একটি যুদ্ধের খসড়া
আমি আমার বাবার হাত ধরে হাঁটছিলাম। পাশাপাশি। বাবা আমাকে বললেন-জীবনে যারা তাদের দিকে ছুটে আসা আগুনের গোলা হাতের মুঠোয় ধরে মুখে পুরে নিয়ে পেটের মধ্যে গিলে হজম করে ফেলতে পারে কেবল তারাই অনেক বড় হতে পারে। আমি বাবার কথায় অবাক হলাম না মোটেই। কারণ তিনি সবসময়ই দার্শনিকের মতো কথাবার্তা বলেন। বেশির ভাগ পরাজিত মানুষের মধ্যেই দার্শনিকের একটা প্রেতাত্মা বসবাস করে। আমার বাবাও তার ব্যতিক্রম নন। তবু আমি তাকে একটু ঝালাই করার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম-তুমি কি তোমার জীবনের দিকে ছুটে আসা আগুনের গোলাগুলো হজম করতে পেরেছিলে?
সে বিমর্ষ মুখে আমাকে বলল-না, পারিনি। আর সে জন্যই আমি ব্যর্থ মানুষ। আমার দিকে ছুটে আসা আগুনের গোলাগুলি আমার বুকে-পিঠে লেগেছিল। আমি তাতে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু তোমাকে পারতে হবে। বাবা যোগ করলো।
আমি বললাম-তুমি কেমন করে ভাবলে যে একজন পরাজিত মানুষের
সন্তান সফল হবে?
হবে। বাবা বলল।
আমি তার আস্থা দেখে খানিকটা অবাক হলাম। সে আমাকে আশ্বস্ত করতেই যেন বলল-পদ্ম কোথায় জন্মে জানো? কাদায়। আমি তোমার জীবনের সেই কাদা। আমার ভেতর দিয়েই তোমার জন্ম হবে। আমি আস্তে আস্তে মাটিতে মিশে যাব। তুমি ফুল হয়ে ফুটে উঠবে। জগতে কোনো চেষ্টাই বৃথা যায় না। আমার এই চেষ্টাও বৃথা যাবে না।
বাবার এই কথায় আমার ভালো লাগলেও খানিকটা মন খারাপ হলো এই জন্যে যে আমি আমার চোখের সামনে আস্তে আস্তে বাবাকে বর্ষার জলে ভেজা মাটির মতো কাদায় পরিণত হতে দেখলাম। সেই কাদার ভেতর দিয়ে একটা ফুল ফুটে উঠছে। আমি শক্ত করে বাবার হাত ধরলাম। বাবাকে আমি কিছুতেই হারিয়ে যেতে দিতে চাই না। পৃথিবীতে আমার বাবাই আমার কাছে সব। কারণ আমার মা শৈশবেই আমাকে আমার বাবার কাছে ফেলে রেখে চলে গেছেন। মায়ের কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই।
আমি প্রসঙ্গ বদলাবার চেষ্টা করলাম। জামাল চাচ্চুর কথা তুললাম। জামাল চাচ্চু জীবনের দিকে ছুটে আসা কোনো প্রকার আগুনের গোলা হজম না-করেই দিব্যি সফল মানুষে পরিণত হয়েছে। ধনী ঘরের মেয়ের সাথে প্রেম করে বিয়ে করায় এখন তার হাতে রাজ্য আর রাজকন্যা-দুটোই গড়াগড়ি খায়। বাবা বললেন-ওর কথা রাখ। ও একটা স্ত্রৈন। কাপুরুষ। ওকে আমি ঘৃণা করি। মানুষ হতে পারলো না।
অথচ এই জামাল চাচ্চুকেই আমার বাবা কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন। আমি শুনেছি এই নিয়ে আব্বু-আম্মুর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হত। সংসারের এমনই আরো অনেক সমস্যা অতঃপর তাদের দুজনকে দুই মেরুতে পাঠিয়ে দিল। আম্মু অন্য একজনের হাত ধরে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো। আমি মায়ের কোল থেকে ছিঁটকে সরাসরি মাটিতে না-পড়ে বাবার বুকে এসে পড়লাম। বাবা আমাকে মায়ের স্নেহ-মমতা দিয়ে বড় করে তুলেছিলেন।
এখন আমার বার চলছে। বয়স মন্দ নয়। কেমন একটা হিরো হিরো ভাব। সবকিছু অন্যরকম। শারীরিক গঠন হৃষ্ট-পুষ্ট হওয়ায় এই বয়সেই সবাই অবাক হয়ে তাকায়। কী যেন দেখে। কী যেন একটা খোঁজে আমার ভিতর। আমি সব চাহনির অর্থ বুঝি না। বাবা আমাকে কঠোর পরিশ্রম করান। তবে সেটা কাজ নয়। প্রশিক্ষণ। শারীরিক প্রশিক্ষণ। প্রতিদিন কম করে হলেও চার ঘণ্টা। বড় হলে আমাকে মনে হয় তিনি সৈনিক বানাবেন। কিন্তু আমি যতটুকু জানি বাবা সৈনিকদের ঘৃণাই করেন। একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন-ওরা দেখতেই যা। ভেতরে পদার্থ বলতে কিছুই নেই। নির্বোধের মতো বিদ্রোহ করে। তারপর নিজেদের হাতেই গুলিতে অথবা কোর্ট মার্শালে মারা পড়ে। অপদার্থ।
যুক্তিটা আমার কাছে মন্দ লাগেনি। তাহলে আমার এই কঠোর পরিশ্রম কেন? কী হবে আমাকে দিয়ে? একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম-বড় হয়ে আমি কী হব বাবা? বাবা ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিলেন-সৈনিক হবে। আমি চমকালাম। বলে উঠলাম-অপদার্থ। বাবা ব্যস্ত হলেন না। বললেন- জীবনের সৈনিক। অস্ত্রধারী নয়। খালি হাতে যে যুদ্ধ জিততে পারে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না জীবনের সৈনিক জিনিসটা আসলে কী? বাবা বললেন-একজন সংগ্রামী মানুষ। জীবনের সাথে যে লড়াই করতে জানে এবং সেই সাথে জিততেও। আমি তোমাকে পরাজিত হতে দিতে চাই না। সাহস, শক্তি আর বুদ্ধিমত্তা-এই তিনটা জিনিসই তোমার প্রয়োজন। আমি খেয়াল করেছি তুমি জন্মেছো এর সবগুলো নিয়েই। এখন আমার কাজ তোমাকে ঝালাই করা। মেরামত করা। তারপর সঠিকভাবে আকৃতি দান করা। যাতে তুমি তোমার আসল রূপ ফিরে পেতে পার। তুমি আসলে আমার ছায়া বৈ আর কিছুই নও। আমি মনে করি আমার স্বপ্ন তোমার মধ্যে দিয়েই পূরণ হতে পারে। তুমি তা পারবে। এই বিশ্বাস আমার আছে।
বাবার কথায় নিজেকে আরো আত্মবিশ্বাসী লাগে। মনে হয় আমি যেন সেই ট্রয়ের বীর হেক্টর। কিংবা স্পার্টার একিলিস। আমি যে-ই হই না কেন জিততে আমকে হবেই। কিন্তু যুদ্ধ কবে হবে! জীবনের যুদ্ধ। বাবাকে প্রশ্ন করতে সাহস পাই না।
বাবা বুঝতে পারেন। তিনিই উত্তর দিয়ে দেন-একদিন আপনা আপনিই তোমার সামনে যুদ্ধ এসে হাজির হবে। তখন তৈরি হবার সময় থাকবে না। এখনি তৈরি হতে হবে। তৈরি হতে সময় লাগে।
সে আসবে
হেডমাস্টার সাহেব ঠায় বসে আছেন। তার কণ্ঠ নির্বাক। তার চক্ষু স্থির। তার ঠোট ভাষাহীন। তার ভেতর অদ্ভুত একটা সৌম্যতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবশ্য তিনি বরাবরই এমন। তবে আজ কোথায় যেন একটা ভিন্নতা আছে। মনে হয় তিনি খানিকটা ঐশ্বরিক।
সবাই সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে এর মধ্যেই। শুধু তিনি একাই অগোছালো। তার অবশ্য তেমন একটা প্রস্তুতিও নেই। বুড়ো মানুষ। টুকটাক কিছু কাপড়চোপড়। তিনি নিজেই নিজেরটা সামলান। এটা সবারই জানা। তাই কেউ হাত দিতে সাহস পাচ্ছে না।
বাড়ি ছেড়ে যাবার ঘটনায় কাউকে খুব একটা দুঃখী হতে দেখা যাচ্ছে না। মানুষের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে যে কোনো পরিস্থিতেই সে নিজেকে মানিয়ে নেয়। তাই তো বন্যার মধ্যেও ধর্ষণ। ভূমিকম্পের মধ্যেও লুট। অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে সবকিছু ঘটতে দেখা যায়।
সাইদুলকে কেন জানি একটু বেশিই অস্থির মনে হচ্ছে। রেবেকা বুঝে উঠতে পারছে না তার সমস্যা কোথায়। রওনা হবার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই তৈরি। দু’দুটো গাড়ি নিয়ে দুইজন ড্রাইভার প্রস্তুত। বাচ্চাগুলোকেও যথেষ্ট সাজোনো হয়েছে। সে নিজেও যুৎসইভাবে তৈরি হয়েছে। রেবেকা তো যেন কুইন অব সেবা বিলকিস। লাগেজ ভর্তি কাপড়চোপড় আর প্রয়োজনীয় নগদ টাকা পয়সা। সব মিলিয়ে বিচিত্র এক আয়োজন। চার জন কাজের লোক হিমসিম খাচ্ছে।
নাসার প্রকৌশলী সাইদুল মূলত আমেরিকা প্রবাসী। ঢাকায় বাড়ি, গাড়ি সবই রেডি আছে। রেবেকা কখনো ঢাকায়, কখনো আমেরিকায়। বাচ্চাদের অবস্থা স্যান্ডউইচের মতো। অবশ্য সমস্যা তেমন কিছুই নেই। সাইদুল গ্রামের ছেলে হলেও রেবেকা ঢাকার প্রতিষ্ঠিত পরিবারের মেয়ে। তাদের দেখাশোনা মূলত তার বাবার বাড়ির লোকজনই করে। আলালের ঘরের দুলালীর যা হয়।
হেডমাস্টার সাহেবের সমস্যা অত্যন্ত সাধারণ। সামান্য কিছু টাকা দেনার কারণেই তাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হচ্ছে। তার ছেলে সন্তান বলতে তেমন কিছুই নেই। মাত্র দুটো ছেলে ছিলো। একটা হিরোইন খেতে খেতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অন্যটা সন্ত্রাসী। হয় সন্ত্রাসী বন্ধুদের হাতে মরেছে না- হয় পুলিশের এনকাউন্টারে খালাস হয়ে গেছে। সাংবাদিকরাও নিশ্চিত করে কিছু লিখতে পারেনি। তবে তার ঘর উজ্জ্বল করে আছে পাঁচটি কন্যাসন্তান। তিনটি বিয়ের যোগ্যা। বাকি দুটি এখনো পড়াশোনা করছে। এদের নিয়েই তার যত চিন্তা। কিন্তু মেয়েদের অতটা চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তিনি নিজে দুর্ঘটনার শিকার না-হলে ভবিষ্যৎ অন্যরকম হতে পারতো।
এই বাড়ি অনেক আগেই বিক্রি করা হয়েছে। এতদিনে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মেয়েদের নিয়ে ওঠার মতো আর একটা আশ্রয় তার দরকার। সে ব্যবস্থা এখনো হয়নি। তবে হাতে তার সময় নেই। আগে এটা ছেড়ে বের হতে হবে তারপর নতুন গন্তব্য খুঁজে নেওয়া যাবে। বাড়ি যে কিনেছে সে আসছে আজ। তার চলে আসার আগেই হেডমাস্টার সাহেবের চলে যাওয়া উচিত। নইলে ব্যাপারটা অপমানজনক।
সাইদুল তার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র ছিল। ভীষণ মেধাবী ছাত্র ছিল সে। মেট্রিকুলেশনে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলো। হায়ার সেকেন্ডারিতেও একই রেজাল্ট। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স করে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে যোগদান। সেখান থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় গমন। অতঃপর পিএইচডি এবং নাসায় যোগদান। তারপর টানা একযুগ সেখানে কর্মরত থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে দেশে।
বাপ-দাদার ভিটে বলতে তার তেমন কিছুই নেই। আর সে জন্যেই সে গ্রামে একটা বাড়ি কিনতে বলেছিলো উঠতি জমির দালাল কালু শেখকে। কালুই এই বাড়ি তাকে কিনে দিয়েছে।
সাইদুলের নতুন বাড়ি একেবারে মন্দ নয়। ঢাকা থেকে এই এলাকা খুব একটা দূরে নয়। ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারলে ঘণ্টা তিনেকের পথ। পথের অবস্থা ভালোই। তারা যথা সময়ে পৌঁছে গেল।
কালু শেখ এই এলাকার উঠতি জমির দালাল। হাতে কাঁচা পয়সা। তবে তার আলাপ ব্যবহার একেবারে মন্দ নয়। তিনি সকাল সকাল এসে পৌঁছেছেন। হেডমাস্টার সাহেবের বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারটা তত্ত্বাবধান করছেন।
মেয়েরা মোটামুটি নির্বিকার। তাদের নানাবাড়ি বলতেও তেমন কিছুই নেই। যা ছিলো তা নদীতে গেছে। তাদের মা এক বাপের এক সন্তান। সেও মরে বেঁচেছে। তাদের মূলত যাবার তেমন কোনো জায়গা নেই। তবে তারা যে খুব একটা অসুখী দেখে তেমনটা মনে হচ্ছে না। তাদের কারও কারও মুখে খানিকটা হাসিও দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা তাদের কাছে একটা অভিযানের মতই মনে হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। যে কেউ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারে। এ আর এমন কি।
হেডমাস্টার সাহেব জানেন এ বাড়ি কে কিনেছে। তার এক সময়ের মেধাবী ছাত্র সাইদুল। জানে কালু শেখও। সে তাই চিন্তিত। এখন সাইদুল এসে দেখলে তাকে বিব্রত হতে হবে। এই বাড়ি বেচাকেনার জন্যে সে একটা ভালো কমিশন পেয়েছে। হেডমাস্টার সাহেবও ভালো টাকা পেয়েছিলো। বিদেশে উপার্জন করা পয়সা। সাইদুল কালু শেখের কথা মতোই টাকা দিয়েছে। দেন-দরবার করেনি। অতকিছু করার মতো সময়ও তার হাতে নেই। ব্যস্ত বিজ্ঞানী। কিন্তু বাড়িটা মূলত কার সে তা জানে না।
হেডমাস্টার সাহেবের অপেক্ষার কারণ মূলত একটাই। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্যে তার তেমন কোনো দুঃখ নেই। জেনে শুনে তিনি জীবনে এই একটা বিবেকহীনের মতো কাজ করেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত ছাত্রের কাছে তার অজান্তে তার বাড়িটা বিক্রি করেছেন। সেই টাকায় তাহার পাহাড় সমান দেনা শোধ করেছেন। আবার মনে মনে এটাও আশা করেছেন যে যখন সাইদুল জানবে তখন তার সফল ও সম্পদশালী ছাত্রটি হয়তো বাড়িটা তাকে ফেরত দেবে। শত হলেও তার প্রিয় স্যারের বাড়ি। এটা সে হয়তো কিছুতেই নিতে পারবে না। অন্য কেউ এই দয়া দেখাবে না। একদার বামপন্থী আদর্শবাদী শিক্ষক যার আদর্শ ছিলো ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, ভগত সিং সে-ই কিনা এমন একটা নিচুতার পরিচয় দিতে পারলো। বিবেকের এই পরাজয় সেই কিছুতেই মানতে পারছে না। এটা তাকে তিলে তিলে দংশন করছে। সে হেরে গেছে জীবনের শেষ খেলায়।
সাইদুল রেবেকাকে নিয়ে যে বাড়িতে ঢুকছে সেটা তার চেনা চেনা লাগছে। তবে গ্রাম অনেক বদলে গেছে। সে ফিরেছে একযুগেরও বেশি সময় পর। কেউ তাকে চেনে না। সেও তেমন কাউকে চিনতে পারছে না। কিন্তু তবুও তার কাছে কেমন যেন মনে হচ্ছে। সে গাড়ির ভেতর থেকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে। অবশেষে সে নিশ্চিন্ত হলো এটা তার স্যারের বাড়ি।
সে কালু শেখকে বলল-এটা তো হেডমাস্টার স্যারের বাড়ি।
কালু শেখ বলল-জ্বী। কালু শেখের ঠাণ্ডা জবাব।
সে বলল-এখানে কেন?
কালু শেখ উত্তর দিল-এটাই আপনার বাড়ি।
মানে? তার স্বরে রাগ।
আপনার স্যার বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে।
সাইদুল শুধু বলল-হোয়াট!
স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করে সাইদুল বলল-আমি সব বুঝতে পেরেছি স্যার। আমি এও জানি আপনি কেন অপেক্ষা করছেন। বিবেকের দংশন থেকে বাঁচার জন্যে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে। তবে তার আর দরকার হবে না। এটা এখন থেকে আমার বাড়ি। আর আমি আপনার ছেলে। তবে আপনারা আর এখন থেকে এখানে থাকছেন না। আমার ঢাকার বাসায় উঠবেন। ওখানে সব আধুনিক ব্যবস্থা আছে। ওরা সবাই ওখানে ভালো থাকবে।
এই গল্পের একটু অংশ বাদ পড়ে গেছে। সাইদুল মূলত পিতৃ-মাতৃহীন একজন এতিম। হেডমাস্টার সাহেব ভালো শিক্ষার জন্য সাইদুলকে শহরে তার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সে গৃহস্থের মহিলা ছিল সাক্ষাৎ ডাইনী। হেডমাস্টার সাহেব তার স্বল্প আয়ের মধ্য দিয়ে নিজের সন্তানদের মানুষ করতে পারেননি। কিন্তু সাইদুলকে মানুষ করার চেষ্টা করেছিলেন। সাইদুলকে দেখতে প্রায়ই তিনি শহরে যেতেন। সাইদুলের সাথে দেখা করতেন। হাতে যতটুকু পারতেন টাকা-পয়সা গুঁজে দিতেন। কিন্তু সাইদুলের পড়াশুনা কিছুই হচ্ছিল না। সাইদুল এসব কথা স্যারকে বলতে পারেনি। কারণ সে জানতো আর কোনো বিকল্প নেই। তাকে মানুষ হতে হবে। পাছে স্যার কষ্ট পায়।
তারপর একদিন বাসা ছেড়ে উধাও। সরাসরি রেবেকার বাবার হাতে। সেখানে মানুষ। সফল জীবন। রেবেকার সাথে এমএসসি। তারপর প্রেম, প্রণয়, বিয়ে। অতঃপর তিন তিনটে ছেলে সন্তান। লজ্জায় দুঃখে সে আর কখনো স্যারের সামনে আসেনি। অবশ্য শেষের দিকে আর ইচ্ছে থাকলেও আসা হয়নি। পড়াশুনা শেষ করে সরাসরি চাকরি। অতঃপর আমেরিকা। তারপর একযুগ। একেবারে কম সময় নয়।
সবকিছু বদলে গেছে। সে-ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে দেশের মাটি থেকে। শেষ পর্যন্ত এভাবে ফিরে আসার মধ্যে দিয়ে সাইদুল যেন একটা পরিপূর্ণ জীবন ফিরে পেয়েছিল।
এ গল্প এখানেই শেষ করতে হবে। কারণ সামনে আগানোর মতো কোনো সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই। তাছাড়া আমাকেও অফিসে যেতে হবে। ব্যাংকের চাকরিতে ঝামেলা একটু বেশিই। আর একথা ভুললে চলবে না যে, জীবন একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা কেউই এর থেকে আলাদা নই।
বেদনার নীল রং
কফি হাউজ থেকে বের হয়ে খানিকটা সামনে গিয়েই আবার কী যেন কী মনে করে নিজের জায়গায় এসে বসে পড়ল রেহেনা। আসলে সজলকে নিয়ে এই টেবিলে বসে সে এ পর্যন্ত কম করে হলেও হাজার কাপ কফি শেষ করেছে। সেই সজল আজ নেই। তার স্পর্শের এই টেবিল চেয়ারগুলোকে সে এত সহজে ফেলে যেতে পারছে না। তার জন্যই হয়তো আবার ফিরে আসা।
সজল থাকলে দারুণ লাগতো। ও কফি ভীষণ পছন্দ করতো। খুব আয়েশ করে খেতো। রেহেনারও কফি পছন্দ। কিন্তু কেন জানি সজলের মতো অতটা আন্তরিক ভঙ্গিতে আয়েশ করে খেতে পারতো না। তার মনে হতো সজল যেভাবে প্রতিটা চুমুকে স্বাদটা গ্রহণ করছে সে ঠিক সে ভাবে স্বাদটাও গ্রহণ করতে পারছে না। সজল আসলে কফির কাপে ডুব দিতে পারত। রেহেনার পক্ষে তা কখনই সম্ভব হয়নি।
কফি হাউজটির মালিক রেহেনা নিজেই। কফির প্রতি দুর্বলতা থেকেই কফি হাউজ বানানোর আইডিয়া। তার পর পাকা ব্যবসায়ী। দিনে দিনে শুধু উন্নতি। পরিবারের মধ্যবিত্ত ভাবটা কাটিয়ে কিছুটা উচ্চবিত্তের ধাচ। এসবই মাত্র কয়েক বছরের ঘটনা।
একবার হঠাৎ এক বৃষ্টিভেজা দিনে কোথা থেকে এক ছোকরা এসে কফি খেতে চাইল। আর অমনি রেহেনাও তার টেবিল থেকে উঠে এসে হাসি মুখে আলাপ জমালো। সে হিসেব সে নিজেও আজও মেলাতে পারছে না। কিন্তু সেই ছেলেটি যে আর দশটা ছেলের মতো মামুলি কোনো ছেলে নয় তা রেহেনা টের পেল সামান্য আলাপচারিতার পথ পেরোতেই।
মোজার্ট-এর যে সিম্ফনিটা তখন কফি হাউজের প্লেয়ারে বাজছিল সেটা যে সন্ধ্যার সাথে মানানসই নয় তা সজলই প্রথম তাকে ধরিয়ে দিল। সে বরং মোজার্ট থামিয়ে রেহেনার কালেকশনে সামান্য চোখ বুলিয়ে কেনি জি’র সেক্সোফোনের একটা সিডি তুলে নিল। তারপর কম সাউন্ড দিয়ে বাজাতে শুরু করল। রেহেনার দারুণ পছন্দ হল বিষয়টা। সে বেশ খানিকটা চাঙ্গা অনুভব করতে লাগল। সেই সন্ধ্যা গড়িয়ে গভীর রাত হল। রেহেনা বাসায় যাবার কথা ভুলে গেল। অবশেষে বাসা থেকে তার ছোট ভাইটা এসে তাকে জানালো যে রাত অনেক হয়েছে। তার এখন দোকান বন্ধ করা উচিত।
রেহেনার দোকান তার বাসার সাথেই সংযুক্ত। একটা সেমি-কমার্সিয়াল ভবনের দোতলার পুরোটা সে ভাড়া নিয়েছে। সামনের দিকটা কফি হাউজ। পিছনের দিকটায় থাকার ব্যবস্থা। সাউন্ডপ্র“ফ দরজা লাগিয়েছে কফি হাউজে। গান-বাজনার শব্দ তাই বাইরে যায় না।
অবশেষে সজলকেও উঠতে হল। সজল ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। মধ্যবিত্ত ঘরের টিপটপ ছেলে। দেখতে শুনতে মন্দ নয়। সব চেয়ে মজার ব্যাপার সে কথা বলতে জানে। রেহেনা তার কথার কাছে হার মেনেছিল। সে মজা করতেও জানে বটে। একদিন কথায় কথায় রেহেনা জিজ্ঞেস করেছিল- আমাকে তোমার কেমন লাগে। সজল হেসে বলেছিল-পেঁচার মতো। চোখের চাহনিতে ঐ রকম একটা ধার আছে। রেহেনা তো হেসেই খুন। কী অদ্ভুত ব্যাখ্যা।
সজল ওরকমই। রেহেনা নিজেও তা জানতো। তাই সজলের কোনো কথায় সে কখনো কিছু মনে করেনি। আর এভাবেই গড়ে উঠেছিল তাদের ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসা হলেই তো আর সবকিছু হয়ে যায় না। তাকে সার্থক করতে হয়। তারা বিয়ের সিন্ধান্ত নিয়েছিল।
কখনো কখনো স্বপ্নের সাজানো বাগানও ভেঙে খান খান হয়ে যেতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগে না। আসলে সুখ থাকতে হয় কপালে। নইলে বর সেজে আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় এত লোক থাকতে একমাত্র সজলই বা মারা যাবে কেন।
রেহেনাও জীবনের এই নির্মম সত্যকে অত্যন্ত সহজভাবেই নিয়েছিল। সবই ঠিক আছে। সে শুধু তার ব্যাবসাটা পরিবর্তন করেছে।
স্ত্রী
মাস্টার্সের শেষ পরীক্ষাটা শেষ করে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম বাইরে তখন ভর দুপুরের নিস্তব্ধতা রোদ্দুরের সাথে মিলেমিশে একাকার। আমি আমার নিজের ভেতরেই যেন খানিকটা সময়ের জন্যে স্থির হয়ে গেলাম। মুহূর্তের এই স্তব্ধতা আমাকে কাল-মহাকাল পেরিয়ে সুদূর অতীতে নিয়ে যেতে না-পারলেও আমার ছোট্ট এই জীবনের কক্ষপথে এক প্রস্থ ঘুরে এলো। মস্তিষ্কের পাঠানো যে তার বার্তা আমার কানে সুস্পষ্ট বেজে উঠলো তার অর্থ হলো এই যে আমার প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষার এখানেই শেষ। হঠাৎ ইচ্ছে করলে এরপরও আমি অনেক দূর যেতে পারি। কিন্তু সে যাওয়ার তাৎপর্য কিছুটা হলেও ভিন্ন। মানুষ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্তই জীবনের পথ ধরে হাঁটে। আসলে পৃথিবীতে তাকে পাঠানো হয়েছিল শিখতে এবং আদম হাওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সে কেবল শিখেই চলেছে। কিন্তু আমার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই দুষ্ট বেড়াজাল ছিন্ন করে মুক্তির আস্বাদ নেওয়ার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। কিন্তু পার্থিব সাদামাটা বাস্তবতার জটিল অক্টোপাস অত সহজে কাউকে ছাড়তে চায় না। তাই হয়ত এতটা দেরি। যা হোক শেষমেষ এ পর্যন্ত এসে হলেও তো মুক্তি মিলেছে। এই সমস্যার আপাত সমাধানটুকুই বা কম কিসে?
একটু আগে ভাগেই পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়েছিলাম বলেই ভাবনার এই অবকাশটুকু পাওয়া গেল। ভালোবাসতে না-পারলেও সাত বছর ধরে যার বুকের ভেতর ছিলাম আজ তার সাথে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় কিছুটা খারাপই লাগছে। কিন্তু ততক্ষণে সবাই বেরিয়ে এসেছে। কিছু বলা আর কিছু না-বলা কথার মিলিত প্রবাহের মধ্যে দিয়ে আমরা যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পৃথক হয়ে গেলাম। জীবন আসলে এমনই। প্রয়োজনই এখানে যেমন একত্রিত করে আবার তার নিঃশেষই টেনে দেয় বিদায়ের সীমারেখা। আমরা আসলেই কি হাস্যকর এবং নির্বোধ?
পাষাণে গড়া কালো রং রাস্তার ওপর ঝরা পাতার শুষ্কতা আধুনিক পায়ের নিচের কৃত্রিমতায় দলিত মথিত হয়ে যায়। আমরা সামনে আগাই। আরও সামনে। সময় এবং সার্থকতার দিকে ক্রমশ এই হেঁটে যাওয়ার ভেতরের গূঢ় রহস্য হৃদয়ের গভীর ভাবনায় তালিয়ে যাওয়ার আগেই একটা নিঃস্ব বিকেল এসে সামনে দাঁড়ায়। জীবনে এই বুঝি প্রথম কোনো বিকেল এলো বন্ধনহীন হওয়ার। পড়ার টেবিলের সাথে এই প্রথম শর্তহীন বিচ্ছিন্নতা। আমি এখন যে কোনো দিকে হেঁটে যেতে পারি। আমার জন্য আর কোনো পাঠ্যক্রমের বাধ্যবাধকতা অপেক্ষা করে নেই। কিন্তু আমি কোথায় যাব?
শেষ বিকেলের সোনালি আলোর নিচে একজন নিঃস্ব মানুষের হেঁটে যাওয়া কারো তেমন করে চোখেই পড়ে না। তবু সে হেঁটে যায়। হাজার বছর ধরে দৃষ্টির আড়ালের ধীর গতিতে হীমবাহের মতো তার চলাচল এক সময় তাকে খানিকটা হলেও আস্তিত্বের উৎসমূল থেকে সরিয়ে নিয়ে স্থাপন করে রাজপথের গতিশীলতায়। সে আসলে গতিই চায়। জীবনের জন্যেই এই গতি তার প্রয়োজন। আসলে গতিই হচ্ছে জীবন। জড়তাই মৃত্যু। আর মৃত্যুকে কে-না ভয় পায়।
মাথার উপর মেঘমুক্ত আকাশি রঙের ছাউনিতে সুনীল আকাশে আজ ভিন্ন কোনো তাৎপর্য না-থাকলেও তার স্বাভাবিকতাই বা কম কিসে। চারপাশে যান্ত্রিক জীবনের অগুণতি প্রসঙ্গে সীমাহীন ব্যস্ততার শরবিদ্ধ মানুষগুলোর অদৃশ্য যন্ত্রণাকর মুখগুলো যেন খানিকটা হলেও বিবর্ণ। আমি নিজেও হয়ত এর অন্যতম অংশীদার। কিন্তু এ মুহূর্তে অনুভূতির ভিন্নতা আমাকে যে স্বকীয়তা দিয়েছে তার মৌলিকত্ব যেন নিংড়ানো কষ্টের নির্যাস ছাড়া আর কিছু নয়। জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আজ কেন জানি কী এক নিঃস্ব অনুভব আমাকে এলামেলো করে দিয়েছে। আমি অবশ্য ততক্ষণে কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছি।
এখানে দৃশ্যপট খানিকটা হলেও ভিন্ন। সবাই আপাত অলস এবং যে যার অনুভূতি আর অবস্থানের ভিন্নতায় উজ্জ্বল কিংবা বিমর্ষ। এর প্রকৃতি অবশ্য জটিল আর তার বর্ণনাও কষ্টসাধ্য। তবে শুধু প্রকৃত এবং প্রতারকের সংমিশ্রণে ব্যাপারটা যে কিছুটা হলেও গোলমেলে তা অস্বীকার করার উপায় নেই কারোরই। তবে জানা থাকতে হবে বিষয়টা। আর হুট করে এসে পরারও উপায় নেই। কারণ সব কিছুই নিখুঁত এবং চাতুর্যের দ্বারা আক্রান্ত। তাই কিছুটা হলেও সংমিশ্রিত তবুও তা গতিশীল কারণ জীবন এমনই। তার দুয়ার যেন সবার জন্যই খোলা।
আমি অবশ্য অপেক্ষারত এবং তা শুধু ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নেওযার জন্যে। আজ কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে তাকে কথাটা বলা দরকার। তাকে জানিয়ে দেয়া দরকার যে এতদিন ধরে তুমি যা জানতে চেয়েছ তার সত্যিকারের স্বরূপ আজই আমার অস্তিত্বের মর্মমূল থেকে স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে এসেছে। আমি নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছি যে আমার অন্তর কিছু একটা চায় আর সে হলো তুমি। এখন তুমি তোমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পার। তুমি কি খুশি হয়েছো?
সে আমরা হাত ধরল। আমি অবাক হলাম না মোটেই। তবে এই নির্ভরতা যা আমাদের দুজনের মধ্যে নতুন করে জন্ম নিল তা আমাকে কেন জানি একটা স্বস্তির মধ্যে নিক্ষেú করল। আমার কাছে জীবনের অর্থটাই পুরোপুরি বদলে গেল। আমার মনে হল আমি কী যেন একটা পেয়েছি যার সাথে আমার কখনো পরিচয় ছিল না। আমার সমস্ত নির্বুদ্ধিতা অন্তর্হিত হলো। মস্তিষ্কের সবগুলো দুয়ার খুলে গিয়ে হু হু করে বাতাস প্রবেশ করতে লাগল। আমি শীতল হলাম। আমি তাই নির্দ্বিধায় বলে উঠলাম-স্ত্রী! তুমিই আমার স্ত্রী হবে!
সে মৃদু হাসল। ভীষণ মিষ্টি সেই হাসির উজ্জ্বলতা তার দুচোখের চারপাশে যেন উজ্জ্বলতর মনে হলো। আমি নিশ্চিত হলাম আমার বিশ্বাসের বাস্তবতায়। আমি কি তাহলে এতকাল ধরে এটাই চাইছিলাম। তাহলে কেনো এতটা কালক্ষেপণ করলাম। কেনই বা এতটা বছর ছিন্নমূল মানুষের মতো অস্থির বাতাবরণে পায়চারি করেছি। হয়তো বা এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যেই। প্রকৃতি সব সময়ই রহস্যময়।
পুনশ্চ পঁাঁচ বছর আগে আমি যখন তাকে প্রথম দেখি তখন সন্ধ্যার আলোকমালা সবে মাত্র জ্বলে উঠেছে। আমাদের চারপাশে অজস্র মানুষের যত্রতত্র বিচরণ আর তার কোলাহল মুখরতায় পরিপূর্ণ। তার মুখ দেখেই মনে হয়েছিল ভালো মানুষ। আর আন্তরিকতা জন্ম নিয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। তবে তা কখনই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি। আর সেটাই নাকি তাকে আকৃষ্ট করেছিল। এটা অবশ্য পরে জানতে পেরেছিলাম।
পলায়ন
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আর ফিরে যাবো না। জানি ক্ষতি হবে বেশ তবু সেও ভালো। কিছু কিছু ক্ষতি মেনে নিয়েও যদি নিজেকে মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচাতে পারি তাই বা মন্দ কিসে। স্বীকার করছি অনেক আশা নিয়ে তার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আশা যে এভাবে দুরাশা হবে তখন স্বপ্নেও ভাবিনি। অথচ ঠিক তাই হলো। এক কথায় বলতে গেলে আমাকে পালিয়েই বাঁচতে হলো। জীবনের ঝুঁকি ছিল না। হৃদয়ের ঝুঁকি ছিল সারাক্ষণ। যন্ত্রণা কাকে বলে তিলে তিলে সে আমাকে জানিয়ে দিয়েছে।
তার ব্যবহার এতটা আন্তরিক ছিলো যে আমার পক্ষে ভুল করাটাই ছিলো স্বাভাবিক। আসলে তার প্রতি ছিল আমার অন্ধবিশ্বাস। অবশ্য আমার অসহায়ত্বও আমাকে তার প্রতি নির্ভরশীল করে ফেলেছিল। তবে আর কোনো বিকল্পও যে ছিল না তা বলা যায় না। হয়ত ছিল। কিন্তু তা নিয়ে আমি ভাবতে চাইনি। আমি আসলে পরিচালিত হচ্ছিলাম আমার হৃদয়ের দ্বারা আর বাকিটা ছিল তার সম্মোহনী ক্ষমতা। সে আমার চোখের সামনে একটা প্রলোভনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে রেখেছিল যা কেবল আমাকে আশান্বিত করতো আর সর্বদাই আমি ভাবনাক্লান্ত থাকতাম। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম বিস্তর ব্যবধান থেকে কিন্তু হৃদ্যিক কারণে তাকে মনে হতো কাছাকাছি। অবশ্য তাকে আমি দোষও দিতে পারি না। কারণ সে কখনই আমাকে এসব ব্যাপারে কিছু বলেনি। আর আমিও তাকে কিছু বলতে পারিনি। ব্যাপারটা অবশ্য বলাবলির পর্যায় পেরিয়ে এসেছে বলেই আমার মনে হত। আর আমি কেবলই তার দিকে আনত শাখার মতো ঝুঁকে পড়ছিলাম। সেও আমাকে নিরস্ত্র করছিল না।
আমাদের ব্যবধান নিয়ে আমি ভাবতাম। তবে তা খুবই সামান্য। কেন যেন আমার একটা বিশ্বাস জন্মেছিল যে সে এই বাধাটা অতিক্রম করতে পারবে। আর আয়নায় আমি প্রায়শই নিজেকে দেখতাম। দেখার মতো রূপ যদিও আমার ছিল না তবুও সব মিলিয়ে আমি নিজেকে মোটামুটি সুন্দরীই ভাবতাম। আর সে-ও তাই বলত। এতে আামর আস্থা বেড়ে যেত যা কখনই অহঙ্কারের পর্যায়ে পড়ে না।
তাকে দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে থাকতাম। থাকাটাই স্বাভাবিক। সে থাকত শহরে আর সেখানে সে উচ্চশিক্ষা অর্জন করছিল। আমি বুঝতে পারতাম তার অবস্থান আর তার বন্ধু মহলও ছিল জমকালো। বিশেষ করে তার বান্ধবীরা যারা শিক্ষিতা, আধুনিকা আর সুন্দরীও বটে। তাদের সাথে সে মিশত কিন্তু কখনই তাদেরকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়নি। তার সহজাত কোমল চাহনিতে আমার সমর্পণ ছিল দ্বিধাহীন আর আমি মনে মনে ভাবতাম একদিন ঐ হাত দুটো কেবল আমারই হবে। এতটা আশা করা হয়ত ঠিক ছিল না। কিন্তু নিরাশ হওয়ার মতো কোনো কারণও ছিল না। সে কখনো আমাকে অবহেলা করেনি। সমালোচনার ভয়কে তুচ্ছ করেই সে আমার কাছে আসত। তবে তা এতটা নির্দোষ ছিল যে কেউ কোনো মন্তব্য করার মতো সুযোগই পেত না। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম আর ভেতরে ভেতরে বেড়ে উঠছিলাম।
খুব ছোটবেলায়ই তাকে আমার ভালো লাগে। তখন আমি কিশোরী আর তাকে বলতে হবে কৈশোর আর যৌবনের মাঝামাঝি একটা চঞ্চল পতঙ্গ। আমি তার চার পাশে ঘুর ঘুর করতাম। সে বুঝতে পারত এবং আমাকে কাছে ডাকত। কথা বলত অত্যন্ত নম্র ভঙ্গিতে এবং হাসত। আমিও হয়ত হাসতাম তবে তা ছিল মুখচোরা আর সেই ছোট্ট বয়সেই নানি-দাদিদের কাছ থেকে শোনা গল্পের কায়দায় তাকে আমি স্বামী ভাবতে পছন্দ করতাম। আসলে সমস্যাটাই এখানে। মেয়েরা খুব অল্প বয়সেই অনেক কিছু বিশেষ করে এই সব স্বামী সন্তান সংসারের অনেক খুঁটিনাটি বুঝে ফেলে।
কয়েক মাস পর পর সে বাড়িতে আসত। কয়েক দিন থেকেই চলে যেত। অবশ্য ছুটির এই সময়টা সে খুব উপভোগ করতো। তাই পড়াশুনা নিয়ে তাকে কখনো ব্যস্ত থাকতে আমি দেখিনি। তবে লেখাপড়ায় তার কৃতিত্বের কথা ছিল সবার মুখে মুখে। তাকে সবাই ভালোও যেমন বাসত তেমনি শ্রদ্ধাও করতো। সে তবুও ছিল বিনীত আর এতটা সরল যে তাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে সে কতটা যোগ্যতার আধিকারী। তার জীবন যাপন ছিল সাদামাটা তবে তা আকর্ষনীয়। সে কথা বলত হেসে হেসে তবে তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। সে সর্বদাই থাকত হাসিখুশি কিন্তু তার ছিল গভীর চিন্তা শক্তি। সে অবশ্য পরবর্তীতে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিল।
প্রতিবার ছুটিতে বেড়াতে এসে আমাদের বাড়িতে দু’একবার সে আসতই। উঠানে চেয়ার পেতে বসত। আমি তাকে আমার সামর্থ অনুযায়ী নাস্তা খেতে দিতাম। অবশ্য তা ছিল খুবই সাধারণ। এই যেমন বাড়িতে তৈরি পিঠা, গাছের কোনো ফল কিংবা স্রেফ ডিমের পোচ। তবে তার আন্তরিকতাই আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাত। তবে মনে মনে আমি খুবই লজ্জা পেতাম। নাস্তা শেষ করে সে পান চেয়ে খেত। সে যে পানে অনভ্যস্ত তবুও খেতে চাইছে দেখে আমি একপ্রস্থ হাসতাম। পান খেলে তার ঠোঁট পানের রসে টকটকে লাল হয়ে উঠত। আমিও তখন রসিকতা করতে ছাড়তাম না। মজা করে বলতাম
আপনার স্ত্রী আপনাকে ভীষণ ভালোবাসবে।
তাই নাকি!
চোখের তারা নাচিয়ে সে তার অনুভূতি প্রকাশ করতো। আমি মনে মনে এই ভেবে লাজুক হতাম যেন তার সেই কথা বলার সময়ের ঠোঁট দুটো আমাকে গভীর মমতায় স্পর্শ করছে আর আমার ভেতরে যে তীব্র রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তার পানের রসে ভেজা ঠোঁটের রক্তিম আবরণের ছোঁয়ায়। সন্ধ্যা হওয়ার পর পরই সে উঠে যেত। যাবার সময় বিদায় নিত অত্যন্ত সাদা মাটা ভাবে। তখনো সেই হাসি হাসি মুখ।
তার সেই হাসির আড়ালে একটা প্রচ্ছন্ন বেদনার পটভূমি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল বলেই হয়ত আমার এতটা সর্বনাশ হলো। না-হলে হয়ত আমি আমার নিজের মতো করেই থেকে যেতে পারতাম।
আমাদের সংসারটা এলামেলো ছিল। অনেকগুলো ভাইবোন। বিশেষ করে অভাব আর অশিক্ষায় আকীর্ণ একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা। তবু আমি তার মধ্যে দিয়েই যতটা সম্ভব নিজস্বতা বজায় রেখে বেড়ে ওঠার চেষ্টা করেছি। পড়াশোনা করছিলাম স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। লেখাপাড়ায় তেমন ভালো ছিলাম না-বলে মাঝে মাঝে ভীষণ আফসোস হতো। তবু মনে মনে সান্ত্বনা পেতাম তার কথা ভেবে। সে ছিল আমার আশা। আমার স্বপ্নের উৎসমূল। আর আকাক্সক্ষার লক্ষ্যবস্তু। সে আমাকে পরোক্ষভাবে তেমনি ভাবতে সাহায্য করেছিল। আমি জানি না এটা তার অপরাধ কিনা তবে তাকে নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতে আমার ভালোই লাগত। আকাশের সবগুলো তারার মাঝে একটি তারাকে আমি তার নামে ডাকতাম। একা একা তার সাথে কথা বলতাম। আমার পোষা বিড়ালটার নামও ছিল তার নামে। আর প্রতি বছর যে বাছুরটা তার তুলতুলে শরীর নিয়ে বোকা বোকা ভঙ্গিতে আমার সাথে খেলত সেটার নামও আমি তার নামেই জানতাম। অবশ্য সে এসবের কিছুই জানত না।
অনেক কথা ছিল। সব হয়ত এতটা সংক্ষেপে বলাও সম্ভব নয়। মানুষের এক জীবনে অনেক কথা থাকতেই পারে। একটি প্রেমেও থাকে অনেক উপাখ্যান। সব কিছু বলার মতো মানসিক ধৈর্যও আমার নেই। আমি শুধু বলতে চাই কী ঘটেছিল। প্রণয়ের মধুর ক্ষণগুলো এখন আমার কাছে বিষময়।
হঠাৎ করেই শুনলাম সে চাকরি পেয়েছে। বেশ ভালো চাকরি। শহরে বাসা নিয়েছে। এখন গ্রাম থেকে বাবা মাকেও শহরে নিযে যাবে। খানিকটা খারাপ লাগল সংশয়ে। তবে কি সে আর গ্রামে ফিরে আসবে না! কিন্তু সে এলো। তার মা-বাবাকে নিয়েও গেল। তার কিছুদিন পর আবার বেড়াতে এলো। কথা হলো গতানুগতিকভাবেই। তাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। আমার কাছে তার এই অনুভবকে মনে হলো ভালোবাসার ভারে নত একটি বিনম্র নারিকেল বৃক্ষ।
এবারেও অবশ্য সে কিছু বলল না। কিন্তু আমি কিছু একটা শোনার আশা করেছিলাম। যা হোক সে চলে গেল। আমি আমার আশা ভঙ্গের বেদনা তাকে বুঝতে দিলাম না। হেসেই তাকে বিদায় জানালাম। এই প্রথম আমার কেন জানি মনে হল তার আশা আমার ছেড়ে দেয়া উচিত। কিন্তু আমার হৃদয় তা পারল না-দেখে আমার কষ্ট হলো। আমি রাতের বিছানায় খানিকটা কাঁদলাম।
হঠাৎ করেই জানতে পারলাম সে তার সৌভাগ্যের দেখা পেয়েছে। আর চমৎকার একটি গাড়ির মালিকও হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তার জন্য একজন চালকও রাখা হয়েছে। আমি খুশি হলাম। কল্পনায় আমি আঙ্গুলের ডগায় ঝকঝকে গাড়িটির ধাতব শরীরের শীতলতা অনুভব করলাম। ভালোবাসলে হয়ত এমনই হয়। কল্পনাশক্তিটা কেমন দরজার মতো হাট করে খুলে যায়। তখন আর বিকেলটা কেবল দিবসের শেষভাগ নয়। রাত্রিটাও কেবল নয় সূর্যের প্রস্থান।
সে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল যৌবনের বারোটা মাসই বসন্ত। অবশ্য সে কখনো আমার হাতও ধরেনি। আমাদের মিলন হতো শুধু চার চোখে। আমরা কেবল স্বপ্ন দেখতাম আর দিগন্তের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম ঐ দূর আকাশের সাথেও পৃথিবীর মিলন হয়। নাকি এই স্বপ্ন শুধু আমার একারই ছিল তা বোঝা কঠিন ছিল। কারণ তখনো তার মধ্যে কোনো নিঃস্পৃহতা আমি দেখিনি।
ভুলটা ধরা পড়ল তখনই যখন আমি তার কাছে ছুটে গেলাম। আমি যা দেখলাম তাতে যেটুকু বুঝলাম সেটা মোটেই আশাব্যাঞ্জক নয়। ব্যাপারটা এমনই যে আমি চাইলে থাকতেও পারি না-চাইলে চলে যেতে পারি। আমার জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট। সেও তা জানতো।
অরণ্যের মানুষ
বিকেলের এই শেষের দিকটায় এসে রহিমার হাতে আর তেমন কোনো কাজ অবশিষ্ট থাকে না। সে তাই সারাদিনের কর্মক্লান্ত অলস দেহটার ভার ছেড়ে দিয়ে ছোট্ট ঘরটার দাওয়ায় বসে থাকে। তার এই বসে থাকাটাও আসলে এক ধরনের অপেক্ষা। লিলির বাপ বাজারে গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ সে হয়ত ফিরে আসবে। লিলি তাদের একমাত্র মেয়ে। এবার আট বছর চলছে। তাদের একমাত্র দুধের গাইটা নিয়ে মাঠে গেছে সে। গাইটাকে ঘাস খাওয়ানোর পাশাপাশি সে হয়ত অন্যান্য ছেলেমেয়ের সাথে খানিকটা খেলাধুলাও করবে। লিলির মা রহিমার তাতে আপত্তি নেই। এই বয়সের ছেলে মেয়েরা একটু আধটু দৌড়-ঝাঁপ তো করবেই। এক সময় সে-ও কি কম করেছে। কত মানুষের বিরক্তির কারণ হয়েছে। সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে তার বুকের গভীর থেকে।
হঠাৎ করে ধাতস্থ হতেই খেয়াল করে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঘরে আলো জ্বালাবার জন্যে আচমকা উঠতে গিয়ে কোমরে চন্ করে একটা ব্যথা অনুভব করে। খানিকটা থমকে যায়। মুখ থেকে নিজের অজান্তেই একটা গোঙানির মতো শব্দ বেরিয়ে আসে, উহ্! তারপর নিজেই যেন নিজেকেই বলে, এই বয়সেই বাত। বুড়ো বয়সে না-জানি কী হয়।
লিলির কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। জোরে জোরে সে যেন কী বলছে একা একা। আজ হয়ত গাইটা তাকে খুব জ্বালাতন করেছে। তার জন্য হয়ত তার এই বিরক্তি। মনে হয় আজ সে বন্ধুদের সাথে খুব বেশিক্ষণ খেলাধুলা করতে পারেনি। আর এ কারণেই তার মেজাজ খানিকটা চড়েছে। রহিমা মেয়ের এই আচরণে একা একা হেসে ওঠে। মেয়েটার জন্য তার বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা মায়া করে ওঠে। সে খানিকটা সজোরেই বলে-
হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে আয় লিলি।
আসছি মা। লিলি জোরে চেঁচিয়ে ওঠে।
রহিমার ততক্ষণে ল্যাম্পে কেরোসিন ভরা শেষ। আগুন ধরিয়ে জায়গামতো বসিয়ে ওজু করার জন্য পুকুরের দিকে পা বাড়ায়। লিলির হাত মুখ ধোয়া শেষ হলে সে উপরে উঠে দাঁড়ায়। রহিমার ওজু করা শেষ হলে মা-মেয়ে একত্রে ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। রহিমা মেয়েকে বলে-
গাইটা বুঝি আজ খুব ঝামেলা করেছে?
হ্যাঁ মা। খুব বিরক্ত করেছে। একটুও খেলতে পারিনি।
ঠিক আছে। মন খারাপ করিস না। ওটার কি অত বুদ্ধি শুদ্ধি আছে যে তোর মনের কথাটা বুঝতে পারবে। অত কিছু বুঝলে তো আর ওটা গরু হতো না। রহিমা মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়।
তা ঠিক। তুমি ঠিকই বলেছ। লিলিও মায়ের কথায় সায় দেয়।
দেখতে দেখতে লিলির বাপও বাজার থেকে ফিরে আসে। প্রতিদিনকার মতো উঠানে দাঁড়িয়েই লিলির নাম ধরে ডাক দেয়। লিলিও রোজকার মতো জোর গলায় বলে-আসছি বাজান।
তোর মায় কই? লিলির বাপ লিলিকে জিজ্ঞেস করে।
ঘরে। লিলি জবাব দেয়।
গরু আনছোস?
হ্যাঁ বাজান।
যা। বাজার নিয়া তোর মায়ের কাছে দে। আমি হাত মুখ ধুইয়া আসতাছি।
করম আলীর মাথা জুড়ে হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশে তাহলে এবার সত্যি সত্যি একটা কিছু হতে যাচ্ছে। শেখ সাহেব সাতই মার্চের ভাষণে যা বলেছেন তা স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া আর কিছু না। এবার তাহলে যুদ্ধ হবেই হবে। করম আলী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। যুদ্ধ শুরু হলে সে-ও যাবে। রহিমাকে কথাটা বলা দরকার।
বাজার থেকে আনা মাছ রান্না করছে রহিমা। করম আলী তার পাশে গিয়ে বসে। মুখে কেমন যেন গম্ভীর একটা ভাব। রহিমা জিজ্ঞেস করে-কিছু কইবেন?
দেশের অবস্থা ভালো না। মনে হয় যুদ্ধ হইবো।
হইলে আমাগো কী?
আমি যুদ্ধে যামু।
রহিমা অবাক হয়ে যায়। এই যুদ্ধের সাথে তাদের সম্পর্ক কী তা সে নিজেও জানে না। সে এক দৃষ্টে চুলার গনগনে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
শেষ চিঠি
প্রিয় সজল,
কয়েকটি নিবন্ধ লিখে রেখে তুমি চলে গেলে। আর আমি এখনও বসে বসে সেগুলো পড়ছি। একটা জীবন কি তবে এভাবেই চলে যাবে। প্রণয়ের আশা ছিল হৃদয়ের কোঠরে। ছিল কত রঙিন স্বপ্ন। আজ সেসব ধূসর হতে হতে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। তোমার আগমন তাই এখনও প্রত্যাশিত। স্মৃতি ঘেঁটে ঘেঁটে আমি ক্লান্ত। আমাকে কৃতজ্ঞ করো।
ইতি-কাজল
চিঠি পেয়ে সজলের অবস্থা আরও নাজুক হলো। এতদিন তার নিজের ওপর যেটুকু আস্থা ছিল তাও হঠাৎ করে ধোঁয়ার মতো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। সে নিজের অজান্তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার ভাগ্য ভালো এসময় আশেপাশে কেউ ছিল না। তাহলে নিশ্চয়ই এক জনকে যেমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হত অন্যজনকে তেমনি বিব্রত হতে হত। দুজনের জন্যই ব্যাপারটা হতো অপ্রত্যাশিত।
চিঠিটা বিছানার নিচে গুঁজে রেখে সজল বিছানা থেকে নামল। ছোট বোন শীলার ঘরে উঁকি মেরে দেখল শীলা চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। সে তাই সজলকে দেখতেই পেল না। সজলের মনে হল ইদানীং শীলা বেশ খানিকটা বদলে গেছে। সেই চঞ্চল কিশোরীটি আজ সদ্য যুবতী। কৈশোরের চাঞ্চল্য দখল করেছে যৌবনের নারীত্ব। তার আচার-আচরণেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তন অবশ্য প্রাকৃতিক। তবে এর বাইরেও যেন কী একটা ঘটছে শীলার ভেতরে।
সজল এখন যে কোনো নারীর বুকের দেয়ালে কান না-পেতেই তা বুঝতে পারে। কাজল তাকে নারীর গভীরে লুকানো প্রেম এবং প্রণয়ের ঐশ্বরিক বেদনার স্বরূপ জানিয়ে দিয়ে গেছে। আর এখন সে তাই শীলার মুখ দেখে যেন সবকিছু বুঝে নিতে পারে। তার খুব ইচ্ছা হলো শীলাকে ডাক দেয়। এই মুহূর্তে তার বেদনার একটু ভাগাভাগি বড় প্রয়োজন। কিন্তু শীলাটা এত বেশি ডুবে আছে যে তাকে সেখান থেকে টেনে তোলা বিবেকহীন।
সজল তার ঘরে ফিরে গেল। কিছুটা সময় অর্থহীন বসে রইল। ভাবনাগুলো যেন একটা বিশেষ গ্রন্থিতে এসে মিলেমিশে জট পাকিয়ে গেছে। এই সব সিদ্ধান্তহীন মুহূর্ত যে কেন মানুষের জীবনে আসে সজল ভেবে পায় না। হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায়। তারপর ওয়ারড্রোবের কাছে গিয়ে পোশাক পাল্টায়। সম্ভবত সে বাইরে বের হবে।
কাজলদের বাড়ি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে। সজল সেই সুদূর বরিশাল থেকে সেখানে পড়তে গিয়েছিলো। পড়াশুনা শেষ করে চলে এসেছে সেও অনেকদিন হলো। ভালো কোনো চাকরি না-পাওয়ায় কাজলের ব্যাপারে কিছু বলতেও পারছে না। আর কাজলও বা কতদিন অপেক্ষা করবে। তার চিঠি পড়লেই সেটা বোঝা যায়।
বাইরে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও সজলের মনের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হলো না। আসলে মেঘ জমে আছে তার মনের কোণায়। সেই মেঘ না-সরা পর্যন্ত মন ভালো হবে কেমন করে। সে সবই বোঝে। কিন্তু বুঝে কোনো লাভ নেই। সবার আগে তার একটা ভালো চাকরি চাই।
অনেকদিন হয়ে গেলো কাজলের কোনো চিঠি-পত্র নেই। সজল মনে মনে ভাবে কাজলের একটা খোঁজ নিলে কেমন হয়। অবশ্য নিয়েও বা কী লাভ। কাজলকে তার কী-ই বা বলার আছে। চাকরি কবে হবে তা সে নিজেও জানে না।
হঠাৎ করেই সুসংবাদটা আসে। অবশেষে তার একটা চাকরি হয়েছে। মনের মতো না-হলেও একেবারে মন্দ নয়। মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া যাবে। কাজলকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। তাকে বলা দরকার যে তার অপেক্ষার পালা শেষ।
সজল পরদিন ভোরে উঠেই ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তার ভেতরটা ভীষণ অস্থির। মনে মনে শুধু অপেক্ষা কখন সে কাজলদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাবে। কাজলের সামনে গিয়ে বলবে-চলো, বিয়ে করি।
কাজলের কবরটা তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্রের ধারেই দেওয়া হয়েছে। শেষের দিকে সে নাকি প্রায়ই বলত সে যদি মারা যায় তাকে যেন ব্রহ্মপুত্রের ধারেই কবর দেওয়া হয়। কিন্তু কে জানত সে সতিই এত তাড়াতাড়ি মারা যাবে। সজলের পৌঁছানোর মাত্র তিনদিন আগে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় কাজলের মৃত্যু হয়।
মাস্টার মশাই
আমার যতদূর মনে পড়ে সেখানে পৌঁছাতে আমার সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল এবং আমি এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে বাস থেকে নেমে রিক্সাওয়ালার কাছে জায়গাটার নাম বলেই উঠে পড়েছিলাম। সে আদৌ যাবে কিনা কিংবা গেলেও তার পারিশ্রমিক কত হবে তা জানার মতো বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার ছিল না। আমি আমার ক্লান্ত দেহটা রিক্সার হুডের সাথে এলিয়ে দিলাম এবং খেয়াল করলাম রিক্সাওয়ালা গন্তব্যের দিকে ছুটতে শুরু করেছে।
ফুরফুরে বাতাসে আমার ক্লান্তি কিছুটা কমে আসতে লাগল এবং তখনই খেয়াল করলাম আমার হাতের ব্যাগটি আমার নয়। আর সাথে সাথে এটা নিশ্চিত হলাম যে ব্যাগটি আমার সহযাত্রীর কাছেই ছিল। এ ধরনের একটা বিভ্রাটও আমাকে বিন্দুমাত্র আলোড়িত করতে পারল না। বরং আমার কাছে সময়টাকে অনেক বেশি উপভোগ্য মনে হতে লাগল। রাস্তাটা ছিল পিচ ঢালা আর রিক্সাটাও চলছিল নিঃশব্দে। আর শহর থেকে গ্রামের দিকে হারিয়ে যাওয়া রাস্তাটার দুধারে ছিল চমৎকার সব বৃক্ষরাজি। হাল্কা জ্যোৎস্না ছড়ানো ছিল চারিদিকে আর সবকিছু মিলে চমৎকার একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। সময়টা ছিল গ্রীষ্মের শুরুর দিকের।
যারা আমাকে পথের নির্দেশ দিয়েছিল তাদের ভাষ্য মতে পথটা ছিল প্রায় পনের কিলোমিটার দীর্ঘ। যদিও তার সৌন্দর্যের প্রশংসাও তারা করেছিলেন উদার মানসিকতার সাথেই। তখনো আমার মনের ভেতরটায় কিছুটা হলেও বেদনাবোধ অবশিষ্ট ছিল আর রাতে বাসের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়ে নুতন করে কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছিল না।
আমি চুপ করে বসে রইলাম। এ পর্যন্ত রিক্সাওয়ালা একটা কথাও বলেনি। হয়ত আমাকে তার পছন্দ হয়নি নয়তো লোকটা এমনি গোমড়ামুখো। আমিও তাকে কিছু বলিনি। রিক্সায় উঠলে রিক্সাওয়ালাদের সাথে গল্প করা আমার একটা অভ্যেসের মতো। কিন্তু আজ আমার কেন জানি চুপ করে থাকতেই বেশি ভালো লাগছে। আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম।
ওর নাম ছিল মিতা। বসেছিল পাশের সিটে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ওকে ঠেলে ভিতরে ঢোকার সময় আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে ঢুকব না পিছন ফিরে ঢুকব। কারণ দুজনের জন্যে নির্ধারিত আসনটার প্রথমটাতেই ও বসেছিল।
বাসে সবাই জানালার কাছের আসনটা পছন্দ করে। কিন্তু ও প্যাসেজের পাশের আসনটায় বসেছিল এবং আমি ওকে জানালার পাশের আসনটায় বসার জন্যে অনুরোধ করলে ও তা হাসিমুখেই প্রত্যাখান করে আমাকেই বরং বসতে বলল। আমি ওকে একটু কষ্ট করে উঠে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিতে বললে ও বসা অবস্থায় সামান্য পিছনে হেলে আমাকে ভেতরে প্রবেশ করে বসতে বলল। তখন দ্বিধাটা আমার মনে এল এবং আমি ওর দিকে মুখ করেই ঢুকতে গেলাম। ও বাধা দিয়ে বলল, এভাবে ঢুকলে আúনার ঘুরে বসতে অসুবিধা হবে। আমি অবশেষে ওর দিকে পেছন ফেরানো অবস্থায়ই ভেতরে প্রবেশ করলাম। ও আমার নিতম্বে চিমটি কেটেছিল এবং আমি যেন তা আদৌ অনুভব করিনি এমন একটা মুখভঙ্গি করে চুপচাপ বসে রইলাম।
পরদিন আমি যথারীতি কলেজে যোগদান করতে গেলাম। যদিও আমার কাছে কাগজ পত্র তেমন কিছুই ছিলো না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও যা কিছু সঙ্গে এনেছিলাম তাও ঐ ব্যাগের সাথে সাথে ওর কাছে চলে গিয়েছিল। কিন্তু অবাক হলাম যখন দেখলাম আমার আগেই সে কলেজে পৌঁছে গেছে। অবশ্য ব্যাগটা সাথে আনতে ভুল করেনি।
মিতা আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বলল-সরি বলতে পারব না। প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে বলে আমাদের বাসায় আপনার থাকার ব্যবস্থা করিয়েছি। আপনি কিন্তু না করবেন না। করলে বাসের মধ্যে বসে যে রকম চিমটি দিয়েছিলাম ওরকম রাম চিমটি দেব। আর বাসের ঘটনা যেন ঘুণাক্ষরেও কেউ কিছু জানতে না-পারে। তাহলে ডাবল রাম চিমটি।
রাম চিমটির কথা শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেলো। মিতা সেটা বুঝতে পারলো কিনা জানি না। পেটের চামড়ায় কষে একটা রাম চিমটি দিয়ে বলল তা মাস্টার মশাই, আমার ব্যাগ কোথায়?
কবিপতœী
তার বুকের দৃশ্যমান অংশটুকু ছিল ধবধবে সাদা, ঘষা পাথরের মতো মসৃণ আর আপাত দৃষ্টিতে পেঁজা তুলোর মতো নরম আর তুলুতলে কারণ তখনো আমি তা স্পর্শ করিনি। আর এজন্যেই আমাকে অনুমানের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আর বর্ণনার জন্যেও আমাকে উপমা খুঁজতে হযেছিল মুহূর্তের জন্যে। তার ঘরে পরা জামার হাতের কাছের অংশ বিশেষ গোঁটানো ছিলো সম্ভবত স্বহস্তে।
আমি গভীরভাবে তাকিয়েছিলাম। তবে অবশ্যই তা প্রথমবার নয়। কারণ আমি ছিলাম তরুণ আর তখনো ততটা সাহসী হয়ে উঠিনি। সে আমার দৃষ্টিতে পড়েছিল কিছুটা আগেই। আর আমি মাঝে মাঝে চোখ তুলে দু-এক পলকের জন্যে তাকে দেখে নিচ্ছিলাম। আমি সতর্ক ছিলাম কারণ আমাদের ঘরটাতে আরও অনেক ছাত্র ছিল এবং আমাদের শিক্ষক সাহিত্যের সব জটিল জটিল বিষয় জলের মতো সহজ ভাষায় বর্ণনা করে যাচ্ছিলেন। সেই সাথে তিনি নিজ মহিমা প্রচারেও ব্যস্ত ছিলেন। আমি সেই মূল্যবান আলোচনায় নিজেকে আদৌ মনোযোগী করাতে পারছিলাম না।
আমার মধ্যে কেমন জানি একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। আমি বারবার তার দিকে তাকাতে লাগলাম এবং এক সময় এতটাই সাহসী হয়ে উঠলাম যে আমার দৃষ্টি স্থির করতে সমর্থ হলাম এবং অবশ্যই তা তার বুকের দিকে। আমি তার দেবীর মতো পাথরে গড়া সুন্দর সূর্যবরণ মুখের পানেও তাকাচ্ছিলাম মাঝে মাঝে। সে মুখ ছিল বিষণœ, অভিব্যক্তিহীন, নিষ্প্রভ। আঁখি পল্লব ছিল ক্লান্ত, শুকনো আর অর্থপূর্ণ। সে ছিল তার অবস্থানে অনড়।
আমাকে অনেক কিছুই অনুমান করে নিতে হচ্ছিল। কারণ পুরো ব্যাপারটায়ই কল্পনার দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় আছে বলে আমার জানা ছিল না। হঠাৎ দেখলাম জানালার ধারটা শূন্য। সম্ভবত কোনো প্রয়োজনে সে অন্তর্হিত হয়েছিল।
এবার আমি আলোচনায় মনোযোগী হতে চেষ্টা করলাম। কারণে অকারণে বারবার হু-হু বলে আমার মনোযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে চাচ্ছিলাম। আর তখনই চা এল। সে নিজ হাতে আমার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল এবং আমি কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপ নিলাম। হাঠাৎ করে তার এই এতটা কাছাকাছি আগমন আমাকে বিব্রত করেছিল এবং আমার কিছুক্ষণ আগের অনুভূতির জন্যে কেমন যেন একটা অপরাধবোধ হতে লাগল।
সে খুব সূক্ষ্মভাবে আমার অবস্থা অনুধাবন করছিল। তবে অবশ্যই তা সবার চোখের আড়ালে। আমার কম্পমান হাত, চায়ের কাপ হতে ছলকে পড়া গরম চা যা আমার সাদা শার্টকে নষ্ট করেছিল-এসব কিছুই। আমি বেশ খানিকটা জড়সড় হয়ে পড়েছিলাম। একটু ভয় ভয়ও করছিল। মনে মনে ভাবছিলাম সে কি আমার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বিরক্ত হয়েছে নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে এর মধ্যে?
কবির সাথে তার দু’একটা যা কথা হল তা ছিল নিতান্তই সাধারণ। এভাবে আমি তার সুমধুর কণ্ঠস্বর শোনার সুযোগ পেলাম প্রথবার। আর যে ব্যাপারটায় নিশ্চিত হলাম তাহলো সে আর কেউ নয় স্বয়ং কবি পতœী। মেরুন রঙের যে ঢিলেঢালা ঘরোয়া পোশাক সে পরেছিল তার বুকের দিকটা ছিল বেশ খোলামেলা। তার গলায় স্বর্ণের সরু একটা হার ছিল যার লকেটটা তার দু’বুকের খাঁজ পর্যন্ত নেমে এসেছিল। তার বুক ছিল সুপুষ্ট আর অদ্ভুত রকমের আকর্ষণীয়। তার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরানো ছিল বেশ কঠিন আর তার আবেদনকে অস্বীকার করা ছিল অসম্ভব।
এভাবে এক দিন, দু দিন, তিন দিন। আমার কবিতার পাঠ যেন আর আগায় না। বিদগ্ধ কবির গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বক্তৃতা অত্যুৎসাহী ছাত্রের ভান করে শুনতে থাকি। কিন্তু তা কেন জানি নিজের কাছেই স্বাভাবিক মনে হয় না। আসলে মন পড়ে থাকে জানালার কাছে। কখন সে এসে দাঁড়াবে। তুখোড় কবি ভেতরে ভেতরে সব বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই বলে না।
আমার রোগ ক্রমেই বাড়তে থাকে। কবিতার খাতা পড়ে থাকে এক পাশে। মাথার মধ্যে কবি পতœীর রূপ-যৌবন ঘুরপাক খায়। কবির অনেক আশা আমাকে নিয়ে। তার অপূর্ণ স্বপ্ন আমি পূরণ করবো। কবিকে ছাড়িয়ে মহাকবি হবো। কিন্তু আমার এ কী হয়েছে!
কষ্ট সইতে না-পেরে একদিন কবিকে বলি আমার মহাকবি হওয়ার সাধনা আপনার ঘরেই আটকা পড়ে আছে। কবি তখনো কিছু বলেন না। শুধু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলেন। তারপর আস্তে করে বলেন-সেই একই ভুল তুমিও করলে। এর আগে সে অন্য এক কবির পতœী ছিল।
ভ্রমণ
একদিন বজ্র-বিদ্যুত মেশানো বৃষ্টিঝড়া সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই খুট খুট করে দরোজায় কে যেন টোকা মারল। একলা ঘরে এতক্ষণ ভরে সিঁটিয়ে থাকা আরিফা কোনো রকমে শরীরটাকে দরোজার কাছে টেনে নিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করল-
- কে?
- আমি রাজা। আমাকে চিনবেন না। দরজাটা একটু খুলবেন।
আরিফা কী করবে ভেবে উঠতে পারছিল না। নিজের জায়গায় ফিরে যাবে নাকি দরজা খুলে দেখবে বাইরে কে দাঁড়িয়ে আছে ভেবে উঠতে পারল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তার সারা শরীর হিস্টিরিয়ার রোগীর মতো কাঁপছে। এই মুহূর্তে তাকে একটি অবুঝ শিশুর মতো মনে হচ্ছে।
বাইরে থেকে আবারও সেই একই কণ্ঠস্বর। এবার একটু করুন-
দয়া করে দরোজাটা একটু খুলুন। ভিজে একদম সপসপা হয়ে গেছি। আপনি যে-ই হোন কোনো ভয় নেই। আমার পরিচয় দিলেই আপনি আমাকে চিনতে পারবেন। শুধু এইটুকু বলছি যে আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। আর আমার ক্ষুধাও পেয়েছে ভীষণ। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্টও হচ্ছে বেশ। তার উপরে আবার বৃষ্টিতে ভিজে একদম কাঁপন উঠে গেছে। আমার কণ্ঠ শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
আরিফা এবার সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হল। সে তার হাত দুটোতে বিছুটা শক্তি সঞ্চয় করল এবং একটানে দরোজার খিল খুলে ফেলল। তারপর একটি মাত্র চিৎকারের শব্দ শোনা গেল।
ঘুম ভাঙতেই আরিফা নিজেকে একটা অচেনা কক্ষে আবিষ্কার করল। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পরিষ্কার ভাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। হাত দুটোকে নাড়াতে গিয়েই সে বুঝতে পারল ওগুলো শক্ত করে খাটের সাথে বাঁধা। পাগুলোরও সেই একই দশা।
সে শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। এবার সে ভীষণ শঙ্কিত হলো। স্মৃতিশক্তির ওপর জোর খাটিয়ে সে অতীতকে মনে করার চেষ্টা করতেই তার গা ভয়ে শিউরে উঠল। সে সজোরে চিৎকার করতেই একটি লোক ছুটে এল। লোকটি অচেনা। তবে দেখে মনে হল নিতান্তই ভালো মানুষ। অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় সেই অচেনা লোকটি তাকে বলল-
চিৎকার করছ কেন? ভয় পেয়েছ? কোনো ভয় নেই। এ পর্যন্ত তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি। আশা করি হবেও না। তুমি কি কিছু খাবে?
আরিফা মাথা তুলে নিজের শরীরটাকে দেখতে চাইল। পোশাক তার যা ছিল তাই আছে। এবার সে তার অনুভূতি দিয়ে অনুমান করতে চাইল তার শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলো আসলেই অক্ষত আছে কিনা। আর যে ধারণা তার জন্মাল তা লোকটির কথার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই তার মনে হলো। সে খানিকটা স্বস্তি পেল এই ভেবে যে এরা অন্তত এখনো তার সম্ভ্রমহানি করেনি।
আরিফাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে লোকটি আবারও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করল।
আরিফা এবারও তার কথার কোনো জবাব না-দিয়েই সরাসরি প্রশ্ন করল-বৃষ্টি কি থেমেছে?
লোকটি তাকে জানাল যে বৃষ্টি কয়েকদিন পূর্বেই থেমেছে।
আরিফা একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল-আজ কী বার?
শনিবার। লোকটি তাকে জানাল।
কত তারিখ। আরিফা সাগ্রহে জানতে চাইল।
১৯শে এপ্রিল। আর আমরা তোমাকে মাত্র দুদিন আগে তোমাদের বাসা থেকে তুলে এনেছিলাম। আর সেটা যে আমাদের বোকামিই ছিল তা তো বুঝতেই পারছ। তুমি যে এত ভীতু একটা মেয়ে জানলে আমরা কখনই এমনটা করতাম না। অনেক ভোগান্তি হল। যা হোক এবার যখন তোমার জ্ঞান ফিরেছে তখন একটা না একটা সমাধানে পৌঁছানো যাবেই। আমরা শুধু এই সময়টার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। কারণ একজন অজ্ঞান মানুষকে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছনো যায় না। তাকে নিয়ে শুধু ঝামেলাই পোহাতে হয়। যেমন তোমাকে নিয়েও আমাদের পোহাতে হয়েছে বিস্ময়কর ঝামেলা। আর এই দুদিনে ডাক্তার বাবদও আমাদের খরচ হয়েছে বিস্তর টাকা। কারণ ব্যাটা আমাদের গোপনীয়তার সুযোগ নিয়েছে। আর তোমার কপালেও জুটেছে স্যালাইনের সাদা পানি। এবার বলো তুমি কী খাবে?
এখানে কী আছে?
কিছু তো আছেই যেমন ধরো শুকনো রুটি, মাংসের ভুনা, ঠাণ্ডা পানীয়।
আমার এ সবেই চলবে।
কিন্তু তার আগে তোমার জন্যে একটা সুখবর আছে। তোমাকে আমরা ভুল করে তুলে এনেছিলাম। এখন তুমি যেতে পারো। এটা তোমার ঘরের চাবি। আর প্রতিবেশীরা কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে-বেড়াতে গিয়েছিলাম। এই ব্যাগে তোমার জন্যে কিছু কাপড়চোপড় আছে। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি তুমি ঐ বাড়িতে একাই থাকতে। সাথে ব্যাগ থাকলে কেউ সন্দেহ করবে না।
ভ্রান্তি
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বন্ধ হয়ে আসছে আমার চারিধার। স্তব্ধ হয়ে আসছে আমার অনুভূতি। আমার উপলদ্ধির জগতটা সংকীর্ণ আর সংক্ষিপ্ত হতে হতে তা যেন একটা ছোট বিন্দুতে মিশে আসছে ধীরে ধীরে। আমি টের পাচ্ছি শূন্যতার পানে আমার অনন্ত যাত্রার অন্তর্গত আয়োজন। নিঃশেষের দিকে অনবরত ছুটে চলা। সত্তার সমূহ বিপর্যয়। আমার কোমল আত্মার অদৃশ্য অবগাহন। আমার অস্তিত্বের গোপনে যে অবিরাম ভাঙ্গনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, আমার কর্ণকূহরে তার প্রতিটি পদাঘাত আমাকে বারবার জানিয়ে দিচ্ছে আমার সময় শেষ হয়ে আসছে।
কিন্তু আমি কখনই চাইনি এমন নিরব পস্থান। আমি জানি এ আমার নিশ্চিত পরাজয়। তবুও আমি কখনই চাইনি এতটা অসহায়ত্বের মধ্যে দিয়ে তা আসুক। আমি বলছি না আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে আমাকে যথাযথ সুযোগ না-দিয়ে। কারণ আমি জানি আমার অনুযোগ সত্য হলেও তা মূল্যহীন। যেহেতু আমি আমার দাসত্বকে মেনে নিয়েছি। মৌখিক পরীক্ষায় যেমন ইচ্ছে হলেও পরীক্ষার্থী অনেক কিছুই বলতে পারে না, হোক না তা যতই সত্য, ঠিক তেমনি আমার ভাগ্য এখন পরীক্ষকের কৃপার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। অবশ্য সবসময়ই তা ছিল।
যেহেতু আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি তাই কোনো প্রতিবাদ করার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু আমি তো অন্তত আমার দুর্ভাগ্যের কথাগুলো আপনাদের বলতে পারি। অবশ্য যদি আপনারা তা শুনতে চান। কিন্তু আমার মনে হয় আপনাদের অন্তত তা শোনা উচিত। আর একথাও তো সত্য যে প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু বলার থাকে। আর তা যদি হয় বিশেষ কোনো মুহূর্তে তবে তা ভালো লাগুক বা না-লাগুক সবারই অন্তত ভদ্রতার খাতিরে হলেও তা শোনা উচিত। আর যেহেতু আমি বিশ্বাস করি আপনারা সবাই অত্যন্ত ভদ্রজন তাই আমার কথাগুলো অন্তত শুনবেন।
আমার ইচ্ছে ছিল না নিজেকে নিয়ে কোনো গল্প লেখার। সবারই একটা জীবন থাকে আর তাতে গল্পও থাকে। আর এটা বলার মধ্যে হয়ত তেমন কোনো বিশেষত্বও নেই। কিন্তু যদি এমন হয় যে সেই গল্পটা তার আপন গতিতে সমাপ্তির পথে না-যেতে পারে তাহলেই হয়ত তা বলার বা লেখার একটা তাগিদ এসে যায়। আর যেহেতু আমার গল্পটা আমারই সবচেয়ে ভালো জানা সেহেতু সেটা বলার দায়িত্বটাও আমিই নিলাম।
আমার গল্পের শুরুটা ভালোই ছিল। যদিও তা ছিল নিতান্তই সাদামাটা কিন্তু তার সাথে যুক্ত সম্ভাবনা তাকে ভিন্ন একটা মাত্র দিয়েছিল। আর আমার দুঃখটাও সেখানেই। একটা কিছু যা প্রকৃতই একটু ভিন্নতর তার প্রতি একটু বাড়তি মনোযোগ তো থাকতেই পারে। আমারও ছিল। আমি তাই নিজেই নিজের ব্যাপারে নিজেই খোঁজ খবর করেছিলাম। আর তখনই জানতে পারলাম যে ডাক্তারের রিপোর্টে একটা ছোট্ট ভুল ছিলো।
বিভ্রান্তি
প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কখন যে জীবনের চল্লিশটি বছর পার হয়ে গেছে সেটা নিয়ে ভাববার মতো অবকাশটুকু কখনো আসেনি তপনের জীবনে। একথা কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে তার জীবনেও অবসর আসতে পারে। কারণ একথা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষদের মধ্যে এ পাড়ার তপনও একজন। এমনটা বিশ্বাসের কারণও আছে। কেউ বলতে পারে না যে তারা কখনো তপনকে বসে থাকতে দেখেছে। তাকে কোনোদিন দিনের বেলায় ঘুমাতেও দেখা যায়নি। যে শিক্ষক সবার মান্য-গণ্য তার সম্পর্কে যদি বলা হয় যে তিনি একটি অবুঝ শিশুকে গলা টিপে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ করে ফেলেছেন কিংবা স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেবের সম্পর্কেও যদি এমন একটা গুঞ্জন ওঠে যে তিনি মাত্র দশ টাকার লোভ সামলাতে পারেননি। তাও হয়ত বিশ্বাস করার মতো দু’চার জন খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তপন জ্যোতি বড়ুয়ার বেলায় অলসতার অভিযোগ কারো কাছে ধোপে টিকবে না। জ্যামিতির উপপাদ্যের মতো তার ব্যস্ততা সবিশেষ প্রমাণিত।
কিন্তু এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব। আর তা যে তপনের জীবনেও সে কথাও প্রমাণিত হল। এক মধ্যরাতে বাসায় ফিরে যাবতীয় ঘরোয়া কার্যকলাপ সেরে তপন যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিতে যাবে তখনই তার ব্যক্তিগত ডায়েরিটার দিকে চোখ পড়ল। ব্যস্ততার কারণে এতদিন ধরে তার হাতের কাছে ছিল কিন্তু একবারও তার চোখে পড়েনি কেন। তপন তবু অত্যন্ত সাধারণ ভঙ্গিতেই সেটা হাতে তুলে নিল। ধুলো ঝেড়ে খুলতেই সাদামাটা অক্ষরে লেখা তার পরিচয়ের তথ্যাবলী চোখে পড়ল। লেখাটা দেখে সে একটু চমকাল। অবিবাহিত। সে এখনও অবিবাহিত। যা হোক এটা কোনো সমস্যা নয়। সাবার বউ থাকে না। বাকি বিবরণীগুলো তাকে মনে করিয়ে দিল ডায়েরিটার বয়স কম করে হলেও বিশ বছর। আর তখন সে কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। পুরনো ডায়েরিটা খুব বেশিক্ষণ দেখতে ভালো লাগলো না তপনের। সে এটাকে আগের জায়গায় রেখে দিল। হাত বাড়িয়ে প্রতিদিনের কাজের ফর্দটা টেনে নিল। জীবনে এই প্রথম সে লক্ষ্য করল একটা পুরো দিন খালি পড়ে আছে। কোনো কাজের কথাই উল্লেখ নেই। সে কারণে তাকে খানিকটা চিন্তিত মনে হল। তার এই চিন্তা কপালের ওপর কয়েকটি কুঞ্চিত রেখা হয়ে ধরা দিল। অবশ্য পরক্ষণেই তা মনের জলের বুকে পাপড়ির পতনে সৃষ্ট ম্লান ঢেউয়ের মতো আলগোছে মিলিয়ে গেল। তপনের ক্লান্ত শরীর ভাবতে রাজী ছিল না। সে তাই ঘুমানোর জন্যে গা এলিয়ে দিল। কখন যে সে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো তা জানার সাধ্য কোনোকালেই তপনের হয়নি।
ঘুম ভাঙল একটানা একটা খটখট আওয়াজে। আর তা এত বেশি ভোরে যে খুব সকালে ওঠায় অভ্যস্ত তপনকেও খানিকটা বিরক্তি সহকারে বিছানা ছাড়াল। দরজা খুলতেই তার চোখে পড়ল একটা ছোট ছেলে। ছেলেটার চোখ দুটো জলে ভেজা। সম্ভবত সে একটু আগেই কেঁদেছে। তপন তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে চেষ্টা করল। কিন্তু এর আগে সে কখনো তাকে দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। কিন্তু ছেলেটি তাকে বাবা বলে ডাকতেই সে খানিকটা অবাক হলো। তার সন্দেহ হলো সে কি সত্যিই অবিবাহিত? অবশ্য ঘুমের ঘোর লাগা দৃষ্টি আর চিন্তার সমন্বয়ে খানিকটা হলেও নিশ্চিত হলো যে সে অবিবাহিত। আর এমন একটা ছেলের বাপও সে নয়। সে ছেলেটাকে একটা ধমক দিতে চাইল। অবশ্য তা মনে মনে। এত কোমল ভোরে কউকে ধমক দিতে কেন জানি তার আর ইচ্ছে হলো না। সে ছেলেটির দিকে ঝুঁকে সে আসলে কী বলতে চায় তা শুনতে চাইল। ছেলেটি কথা বলছিল ফিসফিস করে। তই তার কথা অবশ্য পুরোপুরি বোঝাও যাচ্ছিল না। তপন তাকে একটু জোরেই বলল-তুমি আসলে কী বলতে চাইছ?
ছেলেটি অবশ্য তার এই কথার কোনো জবাব দিল না। শুধু হাত ইশারায় রাস্তার দিকে দেখাল। তারপর হাঁটতে শুরু করল রাস্তার দিকেই। তপনও তার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল মনের অজান্তেই। কী একটা ঘোর তাকে পেয়ে বসেছে তা সে নিজেও জানে না। সে একটা অনুগত কুকুরের মতো তাকে অনুসরণ করল।
পরদিন ভোরে সবাই জানতে পারল যে তপনজ্যোতি বড়ুয়া গত রাতে ইহধাম ত্যাগ করেছে।
কাচের দেয়াল
কলিম উদ্দীনকে ভালো ছাত্র না-বলে উপায় নেই। এক চান্সে এমকম পাস করে ভালো একটা প্রাইভেট ব্যাংকে শিক্ষানবীশ হিসেবে ঢুকে পড়েছে। বেতন ভাতাও ভালো। এই দুর্মূল্যের বাজারে সে যেভাবে তার যোগ্যতা প্রমাণ করেছে তাতে যে কাউকে মানতেই হবে সে এসবের যোগ্য। শিক্ষা জীবনের সবগুলো পরীক্ষার সনদপত্রও তার সপক্ষে প্রমাণ দেয়। সবকিছু মিলিয়ে কলিম উদ্দীনের জীবনে এখন শান্তির সুবাতাস। এতদিন ধরে বুকের মধ্যে চেপে রাখা চাপা নিঃশ্বাসটুকু সে আলগোছে বের করে দিয়ে বুকটা হাল্কা করে নেয়। এরই নাম জীবন। কলিম উদ্দীন আনমনে বলে ওঠে।
বলাটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকেই কষ্টের মধ্যে তার বেড়ে ওঠা। জীবনের আশিভাগ স্বপ্নই তার অপূর্ণ। সবার আগে নিজের জন্যে ভালো কাপড়চোপড় দরকার। তারপর বাসার জন্যে খাট, টেবিল, চেয়ার, আলমারি ইত্যাদি। মা-বাবা অবশ্য এখন থেকে তার সঙ্গেই থাকবে। সঙ্গে ছোট ছোট ভাই বোনগুলো। অতএব একটা বাসার মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে নিলেই হবে।
কলিম উদ্দীনের প্রেমিকা রেবেকা একটা সেল ফোন কোম্পানীর উদ্ভিন্না যৌবনা এক্সিকিউটিভ। তার চলন বলন দেখলে যে কেউ ধরে নেবে কলিম উদ্দীন এই মেয়ের জন্যে দারুণ বেমানান। কিন্তু রেবেকা দেখতে ফাটাফাটি হলেও তার মনটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোই ফুলানো ফাঁপানো। হাওয়া বেরিয়ে গেলে একদম চুপসে যায়। এই রোগা পাতলা গায় গতরে সেকেলে কলিম উদ্দীনের মধ্যে সে যে কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস খুঁজে পায় তার রহস্য আজ পর্যন্ত অন্যে কেনো সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেও এ নিয়ে কম কানাঘুষা হয়নি। কিন্তু রেবেকা অনড়। কলিম উদ্দীন তার জীবনের ধ্র“বতারা। তার কমেডির শাহরুখ খান। ট্রাজেডীর দিলীপ কুমার। জীবনের মঞ্চে ‘কৌন বনেগা আসল পতি’তে তার বিগ বি অমিতাভ বচ্চন।
রেবেকার জন্যে কলিম উদ্দীনের গর্বও একেবারে কম নয়। ক্লাসে অনেক হিরো কাম লাভার মার্কা ছেলেপান থাকলেও রেবেকার ধারে কাছেও কেউ ভিড়তে পারেনি। তার ভরাট বুকের দরাজ দিলের থরে থরে যে ভালোবাসার মিষ্টি, মণ্ডা, সন্দেশ সাজানো তা সে শুধু কলিম উদ্দীনকেই দিয়েছে। যে রেবেকা ইচ্ছে করলেই ওয়াইন রেড প্রিমিওর পেছনের প্রশস্ত সিটে হেলান দিয়ে বড় লোকের টুকটুকে লাল নাদুস নুদুস ফার্মের মুরগীর মতো ছেলেদের সাথে ভাগাভাগি করে ললিপপ চুষতে পারতো সে কিনা শখ করেই এই গেঁয়ো আর শুটকো শরীরের কলিম উদ্দীনের সাথে বাদাম খেয়ে আর ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে পুরো যৌবনটা পার করল। কলিম উদ্দীন আসলেই জাদু জানে। নইলে এমনটা কী করে সম্ভব। রেবেকা তো অন্ধ নয়। কলিম উদ্দীন আসলেই একটা বাজিগর।
অফিসে কলিম উদ্দীনের দায়িত্ব দিন দিন বাড়ছে। তার এত দিনের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটনোর একটা সুযোগ এসেছে। সে কিছুতেই এটা হাতছাড়া করতে রাজী নয়। সে একটা কিছু করে দেখাতে চায়। তার বসও তাকে প্রতিনিয়ত কিছু একটা দেখানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। সে-ও সেটা আলগোছে লুফে নিচ্ছে। তার পারফর্মেন্সের যে সূচক তা নাসার রকেটের মতো কোনো প্রকার কাত ছাড়াই সপ্তম আসমানমুখী। তাকে আটকায় এমন সাধ্য কার। ক্যারিয়ারে সে আসলেই একটা ফেরারী। তার সীমানা শুধু নীল আকাশ। তার লক্ষ্য সে নিজেও জানে না।
রেবেকার সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এতদিন প্রেম করে, বাদাম খেয়ে সময় কাটিয়েছে। এখন দুজনেরই চাকরি হয়েছে। তাছাড়া বিয়ের এটাই উপযুক্ত বয়স। বিয়ের পর ছেলে সন্তান নিতে হবে। তাদেরকে মানুষ করতে হবে। তার জন্যে সময় দরকার। দেরি করে কী লাভ। কোনো এক শুভক্ষণে যথানিয়মে তাদের বিয়ে হয়ে যায়। রেবেকা কলিম উদ্দীনের বাসায় চলে আসে।
কলিম উদ্দীনের জীবনের ষোলকলা কাণায় কাণায় পূর্ণ। গর্বিত শিক্ষা জীবনের শেষে সোনার হরিণ চাকরি। সাথে সাথে প্রেমিকার সাথে মধুর মিলন। সুন্দর একটা বাসা। সেখানে মা-বাপ, ভাই-বোন। এমন জীবন ক’জনের হয়। অতীতের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। হায়রে কষ্টের জীবন। আল্লাহ চাইলে আনন্দের ফুল ফুটতে কতক্ষণ। কলিম উদ্দীন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এক জীবনেই ধন্য সে। বাহবা কুড়োনোর মতো। লাইফ হো তো এ্যায়সি। কলিম উদ্দীন এখন রাজ কুন্দর। রেবেকা শিল্পা শেঠী। সে মনে মনে স্বপ্ন দেখে একদিন সে শশী থারুর হবে। তবে রেবেকাই হবে তার সুনন্দা পুষ্কর। সে তার জীবনে অন্য কাউকে আশা করে না।
দিন যায়, মাস যায়। এভাবে বছর গড়াতে গড়াতে প্রায় অর্ধযুগ। কলিম উদ্দীন এখন অনেকটাই মলিন। মাত্র পাঁচ বছর। কলিম উদ্দীন তাতেই যেন বুড়িয়ে গেছে। হাঁপিয়ে উঠেছে তার জীবন। এই পাঁচ বছরে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে তাকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে। একদার ব্যক্তিত্ববান কলিম উদ্দীন এখন কথায় কথায় বসকে খুশি করার জন্য হাত কচলায়। তার ব্যক্তিত্বের শেষ রেশটুকুও যে কখন মুছে গেছে তা সে নিজেও জানে না। যে চামচাদের সে এক সময় ঘৃণা করতো এখন সে নিজেই সেই দলভুক্ত। তার ঘৃণা হয় না। মাঝে মাঝে সামান্য একটু রাগ হয় আর কি। করপোরেট লাইফে এসব খুব মামুলী ব্যাপার। এখানে টিকে থাকা, উপরে ওঠা অনেক জটিল সমীকরণ। তার জন্যে অনেক কিছু করতে হয়। যে শিল্পী না তাকেও গাইতে হয়। যে বক্তা না তাকেও প্রয়োজনে কথার ফুলঝুরি ছড়াতে হয়। যে কখনো হাসেনি তাকেও হতে হয় দুর্দান্ত কমেডিয়ান। এটাই পারফেকশন। এর পিচ্ছিল মেঝেতে কারও পা হড়কে যায়। কেউ বা দাঁড়িয়ে যায় নির্দ্বিধায়। এখানে সবই সম্ভব।
কলিম উদ্দীনের পা হড়কায়নি। সে দাঁড়িয়ে গেছে। বেশ ভালোভাবেই। গত বছর সোনার মেডেলও পেয়েছে। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই কেন জানি তাকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। বাইরে তার পারফর্মেন্স ভালো হলেও ঘরে তার অবস্থা একদম নাজেহাল। স্বামী-স্ত্রী দুজনের চাকরি। পুরোপুরি রোবোটিক লাইফ। দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এখন মাঝখানে হিমালয় পাহাড় কিংবা প্রশান্ত মহাসাগর-এ দুটোর যে কোনো একটিকেই অনায়াসে বসিয়ে দেওয়া যায়। রেবেকাও দিন দিন কেন জানি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন কাজ করে এসে তারও আর যেন কিছুই ভালো লাগে না। কলিম উদ্দীনের সাথে বেশির ভাগ রাত কথাই হয় না। জীবনের সব আয়োজনের ভিড়ে ভালোবাসার আয়োজনটুকু কখন যে ফিকে হয়ে গেছে দুজনের কেউই তা খেয়াল করেনি। আর খেয়াল করেও লাভ নেই। জীবন আসলে এক দুর্বিসহ আতসবাজীর খেলা। যেখানে আলো আছে কিন্তু তা পথ দেখায় না। যেখানে উচ্ছ্বাস আছে। কিন্তু তা মরিচীকার মতোই ধোকা। এখানে একটা চমক ধরতে গেলে দশটা মৌলিক সুখ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। কলিম উদ্দীন ও রেবেকার জীবনও এর চেয়ে অন্য কিছু নয়। তারা তা বুঝতে পারেন কিন্তু এই বৃত্তের বাইরে যাওয়ার সাধ্য তাদের নেই। তারা জীবনের জালে জড়িয়ে গেছে।
কলিম উদ্দীন উদ্যমী। হতাশা তার ধাতে নেই। সে পরিশ্রমীও। তাই সে স্বপ্ন দেখে। বসের ঐ কাচের দেয়ালে ঘেরা ঘরে একদিন তাকে বসতে হবে। খোলা জায়গায় টেবিল চেয়ার পেতে উদ্বাস্তুর মতো আর কতদিন। সে স্বপ্ন দেখতে থাকে। তার স্বপ্নই তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একটার পর একটা ডিগবাজি খেয়ে প্রায় চার পাঁচটা ব্যাংক ঘুরে কলিম উদ্দীন হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে সে একটি কাচের দেয়ালে ঘেরা কক্ষের মধ্যে বসে আছে। সে আনমনে হেসে ওঠে। নিজেই নিজেকে বলে-কলিম উদ্দীন, তুমি পারও বটে। শেষ পর্যন্ত তুমি সাকসেসফুল। কিন্তু এটা এমন একটা ফুল যাতে গন্ধ নাই। শুধু দেখতেই সুন্দর। শুনতেই ভালো।
রেবেকার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন তলানীতে এসে পৌঁছেছে। তাদের সাড়ে সাত বছরের দাম্পত্য জীবনে একমাত্র সন্তান টিউলিপকে নিয়েই ইদানীং যত সমস্যা। সমস্যার সূত্রপাত কে কাকে কতটুকু সময় দিচ্ছে। কলিম উদ্দীন সকাল আটটায় বেরিয়ে যায়। রেবেকাও। দুজনেরই ফিরতে ফিরতে রাত। এদিকে কাজের লোকের কোলে কোলে টিউলিপের চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়। দিনে দিনে তার অবস্থা টিস্যুতে মোড়া স্যান্ডউইচের মতোই। টিউলিপের বয়স এখন সাড়ে তিন। সে বাবা মাকে মিস করতে রাজী না। কাটা কাটা কথায় সে তার আবদার স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। এই নিয়েই শুরু হয় তাদের সমস্যা। রেবেকার অভিযোগ অবশ্য মিথ্যে নয়। কলিম উদ্দীন সবই বোঝে। কিন্তু কাচের দেয়াল থেকে সে আর বাইরে আসতে পারে না। তার জীবন যেন ওখানেই বাঁধা।
আজ তার চাকরি জীবনের এক যুগ পূর্ণ হলো। কলিম উদ্দীন একটা পার্টি দিয়েছে। সেখানে রেবেকাও থাকবে। থাকবে টিউলিপও। কিন্তু আলাদা আলাদা। রেবেকা তার ফোন কোম্পানীর বসের হাত ধরে পার্টিতে আসবে। টিউলিপকে নিয়ে আসবে তার গভর্নেস। কলিমউদ্দিন সরাসরি অফিস থেকে পার্টিতে। এক যুগ পূর্তিতে তার পক্ষ থেকে সবার জন্যে একটা সুখবর আছে। তার প্রমোশন হয়েছে। সে এখন তার বিভাগের প্রধান। তার কাচের দেয়াল এখন আরও অনেক বেশি প্রশস্ত।
গুড্ডু ভ্যারাইটিস স্টোর
মহল্লার মধ্যেই দোকানটা। প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে। বুড়ো থেকে গুঁড়ো সবাই যাচ্ছে। দেদারসে কিনছে। কী আছে না-বলে বলতে হবে কী নেই। আইডিয়াটা কার দেখতে হবে না। মহল্লারই কৃতি সন্তান গুড্ডুর। এক সময় সে এই পাড়ার ত্রাস ছিলো। কয়েক বছর ভালো মাল কামিয়েছে। এখন নিজেই ত্রাণ কর্তা। গিন্নীদের মুখে গুড্ডুর ভারি প্রশংসা। মাঝে মাঝে স্বামীরাও বিরক্ত। কিন্তু কিছু করার নেই। গুড্ডু একটা লিভিং লিজেন্ড। বর্তমান সময়ের হট কেক। তার অমর সৃষ্টি গুড্ডু ভ্যারাইটিস স্টোর যে কাউকে ঈর্ষান্বিত করে। অনেক মেয়েরাই আফসোস করে-ইস্! গুড্ডুটা কেন যে হঠাৎ করে বিয়ে করে ফেললো। কিন্তু গুড্ডুতো কোনো ভুল করেনি। পাশের পাড়ার ল্যাংড়া লতিফের মেয়ের সাথে আলগা ফূর্তি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে অবশেষে বিয়ে করে জান বাঁচিয়েছে। না-বললে অবশ্য বত্রিশ মামলার আসামী ল্যাংড়া লতিফের চাপাতি এক কোপে তার কল্লা নেমে যেত। গুড্ডু ভ্যারাইটি স্টোর আর আলোর মুখ দেখতো না।
গুড্ডুও ইদানীং বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। দুরন্ত সন্ত্রাসী সন্ত্রাস ছেড়ে দিয়ে এখন পুরোপুরি ব্যবসায়ী। মহল্লার মধ্যেই থাকে সারাক্ষণ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে খেলা করে সময় কাটায়। গুড্ডুর এই পরিবর্তন চোখে পড়ার মতন। একদা যাকে সবাই মহল্লার মধ্যে দাঁ, কাচি, খন্তা, কুড়াল, চাপাতি, রামদা, হকিস্টিক নিয়ে দৌড়াতে দেখেছে সেই গুড্ডুই এখন শিশুদের প্রিয় পাত্র। সকলের প্রাণপ্রিয় গুড্ডু ভাই। গুড্ডুর জীবনে এই পরিবর্তন আসলেই চোখে পড়ার মতো। সত্যিই স্বপ্ন মনে হয়।
গুড্ডুর জন্ম হয়েছিল মূলত পাশের বস্তিতে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। লেখা পড়া তেমন কিছু করা হয়নি। তবে নাম লিখতে পারে। ছোটবেলা থেকেই পোশাকে আশাকে গুড্ডুকে মোটামুটি আকর্ষণীয় আর ব্যক্তিত্ববানই মনে হয়। তার মধ্যে অদ্ভুত একটা নেতৃত্ব গুণ আছে বলতে হবে। মহল্লার ছেলেরা তার নেতৃত্বে বহু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দারুণ সাফল্য লাভ করেছে। এই মহল্লার যে কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যারিস্টারের চাইতে তার সুনাম বা দুর্নাম যা বলি দুটোই বেশি। তার নামেই এই মহল্লার নাম। তার কারণেই আশেপাশের সব পাড়ার লোকজন এই এলাকার লোকজনকে সমীহের চোখে দেখে। এই পাড়ার মেয়েরা মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে যেখানে সেখানে যায়। কারো কিছু বলার থাকে না। গুড্ডু জানলে খবর আছে। মেয়ে মানুষের অপমান সে বরদাস্ত করতে পারে না। সাথে সাথে তার অস্ত্র কথা বলে ওঠে। শাস্তি একটাই। হাত পা ল্যাংড়া করে দেওয়া। গুড্ডুর বিধান বড় নির্মম। সবারই জীবনের মায়া আছে। গুড্ডুর আদালতে কেউ যেতে চায় না।
গুড্ডুর আরও বেশ কয়েকটা ভালো গুণ আছে। সে মুরুব্বীদের সম্মান করে, ভীষণ নিরহঙ্কার আর মুখটা সারাক্ষণই হাসি হাসি। তার বৈশিষ্টটাই এমন যে যে কেউ প্রথম দেখায় তাকে নিতান্ত গোবেচারা ভেবে ভুল করতে পারে। কিন্তু যখন জানতে পারে যে ঐ ছেলেটিই গুড্ডু তখন অনেকেই ভয়ে চুপসে যায়। কেউ কেউ দূর থেকে আর চোখে তাকায়। কাছে আসতে সাহস পায় না। গুড্ডু বুঝতে পারে। সে নিজেই ডাক দিয়ে কথা বলে। সবাই খুশি হয়। গুড্ডুটা আসলে এমনই।
সুখের সময়গুলো কেন জানি খুব দ্রুত পার হয়ে যায়। দেখতে দেখতে গুড্ডু ভ্যারাইটিস স্টোরের প্রথম বর্ষপূর্তি হয়ে যায়। এই সময়ের মধ্যে আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাও ঘটে। গুড্ডু তার প্রথম সন্তানের মুখ দেখতে পায়। গুড্ডুর কাছে মনে হয় পৃথিবীতে এর চেয়ে সুখের আর কিছু নেই। সে পাড়ার সব লোকজনকে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ায়। মসজিদে মসজিদে মিষ্টি বিতরণ করে। তার কাছে মনে হয় জীবন এতদিনে যেন সত্যিকারের পূর্ণতা পেল।
মহল্লার কিছু ছেলের মতিগতি ইদানীং তার কাছে কেন জানি খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না। তারা কেন জানি অনেক বিষয়ে গুড্ডুকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। গুড্ডুর বুঝতে বাকি থাকে না কে তাদেরকে মদদ দিচ্ছে। সে মনে মনে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। গুড্ডু বরাবরই একটু হিসেবী।
গুড্ডুর এক সময়ের বন্ধু পরে প্রতিদ্বন্দ্বী রিপন এতদিন নানা কারণে গুড্ডুর সাথে সুবিধা করে উঠতে পারেনি। কিছুদিন আগে সরকারি দলে যোগ দেওয়ায় বর্তমানে তার অবস্থান মোটামুটি ভালো। গুড্ডুকে ছাড়িয়ে যেতে না-পারলেও প্রায় তার পাশাপাশি চলে এসেছে। এখন শুধু অতিক্রম করার অপেক্ষা। আর এজন্যে তাদের যে কোনো একজনকে তো অবশ্যই সরে যেতে হবে।
নীল ঘুড়ি ও একঝাঁক পায়রার গল্প
পায়রাটি এসেছিল অনেক দূর থেকে। হঠাৎ করেই। এখানে তার আসার কথা নয়। তবুও এসেছিল। বিধির বিধান। নিয়তির নির্মম পরিহাস। নইলে পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে এখানে কেন। তাও আবার মারা পড়তে। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটেছিলো যা আসলে ঘটার কথা নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটে যা আসলেই ব্যতিক্রম। এই ঘটনাটি হয়তো তেমন কিছু নয়। তবে তার কাছাকাছি।
দেখতে দেখতে অনেক পায়রা ছুটে এলো। কারণ আকাশে একটি নীল ঘুড়িও ছিল। পায়রারা তার চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতে তার সাথে গল্প জমাতে শুরু করল। কেউ কেউ বেশ খানিকটা সফলও হলো। এই একটু মুচকি হাসি কিংবা সামান্য চোখ ইশারা। পায়রাদের তাতেই মরি মরি অবস্থা। ভালোবাসার এক আধটা খুদ-কুড়ো অনেক সময় অমৃত তুল্য। তাদের অবস্থাটাও ঠিক তাই ছিলো।
নীল ঘুড়ির একটা নাম ছিলো। থাকতেই পারে। ধরে নিলাম সেই নামটা ছিলো নীলা। একেবারে বেমানান নয়। মোটামুটি। চলনসই। পায়রাদের কারো নাম সোহেল, কারো নাম আমিন, কারো মাসুদ, কারো বা জামাল। সাধারণত যেমনটা হয়। কিন্তু তারা সবাই তাদের নাম ভুলতে বসেছিল। তাদের কাছে একটা নামই বেঁচেছিল। নীলা। সেই নামের মধ্যেই তারা নিজেদের খুঁজে পেত।
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন চলে গেলো। খেলা জমে তো জমে না। সবাই কনফিউজড। নীল ঘুড়িটা আসলে কার। একজন ঠিক করল ঘুড়ির সুতো ছিঁড়ে দেবে। যার হাতে এসে পড়বে সে-ই ঘুড়ির মালিক। অন্যেরা বললো দরকার নেই। ঘুড়ি উড়ছে সেই ভালো। কী প্রয়োজন তাকে হাতে তুলে নেওয়ার। তাদের সম্ভবত সব হারানোর ভয়। ভালোবাসায় এই একটাই জ্বালা। সব হারানোর ভয়।
কিন্তু ঘুড়িটাও দারুণ চঞ্চল। বোঝা যায় না কখন কোনো দিকে কাত হয়। এই পূর্বে তো ঐ পশ্চিমে ঝুঁকছে। কখনো উত্তরে কখনো বা দক্ষিণে। কখনো বা সোজা উপরের দিকে আসমান বরাবর। ভালোই লাগে দেখতে। কিন্তু কারো কারো কলিজা পুড়ে ছাই। তবু তারা আশাবাদী। ঘুড়ির বাহারে মুগ্ধতা এতটাই যে তার অবহেলাটুকুও যেন পৃথিবীর মধুরতম প্রেমের চেয়েও মিষ্টি। মিলনের চেয়ে আনন্দময়। ঘুড়ির নাম যে নীলা।
নীলা এবার কলেজে পা রাখল। দারুণ জমজমাট তার সময়গুলো। এক একটা দিন যেন হীরের টুকরো। তার ব্যস্ততাও ভীষণ। একদিকে পড়াশোনার চাপ, অন্যদিকে রূপচর্চা, সাজগোজ। এমনটা হতেই পারে। সে অক্লান্ত। তার ভালোই লাগছে।
পায়রাদের অবস্থা বেহাল। কেউ ফেল করে আবার সেই পুরনো হাইস্কুলের গুমোট ক্লাসরুমে দম বন্ধ লেকচার শুনছে। কেউ বা ঘুড়ির সাথে উড়াল দিয়ে সোজা কলেজে। কিন্তু কেউই আশাহত নয়। ভালোবাসায় সব সম্ভব। বিন্দু বিন্দুতে যখন সিন্ধু হয় আর অপেক্ষায় যদি পাথরও গলে তবে প্রেমে কী না হয়। ভালোবাসা হচ্ছে পাগল সন্ন্যাসী যার এক ফুঁকে অন্ধ দৃষ্টি পায়। বোবা কালা কথা কয়। অশীতিপর বৃদ্ধ নতুন যৌবনের ভারে থর থর করে কাঁপে। নির্বাচনে বারবার হেরে যাওয়া প্রার্থী পায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এটা আইনস্টাইনের ঊ=সপ২-এর সূত্রের চাইতেও ভয়াবহ। মাধ্যাকর্ষণের বাবা।
ঘুড়িটা উড়ছেই। এখন সে তার আকাশের মধ্য গগনে। বয়স আঠারো চলছে। দারুণ সময়। মনের মধ্যে ল্যাভয়েসিয়ের রসায়নের জটিল সমীকরণ। হাতের কলমে নিউটনের ক্যালকুলাস। কখনো তা ইন্টিগ্র্যাল, কখনো ডিফারেন্সিয়াল। কে বাদ পড়ে, কে যে যুক্ত হয় তা সে নিজেও জানে না। টম ক্রুজ থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা, ম্যারাডোনা থেকে ল্যান্স আর্মস্ট্রং-সবাইকে ভালো লাগে। বুকের ভেতর কিং খানের জন্যে ধুক পুকানি। গৌরীটা একটা হতচ্ছাড়া ছাড়া আর কিছু না। ওর মধ্যে আছেটা কী? তবুও তার কিং খানকে আটকে রেখেছে। আর কিং খানও বা কেমন! ওর মধ্যে সে কী এমন দেখল। এখানেও অবশ্য প্রেম। প্রেমে সব সম্ভব।
ঘুড়ির হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়। তার মন খারাপের কারণ একটাই। পরীক্ষায় সে হেরে গেছে। তাকে টপকে একটি পায়রা আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। পায়রার অহঙ্কার তার পছন্দ নয়। সে চায় সব পায়রা তার চারপাশে ঘুরপাক খাবে। তাকে সেলাম করবে। তার আনন্দে হাসবে। তার দুঃখে কাঁদবে। সে তাই ভীষণ বিরক্ত। পায়রাটা স্থানীয় হলেও একটা কথা ছিলো। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এখন আবার ঘুড়ির কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ওকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। কি আর করা। প্রেমের অভিনয়। যে ফাঁদে সবাই পড়ে।
ঘুড়িটা আলগোছে পায়রাটার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কানে কানে কী যেন বলে। পায়রা মাতোয়ারা হয়ে যায়। আদিম আহবান। পাগল করা। কে সামলাতে পারে। পায়রার বয়সও আঠারো। আউট অব কন্ট্রোল। মাথার ভেতর থেকে সব কিছু উধাও। ক্লাসের ভালো ছাত্র। দিনে দিনে স্যারদের বকুনি। বাবা-মা’র শাসন। তবুও দিশেহারা। সিগারেটের ধোয়ার মধ্যে ঘুড়ির মুখচ্ছবি। ঘুড়ির সাথে খুঁটিনাটি আর খুনসুটি। এভাবে দিন যায়। রাত যায়। অবশেষে হেরে যাওয়া। কিন্তু কী আর করা। মেনে নিতে হবে। এটাই জীবন।
ঘুড়ির কাছাকাছিও এখন আর কেউ নেই। পায়রা দূর থেকে তাকে প্রদক্ষিণ করছে। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। পরাজিত পায়রার সব খোয়া গেছে। নিঃস্ব। কোথাও চান্স হয়নি। অবশেষে সাধারণ একটি কলেজে পাস কোর্সে ভর্তি। কী আর করা। এমনটা হতেই পারে। মেনে নিতে হবে। ভালোবাসায় সবই সম্ভব।
ঘুড়ি এখন বুয়েটের এক ছাত্রের সাথে ঘুরপাক খাচ্ছে। টিএসসিতে তাদের দেখা সাক্ষাৎ। পাশাপাশি বসে গল্প করা। চা, চিনে বাদাম, চানাচুর, আইসক্রীম। মাঝে মাঝে পায়রার সাথে সাক্ষাত। কিন্তু নিরুপায়। সাদামাটা অতীতের কথা ক’জনের মনে থাকে। মনে রেখেই বা কী লাভ। নিদারুণ পানসে। বুয়েটের ছেলেরা অনেক স্মার্ট। কি অঙ্কের খেলায়, কি প্রেমের লীলায়। হলের মধ্যেই প্রেমের সুবন্দোবস্ত। যাও, দরজা বন্ধ করো, মস্তি মউজ করে ধুয়ে মুছে ফিরে আসো। আবার পড়াশুনায় মনোযোগ। ভালো রেজাল্ট হলে ভবিষ্যৎ ধবধবে। পুরনো পায়রার কথা ভেবে কী লাভ। অবশ্য সেটা তো ছিল প্রমের অভিনয়। সত্যিকারের প্রেম হলো এই বর্তমান কাল।
পায়রার অবস্থা সঙ্গীন। দুচোখে ঘোর অমানিশা। অতঃপর ভুল পথ। অনুতাপ। সেখান থেকে ফেরার আকুতি। কিন্তু সব সময় মিরাকল আশা করা ঠিক নয়।
অনামিকা
আমার জনম দুঃখিনী বোন সূচনা জাহান রুমা। আমার মহৎ হৃদয়ের অধিকারী দুলাভাই। আমার প্রিয় ভাগ্নী জান্নাত ও তন্ময়। সবাইকে অনেক ভালোবাসা সহ আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
পৃথিবী হচ্ছে এমন একটি জায়গা যেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই বারবার ঘটে। আমার এই ঘটনাও তেমনি একটি সাধারণ ঘটনা। যা আমাদের চারপাশে মাঝে মাঝেই ঘটে। কিন্তু প্রতিটি সাধারণ ঘটনার ভিতরেও কিছু অসাধারণত্ব লুকিয়ে থাকে। যার নেপথ্যে থাকে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত চরিত্রগুলো। তেমনি একটি আবহমান ঘটনা নিয়ে আমার এই গল্প। যা আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে অন্যরকম এক পৃথিবীতে।
আমার একমাত্র মেয়ে নুবার প্রথম জন্মদিন ছিল পনের অক্টোবর। দিনটি উদযাপনের জন্যে সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে গাজীপুর থেকে সোজা রওনা হই ঢাকায়। ঢাকায় আমার আপাত খালি বাসা থেকে আগেই গুছিয়ে রাখা লাগেজগুলো নিয়ে রাত এগারোটার গাড়িতে রওনা হই খুলনার উদ্দেশ্যে। খুলনায় আমার স্ত্রী আমার ছোট্ট কন্যা শিশুটিকে নিয়ে থাকে। কারণ সে চাকরিজীবী। ঢাকায় ছোট্ট শিশুটিকে বাসায় রেখে অফিস করার অসুবিধা সামলাতেই মাত্র মাস দুয়েক আগে সে খুলনায় বদলি হয়েছে। কারণ সেখানে তার পিতৃকুলের বসবাস। নানা-নানির কাছে তাকে রেখে আমার স্ত্রীর অফিস করা কিছুটা হলেও সুবিধাজনক হবে ভেবে আমারা উভয়ে এই সিদ্ধান্তে একমত হই।
যা হোক আমি যাচ্ছি খুলনায়। মেয়ের প্রথম জন্মদিন উদযাপন করতে। রাতের ভ্রমণ আমার কাছে খুব একটা অস্বস্তির ছিলো না কখনই। কিন্তু এবারের ভ্রমণটা কিছুটা অন্যরকম। ছোট্ট নুবাকে দেখি না প্রায় একমাস। মাসখানেক আগে যখন রমযানের ঈদে খুলনায় গিয়েছিলাম তখন আমি তাকে দেখেছিলাম। মাঝখানে মাত্র এক মাস। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল যুগ যুগ আমি নুবাকে দেখি না। তাই ঘুম আসছিল না দুচোখে। প্রথম জন্মদিনের উৎসব আর আমার ছোট্ট নয়নের মণিকে দেখার আগ্রহে আমার দুচোখের পাতা এক হচ্ছিল না কিছুতেই।
আমি জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর অস্পষ্ট রূপের ভিতর তাকিয়ে আমার অগোছালো অস্তিত্বের নিবিড় অবয়বের ভিতর দিয়ে কী যেন খুঁজছিলাম। এভাবে কখন যে রাত পেরিয়ে গেলো টের পেলাম না। আস্তে আস্তে ভোর হচ্ছিলো।
গাড়ি খুলনায় এসে পৌঁছাতেই আমি নেমে পড়লাম। মালপত্র বুঝে নিয়ে ছুটলাম শ্বশুরের বাসায়। আমার নুবাকে দেখব বলে। যখন বাসায় পৌঁছলাম তখনো পুরোপুরি ভোর হয়নি। নুবা তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। আমি মশারি টেনে ভিতরে ঢুকে ওর পাশে বসলাম। ওর মুখের দিকে তাকাতেই রাজ্যের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ভুলে গেলাম সারা রাত্রির নিদ্রাহীন ভ্রমণের কথা। ওর কপালে একটা চুমু খেলাম। ঘুমন্ত শিশুর কপালে চুমু খাওয়া ওর জন্য ক্ষতিকর কিনা এই কুসংস্কারের কথা মাথায় এলো। ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও হলো পৃথিবীতে আমার অস্তিত্বের ভগ্নাংশ।
জন্মদিনের আয়োজনে কখন যে দিনটা পেরিয়ে গেল টের পাইনি। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হল। সন্ধ্যায় কেক কাটা হল। মূলত নুবার জন্মদিন ছিল পনের অক্টোবর। কিন্তু ঐ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। তাই অফিস করে রাতেই রওনা হলাম। জন্মদিনের অনুষ্ঠান করা হলো শুক্রবারে। ঐ দিন ছিলো ষোল তারিখ। অর্থাৎ একদিন পর আমরা ওর জন্মদিন পালন করলাম। কর্মজীবনে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়। সব স্বপ্ন ইচ্ছেমতো পূরণ করা যায় না।
রাতের অনুষ্ঠান শেষ করতে করতে প্রায় দশটা বেজে গেল। ঢাকায় আমার জরুরি কাজ থাকায় ঐ রাতেই আমাকে ফিরতে হলো। আমি রাত এগারোটার গাড়ি ধরলাম। গাড়ি ধরার জন্যে বাসা থেকে একবারেই প্রস্তুত হয়ে বের হলাম। যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। আমি টিকিট নিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়লাম।
পাশের সিটের একটা বেশ চটপটে ছেলে কী যেন বারবার বলে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি মন দিতে পারলাম না। গাড়ি চলতে লাগলো। সবাই যার যার আসনে বসে পড়লো। রাতের শহরের বুক চিড়ে গাড়ি ছুটছে।
তবে এবারের ভ্রমণটা কেন জানি আমার কাছে অতটা মন্দ লাগছিল না। কারণ পাশের সিটে যারা বসেছিল তারা বেশ আন্তরিক ছিলো। তবে তাদেরকে নিয়ে গল্প লেখার মতো তেমন কিছু ছিলো না। তবুও তাদের অনুরোধে এই গল্পের খণ্ডাংশ। কারণ আমি তাদের খুশি করার জন্যে গল্প লিখব বলে কথা দিয়েছিলাম।
Comments
Post a Comment