ইসলামের জন্মস্থল পূণ্যভূমি আরব। ইসলামের বিকাশকে বুঝতে হলে তাই আরবদের জাতি ও গোত্রগত বিষয়গুলো সম্পর্কে মোটামুটি কিছুটা হলেও ধারণা থাকা প্রয়োজন। কারণ গোত্রগত এই বিভাজনই পরবর্তীতে আরবদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলো। সুদূর অতীত থেকে চলে আসা অস্তিত্বগত বিভাজনের পাশাপাশি পরবর্তীতে সৃষ্টি হওয়া নানামুখী বিভাজন এমনকি একই বংশের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন ধারাও পরবর্তীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলো। যেমন কুরাইশদের মধ্যেরই দুটি ধারা আবদে শামস এর বংশধারা যারা পরবর্তীতে উমাইয়া নামে পরিচিত এবং হাশিম মুত্তালিব এর বংশধারা যারা আমাদের নবী বংশ এদের মধ্যে দীর্ঘ ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবাদ সর্বজনবিদিত। সত্যি করে বলতে গেলে নবী (সাঃ) এর ওফাতের পরবর্তী ইসলামের ইতিহাসের বিকাশ মূলত এই পরস্পর বিরোধী দুটো ধারায় আন্তঃক্রিয়ারই ফসল।
এই অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা আরবদের জাতিগত উৎসের খুব সামান্য একটু আলোচনাই রাখতে চাই। মূলত এ আলোচনা দীর্ঘ ও ব্যাপক। তবু পাঠকদের সুবিধার্থে এ ব্যাপারে অন্তত সামান্য একটু আলোকপাত করা দরকার। সবচেয়ে জরুরী যে কথাটি তা হলো এ ব্যাপারে আরও অনেক অধ্যয়ন ও চর্চা প্রয়োজন। আশা করি পাঠকরা এ বিষয়ের উপর বিশ্ব বরেণ্য সব লেখকদের মহামূল্যবান লেখা অধ্যয়ন করে সম্যক ধারণা লাভ করবেন।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। এ আলোচনার সূত্রপাত করতে গেলে আমাদের একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের কথা নিশ্চয় আমাদের সবার জানা আছে। মহাপ্লাবনের পরবর্তীকালে তার চার পুত্র সাম, হাম, ইয়াফাস ও রাফাজের বংশধরগণ পৃথিবীর একটা বিরাট অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেমিটিক, হ্যামিটিক ও আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। এদের মধ্যে সেমিটিকগণ আরব অঞ্চলে, হ্যামিটিকগণ আফ্রিকা অঞ্চলে এবং ইয়াফাসের বংশধররা অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাফাজের বংশধরদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
এই বিভাজন থেকে আরব জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ কেমন করে হয়েছিলো এ ব্যাপারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে “হিস্টোরি টিভি বাংলা” নামক ওয়েব সাইটে উল্লেখিত একটি ছোট্ট লেখা হুবহু তুলে দিলাম পাঠকদের আগ্রহ মেটানোর জন্যে: “মহাপ্লাবনের পরবর্তী কালের কথা। হযরত নূহ (আঃ) এর চার পুত্র- সাম, হাম, ইয়াফাস এবং রাফাজের বংশধরগণ কালক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেমিটিক, হ্যামিটিকি ও আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। ধারণা করা হয়, সেমিটিকগণ আরব, হ্যামিটিকিগণ আফ্রিকায় বসতি স্থাপন করে এবং বাকি মানবস¤প্রদায় ইয়াফাসের বংশধর। উল্লেখ্য, রাফাজের বংশধর সম্পর্কে প্রামাণ্য ইতিহাস দুর্লভ।
সেমিটিকগণ আরবদেশ এবং কালক্রমে দাজলা ও ফোরাতের অববাহিকা অঞ্চলে যথাক্রমে ব্যবিলন তথা সুমরেীয় ও আক্কাদীয়, আমুরীয়, আসিরিয়, ক্যালদীয়, ফেনেসীয় এবং হিব্রæ সভ্যতার সৃষ্টি করে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সেমিটিক জাতির অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এমনকি হযরত মুসা (আঃ), ঈসা (আঃ) এবং ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ (সঃ) এই সেমিটিক জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আরব দেশ সেমিটিক জাতির আদিভূমি ছিল। একেশ^রবাদী ধর্ম যেমন : খ্রিস্ট ধর্ম ও ইহুদি ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারেও সেমিটিক জাতি নেতৃত্ব দান করেছে। পরবর্তীতে এই সেমিটিক জাতি থেকে আরবে বিভিন্ন জাতি এবং রাজ্যের আবির্ভাব ঘটে।
মুসলমান ঐতিহাসিকগণ আরবজাতিকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। যথাÑ
১. আরব আল বায়দা বা দূরবর্তী আরব : পবিত্র কুরআনে বর্ণিত প্রখ্যাত প্রাচীন বংশ আদ, সামুদ, তাসম ও জাদীস প্রভৃতি এই জাতির শ্রেণীভুক্ত। বর্তমানে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত।
২. আরব আল আরিবা বা আসল আরব : আসল আরব কাহাতানের বংশধর। কাহতানের দুই পুত্র জারহাম ও ইয়ারব। উল্লেখ্য, কাহাতানের পুত্র ইয়ারাবের নাম অনুসারে আরব নামটির উৎপত্তি হয়েছে এবং আরব জাতি ও সেই নামে পরিচিত লাভ করেছে। কাহাতান বংশের উত্থানের মাধ্যমে আরব জাতির প্রকৃত ইতিহাসের সূত্রপাত হয়। তার বংশধরগণ মহানবীর (সঃ) এর জন্মের ৭০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ইয়ামেনে শাসনকার্য পরিচালনা করে।
৩. মুস্তারিবা বা বহিরাগত আরব : হযরত ইব্রাহীম (আঃ) সিরিয়ার নিকটবর্তী শহর বাবেলের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) এর বংশধর আদনান মোস্তারিবা গোত্রের প্রতিষ্ঠিতা ছিলেন। উল্লেখ্য, হেজাজ, নজদ, পেত্রা, পালমিরা অঞ্চলে বসবাসকারী মুস্তারিবা গোত্রের নিযারী হতে মুহাম্মদ (সঃ) এর কুরাইশ বংশের উদ্ভব হয়। অন্যভাবে, ইসমাইল (আঃ) এর ৫৮ তম অধঃস্তন পুরুষ আল ফিহরের অন্য নাম ছিল কোরেশ। সেই নাম থেকে ‘কোরাইশ বংশ’ নামের উৎপত্তি।
আবার ভূ-প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে আরবের অধিবাসীদের দুই শ্রেনীতে বিভক্ত করা যায়।
প্রথমত, শহরের স্থায়ী বাসিন্দা, যারা উর্বর ও তৃণ অঞ্চলগুলোতে জনপদ গড়ে তুলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তারা কৃষিকার্য, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি করে জীবিকা নির্বাহ করত। বহির্বিশে^র সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তারা মরুবাসী বেদুঈনদের চেয়ে অধিকতর রুচিসম্পন্ন ও মার্জিত।
দ্বিতীয়ত, মরুবাসী যাযাবর বেদুঈন, তারা ছিল স্বাধীনচেতা ও বেপরোয়া দুর্ধর্ষ অধিবাসী। তারা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসের পরিবর্তে মরুভূমিতে সর্বত্র ঘুরে বেড়াত এবং তৃণের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করত। তাদের অন্যতম পেশা ছিল শহরের স্থায়ী বাসিন্দাদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করা। তাই শহরবাসী ও মরুবাসী বেদুঈনদের মধ্যে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এই বেদুঈনদের মধ্যে অন্যতম ছিল উত্তর আরবের বেদুইন গোত্র সমূহ। আদনান গোত্র হতে উৎপত্তি হয় কুযায়া, রাবীয়া এবং মুয়ায গোত্র। এই তিনটি গোত্র হতে উত্তর আরবের গোত্রগুলির সৃষ্টি হয়। উক্ত তিনটি গোত্র কালক্রমে অসংখ্য গোত্রে বিভক্ত হয়ে পৃথক পৃথক এলাকায় স্বাধীনভাবে অথচ পরস্পরের সাথে বিবাদ বিসংবাদ নিয়ে বসবাস করত।
এখানে কুয়াযের গোত্রের শাখাগুলো নজদের উত্তরে বসবাস করতো। মুয়ায ও রাবীয়া গোত্রের শাখাগুলো মক্কার ও তার আশেপাশে বসতি বিস্তার করে। তাই এই গোত্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকতো। উল্লেখ্য, মুয়ায গোত্র থেকে কায়িস, কায়িস থেকে কুরাঈশ ও কিনানা এবং কুরাঈশ থেকে উমাইয়া ও হাশিম গোত্রের উদ্ভব হয়। এই হাশিম গোত্রে বিশ^ মানবতার মুক্তির দূত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব ইসলামের শ্রেষ্ট ও সর্বশেষ নবী মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মগ্রহণ করেন।”
আরব জাতির ইতিহাস ও নবী মুহম্মদের (সাঃ) এর জন্ম নিয়ে চণঞঐঊণঅ বিনংরঃব– এ উল্লেখিত একটি প্রবন্ধঃ
আরবদেশ জগতের বৃহৎ জাতিসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, ছিল তাদের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও শাসন ব্যবস্থার প্রভাব মুক্ত। প্যালেস্টাইন থেকে সুয়েজ খালের দিকে যে পর্বতমালা নেমে গেছে তা আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তসীমা পর্যন্ত লোহিত সাগর বরাবর প্রায় সমান্তরালভাবে চলে গেছে যা হিজাজ বা পর্বত প্রাচীর হিসেবে অভিহিত। আর ইয়েমেন প্রদেশের সীমারেখা পর্যন্ত এই ভূ-খÐ এই নামেই পরিচিত।
হিজাজে কোথাও পর্বতমালা সাগরের খুব কাছাকাছি, কোথাও বা উপকূলভাগ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। সাময়িক বৃষ্টিপাতের ফলে মাঝে মাঝে সবুজ উপত্যকা ও উর্বর মরুদ্যান ছাড়াও এতে রয়েছে দীর্ঘ অনুর্বর, জনবসতিশুণ্য নিম্নভূমি। এই সীমা অতিক্রম করে পূর্বদিকে বিস্তৃত হয়েছে বৃষ্টিহীন নজদ- আরব দেশের উচ্চভূমি- মরুভূমি, গিরিখাত ও স্থানে স্থানে নয়নাভিরাম আবাদী জমিসহ বিশাল মালভূমি। হিজাজের এই পার্বত্য অঞ্চলে নবী মুহম্মদের জন্মস্থান ও লালনভূমি মক্কা ও মদিনা নগরী অবস্থিত।
হিজাজের এই বিশাল ভূ-খÐ মোটামুটি চারটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে বিভক্ত। উত্তরে প্রাচীন ইদোমীয় ও মেদিনীয়দের দেশসহ আরব পেট্রিয়া। তারপর হিজাজ প্রদেশের মধ্যে অবস্থিত প্রসিদ্ধ শহর ইয়াসরিব-এই শহর পরবর্তীকালে মদিনা নামে পরিচিত হয়। হিজাজের দক্ষিণে তিহামা প্রদেশ, এখানে মক্কা এবং জেদ্দা বিমান বন্দর অবস্থিত। সর্ব দক্ষিণে আছির, ইয়েমেনের প্রান্তসীমায় শেষ হয়েছে।
ইয়েমেন: আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তসীমা, পশ্চিমে লোহিত সাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, উত্তরে হিজাজ ও পূর্বে হাদ্রামাউত দ্বারা পরিবেষ্টিত। হাদ্রামাউত ও তার পূর্বের মাহুরা জেলা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। উপদ্বীপের দক্ষিণ পূর্ব কোনে মাহুরার পরে ওমান এবং তার উত্তরে পারস্য উপসাগরের উপর বাহরাইন বা আল-আহসা। তার প্রধান প্রদেশের নাম থেকে এই দেশ হিজর বলেও অভিহিত হয়।
উচ্চভূমি নজদ বৃহৎ মালভূমি। এর পূর্বদিকে হিজাজের পর্বতসমূহ থেকে আরম্ভ হয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে এবং মধ্য-আরব ভূমি গঠন করেছে। নজদের উত্তরাংশ সিরিয়ার মরুভূমিতে বিস্তৃত হয়েছেÑ এখানে আরবের বিভিন্ন গোত্র স্বাধীন ও দুর্বারভাবে ঘোরাফেরা করে, তাদের পূর্বপুরুষ প্রাচীন অরামীয়দের মত জীবন-যাপন করে। উত্তর-পূর্ব অংশ হল ইরাকের মরুভূমি, তা ইউফ্রেটিসের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত কলদীয়র উর্বর ভূ-খÐে গিয়ে শেষ হয়েছে এবং আরব দেশের আবাদী অঞ্চলকে পৃথক করেছে।
পূর্বদিকে নজদের আরবরা নাফুদ দ্বারা আল-আহসা থেকে পৃথকীকৃত। দক্ষিণের দিকে দাহনার বিশাল মরুভূমি তা হাদ্রামাউত ও মাহুরা থেকে নজদকে পৃথক করেছে। এই বিরাট ভূ-খÐ বেদুইন বা মরুবাসী ও শহরবাসী এই দু’স্থানীয় শ্রেণীর অধিবাসী দ্বারা অধ্যুষিত। বেদুইনদের নিজ গোত্রের উপর অবিচল ভক্তি এবং নিজস্ব আত্মসম্মানবোধ থাকলেও তারা খুবই হঠকারী, মনুষ্য জীবনের প্রতি অবজ্ঞাশীল এবং প্রতিহিংসা পরায়ণ। বেদুইন ও শহরবাসীর মধ্যে পার্থক্য যাই থাকুক মূলতঃ তারা সবাই মরুসন্তান এবং তারা গোত্র ও জাতিতে ভিন্ন। এই ভিন্নতার প্রধান কারণ তাদের উৎপত্তির বিভিন্নতা। বিভিন্ন বংশের লোক বিভিন্ন সময়ে এই উপদ্বীপে বাস করেছে। অনেক বংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের দুস্কৃতি বা তাদের পরাক্রম পরবর্তী বংশধরদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে এবং এই ঐতিহ্যই জাতিসমূহের ইতিহাস গঠন করেছে।
আরব উপদ্বীপে যারা বাস করত তাদেরকে তিনটি প্রধান উপদলে ভাগ করা যায়।
আরাবুল বায়দা: এরা হল ধ্বংসপ্রাপ্ত আরব আধিবাসী, এদের অন্তর্ভুক্ত হল হেমিটিক উপনিবেশসমূহ (কুশাইটরা)Ñ তারা উপনিবেশিকতার ক্ষেত্রে সেমিটিকদের পূর্ববর্তী ছিল, এমন কি সিরিয়া, ফিনিসিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের আরামিয়ান জনগণের মত।
আরাবুল আরিবা বা মুত্বারিবা: এরা হল মূল আরব অধিবাসীÑ প্রকৃত সেমিটিকরা, যাদেরকে খাতান বা খোকতান থেকে এসেছে বলে ধরা হয় এবং এরা দক্ষিণে অগ্রসর হওয়ার সময় আদিম অধিবাসীদের ধ্বংস করেছিল। খোকতান বংশোদ্ভূত আরবরা প্রকৃতিতে যাযাবর; তারা অধ্যুষিত দেশসমূহের আদিম অধিবাসীদের, হেমিটিক আকাশ পূজারীদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করেছিল। তাদের আদি বাসস্থান ছিল সেই এলাকা, যেখান থেকে ইব্রাহিম বংশোদ্ভূত লোকদের আগমন হয়েছিল।
ইউফ্রেটিস নদী, দক্ষিণ তীরবর্তী ব্যাবিলন বা ইরাক আরাবী নামে বর্তমানে যে জেলা কথিত হয়ে থাকে তার পরিপ্রেক্ষিতে খোকতানের দু’জন প্রত্যক্ষ পূর্বপুরুষের দু’টি অর্থবহ নাম আরফাজাদ, ‘কলদীয়দের সীমান্ত’ এবং এবারÑ ‘(নদীর) অপর তীরবর্তী লোক’ দ্বারা সঠিকভাবে নির্দেশিত হয়ে থাকে।
আরাবুল মুস্তারিবা বা দেশীকৃত আরব: এরা হল ইব্রাহিম (আঃ) বংশোদ্ভূত সেমিটিক। তারা শান্তিপূর্ণ আগন্তুক বা সামরিক উপনিবেশিক হিসেবে এই উপদ্বীপে প্রবেশ করেছিল এবং খোকতান বংশোদ্ভূত আরবদের সাথে পারস্পরিক বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেছিল।
আরাবুল আরিবা শ্রেণীর মধ্যে যে বংশগুলি বিশেষ উল্লেখ্যের দাবী রাখে সেগুলি হলÑ বনি আ’দ, অমালিকা, বনি সামুদ এবং বনি যুরহুম।
বনি আ’দ: এরা উৎপত্তির দিক দিয়ে হেমিটিক বংশোদ্ভূত। তারা আরব উপদ্বীপের প্রথম আগন্তুক ও উপনিবেশিক। তারা মধ্য আরবে প্রধানভাবে বসতি স্থাপন করেছিলÑ অঞ্চলটি ইয়েমেন হাদ্রামাউত ও ওমানের সন্নিকটবর্তী। তাদের অস্তিত্বের একসময় তারা শক্তিশালী ও বিজেতা জাতিতে পরিণত হয়েছিল। এই বংশেরই একজন নৃপতি ছিলেন শাদ্দাদ।
শাদ্দাদ: এই যাযাবর অভিজেতা ও তার জাতি আল্লাহর গজবে নিপতিত হয়েছিল। অল্প সংখ্যক যারা রক্ষা পেয়েছিল তারাই দ্বিতীয় আ‘দ জাতি। এরা পরবর্তীতে থেবাইড ও ইথোপিয়া বা কুসাইট প্রতিবেশীদের যুগ্ম সহযোগিতায় দক্ষিণ দিকে চ‚ড়ান্তভাবে বহিস্কৃত হয়েছিল। একসময় তাদের অবশিষ্টের একাংশ আরব উপদ্বীপে গমন করে এবং সেখানে (ইয়েমেনে) যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল এবং ক্রমে তারা খোকতান প্রবাহের মধ্যে মিশে গিয়েছিল।
বনি অমালিকা: এরা ছিল অরামীয় বংশোদ্ভূত যারা প্রাথমিক অ্যাসিরীয় নৃপতিদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে আরবে প্রবেশ করেছিল এবং ক্রমে ইয়েমেন, হিজাজ, প্যালেষ্টাইন ও সিরিয়ায় বিস্তৃত হয়েছিল। তারা মিসরে প্রবেশ করেছিল এবং বেশ কয়েকজন ফেরাউন তাদের মধ্যে থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। হিজাজের অমালিকারা বনি কাহতানদের একটি শাখা বনি যুরহুমদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বা বিতাড়িত হয়েছিল। বনি যুরহুম মূলতঃ দক্ষিণ আরবে বসতি স্থাপন করেছিল এবং পরবর্তীকালে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে অমালিকাদের পর্যুদস্ত করেছিল।
বনি সামুদ: এরা আ’দদের মত কুশাইট বা হেমিটিক বংশের অন্তর্ভুক্ত। তারা প্রথমে ইদম সীমান্ত এবং পরে আরব পেট্রিয়ার পূর্বে অবস্থিত হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী হিজর নামক প্রদেশে বসতি স্থাপন করেছিল। তারা ছিল গুহাবাসী, পাহাড়ের পার্শ¦ কেটে বাড়ি তৈরী করত। সিরিয়া এবং নজদ বা হিজাজের মধ্যে বাণিজ্যের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সামুদরা একসময় সমৃদ্ধির চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। অতঃপর একসময় তারা সিরিয়া ও আরবে অভিযান চালনাকারী চেদরলাওমার (খুজার আল-আহমার) কর্তৃক অভিযানের সময় বহুলাংশে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এর পরবর্তীতে তাদের উপর ঐশী গজব নিপতিত হয়েছিল। এই প্রাচীন গুহাবাসী তাদের শক্ত বাসস্থানকে ঐশী গজব থেকে নিরাপদ বলে ভাবত। কিন্তু ঐশী গজবের সময় পাথুরে বাসস্থান তাদের কোন কাজে আসেনি। তাদের অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
ঐশী গজবের পরে জীবিত বনি সামুদরা ইলামাইটিক উপসাগরের উত্তরে সোর পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং সেখানে তারা ইসহাক ও ইয়াকুবের সময়ে বাস করত, কিন্তু তারা শীঘ্রই তিরোহিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে প্রতিবেশী বংশসমূহের মধ্যে মিশে গিয়েছিল এবং তাদের স্থান অধিকার করেছিল ইদোমবাসীরা যারা কিছুকালের জন্যে সোরপর্বত অধিকার করেছিল। এই ইদোমবাসীদের উত্তরাধিকার লাভ করেছিল সেই আরবরা, যারা বনি কাহতান কর্তৃক ইয়েমেন থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।
বনি যুরহুম: এরা আরাবুল আরিবা শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এবং তারা হিজাজে অমালিকা বংশকে পরাভূত ও স্থানচ্যূত করেছিল। এই যুরহুমদের একটি শাখা সুপ্রাচীন আ’দদের সমসাময়িক এবং তারা কুশাইট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। অন্যটি কাহতানের বংশধর যারা এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় ইয়েমেনের উপত্যকা থেকে বেরিয়ে পড়ে এবং হিজাজের অমালিকাদের বিতাড়িত করে সেখানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। এদের আগমন এমন সময়ে হয়েছিল যখন ইসমাইলীয় আরবরা বনি অমালিকাদের মধ্যে প্রাধান্য অর্জন করেছিলÑ যেখানে বহুদিন পূর্বে তারা বসতি স্থাপন করেছিল। ইসমাইলীরা আক্রমণকারীদের সাথে স¤প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করেছিল এবং একসময় পাশাপাশি বাস করত। ইসমাইলের বংশধরদের অগ্রসরমান প্রবাহের সামনে যুরহুম গোত্রের লোকেরা উপত্যকায় তাদের শক্তি হারাচ্ছিল এবং এক শতাব্দী পার হতে না হতেই হিজাজ ও তিহামা, ইব্রাহিমীয় আরবদের করতলগত হল।
এই সকল বংশ ছাড়াও এ অঞ্চলে তাসম, যাদিস ও অন্যান্য কিছু ক্ষুদ্র ক্ষদ্র গোত্র ছিল। তারা উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা রাখেনি।
আরাবুল মুস্তারিবা: ইবারের পুত্র কাহতান থেকে উদ্ভূত গোত্রসমূহ। তারা প্রধানতঃ ইয়েমেনে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। তাদের ক্রমঃবিকাশ একসময় ব্যাবিলনীয় নৃপতির আক্রমণে বিপর্যস্ত হলেও পরবর্তীতে তারা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল এবং ক্রমে হিজাজ, নজদ, ইরাক ও মেসোপটেমিয়ার মরুভূমিতে বিস্তৃত হয়েছিল। সেখানে তারা তাদের পূর্বসুরী কাহতানদের চ‚ড়ান্তভাবে আত্মসাৎ করেছিল। এই কাহতানের বংশধরেরা উত্তর-পূর্ব দিক হতে আরবে প্রবেশ করেছিল এবং দক্ষিণ দিক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এখানে তারা কিছুকালের জন্যে কুশ বংশের আ’দ গোত্রের সাথে তাদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের অধীনে বাস করেছিল এবং পরিশেষে নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। কাহতান বংশের লোকেরা শুধু দক্ষিণ আরবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের আবাস ছিল মেসোপটেমিয়াতেও। সেখান থেকে দক্ষিণাভিমুখে ইয়েমেনে গমনকালে তারা সমগ্র আরব উপদ্বীপ পরিভ্রমণ করেছিল এবং নিঃসন্দেহে তাদের যাত্রাপথের ধারে বসতির চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। ঐসময় আরব উপদ্বীপে যে জনপ্রবাহ চলেছিল তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবার বা হোবারের পুত্র কাহতান ও ইয়াকতান ভ্রাতৃদ্বয়। কাহতান পুত্র ইয়ারেব তার নামানুসারে তার বংশধরদের এবং সমগ্র দ্বীপটির নামকরণ করেছিলেন।
ইয়ারেবের পুত্র ইয়েশহাদ তার পিতার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তিনি রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী মা’রেবের প্রতিষ্ঠাতা এবং আব্দুস শামস ওরফে ‘সাবা’র পিতা। সাবার পরবর্তী বংশধর বিভিন্ন কাহতান গোত্রের পূর্বপুরুষ।
সাবা দুই পুত্র রেখে যানÑ হিমার ও কুহলান। হিমার তার পিতার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তার নামানুসারে সাবা রাজবংশ হিমাইরী বলে অভিহিত হয়। হিমার এবং তার ভ্রাতা কুহলানের বংশধরেরা পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। এই বংশেই জন্মেছিলেন জুলকারনাইন ও রানী বিলকিস (যিনি শলোমনের রাজত্বকালে জেরুজালেমে গিয়েছিলেন)।
আদি ইসমাইলীয় বসতির শুরু যখন ইব্রাহিম কলদীয়া থেকে নির্বাসিত হন এবং আরবে বসবাস আরম্ভ করেন। ব্যাবিলনের নৃপতি নেবু চাঁদ নেজ্জার কর্তৃক পর্যুদস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত যুরহুম গোত্রসমূহ, ইসমাইলের বংশধররা হিজাজে বিস্তারলাভ করেছিল ও সমৃদ্ধশালী হয়েছিল।
মক্কা নগরীর পত্তন আরব উপদ্বীপে ইব্রাহিমের বংশধরদের প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক। যুরহুম বংশের প্রধান মেগহাস-বিন-আমরের কন্যা সাঈদাকে মুস্তারিবা আরবদের প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইলের সাথে বিবাহ দেয়া হয়েছিল। এই ইসমাইল মক্কা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। প্রায় একই সময়ে কা’বাগৃহ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই কা’বাগৃহের জন্যেই মক্কা আরবের অন্যান্য নগরীর উপর প্রাধান্য বিস্তার করে।
গোত্রসমূহের বিশুদ্ধ পিতা ইব্রাহিম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কা’বাগৃহ জাতির সর্বাপেক্ষা পবিত্র এবাদতখানা হিসেবে সমাদৃত ছিল। এই পবিত্র গৃহে আকিক পাথরে নির্মিত তিন’শ ষাটটি মূর্তি; দু’টি গজল, স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত দ্রæতগামী মৃগ, ইব্রাহিম ও তদীয় পুত্রের প্রতিমূর্ত্তি শোভিত ছিল। এখানে প্রত্যেক বৎসর আদমের সময়ে স্বর্গ থেকে পতিত কাল পাথর ‘হজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করতে এবং নগ্ন অবস্থায় কা’বাগৃহ সাতবার প্রদক্ষিণ করতে বিভিন্ন গোত্রের লোক আগমন করত। এ কারণে মক্কা শুধু আরবদের ধর্মীয় যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল না, বাণিজ্যিক কর্মকাÐেরও কেন্দ্র ছিল।
মক্কা বাণিজ্যিক রাজপথে অধিষ্ঠিত হওয়ায় প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে সম্পদ ও সংস্কৃতি সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিল। অবস্থানের অপরিহার্যতার ফলে হিজাজের আরবরা বিশ্বের জাতি সমূহের পরিবাহক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
মক্কা বাণিজ্যিক কর্মকাÐের কেন্দ্র ছিল। ফলে প্রাচ্যের অন্যান্য জাতিসমূহ থেকে আরবরা সবসময়ে স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত হয়েছিল। মক্কা থেকে কারাভার যাত্রা শুরু হত। তারা ইয়েমেন ও ভারতের পণ্যসম্ভার বাইজান্টাইন রাজ্যসমূহ ও পারস্যে নিয়ে যেত এবং সিরিয়া থেকে পারস্যের সিল্ক ও অন্যান্য দ্রব্য আমদানী করত। বাণিজ্যিক দ্রব্য ছাড়াও অনেক কিছুই এই আমদানী তালিকায় থাকত। এসব কারাভার সাথে এসেছিল বিলাসী জীবনের অভ্যাস ও পাপ। সিরিয়া ও ইরাক থেকে আমদানীকৃত গ্রীক ও পারস্যিক দাসীরা তাদের নৃত্যগীতের মাধ্যমে ধনীদের অলস মূহুর্তগুলিকে আনন্দে ভরে দিত কিংবা তাদের পাপের ইন্ধন যোগাত। এসব জাতির ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে উদ্দীপ্ত করত, কেউই আগামী দিনের কথা ভাবত না।
আরবরা, বিশেষতঃ মক্কাবাসীরা মদ্যপান, জুয়া ও সঙ্গীতের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত ছিল। যে সকল দাসী-রমনী নৃত্যগীত করত তাদেরকে কীয়ান বলা হত। তারা ছিল চরম নীতিহীন। তথাপি তারা সর্বোচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত ছিল এবং বড় বড় দলপতিরা তাদের প্রতি প্রণয় নিবেদন করত। বহুবিবাহ অবাধে অনুশীলিত হত। মাতা ছাড়া অন্য বিধবা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হত এবং পুত্রের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে পর্যবসিত হত। নারী ও শিশু বিক্রয়ের মত নিষ্ঠুর ও অমানবিক ব্যবসা ছিল সার্বজনীন।
পরপর অ্যাসিরীয়, গ্রীক ও রোমকদের দ্বারা জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে ইহুদিরা আরবদের মধ্যে তাদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু তারা তাদের জন্মভূমি থেকে ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সংঘাতের সেই সুতীব্র মনোভাব বহন করে এনেছিল যা তাদের অধিকাংশ দুর্গতির মূলে ছিল।
যাহোক, তারা আরবে পর্যাপ্ত সংখ্যক লোককে ধর্মান্তরিত করতে সমর্থ হয়েছিল। মুহম্মদের সময়ে ইয়েমেনে কুহলানের পুত্র, হিমাইরার ও কিন্দার বংশধরদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ মূসার শরীয়ত পালন করত। খায়বর ও ইয়াসরিবে ইসমাইলী বংশোদ্ভূত বনি কুরাইজা ও বনি নাজির গোত্রও মূসার শরীয়ত পালন করত কিন্তু বহুপূর্ব থেকেই তারা আরবদের মত স্বদেশী হয়ে গিয়েছিল। নেস্তোরিয়ান ও জ্যাকোবাইট খ্রিষ্টানরাও আরবে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ঈসার শরীয়ত মেসোপটেমিয়ায় প্রতিষ্ঠিত তাগলিবাইত ও বাহরাইনে বসতি স্থাপনকারী বনি আব্দুল কায়েস গোত্রসমূহের বিভিন্ন শাখার মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল এবং নযরানেÑ বনি হারিস, বিন কাব- ইরাকে, বনি ইবাদ- সিরিয়ার গনাসাইড ও কতিপয় খুজাইত পরিবারে এবং দুমাতুল জান্দালে, সাকোনী- বনি কালেবদেরমধ্যে সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল। যে সমস্ত গোত্র প্যালেষ্টাইন ও মিসরের মধ্যবর্তী মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াত তাদের কিছুও ছিল ঈসার শরীয়তের অনুসারী।
মক্কা নগরী যোগাযোগ ও অবস্থান- উভয়দিক থেকে আরব জনপদসমূহের মধ্যে প্রভূত গুরুত্ব ও খ্যাতির অধিকারী ছিল। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত ঢালু উপত্যকার উপর অবস্থিত এই শহর পশ্চিমে পর্বতশ্রেণি ও পূর্বে উচ্চ গ্রানাইট পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। কেন্দ্রস্থলে প্রাঙ্গনমুখী গণমিলনায়তনসহ কা’বাগৃহ, নিয়মিত পাকা রাস্তাসমূহ, সুরক্ষিত গৃহসমূহ নিয়ে শহরটি সমৃদ্ধি ও শক্তির কেন্দ্র ছিল।
কা’বাগৃহের তত্ত¡াবধানের ভার মূলতঃ ইসমাইলের বংশধরদের উপর ন্যস্ত ছিল; বাবিলনীয়দের আক্রমণের ফলে তা যুরহুম গোত্রের লোকদের হাতে চলে যায় এবং তারা পার্থিব ও ধর্মীয় ক্ষমতার সমন্বয়ে মালিক উপাধি ধারণ করে।
কা‘বা গৃহের অভ্যন্তরে একটি গর্ত বা কূপ ছিল। এর নাম ছিল খাজিনা। কা‘বার হাদিয়া স্বরূপ যেসব মূল্যবান সামগ্রী আসত সেগুলি এই কূপে সংরক্ষিত রাখা হত। এতে দু‘টি স্বর্ণের হরিণ, তরবারী, বর্ম ও অন্যান্য বহুমূল্যবান অলঙ্কার সংরক্ষিত ছিল। যুরহুম গোত্রের এক প্রধানÑ ওমর বিন হারেস সংরক্ষিত মূল্যবান সম্পদ লুন্ঠিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সেগুলি কোন এক রাতের আঁধারে জমজম কূপের কাছে নিয়ে যান। জমজম কূপটি ঐসময় শুকিয়ে গিয়েছিল। ওমর কূপটি খনন করে সমস্ত সম্পদ সেখানে লুকিয়ে রাখেন।
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে যুরহুম গোত্রীয়রা বনি খোজা নামীয় একটি কাহতান গোত্রের দ্বারা পর্যুদস্ত হয়। এই বনি খোজারা ইয়েমেন থেকে বেরিয়ে মক্কা ও হিজাজের দক্ষিণাঞ্চলসমূহ অধিকার করে নিয়েছিল। ইতিমধ্যে ইসমাইলী বংশীয়রা যারা ব্যাবিলনীয় নৃপতিদের অধীনে ভয়ানকভাবে দুর্দশাগ্রস্থ হয়েছিল তারা ধীরে ধীরে তাদের পূর্বশক্তি ফিরিয়ে এনেছিল এবং হযরত ঈসার জন্মের প্রায় শতাব্দীকাল পূর্বে ইসমাইলের অন্যতম বংশধর আদনান ইসমাইলের মত যুরহুম বংশের এক প্রধানের কন্যাকে বিবাহ করে মক্কায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তার পুত্র মা’আদ হিজাজ ও নজদের ইসমাইল বংশোদ্ভূতদের যথার্থ আদিপুরুষ। মা’আদের এক বংশধর ফিহর, গোত্র নাম কুরাইশ তার আবির্ভাবকাল খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক। এই গোত্রই আরবকে দিয়েছিল তার প্রেরিত পুরুষ ও আইনবেত্তা, নবী মুহম্মদকে।
বনি খোজা গোত্র দু’শতাব্দীরও অধিক কা’বাগৃহ এবং কা’বাগৃহ তাদের যে প্রাধান্য দিয়েছিল তার অধিকার ভোগ করেছিল। শেষ খোজা গোত্রপ্রধান হোলাইলের মৃত্যুতে ফিহরের এক বংশধর কোসাই যিনি হোলাইলের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন, খোজাদেরকে মক্কার বাইরে তাড়িয়ে দিলেন এবং নিজেই নগরের পার্থিব ও ধর্মীয় সর্বময় ক্ষমতা দখল করলেন। এভাবে তিনি হিজাজের প্রকৃত শাসনকর্তা হলেন।
কোসাই ৩৯৮ সি.ই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতঃপর পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে মক্কা নগরীর অধিপতির আসনে সমাসীন হয়ে অবিলম্বে সুগঠিত ভিত্তির উপর নগরীর শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন।
কুরাইশরা কোসাইপূর্ব কালে কা’বাগৃহ থেকে যথেষ্ট দূরে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত। কা’বাগৃহের প্রতি তারা যে আত্মাস্তিক পবিত্রতা আরোপ করত তাই তাদেরকে তার সন্নিকটে বাসগৃহ নির্মাণে বাঁধা দিত। অরক্ষিত অবস্থায় জাতীয় উপাসনালয় বিপদের সম্মুখীনÑ এই সত্য অনুধাবন করে কোসাই তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণের জন্যে চারিদিকে পর্যাপ্ত খালি জায়গা রেখে দিয়ে কা’বাকে বেষ্টন করে কুরাইশদেরকে ঘরবাড়ি নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করলেন। যে সব পরিবারের মধ্যে জমি বন্টন করা হয়েছিল তারা সুরক্ষিত গৃহ নির্মাণ করল। কোসাই নিজের জন্যেও একটা প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রাসাদের মূল প্রবেশদ্বার দরজা কা’বাগৃহের প্রাঙ্গনে ছিল। এই প্রাসাদে পরামর্শসভা অনুষ্ঠিত হতÑ কোসাইয়ের সভাপতিত্বে সরকারী কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। এই সভায় কোসাইয়ের বংশধর ছাড়া চল্লিশ বৎসরের কম বয়সের কোন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করতে পারত না।
কোসাই নিজে ধর্মীয়, বেসামরিক ও রাজনৈতিক কার্যাবলী পরিচালনা করতেন। তার প্রতিপত্তি কুরাইশ বংশের গৌরব বৃদ্ধি করেছিল এবং তার সময় থেকেই ইসমাইলের বংশধরদের মধ্যে কুরাইশরা উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব অর্জন করেছিল।
কোসাই ৪৮০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে মৃত্যুবরণ করলে তার জৈষ্ঠ্যপুত্র আব্দুদ্দার উত্তরাধিকারী হলেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র ও ভ্রাতুস্পুত্রের মধ্যে বিরোধ শুরু হল। আপোষ মিমাংসায় ভ্রাতা আব্দুস মান্নাফের পুত্র, আব্দুস শামসের উপর সিকায়া ও রিফাদার ভার ন্যস্ত হয়। আব্দুস মান্নাফের শামস, হাশিম, নত্তফেল ও মুত্তালিব এই চার পুত্র ছিলেন। আব্দুস শামস তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ছিলেন। তাই তিনি তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব গোত্রের মধ্যে প্রতিপত্তিশীল ও ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তি তার ভ্রাতা হাশিমের উপর ন্যস্ত করেছিলেন।
অধিকাংশ মক্কাবাসীদের মত হাশিমও বাণিজ্য করতেন। তিনি নিয়মিতভাবে মক্কা থেকে দু’টি বাণিজ্য দল পাঠাতেন। একটি শীতকালে ইয়েমেনে, অন্যটি গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায়। একবার ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমনকালে হাশিম ইয়াসরিবের বনি নাজ্জার গোত্রের সালমা নাম্নী জনৈকা নারীর পাণি গ্রহণ করেন। কিছুকাল পর সিরিয়ায় এক বাণিজ্য অভিযানকালে তিনি গাজা শহরে (৫১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে) মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ইয়াসরিববাসী স্ত্রী সালমার গর্ভজাত একমাত্র পুত্র শায়বাকে রেখে যান। তার মৃত্যুতে তার পুত্রের খবর তার ভ্রাতাদের কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়। এদিকে তার মৃত্যুতে রিফাদা ও সিকায়া তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা মুত্তালিবের উপর ন্যস্ত হয়। দীর্ঘ আট বৎসর পর মুত্তালিব ভ্রাতুষ্পুত্রের সংবাদ পেযে শ্বেতকেশ বিশিষ্ট যুবক শায়বাকে ইয়াসরিব থেকে মক্কায় নিযে আসেন। শায়বাকে মুত্তালিবের দাস মনে করে মক্কাবাসীরা তাকে ‘আব্দুল মুত্তালিব’ বলত। এই আব্দুল মুত্তালিবই নবী মুহম্মদের পিতামহ।
মুত্তালিব ৫২০ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে ইযেমেনের কাজওয়ানে মৃত্যুবরণ করলে আব্দুল মুত্তালিব তার উত্তরাধিকার লাভ করেন। এসময় মক্কার শাসনভার কোসাই পরিবারের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের নিয়ে গঠিত পরিষদের উপর ন্যস্ত ছিল। আমিনা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন।
আব্দুল মুত্তালিব দশটি পুত্র ও ছয়টি কন্যাসন্তান লাভ করেছিলেন। হারিস ছিলেন জৈষ্ঠ্য পুত্র। অন্যান্যরা হলেন আবু লাহাব (আব্দুল উজ্জা), আবু তালিব (আব্দুল মান্নাফ), আমরের কন্যা ফাতিমার গর্ভজাত পুত্ররা হলেন জোবায়েুর ও আব্দুল্লাহ এবং কন্যারা হলেন আত্তিকা ও মায়মা, আরওয়া, বার্রা ও বায়জা। নুতাইলার গর্ভজাত পুত্ররা হলেন ধিরার ও আব্বাস। হালার গর্ভজাত পুত্ররা হলেন মুকাইন, গায়জাক, হামজা ও কন্যা সফিয়া। আব্দুল মুত্তালিবের অন্য দু’টি পুত্র অজ্ঞাতনামা, সম্ভবতঃ তারা কোন সন্তান রেখে যাননি।
জুহরী পরিবারের প্রধান ওয়াহাবের কন্যা আমিনার সাথে আব্দুল¬াহর বিবাহ হয়েছিল। বিবাহের পর প্রথা অনুযায়ী আব্দুল¬াহ তিন দিন শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এলেন। এসময় তার বয়স ছিল সতের বৎসর। তার বিবাহের পরবর্তী বৎসর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের সমাবেশে পরিপূর্ণ। বৎসরের শুরুতেই ইয়েমেনের শাসক আবরাহা আল-আশরাম কা’বাগৃহ ধ্বংস করার জন্যে জাঁকজমকের সাথে একটি সুসজ্জিত হস্তী পৃষ্ঠে সমাসীন হয়ে এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কার অদূরে চলে এলেন।
এই ঘটনার অল্পকাল পরে মুহম্মদ মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সমযে আব্দুল্লাহ ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেছিলেন। ফেরার পথে তিনি মদিনায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। পিতা আব্দুল মুত্তালিব তার অসুখের কথা শুনে পুত্র হারিসকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। হারিস মদিনায় গিয়ে জানতে পারেন তিনি মারা গিয়েছেন। এরপর তাকে মুহম্মদের মামা আদি পুত্রদের অধিকৃত অঞ্চলে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। মৃত্যুর সময় আব্দুল্লাহ একটি উট, একপাল মেষ ও উম্মে আয়মন নাম্নী এক দাসী রেখে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে নবী মুহম্মদ এগুলির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন।
আব্দুল্লাহর মৃত্যুর অল্পকিছুদিন পরে তার স্ত্রী আমিনা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। তার নাম রাখা হয় মুহম্মদ। হস্তী বৎসরের ৯ই রবিউল আওয়াল, সোমবার, আবিসিনীয় সৈন্যবাহিনী ধ্বংসের পঞ্চাশ দিনের কিছু পরে, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ শে এপ্রিল তারিখে সুবেহ সাদিকের অব্যবহিত পরে নবী মুহম্মদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর এভাবেই কবুল হল ইব্রাহিমের এই প্রার্থনা-“আর যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল (কা’বা) গৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল, তখন তারা বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাদের এ কাজ গ্রহণ কর। তুমি তো সব শোন আর সব জান।
হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাদের দু‘জনকে তোমার একান্ত অনুগত কর ও আমাদের বংশধর হতে তোমার অনুগত এক উম্মত (সমাজ) তৈরী কর। আমাদেরকে উপাসনার নিয়ম পদ্ধতি দেখিয়ে দাও, আর আমাদের প্রতি ক্ষমাপরবশ হও! তুমি তো অত্যন্ত ক্ষমাপরবশ পরম দয়ালু।
হে আমার প্রতিপালক! তাদের মধ্যে থেকে তাদের কাছে ”একজন” রসূল প্রেরণ কোরও যে তোমার আয়াত তাদের কাছে আবৃত্তি করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি তো পরাক্রমশালী, তত্ত¡জ্ঞানী। (২:১২৭-২৯)
ইব্রাহিম ও ইসমাইলের বংশে প্রথম ও শেষবারের মত একজন নবীর আগমন হল। ঈসা হলেন ‘মসিহ’ কেবল ইহুদি গোত্রের জন্য, আর মুহম্মদ ’মসিহ’ জগৎবাসীর জন্যে। আর তাই কোরআনে বলা হয়েছে তিনি জগৎবাসীর জন্যে মূর্ত্ত্য করুণা স্বরূপ- ‘‘এবং আমি তাকে নিখিল বিশ্বের জন্যে মূর্ত্তিমান করুণাস্বরূপ পঠিয়েছি।” (২১:১০৭)
Comments
Post a Comment