একটা সময় ছিল, ওই আশির দশকে,যখন শঙ্খ ঘোষ আমাদের অধিকার করে নিচ্ছেন ক্রমশ, আর আমরা সেই টানের স্বরূপ বুঝে নিতে চাইছি নানা কায়দায়। সেই সময় আমি যেখানে থাকতাম, তার আশেপাশে কবিতা নিয়ে চর্চার ধরনটা ছিল শঙ্খ ঘোষের কবিতার যে ধরন, তার উলটো। এখানে কথা উঠবে, শঙ্খ ঘোষের কবিতার ধরনটা কেমন, আর তার উলটো ধরন বলতেই বা কী বোঝায়। এভাবে সোজা বা উলটো করে লেখালেখির কোনো ধরনকে ধরা যায় নাকি?
এই দুটো সমস্যা নিয়ে একটু খেলতে পারলেই একটা লেখা গুছোনা হয়ে যায়।
প্রথম কথা, শঙ্খ ঘোষের, শুধু শঙ্খ ঘোষ কেন, কোনো লেখকেরই কবিতাভাষাকে কোনো একবগগা ধরনে চেনানো যায় না। বাংলা কবিতায় শঙ্খ ঘোষের একটা জায়গা ঠিক হয়ে গেছে। শঙ্খ ঘোষের কবিতার পাতা উলটে যেতে যেতে টের পাওয়া যায় সময় তার সব রহস্য আর সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর কবিতায় নানা গমকে উঠে আসতে চেয়েছে।
এই গমকটা খুব বড়ো ব্যাপার। কে কীভাবে কথা বলবেন কবিতায়, তার মাত্রা বা বহরের ওপর নির্ভর করে তাঁর কবিতা কাকে, কতটা, কতদিন ছুঁতে পারবে। এমনিতে এখন বিশ্বমুহূর্তের আওতায় আমরা, যে-কেউ, যে-কোনো লেখকের কবিতা যে-কোনো সময়ে পড়ে ফেলতে পারি। ফলে মহাকালের ধারণাটা আগে যতটা ঘোরালো ছিল, এখন তা আরো গুলিয়ে গেছে। এত তাজা কবিতা, ঝকঝকে কবিতা, কাঁটা-লতাভর্তি কবিতা নানা জায়গায় পড়া যাচ্ছে যে, সময়ের এক বিশ্বভাষায় আমরা কথা বলছি মনে হচ্ছে। এই অবস্থায়, নিজের উচ্চারণের ধরণটা আলাদা করে না নিতে পারলে মনে হয় যেন কিছুই করা হল না। যে-কথা বলছি, তা যে ইহজগতে কেউ কোনোদিন বলেনি, তা তো নয়, সবকিছুই প্রায় বলা হয়ে গেছে। শুধু ধরনটা আলাদা। আর এই আলাদা ধরনের জন্যই বলাটাও আলাদা হয়ে যায়। মনে হয়।
শঙ্খ ঘোষ বারবার এই ধরনটা পালটে পালটে নিজের ভাষাটাকে সক্ষম করে রাখতে চেয়েছেন। বারবার। আমি এখন যে-দুটি বইয়ে কবিতা নিয়ে আলোচনা করব, তার পাতায় পাতায় এই প্রবণতা ছড়ানো।
আমার সামনে দিয়ে যারা যায়, আমার পাশ দিয়ে যারা যায়
সবাইকে বলি: মনে রেখো
মনে রেখো একজন শারীরিক খঞ্জ হয়ে
ফিরে গিয়েছিলো এই পথে
বালকের মতো তার ঘর ছিলো বিষণেœর
দুপুর আকাশে ছন্নছাড়া
চোখে তার জল নয়, বুকের পিছনে দিঘি
ভাঙা বাড়ি প্রাচীর আড়াল
শতাব্দীর ঝুরিনামা গাছের নিবিড়ে এই
ব্যবহারহীন জল থেকে
খুব সচেতনভাবে পংক্তি বিন্যাসের এই অভিনব ধরন এখানে ব্যবহার করেছেন শঙ্খ ঘোষ। এখানে একটা কথা বলার আছে। এই বিন্যাসটা কি কবিতার পক্ষে, কবিতার কথার ঝন্য খুব জরুরি? এর উত্তরে দুটো কথা বলা যায়। প্রথম কথা, জরুরি যদি নাও হয়, তাহলেও বিন্যাস নিয়ে এই ধরনের নানা নিরীক্ষা করার হক কবির আছে। প্রাণের দায়ে এই কাজটা তাকে করতে হয়। অনেক সময় এমন হয় যে, এই আলাদা হবার তাড়ানায় একটা ধরন তিনি অন্তর্গত করে নিতে পারেন, আর তখনি তার ভেতরে ভেতরে অর্থময়তার সঞ্চার হয়।
দ্বিতীয় কথা হল, অনেক সময় বলার টানেই ধরণ আপনি ধরা দেয়। এই কবিতায় যেমন, আমার মনে হয়েছে, এই দ্বিতীয় যুক্তিটি কাজ করেছে। আবার এটা আমার মনে হয়েছে ‘মনে রেখো’-এই কথাটি পড়ে। ‘সবাইকে বলি: মনে রেখো’- এই উচ্চারণটি কবির অভিপ্রায় ছিল, আর ছিল বলেই তা পুরো কবিতার আকারটিকেও নিধর্রিত করে দিয়েছে। কবিতার শেষে ‘মনে রেখো’ কথাটি যেভাবে ফিরে আসে, তা এই ধরনটিকে সফলতার আলোয় ছুঁয়ে যায়।
ঠিক একই কথা বলা যায় ‘শরীর’, কবিতা সম্পর্কেও। একদম একই কথা-
শরীরের মধ্যে কি একটা ঘটছে, ডাক্তার
ঠিক জানি না
কীভাবে বলতে হয় তার নাম
আয়নার সামনে বসলে ভারী হয়ে আসে চোখ
পেশির মধ্যে ব্যথা
ভিতর থেকে ফুটে বেরোয় হলুদ রঙের আলো
কিন্তু সে তো গোধূলির আভা, রক্তে কি
গোধূলি দেখা যায়?
রক্তে কি গোধূলি দেখা যায়? যাওয়া ভালো?
শরীরের মধ্যে কিচু একটা ঘটে যাচ্ছে ডাক্তার
জানি না তার নাম
এখানেও দুটি পংক্তির গঠনে একটা অভিনবত্ব আছে। শেষ দুটো লাইন বাদ দিলে পুরো কবিতাটা একই গঠনে লেখা। আর এখানেও, ‘ঠিন জানি না’ এই কথাটি পুরো কবিতাটির আকার ঠিক করে দিয়েছে।
এই ধরনটি অভিনবত্বের শীর্ষ ছুঁয়েছে ‘খরা কবিতায়।
সব নদী নালা পুকুর শুকিয়ে গিয়েছে
জল ভরতে এসেছিল যারা
তারা
পাতাহারা গাছ
সামনে ঝলমল করছে বালি
এইখানে শেষ নয়,এই সবে শুরু।
তারপর
বালি তুলে বালি তুলে বালি তুলে বালি
বিশ্বসংসার এ-রকম খালি
আর কখনো মনে হয়নি আগে
কবিতাটির প্রথম স্তবকের দ্বিতীয়-তৃতীয় পংক্তিতে অন্ত্যমিল আছে। এমনিতে এর মধ্যে কোনো অতিরিক্ত সঞ্চার নেই। তারপর, দ্বিতীয় স্তবকের তৃতীয় চতুর্থ লাইনের মিলটা লক্ষ করুন। পুররুক্তির সচেতন অর্থহীনতাকে কবি এখানে বাজিয়ে তুলতে চেয়েছন। আর তা বেজে উঠে, পরের লাএনই ‘খালি’র সঙ্গে মিল নিয়ে নিঃসঙ্গতাকে ধ্বনির অনুষঙ্গ দিয়ে দিল।
নেতিবাচকতাকে এভাবেই ধ্বনির সমর্থনে, শব্দের সমার্থক সৌজন্যে ‘না’ কবিতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন শঙ্খ ঘোষ। একই ভাবে-
এর কোনো মানে নেই। একদিনের পর দু-দিন পর তিনদিন
কিন্তু তারপর কী?
এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান
তুমি বলেছিলে ঘর হবে, ঘর হলো
তারপর কী?
তুমি বলেছিলে ¯েœহ হবে, ¯েœহ হলো
তারপর?
কতদূরে নিতে পারে ¯েœহ? অন্ধকারও আমাকে সন্দেহ
করেনি কখনো
বুকে বসে আছে তার বড়ো প্রতিস্পর্ধী কোনো!
না-এর পর না, না-এর পর না, না-এর পর না
তারপর কী?
পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা
তারপর?
আবার এই কবিতাতে, আগের কবিতায় ধরনে অন্ত্যমিল নয়, বাক্যের অন্তর্গত মিলে অর্থহীনতাকে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় লাইনে, ‘দু-জন’ টলে গেল ‘দুর্জন’-এ, পরে, ‘¯েœহ’ বিষিয়ে গেল ‘সন্দেহ’তে। এইরকম পরতে পরতে মনোযোগ নিয়ে লেখা কত কবিতা যে শঙ্খ ঘোষ-এর আছে।
একই শব্দ দুবার ব্যবহার করে তিনি অতিরিক্ত কোনো ইশারা দিতে চান।‘সারি সারি উট আর উটের চোখের নীচ জল’-এখানে ‘উট’ দুবার না এলে চলত এটা মনে হতেও পারে। কিন্তু এই যে অতিরেক, বিবৃতির টান, এটাই কবির লক্ষ্য ছিল, বলার পাশ দিয়ে পাশ দিয়ে বয়ে যায় অর্থের দ্বিতীয় স্তর।
আসলে, কিছুই তো নিশ্চিত নয়, স্পষ্ট নয়। উদ্দেশ্যহীনতা আর বিভ্রান্তি আমাদের বিমূঢ় করে রাখে। নিছক সরলরেখায় তো চলেনা আমাদের জীবন। ‘সন্ততি’ কবিতায় দুলাইন জুড়ে শুধু প্রশ্নের তাড়না-
এ কি মৃত্যু? এ কি বিচ্ছেদ? না কি মিলনেরই অপার বিস্তার?
এ কি মুহূর্ত? এ কি অনন্ত? না কি এরই নাম সন্তত জীবন?
এই বিরতিহীন প্রশ্নের ধরনটি ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ বইটির ‘চড়–ইটি কীভাবে মরেছিল’ কবিতাতেও আছে-
প্রথর? কত প্রহর হলো? এখনও কি দিন হয়নি?
আলোর পথ কোথায়?
টেবিল থেকে চেয়ারে আর চেয়ার থেকে গ্রিলের ওপর
স্বাধীনতার শেষ?
আকাশ থেকে ছিঁড়ে আমার ঘরের মধ্যে আকাশ দিয়ে
কোথায় গেছে ওরা?
গলার কাছে শুকনো লাগে, বুকের কাছে শূন্য লাগে, ভুল করে কি একটা দানাও রেখে যায়নি ফেলে?
শঙ্খ ঘোষ আরেকটি ধরনে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে আছেন। এটা যে বাংলা কবিতায় আগে একেবারে হয়নি তা নয়। প্রতিদিনের কথাকে কবিতায় প্রায় উদ্ধৃতির মতো করে ব্যবহার সফল হতে পেরেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়-ও। দু’জনের-ই কথায় আছে ব্যঙ্গের ধার, কখনো কৌতুকের ইশারায়। দু’জনের-ই চোখ মূলত সমাজের খর চলাচলের দিকে। তফাত তবু তো আছেই। দু’জনেই ধরনে এত মিল সত্ত্বেও দু’জনেই প্রখরভাবে আলাদা। একবার পড়েই চেনা যায় কোনটা কার লেখা। শঙ্খ ঘোষের লেখায় হয়তো ব্যঙ্গের চেয়ে করুণা বেশি, বা হয়তো সুভাষ যতটা সরাসরি সামনে তাকান, শঙ্খ ততটা না তাকিয়ে আরেকটু আড়ালে রেখে দিতে ভালোবাসেন তাঁর লক্ষ্য। ‘সাদাকালো’ কবিতাটা পড়–ন-
পথের ওই খুনখুনে বুড়ো
যখন এগিয়ে এসে বলে ‘আমি চাই।
দেবেন না? না দিয়ে
কাকে ঠকাচ্ছে মশাই?’
আর চারদিক থেকে ভদ্রলোকেরা;
‘সাবধান, সরে যান
লোকটা নির্ঘাৎ টেনে এসেছে
কয়েক পাইট’
তখন আমার সামনে কেঁপে দাঁড়ায়
ওয়াশিংটনের আরেক মস্ত বুড়ো
থুত্থুরে
ছেঁড়া বুকে ঢিল খেতে
তবু যে আঙুল তুলে বলেছিল ‘শোনো
আই অ্যাম ব্ল্যাক
বাট মাই ওয়াইফ ইজ হোয়াইট!’
টেনে এসেছে/কয়েক পাইট’-এই জায়াগাটুকু বাদ দিলে পুরো কবিতায় ব্যঙ্গ যতটা খরশান হয়ে উঠতে পারতো ততটা কিন্তু হয়নি। অথচ তার সম্ভাবনা ছিল ষোলো আনা। বিশেষ করে শেষ কথাটিকে আরো টেনে নেবার ঝোঁক কবি টের পাননি, আমার তা মনে হয় না। কিন্তু তিনি যে থেমে গেলেন, এতেই, কবিতাটির বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়ে গেল।
‘হাসপাতাল’ কবিতাটিও এখানে পড়া যেতে পারে-
নার্স ১ ঘুমোতে পারি না, প্রতি হাড়ের ভিতরে জমে ঘুণ
পা থেকে মাথায় ওঠে অশালীন বীজানুবিস্তার
ঘূর্ণমান ডাক দিই: কে কোথায়, সিস্টার সিস্টার-
‘হয়েছে কী? চুপ করে নিরিবিলি ঘুমিয়ে থাকুন।
তাছাড়া নিয়মমতো খেয়ে যান ফলের নির্যাস-’
সাদাঝুঁটি লাল বেল্ট খুট খুট ফিরে নার্স।
নার্স ২ রাত দুটো। চুপিচুপি দুটি মেয়ে ঢুকে দেখে পাশের কেবিনে
¤্রমিমাণ যুবাটির আরো কিছু মরা হলো কি না।
‘এখনও ততটা নয়’ ঠোঁট টিপে এ ওকে জানায়।
‘তবে কি ঘুমোচ্ছে? না কি জ্ঞানহীন? ডাক্তার দরকার?’
‘থাক বাপু’-ফিনফিনে ফিঙে দুটি ফিরে চলে যায়
‘আমরা কী করতে পারি! যার যার ঈশ্বর সহায়।’
অসুখী মানুষটির আর্তির উত্তরে নার্সদের প্রথম কথার মধ্যে, প্রায় প্রত্যেকটি শব্দে, নানা স্তর আছে। ‘নিরিবিলি’ ঘুমিয়ে থাকা, ‘নিয়মমতো’ ফলের নির্যাস খাওয়ার নির্দেশ-এর মানে বুঝতে অসুবিধে হয় না। কবিতাটির সবচেয়ে মোক্ষম যে হত্যাকান্ড ‘¤্রয়িমাণ যুবাটির আরো কিছু মরা হলো কি না’ জানার উৎকণ্ঠা, নার্সদের স্বাভাবিক উদাসীন তা আরো নির্মম হয়ে উঠেছে।
‘বাবুমশাই’ কবিতাটি, নাম কবিতাটির সঙ্গে এই বইয়ের ঘরানা চিনিয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে ধরিয়ে দিচ্ছে শঙ্খ ঘোষের ঘোষিত ধরনটিও। এই লেখার শুরুতে যে বলেছিলাম নিজেকে প্রাণের দায়ে আলাদা করে নিতে নানা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতেই হয় কবিকে, তার একটা বড়ো নমুনা এই ‘বাবুমশাই’ কবিতাটি। এই ধরনটির মধ্যেই যে প্রকাশ্য অভিনবত্ব আছে, তা ভেতরের কথাটিকেও ধরে নিয়েছে। শুরুতেই কবিতাটি সম্পর্কে কবি লিখে দেন: আশা করি সকলেই বুঝবেন যে এই ধরনের রচনা পড়বার বিশেষ একটা সুর আছে!’ ‘সুর’ কথাটি খেয়াল করবার মতো। কবি সুরকে মেনে নিয়েছেন এই কবিতায়। সুর আর শব্দের যে-স্বাভাবিক বিচ্ছেদ বজায় রেখে কবিতা লিখতে হয়, এখানে তা অস্বীকার করা হয়েছে।
করা হয়েছে, কারণ এভাবেও যদি বলার কথাটা বাজিয়ে দেওয়া যায়-এই ভাবনা কবিকে এখানে আক্রমণ করেছিল। কবিতাটি পড়ে বোঝা যায়, সেই টান কবি সফলভাবে সামলে নিতে পেরেছেন। ধরনটির মধ্যে যে-উগ্রতা আছে; তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলার কথাটা অক্ষুণœ রাখার জন্য ঘোরতর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাঁকে। ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন নিশ্চয়। কিন্তু সেই সংগ্রামের কোনো চিহ্ন কবিতাটিতে নেই, এখানেই লেখাটির সাফল্য।
কথা বলার একবগগা ধরনটিই যে শেষের আগের দুটি লাইনের ঐতিহাসিক উচ্চারণে পৌঁছে দিয়েছে কবিতাটিকে, এটাও কবিতাটি পড়লে বোঝা যায়।
ভঙ্গির এই প্রকাশ্য মুখরতা আছে ‘লজ্জা’ কবিতাতেও। সেখানেও বলার ধরনটি-ই টেনে নিয়ে গেছে কথাকে। আর সেখানেও, শেষপর্যন্ত, রাশ ধরে রাখতে পেরেছেন বলেই কবিতার শেষ হয় সংযত একটি প্রশ্নের সম্ভাবনায়।
বলেছিলাম, এই কবিতাটি এবং ‘মুর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ শঙ্খ ঘোষের প্রবণতা সবচেয়ে জোরালোভাবে চিনিয়ে দিয়েছে। সেই স্বভাবটি কী” এভাবে সরাসরি বোঝানো খুব মুশকিল। তবে বলা যায়, আরেকটা কলকাতাকে খোঁজে, আবার, একই সঙ্গে চুপ করে নীলকুঠুরিতে বসে থাকা। এমনভাবে লিখলাম যেন মনে মনে হচ্ছে এই দুটি প্রবণতা পরস্পরের বিপরীত। তা তো নয়। আসলে যে নিজস্বতার কথা বলছিলাম, তা অর্জনের কথাই ‘মুর্খ বড়ো, সামাজিক নয়, সামাজিক নয়’ কবিতায় ব্যঙ্গার্থে ধরা পড়ছে। এই নিজস্ব সামর্থ্যেই দিনের রাতের মাথায় যে খুন ঝরছে, তার কথা লিখ রাখতে চান কবি। বইটির রচনাকাল যে সত্তর দশক, এই তথ্যটি এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায়।
‘যদি’ কবিতায় এই কথাটিই যেন অন্যভাবে বলে দিয়েছেন কবি-
প্রতিটি মুখের থেকে যদি সব বিচ্ছেদের হেমন্তহলুদ পাতা
ঝরে যায়
হাত পেতে বলে যদি, এসো ওই আল ধরে
চলে যাই সেচনের দেশে
যদি মাটি ফুলে ওঠে আর সব খরা ভেঙে
ছুটে আসে বিদ্যুতের টান-
হতে পারে, সব হতে পারে যদি এই মহামৃত্তিকায় আমার মুখের দিকে
ঝুঁকে থাকো আকাশের মতো
মাটির দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ-এটা ছবি হিসেবে খুব অভিনব কিছু নয়। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের কবিতার ধরন বোঝার জন্য এই পংক্তিটি জরুরি। একটু আগেই যে বলা হলো চুপ করে নীলকুঠুরিতে বসে থাকার কথা, সেখানে বসেই লোকে যাকে সামাজিক বলে তার উল্টোদিক থেকে আরেকটা কলকাতার খোঁজ পাবার কথা, এখানে তো তাই বলা হলো। নিজস্বতার, নিজের ভেতরের দিকে তাকিয়ে থাকার সামর্থ্যে ভর দিয়েই ‘সব হতে পারে।’
‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, কবিতার বলার কথাও তো তাই। ‘একলা হয়ে’ গলির কোণে’ দাঁড়িয়েই তো অপেক্ষা থাকে ‘তোমার জন্য’। জৌলুসে, বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে সেই ব্যক্তিগত অপেক্ষার সমাধি ঘটে যায়।
একমাত্রিক সুন্দরের দিকে হাত জোড় করে বসে থাকা শঙ্খ ঘোষের স্বভাব নয়। যে-কোনো দৃশ্যের সাধারণ স্তর থেকে তিনি স্তরান্তরে চলে যেতে পারেন। কারণ তিনি দেখেছেন ‘ভাঙা ডানা পড়ে থাকে রাজপথে, গুহামুখে, চরে।’ সম্ভাবনার সমুদ্র থেকে কোনো আসক্ত হাওয়া উঠে আসছে না, তবু, এই ‘নাগিনীপিচ্ছিল অন্ধকারে’ও তিনি বলতে পারেন-
তারও মাঝখানে আমি স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন দেখি
দেখি ওরা হেঁটে যায় পৃথিবী সুন্দরতর করে
নক্ষত্রবিলাসে নয়, দিনানুদিনের আলপথে
আর যতদূর যায় ধানে ভরে যায় ততদূর।
তাঁকে তো কেউ দায়িত্ব দেয়নি তবু যেহেতু তিনি জানেন, ‘চম্পকনগরে আজ কানীর চক্রান্ত চারিদিকে’ তাই,
আমি শুধু এইখানে প্রহরীর মতো জেগে দেখি
যেন না ওদের গায়ে কোনো নাগিনীর শ্বাস লাগে
যেন কোন ঘুম, কোন কালঘুম মায়াঘুম এসে
শিয়র না ছুঁতে পারে আজ এই নিশীথনগরে
এখানে একটা ব্যক্তিগত কথা বলি। আমার মনে স্বদেশ নিয়ে কোন আবেগ নেই। ভারতবর্ষের জন্য আমি আলাদা কোনো উদ্দীপনা টের পাই না। বাংলার কেউ না খেললে আমি ক্রিকেট দেখি না। এর নানা সামাজিক ঐতিহাসিক কারণ তো আছেই, সে অন্য প্রসঙ্গ।
দেশ আমাদের আজও কোনো
দেশ আমাদের আজও কোনো
দেশ আমাদের আজও কোনো মাতৃভাষা দেয়নি এখনও
শঙ্খ ঘোষের এই কথা আমি আমার মতো করে পড়ি। কবিতাটিতে কথাগুলো বলা হয়েছে অন্যসূত্রে। এখানেও শেষ তিন লাইনের বলার ক্রম খেয়াল করার মতো। আক্ষেপ, অসহায়তা আর ক্ষোভ কথাটিকে প্রথমে সংহত রেখে তারপর সম্পূর্ণ করল। ‘ভিখিরির আবার পছন্দ’ কবিতাটি পড়তে পড়তে ‘বাবুমশাই’ কবিতার স্বর চের পাওয়া যায়। পুনরুক্তি, ভ্যঙ্গ আর সামাজিকভাবে বাতিল মানুষজনের কোণ থেকে দেখার ভঙ্গি এই দুটি কবিতাকে মিলিয়ে দিয়েছে।
এই দুটো সমস্যা নিয়ে একটু খেলতে পারলেই একটা লেখা গুছোনা হয়ে যায়।
প্রথম কথা, শঙ্খ ঘোষের, শুধু শঙ্খ ঘোষ কেন, কোনো লেখকেরই কবিতাভাষাকে কোনো একবগগা ধরনে চেনানো যায় না। বাংলা কবিতায় শঙ্খ ঘোষের একটা জায়গা ঠিক হয়ে গেছে। শঙ্খ ঘোষের কবিতার পাতা উলটে যেতে যেতে টের পাওয়া যায় সময় তার সব রহস্য আর সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর কবিতায় নানা গমকে উঠে আসতে চেয়েছে।
এই গমকটা খুব বড়ো ব্যাপার। কে কীভাবে কথা বলবেন কবিতায়, তার মাত্রা বা বহরের ওপর নির্ভর করে তাঁর কবিতা কাকে, কতটা, কতদিন ছুঁতে পারবে। এমনিতে এখন বিশ্বমুহূর্তের আওতায় আমরা, যে-কেউ, যে-কোনো লেখকের কবিতা যে-কোনো সময়ে পড়ে ফেলতে পারি। ফলে মহাকালের ধারণাটা আগে যতটা ঘোরালো ছিল, এখন তা আরো গুলিয়ে গেছে। এত তাজা কবিতা, ঝকঝকে কবিতা, কাঁটা-লতাভর্তি কবিতা নানা জায়গায় পড়া যাচ্ছে যে, সময়ের এক বিশ্বভাষায় আমরা কথা বলছি মনে হচ্ছে। এই অবস্থায়, নিজের উচ্চারণের ধরণটা আলাদা করে না নিতে পারলে মনে হয় যেন কিছুই করা হল না। যে-কথা বলছি, তা যে ইহজগতে কেউ কোনোদিন বলেনি, তা তো নয়, সবকিছুই প্রায় বলা হয়ে গেছে। শুধু ধরনটা আলাদা। আর এই আলাদা ধরনের জন্যই বলাটাও আলাদা হয়ে যায়। মনে হয়।
শঙ্খ ঘোষ বারবার এই ধরনটা পালটে পালটে নিজের ভাষাটাকে সক্ষম করে রাখতে চেয়েছেন। বারবার। আমি এখন যে-দুটি বইয়ে কবিতা নিয়ে আলোচনা করব, তার পাতায় পাতায় এই প্রবণতা ছড়ানো।
আমার সামনে দিয়ে যারা যায়, আমার পাশ দিয়ে যারা যায়
সবাইকে বলি: মনে রেখো
মনে রেখো একজন শারীরিক খঞ্জ হয়ে
ফিরে গিয়েছিলো এই পথে
বালকের মতো তার ঘর ছিলো বিষণেœর
দুপুর আকাশে ছন্নছাড়া
চোখে তার জল নয়, বুকের পিছনে দিঘি
ভাঙা বাড়ি প্রাচীর আড়াল
শতাব্দীর ঝুরিনামা গাছের নিবিড়ে এই
ব্যবহারহীন জল থেকে
খুব সচেতনভাবে পংক্তি বিন্যাসের এই অভিনব ধরন এখানে ব্যবহার করেছেন শঙ্খ ঘোষ। এখানে একটা কথা বলার আছে। এই বিন্যাসটা কি কবিতার পক্ষে, কবিতার কথার ঝন্য খুব জরুরি? এর উত্তরে দুটো কথা বলা যায়। প্রথম কথা, জরুরি যদি নাও হয়, তাহলেও বিন্যাস নিয়ে এই ধরনের নানা নিরীক্ষা করার হক কবির আছে। প্রাণের দায়ে এই কাজটা তাকে করতে হয়। অনেক সময় এমন হয় যে, এই আলাদা হবার তাড়ানায় একটা ধরন তিনি অন্তর্গত করে নিতে পারেন, আর তখনি তার ভেতরে ভেতরে অর্থময়তার সঞ্চার হয়।
দ্বিতীয় কথা হল, অনেক সময় বলার টানেই ধরণ আপনি ধরা দেয়। এই কবিতায় যেমন, আমার মনে হয়েছে, এই দ্বিতীয় যুক্তিটি কাজ করেছে। আবার এটা আমার মনে হয়েছে ‘মনে রেখো’-এই কথাটি পড়ে। ‘সবাইকে বলি: মনে রেখো’- এই উচ্চারণটি কবির অভিপ্রায় ছিল, আর ছিল বলেই তা পুরো কবিতার আকারটিকেও নিধর্রিত করে দিয়েছে। কবিতার শেষে ‘মনে রেখো’ কথাটি যেভাবে ফিরে আসে, তা এই ধরনটিকে সফলতার আলোয় ছুঁয়ে যায়।
ঠিক একই কথা বলা যায় ‘শরীর’, কবিতা সম্পর্কেও। একদম একই কথা-
শরীরের মধ্যে কি একটা ঘটছে, ডাক্তার
ঠিক জানি না
কীভাবে বলতে হয় তার নাম
আয়নার সামনে বসলে ভারী হয়ে আসে চোখ
পেশির মধ্যে ব্যথা
ভিতর থেকে ফুটে বেরোয় হলুদ রঙের আলো
কিন্তু সে তো গোধূলির আভা, রক্তে কি
গোধূলি দেখা যায়?
রক্তে কি গোধূলি দেখা যায়? যাওয়া ভালো?
শরীরের মধ্যে কিচু একটা ঘটে যাচ্ছে ডাক্তার
জানি না তার নাম
এখানেও দুটি পংক্তির গঠনে একটা অভিনবত্ব আছে। শেষ দুটো লাইন বাদ দিলে পুরো কবিতাটা একই গঠনে লেখা। আর এখানেও, ‘ঠিন জানি না’ এই কথাটি পুরো কবিতাটির আকার ঠিক করে দিয়েছে।
এই ধরনটি অভিনবত্বের শীর্ষ ছুঁয়েছে ‘খরা কবিতায়।
সব নদী নালা পুকুর শুকিয়ে গিয়েছে
জল ভরতে এসেছিল যারা
তারা
পাতাহারা গাছ
সামনে ঝলমল করছে বালি
এইখানে শেষ নয়,এই সবে শুরু।
তারপর
বালি তুলে বালি তুলে বালি তুলে বালি
বিশ্বসংসার এ-রকম খালি
আর কখনো মনে হয়নি আগে
কবিতাটির প্রথম স্তবকের দ্বিতীয়-তৃতীয় পংক্তিতে অন্ত্যমিল আছে। এমনিতে এর মধ্যে কোনো অতিরিক্ত সঞ্চার নেই। তারপর, দ্বিতীয় স্তবকের তৃতীয় চতুর্থ লাইনের মিলটা লক্ষ করুন। পুররুক্তির সচেতন অর্থহীনতাকে কবি এখানে বাজিয়ে তুলতে চেয়েছন। আর তা বেজে উঠে, পরের লাএনই ‘খালি’র সঙ্গে মিল নিয়ে নিঃসঙ্গতাকে ধ্বনির অনুষঙ্গ দিয়ে দিল।
নেতিবাচকতাকে এভাবেই ধ্বনির সমর্থনে, শব্দের সমার্থক সৌজন্যে ‘না’ কবিতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন শঙ্খ ঘোষ। একই ভাবে-
এর কোনো মানে নেই। একদিনের পর দু-দিন পর তিনদিন
কিন্তু তারপর কী?
এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান
তুমি বলেছিলে ঘর হবে, ঘর হলো
তারপর কী?
তুমি বলেছিলে ¯েœহ হবে, ¯েœহ হলো
তারপর?
কতদূরে নিতে পারে ¯েœহ? অন্ধকারও আমাকে সন্দেহ
করেনি কখনো
বুকে বসে আছে তার বড়ো প্রতিস্পর্ধী কোনো!
না-এর পর না, না-এর পর না, না-এর পর না
তারপর কী?
পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা
তারপর?
আবার এই কবিতাতে, আগের কবিতায় ধরনে অন্ত্যমিল নয়, বাক্যের অন্তর্গত মিলে অর্থহীনতাকে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় লাইনে, ‘দু-জন’ টলে গেল ‘দুর্জন’-এ, পরে, ‘¯েœহ’ বিষিয়ে গেল ‘সন্দেহ’তে। এইরকম পরতে পরতে মনোযোগ নিয়ে লেখা কত কবিতা যে শঙ্খ ঘোষ-এর আছে।
একই শব্দ দুবার ব্যবহার করে তিনি অতিরিক্ত কোনো ইশারা দিতে চান।‘সারি সারি উট আর উটের চোখের নীচ জল’-এখানে ‘উট’ দুবার না এলে চলত এটা মনে হতেও পারে। কিন্তু এই যে অতিরেক, বিবৃতির টান, এটাই কবির লক্ষ্য ছিল, বলার পাশ দিয়ে পাশ দিয়ে বয়ে যায় অর্থের দ্বিতীয় স্তর।
আসলে, কিছুই তো নিশ্চিত নয়, স্পষ্ট নয়। উদ্দেশ্যহীনতা আর বিভ্রান্তি আমাদের বিমূঢ় করে রাখে। নিছক সরলরেখায় তো চলেনা আমাদের জীবন। ‘সন্ততি’ কবিতায় দুলাইন জুড়ে শুধু প্রশ্নের তাড়না-
এ কি মৃত্যু? এ কি বিচ্ছেদ? না কি মিলনেরই অপার বিস্তার?
এ কি মুহূর্ত? এ কি অনন্ত? না কি এরই নাম সন্তত জীবন?
এই বিরতিহীন প্রশ্নের ধরনটি ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ বইটির ‘চড়–ইটি কীভাবে মরেছিল’ কবিতাতেও আছে-
প্রথর? কত প্রহর হলো? এখনও কি দিন হয়নি?
আলোর পথ কোথায়?
টেবিল থেকে চেয়ারে আর চেয়ার থেকে গ্রিলের ওপর
স্বাধীনতার শেষ?
আকাশ থেকে ছিঁড়ে আমার ঘরের মধ্যে আকাশ দিয়ে
কোথায় গেছে ওরা?
গলার কাছে শুকনো লাগে, বুকের কাছে শূন্য লাগে, ভুল করে কি একটা দানাও রেখে যায়নি ফেলে?
শঙ্খ ঘোষ আরেকটি ধরনে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে আছেন। এটা যে বাংলা কবিতায় আগে একেবারে হয়নি তা নয়। প্রতিদিনের কথাকে কবিতায় প্রায় উদ্ধৃতির মতো করে ব্যবহার সফল হতে পেরেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়-ও। দু’জনের-ই কথায় আছে ব্যঙ্গের ধার, কখনো কৌতুকের ইশারায়। দু’জনের-ই চোখ মূলত সমাজের খর চলাচলের দিকে। তফাত তবু তো আছেই। দু’জনেই ধরনে এত মিল সত্ত্বেও দু’জনেই প্রখরভাবে আলাদা। একবার পড়েই চেনা যায় কোনটা কার লেখা। শঙ্খ ঘোষের লেখায় হয়তো ব্যঙ্গের চেয়ে করুণা বেশি, বা হয়তো সুভাষ যতটা সরাসরি সামনে তাকান, শঙ্খ ততটা না তাকিয়ে আরেকটু আড়ালে রেখে দিতে ভালোবাসেন তাঁর লক্ষ্য। ‘সাদাকালো’ কবিতাটা পড়–ন-
পথের ওই খুনখুনে বুড়ো
যখন এগিয়ে এসে বলে ‘আমি চাই।
দেবেন না? না দিয়ে
কাকে ঠকাচ্ছে মশাই?’
আর চারদিক থেকে ভদ্রলোকেরা;
‘সাবধান, সরে যান
লোকটা নির্ঘাৎ টেনে এসেছে
কয়েক পাইট’
তখন আমার সামনে কেঁপে দাঁড়ায়
ওয়াশিংটনের আরেক মস্ত বুড়ো
থুত্থুরে
ছেঁড়া বুকে ঢিল খেতে
তবু যে আঙুল তুলে বলেছিল ‘শোনো
আই অ্যাম ব্ল্যাক
বাট মাই ওয়াইফ ইজ হোয়াইট!’
টেনে এসেছে/কয়েক পাইট’-এই জায়াগাটুকু বাদ দিলে পুরো কবিতায় ব্যঙ্গ যতটা খরশান হয়ে উঠতে পারতো ততটা কিন্তু হয়নি। অথচ তার সম্ভাবনা ছিল ষোলো আনা। বিশেষ করে শেষ কথাটিকে আরো টেনে নেবার ঝোঁক কবি টের পাননি, আমার তা মনে হয় না। কিন্তু তিনি যে থেমে গেলেন, এতেই, কবিতাটির বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়ে গেল।
‘হাসপাতাল’ কবিতাটিও এখানে পড়া যেতে পারে-
নার্স ১ ঘুমোতে পারি না, প্রতি হাড়ের ভিতরে জমে ঘুণ
পা থেকে মাথায় ওঠে অশালীন বীজানুবিস্তার
ঘূর্ণমান ডাক দিই: কে কোথায়, সিস্টার সিস্টার-
‘হয়েছে কী? চুপ করে নিরিবিলি ঘুমিয়ে থাকুন।
তাছাড়া নিয়মমতো খেয়ে যান ফলের নির্যাস-’
সাদাঝুঁটি লাল বেল্ট খুট খুট ফিরে নার্স।
নার্স ২ রাত দুটো। চুপিচুপি দুটি মেয়ে ঢুকে দেখে পাশের কেবিনে
¤্রমিমাণ যুবাটির আরো কিছু মরা হলো কি না।
‘এখনও ততটা নয়’ ঠোঁট টিপে এ ওকে জানায়।
‘তবে কি ঘুমোচ্ছে? না কি জ্ঞানহীন? ডাক্তার দরকার?’
‘থাক বাপু’-ফিনফিনে ফিঙে দুটি ফিরে চলে যায়
‘আমরা কী করতে পারি! যার যার ঈশ্বর সহায়।’
অসুখী মানুষটির আর্তির উত্তরে নার্সদের প্রথম কথার মধ্যে, প্রায় প্রত্যেকটি শব্দে, নানা স্তর আছে। ‘নিরিবিলি’ ঘুমিয়ে থাকা, ‘নিয়মমতো’ ফলের নির্যাস খাওয়ার নির্দেশ-এর মানে বুঝতে অসুবিধে হয় না। কবিতাটির সবচেয়ে মোক্ষম যে হত্যাকান্ড ‘¤্রয়িমাণ যুবাটির আরো কিছু মরা হলো কি না’ জানার উৎকণ্ঠা, নার্সদের স্বাভাবিক উদাসীন তা আরো নির্মম হয়ে উঠেছে।
‘বাবুমশাই’ কবিতাটি, নাম কবিতাটির সঙ্গে এই বইয়ের ঘরানা চিনিয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে ধরিয়ে দিচ্ছে শঙ্খ ঘোষের ঘোষিত ধরনটিও। এই লেখার শুরুতে যে বলেছিলাম নিজেকে প্রাণের দায়ে আলাদা করে নিতে নানা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতেই হয় কবিকে, তার একটা বড়ো নমুনা এই ‘বাবুমশাই’ কবিতাটি। এই ধরনটির মধ্যেই যে প্রকাশ্য অভিনবত্ব আছে, তা ভেতরের কথাটিকেও ধরে নিয়েছে। শুরুতেই কবিতাটি সম্পর্কে কবি লিখে দেন: আশা করি সকলেই বুঝবেন যে এই ধরনের রচনা পড়বার বিশেষ একটা সুর আছে!’ ‘সুর’ কথাটি খেয়াল করবার মতো। কবি সুরকে মেনে নিয়েছেন এই কবিতায়। সুর আর শব্দের যে-স্বাভাবিক বিচ্ছেদ বজায় রেখে কবিতা লিখতে হয়, এখানে তা অস্বীকার করা হয়েছে।
করা হয়েছে, কারণ এভাবেও যদি বলার কথাটা বাজিয়ে দেওয়া যায়-এই ভাবনা কবিকে এখানে আক্রমণ করেছিল। কবিতাটি পড়ে বোঝা যায়, সেই টান কবি সফলভাবে সামলে নিতে পেরেছেন। ধরনটির মধ্যে যে-উগ্রতা আছে; তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলার কথাটা অক্ষুণœ রাখার জন্য ঘোরতর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাঁকে। ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন নিশ্চয়। কিন্তু সেই সংগ্রামের কোনো চিহ্ন কবিতাটিতে নেই, এখানেই লেখাটির সাফল্য।
কথা বলার একবগগা ধরনটিই যে শেষের আগের দুটি লাইনের ঐতিহাসিক উচ্চারণে পৌঁছে দিয়েছে কবিতাটিকে, এটাও কবিতাটি পড়লে বোঝা যায়।
ভঙ্গির এই প্রকাশ্য মুখরতা আছে ‘লজ্জা’ কবিতাতেও। সেখানেও বলার ধরনটি-ই টেনে নিয়ে গেছে কথাকে। আর সেখানেও, শেষপর্যন্ত, রাশ ধরে রাখতে পেরেছেন বলেই কবিতার শেষ হয় সংযত একটি প্রশ্নের সম্ভাবনায়।
বলেছিলাম, এই কবিতাটি এবং ‘মুর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ শঙ্খ ঘোষের প্রবণতা সবচেয়ে জোরালোভাবে চিনিয়ে দিয়েছে। সেই স্বভাবটি কী” এভাবে সরাসরি বোঝানো খুব মুশকিল। তবে বলা যায়, আরেকটা কলকাতাকে খোঁজে, আবার, একই সঙ্গে চুপ করে নীলকুঠুরিতে বসে থাকা। এমনভাবে লিখলাম যেন মনে মনে হচ্ছে এই দুটি প্রবণতা পরস্পরের বিপরীত। তা তো নয়। আসলে যে নিজস্বতার কথা বলছিলাম, তা অর্জনের কথাই ‘মুর্খ বড়ো, সামাজিক নয়, সামাজিক নয়’ কবিতায় ব্যঙ্গার্থে ধরা পড়ছে। এই নিজস্ব সামর্থ্যেই দিনের রাতের মাথায় যে খুন ঝরছে, তার কথা লিখ রাখতে চান কবি। বইটির রচনাকাল যে সত্তর দশক, এই তথ্যটি এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায়।
‘যদি’ কবিতায় এই কথাটিই যেন অন্যভাবে বলে দিয়েছেন কবি-
প্রতিটি মুখের থেকে যদি সব বিচ্ছেদের হেমন্তহলুদ পাতা
ঝরে যায়
হাত পেতে বলে যদি, এসো ওই আল ধরে
চলে যাই সেচনের দেশে
যদি মাটি ফুলে ওঠে আর সব খরা ভেঙে
ছুটে আসে বিদ্যুতের টান-
হতে পারে, সব হতে পারে যদি এই মহামৃত্তিকায় আমার মুখের দিকে
ঝুঁকে থাকো আকাশের মতো
মাটির দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ-এটা ছবি হিসেবে খুব অভিনব কিছু নয়। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের কবিতার ধরন বোঝার জন্য এই পংক্তিটি জরুরি। একটু আগেই যে বলা হলো চুপ করে নীলকুঠুরিতে বসে থাকার কথা, সেখানে বসেই লোকে যাকে সামাজিক বলে তার উল্টোদিক থেকে আরেকটা কলকাতার খোঁজ পাবার কথা, এখানে তো তাই বলা হলো। নিজস্বতার, নিজের ভেতরের দিকে তাকিয়ে থাকার সামর্থ্যে ভর দিয়েই ‘সব হতে পারে।’
‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, কবিতার বলার কথাও তো তাই। ‘একলা হয়ে’ গলির কোণে’ দাঁড়িয়েই তো অপেক্ষা থাকে ‘তোমার জন্য’। জৌলুসে, বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে সেই ব্যক্তিগত অপেক্ষার সমাধি ঘটে যায়।
একমাত্রিক সুন্দরের দিকে হাত জোড় করে বসে থাকা শঙ্খ ঘোষের স্বভাব নয়। যে-কোনো দৃশ্যের সাধারণ স্তর থেকে তিনি স্তরান্তরে চলে যেতে পারেন। কারণ তিনি দেখেছেন ‘ভাঙা ডানা পড়ে থাকে রাজপথে, গুহামুখে, চরে।’ সম্ভাবনার সমুদ্র থেকে কোনো আসক্ত হাওয়া উঠে আসছে না, তবু, এই ‘নাগিনীপিচ্ছিল অন্ধকারে’ও তিনি বলতে পারেন-
তারও মাঝখানে আমি স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন দেখি
দেখি ওরা হেঁটে যায় পৃথিবী সুন্দরতর করে
নক্ষত্রবিলাসে নয়, দিনানুদিনের আলপথে
আর যতদূর যায় ধানে ভরে যায় ততদূর।
তাঁকে তো কেউ দায়িত্ব দেয়নি তবু যেহেতু তিনি জানেন, ‘চম্পকনগরে আজ কানীর চক্রান্ত চারিদিকে’ তাই,
আমি শুধু এইখানে প্রহরীর মতো জেগে দেখি
যেন না ওদের গায়ে কোনো নাগিনীর শ্বাস লাগে
যেন কোন ঘুম, কোন কালঘুম মায়াঘুম এসে
শিয়র না ছুঁতে পারে আজ এই নিশীথনগরে
এখানে একটা ব্যক্তিগত কথা বলি। আমার মনে স্বদেশ নিয়ে কোন আবেগ নেই। ভারতবর্ষের জন্য আমি আলাদা কোনো উদ্দীপনা টের পাই না। বাংলার কেউ না খেললে আমি ক্রিকেট দেখি না। এর নানা সামাজিক ঐতিহাসিক কারণ তো আছেই, সে অন্য প্রসঙ্গ।
দেশ আমাদের আজও কোনো
দেশ আমাদের আজও কোনো
দেশ আমাদের আজও কোনো মাতৃভাষা দেয়নি এখনও
শঙ্খ ঘোষের এই কথা আমি আমার মতো করে পড়ি। কবিতাটিতে কথাগুলো বলা হয়েছে অন্যসূত্রে। এখানেও শেষ তিন লাইনের বলার ক্রম খেয়াল করার মতো। আক্ষেপ, অসহায়তা আর ক্ষোভ কথাটিকে প্রথমে সংহত রেখে তারপর সম্পূর্ণ করল। ‘ভিখিরির আবার পছন্দ’ কবিতাটি পড়তে পড়তে ‘বাবুমশাই’ কবিতার স্বর চের পাওয়া যায়। পুনরুক্তি, ভ্যঙ্গ আর সামাজিকভাবে বাতিল মানুষজনের কোণ থেকে দেখার ভঙ্গি এই দুটি কবিতাকে মিলিয়ে দিয়েছে।
Comments
Post a Comment