।
- এতো অস্থির হয়ো না কুতুব। এখনো কোন ফয়সালা হয়নি। তবে সত্যি কথা বলতে কি আমি ভাবছি। এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেইনি।
- কিন্তু নিতে হবে। নেওয়া উচিত। ছেলেদের জন্য বউ আনতে হলেও ঘরে একজন মানুষ দরকার। বুবুর জন্য মন খারাপ করবেন না। যে যাওয়ার সে চলে গেছে।
- আমি আসলে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি।
- আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হেল্প করার জন্যেই আমি এসেছি। আপনি ভেবে দেখেন।
- মুরাদ দেখছি তোমাকে সবই বলেছে?
- ও কোন অন্যায় করেনি। সংসারের জন্য প্রয়োজন আছে। তাছাড়া আপনি তো এখনো একেবারে বুড়ো হয়ে যাননি। যদি একশ বছর বাঁচেন একা থাকা কি ঠিক হবে। নিঃসঙ্গ জীবনের ভার বড় দুর্বিসহ। পাথরের চেয়েও ভারী।
- তুমি দেখছি দার্শনিক হয়ে গেছো!
- আপনার মত বড় কবি না হলেও জীবনের কিছু কিছু বিষয়তো বুঝি। একেবারে বোকার হদ্দ নিশ্চয়ই নই।
- আমি তা বলিনি।
- আপনি ভেবে দেখেন। আমি আপনার সব কিছু ঠিকঠাক করে আয়োজন করে দেবো।
- তুমি খুব ভাল মানুষ।
- সবাই বলে।
- ঠিকই বলে।
- জানি না। আপনি রাজী হন।

কুতুবের চোখে জলের যে ধারা তা যে আর সামলানো যাচ্ছিল না তা তার অধোবদন দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। মাথা নিচু করে সে উঠে চলে গেল। বুঝতে বাকি রইল না তার বুবুর কথা মনে পড়েছে। মায়ার যে বন্ধন চিরকাল মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে আমরা কেউই তার সীমানা অতিক্রম করতে পারিনি কখনো। কুতুব তার ব্যতিক্রম নয়। আমি নিজেও তো সব ুসময় পারি না। এই যেমন এখনো পারলাম না। রেবেকার জন্যে বুকের গহীনের ছোট্ট সাগরে কোথা থেকে কেমন করে যখন তখন ঢেউ ওঠে তার রহস্যের কোন কূল-কিনারা করতে পারি না। বসে বসে শুধু ছোট্ট শিশুর মত কাঁদি। দুচোখের কোণে জমা বেদনার অশ্র“ স্ফটিক জলের ফোঁটা হয়ে আমার নিজের নিয়তির পাষাণ বুকের উপর ঝরে পড়ে নিঃশব্দে।


সামনে রমজান মাস। সরকারের ভূমিকা নিয়ে চারিদিকে কথা হচ্ছে। প্রতিবারের মত এবারও সরকার কতটা ব্যর্থ হবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। সদ্য সমাপ্ত বেইজিং অলিম্পিকের ঘোর কাটতে না কাটতেই মানুষের মুখে মুখে এখন রমজানের আলোচনা।

এবারের অলিম্পিকের কিছু চমকপ্রদ বিষয় ছিল। তার অন্যতম হচ্ছে জল দানব মার্কিন সাঁতারু ফেলপসের সকল ইভেন্টেই সোনা জয়। আর এই ৮টি জয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি তার স্বদেশী মার্ক স্পিৎজের সর্বোচ্চ সাতটি সোনা জয়ের রেকর্ড ভেঙ্গে দিলেন। এছাড়া ছিল উসাইন বোল্টের ৯.৬৯ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ানোর অবিশ্বাস্য ঘটনা। পাশাপাশি দৌড়ে তিন তিনটি সোনা জয়। এছাড়াও একই দেশ জ্যামাইকার মেয়ে ম্যারি অ্যান ফ্রেসারের  ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে সোনা জয় করার কৃতিত্ব। পোল ভোল্টে ইতিহাস সৃষ্টি করে ইয়েলেনা ইসিনবায়েবার রেকর্ড উচ্চতা অতিক্রম। সবকিছু মিলিয়ে চীনের নিঁখুত আয়োজনে স্বপ্নের অলিম্পিক ছিল এটা। সবচেয়ে বড় কথা পদক তালিকায় এই প্রথম চীনের শ্রেষ্ঠত্ব সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব ক্রীড়ায় এখন চীনাদের জয় জয়াকার। দুঃখ একটাই আমরা কোন পদক পাইনি।

এবছর ঢাকায় বর্ষাটা একটু বেশিই হয়েছে অন্যান্য বছরের তুলনায়। মে মাস আসতে না আসতেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাপারটা মন্দ নয়। তবে ঢাকা মহানগরীর বেশীরভাগ রাস্তাঘাটই ততটা উন্নত নয়। সামান্য বর্ষা হলেই কর্দমাক্ত হয়ে যায় বেশির ভাগ রাস্তাই। তাতে অবশ্য বায়ু দুষণের মাত্রাটা কিছুটা কমই হয় বলতে হবে। এবছরও দুষণের মাত্রাটা অনেকটাই কমেছে। বায়ু কিছুটা হলেও নির্মল। আবহাওয়ায়র একটা ভ্যাপসা ভাব থাকলেও মোটামুটি মন্দ লাগছে না। সবকিছু মিলিয়ে একটা অন্যরকম ভালো লাগা হৃদয়টাকে কেমন যেন নাড়া দিয়ে যায়। আকাশের বুকে কালো মেঘের ঘনঘটা কেমন যেন একটা দোলা দেয় মনের ভেতর।

সুজাতা নিয়মিতই পড়াতে আসে। কথা হয় আমার সাথেও। একটা ব্যাপার আমার কাছে বেশ আবাকই লাগে। সবকিছুতেই সে খুবই স্বাভাবিক। এমনকি বিয়ের ব্যাপারটা খোলাখুলি আলোচনা হওয়ার পরও তার তেমন কোন ভাবান্তর নেই। এই বাড়িটাকে সে যেন তার নিজের বাড়ি হিসেবেই মনে মনে গ্রহণ করে ফেলেছে। অতএব তার যেন বিব্রত হওয়ার কিছু  নেই। বরং যা হচ্ছে তা যেন খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। উল্টো তার ভাবখানা এমন যেন অনেক আগেই এমনটা হওয়া উচিত ছিল। বরং দেরি হয়ে গেছে। যদিও বিয়ের জন্য তাকে কখনো ব্যস্ত হতে দেখিনি।

সুজাতা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অনেকগুলো ভাইবোন। কিন্তু সবাই খুব মেধাবী। তাই কারোরই লেখাপড়া নষ্ট হওয়ার কথা ভাবতে পারেনি ঘুনাক্ষরেও। আর সংসারের সেই ঘানি টানতে টানতে কখন যে তার যৌবনের সেই সোনালি মুহূর্তগুলো পেরিয়ে গেছে সে তা টেরই পায়নি। যখন পেয়েছে তখন তার বয়স পয়ত্রিশ। বিয়ের জন্য খুব একটা উপযুক্ত সময় নয় নিশ্চিত। তবে তার এই জীবন তাকে যা দিয়েছে তা হলো স্থিরতা। সে যেন একটা শান্ত সরোবর। ঢেউহীন দিঘী। আবেগ তার আছে বটে তবে তা বিবেচনার মোড়কে মোড়ানো। তার হৃদয় কখনো সে সীমানা ভাঙতে দেয়নি। কারণ যদি সে ফেরারী হৃদয় আর ঘরে না ফেরে তাহলে কে নেবে জন্ম-জন্মান্তরের এই দায়। কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে ছোট ছাট এই সব অসহায় ভাই-বোনগুলো। অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও সে তাই বেছে নিয়েছিল এমন এক জীবন যেখানে সে তার পিতার সংসারের স্বপ্নকে সাজাতে সক্ষম হয়েছিল। নিজের জীবনের স্বপ্ন তাই তার অধরাই রয়ে যায়।


হঠাৎ করেই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই। এটা যে এক ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি তা মুরাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না। সেও সঙ্গে যেতে রাজি হয়। দুজন গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। আমি ড্রাইভ করছি। মুরাদ আমার পাশের সিটে। আকাশ কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন। মুরাদ গুনগুন করে গাইছে-
হায় বরষা/ এমন ফাগুন কেড়ে নিও না/ আমার প্রিয়ার চোখে জল এনো না/ মধুর স্বপন ভেঙ্গে দিও না/...

আমি বললাম-তুই তো ভালোই গাইতে পারিস গানটা। কই আগে তো কখনো এভাবে গাইতে শুনিনি।
- অত কিছু ভেবে চিন্তে গাইনি। ভালো লেগেছে গাইলাম। তোমার ভালো লাগলে সত্যিই মজার। কারণ এখানে শ্রোতা মাত্র একজন। সে খুশি হলেই শিল্পী সার্থক।
দারুণ। আমি বললাম।
- শোনো, গানটা আমি অতটা ভালো গাইতে পারি না যতটা তোমার কাছে মনে হচ্ছে। তবুও তোমার কাছে ভালো লেগেছে, কারণ আজ অনেক দিন পর গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি। তাই আমাদের হৃদয় এমনিতেই উদ্বেলিত। সেই আনন্দের বাণে আমার গানের খুঁতগুলো ভেসে গেছে। তুমি পুলকিত হয়েছ। আমি সার্থক হয়েছি শিল্পী হিসেবে। আসলে বাবা, সময় হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। ’৭১-এ যা ছিল পবিত্র দায়িত্ব আজ তাকে কেউ সন্ত্রাস ছাড়া  কিছু বলবে না। কিন্তু তখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে এর কোন বিকল্প ছিল না। যুদ্ধও কখনো কখনো প্রয়োজনীয় ও জরুরি হয়ে ওঠে। তা শুধু সময়ের প্রয়োজনেই।
- তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা শুধু সময় তাড়িত।
- হয়তো বা।

অনেক দিন পরে মা-বাবার কবরের পাশে এসে দাঁড়াই। বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে আমার পাশে মুরাদ। দাদা-দাদীর জন্যে অঝোরে কাঁদছে সে। কাঁদছি আমিও। কারণ আমার মা-বাবার পাশাপাশি আমার দাদা-দাদীও মানে মুরাদের পর দাদারাও এখানে শায়িত। কান্নার রুধির তাই নিয়ন্ত্রণের বাধ ভেঙ্গে আঝোর ধারায় বেরিয়ে আসছে।
গ্রামের বাড়িতে দুদিন থেকেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। ভালো লাগা, মন্দ লাগার একটা মিশেল অনুভূতি সবকিছু ছাপিয়ে ছুঁয়ে যায় সত্তার তলদেশ। অজস্র স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত তনুমন যেন বারবার একটি সবুজ ধানের পাতার মত তির তির করে কেঁপে ওঠে।

স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত হৃদয়। তবুও বাস্তবতায় ফিরে আসতে হয়। এটাই জীবন। আমার দর্শন তাই সর্বদা চঞ্চল। জীবনের রূঢ়তার কাছে যেমন কখনো হার মানিনি তেমনি গা ভাসাইনি আনন্দ বানে। কর্মের মধ্যেই খুঁজেছি তৃপ্তির আস্বাদ। শোকের পালক ঝেড়ে ফেলে সান্ত্বনায় খুঁজে নিয়েছি আশ্রয়।  সহস্র আঘাতে জর্জরিত যে জীবন তার মর্মমূলে প্রবেশ করে তাকেই করেছি বর্ম। তাইতো আজ সমস্ত বেদনার স্তূপ একপাশে সরিয়ে পথ চলি আলগোছে। চোখের সামনে দেখতে দেখতে একটা জীবনের সিংহভাগ পেরিয়ে গেল। পঞ্চাশ বছর এমন কোন বয়স নয়। তবুও তো তা অর্ধশত বছর। আমার বাবা শতায়ু হয়ে ছিলেন। তিনি সত্যিই ভাগ্যবান। একটা শতাব্দী জুড়ে পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহণ করেছিলেন। পুরো ইংরেজ, পাকিস্তানী আমল দেখেছিলেন। দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলা। সত্যিই এক বিরল সৌভাগ্য। বাবা নির্ঝঞ্ঝাট লোক ছিলেন। অনেক ব্যাপারেই ছিলেন নিরপেক্ষ। আমি তার মত হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। জীবনের প্রতি নির্লোভ আর নিরপেক্ষ হওয়া এতটা সহজ নয়।


পত্রিকার সংবাদ মোটেই সুখকর নয়। জেল হত্যা মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন রশিদ, হুদা, মহিউদ্দিন-রা। দায়ি তাহলে কারা? অনেক প্রশ্ন হয়ত চাপা পড়ে যাবে। সাথে অনেকগুলো উত্তর। রাজনীতি এমনই একটি বিষয়। উত্তর না জানা প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছাত্র। মাঝ মাঝে আমার আর ভালো লাগে না। আবার মন্দও যে লাগে তা বলা যাবে না। শুধু পরিস্থিতিগুলো যা একটু এলোমেলো।

জাতীয় নেতাদের অনেকেরই দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতির খবরও বেরিয়েছে। ব্যাপরটা মন্দনা। তবে সবাই যদি অব্যাহতি পায় দুর্নীতির দায়ভার তাহলে কার। আর কারো যদি দায়ভারই না থাকে তাহলে মামলা কেন? আসলে এসবের দ্বারা লাভবান হচ্ছে কারা? আমরা কার জন্যে এই সব নাটকীয়তার অবতারনা করছি। সে কি তাহলে অদৃশ্য কোন শক্তি। জনগণ তাহলে কি নিয়ন্ত্রকদের এখনো চেনে না কিংবা জানে না। হতে পারে। সাপের মুখ আর লেজ একপ্রান্তে নয়। বাস্তবতার বাইরে যাওয়ার মত অতিপ্রাকৃতিক কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না। ঘুরে ফিরে সেই একই প্রদর্শনী। কোনোটা স্বৈরাচার, কোনোটা অনাচার।


দ্বিতীয় পর্ব ঃ তুমিই মৃন্ময়ী


রেবেকা কেমন করে আমার জীবনে এসেছিল তার মর্মার্থ হয়ত আমি কোনোদিন কাউকে বোঝাতে পারবো না। প্রেম অনুভবের, সব পাওয়াই অনুভূতির। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটা ছিল কিছুটা ভিন্নতর। সাধারণের ভিতরে অসাধারণ। অনেক বেশি নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ ছিল সেই কাহিনী। ভাবলে মনটা ভরে যায় গর্বে। প্রেমের মাহাত্ম্য ছিল সে পাওয়ায়। জীবনের খাঁটি বাস্তবতা থেকে জন্মানো প্রেম। কোন কাল্পনিক কাহিনী নয়। সেই কাহিনী এখন বলব। কারণ তা বলা জরুরি। ধরণীর ধুলায় স্বর্গের মুক্তোদানার যে মাহাত্ম্য তারই সার্থক রূপায়ণ ছিল সেই প্রেম। সেই প্রেম নিয়ে আমি গর্বিত। সেই প্রেমই মূলতঃ আমার জীবন, জীবনের নির্মাণ। আমি সেই স্মৃতির অবশিষ্টাংশ। পড়ে থাকা খণ্ডাংশ। তার অংশ নিয়ে সে চলে গেছে। আমি বসে আছি তাকে স্মরণ করে তার সেই মানবিক ভালোলাগা আর ভালোবাসার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে।

রেবেকাকে নিয়ে সাজেদারও আগ্রহের অন্তঃ নেই। সেও তাই রেবেকার সম্পর্কে সবকিছু শোনার জন্য অনেকদিন ধরে অনুরোধ করে আসছিল।    কিভাবে আমাদের পরিচয়, প্রেম, প্রণয়, পরিণয়। কিন্তু আমি কখনো মুখ খুলতে রাজি হইনি। শেষ পর্যন্ত তার অনুরোধ আর ফেলতে পারলাম না। তাকে সবকিছু খুলে বলতে বাধ্য হলাম। কারণ তার এটা জানা দরকার।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই নয় আমার পুরো জীবনটা জুড়েই  চেষ্টা করেছি নিজেকে একটা আনন্দ ঘন পরিবেশের মধ্যে রাখতে। এটা আমার একান্ত চেষ্টাই ছিল বলতে হবে। আর আমি তাতে সফলও ছিলাম। কিন্তু আমার আনন্দঘন জীবনে নিঃসঙ্গতা এমন করে এসে সবকিছু এলোমেলো করে দেবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। বায়ুর মধ্যে বাস করে আমরা যেমন বায়ুশূন্যতাকে ভুলে থাকি এ যেন তেমনি এক অভিজ্ঞতা। আমার অবস্থা দিনে দিনে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো হয়ে আসছিল। লজ্জা ভেঙে কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। অবশ্য এখানে বলার মতও কেউ নেই। জীবনের প্রথম কর্মস্থলে এসে নতুনত্বের আস্বাদ পরাজিত হলো ভয়ঙ্কর একাকীত্বের কাছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মালেকা বুয়াকে না পেলে আমার পক্ষে এখানে আদৌ থাকা সম্ভব হতো কিনা তাতে সন্দেহই ছিল। সেই যেন আমাকে এখানে ধরে রেখেছে তার যতœ আর অতিথেয়তায়। অবশ্য আমি তাকে সন্তোষজনক পারিশ্রমিকের চেয়েও খানিকটা বেশী দিচ্ছি অতিরিক্ত সেবা এবং সঙ্গ পাওয়ার আশায়। বুয়াও তার প্রতিদান দিতে কসুর করছে না। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমি তার এতটাই আপন হয়ে উঠেছি  যে আমিই যেন তার ধ্যান জ্ঞান। এই কিনে নেওয়া ভালোবাসাটুকুই যে দিন-দিন কৃত্রিমতা হারিয়ে খাঁটিত্ব খুঁজে নিচ্ছে তা আমরা দুজনেই বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।

বুয়ার সাথে গল্প করেই অবসর কাটে। বাকিটা সহিত্য চর্চা আর গানবাজনা শুনে। টেলিভিশন দেখার নেশাও আছে। তবু সব কিছুই ছাপিয়ে কি যেন একটা না পাওয়ার বেদনা হাহাকার করে ওঠে। মাঝে মাঝে তাকে মনে হয় তৃষ্ণা, মাঝে মাঝে মনে হয় শূন্যতা। বিশেষ করে রাতটা একদম কাটতেই চায় না। বুয়ার যেতে প্রায়ই গভীর রাত হয়ে যায়। আমিই তাকে আটকে রাখি। সে-ও যেন কিসের একটা বন্ধনে আটকা পড়ে থাকে। যাই যাই করেও যায় না। এ বন্ধন যে দেহের নয় তা উজ্জ্বল দিবালোকের যত স্পষ্ট। আমার সাথে তার সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি কারণ তার সে বয়সও নেই। সে এখন শ্রীহীন ক্লান্ত বৃক্ষ। তার কাছে বসন্তও যা শীতও তাই। দিন রাত্রি সবই সমান। জীবন যৌবনের দুই মিলিত প্রবাহের উত্তাল ধারা মহাকালের সাগরে বিলীন হওয়ার মতই তার বাস্তবতা।

পাশাপাশি অবস্থান মানুষকে অনেক সমতায় নিয়ে আসে। সময় ও সাময়িকতা হাজার যোজনের ব্যবধান ঘুঁচিয়ে দিতে পারে যখন-তখন। বুয়ার সাথে আমার সম্পর্কও তাই। আমাদের গল্প হয় বন্ধুর মত। প্রাণ খুলে সে আমাকে তার জীবনের কাহিনী বলে যায়। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি। এভাবে পারস্পরিক সহমর্মিতা যে অসম বন্ধুত্বের সেতু বন্ধন তৈরি করে তার সামাজিক স্বীকৃতি না থাকলেও মানসিক স্বীকৃতি যুগে যুগে ছিল। হয়ত আগামী দিনেও থাকবে। যৌনতার অতীত সম্পর্কগুলো প্রতিহিংসার কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলে তা মন্দিরের পবিত্রতাও লাভ করতে পারে কখনো কখনো। এমন নিঃসঙ্কোচ জবানবন্দী পৃথিবীতে আর হয় না। বুয়ার সাথে আমার গল্প হয় দ্বিধাহীন। তবে বরাবরের মতই প্রসঙ্গটা থাকে নির্দোষ আর উপস্থাপনা থাকে সাবলীল। সে রাতে আমার কণ্ঠ খানিকটা কেঁপেছিল। কারণ আমি এমন কিছু বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম যা এক কথায় গর্হিত।

কথাটা যে কিভাবে বলব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ব্যাপারটা ভাবতেই নাক-কান দিয়ে গরম ভাঁপ বেরোচ্ছিল। কিন্তু বলার লোভও সামলাতে পারছিলাম না। অবশেষে ঝুঁকি নিতেই হলো। চিরাচরিত পদ্ধতিতেই শুরু করলাম।
- বুয়া! আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। অবশ্য যদি কিছু মনে না করেন।
- না,না, মনে করব কেন, মনে করার কি আছে, বলেন।
- না মানে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। বলছিলাম কি...
-কি ব্যাপার! আমাকে বলেন। আমি ছাড়া আপনার এখানে আর আছেই বা কে, কাকেই বা বলবেন। বলেন না কি বলবেন?
- আসলে আমার যা বয়স তাতে একা থাকা ভীষণ কষ্টের।

কথাটা শুনে বুয়া ফিক্ করে হাসলো। মনে মনে হয়ত ভেবেছে আমি বিয়ের কথা বলবো। তাই তার আগ্রহ যেন দ্বিগুন হয়ে ঝড়ে পড়ল তার কথাতেই।
- বুঝতে পেরেছি। বেগম সাহেবের দরকার।
- না বুয়া, এই মুহূর্তে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয় বলেই তো সমস্যা। আমি বলছিলাম কি আপনি যদি কোন একটা মেয়েকে জোগাড় করে দিতেন যে আমার এখানে থেকে রান্না বান্নার পাশাপাশি আমাকেও খুশি করবে। অনেক গরীব, অসহায়, ভালো মেয়েই তো আছে। আমি তার সব প্রয়োজনই মেটাতাম। কাপড় চোপড় গহনা-গাঁটি, টাকা পয়সা যখন যা প্রয়োজন। তার কোন কিছুর অভাব হতো না। সে ভালোই থাকতো। কিন্তু আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। ব্যবস্থা হলে আমি আপনাকে খুশি করব। তাছাড়া আপনার তো কাজের অভাব নেই। এমনকি কাজ না করলেও চলে। তাই যদি একটু দেখতেন। সত্যি বলতে কি একা একা ভীষণ কষ্ট হয়। কেউ হলে মন্দ হতো না। আমি আপনাকে খুলেই বললাম।

বুয়া চুপ হয়ে গেল আমার কথা শুনে। ঘরের মধ্যে তখন পিন পতনের নিরবতা। আমরা পরস্পরের নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছিলাম। কথাগুলো বলার সময় আমি কেন জানি একবারও তার মুখের দিকে তাকাইনি। এবার অসহ্য নিরবতার শরীর ভেদ করে আড়চোখে তাকে দেখে নিতে গিয়ে দেখি সে এক দৃষ্টে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুটা সাহস নিয়েই বললাম
- আপনি কি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন বুয়া।
- না, না কষ্ট পাব কেন, দেখি কি করতে পারি।

বুয়ার মুখে মিষ্টি হাসির রেখা ঝিলিক মারতে দেখে আমি সাহস ফিরে পেলাম। পকেট হাতড়ে দুটো একশ টাকার নোট তার হাতে দিতে দিতে বললাম-
- আপনার সন্ধান ফি। খুব সামান্য। আসল বকশিস তো রইলই।
- না,না লাগবে না, রেখে দেন, আগে ব্যবস্থা হোক, তারপর নেব। এখন দিলে কিন্তু রাগ করব।
- ঠিক আছে বুয়া, তখন কিন্তু না বলতে পারবেন না। মনে থাকে যেন।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। মনে থাকবে।

সে রাতে আলাপ আর জমল না। বুয়া বিদায় নিতেই আমি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। বিশ্রী রকমের অনুভূতি হতে লাগল। জীবনে এই প্রথম পাপ কর্মের আনুষ্ঠানিক আয়োজন। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল। রাত্রির নির্জন অন্ধকার যেন ভীষণ হা হয়ে গিলে ফেলতে চাইছে আমাকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছি টের পাইনি। স্বপ্নে একটি অচেনা মেয়ের সাথে নিজেকে ঘনিষ্ট হতে দেখে ঘুম ভাঙল। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে আবারও শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল কলিং বেলের আওয়াজে। দরজা খুলতেই খানিকটা অবাক হলাম। কিছুটা বিরক্তও। সম্ভবতঃ মফস্বল থেকে আসা একটা সাদামাটা লোক রং ওঠা একটা ব্যাগ নিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে বহুদিন গাট্রি বেঁধে রাখা অসম মাপের শার্ট প্যান্ট। তেল তেলে চুলে রোগা টিং টিংয়ে। লোকটির মুখ এতটাই শুকনো যে বুক আঁতকে ওঠে। খানিকটা এগিয়ে এসে সে নীচু গলায় জিজ্ঞেস করল-
- এটা কি জাফর আহমেদের বাড়ি?
- রাস্তার ওপাশেরটা। আমি বললাম।
- ধন্যবাদ। সকাল বেলা বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
- ঠিক আছে।

দরজা বন্ধ করে আবার শুতে যাব। কিন্তু কেন জানি হঠাৎ করেই ইচ্ছেটা উবে গেল। বাথরুমে ঢুকে দাঁত মাজতে মাজতে ভাবতে লাগলাম এখনো বুয়া আসছে না কেন? প্রতিদিন তো এই সময়েই আসে। পরক্ষণেই ভাবনাটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে তোয়ালেটা টেনে নিয়ে মুখ হাত মুছে ফেললাম। ক্যাসেট প্লেয়ার অন-করতেই বেগম আক্তার সিদ্ধ গলায় গেয়ে উঠলেন- এ মৌসুমে পরবাসে... । আমি খাটের প্রান্তে বালিশে হেলান দিয়ে গান শুনতে শুনতে হাত বাড়িয়ে সমকালীন ফরাসী কবিতার একটা অনূদিত সংকলন টেনে নিলাম। গুরুপদ চক্রবর্তীর অনুবাদে জঁ তারদিয়্যোর একটি কবিতায় ডুব দেয়ার চেষ্টা করলাম।

কি বলি, কি ভাবি? আপন মুখ
দেখাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করে দিনটি
ক্লান্তি আনে শ্রেষ্ট বন্ধুদের
এটা মেনে নিই, চলো এটা মেনে নিই।

অথচ কপট নিশি মিশে যায় আমাদের
প্রতিটি পলকে, আঘাতে আঘাত হানে
চোখের পাতার নিচে, বুকে হাঁটে
বিবিধ বস্তুর চারপাশে

কি উৎকন্ঠা! কি উৎকন্ঠা!
নামহীন এই বস্তুটিকে নিয়ে
যেটি দিনও নয় রাতও নয়
বলো চুপিসারে, তোমাকে তাই বলি
এখানে কিছু না বলাই শ্রেয়!

আবার কলিংবেল বেজে ওঠে। সকালের স্নিগ্ধতার মাঝে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে মালেকা বুয়া দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে। প্রথম দিনের সেই অভিব্যক্তির মতই নিবিড়তায় আচ্ছন্ন তবে গভীরতা তার চেয়ে শতগুন বেশি। খানিকটা দূরে সে দাঁড়িয়ে। বাতাসের শরীরে খোদাই করা মর্মরের প্রতীমা। আমি এক পলক দেখেই বুয়াকে ভেতরে আসতে বলে খাটে এসে বসলাম। বুয়াও খানিকটা সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করল। সে এসে দাঁড়াল দরোজার কাছে। আমার দৃষ্টি প্রচ্ছন্ন বিহবলতায় আবারও তাকে অনুসরণ করল।
দরোজার একটা পাল্লা ধরে নতমুখে সে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন এটাই এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আশ্রয়। নির্জীব এই কাঠের খণ্ডটিও যেন এই প্রথম কোন সদ্য কৈশোর পেরোনো মেয়ের অবলম্বন হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছে। তাকে তাই এই মুহূর্তে মেয়েটির অভিভাবক হিসেবে ভাবতে আমারও ভালো লাগছে। মেয়েটি তার এই সাময়িক আশ্রয়ের আড়ালেই যেন তার সব লজ্জা আর সঙ্কোচ ঢাকার চেষ্টা করছে। তার মুখের যে পার্শ্বদেশ আমার চোখে পড়ছে তা তার সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতা প্রকাশ করতে না পারলেও প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে সার্থকতার সাথেই।

আমি অবশ্য এতটা আশা করিনি। কিন্তু ভাগ্য আমার ভালোই বলতে হবে এই দূরদেশে। আকাক্সক্ষার সীমারেখা অতিক্রম করে প্রাপ্তির ধার ঘেষে যে অনন্যা এসে দাঁড়িয়েছে সে মুগ্ধ করার অবকাশ না পেলেও মোহিত করতে পেরেছে পুরোপুরিভাবেই। আমি তাকে একপ্রস্থ অপলক দেখে নিলাম। মনে মনে শুধু একটি শব্দই উচ্চারণ করলাম- বনলতা সেন। তাহলে কি এই সেই নারী যার জন্য পুরুষকূল হাজার বছর ধরে পথ হেঁটেছে, আগামীতেও হাঁটবে। আমার কথা বলার ইচ্ছা বিলুপ্ত হয়েছিল তাকে এক পলক দেখেই। আর এই মৌনতা আমার এতোদিনকার কাজের মহিলাটিকে খানিকটা বিব্রতই করল। সে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল-
খুব ভালো মেয়ে। বাপ-মা নেই। আমার কাছেই মানুষ। ভীষণ লাজুক। শরীরের ব্যাপার-স্যাপার এখনো বোঝে না। তবে শিখিয়ে নিলে পারবে। ভালো রান্না-বান্না করতে পারে। নিজের হাতেই শিখিয়েছি। এই প্রথম ঘরের বাইরে বেরোল। হাইস্কুলে পড়ছে। তবে আমার দ্বারা আর সম্ভব হচ্ছে না। দেখে শুনে রাখলে ঘরের লক্ষ্মীর মতই হবে। মন্দ বললে কষ্ট পাবে। তবে টু শব্দটি করবে না। সাত চড়ে রা নেই যাকে বলে। আপনার ভাগ্য ভালো।

একটানা কথাগুলো বলে মালেকা বুয়া হাঁফ ছাড়লেন। তার বুকের ভেতর জমানো ভূমিকা এভাবে গুছিয়ে বলতে পারায় তিনি নিজেই যেন খুশি হলেন নিজের উপর। আমি কি বলব বুঝাতে পারলাম না। খুশিতে বুয়ার হাতে পাঁচশ টাকার দুটো নোট গুঁজে দিলাম। নোট দেখে বুয়ার বাকরুদ্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। সেও এতটা আশা করেনি। কিন্তু আমি যখন তার হাতে গোঁজা নোটসহ তার হাত মুঠো করে ধরে বললাম-
আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। এখানে ওর কোন অযতœ হবে না। ওকে আমি নিজের মতো করেই দেখে শুনে রাখব। যখন যা প্রয়োজন ও তাই পাবে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ওর দায়িত্ব আমার। তখন আর বুয়া আপত্তি করার সুযোগই পেল না। তড়িৎ বিদায় নিয়ে চলে গেল। যাবার আগে মেয়েটির হাত ধরে পরক্ষণে আবার তা ছেড়ে দিয়ে শুধু মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল। মেয়েটিও তার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে একবার তাকালো। এমন নিরাসক্ত, নির্জীব চাহনি যে এতটা বাঙময় হতে পারে জীবনে এই প্রথম দেখলাম। চাহনির এ গভীরতা যে আমাকে ডুবিয়ে মারার জন্য যথেষ্ট তা বুঝতে বাকি রইল না।

বুঝতে অসুবিধা হলো না মেয়েটিকে সবকিছু বুঝিয়ে শুনিয়েই নিয়ে আসা হয়েছে। তাই তার লজ্জার পাশাপাশি সে যে খানিকটা প্রস্তুত তা তার অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট। বাসর রাতের জন্য অপেক্ষমান নারীর মত একই সাথে তার শঙ্কা আর আকাক্সক্ষা যেন ধরা পড়ে যায় একটু গভীরতা নিয়ে তার দিকে তাকালেই।

আমি যতটা সম্ভব মিষ্টি করে হেসে মেয়েটির সাথে কথা বলার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করলাম। কিন্তু কেন জানি নিজের হাসিকে নিজের কাছেই লম্পটের হাসির মতো মনে হল। মনে মনে ভাবলাম, যাক মেয়েটি যেহেতু মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে সেহেতু আমার এই অভিব্যক্তি হয়ত তার কাছে ধরা পড়েনি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল মেয়েদের সারা শরীরে চোখ থাকে। খানিকটা বিব্রত বোধ করলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে একটা চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে আহ্বান করলাম। প্রথমবার সে আমার আহ্বান শুনল কি শুনল না বুঝতে পারলাম না। তাই আবারও ডাকলাম। সে অধরোষ্ঠের একপ্রান্ত দাঁতে চেপে তেরছা চোখে আমাকে খানিকটা দেখে নিয়ে চেয়ারে এসে বসল। খানিকটা নিরবতা শেষে আবার আমাকেই কথা বলতে হলো। আর সে-ই বা কি বলবে এই মুহূর্তে। এখানে সে সম্পূর্ণ নতুন। তাই তাকে সবকিছু বুঝিয়ে শুনিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমারই। আমি সে দায়িত্ব পালন করতে প্রবৃত্ত হতে যাব এমন সময় সে মুখ খুলল। চমৎকার উচ্চারণে ঝনঝনে কাঁসার মতো সশব্দে নয়, পত্র পল্লবের মর্মর ধ্বনির মত মিহি কণ্ঠে সে শুধু বললো-
একটা বিয়ে করে নিলেই তো পারতেন? এসব কি অন্যায় নয়?
আমি বলার মত কোন কথা খুঁজে না পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম-
তোমার কি আপত্তি আছে আমার এখানে থাকতে?
আপত্তি থাকলে কি আসতাম? তাছাড়া আপত্তি বা সম্মতি দিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা নির্ধারণ করা যায় না। এটা নৈতিকতার ব্যাপার। সে যাক, মালেকা ফুফু আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলেছেন, আপনার কোন সমস্যা হবে না। আমি জেনে শুনেই এসেছি।
তুমি বোধ হয় ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছ না?
হয়ত না, আবার হয়ত হ্যাঁ। আমি নিজেও স্পষ্ট করে জানি না কোনটা ঠিক। তবে আমার একটা আশ্রয় প্রয়োজন। মাথার উপর একটা ছায়া। এতদিন ফুপু ছিলেন সেই ছায়া। এখন আমি বড় হয়েছি। তার ছায়া আমার  জন্যে যথেষ্ট নয়। আমার শরীর আর মনের জন্যে তার সঙ্গও পরিপূর্ণ নয়। আমার এখন এমন অনেক কিছু প্রয়োজন যা তার কাছে নেই। আর তার জন্যে হাত বাড়ানোর অধিকার আমার আছে। আমি আপনাকে বিয়ে করার কথা বলছি না, একথা বলার মত ধৃষ্টতা আমার নেই। কোনোদিন হবেও না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি আমার প্রয়োজনই এখানে এসেছি। আপনার প্রয়োজন নিয়ে ভাবার মত সুযোগ তো এখনো আমি পাইনি।
- তোমার দৃষ্টিভঙ্গি চমৎকার। আর তা জলের মত পরিস্কার। তোমার      চিন্তার পরিচ্ছন্নতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তুমি যে কোন কথা নির্দ্বিধায় বলতে পার।
- আমাকে রান্নাঘরটা দেখিয়ে দিন। আমি রান্না-বান্নাটা এখনি সেরে ফেলতে চাই। তারপর গোসল সেরে আপনাকে খেতে দেব। অবশ্য আপনার এখানে করার মত কাজের বড় অভাব। আমি বেশি কাজ করতে পছন্দ করি। নিজের কোন কাজ না থাকলে অন্যের কাজ করে দেই। বসে থাকতেই বরং আমার কষ্ট হয়।

আমি তাকে আমার সাথে আসতে বললাম। সে ছায়ার মত আমার পিছু পিছু এসে রান্না ঘরে প্রবেশ করল। দেখিয়ে দেওয়া বলতে যা বোঝায় তেমন কোন ব্যাপার আসলে এখানে নেই। এক পলক তাকালেই সব চোখে পড়ে। তবুও সংক্ষেপে তাকে বুঝিয়ে বললাম। চলে যাওয়ার সময় ঘুরে দাঁড়ালে সে খানিকটা অবাক হলো। আমি মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলাম-
তোমার নামটা কিন্তু জানা হলো না?
- রেবেকা।
- আপনার নাম?
- শফিকুর রহমান। সবাই অবশ্য শফিক বলে ডাকে।
- ধন্যবাদ। সে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করল।
মিষ্টি হেসে আমিও আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম। তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে বিছানায় বসে খানিক পরে বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই স্মৃতির দরজা খুলে গেল চেতনার কিবোর্ডে আঙুল পড়তে না পড়তেই। মনের পর্দায় ভেসে উঠল এই শহরে প্রথম দিনের স্মৃতি।

প্রথম যেদিন আমি এই শহরে এসেছিলাম সেদিন কেন জানি শহরটিকে অস্বাভাবিক শান্ত মনে হয়েছিল। এই শহরটিকে আমার তাই প্রথম দর্শনে কিছুটা নির্জীব এবং গুরুত্বহীনই মনে হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে মনে হল আমার ধারণা পুরেপুরি ঠিক নয়। আমি আস্তে আস্তে অনুভব করতে লাগলাম শহরটিরও প্রাণ আছে। তারও নাড়ীর স্পন্দন আছে। আর সেই স্পন্দনের উৎসমূলে একটা হৃদপিণ্ডও আছে।

এই শহরের উৎসমূল তার বাণিজ্যিক কার্যকলাপ। আশাপাশের অঞ্চলগুলির যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর পাইকারী ও খুচরা বিক্রয় নিয়ন্ত্রণকারী দোকানপাটগুলো এই শহরেই অবস্থিত। তাছাড়া সপ্তাহের বিশেষ দুটো দিনে এই শহরের জন্য নির্ধারিত বাজারের দিন। ঐদিন পণ্যসামগ্রীর সমাহার হয় আরো বেশি। ক্রেতাও থাকে সর্বাধিক। সেই দিন দুটোতে শহরের একটা বিশেষ রূপও ধরা পড়ে। ক্রেতা আর বিক্রেতায় ছোট্ট শহরটি সরগরম হয়ে ওঠে। মনোযোগ সহকারে ছোট্ট শহরটির এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলেও কেন জানি আমি এর সাথে একাত্ম হতে পারছিলাম না। এর নাড়ীর স্পন্দনের সাথে কেন জানি আমার স্পন্দন মেলাতে পারছিলাম না।

সমস্যাটি ছিল আমার একান্ত ব্যক্তিগত। আসলে হঠাৎ করে নিজস্ব বৃত্তের বাইরে এসে আমি কেন জানি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। অবশ্য এই শহরে আমার কোন আপনজন ছিল না। এমন কোন পরিচিত জনও ছিল না যার সাথে সময় আর অনুভূতিগুলো ভাগাভাগি করা যায়। আমি ছিলাম সম্পূর্ণ একা। আর এই একাকীত্ব আমাকে যতটা না বাহ্যিক তারও চেয়ে অনেক বেশি অন্তর্গতভাবে নিঃসঙ্গ এবং নিঃস্ব করে তুলেছিল। আমি কেন জানি কারও বন্ধু হতে পারছিলাম না কিংবা অন্য কেউও আমাকে বন্ধু হিসেবে নিতে পারছিল না।

এটা সত্যি সত্যিই একটা সমস্যা আর আপনিও যদি কখনো এমন একটা সমস্যায় পড়ে থাকেন তাহলে ব্যাপারটা অনুধাবন করা আরও সহজ। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি কিছু একটা বলার জন্যও যেমন কাউকে পাবেন না তেমনি আপনি যদি আশা করেন যে কেউ আপনাকে একটা কিছু বলুক তবে আপনার সে আশাও পূরণ হবে না। আপনার নিজের কাছে মনে হবে আপনি মরুভূমিতে পথ হারিয়ে বসে আছেন তপ্ত বালুর উপর। যদিও দিবসের সূর্য তার স্বাভাবিক নিয়মে ক্রমশঃ মধ্যগগনের দিকে ধাবিত হচ্ছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর অবয়বে কিন্তু আপনার কাছে এই অতীব প্রয়োজনীয় আলো আর উত্তাপটুকুই তখন ভীষণ যন্ত্রণার। আপনি যেন যাত্রী বোঝাই কোন প্লাটফরমের একমাত্র যাত্রী যার অবস্থান অন্যের থেকে পৃথক। তাই আপনিও স্বাভাবিক ভাবেই তাদের থেকে আলাদা। আসলে আপনি সবার মাঝে থেকেও কারো সাথে নেই। আপনি একা এবং খানিকটা নির্বোধের মতই মনে হবে নিজেকে। আমার অবস্থাটা আসলেই এরকম ছিল। আমি বোধহয় প্রকৃত অবস্থাটা বিন্দুমাত্রও বোঝাতে সক্ষম হলাম না।

শুয়ে শুয়ে আমি এসবই ভাবছিলাম। হঠাৎ কেন জানি ভাবনায় ছেদ পড়ল।  খানিকক্ষণ পরেই গোলস সেরে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে সে যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ালো আমি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতেই তার দিকে তাকালাম। তাকে আমার একটা ভেজা পদ্মের সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে হলো।

নীচু গলায় সে আমাকে বললো- খাবার রেডী। আপনি কি এখনই খাবেন?
- হ্যাঁ। গরম গরম নিশ্চয়ই বেশী ভালো লাগবে।
সে হাসলো। সে হয়ত আমার কথার অন্য কোন অর্থও ধরে নিয়েছে। ব্যাপারটা ভালোই লাগলো।

খেতে খেতে আমরা টুকটাক কথাবার্তা বলছিলাম। সেসব কথাবার্তার কিছুটা ব্যক্তিগত, কিছুটা দৈনন্দিন। অবশ্য জীবন এবং যৌবনের কথাও দুএকটা এসে যাচ্ছিল। সে যাই হোক কথাবার্তা যা কিছু হচ্ছিল তাতে তার          দৃষ্টি ভঙ্গির গভীরতাই আমাকে বারবার তার প্রতি মনোযোগী করে তুলছিল। মনে মনে কিছুটা অবাকই হচ্ছিলাম। মফস্বলের একটা ছোট্র মেয়ে জীবনের এতটা গভীরতার সন্ধান পেলো কি করে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি অফিসের জন্যে উঠে পড়লাম। তৈরী হওয়ার সময় তাকে টুকটাক কিছু বিষয়ে অবহিত করলাম যা তার জানা জরুরী। কারন তাকেই এখন থেকে আমার অঘোষিত স্ত্রীর মতোই আমার সংসার সামলাতে হবে। খুব একটা কথা না বাড়িয়ে আমি বেড়িয়ে পড়লাম। স্বাভাবিক হওয়ার জন্যে তাকে কিছুটা সময় একা থাকতে দেওয়া ভীষন দরকার।

বাইরের পৃথিবীটা আমার কাছে কেন জানি অন্য রকম লাগছিল। আসলে সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল। যা কিছু এলোমেলো তা হলো আমার মনের অবস্থাটা। তবে এই এলোমেলোমিটা যে আনন্দের তা আমার এই ফুরফুরে ভাব দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবে। অনেক দিন পর কেন জানি একটা নির্মল আনন্দ বুকের ভেতরের ছোট্র দীঘিটাতে ঢেউ তুলেছে। জমে থাকা অস্থিরতা আর বিষন্নতাকে ছাপিয়ে কি এক অন্যরকম ভালোলাগা এসে ভর করেছে তা ভাবতেই যেন এক ঝাক পায়রা তাদের সোনালী ডানা মেলে স্বর্গের দিকে দিয়েছে উজাড় উড়াল। সত্যি কথা বলতে কি অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়েটি আমার হৃদয়ের উষ্ণতম জায়গাটিতে হাত রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমি বোধহয় একটা কিছুতে জড়াতে যাচ্ছি।      

সেদিনের সেই মুগ্ধতা যেন আজো আমার অস্তিত্বকে সমান আবেদন নিয়েই ছুঁয়ে আছে। যাহোক কোন প্রকার দেরি না করেই আমরা বিয়ে করেছিলাম। সে-ও তার পড়াশুনাটা চালিয়ে গিয়েছিল। দারার যখন জন্ম হয় তখন তার মাস্টার্সের ফল বেরিয়ে ছিল।



তৃতীয় পর্ব ঃ তবুও জীবন


সারাহ পেলিন রিপাবলিকানদের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেয়েছেন। ম্যককেইনের রানিংমেট হিসেবে তিনি কেমন হবেন তা সময়ই বলে দেবে। তবে মহিলা ইতোমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছেন। যদিও এই পথচলা আলাস্কার গভর্নরের জন্য এতোটা সহজ হবে না তবুও চার ঘণ্টার কম সময়ে ম্যারাথন দৌঁড়ানো এই মহিলা এত সহজে হারবার পাত্র নয়। তার দম আছে। সাবেক মিস পিজ্যান্ট আলাস্কা চ্যাম্পিয়ন, মিস আলাস্কা রানার্র্সআপ, আলাস্কার মেয়র এবং বর্তমান গভর্নর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী যে এক সময়ের অত্যন্ত ভালো বাস্কেট বল খেলোয়াড় এবং শেষ মুহূর্তে ম্যাচ জেতার রেকর্ডের অধিকারী এই মহিলার অনেক প্লাস পয়েন্ট আছে। অত্যন্ত স্ট্রেস প্লে করার জন্য একসময় তাকে ‘সারাহ বারাকুদা’ বলা হতো। ভোগ ম্যাগাজিনের কভার তুখোড় গ্ল্যামারাস এই মহিলাকে সামলাতে ডেমোক্র্যাটদের যে হিমসিম খেতে হবে তা বলাই বাহুল্য। সবচেয়ে বড় কথা সিনিয়র সিনেটর জো বিডেনের সামনে তিনি যে প্রাণবন্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তা-ই এখন বিশ্ববাসীর আলোচনার বিষয়বস্তু। নমিনেশনেই তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছেন। পাল্লা এখন রিপাবলিকানদের দিকেই ভারী বলতে হবে।

এদিকে দেশের অবস্থাও নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। ভিআইপি বন্দিরা একের পর এক মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি মুক্তি প্রাপ্তদের জন্য আনন্দের। রাজনীতিবিদদের মুক্তি আমাদের তথা গণতন্ত্রের জন্যও শুভ। কিন্তু সমস্যা হলো এভাবে নির্বিচারে গ্রেফতারের পর আবার এভাবে ঢালাওভাবে মুক্তি দানের বিষয় দেশের প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। আসলে এসব হচ্ছে কি! এতে তো যারা ভালো মানুষ তারাও যেমন বিব্রত হচ্ছে তেমনি যারা খারাপ তারাও যে দ্বিগুন উৎসাহে খারাপ কাজ শুরু করবে না তার তো কোন গ্যারান্টি নেই। জাতি কি আর কখনো তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে। তারা যখন খালাস পেয়েই গেল তখন তো এটাই প্রমাণিত হলো যে তারা নির্দোষ। তাহলে শুধু শুধু এতগুলো ভদ্রলোককে বিব্রত করা কেন?

হঠাৎ করেই লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ততাটা যেন একটু বেশীই বেড়ে গেছে। দুটো বইয়ের কাজ একসাথে চলছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই চাপও একটু বেশী। কিন্তু কেন জানি মাথাটা বেশ ভালো কাজ করছে। কাজের চাপ থাকলেও নিজের ভেতর বাড়তি কোন চাপই অনুভব করছি না। বরং ভালো লাগছে। লেখার গতি দেখে নিজেই বুঝতে পারছি এ লেখা শেষ হতে খুব বেশী সময় লাগবে না। প্রকাশককেও সে কথা অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছি। সে ভীষন খুশী।

সাব্বির সাহেব হঠাৎ করেই একদিন বিকেল বেলায় এসে হাজির হলেন। হাসি হাসি মুখ করে বললেন, চা খাওয়ার জন্যে চলে এলাম। অসুবিধা নেই তো।

আমি না হেসে পারলাম না। হাসতে হাসতে বললাম- অসুবিধা আছে। চায়ের দাম সঙ্গে এনেছেন তো?
তিনি অবাক হয়ে বললেন, মাণে!
আমি বললাম- যেভাবে বললেন তাতে তো মনে হলো কোন একটা চায়ের দোকানে এসে ঢুকেছেন। সামান্য চা খাওয়ার জন্যে এতটা জবাবদিহিতা। তাই বললাম আর কি।

তিনি আর না হেসে পারলেন না। হো হো করে এক প্রস্থ হেসে বললেন- আমি ভাবলাম না জানি আবার কি। আপনার রসিকতাটা সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারিনি।

সুজাতা আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইল। আমি কোন ভনিতা না করেই হ্যাঁ বলে দিলাম। মুরাদ সাথে সাথে ফোন করে তার ভাইদের খবরটা জানিয়ে দিল। দুজনই তারিখ জানতে চাইল। মুরাদ ভারী গলায় বললো-তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। ঠিক হলে পরে জানাবো।

কুতুবউদ্দিন খুশি হলো। খুশি হলো সাব্বির সাহেবও। আমি কিছুটা চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু মুরাদ সেটা বুঝতে পেরে নিজের থেকেই আগ বাড়িয়ে  আমাকে বললো- আমি ওনাকে মা বলে ডাকতে রাজি আছি। আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না সুজাতা কিভাবে  মুরাদকে এতোটা জয় করে নিলো।

আমি কেন জানি হেসে ফেললাম। মুরাদও হাসল।


Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

UCPDC - 600 Bangla

ইউসিপিডিসি-৬০০ ধারা-১ঃ ইউসিপিডিসি-এর প্রয়োগঃ ইউসিপিডিসি এর ২০০৭ সালের সংশোধনী আইসিসি পাবলিকেশন ৬০০ এর বিধি বা ধারাসমূহ (স্ট্যাণ্ড বাই লেটার অব ক্রেডিট সহ) সকল এলসিতে প্রয়োগ হবে। এলসিতে নির্দিষ্ট কোন স্থানে উল্লেখ না করলে তা সকল পক্ষের উপরই কার্যকর হবে। ধারা-২ঃ সংজ্ঞা ঃ অন্য কোন অর্থে ব্যবহার না করলে এই বিধিতে এ্যাডাভাইজিং ব্যাংক বলতে সেই ব্যাংককে বোঝাবে যে ইস্যুইং ব্যাংক এর অনুরোধে ঋণপত্র সুবিধা প্রদান করে। গ্রাহক বলতে সেই পক্ষকে বোঝাবে যার অনুরোধে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়। ব্যাংকিং কর্ম দিবস বলতে সেই দিনকেই বুঝাবে যেদিন ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট স্থানে উক্ত বিধি অনুযায়ী নিয়মিতভাবে তার প্রত্যাহিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বেনিফিসিয়ারী বলতে সেই পক্ষকে বুঝাবে যার পক্ষে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। কমপ্লাইং প্রেজেণ্টেশন বলতে সেই প্রেজেণ্টেশনকে বুঝাবে যা ঋণের সকল শর্তানুযায়ী করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আদর্শ ব্যাংকিং চর্চার আওতাধীন। কনফার্মেশন বলতে কনফার্মিং ব্যাংক এর পাশাপাশি ইস্যুইং ব্যাংক কর্তৃক সুনির্দিষ্টভাবে একটি কমপ্লাইং প্রেজেণ্টেশনকে অনুমোদন ঝুঝায়। কনফার্মিং ব্যাংক বলতে সেই ব্যাংককে ঝুঝা

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে