সূচীপত্র
জলমহল
সোনালি দিনের সোনালি বালিকারা
অনন্তর জীবনের শেষ দিন
একাকী জ্যোৎস্নায় অরুণিমা
সমুদ্র স্নান
এসেন্স অভ্্ পেডিয়াট্রিক্স
দ্য কলামিস্ট
কবি ও কলমিলতা
কুইন অফ মাওনা
শোভা
সুপ্রভাত! হে বালিকা!
মিনতিলতা
ছোটগল্প নিয়ে ভাবনা
ছোটগল্প হচ্ছে ক্যামেরার ফ্লাশ। জীবনের পটভূমিতে এক টুকরে আলোর ছটা। শৈশবে দেখা বায়োস্কোপের এক ঝলক বাহারী রঙ্গিন চিত্রকল্প। ছোটগল্প হচ্ছে এক টুকরো কথোপকথন। প্রিয়ার এক ঝলক চাহনি। ছোটগল্প আসলেই ছোট ছোট কিছু ঘটনার মৌলিক বহিঃপ্রকাশ। ছোট গল্পকে তাই কখনও কখনও মনে হয়ে এক পশলা বৃষ্টি, এক প্রস্থ মিষ্টি হাসি কিংবা একটি চোরা চাহনি। ছোটগল্প সম্পর্কে এমনি হাজারো কথা বলা যায়। তবে মূল কথা হলো এই যার অবয়ব, এই যার আবেদন তাকে অস্বীকার করার মত দুঃসাহস লেখক হিসেবে আমার কখনও ছিলো না। বরং যা ছিলো তাকে দুর্বার আকর্ষণই বলা যায়। আর এই আকর্ষন থেকেই সেই শৈশবেই গল্প লিখতে বসা। শুধু লেখাই নয়। রাতারাতি প্রকাশ করার মত দুঃসাহস। আমার প্রথম ছোট গল্প গ্রস্থ ”শতাব্দীর সৌরভ” প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে বলতে হবে। ২০০৮-এ এসে সমাপ্ত করেছি আমার দ্বিতীয় ছোটগল্প গ্রন্থ ”কৃষ্ণচূড়া ও অন্যান্য প্রেমের গল্প” যা ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারীর বইমেলায় পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ২০১০ সালের ফেব্র“য়ারীর বইমেলায় বের হয়েছিল তৃতীয় ছোটগল্প গ্রন্থ ”হেলেনকে আমি ভালোবেসেছিলাম”। আর এরই ধারাবাহিকতায় এটি আমার চতুর্থ ছোটগল্প গ্রন্থ।
গল্প নিয়ে অনেক ভাবনা। অনেক এক্সপেরিমেন্ট। তার প্রমানও মিলবে আমার লেখা গল্পগুলোতে। আমি সবসময়ই চেয়েছি আমার লেখা ছোটগল্পগুলো যেন কায়া ছেড়ে মায়া হয়ে উজাড় উড়াল দিতে পারে। কতটা পেরেছে তার বিচারের ভার সব সময়ই থাকবে পাঠকের উপর। তবে ইচ্ছে আছে বিভিন্ন আঙ্গিকে ছোটগল্পের ব্যাবচ্ছেদ করা। সেটা হয়ত অনেক কঠিন কাজ। তবুও ধৃষ্টতা কিছুটা দেখাতেই হচ্ছে। কারণ গল্পকার হওয়ার স্বপ্নকে এত সহজে ছেড়ে দিতে পারছি না।
আসলে আমি গল্প লিখি কারণ গল্পে কেমন যেন একটা স্বস্তি পাই। মনের মধ্যে অন্যরকম একটা প্রশান্তি খুঁজে পাই। বাইশ গজের পিচে একজন বোলার যেমন ভালো বল করে তৃপ্তি খুঁজে পান তেমনি একজন ব্যাটসম্যানও স্বস্তিঃ খুঁজে পান সেই বলে দুর্দান্ত শট হাঁকিয়ে। আমার মাঠে অবশ্য আমিই বোলার, আমিই ব্যাটসম্যান। তারপরও অস্বস্তির কিছু নেই। পাঠকরা আছে দর্শক হিসেবে। তাদের হাততালি পেলেই বুঝতে পারব ব্যাপারটা দারুন হয়েছে। জয়তু ছোটগল্প।
জলমহল
কোন এক বিষণœ বিকেলে প্রশান্ত নামের ছেলেটি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। সে নিকটস্থ একটি ফার্মেসীতে গেলো এবং পাঁচ পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে এনে তার কাঠের ঘরের নড়বড়ে দরোজা বন্ধ করলো। যদিও তার বাসাটা বাজারের ভিতরেই কিন্তু কেন জানি সেখানটায় অদ্ভুত একটা নিরবতা বিরাজ করে। আর এই নিরবতার ধার ঘেষেই সে আস্তে আস্তে তার কিনে আনা পাঁচ পাতা ঘুমের ওষুধের তিন পাতা পর্যন্ত খেতে সমর্থ হয়। প্রশান্ত ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যায় অনেক মানুষের অজান্তেই। কিন্তু দুভার্গ্য তার এখানেই যে সে মরতে সক্ষম হয় না। কেউ একজন তাকে খুঁজতে গিয়ে অচেতন অবন্থায় আবিস্কার করে এবং সবাই মিলে প্রশান্তকে টেনে হেঁচড়ে রাস্তার উপর নিয়ে আসে। তার সারা শরীরে পানি ঢালা হয় এবং আস্তে আস্তে তার ঘোর কাটতে থাকে। কয়েকজন মিলে তাকে হাত ধরে হাঁটায়। প্রশান্ত টলতে টলতে তাদের সাথে পা ফেলে। তাদের উদ্দেশ্যে একটাই। প্রশান্তকে ঘুমাতে দেওয়া যাবে না। একবার ঘুমিয়ে পড়লে সে আর সেই ঘুমের জগৎ থেকে ফিরবে না। প্রশান্তর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও শেষ পর্যন্ত সবার চেষ্টাই সফল হয়। প্রশান্ত আস্তে আস্তে জেগে ওঠে। কিন্তু তার এই জেগে ওঠা যে অর্থহীন তা সবাই না জানলেও কেউ কেউ জানে। তারাও প্রশান্তকে বেঁচে থাকার জন্যে কৃত্রিম মনোবল জোগায়। কিন্তু তারা নিজেরাও জানে তাদের এই সান্ত্বনা অসাড়। অর্থহীন প্রলাপ। প্রশান্তর আসলে মরে যাওয়া উচিত। কিন্তু সবকিছুর পরও প্রশান্ত বেহায়ার মতো বেঁচে ওঠে। ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগে না কারো কারো। তারা মনে মনে বলে, তোর মরে যাওয়াটাই তো ঠিক ছিল। মরতে গিয়ে তুই আবার থামলি কেন? বেক্কলের মতো বেঁচে ওঠার কোনো মানে হয়!
দিন আসে। দিন যায়।
রাত আসে। রাত যায়।
বলেশ্বরের স্রোতে জলের ধারা বয়ে চলে কালের নিয়মে।
প্রশান্ত আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে।
জীবন এগিয়ে চলে জীবনের নিয়মে। আসলে কোন কিছু থেমে থাকে না। না থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রশান্তর আত্মহত্যার অপচেষ্টার কাহিনী আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় সময়ের স্রোতে। জনতার কোলাহলে অন্য কোন কাহিনী হয়ে ওঠে মুখোরোচক। কিন্তু কেন জানি আমার বুকের ভেতর প্রশান্তর আত্মহত্যার চেষ্টার এই কাহিনীটা খচখচ করে বিধতে থাকে। আসলে প্রশান্ত কেন মরতে চেয়েছিল?
একাত্তরে প্রশান্তর মা-বাবা মারা যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। তাতে স্থানীয় রাজাকারদের যে হাত ছিলো না, একথা বলার কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছোটবোনকে কোলে নিয়ে প্রশান্ত কোনোমতে পালাতে সক্ষম হয়। সে যাই হোক। এরকম ঘটনা আরও অনেকের জীবনে ঘটেছে। প্রশান্ত এই লাইনে নতুন কেউ নয়। তার মতো আরো অনেক প্রশান্ত আমাদের চারপাশে আজো নির্বাক ঘুরে বেড়ায়। স্বাধীনতার চলি¬শ বছরের মাথায়ও আমরা প্রশান্তদের প্রেতাত্মা থেকে মুক্ত হতে পারিনি। পারিনি এই জন্যে যে প্রশান্তরা কেন জানি স্বেচ্ছায় মরে যায়নি। আবার কেউ তাদের খুঁজে পেতে ধরে ধরে অন্তত মেরে ফেলেনি। সবচেয়ে বড়ো কথা প্রশান্তরা যুদ্ধের প্রতি সর্বনিম্ন শ্রদ্ধার স্মৃতি নিয়ে স্বরূপে আজো সমাজের ভেতরেই একটা আনাকাক্সিক্ষত বস্তু হিসেবে রয়ে গেছে। প্রশান্ত না চাইলেও কেন জানি তার অস্তিত্বের ভুত সহজেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে যেতে চায় না। সবকিছু সয়েও ঠিক ঠিক বেঁচে থাকে। প্রশান্তকেও তাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে উঠতে হয়। আসলে না চাইলেও অবহেলার এই যে জীবন তা থেকে প্রশান্তরা এত সহজে যেতে পারে না। তাকে যেতেও দেওয়া হয় না। কখনো কখনো বোনের সম্ভ্রম হারানোর দৃশ্য দেখার জন্য প্রশান্তকে বারবার বেঁচে উঠতে হয়। তার মৃত্যু এত সহজ নয়।
প্রশান্তর ছোট বোনটা যাকে নিয়ে সে যুদ্ধের সময় পালিয়ে ছিল- থাকে ছোট্ট বাজারটার অপর প্রান্তে। একটা খালি বাড়িতে। বাড়িতে মাত্র একটাই ঘর। সেই ঘরে দুইটা মেয়ে। একটা প্রশান্তর বোন, অন্যটা তার বোনের বান্ধবী। দুজনে মিলে ছোট সংসার। প্রশান্ত সেখানে থাকে না। কারণ দুটো। একটা হচ্ছে যেহেতু অন্য একটা মেয়ে থাকে। দ্বিতীয়টা আপাতত বলা যাবে না। যাহোক প্রশান্ত সময় পেলেই বোনের ওখানে যায়। খোঁজ খবর নেয়। বোন তার খেয়ে পড়ে ভালোই আছে। তবে প্রশান্তর যা একটু কষ্ট। এই মফস্বলের বাজারে তার আয়ের তেমন কোন উৎস নেই। জমি জিরাত যা ছিলো তার সবই যুদ্ধে খোঁয়া গেছে। তারা বলতে গেলে নিঃস্ব। সে ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়িয়ে যা দু’পয়সা পায় তাতেই পেট চালানোর চেষ্টা করে। তবে মাঝে মাঝে না খেয়েও থাকতে হয়। হিন্দু হওয়ার সমস্যা অনেক। মুসলমান বাড়িতে খেতে পারে না। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু বাড়ি আর কটা।
সব দুুঃখ মেনে নিয়েও প্রশান্ত ভালোই ছিলো। তার মনটা আরো ভালো হয়েছিল যখন সে জানতে পারল জলমহলের বাবু তার বোনের পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়েছেন। যাক, এবার তাহলে বোনের একটা গতি হলো। সেই বাবুই তাকে এই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে মনে মনে বাবুকে ধন্যবাদ দেয়। পথ চলে আর ভাবে, বাবুর অনেক দয়া।
জলমহল হচ্ছে এই এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারের পারিবারিক বাসস্থানের নাম। বাড়ির চারপাশে চারটি দিঘি। মাঝখানে সুরম্য প্রাসাদ। নাম জলমহল। এই এলাকার পত্তন থেকে শুরু করে যত উন্নয়ন সবই জলমহলের কল্যাণে। অবশ্য বিতর্কও যে কিছু নেই তা কিন্তু নয়। এলাকার কর্তৃত্বের মধ্যে দিয়েই তাদের উত্থান। অতএব, এলাকার উন্নয়নের সিংহভাগই গেছে তাদের উন্নয়নের পেছনে। তবুও মানুষ খুশি। কারণ তাদর সুবাধেই এলাকায় আজ আলো জ্বলছে। তা সে শিক্ষার আলোই হোক আর বিজলী বাতির আলোই হোক। একাত্তরে জলমহলের অধিবাসীরা পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করেছিল। তাতে তাদের লাভও হয়েছিল বেশ। স্বধর্মী-বিধর্মী অনেকেরই বিষয় সম্পত্তি হস্তগত হয়েছিল তাদের। মারা পড়েছিল কিছু নিরপরাধ মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা। সে যা হোক জলমহলের জৌলুসে তাতে একটুও ভাটা পড়েনি। একটুও খাটো হয়নি তাদের প্রভাব। যুদ্ধের পর প্রভাব প্রতিপত্তির জোরেই সেই কলঙ্ক তারা মুছে ফেলেছিল। রাতারাতি জলমহল হয়ে গিয়েছিল পবিত্র তীর্থভূমিতে। ধনে জনে যার বসবাস তার ভাগ্য এভাবেই বাতাসে দোল খায়। কি যুদ্ধ, কি মহামারী আর কি বন্যা কিংবা খরা তার সুদিন বারোমাস। মানুষের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রাদের ভাগ্য তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। জলমহল তাই দিনে দিনে তীর্থে পরিণত হয়েছে।
প্রশান্তর এসবে কিছু আসে যায় না। সে রাজনীতি করে না। ধর্ম নিয়েও তার মাতামাতি নেই। আসলে রাজনীতি আর ধর্মের মত জটিল বিষয়গুলো সে একটু কমই বোঝে। নবম-দশম শ্রেণির গণিতে তার মাথা ভালো। বিজ্ঞানেও তার জ্ঞান বেশ প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু স্কুলের ভালো ছাত্র প্রশান্ত অভাব আর অনিশ্চয়তার দুনিয়ায় বোবা, কালা, অন্ধ। এভাবেই হয়তো ভালো থাকা যায়। প্রশান্ত নাক, চোখ বন্ধ করে ভালো থাকতে চেষ্টা করে।
জোড়া তালি দেওয়া এই ভালোলাগার মাঝে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় একটা সংবাদে। সংবাদটা তার কাছে আসে অত্যন্ত গোপনে। সে শোনেও অতি সাবধানে। এই তল¬াটে তার শোনার যোগ্য নয় এমন কিছু শুনতেও তার ভয়। পাছে এই শোনার অপরাধেই না আবার তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়। কোনটা যে অপরাধ আর কোনটা নয় তা তার এই ছোট্ট জীবনে সে আজো বুঝে উঠতে পারেনি। না পারাটাই স্বাভাবিক। মেরুদণ্ডী প্রাণী হলেও তার কোন মেরুদণ্ড নেই। সে আসলে দৃশ্যত মেরুদণ্ডী। কিন্তু সে জানে তার মেরুদণ্ডের ভিতরটা ফাঁপা। বায়ু দ্বারা পূর্ণ। বেলুনের মত সামান্য সুঁইয়ের আঘাতে চুপসে যাবে। প্রশান্ত নামের বেলুনটি নিঃশব্দে ফেটে আস্তে মিলিয়ে যাবে সবার অজান্তে। ভয় তার এখানেই।
কেউ একজন প্রশান্তর কানে কানে ফিস ফিস করে যে খবরটি দেয় তা রীতিমত বিস্ময়কর। কিন্তু খবরটি শোনার পর থেকে সে কেমন যেন হিম হয়ে যায়। নিজেকে তার একটা শীতল সরীসৃপ মনে হয়। অবশ্য সাপ হলে ভালো হতো। সাপের বিষ আছে। কিন্তু প্রশান্তর তাও নেই। সে হলো গোবেচারা অমেরুদণ্ডী প্রাণী, যেমন- কেঁচো।
প্রশান্ত মনে মনে ঠিক করে কথাটা তার বোনকেই জিজ্ঞেস করবে। কারণ অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করাও তার জন্যে অপরাধ হয়ে যেতে পারে। প্রশান্ত মনে মনে আশা করে তার বোনের জবাব যেন না হয়। তাহলে সে এই পৃথিবীতে আরও কিছুটা দিন স্বস্তিতে বেঁচে থাকতে পারবে।
প্রশান্ত আস্তে আস্তে তার বোনের বাসায় যায়। বারান্দায় গিয়ে বসে। তার মুখটা কেমন শুকনা শুকনা দেখায়। বোন কেন জানি খানিকটা শংকিত হয়। আস্তে জিজ্ঞেস করে- কিরে, শরীর খারাপ?
- না
- তা হলে এমন লাগছে কেন?
- কেমন লাগছে?
- কেমন যেন। ঠিক বোঝাতে পারবো না।
- ও কিছু না। এমনিই।
- শোন, তোকে একটা কথা জিজ্ঞস করবো। আমি যে কথাটা তোকে জিজ্ঞেস করেছি তা তুই কাউকে বলবি না। এমনকি তোর বান্ধবীকেও না।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। কি কথা, বল?
- জলমহলের বাবু কি রাতে তোর কাছে শুতে আসে?
মাথা নিচু করে দীপা। তার মুখ থেকে আর কোন কথা বের হয় না। প্রশান্ত নিচু চোখে তাকায়। তখন দীপার চোখ থেকে টপটপ করে জলের ফোঁটা মেঝেতে পড়েছে।
প্রশান্ত যা বোঝার বুঝে নেয়। সে অনেক কষ্ট তার শরীরটাকে টেনে তোলে। তারপর ঘর থেকে বোরোনোর জন্য পা বাড়ায়। খানিকটা থেমে আস্তে বলে- জানিস যুদ্ধের সময় ওরাই আমাদের বাবা-মাকে খুন করেছিল।
কথাগুলো বলতে প্রশান্তর অনেক কষ্ট হয়। সে আর কথা বাড়ায় না। তার চোখে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম জল টলমল করে। বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অংশটুকু প্রশান্ত তার নিজের অজান্তেই বোনের বাড়ির সেই বরান্দায় ফেলে রেখে চলে আসে। তার বোন হয়ত খানিকটা বুঝতে পারে। কারণ এই ভাই-ই তাকে সারাজীবন ছায়ার মতো আগলে রেখেছিল।
দীপার মনটা কি এক অজানা শংকায় ভরে ওঠে। কিন্তু কেন জানি মুখে কিছুই বলতে পারে না। সবকিছুকেই সে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছে। দুর্বলের নিয়তিই সার।
এরপরও আর বেঁচে থাকার মধ্যে প্রশান্ত কোন মানে খুঁজে পায় না। ফার্মেসীর ওষুধগুলো সে সবই খেতে চেয়েছিল। কিন্তু তিন পাতা খাবার পর সে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপরের অংশের কিছুই প্রশান্তর জানা হয় না।
তার আত্মা শুধুমাত্র চেয়ে চেয়ে দেখে দীপার কোলে যীশুর পাবিত্র মাথার মতই প্রশান্তর শান্ত মস্তক চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে।
সোনালি দিনের সোনালি বালিকারা
আমার নাম রূপম।
আমার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন যে কোন কারনেই হোক হঠাৎ করে আমার মা মারা যান। আমি এতিম হয়ে যাই। সবাই আমার দিকে কেমন একটা বিষন্ন আর করুন দৃষ্টিতে তাকায়। বিষয়টা একদিকে যেমন ভালোলাগে তেমনি অন্যদিকে আবার কেমন যেন একটু দুঃখও হতো। সবার জন্যে কেমন যেন একটা মায়া অনুভব করতাম। তখনও মৃত্যু কি জিনিস তা ভালো করে বোঝার মতো বয়স আমার হয়নি। তাই উল্টো সবাইকে আমার কেন জানি দুঃখী মনে হতো। কিন্তু বড় হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম সেদিন আসলে আমিই দঃখী ছিলাম। আর আমার জন্য সবারই ছিল øেহের দৃষ্টি । অবুঝ হৃদয়ের সেই ভুলের জন্য তখন ভীষন দুঃখ হয়েছিল। সেই দৃশ্য মনে হলে মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতাম। হায়! উল্টো আমি সবাইকে দুঃখী ভেবেছিলাম। অথচ মা হারিয়ে আমিই ছিলাম সবচেয়ে দুঃখী। কিন্তু জগতের এত কিছু লীলা খেলা বোঝার মতো বয়স যে তখনও আমার হয়নি। তাই সবাইকে মনে মনে ক্ষমা করে দিলাম।
এসবই আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছিল বড় হয়ে যখন দেখলাম সবার মা আছে, আমার মা নেই। আমি আর এক প্রস্থ কাঁদলাম । মা না থাকাটা ভীষণ অসুবিধার। স্কুলে যাওয়ার সময়, খাওয়ার সময় কিংবা পড়া তৈরীর সময় অথবা নিতান্ত ঘুমাতে যাবার সময় কারও আদর পাওয়া যায়না। এটা সত্যিই অসুবিধা। আমি মায়ের কথা মনে করার চেষ্টা করতে থাকি কিন্তু তেমন কিছু মনে করতে পারি না।
আমার বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ। অবশ্য অনেক লোকই বুদ্ধিমান হয়। এটা এমন কোন বিষয় নয়। এই যেমন ধরুন বাসের সামান্য একজন কন্ডাকটার, সেও দারুন বুদ্ধিমান। কারন ভাড়া তুলতে এসে সে সবার কাছ থেকেই আস্ত নোট নিয়ে বসে থাকে। তার সাফ সাফ জবাব, আমার কাছে ভাংতি নেই। ভাংতি হলে দেবো। অগত্যা ব্যস্ততায় অনেকেরই মন থেকে তার নোটের কথাটা টুপ করে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আলগোছে মুছে যায়। স্টেশনে বাস থামতেই দ্রুত নেমে পড়ে। আর তখনই সেই কন্ডাকটার ঐ ভদ্রলোকের দেয়া নোটটা আস্তে করে ভেতরের পকেটে রেখে দেয় । আমি নিজেও একদিন এই ঘটনার শিকার । সাথে গাড়ী না থাকায় গুলিস্তান থেকে বাসে চড়ে কাকরাইল যাচ্ছিলাম। ভাংতি না থাকায় একশ টাকার নোট দিলাম। কন্ডাকটার আমাকে বলল, ভাংতি নেই, ভাংতি হলে দেব। আমি গোবেচারার মত বসে রইলাম। কাকরাইল চলে এলো। আমি নেমে গেলাম। একশ টাকার নোটটা কন্ডাকটারের হাতে রয়ে গেল। দুটাকার বদলে একশ টাকা। মন্দ নয়। আমি সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, কন্ডাকটাররাও বুদ্ধিমান প্রানী। ভালোই লাগলো ব্যাপারটা ভাবতে। জগতে দলমত নির্বিশেষে সবাই বুদ্ধিমান। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই বুদ্ধিমান। এই একটা জায়গায় সবার মধ্যেই দারুন মিল। খাচার পাখি থেকে শুরু করে ধূর্ত শেয়ার ব্যবসায়ী, গৃহিনী থেকে শুরু করে ঝানু রাজনীতিবিদ,পদার্থের প্রফেসর থেকে শুরু করে ময়লাকুড়ানী মেয়ে - কার ঘটে নেই বুদ্ধির মত একটি সাধারণ উপাদান। ব্যাপারটা ভাবতেই ভালো লাগে। মনটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে যায়।
আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম আমার বাবার সুক্ষè দৃষ্টি ভঙ্গির কথা তার গভীর অর্ন্তদৃষ্টির কথা। কিন্তু মাঝখান থেকে এসে গেল বুদ্ধি নামক বিষয়টি । কারন এই জিনিসটি আমার নাকি কমই আছে। তবে এসব অবশ্য আমার বান্ধবীদের মতামত। যে জিনিসটা সবার অঢেল আছে সেই জিনিসটি আমার কম আছে এটা সত্যিই দারুন লজ্জার।
আমি অবশ্য নিজেকে বুদ্ধিমানই মনে করি। যদিও তারা আমার মাঝে বুদ্ধিমত্তার তেমন কিছু খুঁজে পায় না। তারা অবশ্য সব সময়ই বলে যে আমি এতটাই বোকা যে নারীর ঐ ছোট্র মনটুকুও বুঝিনা। ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার মানে বুদ্ধিমান বুঝায়না। বুদ্ধিমান হলো তারাই যারা দুই আর দুই যোগ করে অনায়াসে ছয় বানাতে পারে। কিন্তু ধরার উপায় নেই। আমি তাদের দলে পড়িনা। কারন আমার মধ্যে তেমন কিছু নেই। আমি সারাক্ষন শুধু ঠকি। এবং ইচ্ছে করেই সব্ইা আমাকে ঠকায়। কিন্তু আমি আমি সেটা ধরতেও পারিনা।
তাদের কথার অবশ্য যুক্তি আছে। কারন এই কিছুদিন আগেও একজন বেকার যুবক যখন আমার কাছে এসে ইনিয়ে বিনিয়ে একহাজার টাকা চাইল জামা কাপড় কিনে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে বলে আমি তাকে দুই হাজার টাকা দিলাম। এই কথা জানার পর সবাই এসে আমাকে জানালো যে ওটা হলো একটা মস্ত যোচ্চোর আর ওর কাজই হলো মানুষের সাথে প্রতারণা করা। ওই টাকায় নাকি রাতভর ডাইল খাবে। এসব ইন্টারভিউটিউ কিছু না। সব ভুয়া। অবশ্য টাকা দেওয়ার পর তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। অন্য কারো সাথেও হয়নি। ওরা আমাকে চূড়ান্ত নির্বোধ হিসেবেই রায় দিল। আমিও নির্দ্ধিধায় মেনে নিলাম। নিজেকে আমার সেই রাজার মতোই মনে হলো যে অচেনা লোককে ঘোড়া কেনার জন্য টাকা দিয়েছিল।
কিন্তু সব কিছুরই ব্যতিক্রম আছে। সৃষ্টির শুরু থেকে গাছ থেকে যত আপেল পড়েছে সবাই তা কুড়িয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছিল বলেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিষয়টি তখনও পর্যন্ত অনাবিস্কৃত রয়ে গিয়েছিল। নিউটন নামক একজন কম বুদ্ধির লোক আপেল না খেয়ে উল্টো তা নিয়ে গবেষণায় বসলেন। তিনি ভাবতে শুরু করলেন আপেল নিয়ে। আপেল আকাশে না গিয়ে মাটিতে পড়ল কেন? আবিস্কৃত হল মাধ্যাকর্ষণ তত্ব। আমরা পেলাম আকাশ যান আরো কত কি। আমার টাকা পেয়ে উধাও হয়ে যাওয়া সেই ধান্ধাবাজ ডাইলখোর তিন মাস পরে এসে হাজির। পরনে দামী পোশাক, গলায় টাই। আমাকে সালাম করে বললো, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি অবাক না হয়ে বললাম -হ্যাঁ, পেরেছি। সে হাসল। তারপর বললো, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি পেয়েছি। বেতন ষাট হাজার টাকা। দিনে দিনে শুধু বাড়বে। বিয়ের কথা ভাবছি। কাজের চাপে আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ পাইনি। নতুন চাকরি। বোঝেনই তো। ছুটিছাটা নেই। আগামী বছর ফরেন এসাইনমেন্ট। ভালো করলে গাড়ী-বাড়ী অনেক কিছু।
সবাই অবাক। বলতে গেলে হা। ব্যাটা বলে কি। কার্ড বাড়িয়ে দিতেই সবাই তা লুফে নিল। আমার দেখার আগেই সবার দেখা শেষ। সত্যিই বিদেশী কোম্পানী। সত্যিই এক্সিকিউটিভ। যুবকের মুখে হাসি। নীচু হতে হতে সে বললো, আর একবার আপনাকে সালাম করি ভাইজান। সেদিন টাকাটা না পেলে ইন্টারভিউ দিতে পারতাম না। চাকরি তো দূরের কথা না খেয়ে মরতে হতো। এখন আর ডাইল খাইনা। স্কচ খাই। আপনি খাবেন না। ভালো মানুষেরা এসব খায় না। আমি তাকে বললাম, আমি ভালো মানুষ নই। তোমাকে এমনিই টাকাটা দিয়েছিলাম। পৃথিবীর সব ভালো মানুষেরা এই কথাটাই বলে। আপনি যে ভালো মানুষ তা আর একবার প্রমানিত হলো। সে যা হোক জগতে কিছু কিছু ভালো মানুষ আছে বলেই সংসারের চাকা চলছে। ভালো মানুষেরা হচ্ছে চাকার গ্রীজ। গ্রীজ ছাড়া চাকা ঘোরে না।
যুবক চলে যায়। যাবার আগে শুধু এটুকু বলে, আপনার বিশ্বাসের মর্যাদাই আমার প্রতিষ্ঠা। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমিও যেন মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকতে পারি। সবাই ভালো থাকবেন ।
সবাই বলে উঠল, মিরাকল! কেউ বলল না আমার দূরদর্শীতা। আমিও তাই নির্বোধের তালিকায়ই রয়ে গেলাম।
আমি সোনালি বালিকাদের গল্প বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নানা ফালতু প্রসঙ্গ এসে ভিড় করছে। অবশ্য একেবারে ফালতু নয়। আমার বালিকারা এসবের মধ্যে নিহিত। তারা বিরাজিত আমার চারপাশের এই প্রতিবেশ ও পরিবেশের মধ্যেই। তারা বনের প্রাণী নয়। তারা আকাশেও ওড়ে না। কেউ কেউ অবশ্য পানিতে সাঁতার কাটে এবং বিমানে ওড়ে। তবুও এটাই সত্য যে তাদের বাস মূলত: ধরণীর ধুলায়। যতই আধুনিক হোক এই শহর আর তার জীবন, এর ফাঁক গলিয়ে সেই সব সোনালি বালিকাদের শুভ্র পদ পদ্মে খানিকটা হলেও যে ধূলো লাগে তার প্রমান তাদের বাসার বাহারী সব কার্পেটের উপস্থিতি। ধূলো না থাকলে কার্পেটের কোন প্রয়োজন ছিল না। মানুষ মূলত: ধূলোর সঙ্গী।
আমি অবশ্য সোনালী বালিকাদের গল্প বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বার বার অন্য প্রসঙ্গ এসে ভিড় করছে। অন্য রকম একটা ভালোলাগা আমাকে পেয়ে বসেছে। ভালোলাগা আজ কেন জানি খানিকটা হলেও আর্দ্র। কেমন যেন একটা ভিজে ভিজে অনুভূতি। আমার মনটাও তাই আর্দ্র। আমি আজ রাতে ভীষণ ভালো আছি । আর এজন্যেই হয়ত সোনালি বালিকারা এসে আমার অনুভূতিতে ভীড় জমিয়েছে। বালিকারা এমনি এমনি আসেনা। সোনালী সময়েই ঘটে সোনালী বালিকাদের আগমন। আমি আমার বাবার সূক্ষè অর্ন্তদৃষ্টির কথাও বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে আর যাওয়া হয়নি।
আমার বাবা আসলেই সূক্ষè অর্ন্তদৃষ্টির মানুষ। আমার কোন কিছুই তার চোখ এড়ায় না। সে তার অর্ন্তচক্ষু দিয়ে আমাকে দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করে। আমাকে নিয়ে ভাবে এবং ভালোবাসে । আমাদের দুজনের এক জীবন বলতে গেলে অনেক কথার স্মৃতি। অনেক দীর্ঘ গল্প। এই গল্পে সেই গল্প করার উদ্দেশ্য আমার নেই। কারণ একটাই। আমি স্থির করেছি আজকের এই ভেজা ভেজা অনুভূতির রাতে আমি আমার পিতার অপত্য øেহের সেই দারুন সব স্মৃতিচারণ করে মন খারাপ করবো না। কারণ মা না থাকায় আমার জীবনে তাকে সেই মায়ের স্থানটাও পূরণ করতে হচ্ছে। বোন না থাকায় তাকেই নিতে হয়েছে সেই দায়িত্ব। সে এক বিরাট ইতিহাস। দীর্ঘ পথ চলা। সোনালি বালিকাদের গল্পের এই ছোট্ট পরিসরে আমার বাবার সেই বিরাট ভূমিকার ইতিহাসের কানাকড়িরও জায়গা দেয়া কঠিন হবে। তার একটা ছোট্ট টুকরার আয়তনই যেন আমার কাছে একটি হিমালয়ের চাইতে বড়। তাকে রাখার জায়গা নেই এই গল্পে। তবুও যদি গল্পের সুবাদে একটু আধটু এসেই যায় তবে তার প্রাসঙ্গিকতা বিশালকায় তিমির পৃষ্ট দর্শণের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
যাহোক আমার সোনালি দিনে সোনালি বালিকারা এসেছিল। সব কিশোরের জীবনে আসে। আসে সব তরুণের জীবনে। আসে সব যুবকেরও। সত্যি কথা বলতে কি এসব খুবই সাধারণ। তবুও আমি গল্প লিখতে বসলাম। হয়তো কিছু একটা অন্যরকম ছিল।
সোনালি বালিকারা সংখ্যায় ছিল তিনজন। একজনের নাম রায়হান। অপর জনের নাম রেবেকা। আর শেষ জনের নাম রেহানা। তিন জনই অনন্যা। রূপে গুনে অতুলনীয়া। তারা এমনি এমনি আসেনি। আমি তাদের বেছে বেছে জোগাড় করেছিলাম। তিনজনই আমার সাথে ঘনিষ্ট ছিল। বন্ধুত্ব বলা যায় যাকে। তারা আমাকে স্পর্শ করেছিল আমার অনুভূতির গভীরতম প্রদেশে। তবে ব্যতিক্রম শুধু এটুকুই তারা প্রত্যেকেই আমাকে প্রেমিক ভেবেছিল। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা ছিল না। তাদের একজন ছিল আমার মায়ের অবয়বে। একজন ছিল আমার বোনের মত। আর অন্যজন ছিল আমার খালার আদলে। যার কাছে আমি বড় হয়েছি। তারা এসবের কিছুই জানত না। শুধু শুধু ভালোবাসা নিয়ে ভেবে ভেবে অস্থির হতো। আমি মনে মনে শুধু হাসতাম।
আমি ধোয়া তুলসী পাতা নই। মেয়ে মানুষের মন বুঝি। বুঝি তাদের ধর্ম-কর্ম। আমারও হৃদয় জুড়ে প্রেমিকার আসনে একজন ছিল। তবে সে এদের কেউ নয়। সে আমার বাবার পছন্দের মেয়ে। ছেলের বউ করে আনবেন বলে যাকে তিনি আমার খুব ছোট্ট বেলায়ই ঠিক করে রেখেছিলেন। তার নাম বর্ষা। সে থাকে কলকাতায়। তার বাবা মার সাথে। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে বর্ষা এই গল্পের কোন চরিত্র নয়। তার সাথে আমার অন্য জীবন। এই গল্পে আমি শুধু সোনালি দিনের সোনালী বালিকাদের গল্পই বলব। আর তারা মাত্র তিন জন।
রায়হান কে আমি আমার মায়ের জায়গায় কল্পনা করতাম। তার সেই গুণ ছিল। সে øেহবৎসল, কোমলমতী, মায়াময়। আমার প্রতিটি বিষয়ে নজর রাখত। সবার আগে রায়হানের চেখে পড়ে আমার চুল উস্কোখুস্কো, চোখে ক্লান্তি, রাতে ভালো ঘুম হয়নি, পড়াশুনায় মনোযোগ নেই, খাওয়া-দাওয়া হয়নি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। যা হোক সে তাই আমার মায়ের আসনে বসেছিল। রেবেকা ছিল আমার খালার মত। নিয়ম কানুনের প্রতি ভীষণ অটল। আমাকে নিজের মত করে চলতে শেখার ব্যাপারে তালিম দানকারী। আমার অনিশ্চিত পৃথিবীর শংকায় শংকিত এবং আমার যা কিছু প্রয়োজন তার সরবরাহকারী। এখানে বলে রাখা ভালো আমাদের স্বচ্ছলতা প্রশ্নাতীত। অঢেল অর্থ বিত্তের মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা। আমার সোনালি বালিকারাও স্বচ্ছল পরিবারের। তাই অভাব মেটানোর জন্য নয় বরং উপচে পড়া স্বচ্ছলতার জন্যেই একজন আর একজনের জন্যে খরচ করার ব্যাপারে দ্বিধাহীন ছিলাম। রেবেকা বলতে গেলে আমার প্রয়োজনীয় সবই নিজের থেকে কিনে ফেলত। তাকে কোন কিছু বলতে হতো না। আর ওর হাসি ছিল একটা মিষ্টি বোনের মতোই। আমার সাথে ঘুরতে বের হওয়ার জন্যে পাগল ছিল, গান বাজনা শোনা, সিনেমায় যাওয়া, পড়াশুনায় সাহায্য করা, থাকার ঘরটা নিজের হাতে গুছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি টুকটুকটাক বকাঝকা করা, ইত্যাদি, ইত্যাদি ছিল তার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। তাকে তাই আমার বোনের জায়গায় বসিয়ে ছিলাম।
কিন্তু তিন জনের কেউই তা জানত না। জানত না বর্ষার কথাও। তাদের হিসেব তাই কখনও মিলত না। তারা আমাকে প্রেমহীন পুরুষ বলেই জানত। কিন্তু আমি সুখী ছিলাম। আমাকে ঘিরে থাকা এই সব সোনালি বালিকারা আমার জীবনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল। বর্ষার কাছে আমি পেয়েছিলাম প্রেমের উষ্ণতা। তারা যখন বর্ষার কথা জানল ততদিনে দিবসের সূর্য অনেকটাই মধ্য আকাশে উঠে গেছে। তার উত্তাপ সবাইকে কিছুটা হলেও উত্তপ্ত করেছিল। এই বর্ষার মধ্যে এমন কি আছে যা তাদের নেই। আমি তাদের বলতে পারিনি তোমাদের মাঝে যা আছে তা বর্ষার মাঝে নেই বলেই বর্ষা আমার জীবনে এসেছে। বর্ষার মাঝে ছিল সংসারী হওয়ার গুণ। জীবনের হিসেবের খাতা নিয়ে সে সব সময় ঘুরে বেড়াত। সে আমাকে ভালোবাসত হিসেব করে। তার মাথা জুড়ে আমাদের সংসারে ছক। ভালোবাসাকে ছাড়িয়ে সেই তুমুল হিসেবের খেলায় সে সংসারের ছবি আঁকত। অন্যদের সরিয়ে নিজের জন্যে জায়গা করে নেওয়ার পাশাপাশি আমাকে সংসারী বানানোর তার তীব্র চেষ্টাই তাকে স্ত্রীর যোগ্য করে তুলেছিল। সে ছিল প্রেমিকার চেয়ে বেশী কিছু।
এদিক দিয়ে বলতে গেলে সত্যিকারের ভালোবাসা আমার জীবনে কখনও আসেনি। কারণ বর্ষা সেই প্রকৃতির ছিল না । সে ভবিষ্যতের কথাই ভাবতো। আমি তাই তাকে মেনে নিয়ে ছিলাম। শুধু আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। স্ত্রী হওয়ার জন্য চাই একজন কড়া মিস্ট্রেস যে শুধু ভবিষ্যতের কথাই ভাববে। সেও তার চেয়ে বেশী কিছু ছিল না। অবশ্য সে আমাকে ভালোবাসত এবং সেটা তার আমাকে ঘিরে ভাবনার মধ্যেই ফুটে উঠত। আমার বাবা তার জন্যেই এই কঠিন হিসেবী মেয়েটিকে পছন্দ করেছিলেন। সে সংসারের যোগ্য।
গল্পের শুরু দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে গল্পটা হয়তো লম্বা হবে। কিন্ত এই গল্পের লম্বা হওয়ার কোন কারণ নেই। আমার সোনালি বালিকারা এখন যার যার নিজস্ব সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সোনালী বালিকাদের একেক জন পৃথিবীর একেক প্রান্তে। বড় লোকের মেয়েদের উল্টোপাল্টা দেশে বিয়ে হয়। তাদের জীবনটাই এমন। একেক দেশ থেকে একেক রাজকুমার এসে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদের থেকে মুক্ত হয়ে আমি এখন বর্ষার সংসারে সংসারী। বর্ষা তার সংসারের হিসেব নিয়ে ব্যস্ত।
আমাদের ছোট্ট মেয়েটি মেঝেতে খেলা করছে। আমি গল্প শেষ করে তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সেও কেন জানি আমার দিকে তাকিয়ে অর্থহীন হাসল। আমি তাকে এমনিই বললাম, গল্প এখানেই শেষ। সে কি বুঝল জানি না।
ধৈরজ করিমু মন কি বুদ্ধি করিয়া
আন মনে মোর মন লৈ গেছে হরিয়া।।
- লায়লী মজনু, বাহরাম খান
অনন্তর জীবনের শেষ দিন
সকাল থেকেই ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। অনন্ত ঠিক করলো আজ আর সে অফিসে যাবে না। সারা জীবন অফিস অফিস করে সে জীবনটা আর মাটি করতে চায় না। আজ সে রাস্তায় বের হবে। এই ঘণঘোর বর্ষার মধ্যেই বের হবে এবং সারা শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরবে। অনন্তের এই সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টে আচমকা এবং পাগলামী মনে হলেও ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। ভেতরে ভেতরে সে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু এতোদিন পেরে ওঠেনি। পেরে ওঠেনি নানা কারনে। অনন্ত বরাবরই লেখাপড়ায় ভালো। তাই ছাত্রজীবনে কোন সুযোগই তার মেলেনি নিজেকে নিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানোর। তারপর পাস করার পরই চাকরি। অফিসের চার দেয়ালের ভেতরে বন্দি জীবন। অনন্ত যে হাঁপিয়ে উঠেছে তাও নয়। জীবনের এই বাস্তবতা তার যে শুধু একার তাও নয়। তবুও কেন জানি কোথায় কোন শূণ্যতা সারাক্ষণ তার বুকের ভেতরটায় তোলপাড় তোলে। অনন্ত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বাসা থেকে নিজেকে অফিসে যাওয়ার উপযোগী করে তৈরি হয়েই বের হয়। কিন্তু সে আর অফিসে যায় না। বৃষ্টির ভেতর মাথার উপর একটা ছাতা ধরে সে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। বৃষ্টির পানির ছাটে অনন্তর জুতো আর প্যান্টের গোছানো অংশ ক্রমশঃ ভিজে আসে।
অনন্তের জন্যে আজকের দিনটা একটু আলাদা। এই দিনেই মিনুর সাথে তার দেখা হয়েছিল। মিনু মেয়েটা মন্দ ছিলো না। ভালোবাসতো তাকে হৃদয় দিয়েই। কিন্তু মিনুর ভালোবাসা নিয়ে ভাববার মতো সময় অনন্তর ছিলো না। তার ভাবনা জুড়ে তখন শুধু জীবনের জটিল ধাঁধা। তাকে বড় হতে হবে। এই সব প্রেম ট্রেম নিয়ে ভাববার সময় কই। মিনুটা হঠাৎ করেই বিয়ে করে ফেলে। কোথাকার কোন উটকো এক যুবক এসে তাকে নিয়ে যায়। শোনা যায় পরের বাড়িতে সে সুখী ছিলো না। স্বামীর সাথে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হতো। তারপর একদিন হঠাৎ করেই মিনুর লাশ এসে হাজির হয়। হোগলা প্যাঁচানো লাশ। ময়না তদন্তের জন্যে কাটা ছেড়া করা হয়েছে। মিনুদের বাড়ির উঠানে রাখা। সবাই দেখতে গেলো হুড়মুড় করে। অনন্ত যায়নি। যে মেয়েটি একদিন তাকে ভালোবাসতো তার লাশ দেখা খুব একটা আনন্দের কাজ নয়। অনন্তের কাছে এই ব্যাপারটা একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে এসেছিল। প্রথমতঃ অনন্ত নিজেকে প্রশ্ন করেছিল
-মিনু কি তার প্রেমিকা ছিলো কখনও ?
- হ্যাঁ! সে নিজেই নিজেকে জবাব দিলো। কারণ সে-ও মিনুকে ভালবাসতো। কিন্তু প্রেম করার মতো সময় তার ছিলো না। এটা মিনু বা তার কারোরই দোষ নয়।
- দ্বিতীয়তঃ
- মানুষের চলে যাওয়া কতোটা স্বাভাবিক?
শেষের প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে অনন্ত রাস্তায় বের হয়েছে। অফিসে যে এই প্রশ্নের উত্তর নেই তা তার জানা। অনন্ত তাই হাঁটছে। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় একজন সুবেশ যুবক একটি প্রশ্নের উত্তরের জন্যে হেঁটে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আহামরি কিছু নয়। অনন্তর মনে হলো হাসপাতালের বিছানায় যারা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে তাদের সঙ্গী সাথী যারা কিংবা ভয়াবহ দূর্ঘটনার শিকার হয়ে যারা ইমার্জেন্সিতে মুমূর্ষ তাদের আপন জনরা যে বাস্তবতার মুখোমুখি তার চেয়ে তার অবস্থা অনেকটাই ভালো। আর তাই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়িত্ব তারই। সে হাঁটতে থাকে।
প্রচন্ড বৃষ্টিতে রাস্তা প্রায় খালি। কিন্তু অনন্তর থামবার সুযোগ নেই। একটা জীবন তার বরাবরই ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেই কেটেছে। আজও তেমনি। সে ক্রমশঃ হাঁটার গতি বাড়াচ্ছে। হঠাৎ করেই কে যেন তাকে পেছন থেকে ডাক দিলো। একটা মেয়েলি কণ্ঠ। কিছুটা চেনা চেনা। সে ফিরে তাকালো। অবাক হওয়ার কিছু নেই। মিনু দাঁড়িয়ে আছে। তার সারা শরীরে কাটা-ছেঁড়ার পর বিভৎস আকারের সেলাই। তাকে অনেকটা মেরী শেলীর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবের মতোই লাগছে। তবে মহিলা দানব। কিন্তু অনন্ত মোটেই চমকালো না। এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। নরোম গলায় জিজ্ঞেস করলো - তুমি কেমন আছো?
মিনুও নির্বিকারভাবে জবাব দিলো - ভালো আছি? তুমি কোথায় যাচ্ছো?
- একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে।
- কি প্রশ্ন?
- মানুষের চলে যাওয়া কতোটা স্বাভাবিক?
- একদম স্বাভাবিক।
- তুমি সত্যি বলছ ?
- হ্যাঁ। আমি কখনও মিথ্যে বলিনি। তোমাকে ভালোবাসতাম। এটাও মিথ্যে ছিলো না।
- জানি।
- তাহলে আমাকে ভালোবাসা দাওনি কেন?
- আমার সময় ছিলো না।
- কি লাভ হলো?
- কেন?
- তুমিও তো জগতে খুব বেশীদিন থাকতে পারলে না?
- কেমন করে বুঝলে?
- আজ তোমার শেষ দিন?
- হতে পারে। এভাবে কখনও ভাবিনি। তুমি কি আমার উপরে প্রতিশোধ নেবে?
- না।
- কেন?
- তুমি আমাকে ভালোবাসো।
- তুমি বিশ্বাস করো?
- হ্যাঁ, করি।
- কোন প্রমাণ আছে ?
- আছে?
- কি প্রমাণ?
- আমার মৃত্যুর পর তুমি ভাল নেই।
- আমার তো তা মনে হয় না। আমি ভালোই আছি।
- ভালো থাকলে তুমি অফিসে যেতে।
- প্রতিদিন অফিসে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
- আছে। প্রত্যেক চাকরিজীবী, বিশেষ কোন কারণ না থাকলে অফিস কামাই দেয় না।
- আমি ইচ্ছে করে যাইনি।
- না। ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আজ তোমার জীবনের শেষদিন। কারণ তুমি মনে মনে সব সময় ভাবতে কোন এক বৃষ্টিস্নাত দিনে যেন তুমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাও। বিধাতা তোমার ইচ্ছে মঞ্জুর করেছেন।
- হতেও পারে।
- সন্দেহ নেই। সত্যি।
- আমি তৈরি।
- অবশ্য লাভ নেই।
- কেন?
- আমি তোমার ইচ্ছে পূরণ হতে দেবো না।
- কেন?
- আমি চাই তুমি বেঁচে থেকে কষ্ট পাও?
- কেন?
- আমি প্রতিশোধ নেব।
- এভাবে?
- হ্যাঁ। আমি বিধাতার কাছে প্রার্থনা করেছি। আমার অপমৃত্যুর কালে আমার থেকে যাওয়া আয়ুটা যেন তোমাকে দেওয়া হয়ে। তিনি মঞ্জুর করেছেন।
- সেটার পরিমান কত?
- একশ বছর।
- বলো কি? সর্বনাশ। এ তুমি কি করেছো !
- ঠিকই করেছি। পৃথিবীতে তুমি বৃদ্ধ হয়ে অনেক দিন বাঁচবে। সুন্দরী, কিশোরী, কুমারী, যুবতী মেয়েদের দেখবে আর আফসোস করবে। কিন্তু তাদের ভালোবাসা দিতে পারবে না। এটা দেখে আমি শান্তি পাবো।
- তুমি না বললে তুমি প্রতিশোধ নেবে না। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
- এটা কোন প্রতিশোধ নয়। এটা একটা প্রার্থনা। আর বাকীটা তার বাস্তবতা। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
- কিন্তু আমি তো এতো দীর্ঘ সময় পৃথিবীর বুকে থাকতে চাই না।
- তোমার অবচেতন মন চায়। সে চায় জগতের সবকিছু তার নিজের মত করে পেতে। এটা এক ধরণের মানসিক বিকার। তুমি সে বিকারের শিকার একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ। তোমার জন্যে এটাই বাস্তবতা। কোন অভিশাপ, শাস্তি বা প্রতিশোধ নয়। তোমাকে তোমার জীবনের করুণ খেয়ালের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো। তুমি বাসায় ফিরে গিয়ে পোশাক পাল্টে অফিসে যাও। তারপর অফিসে গিয়ে বলো - তুমি ঠিক সময়ই অফিসে রওয়ানা হয়েছিলে। পথে একটা এক্সিডেন্টে তোমার কাপড় চোপড় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেটা বদলে ফের আসতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো। বস খুশী হবেন। আজ বিকেলে ওনার একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজে তোমার দরকার হবে। তুমি ব্রিলিয়্যান্ট অফিসার। তোমার অফিসের কেউ এই কাজটা করে দিতে পারবে না। আবার কাজটা না হলে উনি বিপদে পড়বেন। তোমার উপর বিরক্ত হবেন। তোমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে। তুমি যাও।
অনন্ত আর কথা বাড়ায় না। মিনু তাকে হাত তুলে বিদায় জানায়। অনন্ত দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে একশত বছর পার হয়ে যায় অনন্ত বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ নিজেকে সে আবিষ্কার করে একটা অন্ধকার গহবরের ভেতরে। সেখানে মিনু তার পাশে শুয়ে আছে। ঠিক সেই বৃষ্টি ভেজা সেদিনের মত।
একাকী জ্যোৎস্নায় অরুণিমা
আজ সাতই মার্চ। চারিদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ বাজছে। অরুনিমার কানের তালা বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না হঠাৎ করে বাঙালী এতোটা মুজিব ভক্ত হয়ে উঠল কেমন করে। মাঝখানে এই যে একটা দীর্ঘ বন্ধ্যা সময় পার হলো তখন এই লেখকগুলো কোথায় ছিলো। আসলে বাঙালী জাতিটাই এমন। হুজুগে মাতার। যখন যেদিকে স্রোত সেদিকে গা ভাসায়। নইলে এদেশে এতো উল্টা-পাল্টা ঘটনা ঘটে কেমন করে। সবাই তো এদেশের মানুষ। এই দেশের জল-হাওয়া-কাদায় বেড়ে ওঠা সত্তা। সে বুঝে উঠতে পারে না স্বাধীনতার পর এই চল্লিশ বছরে এই দেশে কি-না ঘটেছে। যুদ্ধের সময় তার বাবা-মায়ের মৃত্যু না হয় একটা কাকতালীয় ঘটনাই ছিলো। পাকিস্তানীরা পূর্ব বাংলাকে দমন করার নামে না হয় তৃতীয় পাক-ভারত যুদ্ধ করতে গিয়ে হিন্দু-নিধনের মাধ্যমে ভারতকে একটা কঠিন শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছিল এবং সেই শিক্ষামূলক ঘটনার সাক্ষী হয়ে তার বাবা-মা আর ছোট ভাইটা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু যুদ্ধের পর তো এই দেশ এদেশের মানুষেরাই বুঝে পেয়েছিল। কিন্তু তারপরও তো কতো ঘটনা ঘটল। গা শিহরণ করা ঘটনা। শেখ মুজিবের স্বপরিবারে মৃত্যু, খালেদ মোশাররফের মৃত্যু, মোস্তাকের সরকারের, জিয়ার উত্থান, এরশাদের দীর্ঘ শাসন আমল, খালেদা জিয়ার রাজনীতি, হাসিনার গণতন্ত্রায়ন এবং সর্বশেষ ডিজিটাল বাংলাদেশে অরুনিমার চোখের জল মুছে দেওয়ার মতো সেই স্নেহ-কোমল হাত কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সময়ের সাথে সাথে পেট ভর্তি জল আর পলির প্রবাহ নিয়ে বাংলার জমিন জুড়ে কখনও ধীরে কখনও দ্রুতগতিতে বয়ে গেছে গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার মত কত শত নদী কিন্তু এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে শান্তির পায়রা কখনই তার প্রশস্ত পাখা মেলে উড়তে পারেনি। কেন পারেনি। সেই প্রশ্নের উত্তর অরুণিমার জানা নেই। এসব রাজনীতির জটিল সমীকরণ। রাজায় রাজায় দাবা খেলার জটিল চাল। এখানে অরুণিমার মতো কোমলমতি হৃদয়ের একটি মেয়ের ভাবনা এবং ভালোবাসা ভীষণ অপ্রাসঙ্গিক। অরুনিমা তাই একা একা তার জন্যে একটা পৃথক পৃথিবী খোঁজে। যেখানে তার সামনে পড়ে থাকে তার গ্রাম্য-চিকিৎসক পিতার ধূতি পড়া তেল চকচকে টাকের পাশাপাশি সংসারি মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর পড়া এক টুকরো কোমল মুখ আর সহজ-সরল ছোট্ট ভাইটার অবুঝ কচি মুখটা। এরা সবাই এখন লাশ। মৃতদের কোন সময় জ্ঞান আছে কিনা জানা নাই। কিন্তু অরুণিমার কাছে গুণে গুণে চল্লিশ বছর। একেবারে কম সময় নয়। কিন্তু তার কাছে সবচেয়ে অবাক লাগে তখনই যখন সে দেখে এই চল্লিশ বছরে এখনও অনেক কিছু অমীমাংসিত। তবে লক্ষণ ভালো। দেশটা মনে হচ্ছে কোন একটা গন্তব্যের খোঁজ পেয়েছে। মানুষের মুখ দেখে অরুণিমার তাই মনে হয়। এই আবেগের মধ্যে কোথায় যেন একটা কিছু লুকিয়ে আছে। মানুষ বোধ হয় এবার সত্যি সত্যিই কোমড় বেঁধে নেমেছে। একটা কিছু না করে ছাড়বে না। দেখা যাক কি হয়।
অরুণিমার জীবন ব্যতিক্রম কিছু নয়। আর দশটা যুদ্ধে সব হারানো শিশুর মতোই তার বেড়ে ওঠা। তার শৈশব, কৈশোর কিংবা যৌবনের কোনোটাই এমন কোনো ঔজ্জ্বল্য ধারণ করে না যার আলোতে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সে আর দশ জন মানুষের মতোই সমান সাদামাটা অস্তিত্বের ধারক। তার বিশেষত্ব শুধু এটুকুই যে সময় তার সমস্ত রূপ-লাবণ্য কেড়ে নিয়ে পয়তাল্লিশ বছরের একটি পোড় খাওয়া কুমারী বৃদ্ধায় পরিণত করেছে। তবু ভাবতে ভালো লাগে সে এখনও বেঁচে আছে। কুকুর, বিড়াল কিংবা শকুন তাকে মাঝে মাঝে ঠোকরালেও পুরোপুরি খেয়ে ফেলতে পারেনি। অশূচির শরীর আসলে মরণেরও অযোগ্য। এজন্যেই ধরায় তার স্থান হয় অতি সহজে। অরুণিমা নিজের ভেতরে কখনও কোন উন্মাদনা অনুভব করে না। তার ভালো লাগে শুধু এটুকু ভেবেই হিন্দু হলেও তাকে শেষতক ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়নি। এই দেশে সে থাকতে পেরেছে। অনেক আশা আর ভালোবাসাহীনতার মধ্যেও তাকে যে প্রবাসের ভিখারী হতে হয়নি এতেই সে খুশী। ভারত কখনও তার দেশ ছিলো না। কোন কালে হবেও না। সে বাঙালী ! বাংলাদেশী ! বাংলাদেশ তার দেশ।
অরুণিমার এই দেশ প্রেমের কথা কেউ জানে না। কেউ জানে না সে কোথা থেকে এসেছে। এই যান্ত্রিক শহরে তার ইতিহাস শোনার মতো সময় কারো নেই। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মরার মতো পড়ে থাকে পয়তাল্লিশ বছরের পোড় খাওয়া শরীর। জীবনের অস্তিত্ব থাকলেও যৌবনের কোন সারাংশ আর তাতে অবশিষ্ট নেই। সব যেন কোথায় খোঁয়া গেছে। অরুণিমা কিছুই মনে করতে পারে না। তার কাছে ক্রমশঃ সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। ভীষণ ক্লান্ত লাগে। আকাশের সব তারা মিলেও তার দুচোখের পাতা খুলে রাখতে পারে না। অরুণিমা অঘোরে ঘুমায়। পৃথিবীর সব নিঃস্ব আর ক্লান্ত মানুষের ঘুমের ধরণ মোটামুটি একই।
২০০৯ সালের এই মার্চ মাসে আমের গাছে অনেক মুকুল ধরেছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রতি বছর এমনই হয়। তারপরও কেন জানি অরুনিমার মনে হয় এবারের মুকুলগুলো একটু অন্য রকম। দেশে অনেকদিন পর একটা মুক্তবুদ্ধির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবারের সরকারটাও সেই আওয়ামী লীগের হলেও কোথায় যেন একট ভিন্নতার গন্ধ অছে। কেউ বলুক আর না বলুক সেই আমেজটা সবাই পাচ্ছে। অনেক রাঘব বোয়াল বাদ পড়েছে মন্ত্রীসভা থেকে। একটু অবাক করার মতোই সিদ্ধান্ত বটে। অরুনিমার মনটা কেন জানি খানিকটা হলেও ভিন্ন রকম আনন্দে ভরে ওঠে। তাকে দেখে যদিও মনে হয় সে কিছুই বোঝে না কিন্তু বাস্তবে ব্যাপার পুরো উল্টো। তার ভেতরটা দারুন সক্রিয়। ইংরেজি বাংলায় সমান পারদর্শী। কিন্তু কোথাও তার প্রকাশ নেই। এটা তার একান্ত নিজস্ব সাধনা। এ নিয়ে বাড়াবাড়ির কিছু নেই।
অরুনিমার দিনগুলো আগের মতোই কাটতে থাকে। রাতারাতি বদলে যাওয়ার মতো কিছু ঘটবে এমন স্বপ্নও সে কখনও দেখেনা। দেখার কোন কারণও নেই। তাছাড়া স্বপ্ন সে যে দেখবে তার ক্ষেত্র কই। কে আছে তার এই পৃথিবীতে। মা-বাপ, ভাই-বোন কেউ নেই। সবাই পরপারে। বুকের ভেতর অনেকগুলো মৃত লাশ নিয়ে অরুনিমার জীর্ণ দেহ দিনে দিনে আরও শীর্ণকায় হয়েছে স্রোতহারা শুক্নো নদীর মতো। শরীর থেকে কালের পরিক্রমায় যৌবন অন্তর্হিত হয়েছে সবার অজান্তে। শুধু অরুনিমাই জানে এভাবে তিলে তিলে নিঃস্ব হওয়ার এই নিদারুণ গল্প। আসলে এই গল্পের কোন ভাগাভাগি হয় না। সব অনুভূতিকে খন্ড-বিখন্ড করা যায় না যেমন করা যায় না পূর্বপুরুষদের চিতা। এটা আসলে হৃদয়ের সবচেয়ে গভীর অনুভূতিপ্রবণ একটা কোন যেখানে প্রতিটি মানুষই তার নিজের মতো করে খানিকটা আলো, খানিকটা আঁধার আর কিছুটা জ্যোৎস্নার একটা মিশেল তৈরি করে রাখে। অরুনিমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। আসলেই সে একটা নিসঃসঙ্গ হিমবাহের মত যার গতি এতটাই মন্থর যে খালি চোখে তা দেখা যায় না। অরুনিমার জীবন অরণ্যের নিবিড়তা নিয়ে এই কৃত্রিম শহরের সমস্ত রুক্ষতার মধ্যে এক টুকরো ছোট্ট মরুদ্যান হয়ে তার নিজের কাছেই শুধু শোভা পায়।
যত দিন যায় অরুনিমার তত ভালো লাগতে থাকে। দেশটা তাহলে সঠিক পথেই যাচ্ছে। অনেক আশা, অনেক সম্ভাবনার বীজ বোনার গান শুনতে পায় সে। মানুষের মুখে তাহলে হাসি ফুটবে এ যাত্রা। সবকিছু দেখে তার কাছে তেমনই মনে হয়। নানা ধরণের নতুন নতুন বিষয়বস্তু আলোচনায় আসতে থাকে। অনেক ঐতিহাসিক বিতর্কের আইনগত সমাধান হতে থাকে। সবাই মানুক বা না মানুক একটা হিল্লে তো হচ্ছে বিষয়গুলোর। দেশ ও জাতির জন্যে এর প্রয়োজন আছে। একটা স্বাধীন জাতি চিরকাল কোন বিতর্কের জালে বাঁধা পড়ে থাকতে পারে না। তার নিজের প্রয়োজনেই এই গোলক ধাঁধা থেকে তার মুক্তি দরকার। সে মুক্তি হয়ত এবার মিলবে। অরুনিমা ভাবতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে পুরোদমে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে থাকা খুনিদের ফেরত আনছে বাংলাদেশ। মনে হচ্ছে এ যাত্রা এর বিচার করতে পারবে বাংলাদেশ। জাতি একটা জিজ্ঞাসা থেকে মুক্ত হবে। তবে পাশাপাশি একটা সংশয়ও যে থাকে না তা কিন্তু নয়। সেটা সে মনের গভীরে লুকিয়ে রাখে আলগোছে। এই সংশয়ের নাম ব্যর্থতা। যদি এবার ব্যর্থ হয় জনগণ তাহলে হয়তো জাতির জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদী অপেক্ষার পালা শুরু হতে পারে।
দিন যায়। মাস যায়। এভাবে প্রায় বছর ঘুরে নতুন বছর ছুঁই ছুঁই করছে। বিচার প্রক্রিয়া সঠিক ভাবেই এগোচ্ছে মনে হচ্ছে অরুনিমার। তবু অপেক্ষায় তার শিরাগুলো টান টান হয়ে থাকে। সে অপেক্ষায় থাকে কোন এক সকালের জন্যে যেদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শুনবে খুনিদের ফাঁসি হয়ে গেছে। বাংলার জমিন আজ অভিশাপমুক্ত। এদেশের কোটি কোটি মানুষ আজ পিতৃ হত্যার বিচার পেয়েছে। পাপের বোঝা প্রায়শ্চিত্রের আগুণে পুড়ে কিছুটা হলেও হালকা হয়েছে ছাইয়ের অবশিষ্টে।
অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ আসে। কল্পনার সেই ভোর। অরুনিমা গতরাতেও ভীষণ ক্লান্ত ছিলো। তাই সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই কোনো মতে দুটো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এক ঘুমে রাত্র পার। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শুনতে পায় গতরাতে খুনীদের ফাঁসি হয়ে গেছে। সত্যিই তাহলে ঘটনাটা ঘটেছে। সত্যিই বাংলার মাটি থেকে অবশেষে রক্তের দাগ মুছে গেছে।
পরক্ষণেই অরুনিমা ভাবে সব দাগ এখনও মোছে নাই। যুদ্ধোপরাধীদের বিচার আজও জাতি করতে পারেনি। যেদিন এদেশের মাটিতে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে সেদিন বাংলার মাটি পুরোপুরি কলুষ মুক্ত হবে। অরুনিমার মন কেন জানি বলে ওঠে হয়তো সেদিন আর খুব বেশী দূরে নয়। বুকের গহীন কোনে লুকিয়ে রাখা আলো, আঁধার আর জ্যোৎস্নার মিশেলে অরুনিমার মন যেন কোথায় হারিয়ে যায় মূহুর্তে।
মা, বাবা আর ছোট্ট ভাইটার কথা মনে পড়তেই দু’চোখ জলে ভরে আসে। এ অশ্র“তে কষ্ট থাকলেও আজ কিছুটা হলেও আনন্দ আছে। আছে সান্ত্বনা আর স্বপ্নের বীজ। সেই বীজ বহন করা এক ফোঁটা তপ্ত অশ্র“ অরুণিমার মনের অজান্তেই বাংলার তপ্ত মাটিতে টপ করে ঝরে পড়ে।
সমুদ্র স্নান
তীরে পা ছড়িয়ে বসে আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি হাজারটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে আমার প্রিয় মানুষটির পায়ের কাছে। আমার মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর সবটুকু সমুদ্র তার সবটুকু জল নিয়ে এগিয়ে এসেছে ওর পা ধুইয়ে দিতে। ও যেন আমার স্বপ্নের রাণী। পুরো পৃথিবীর বুকে ও-ই যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারী। আসলে এসবের পুরোটাই আমার কল্পনা। সমুদ্রের ঢেউ আপনা আপনি এসে তীরে আছড়ে পড়ে। সে কারো পা খোঁজে না। বরং মানুষই তার ভেঙ্গে পড়ার রেখার উপর দাঁড়ায়। তা সে নববধূই হোক আর সংসারের ভারে ন্যুজু হওয়া পোড় খাওয়া গৃহবধূই হোক। প্রকৃতির কাছে কারো জন্যে বাড়তি রোমান্সের কিছু নেই। সব যার যার নিজস্ব অনুভব। জ্যোৎস্না রাত শুধু কোন দম্পতির জন্যেই আসে না। জ্যোৎস্না সবার জন্যেই জ্যোৎস্না। কেউ তাকে খোঁজে। কেউ খোঁজে না।
সন্ধ্যা হতেই হোটেলে ফিরে এলাম। কারণ ঠান্ডাটা বেশ ঝাঁকিয়ে এসেছিলো। তাছাড়া তীরে তেমন কোন লোকও ছিলো না। অথচ মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম দু’জন গভীর রাত পর্যন্ত সমুদ্রের তীরে বসে থাকব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হোটেলের কক্ষই বেশী উষ্ণ। বাস্তবেও তাই। কক্সবাজারের বীচ সন্ধ্যার পরেই জনশূণ্য। কারো ইচ্ছে নেই রাতের বাতাসে হিম হয়ে সমুদ্র দর্শনের। না হওয়াটা দোষের কিছু নয়।
রুমানা ফ্লাক্স থেকে ঢেলে কফির কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললো - তোমার কেমন লাগলো সমুদ্র দর্শন। আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম - ভালোই। - তোমার? প্রশ্ন করলাম। ও বলল - মন্দ না। ওকে কিছুটা নিরুত্তাপ মনে হলো। অবশ্য কালও সমুদ্র স্নান করব। সাথে সূর্যস্নানও। তারপর ঢাকায় ফিরে যাব। হাতে অনেক কাজ জমে আছে। খুব বেশী বিনোদনের সময় নাই। আমি শুধু বললাম - হু-উ।
পরদিন যথারীতি সমুদ্র স্নানে গেলাম। সাথে সূর্যস্নান। দুজন পাশাপাশি বসে আছি।
টুকটাক দু’একটা ভালোলাগা-ভালোবাসার কথা হচ্ছে। আমাদের ভালোবাসায় উত্তাপটা বরাবরই একটু কম। রুমানা ভালোবাসতো অন্য একজনকে। না পেয়ে আমার জীবনে জড়িয়েছে। আমি চেয়েছিলাম মিতুকে। সে-ও হারিয়ে গেছে। অবশেষে রুমানার সাথে জুটেছি। দু’জনই জীবন এবং যৌবনে পোড় খাওয়া মানুষ। খুব বেশী ভালোবাস-ভালোবাসা বুকের ভেতরে অবশিষ্ঠ নেই। যা ছিল তা আগেই উজাড় হয়েছে।
তবুও চলছে জীবনের গাড়ী। বিয়ের পর রুটিন মাফিক হানিমুন। রুমানার প্রাইভেট অফিসের চাকরি। ঢাকায় ফিরে হাজার কাজের ভাবনা। আমার শেয়ার বাজারে ছোট্ট পুঁজির বিনিয়োগ। মাথার মধ্যে সারাদিন শুধু ঘুরপাক খায় ইনডেক্স নামল না উঠলো। সুখ-শান্তির চাকার চাইতে লাল-সবুজের তীর চিহ্নই আমার চোখের সামনে ঘুরপাক খায়। যার জীবন যেখানে পড়েছে বাঁধা। জীবনের বাস্তবতার কাছে ভালোবাসার ভাষা হয়তো অনেকটাই বোবা হয়ে থাকে। তবুও ভালো লাগে জীবন ও ভালবাসার এই মিশ্র অনুভূতি। সবকিছু ছাপিয়ে কখনো কখনো ভালোবাসাগুলো ছোট ছোট খুপরি দিয়ে উঁকি মারে। রুমানার প্রেমও যেন এমন কিছু। ঠান্ডা হতে হতে খেয়ে ফেলা পাশের দোকানের চায়ের মতই। এর চেয়ে হয়ত বেশী কিছু নয়।
ঢাকায় ফিরে আসি। জীবন আবার আগের মতোই। সাথে শুধু রুমানা যোগ হয়েছে। তারও একই অবস্থা। নাগরিক নারীদের হাতের মেহেদীর রঙ খুব দ্রুত মুছে যায়। হ্যান্ডওয়াশের তীব্রতায় তার ছাপ বেশীদিন থাকে না। তার বুড়ো বসের চর্মচক্ষুর আস্বাদন তাকে ক্রমশঃ ভোঁতা করে তুলেছে। এসব তার নিজেরই অনুভূতি। আমাকে সে নির্দ্ধিধায় সবকথা খুলে বলে। কারণ আর কিছু নয়। আমরা দুজনই পোড় খাওয়া মানুষ। আমাদের অনেক কিছুই জানা। ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নাই। আমরা আমাদের খুঁত এবং ক্ষতগুলোকে খুব ভালো করে চিনি। অবশ্য তার মলমও আমাদের কাছে আছে। এই মলমের নাম মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া। একই উপাদানের দুটো ভিন্ন নামের ওষুধ। জীবনের জন্য বড়ই প্রয়োজনীয়।
দিন-যায়। রাত যায়। জীবন তবু চলতে থাকে। তার থামার সুযোগ কোথায়। রুমানার ফিরতে প্রায়ই রাত হয়। অফিসে নানা ঝামেলা। আজ এটাতো কাল ওটা। শেয়ার বাজারের অবস্থা ভালো না। আমিও নানা ঝামেলার মধ্যে দিয়ে কখন যে দিনগুলো কেটে যায় টের পাই না। দুজনের যেন দু’জনকে জানার বা জানানোর মতো সময়টুকুও নেই। দিন চলে যাচ্ছে এটাই বড় কথা। আমরা আসলে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিয়েছি।
একদিন হঠাৎ করে অবেলায় বাসায় চলে আসি। এই সময় কখনো বাসায় ফেরার কথা নয়। কিন্তু শরীরটা কেন জানি ভালো লাগছিল না। বাসায় ফিরে সিকিউরিটি লক খুলে ভেতরে ঢুকতেই বাথরুমে কার যেন উপস্থিতি টের পেলাম। একজন নয়, দু’জন। দারুণ হাসাহাসি চলছে। তার সাথে সাথে চলছে উদ্দাম স্নানের তান্ডব। কান পাততেই বুঝলাম রুমানার সাথে অন্য কেউ। সম্ভবত ওর অফিসের বস। আমি আর কিছু ভেবে উঠতে পারলাম না। একটা সাদা কাগজে শুধু লিখলাম - তোমাদের এই কৃত্রিম সমুদ্রস্নানে আমি আসলে হঠাৎ করে এসে পড়ায় বিব্রত। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আপতত বাইরে যাচ্ছি। রাতে বাসায় ফিরে দু’জন একত্রে খাবো। অবশ্য তুমি যদি রাতের খাবারটা বসের সাথে না খেয়ে ফেরো।
দুপুরের প্রচণ্ড গরমের মধ্যে শহরের রাস্তায় উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থকি। মাথার উপরে খোলা আকাশ। মূহুর্তের জন্যে মন ছুটে যায় কক্সবাজারের সেই সমুদ্রের তীরে। আমি বসে আছি। রুমানার পায়ের কাছে পৃথিবীর সব টেউ এসে ভেঙ্গে পড়ছে। সম্ভিত ফেরে লাইট পোস্টের ধাক্কায়। আমি তাহলে এই শহরেই আছি।
গু যবধৎঃ রং নড়ঁহফ নু নবধঁঃু’ং ংঢ়বষষ
গু ষড়াব রং রহফবংঃৎঁপঃরনষব
অস ও ঃড় ংবঢ়ধৎধঃব ভৎড়স সু ড়হি
ঋৎড়স যবৎ ভড়ৎ যিড়স ও নৎবধঃযব ধষড়হব?
- খধরষর-গধুহঁ, ঘরুধসর
এসেন্স অভ্্ পেডিয়াট্রিক্স
খুব সহজ সরল ভঙ্গিতেই মেয়েটি আমার টেবিলের মুখোমুখি রাখা চেয়ারগুলোর পেছনের সোফাগুলোর একটাতে এসে বসল। আমি কেন জানি বিষয়টি খেয়াল করলাম যদিও খেয়াল করার মতো তেমন কোন ঘটনা এটা নয়। যেহেতু এটা একটা ব্যাংকের শাখা এবং আমি এই শাখার দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি তাই আমার টেবিলে প্রতিদিনই এরকম অজস্র লোকের আনাগোনা। যে কোন দিক দিয়ে বিচার করলে ব্যাপারটাকে কোনমতেই অস্বাভাবিক কিছু বলা যায় না। তার উপরে মেয়েটি দেখতেও সাধারণ। তারপরও কেন জানি ঘটনাটা ঘটল। অনেক অসামান্য সুন্দরী মেয়ের চাইতে সে খানিকটা বেশীই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো। আমি অবাক হলাম না। হাজার হোক পুরুষের মনতো। সামান্য উত্তাপেই গলে।
আমি আরও অবাক হলাম যখন সে কথা বলতে শুরু করলো। অদ্ভুত সাদামাটা ভঙ্গিতে সহজাত এবং সাবলীল উচ্চারণ। সব মিলিয়ে অসাধারণ। আমি আরও অবাক হলাম তার দ্রুতগতিতে কথা বলার স্টাইল দেখে। সে তার সাধারণত্ব দিয়েই আমাকে বধ করলো। আমি তার কথায় বেশ মজা পাচ্ছিলাম তবে অবশ্যই তা হাস্যকর কিছু নয়। আমার কেন জানি কোন কারণ ছাড়াই ভালো লাগছিল। ভালোলাগাগুলো আসলে এমনই। প্রায়শঃই খানিকটা অর্থহীন।
তার সাথে দু’জন গ্রাম্য বোরকা পড়া সাদামাটা মহিলা ছিলো। সে তাদের একজনের জন্যে একটা হিসাব খোলার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করছিলো। কিন্তু আমি ব্যাপারটাকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না দেখে সে কেমন যেন একটা হাল্কা ধরনের বিব্রত বোধ করছিলো। আমি সেটা বুঝে ওঠা সত্ত্বেও কেন জানি আমার অবস্থান থেকে নড়তে পারছিলাম না। আমার জবাব অনেকটা না এর মতোই।
চলে যাওয়ার আগ মুূহুর্তে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম - আপনি কি পড়াশুনা করেন ? সে বলল - আমি মেডেকেলে পড়ি। তার বলাটা আমার কাছে এতোটা নির্বিকার আর নিরুত্তাপ মনে হলো যে আমি কি শুনলাম তা বুঝতে পারলাম না। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম - কোথায় ? সে বলল - ময়মনসিংহ মেডিকেলে। সে আগের মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ঘোর যেন আর কাটে না। এ কাকে আমি তুচ্ছজ্ঞান করলাম। যে আমি মানুষকে মূল্য দিতে দিতে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেই আমি এমন একটা অসাধারণ মেয়েকে চিনতে পারলাম না। সত্যি কথা বলতে কি তার মধ্যে একজন মেডিকেল ছাত্রীর তথাকথিত অহংকার আর আভিজাত্য জ্ঞানতো দূরে থাক একটা সাধারণ অশিক্ষিতা মেয়ের অর্থহীন অহংকারের ছিঁটেফোঁটাটুকুও ছিলো না। সে আমাকে সত্যিই বিব্রত করলো। আমি নড়ে চড়ে বসতেও ভুলে গেলাম। বোকার মতো হাসলাম। তাকে সরাসরি বলেই ফেললাম - আপনার এই পরিচয়টা আগেই দেওয়া উচিত ছিল। আপনাদের মতো মানুষের জন্যে আমি অনেক কিছু করতে পারি। সে বলল -তেমন কিছু করতে হবে না। শুধু একটা একাউন্ট করে দিলেই চলবে। কেউ রাজী হচ্ছে না তো তাই আপনাদের এখানে এলাম। ততক্ষণে সে সোফা থেকে উঠে চলে যাচ্ছিল। দাঁড়ানো অবস্থায়ই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। পৃথিবীর প্রথম গোলাপ ফোঁটার মতোই নিষ্পাপ সেই হাসি। আমি শুধু বললাম - আমি ওনার হিসাব খুলে দেব। আপনার আর কষ্ট করে আসতে হবে না। কিছু মনে না করলে আপনার ঠিকানা ও ফোন নম্বরটা দিবেন। আমি মাঝে মাঝে ময়মনসিংহে যাই। আপনার সাথে হয়তো দেখা করতে পারি। সে আমার একটা ভিজিটিং কার্ডের পিছনে তার ফোন নম্বর ও ঠিকানা দিল। তার নাম কাজল।
কাজলের সাথে রাতে ফোনে কথা হলো। এই প্রথম ফোনে কথা হলো। সাধারণভাবেই শুরু। তেমন কোন ভনিতা নেই। মুগ্ধ করার চেষ্টা নেই। কথা আগালো অনেক দূর। তার যে ভালো লাগল সেটা বোঝা গেল। আমার অনেক বেশী ভালো লাগল। আমি অন্ততঃ এটুকু বুঝতে পারলাম যে তার সাথে আর কিছু না হোক স্রেফ নিশ্চিন্তে কথা বলা যায়। বন্ধু হওয়ার মতো গুণটুকু এই সাদামাটা মানুষটার যথেষ্টই আছে।
দিন যায়। রাত যায়। কাজলের সাথে অনেক কথা হয়। ওকে কিছু একটা উপহার দিতে ভীষণ ইচ্ছে করে। তখন শীতকালের সময়। শীতের প্রকোপটা সেবার একটু বেশীই ছিল। কাজলের জন্য উলের হাত মোজা, পা মোজা, মাথার টুপি এসব টুকিটাকি জিনিস কিনি। ওকে জানাই। ও না করে। ওর পড়াশুনার খবর জানতে চাইলে বলে - একটা বই খুব দরকার। ময়মনসিংহে সব সময় পাওয়া যায় না। তবে দোকানদারকে জানিয়ে দিয়েছি। তারা ঢাকা থেকে আনিয়ে দেবে। আমি বলি আমি কিনে পাঠিয়ে দেবো। তুমি শুধু বলো বইয়ের নাম কি। ও বলতে চায় না। অবশেষে আমার আপত্তিতে বলতে রাজী হয়। তবে সাথে সাথে এ-ও জানিয়ে দেয় আমি যেন বই না পাঠাই। তাহলে সে আমার সাথে আর কখনও কথা বলবে না। আমি কিছু বলি না। শুধু জিজ্ঞেস করি বইয়ের নাম কি? সে শুধু বলে - এসেন্স অভ্ পেডিয়াট্রিক্স।
নীলক্ষেতে গিয়ে বইটা কিনে ভালো করে প্যাকেট করে এস এ পরিবহনের মাধ্যমে ওর ঠিকানায় পাঠিয়ে দেই। তারপর ওকে ফোনে জানাই। ও খুব বিরক্ত হয়। তবে বলে - যেহেতু বইটা পাঠিয়ে দিয়েছেন তাই এটা হয়তো রাখব। তবে আর কিছু পাঠাবেন না। তাহলে কিন্তু আর কখনো কথা হবে না। সবকিছু ফেরত পাঠিয়ে দেবো।
যা হোক শেষ পর্যন্ত কাজল কি ভেবে জানি না বইটি ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আমি এস এ পরিবহন থেকে বইটি বুঝে নেই। কাজলকে ফোনে জানাই বইটা ফেরত পেয়েছি। কাজল শুধু বলে আপনাকে কষ্ট দিলাম।
এ আর খানের এসেন্স অভ্ পেডিয়াট্রিক্স চুপচাপ পড়ে থাকে আমার বিছানার পাশে। আমার দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পরে। আমার অস্পষ্ট কষ্ট কেন জানি বলে ওঠে - কাজল, বইটা তুমি রাখলেও পারতে। একটা বইয়ের বিনিময়ে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে কিনে ফেলতাম না। মানুষ এত সহজে বিক্রি হয় না। কাজলের কাছেও হয়ত কোন যুক্তি আছে। যার জন্যে সে ওটা ফেরত পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি সবসময় মনে করি আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভালো মেয়েদের মধ্যে সে একজন। তাজমহলের মতোই খাঁটি, সত্য আর সুন্দর।
দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়। কাজলের সাথে আর দেখা হয় না। আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। তেমন কোন সমস্যা নয়। এই সামান্য অনিয়ম আর কি ! শরীরটা অনেক ভেঙ্গে গেছে দিন-রাত খাঁটুনিতে। নিজেকে অনেক রোগা আর জীর্ণশীর্ণ লাগছে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। ঘুম ভাঙ্গল কারো ডাকে। উঠে নড়েচড়ে বসতে যাবে। কিন্তু পুরোপুরি তাকাতেই অবাক হলাম। গায়ে সাদা এপ্রোন, গলায় স্টেথ্সকোপ, হাতে ফাইল। একজন মহিলা ডাক্তার আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। সে আর কেউ নয়। আমার কাজল। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো - আপনার নাম ? আমি নাম বললাম। সে অনেকটা অবাক হলো। কিন্তু চিনতে পারলো কিনা বুঝতে পারলাম না। আবারও নাম জিজ্ঞেস করলো। আমি শুধু বললাম - তোমার ফেরত পাঠানো এসেন্স অভ্ পেডিয়াট্রিক্স বইটি এখনও আমার কাছে আছে। আমি তোমার সেই রুমি। তোমার সাথে এভাবে দেখা হবে কখনো ভাবিনি।
কাজল কি বুঝল জানিনা। সে নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার হয়তো অতীতের সেই কথাগুলো মনে পড়েছে। ফাইল হাতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আলগোছে হেঁটে চলে গেলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার চোখ দিয়ে একটা স্বচ্ছ স্ফটিকের মত এক ফোঁটা জল নিরবে মেঝেতে পড়ল। সেই জলের ফোঁটার চেয়ে পবিত্র কিছু এই পৃথিবীতে আমি আর কখনও দেখিনি।
দ্য কলামিস্ট
শৈশব থেকেই সফর আলীর স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক হবেন। কিন্তু স্কুলের পরীক্ষা পেরোতে গিয়েই তিনি বুঝলেন তার দ্বারা এটা সম্ভব নয়। কারণ সৃষ্টিশীলতা বিষয়টা তার ভেতর আসে না। তিনি যা পারেন তা হলো “প্রশ্নপত্র দেখে তারপর বিভিন্ন বই-পত্র ঘেঁটে উত্তর বের করে সাজিয়ে দিতে। পরীক্ষার হলে অবশ্য এসবের কোন সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়ে নকলের রাস্তা ধরতে হয়। ব্যাপারটা ভীষণ লজ্জার। তার সুস্থ এবং সজাগ বিবেক কিছুতেই এটা সায় দেয় না। কিন্তু উপায় কি? এছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। সে কি তবে মেট্রিক ফেলই থেকে যাবে। সফর আলী নাক-চোখ বন্ধ করে কুইনাইন খিলে খাওয়ার মত রিস্ক নিয়ে নেয়। তার টেকনিক্ আর নোট লেখকের ক্রেডিট - সবমিলিয়ে সফর আলী প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়। সবাই বলতে শুরু শুরু করে সফর আলী বড় হয়ে একটা কিছু না হয়ে যায় না। তারপর সে নিশ্চয় এলাকা তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু সফর আলীর মনে শান্তি নেই। ভীষণ মনোকষ্টে তার অসুস্থ হওয়ার জোগাড়। বিবেকের পোড়ানী বড় তীব্র।
দেখতে দেখতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে আসে। আর্টসের ছাত্র সফর আলী কিছুতেই ইতিহাসের সালগুলো মনে রাখতে পারেন না। একই সমস্যা অর্থনীতিতেও। কোন তথ্য বা তত্ত্বই তার মনে থাকে না। পৌরনীতি বিষয়টাতো আরও জটিল। এক এক জন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর এক এক মত। কে যে কোন মতটা দিয়েছে তাই তার গুলিয়ে যায়। সফর আলীর মাথা ঘুরে আসে। শুধু চতুর্থ বিষয়ে সে একটু ভালো। কারণ এখানে পড়াশুনার তেমন কোন দরকার নেই। বেশীরভাগই ব্যবহারিক। দেখে শুনে সময় নিয়ে কর। মাথা খাঁটিয়ে লেখার কিছু নেই। সফর আলীর যত সমস্যা এই মাথায়। কিন্তু চতুর্থ বিষয় দিয়ে তো আর পুরো উচ্চ মাধ্যমিকটা পার হওয়া যাবে না। এই বিশাল বৈতরণী পার হতে হলে তাকে অবশ্যই একটা মাস্টার প্ল্যান তৈরি করতে হবে। কৌশল করে আগাতে হবে। কৌশল আর কি? আবারও নকলের দারস্থ হওয়া। সফর আলীর মনে শান্তি নেই। সে নীতিবান মানুষ। কিন্তু পরীক্ষা পাশের জন্যে বার বার তার এই অনিয়ম সে নিজেই মেনে নিতে পারছে না। সফর আলীর ভীষণ মন খারাপ লাগে। সে একটা মজা পুকুরের পাড়ে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। মশার কামরে সফর আলীর হাত-পা ফুলে গেছে। তবুও ওঠার নাম নেই। তার খুব আফসোস লাগে নিজের ব্যর্থতায়। তার ঘাড়ের ওপর মাথা আছে ঠিকই। কিন্তু সেই মাথা যে এতটা অকার্যকর সেটা ভেবেই তার দুঃখটা উস্কে যায় বার বার। সফর আলী আনন্দে হু হু করে কেঁদে ওঠে। কয়েক ফোটা তপ্ত অশ্র মজা পুকুরের শুষ্ক পাড়ের বিবর্ণ ঘাসের উপর টপটপ করে পড়ে।
সফর আলীর জীবনের পরিক্রমা এমন জটিল কিছু নয়। এভাবেই একটার পর একটা পরীক্ষা পাস করে সফর আলী বিএ ডিগ্রি লাভ করে। পিতার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো হওয়ায় তাকে কোথাও খুব একটা বেগ পেতে হয় না। সফর আলী মনে মনে তার জীবনের গন্তব্য ঠিক করে। কোন একদিন সে অনেক বড় একজন কলামিস্ট হবে।
সফর আলীর স্বপ্ন পূরণ হতে খুব একটা দেরী হয় না। সম্পাদকের সাথে মালপানি খেতে খেতে আর নানা উপলক্ষে উপহার বিনিময়ের মাধ্যমে সে অনেক সম্পাদকেরই কৃপাদৃষ্টি লাভ করতে সক্ষম হয়। কারণে অকারণে তার লেখা বিভিন্ন অর্থহীন কিংবা ঈষৎ অর্থযুক্ত কলামগুলো পত্রিকার পাতায় নিয়মিত ছাপা হতে থাকে। সফর আলী রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। লেখক হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। এমনকি বিদেশে অবস্থানরত বাঙালীরাও তাকে সাদরে গ্রহণ করে। তার নামটাকে একটু ব্যতিক্রমভাবে উপস্থাপন করা হয়। কারণ একটাই। দৃষ্টি আকর্ষণ। সফর আলীর কলামিস্ট নাম হয় সফর আলী বিএ। চমৎকার কম্বিনেশন। যোগ্যতা আর উপস্থাপনার সাথে অপূর্ব সমন্বয়ে সফর আলী হিট হয়ে যান।
কলামিস্ট হিসেবে সফর আলী যখন তুঙ্গে তখনই তার ডাক পড়তে শুরু করে বিভিন্ন টক শোতে কথা বলার জন্যে। সফর আলী না করতে পারেন না। তাছাড়া তার মাথায় কিছু না থাকলেও মুখে যেন খই ফোটে। একবার শুরু করলে থামতে চান না। যা মুখে আসে তাই বলেন। সংবিধান থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার, আমেরিকা থেকে শুরু করে আফগানিস্তান কি জানেন না তিনি। সমস্যা যা ছিল তা ঐ পরীক্ষার খাতায়। কিন্তু সেদিন হয়েছে বাসি। সফর আলী বিএ এখন দেশের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী। ঝানু কলামিস্ট। দেশী-বিদেশী, নতুন-পুরান সব পত্রিকার সংগ্রহ থেকে কাটাকাটি করে জোড়াতালি দিয়ে তিনি যেসব কলাম তৈরি করেন তার সমৃদ্ধি নিয়ে সংশয়ের কোন কারণ নেই। পুরো দেশবাসী তার এই কক্টেল গোগ্র্রাসে গিলছে। এবং তিনিও একটার পর একটা সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-এ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে চলছেন। সফর আলী আজ ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন এক নির্ভীক সৈনিকের নাম। তিনি আজ জাতির অন্যতম বিবেক বলে পরিচিত। তাকে রোখে এমন কেউ নেই। একটার পর একটা পদক প্রাপ্তি আর নতুন সাফল্যের দুয়ার খুলে যাচ্ছে তার জীবনে। সম্ভাবনার দশ দিগন্তের আরাধ্য হাতছানি তাকে সারাক্ষণই ফুরফুরে মেজাজের মানুষে পরিণত করেছে। সাফল্যের পাশাপাশি অর্থ-বিত্তের ছড়াছড়ি। সেদিন আর বেশী দূরে নয় যখন সফর আলী সম্মান সূচক ডি-লিট ডিগ্রিী লাভ করবেন। তাকে আটকাবার কোন উপায় স্বয়ং রাবনেরও জানা নেই। টিভি খুললেই সফর আলী বিএ। পত্রিকার পাতায় সফর আলী বিএ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সফর আলী বিএ। গোল টেবিল আলোচনায় সফর আলী বিএ। কোথায় আছেন তিনি জিজ্ঞেস না করে বলতে হবে কোথায় নেই তিনি। সবাই বলতে শুরু করেছে সফর আলী বিএ নয়, সফর আলী বিস্ময়কর।
সফর আলীর ভাবনায় ছেদ পড়ে। চারিদিক ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। মশার কামড়ে সারা শরীর ফুলে গেছে। অতীতের মত আজ অনেকদিন পর সে আবার সেই মজা পুকুরের পাড়ে বসেছিল। বসতেই পুরণো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সফর আলী ভুলে যায় সময়ের হিসাব। কল্পনায় পাড়ি দেয় জীবনের পথ পরিক্রমা। সফর আলী মনে মনে ভাবে এক জীবনে তার সবই হলো।
এবার দেশের জন্যে একটা কিছু করতে হবে। এই মজা পুকুর যেখানে বারো মাস-ই মশার জন্ম তার সংস্কার করতে হবে। তার জন্য সবার আগে যা দরকার তা হলো তাকে একটা এনজিও খুলতে হবে। অবশ্য এটা কোন ব্যাপার নয়। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি তা করতে সক্ষম। অনুদানও মিলে যাবে। কারণ তিনি সফর আলী বিস্ময়কর।
ঞযবরৎ ড়হষু ঃধংঃব ধিং ষড়াব, ধহফ ষড়াব’ং ংবিবঃ ঃরবং
অহফ ৎিরঃরহম ঃযব মযধুবষং ঃড় বধপয ড়ঃযবৎ’ং বুবং.
- খধরষর-গধুহঁ, ঘরুধসর
কবি ও কলমিলতা
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির বুক চিড়ে যন্ত্রযানটা সাপের মত হিস হিস শব্দে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে আর এর বিলাসবহুল সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে আছেন এক ভদ্রলোক। পাশের সিটে বসেছেন এক ভদ্র মহিলা। তিনি খানিকটা অস্থির। কেমন যেন উস্খুশ করছেন। তার অস্থিরতার কারণ আপাতঃ দৃষ্টে বোঝা না গেলেও তিনি মূলতঃ পাশের ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার জন্য কোন একটা অজুহাত খুঁজছেন। কিন্তু ভদ্রলোক সেই তখন থেকে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। এরকম অবস্থায় একজন লোকের সাথে কথা বলা একটু অস্বস্তিকর। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন।
এক পর্যায়ে ভদ্রলোক নড়ে চড়ে ঊঠে সোজা হলেন। ভদ্র মহিলার দিকে তাকালেন। মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর আবার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফিরে গেলেন। ভদ্রমহিলা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি অনেকটা গায়ে পড়েই জিজ্ঞেস করলেন -
-আপনি কি রুমি?
- না। আমি আপনার রুমি নই।
- ওহ! কিন্তু আপনাকে রুমির মতো লাগছে। কবি রুমি।
- মাওলানা জালালুদ্দির রুমি?
- নাহ! ওমর খালেদ রুমি।
- জি না। আমি আপনার রুমি নই।
কথা শেষ করেই ভদ্রলোক আবার সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। কিন্তু তার এই অদ্ভুত যোগাসন বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। পকেটে রাখা মোবাইলে বেজে ওঠায় তিনি উঠে মোবাইল ধরলেন। ওপার থেকে কেউ একজন হয়ত বলল - রুমি বলছেন?
তিনিও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন - হ্যাঁ। রুমি বলছি। বলুন।
পাশের সিটে বসা মহিলার চক্ষু চড়ক গাছ। এভাবে মুখের ওপর মিথ্যে কথা।
অপর প্রান্তের কণ্ঠটি সম্ভবত কোন মহিলার কারণ তিনি বিগলিত। চোখে-মুখে- ঠোঁটে হাসির ঝলক। মহিলাদের সাথে কথা বলার সময়ই সাধারণত লম্পট পুরুষদের চেহারায় এমন একটা অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। পাশের সিটের মহিলাটি হা করে তাকিয়ে মনোযোগের সাথে ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনছিলেন। ওপাশের কণ্ঠটি সম্ভবতঃ তার সাম্প্রতিক কোন বইয়ের প্রশংসা করল। তিনিও বিগলিত কণ্ঠে বললেন - আমার লেখা যদি আপনাদের ভালো লাগে সেটাই আমার সত্যিকারের সার্থকতা। আমি বিগলিত।
ভদ্রলোক ফোনে আরও কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বললেন। তার কিছুটা শ্লীল, কিছু অশ্লীল আর কিছু কিছু কথা এই দুইয়ের মাঝামাঝি। ভদ্রমহিলা কিছুটা অবাক হলেন। তিনি অপরিচিতা। বাসের সিটে বসে এরকম একজন অপরিচিতা মহিলা পাশে থাকা সত্ত্বেও ফোনে এ ধরনের রসালাপ তিনি এই প্রথম শুনলেন। ব্যাপারটি তার মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতির জন্ম দিলো। তিনি যতটা না অবাক তার চেয়েও বেশী পুলকিত হলেন। কারণ তারও মৌনতার চেয়ে যৌনতার দিকেই ঝোঁক বেশী। অবশ্য ভদ্রলোক এখনও তাকে কোন সুযোগ দেননি। কিন্তু এবার তিনি ধরা পড়ে গেছেন। ফোনে তিনি তার নাম বলেছেন রুমি। আর যায় কোথায়।
ভদ্রলোক ফোন শেষ করে আবার মহিলার দিকে তাকালেন। তারপর মিষ্টি করে সেই চরিত্রহীন লোকদের হাসিটা হাসলেন। এভাবে হাসার কোন মানে হয় না। মহিলা নিঃসন্দেহে হাস্যকর কিছু নয়। রীতিমত একজন ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন - আপনি কিন্তু ফোনে আপনার নাম রুমি বলেছেন?
- হ্যাঁ বলেছি। ভদ্রলোক অত্যন্ত নির্বিকার।
- আমিও তো তাই বলছি। আপনার নাম ওমর খালেদ রুমি। আপনিই কবি রুমি।
- ভুল করছেন। আমি রুমি নই। দেশে কি আর কোন রুমি থাকতে নেই। আপনি কেন শুধু শুধু জোর করে আমাকে অন্যের সাথে মেলাতে চাচ্ছেন। আমিও রুমি। তবে অন্য রুমি। কবি রুমি নই। তার কথা আমিও জানি। ব্যাটা জোকার।
- দেুখন সে আমার প্রিয় কবি। তার সম্পর্কে বাজে কথা বলবেন না। উনি অনেক ভালো কবি। আপনার মত ধুরন্ধর নয়। এমন চালাকি করে না।
- আমিও তো তাই বলি। আমি আপনার সেই রুমি নই। ব্যাস, এবার খুশী তো?
- নাহ্! আপনি সত্য কথাটা বলছেন না। আপনি আসলে কে?
- আমি কেউ না। আমার কোন অস্তিত্ব নেই।
এই যে আমাকে দেখছেন না এটা হলো আমার প্রেতাত্মার শরীর। অশরীরী কায়া। দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই। শুধু চোখে দেখা যায়।
- আপনি তো ভৌতিক গল্প কিংবা সায়েন্স ফিকসন্স লেখেন না। আগামীতে ওগুলোতেও হাত দেবেন নাকি?
- কি জানি, দিতেও পারি।
- আপনি রুমি। কারণ আপনি স্বীকার করেছেন যে আপনি লেখালেখি করেন।
- কখন স্বীকার করলাম।
- এই মাত্র।
- ভুল বলেছি। মিথ্যা করে বলেছি।
- মোটেই না।
- আপনার ছবির সাথে আপনার চেহারার মিল আছে।
- সবার আছে।
- আমি আপনার বইয়ের পিছনের ছবির কথা বলছিলাম।
- তাই নাকি।
- এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন ?
- কোন কারণ নেই। ঐ ব্যাটা রুমিকে আমিও দেখতে পারি না একদম। ব্যাটা একটা ভন্ড কবি। জোচ্ছোর, মিথ্যেবাদী আর ধোঁকাবাজ। যাচ্ছে তাই সব কবিতা লেখে মেয়েদের মাথা খারাপ করার জন্য। ব্যাটা আসলে একটা জুয়াড়ী। কবিতার জুয়া খেলে। একদম হতচ্ছাড়া।
- আপনি তার ঊপর এত ক্ষ্যাপা কেন?
- এই যে আপনার মত ক্ষ্যাপাটে তরুনীরা তার সাথে আমাকে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলেন। আমি যতই বলি যে আমি রুমি নই কে শোনে কার কথা। শুনুন, আমি আসলেই রুমি নই।
ভদ্রলোক থামলেন। ভদ্রমহিলাও হাল ছেড়ে দিয়ে সিটের সাথে গা এলিয়ে দিলেন। প্রিয় কবিকে কাছে পেয়েও তার সাথে যুক্তিতে পেরে উঠছেন না। এটা দারুণ কষ্টের। তাহলে কি আসলেই লোকটা তার প্রিয় কবি নয়।
সময় বয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে সামনে এগোয়। ভদ্রমহিলার মনে শান্তির চেয়ে অস্বস্তিই বেশী। কিন্তু ভদ্রলোক ঠিকই নির্বিকার। এমন সময় আর একটা ফোন আসে। ফোনে ভদ্রলোক বলেন - হ্যাঁ। রুমি বলছি। বলুন কে বলছেন। ওপাশ থেকে সম্ভবতঃ কোন নারী কণ্ঠ জবাব দেয় - আমি লাবণ্য বলছি। ভদ্রলোক সেটাই সজোরে পুনরায় বলেন - ওহ! আপনি লাবণ্য বলছেন। তা বলুন, আমি আপনার কি সেবা করতে পারি। ওপারের কণ্ঠস্বর আর কি কি বলছে বোঝা যায় না। তবে ভদ্রলোক একসময় হঠাৎ করেই বলে ওঠেন - হ্যাঁ, একদিন প্রেম এসে হঠাৎ দরোজায় কড়া নেড়েছিল - বইটিই আমার সর্বশেষ কবিতার বই। এরপর আর কোন কবিতার বই আসেনি।
ভদ্রমহিলা এবার নড়ে চড়ে বসেন। এটিই তো ওমর খালেদ রুমির সর্বশেষ কবিতার বই। উনি তাহলে আমার সাথে মিথ্যে বললেন কেন। তার দারুণ অভিমান হয়। অভিমানে গলা ফুলে আসে। ভদ্রলোক ফোন রাখতেই আবার আক্রমন। এবার বেশ জোরে শোরেই - একদিন প্রেম এসে হঠাৎ দরোজায় কড়া নেড়েছিল - তাহলে আপনার সর্বশেষ বই। এরপর আর কোন বই আসেনি ?
-জ্বী না। আসেনি।
- তারপর দুজনেই হেসে ফেলেন।
দেখতে দেখতে বাসটা স্টেশনে এসে থামে। দুজন নেমে পড়েন। ভদ্রমহিলা বাস থেকে নেমে খানিকটা সামনে গিয়ে দাঁড়ান। কবি তার পাশাপাশি। দু’জনে সামনে পা বাড়ান। কবি তাকে জিজ্ঞেস করেন - আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি।
- কলমিলতা! ভদ্রমহিলার জবাব।
- এটা কোন নাম হলো। আমি আপনার নাম দিলাম লতা। আমি কিন্তু আপনাকে এই নামেই ডাকবো।
- আমার আপত্তি নেই।
আকাশ তখন বেশ পরিস্কার। একটু আগেও যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল এখন তাও থেমে গেছে। চড়া রৌদ্র না থাকলেও বেশ শান্ত একটা পরিবেশ। সেই সুন্দর আবহাওয়ার ভেতর দিয়ে লতা নামের মেয়েটি তার প্রিয় কবির সাথে একটি কফি শপের সন্ধানে যাচ্ছে। এক কাপ ভালো কফির উষ্ণতা পাবার জন্যে।
তোহ্মার কমল মুখ দেখিয়া অনুপ।
আকুল হইল মোর নয়ান মধুপ।।
তুহ্মি বিনে অকারণ জীবন যৌবন।
তুহ্মি বিনে অকারণ এ তিন ভুবন।।
যতনে পাইলুঁ মুঞি করিয়া কামনা।
পিরীত রাখিও মোর জানিও আপনা।।
- লায়লী-মজনু, বাহরাম খান
কুইন অফ মাওনা
মাওনা কোন শহরের নাম নয়। এটি কোন জেলা, উপজেলা, পৌরসভা এমনকি বাজারও নয়। এটি একটি চৌরাস্তা মাত্র। কিন্তু সেই মাওনাই আজ যে কোন শহরের মাথা খায়। নাগরিক সুবিধা না থাকলেও এখানে যে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে তা চোখে পড়ার মত। এখানে নেই এমন কিছু নেই। দোকান পাট, ক্লিনিক, শপিং মল, স্কুল, কলেজ সবকিছু। মাওনায় তাই যে কেউ নিজেকে খুঁজে পেতে পারে।
আমার ব্যাপার অবশ্য ভিন্ন। আমি গত উনিশ বছর ধরে ঢাকায় ছিলাম। তাও ঢাকা নামধারী কোন শহরতলী যেমন উত্তরা, টঙ্গী, মেরাদিয়া, ডেমরা বা জিঞ্জিরায় নয়। একদম শহরের প্রাণকেন্দ্র কাঁঠাল বাগান কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। এখানেই কেটেছে আমার জীবন যৌবণের চুম্বক অংশ। যাহোক মাওনায় এসে অন্ততঃ আমার অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আগেই বলেছি মাওনা একটি চৌরাস্তা মাত্র।
সবকিছুর পরও কিছুটা অবাক হই। এই এলাকায় গভীর নলকূপের সুস্বাদু পানি পান করে। চারপাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া শিল্পায়নের ধ্বকল সামলাতে হিমশিম খাওয়া মানুষগুলোর রাতারাতি বিত্তবান হওয়ার পাশাপাশি এখানকার কয়েকজন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাকে যারপর নাই মুগ্ধ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা আমি এখানে নতুন এলেও রাতারাতি খাপ খাইয়ে ফেলি নিজেকে। জায়গাটা ভালো লাগতে শুরু করে। ধীরে নয়। দ্রুত। সময় সুযোগে পেলেই সহকর্মীদের নিয়ে এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখি। যত দেখি তত ভালো লাগে। গ্রীষ্মকালে আনারসের ছড়াছড়ি। লালমাটি। চারিদিকে ভাওয়াল গড়ের আবহ। আধুনিক রাস্তাঘাট। সবকিছু আমাকে মুগ্ধ করে। আমি মাওনাকে ভালোবাসতে শুরু করি।
কিন্তু ভালোবাসা আসলে শূন্যে ভাসে না। তাকেও কোনও কিছুর উপরে ভর করে বাঁচতে হয়ে। বেড়ে উঠতে হয়। আমি তেমন কিছু খুঁজতে থাকি। আমার এমন কিছু চাই যা আমার হৃদয় তন্ত্রীতে সুর তুলতে পারে। আমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে আমার সত্তার গহীন অতল থেকে। আমি পাখির মত পাখা মেলে উড়তে পারি। হাওয়ায় ভাসতে পারি শুষ্ক কাশফুলের কোমল শরীর হয়ে। আমি কাঁদতে পারি। আবার হাসতেও পারি। জীবন এবং যন্ত্রনার মাঝখানে যে সূক্ষè সীমারেখা তার ধার ঘেঁষে ক্রমশঃ বেড়ে ওঠা দেয়াল ভেদ করে আমার ফুসফুস যেন তার প্রয়োজনীয় নিঃশ্বাসটুকু টেনে নিতে পারে তার জন্য মনটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। আমি মাওনায় নিজেকে খুঁজি। আর খুঁজি আমার ছায়া। কিন্তু তেমন কিছুর দেখা মেলে না। এই জগৎ বড় নিষ্ঠুর।
এভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। নগর থেকে কিছু দূরে শীতলক্ষ্যার কোমল ধারা বহমান। মাঝে মাঝে তার পাশে গিয়ে বসি। হৃদয়ের শোকেসে তুলে রাখা স্মৃতির পাত্রগুলো আনমনে একাকি সাজাই। কিন্তু কেন জানি বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। হেলেনের কথা মনে পড়ে।
পরক্ষনেই নিজেকে বুঝাই হেলেন আমার জীবনে কোন ধ্র“ব সত্য নয়। সে একটি বিভ্রান্ত স্মৃতিমাত্র। আমার অস্তিত্বের চারপাশে ছড়ানো সূক্ষè মাকড়সার জাল। আমার কল্পনার রাজ্যে জট পাকানো একটি জটিল ধাঁধা। আমি তাকে ভুলে যেতে চাই। পৃথিবীতে ভালোবাসা আর ভুলের মত এত সত্য আর কিছু নেই। মানুষ মূলতঃ অজস্র ভুলের সমষ্টি। আর ভালোবাসা হলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আমি আমার অস্তিত্বের গভীরে দারুণ গোপনে নিজেকে মেরামত করি। ভীষণ একাকী সেই চেষ্টায় আমার ক্লান্ত হাত দুটো ধরার মত কেউ থাকে না। হেলেন থাকলে ভালো হতো। কিন্তু দুঃস্বপ্ন কখনও মধুর কিছু আনে না। আমি আমার জীবনের ধূসর চৌরাস্তায় একজন নিঃসঙ্গ পথিকের মত আনমনে দাঁড়িয়ে থাকি পথভুলে। আমাকে কেউ ডেকে বলে না - চলে এসো। তোমার জন্য অনন্ত শান্তি আছে। তোমার অপেক্ষার পালা শেষ।
আমি মূলতঃ মাওনায় আসতে রাজী হই সে না পাওয়ার কষ্টের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। আমার বিভৎস স্মৃতি আর দারুণ পরাজিত ভালোবাসাকে পেছনে ফেলে আমি মূলতঃ পলায়নপর এক তীরন্দাজ। আমার ভেতরে যে আমি তার হাত থেকে বাঁচার জন্যেই মূলতঃ এই চেষ্টা। আমার বহুধা বিভক্ত সত্তার মূলে যে বিষের খনি তা আমাকে এতকাল ধরে শুধু নীলকণ্ঠই করেছে। আমি ভালোবেসেছি এবং দুঃখ পেয়েছি। আমি এসবের আর পুনরাবৃত্তি চাইনি। তাই প্রাণহীন ঐ পাষাণ শহরের সীমানা পেরিয়ে আমার জন্যে এমন একটা জায়গা বেছে নেওয়াই ছিল সাময়িক সান্ত্বনা। আমি তাই করেছিলাম। মানুষ মূলতঃ পলায়নপর। কিন্তু ফিরে যাওয়া তার নিয়তি। আমি চেষ্টা করেছিলাম।
গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা এলো। দেখতে দেখতে বর্ষাও যায় যায়। কিন্তু হৃদয়ের জমিন যেন কিছুতেই ভেজে না। হাত, পা ছড়িয়ে দিয়ে বিভ্রান্ত সাতারুর মত হাতড়ে বেড়াই কুল। কিন্তু তার যেন আর দেখা মেলে না। আমার হৃদয়ের রাণীকে আমি খুঁজি। ...
শোভা
গ্রীষ্মের দিনে স্কুল ছুটি হতে হতে প্রায় চারটা বেজে যায়। দূর দূরান্ত থেকে মফস্বল শহরের এই হাইস্কুলে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। তাদের বেশীরভাগই পেটে ক্ষুধা নিয়ে স্কুল শেষ করে। তারপর বেরিয়ে পড়ে কয়েক মাইল দূরবর্তী তাদের গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যখন বাড়ীতে পৌঁছায় তাদের মুখ তখন শুকিয়ে কাঠ। দুচোখ ঘোলা আর ঝাপসা। চেহারা মলিন। দুপুরের খাবার খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে যায় কখনও কখনও। তবু আফসোস নেই। বিদ্যা অর্জনের জন্যে এই ত্যাগ তেমন কিছু নয়। শোভাও এই সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে একজন। তাদের দরিদ্র হিন্দু পরিবার। ছিমছাম বাড়ী। নিকোনো উঠান। গোবরের প্রলেপ দেওয়ায় পরিচ্ছন্নতা যেন একটা ভিন্ন মাত্রা নিয়ে ভেসে ওঠে। অভাবের সংসার। তবু শোভার ভালো লাগে। তেমন কোনো ঝামেলা নেই। খেয়ে না খেয়ে দিনগুলো কোন রকমে কেটে যায়।
শোভা এবার মেট্টিক পরীক্ষা দেবে। লেখাপড়ায় তার মনোযোগ মোটামুটি। তাছাড়া সে নিজেকে খুব একটা মেধাবীও মনে করে না। ক্লাসে তার পিছনের দিকের রোলই তার প্রমাণ। অবশ্য এসবে তার তেমন কোন আফসোস নাই। আফসোস করে কি লাভ। শুধু শুধু স্বপ্ন দেখার কোন মানে হয় না। সে তো আর নেহরু কণ্যা ইন্দিরা হয়ে পৃথিবীতে আসেনি। বরং গরীবের সংসারে নিজেকে তার একটা বাড়তি বোঝাই মনে হয়। যদিও তার বাবা মা এমনটা মনে করেন না। কিন্তু শোভার ভেতর কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ কাজ করে। মনে হয় এভাবে এই পৃথিবীতে না জন্মালেই ভালো হতো। শোভার শুধু নামেই শোভা। বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব নাই। অবশ্য শোভা দেখতে মোটামুটি হলেও তার চোখ দুটো ভারী সুন্দর। শোভার স্বার্থকতা শুধু একটুকুই।
শোভার এই চোখ আরও সার্থক হয় যখন সে জানতে পারে ক্লাসের ফার্স্ট বয় মনির তার এই চোখ ভীষণ পছন্দ করে। বিশেষ করে তার এই পটল চেরা চোখ দিয়ে যখন সে গরুর মতো ভাসা ভাসা করে তাকায় তখন মনিরের যেন একদম মরে যেতে ইচ্ছে করে। তার মনে হয় তারা দুজন যেন স্বর্গের বারান্দায় ঝুলে আছে। আর এভাবে অনন্তকাল ঝুলে থাকার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। এই আনন্দের কথা অবশ্য কেউ জানে না।
এভাবে দিন যায়। রাত যায়। বলেশ্বরেরর জলের স্রোত কত লক্ষ টন জল নিয়ে সমুদ্রে পতিত হয় তার হিসেবে কেউ রাখে না। শোভার পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। পড়াশুনা নিয়ে তার ভাবনাটা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। ভাল রেজাল্ট না হোক অন্ততঃ একটা দ্বিতীয় বিভাগ তো তাকে পেতেই হবে। সে তাই আলতো করে বইয়ের পাতা উল্টায়। কিন্তু কেন জানি মন বসে না। মনির হয়ত এখন গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। কিন্তু সে পারছে না। তার মনের ভেতর মনির ঢুকে বসে আছে। সে কিছুতেই সেখান থেকে বের হতে চায় না।
টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। শোভা কৃতকার্য হয়েছে। সে এবার পরীক্ষা দিতে পারবে। এই সময়ে স্কুলে কোচিং ক্লাস করাচ্ছে। শোভাও নিয়মিত কোচিং করছে। ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই যার যার মতো দ্রুত চলে যায়। সামনে পরীক্ষা। নষ্ট করার মতো সময় কারোর নেই। কিন্তু শোভা বসে থাকে স্কুলের ছাদে গিয়ে। ওখান থেকে মনিরের বাসাটা দেখা যায়।
এভাবে প্রতিদিন কোচিং শেষে ক্ষুধার্ত শোভা দ্রুত বাড়ির পথে পা না বাড়িয়ে কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ায় এলাকাটা তখন নীরব। আর সেই নীরবতা বিকেলগুলোকে আরও বিষন্ন করে তোলে। স্কুলের পাশেই নদী। শোভা হেঁটে নদীর পাড়ে যায়। নদীতে গ্রীষ্মের জোয়ারের জলের উপর কুসুমের মত আবরণ। ভীষণ ভালো লাগে শোভার। এই অপেক্ষার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। সেই আনন্দ তার একান্ত নিজস্ব। সে ঠিকই জানে স্কুল থেকে ফিরে বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে মনির ঠিকই আসবে। তার সাথে দেখা হবে। কথা হবে। হৃদয়ের কথাটা তাকে বলা না গেলেও এই যে অলিখিত সাক্ষাতের ধারাবাহিকতা এটাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রতিদিন এভবেই শোভা আগামী দিনের জন্যে অপেক্ষা করে। সে খুব ভালো করেই জানে মনিরের সাথে তার কখনও প্রেম করা হবে না। কিন্তু তবুও কেন জানি তার মন বলে মনির হয়তো তাকে খানিকটা হলেও পছন্দ করে। নইলে প্রতিদিন তার এই অপেক্ষার মূল্য দেওয়ার জন্যে সে ছুটে আসত না। কোন না কোন অজুহাতে এসে দেখা করতো না। ভালোবাসার একটা আলাদা রঙ থাকে। সেই রঙের খানিকটা সে তাদের সম্পর্কের মাঝেও খুঁজে পায়।
এভাবে দিনের পর দিন যায়। মাসের পর মাস। পরীক্ষা শেষ করে শোভা এখন বাড়িতে। স্কুলে যাওয়া হয় না বলে মনিরের সাথে তার আর দেখা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। পরীক্ষা শেষ করে মনিরও যে কোথায় কোথায় ছুটছে তা তার জানা নেই। দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটে তার বারান্দায় বসে উঠোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। নিকোনো উঠোনের প্রশস্ত বুকে সে যেন কি একটা খুঁজে বেড়ায়। আসলে তার মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। মনিরের কাছে। এক জীবনে কি আর কখনও ওর সাথে দেখা হবে।
সত্যিই দেখা আর হয় না। সে মনিরের সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেও পারে না। শোভার পড়াশুনা আর এগোয় না। এ নিয়ে অবশ্য তার তেমন কোন ভাবনাও নেই। তার ভাবনা মনিরকে ঘিরে। সে কোথায় ভর্তি হলো। কোন কলেজে। পড়াশুনা কেমন চলছে। কেমন লাগছে তার কলেজ জীবন। এমনই কত জিজ্ঞাসা তার মনের ভেতর। কিন্তু তার এই সব প্রশ্নের উত্তর জানার কোন সুযোগ তার হাতে নেই। সে গ্রামের মেয়ে। আগে স্কুলে যাওয়ার সুবাদে ঘর হতে বের হতো। এখন সে সুযোগও নেই। তাছাড়া মনিরদের বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। যখন স্কুল চলছিল তখন মনির স্কুলের পাশেই একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকত। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সে বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আর এখন কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাই বা কে জানে। এমনিতেই সে একটু বোহেমিয়ান টাইপের। তার উপরে পরীক্ষা শেষ। এখন আর তাকে পায় কে। তবে শোভার বিশ্বাস পরীক্ষায় সে সত্যিই ভালো করবে। তাদের কেন্দ্রে সে-ই হয়ত প্রথম হবে।
হঠাৎ করেই শোভার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর সাথে সে চলে যায় ভারতে। কলকাতায় তারা থাকতে শুরু করে। কলকাতায় শোভাদেরও আপনজনরা আছে। তারাই শোভার বিয়ে ঠিক করে। কলকাতায় এসে শোভার অতোটা ভালো লাগে না। অন্যদের লাফালাফি ঝাপাঝাপি দেখে সে বুঝে উঠতে পারে না এতোটা উন্মাদনার কি আছে। সে নীরবে নিভৃতে তার ফেলে আসা জীবনকে খোঁজে হৃদয়ের গহীন কোনে। কিন্তু সে সব আজ অতীত মাত্র। তার কাছে বর্তমানটাই ধীরে ধীরে মূখ্য হয়ে ওঠে। জীবনের এটাই ধর্ম। পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্যেই মানুষ বদলায়।
এভাবে দিন যায়। বছর যায়। শোভার জীবন নানা ফুলে ফলে শোভিত হয়। কোল জুড়ে সন্তান আসে। সে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুক আনন্দে ভরে যায়। মাতৃত্বের স্বাদ তাকে নতুন জীবনের সন্ধান দেয়। মাঝে মাঝে মনে হয় তার এই সন্তান যদি মনিরের হতো এর চেয়ে খুশীর আর কিছু হতো না। কিন্তু সে শুধু স্বপ্ন মাত্র। বাস্তবে তার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ মনির মুসলমান। সে হিন্দু। ধর্ম তাদের জন্যে একটা বিরাট বাঁধা। শোভার অবশ্য কখনওই প্রত্যাশা করার মতো কিছু ছিলো না। কারণ মনির তাকে আদৌ ভালোবাসে কিনা সেটাই তার জানা নেই। সে কখনও জিজ্ঞেস করতেও সাহস পায়নি। পাছে ভয় যদি মনির না বলে তাহলে এর চেয়ে কষ্টের আর কিছু থাকবে না। তার চেয়ে না জানাই ভালো। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়েই জীবনটা কেটে যাবে।
এবারের কলকাতা বইমেলা খুব জমে উঠেছে। শোভা মনে মনে ঠিক করে সে বইমেলায় যাবে। মনির লেখালেখি করতো। সেও নিশ্চয়ই বইমেলা খুব পছন্দ করে। তাছাড়া সে লেখাপড়া জানা মেয়ে। বইমেলায় গেলে নিশ্চয়ই তার ভালো লাগবে। পাশাপাশি বাচ্চাটার জন্যে কিছু শিশুতোষ বইও কেনা যাবে। সে তার স্বামীকে ব্যাপারটা জানায়। স্বামী শুনে খুশী হয়। তারা সপরিবারে বই মেলায় রওয়ানা হয়।
মেলা প্রাঙ্গনে দারুণ ভীড়। সবাই যার যার মতো হাঁটছে। কেউ কেউ বই দেখছে। কেউ বা কিনছে। তার ছ্টো ছেলে সন্তানটি মেলায় এসে দারুণ খুশী। সে প্রায়ই শোভার হাত থেকে ছুটে গিয়ে এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। তারা কিছু শিশুতোষ বই কিনল। এবার ফেরার পালা। ফিরতে যাবে এমন সময় তাকে যেন কে পিছন থেকে ডাকলো। শোভা অবাক। সেই চেনা কষ্ঠ। সেই পুরনো আহবান। ভুল শুনলো না তো। সে ফিরে তাকায়। অবাক হয়। আর কেউ নয়। মনির! এখানে ! কিভাবে!
দু‘জনে থমকে দাঁড়ায়। কারো মুখ দিয়ে আর কোন কথা সরে না। মনির তাকিয়ে থাকে অপলক। সেই চোখ। সেই চাহনি। সবই আগের মতোই আছে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয় তারা। তারপর কুশল বিনিময়। শোভা তার সন্তানকে দেখায়। সাথে স্বামীকেও পরিচয় করিয়ে দেয়। শোভার স্বামী তাকে তাদের বাসায় দাওয়াত করে। কিন্তু মনির জানায় তার টিকেট কাটা হয়ে গেছে। তাকে চলে যেতে হবে। কারণ ইতোমধ্যে ছুটিও শেষ।
শোভা ভেবে উঠতে পারে না কি বলবে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তারা বিদায় নেয়। বাসায় ফিরে তার স্বামী তাকে দুহাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে আলতো করে বলে - একদিন তুমি ওনাকে ভালোবাসতে। তবে তোমাদের সম্পর্ক যে কতটা পবিত্র তার প্রমাণ আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমি তোমাকে শুধু ভালোই বাসি না। রাতারাতি শ্রদ্ধা করি। পৃথিবীর সব প্রেম যেন এমনই হয়। এতোটা সুন্দর। এতো পবিত্র।
ঙহব ংরহমষব মষধহপব ঃযব হবৎাবং ঃড় ভৎবহুু ৎিড়ঁমযঃ
ঙহব ংরহমষব মষধহপব নবরিষফবৎ’ফ বাবৎু ঃযড়ঁমযঃ.
- খধরষঁ-গধুহঁ, ইধযৎধস কযধহ
সুপ্রভাত! হে বালিকা!
মাওনা থেকে ময়মনসিংহ। সেখান থেকে মুক্তাগাছা। সব মিলিয়ে বলতে গেলে ঘন্টা দু’য়েকের রাস্তা। কিন্তু মনে হয় হাজার বছরের পথ। কেন যে মনে হয় তা শুধু আমি জানি। ভালবাসার মানুষের কাছে যাওয়ার সময় মনে হয় পথ আর ফুরোয় না। ফুরোবে কেমনে? প্রতিটি মূহুর্ত যে অপেক্ষার আগুনে পোড়া কাঠ কয়লার মতো নির্জীব। তার মুখ না দেখা পর্যন্ত সে আগুনও নেভে না, শান্তিও মেলে না।
অন্তরার সাথে সাক্ষাতটা নাটকীয় না কাব্যিক নাকি দৈব তা আজও বুঝে উঠতে পারি না। ব্যাংকের একটা কাজে আমার এক সহকর্মীকে নিয়ে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। একজন প্রতারক গ্রাহককে তাগাদা দিতে। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দেখলাম হাতে বেশ খানিকটা সময় রয়ে গেছে। সহকর্মী ফয়সাল কে বললাম - চলো, মুক্তাগাছায় যাওয়া যাক। সেখানে জমিদার বাড়ী দেখা যাবে ও রাজী হয়ে গেল। আমরা ছুটলাম মুক্তাগাছার দিকে। সবুজ গাছ-গাছালীর মধ্যে দিয়ে কার্পেটিং করা রাস্তা। মাত্র পনের মিনিটের পথ। একটু দূরে পুরনো ব্রহ্মপুত্র যা ক্রমশঃ রাস্তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যেতে যেতে দুপাশের দৃশ্য দেখছিলাম। এই নিয়ে ময়মনসিংহে দুবার এলাম। সব মিলিয়ে বলতে গেলে ভালই লাগছে। প্রথমবার জয়নুল যাদুঘর দেখেছিলাম। ময়মনসিংহ শিল্প সংস্কৃতির পুরনো আবাস। একসময় ঢাকার বইরে এখানেই বসত সাহিত্য সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় আয়োজন। নাগরিক ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে শিল্পের সেই রঙ আজ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
জমিদার বাড়ী দেখার ব্যাপারে সেখানের গাইড অনেক সহযোগিতা করল। গাইডের বর্ণনা শুনে মনটা ভীষন ভারী হয়ে গেল। জমিদারদের জনসেবার চেয়ে অত্যাচারের কাহিনী বেশী। বিশেষ করে বাসর রাতের আগে কুমারী মেয়েদেরকে জমিদারদের হাতে তুলে দেওয়ার বিভৎস কাহিনী সত্যিই পীড়াদায়ক। জমিদার বাড়ী থেকে মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডা খাওয়ার জন্য গেলাম। জমিদার বাড়ী থেকে সামান্য দূরে মন্ডার দোকান। প্রায় একশত পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য। মালিক পক্ষের পঞ্চম পুরুষের একজনের সাথে কথা হলো। মন্ডা খাওয়া শেষ করে যখন বাইরে বের হলাম তখন বাইরে দুপুরের ভরা রৌদ্রের হাহাকার। রিক্সা নিয়ে ছুটলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ময়মনসিংহ গিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেখব। তারপর মাওনা।
বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখলাম ভর দুপুরে বাসস্ট্যান্ডে তেমন কোন লোক নেই। একটা সেলুনের মধ্যে বসে খানিকক্ষন অপেক্ষা করলাম। ফয়সাল গেলো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। মিনিট বিশেক অপেক্ষার পরও যখন দেখলাম বাস ছাড়ার কোন নামান্তর নেই আমরা সিএনজি ধরে ময়মনসিংহ যাওয়াই স্থির করলাম। সিএনজি ষ্টেশন কাছেই। সেখানে যাত্রীবাহী সিএনজির ছড়াছড়ি। জন প্রতি পনের টাকা। সিএনজির ভিতর দেখলাম অপূর্ব সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে। সকালের মিষ্টি রোদের মত স্নিগ্ধ তার অবয়ব। মাঠের সবুজের মত কোমল তার রূপের বাহার। কিন্তু পাশেই এক আধ-খেঁচড়া যুবক। আমি মনে মনে ধরে নিলাম নিশ্চয়ই এই যুবক মেয়েটির বন্ধু বা স্বামী। সুন্দরী মেয়েদের বন্ধুরা বা স্বামীরা সাধারণত এরকমই হয়।
তাই সাহস করে মেয়েটির দিকে সরাসরি তাকানোর চেষ্টা করলাম। নতুন জায়গা। আবার কোন বিপদে পড়ি। কিন্তু মন যেন আর মানে না। সিএনজির পিছনের দিকে তিনটা সিট। মেয়েটি যে পাশে আমি ঠিক তার অন্য পাশে। মাঝখানে ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের ঘাড়ের পিছনের দিক থেকে তাকালে মেয়েটির ঘাড় দেখা যায়। অপুর্ব সুন্দর গ্রীবাদেশে বিষন্ন জ্যোৎস্নার আলোর মতই লাবন্য প্রভা মাখামাখি হয়ে আছে।
বার বার তাকাতে লাগলাম। লোভ সামলাতে পারছিলাম না। মেয়েটি বুঝতে পারল। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। খানিকটা পথ যেতেই সিএনজি চালক রাস্তার পাশের একটা ফিলিং ষ্টেশনে থামল সিএনজি নেওয়ার জন্য। আমরা সবাই নেমে দাঁড়ালাম। মেয়েটি আমার কাছ থেকে সামান্য দূরে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ কি যেন ভেবে আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল - এতগুলো সিএনজির মধ্যে আমাদের সিএনজি কোনটা বলতে পারবেন ? আমি অবাক হলাম। হেসে বললাম - পারব। কিন্তু আপনার ভাবনা কিসের ? আপনার সাথে তো লোক আছে। ? সে বলল - উনি আমার সাথে না। আমি একা যাচ্ছি। আমি বললাম – তাই! আমি তো ভেবেছিলাম উনি আপনার বন্ধু অথবা স্বামী। সে বলল - জ্বী না। আমি ওনাকে চিনি না।
ইতোমধ্যে চালকের সিএনজি নেওয়া শেষ। আমরা সিএনজিতে ওঠার জন্য এগিয়ে গেলাম। সিএনজিতে ওঠার ঠিক আগ মূহুর্তে আমার কাঁধে মেয়েটির হাতের টোকা অনুভব করলাম। সিএনজিতে সে আমাকে তার পাশে বসার ইঙ্গিত দিল। ভদ্রলোক খানিকটা অবাক হলেন। এত তাড়াতাড়ি এড্জাস্টমেন্ট।
মেয়েটির সাথে অনেক কথা হল। এত অল্প সময়ে যত কথা বলা যায় তার চেয়ে খানিকটা বেশি। আগ্রহ অনেক। কিন্তু সময় কম। তাই গতি দ্রুত। ময়মনসিংহ পৌঁছে সে তার জন্যে অপেক্ষামান তথাকথিত ”ভাইয়া”র সাথে চলে গেলো। এই ভাইয়াটা কে তা জিজ্ঞেস করার মত সময় পাইনি।
অন্তরার কোন ভাই নাই।
অন্তরার নম্বার আমার কাছে আছে। সে-ই দিয়েছে। আমার কার্ডও আমি তাকে দিয়েছি। কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ। সে-ও আমাকে ফোন করছে না। ভীষণ অস্থির লাগছে। দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। আমি সুযোগ পেলেই নাম্বারটা ট্রাই করি।
একদিন হঠাৎ দেখলাম রিং হচ্ছে। বুকটা ধ্বক করে উঠল। একজন বয়স্কা মহিলার কন্ঠস্বর। বুঝলাম অন্তরার মা। সে আমাকে জানিয়ে রেখেছিল তার মা ফোন ধরতে পারে। কোন সমস্যা নেই। মাকে বললেই হবে - অন্তরার সাথে কথা বলতে চাই। মা ডেকে দেবে। অন্তরার মা জানাল - অন্তরা বাসায় নেই। সে প্রাইভেট পরতে গেছে। দুপুরে ফিরবে। দুপুরে আবার ট্রাই করলাম। কলেজে গেছে। কলেজ থেকে বিকালে ফিরবে। সন্ধ্যায় অন্তারার সাথে কথা হলো। মনে হলো যেন অনেক দিনের পরে বৃষ্টি হল। অনেক তৃষ্ণার পর খানিকটা শীতল জল। অন্তরাকে হারিয়ে ফেলতে ফেলতে আবার ফিরে পেলাম। এই ফোন নাম্বারটা ছাড়া তার আর কোন হদিস আমার জানা ছিল না।
অন্তরার সাথে নিয়মিত কথা হয়। সে আমাকে ময়মনসিংহ যেতে বলে। সেখানে আমাদের দেখা হতে পারে। কিন্তু আমি যেন আর সময় করতে পারি না । নানা ঝামেলা। একদিন এই সমস্যা তো অন্যদিন ঐ সমস্যা। সব মিলিয়ে একটা বিশ্রী ব্যাপার।
এভাবে বেশ কিছুদিন যায়। একদিন অফিসে কাজ করছিলাম। এমন সময় অন্তরার ফোন বেজে ওঠে। তার আব্বু ভীষন অসুস্থ। আব্বুকে নিয়ে সে এখন হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে আছে। কোন সিট পাওয়া যাচ্ছে না। ভীষণ সমস্যা। আমার অস্থির লাগে। স্যার কে বলি আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। আমার একজন অসুস্থ রোগী আছে হাসপাতালে। তাকে দেখতে যাব। স্যার জিজ্ঞেস করেন - রোগী আমার কি হয় ? আমি বলি - আমার চাচাতো বোন। অন্তরার আব্বু উচ্চারন আমি ফোনে আপু শুনেছিলাম। তাই মনে মনে ভেবেছিলাম তার কোন বোন হয়তো অসুস্থ। অন্তরারা ছয় বোন।
আমি যে যাব এই কথা অন্তরাকে বলি না। ময়মনসিংহ মেডিকেলে কাজল নামে আমার একজন পরিচিতা আছে। সে ময়মনসিংহ মেডিকেলের ছাত্রী। তাকে অন্তরাদের অবস্থান জানিয়ে যথাসম্ভব সহযোগিতা করতে বলি। কাজল তার ক্লাস শেষ করে সেখানে যায়। আমি বাসে উঠি ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে। বাসের ঝাঁকুনিতে আমার তন্দ্রা আসে। ময়মনসিংহে পৌঁছে দেখি অনেকগুলো মিসকল। কাজল আর আন্তরার নাম্বার থেকে। ততক্ষনে আমি মেডিকেলের গেটে বাস থেকে নেমে গেছি।
আমি যে যাচ্ছি অন্তরাকে সেটা না জানালেও সে ঠিকই জানতে পারে। কাজল আমার অফিসে ফোন করেছিল। অফিস থেকে জানানো হয়েছে আমি ময়মনসিংহে যাচ্ছি। অন্তরার আর বুঝতে বাকি থাকে না আমি ওখানেই যাচ্ছি। আমি যখন পৌঁছাই অন্তরা আর ওর মা চলে যাওয়ার জন্য তৈরী। রোগীর সাথে রাতে অন্য লোক থাকবে।
অন্তরাদের সাথে আমি মেডিকেলের গেটে দাঁড়িয়ে কথা বলি। ওর দিকে অপলক তাকিয়ে কি যেন দেখি। নিজেকে এলোমেলো মনে হয়। ভীষন ভালোও লাগে। অন্তরার মুখে তখন মিষ্টি হাসির ঝিলিক। এভাবে চলে আসাতে সে ভীষন খুশী হয়েছে।
এমনি করে এগুতে থাকে সম্পর্কের সাম্পান। কখনও তার পালে বাতাসের বেগ। কখনও তাতে উজানের টান। দিন যায়। মাস যায়। তারপর বছর। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। তারপর আরও কি যেন মন চায়। অন্তরাকে বলতে পারি না। সব কথা বলা যায় না।
অন্তরা আজ নেই। আমার জীবন থেকে সে অনেক দূরে হারিয়ে গছে। এটাই স্বাভাবিক। মনে মনে ভেবেছিলাম একদিন ওকে একটা সারপ্রাইজ দেব। কোন একদিন খুব ভোরে সরাসরি ওদের বাড়িতে গিয়ে ঠিক ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। ওকে অবাক করে দিয়ে বলব - সুপ্রভাত! হে বালিকা!
কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।
মিনতিলতা
খুব ভোরেই মিনতির ঘুম ভেঙে যায়। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস। ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে আর আলসেমি করে বিছানায় পড়ে থাকে না। ঝটপট উঠে পড়ে। ট্র্যাকস্যুট ট্রাডজার পরে দৌঁড়াতে বের হয়ে যায়। তার জন্যে এটা কোন ব্যাপারই না। সে এই এলাকারই মেয়ে। এখানেই তার জন্ম, বেড়ে ওঠা। তাছাড়া তার বাবা এই শহরের পৌরসভার চেয়ারম্যান। তার দিকে চোখ তুলে তাকানোর মতো কেউ নেই। সে নিশ্চিন্তে দৌঁড়াতে বের হয়। এই অভ্যেস তার ছোটবেলার। তার পক্ষে এটা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই কে কি বলল বা ভাবল তাতে তার কিছু আসে যায় না। তার ভালো লাগে এই প্রাতঃভ্রমন।
মিনতির বয়স এখন সতেরো পেরিয়ে আঠার চলছে। স্থানীয় কলেজের মাধ্যমিক শ্রেণীর বিজ্ঞান প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পড়াশুনায় তাকে মোটামুটি ভাল বলা যায়। তবে তার চেষ্টা আছে। আছে অধ্যবসায়। ভীষন গভীর মনোযোগ। মেধা বলতে যদি কিছু থেকে থাকে সেটা তার অতটা ভাল না হলেও সে এগিয়ে যেতে আগ্রহী। তার ভিতরের দৃঢ় প্রত্যয় তাকে সামনে এগিয়ে নেবে বলেই বিশ্বাস। সে হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। তাই সবার বাধা সত্ত্বেও বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে। অন্যরা পারলে ও সে পারবে।
সকালের মত মনির বিদায় নেয়। ক্লাসে যেতে আবার মিনতির সাথে দেখা। মিনতি তাকে দেখেই দৌঁড়ে লাফাতে লাফাতে ছুটে এসে বলে - ক্লাসে তুমি সব সময় আমার সাথে সাথে থাকবে। দেখনা আমি কোন ছেলেকে পছন্দ করি না। কেবল তোমাকে ছাড়া।
- তুমি আমাকে পছন্দ কর?
- হ্্যাঁ করি।
মনির আর কিছু বলে না। তার ঠোঁটের কোনায় এক টুকরো মিষ্টি হাসি সকালের রোদের মত ঝিলিক দিয়ে আবার কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। সে যেন নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে - পছন্দ আসলে কি জিনিস?
কিছুদিন পরেই সে বুঝতে পারে পছন্দ আসলে কিছুই না। সারাক্ষন পাশাপাশি থাকা। একসাথে পড়া তৈরী করা। এটা ওটা বিষয় নিয়ে টুকটাক গল্প। মাঝে মাঝে একটু আধটু হাসহাসি। খুঁটিনাটি খুঁনসুটি। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিক্যাল করা। প্র্যাকটিক্যালের খাতা লিখতে সাহায্য করা। আরও কত কি! পছন্দ আসলে একটি বাহারি পাতাবাহার গাছ। এরকম একটি পাতাবাহার গাছ সে তার ছোটবেলায় একদিন কোন এক হিন্দু বাড়িতে দেখেছিল। সেই গাছের স্মৃতি তার চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে। সেই গাছ যেন পছন্দের বৃক্ষ হয়ে তার চোখের সামনে সারাক্ষন দোল খায়। তার গাছের নাম মিনতিলতা।
এভাবে প্রথম বর্ষ পার হয়। তারা দ্বিতীয় বর্ষে ওঠে। সকালে দৌঁড়ানো, দিনে ক্লাস, তার পর বিকেলে মিনতিদের বাসার ড্রইং রুমের টেবিলে বসে ক্লাসের পড়াশুনার ঝামেলা শেষ করা। সব শেষে সন্ধ্যায় রুমে ফিরে রাতের পড়া শেষ করে গল্প, উপন্যাস, কবিতা। মিনতিকে নিয়ে আলাদা করে ভাববার সময় কই মনিরের। মিনতি তো সব সময় মিনতিলতা হয়েই তার সাথে জড়িয়ে আছে। তাকে মন থেকে নামানোর অবকাশ কোথায়।
দেখতে দেখতে কখন যে দুটো বছর পার হয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মনির এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। পড়াশুনা আর টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত। পাশাপাশি লেখালেখি তো আছেই। সবচেয়ে বড় কথা জীবনের বাস্তবতার কাছে কখন যে সবকিছু ফিকে হয়ে যায় কেউই টের পায় না। সেদিনের সেই মিনতি লতা কোথায় যে হারিয়ে গেছে তা সে নিজেও জানে না। তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। থাকলেও লাভ হত না। মনির গরীব ঘরের ছেলে। মোবাইলের বিলাসিতা তাকে মানাতো না।
এভাবে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ হয়। নতুন চাকুরী নিয়ে সে যায় কর্মস্থলে যোগদান করতে। মিনতিলতাদের শহরেরই একটা কলেজ। কিন্তু টিচার্স রুমে কে যেন বার বার তার দিকে আড়চোখে তাকায়। কিছু একটা বলতে গিয়েও আবার নিজেকে সামলে নেয়। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব মনিরকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তার গুনগান সম্পর্কে একটা ছোট্ট বক্তৃতা দিয়ে ফেলেন। আসলে তার স্বভাবটাই এমন। পলিটিক্স করলে নিঃসন্দেহে ভাল করত লোকটা।
মনির অত্যন্ত বিনীতি ভঙ্গিতে একটা চেয়ার টেনে বসে। সহকর্মীদের সাথে আলাপে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চশমা পড়া মেয়েটি কেন যেন বার বার তার দিকে একটু আড়চোখে তাকায়। সরাসরি তার দিকে তাকালেই পারে। মিনতিলতার এভাবে বদলে যাওয়ার কোন কারণ নেই। মনির আগের জায়গায়ই আছে। ঠিক আগের মতই তার পছন্দের বৃক্ষ এখনও সেই সেদিনের মত মৃদুমন্দ বাতাসেই দোল খায়।
প্রথম দিন তাই বেশিক্ষণ তার থাকা হয় না। চলে আসার জন্য সে যখন উঠতে যাবে তখন মিনতিলতা সেখানে নেই। তার বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগে। মিনতিলতা তাহলে গেল কোথায়! আজকের মত তবে কি ওর মুখটা আর দেখা যাবে না। আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কলেজ গেট থেকে বের হওয়ার সময় মিনতিলতার সেই কোমল কণ্ঠ তার কানের কাছে বেজে ওঠে।
- কেমন আছো মনির ?
- ভাল।
- তুমি কেমন আছো ?
- ভাল। আমাকে চিনতে পেরেছো ?
- না চিনলে তুমি বলতাম না।
- তাই নাকি! জেনে খুশী হলাম। এতদিন পরেও আমাকে মনে রাখার জন্য ধন্যবাদ।
- শুধু মনে রাখা নয়। পছন্দ করা। মানে একটু বেশি কিছু। তুমি বোঝ না
- আমি তোমাকে এখনও পছন্দ করি।
মনির আর কিছু বলে না। তার ঠোঁটের কোনে কলেজের প্রথম বর্ষের সেদিনের সেই সোনা রোদের মত চিকচিক করা হাসির রেখা উঁকি দিয়ে আবার যেন কোথায় মিলিয়ে যায়। পরদিন সকালে মনির আর কলেজে আসে না। তার একটা চিঠি আসে শুধু। তাতে লেখা - মিনতিলতা, তোমাকে পাব না জেনে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন জানলাম তুমি এখনও আমার জন্যে অপেক্ষায় আছো নিজেকে ভীষন স্বার্থপর মনে হলো। সত্যিই আমি তোমার ভালবাসা বুঝতে পারিনি। কিন্তু তুমিও তো বলতে পারতে । অবশ্য কলেজ থেকে চলে আসার পর তোমার সাথে আর কখনও দেখা হয়নি।
(মিনতিলতা গল্পটি আমার ভীষন প্রিয় সহপাঠিনী মিস ঝুমাকে উৎসর্গ করা হলো। ঝুমা আর আমি সরকারী পি সি কলেজে একত্রে পড়তাম। সে বাগেরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান আবু বড়মিয়ার ছোট মেয়ে। ঝুমা, তোমাকে কখনও বলতে পারিনি যে আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। প্রিয় পাঠক, এই গল্প আর আমার আর ঝুমার জীবনের সাথে কোন সাদৃশ্য নেই।)
Comments
Post a Comment