ওমর খালেদ রুমি লেখেন প্রচুর। তার প্রমাণ তার গ্রন্থতালিকা। ২০০১ এ বেরিয়েছে তার প্রথম গ্রন্থ। ২০০৯ এ দেখা যাচ্ছে এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে দশটির অধিক বই। ওমর খালেদ রুমি সব্যসাচী লেখক। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প-সর্বত্র তার সমান বিচরণ। ‘কাগজ ছেঁড়ার খেলা’ ওমর খালেদ রুমির সম্প্রতি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। ছোট আকারের বই নয়, ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার একটি বই, যাতে কবিতা রয়েছে মোট চুরাশিটি। একজন তরুণ তার অন্যান্য কাজের বাইরে লেখার জন্য সময় আলাদা করে রাখেন, কিংবা বলা যায় অন্যান্য কাজের যথেষ্ট প্রয়োজন স্বত্তেও লেখালেখির জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় ও পরিশ্রম করতে দ্বিধাবোধ করেন না। আর তারই ফসল হয়ে ওঠে তার অজস্র লেখা। কিন্তু শত শত পৃষ্ঠা লিখে গেলেই চলে না। সবচেয়ে বড় শর্ত থাকে যা তা হলো লেখাকে মানসম্মত হতে হয়। হঠাৎ হঠাৎ একটি দুটি মানসম্মত কবিতা বা গল্প কেউ কেউ লিখে দেখাতে পারেন, তা প্রকাশ হলে তিনি প্রশংসাও কুড়োন, কিন্তু অজস্র ধারায় প্রতিনিয়ত লিখে যেতে হলে প্রয়োজন হয় গভীরতর সত্তায় শিল্প তৈরির ক্ষমতাসম্পন্ন গুণ। এই গভীর সত্তায় সর্বাংশে কবি বা গলপকার বা উপন্যাসিক বা একই সঙ্গে সকল কিছু হওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়, খুব কম সংখ্যকই তা পারে। সেই কমসংখ্যক মানুষের সঙ্গে নিজেকে সামিল করতেই ওমর খালেদ রুমির এতসব সৃষ্টি-তাড়না, নাকি শুধুই লেখার আনন্দে লেখা, সেই প্রশ্নের বিশদ ব্যাখ্যার চেয়ে তার একটি কাব্যগ্রন্থের আলোচনা বা পাঠ এর মাধ্যমেই বরং তাকে বুঝে নেওয়া যায়। ‘কাগজ ছেঁড়ার খেলা’ গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাতে যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো কবির অনুভূতিপ্রবণ মন এবং একই সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞান। জন্ম, মৃত্যু, বেঁচে থাকা, প্রেম, আকাক্সক্ষা এসব কিছু নিয়েই কবির মনে বহুদিনের নানা প্রশ্নোত্তর একটা পরিণত বোধে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে তার কবিতার পঙক্তিগুলি প্রায়শই সেই বোধের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এই বোধের প্রগাঢ়তা ও ঋদ্ধতাই একজন কবির কবিতাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত হতে সাহায্য করে, এই সত্য রুমির কবিতাতে বারবার বেজে ওঠে।
‘চলো ওঠা যাক। অনেক কথা হলো আজ/ বিমূর্ত রাত্রির মতো অন্য এক আঁধার/ খেলা করে ভেতরে তুমুল। তুমি কি অপেক্ষারত?/ আমার সময় নেই। আমি উঠে যাব...’ বইয়ের প্রথম কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি এরকম। এই কবিতায় যা দেখা যায় তা হলো কবির মধ্যকার বিভক্তি। কবি উঠে পড়বেন বলে প্রস্তাব করছেন এবং একই সঙ্গে অন্য একজনকে কল্পনা করছেন যে কিনা অপেক্ষারত। পরবর্তি পঙ্ক্তিগুলোয় কবি প্রেমের চিরন্তন আকর্ষণ এবং সেইসঙ্গে পাপপূণ্য ও প্রাচীনত্ব ও আধুনিকতা নিয়ে হালকা হালকা রঙের আঁচড়ের মতো তৈরি করেছেন ধারণার বিভিন্নতা।
কবিতাকে ঠিক এ সময়েরই কবিতা করবার ক্ষেত্রে যে পরিমিতি বোধ, আঙ্গিক সচেতনতা, চিত্রকল্প ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব নতুন কোন অবয়বের প্রয়োজন, তার সকল কিছুই ওমর খালেদ রুমি কবিতায় ধরে রাখতে সচেতন। দেখা যার অনেকাংশে তিনি সফলও। ছোট্ট একটি কবিতা, ‘জীবন’ এতে দেখা যায় তার গভীরতা স্পর্শ করবার ক্ষমতা। ‘জীবন আমার কাছে রাত্রি, ছোপ ছোপ অন্ধকার/ অবহেলা, নিশীথের অন্ধকারে আলোর প্রত্যাশা/ কঠিন খেলা; ভিন্ন এক মেলা।’
ওমের খালেদ রুমির কবিতায় প্রেমের বিচার বিবেচনাই প্রধান। কিন্তু প্রেমের কাছে তিনি হৃদয়কে সমর্পণ করেও পরক্ষণে উচ্চারণ করেন অন্য বোধের পঙ্ক্তি। কখনো কখনো তার এমনও উপলব্ধি হয় :
‘ভোগের আরাধনা কখনই প্রশান্তি আনে না।’ অথবা, ‘এখন আমার চোখ দুটোকে কেবলই মনে হয় অর্থহীন/ আর তোমার ধূসর গ্রীবার ভাঁজে জমেছে শুধুই ঝুলকালি।’
কিন্তু অনেক কবিতাতেই কবি সরাসরি প্রেমের বন্ধনা করেছেন। ‘যেখানে রাতের ফিনফিনে আঁধারেও/ নারী তার শাড়ি খুলে ফেলে নির্দ্ধিধায়/ নগ্নতা যেখানে ধ্র“পদী আর/ ক্ষরণ যেখানে পবিত্র প্রবাহ/ তার কাছে যাব’
ভাবনার গভীরতায় যেমন ডুব দেওয়ার অভ্যাস, তেমনি সহজতাকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা আছে ওমর খালেদ রুমির। ফলে কাগজ ছেঁড়ার খেলা কাব্যগ্রন্থের কবিতা সকল শ্রেণির পাঠকেরই ভালো লাগবে। কাগজ ছেঁড়ার খেলা বইটি প্রকাশ করেছে মুক্তচিন্তা প্রকাশনা। প্রকাশ কাল ফেব্র“য়ারি ২০০৯। প্রচ্ছদ এঁকেছেণ ওমর খালেদ রুমি নিজেই। বইটির মূল্য আশি টাকা। (ইয়াসির আজিজ)
Comments
Post a Comment