সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার কবিতার সবচেয়ে বড়ো ধরন হলো নিঃশব্দ এক দার্শনিকতা, যা তাঁর সবধরনের কবিতাকে সাবলীলভাবে ছুঁয়ে রয়েছে। এমন নয় যে তাঁর বলার ধরনটি মৃদু, নরম। বরং যা বলেন তিনি, বেশ জোর গলায় বলেন, এমনও বলা যায় যে এই গলা তুলে কতা বলার ধরনটি-ই তাঁর কবিতাকে সমসময়ের অন্য কবিতার থেকে আলাদা করেছে। এই প্রসঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়তে পারে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি, কিন্তু এখানে এই কথাটুকু বলে রাখা ভালো যে কেন এমন প্রবল এক ভঙ্গি সত্ত্বেও দার্শনিকতার আগে নিঃশব্দ কথাটি বসালাম আমি। সুনীলের যে-কোন কবিতা পড়লেই বোঝা যায় যে যখন কিছু বলছেন তিনি, তখন, বলার পাশাপাশি বক্তব্যটিকে তুলে নিচেছন অন্য আরেকটি স্তরে। এই দ্বিতীয় দার্শনিকতার পরতটিই সুনীলের কবিতার নিজস্ব ঠমক। এমনিতে শব্দ নিয়ে তাঁর খুব সচেতন নিরীক্ষা তেমন একটা ছিল না, নির্দিষ্ট শব্দের চেয়ে বরং রহস্যময় অর্থময়তার একটা প্রবাহ বজায় রেখে কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন তিনি। শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে তাঁর আর অলোকরঞ্জনের সেই বিখ্যাতহ বিতর্ক তো আমাদের সবার মনে আছে। কবিতার শব্দের দোলাচল নিয়ে যা বলেছিলেন তিনি, তা সাধারণভাবে যে-কোনো কবিতা সম্পর্কেই বলা যায়, কিন্তু বিশেষ করে সুনীলের নিজের কবিতা প্রসঙ্গে সেই কথার বিশেষ মানে আছে। শব্দে তির্যক অর্থন্তরের দিকে চোখ ছিল না তাঁর, তিনি কথার উদার এক বুনন রচনা করতে চাইতেন। এটা অনেকটা তাঁর ব্যক্তিজীবনের কথাবলার ঢং-এর মতোই। মাথা উঁচু করে গলা তুলে আহ্বানের এক ভঙ্গিতে বজায় রাখতে পারতেন। এটা খুব বড়ো একটা ব্যাপার। সাধারণত আমাদের কথা বলার ধরন আর কবিতার উচ্চারণের আদল খুব একটা মেলে না। আমাদের সময়ের মান্য কবিদের কথা বলার ভঙ্গি মেনে রেখে পাশাপাশি তাঁদের কবিতা মনে করুন-দেখবেন তাঁদের কবিতায় অন্য একটা তল যুক্ত হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক, কবিতা তো নানা রকম হবেই। কবিতার হয়ে ওঠার একতা পদ্ধতি আছে, নানা দিক থেকে নানা অনুষঙ্গ বুনে বুনে একটা কবিতা লেখা হয়। লেখার পর তা যেখানে পৌঁছবে, সেটা সেই নির্দিষ্ট কবিতাটির অবধারিত গন্তব্য। সেই শীর্ষবিন্দু কোন লেখা কত স্বাভাবিকভাবে স্পর্শ করল, তার ওপরেই সেই লেখাটির থাকা-না থাকা নির্ভর করে। সুনীলের ধরন আর শঙ্খ ঘোষের ধরন তো এক নয়। শঙ্খ ঘোষের কথা বলার ভঙ্গির সঙ্গে তাঁর কবিতার স্বরভঙ্গিমার কোন মিল নেই। তাঁর কবিতা আলাদা এক মননভঙ্গির গভীরতা নিয়ে কথা বলে। এমনকি যখন কৌতুক বা ব্যঙ্গের ধরন রাখেন তিনি কবিতায়, তখনও ভাষা তার স্বাভাবিক মন্দ্রতা হারায় না। কিন্তু এভাবে তো রোজ কথা বলা যায় না। তাঁর কথা বলার মধ্যে অন্য শিল্প আছে। সুনীলের সঙ্গে এইদিক থেকে মিল াাছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। নীরেন্দ্রনাথের লেখা পড়ার সময় আমি যেন তাঁর নিজস্ব বাচনভঙ্গিমাটুকু শুনতে পাই- হাত নেড়ে, কখনো মাথা নামিয়ে, কখনো দাপটের সঙ্গে তুলে তিনি যেন নিজেই কবিতাটি পড়ছেন মনে হয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই ভঙ্গিমাটির মধ্যে যে দাপট আছে, রাখঢাক না রেখে প্রায় কলার তুলে কথা বলার এই যে ভঙ্গি, তার সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আদলের মিল আছে। শীক্তর কবিতাও দরাজ, খোলামেলা, উদাত্ত আর সাবলীল। সুনীলের মতোই। তবে শক্তির কবিতায় এক জটিল বনান্ধকার আছে, আলোছায়াময় রহস্যের সম্ভাবনা নিয়ে নির্মম মজা করতে ভালোবাসতেন তিনি, শব্দের নিজস্ব সৌন্দর্যের দিকেও তাঁর সুনীলের চেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল। আবার সুনীলের কবিতা দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায়, শক্তি সেখানে ভেতরে ভেতরে ঘূর্ণীর জটিলতা তৈরি করতে ভালাবাসেন।
শেকস পিয়রের নাটক সম্পর্কে আলোচনায়,বার্নাড শ একবার জানিয়েছিলেন যে, সাহিত্যের উৎকর্ষের এক নির্দিষ্ট সীমা আছে, এবং, সময় কখনো-না-কখনো সেই সীমা স্পর্শ করে। এখন, এই নির্ধারিত উৎকর্ষবিন্দুটি কখন এবং কীভাবে টের পাওয়া যায় তা নিয়ে, নানা স্তরে মতান্তর আছেই। বাংলায়, অন্তত ঔপনিবেশিক পর্বে, উনিশ শতকের শেষ থেকে এই শতকের প্রথমাংশ সেই উৎকর্ষের স্পর্শ পেয়েছে-একথা বোধ হয়, কম-বেশি মেনে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে রেখেই একথা বললাম, কিন্তু তার পরেও, বাংলা সাহিত্য অন্যরকম ভাবে ফলবান হয়ে উঠেছে, এবং যদিও আরো বেশি কিছুকাল না গেলে এই সময় সম্পর্কে সেভাবে কিছু বলা ঠিক হবে না, তবু,হয়ত টের পাওয়া যাচ্ছে কোথাও কোথাও অস্ফুট ফসলরেখা, কখনো পর্যাপ্ত খামারবাড়ি, শস্যচিহ্ন, নবান্নের ওম-সব মিলিয়ে, রবীন্দ্রনাথের পরে আবার যে সেজে উঠছে বাংলা সাহিত্য, হয়তো সেই উৎকর্ষের ভারেই, তা বোঝা যাচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, এই বিচিত্র উৎসব সজ্জার সুরম্য ও আলোচিত বৈদূর্য।
যে-কোনো লেখক, তাঁর পরের পর্বের তরুণ লিখিয়েদের গ্রহণে আলোড়নে পুনর্জীবন পান। ‘পূনর্জীবন’ শব্দটির দুটো ইশারা আছে। এক, নতুনভাবে আলোচিত হওয়া-আলোচনার শেষ বাক্যটিতে তিনি নিহত হতে পারেন। অথবা, দুই, তাঁকে প্রবাদে উত্তীর্ণ করাও হতে পারে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অব্যবহিত পরে এবং এই মুহূর্থে যাঁরা লিখতে এসেছেন, লিখছেন, তাঁদের মধ্যে পুনর্জীবিত সুনীল শব্দটির দ্বিতীয় ইশারাই স্পষ্ট করে তুলছেন, ক্রমশ।
এর অনেকগুলি কারণ আছে। প্রতিষ্ঠান ও তার নানা অনুষঙ্গ, রচনা সংখ্যা, জীবনযাপন, চারিত্র্য, এক ধরনের তড়িৎ দার্শনিকতা-সব জড়িয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামটির এক প্রবা তৈরি হয়েছে। এই কারণগুলির প্রায় সবকটিই বাইরের ব্যাপার, রচনার মৌলিক কোনো ধরন নয় এগুলো। এটাই হয়। সমসময়ের কোনো লেকক সম্পর্কে ভাবতে গেলে তাঁর ভেতরের ঘূর্ণীর চেয়ে প্রকাশ্য ব্যবহারই গুরুত্ব পেয়ে যায়। সময়ের নিরাসক্ত ব্যবধান তৈরি না হলে লেখকের আসল অবয়বের পুরোটা চোখে পড়েনা।
কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুধু ঐ ক’টি ব্যবহার ভঙ্গিমার জন্যই শিরোধার্য হয়ে ওঠেননি, বলা বাহুল্য। তাঁর সামগ্রিক লেখালেখির কিছু অবধারিত ধক নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন এই সময়ের পাঠক। গল্পে, কবিতায়, উপন্যাসে, গদ্য রচনায় আলাদা আলাদ ভাবে, কখনো মিশ্র বিন্যাসে নানা ঝলক নানাভাবে ঝকঝকে করে উঠেছে। এগুলি তাঁর লেখক সত্তারই কিছু মৌলিক লক্ষণ, ফলে তাঁর গল্প উপন্যাসেও এর ছায়া পড়েছে নিঃসন্দেহে। মাঝেই মাঝেই মনে হয়, যেন বিষয়ের নিরীহ ছায়া হয়ে নেমে আসে অন্য এক মেঘস্বভাব, ক্রমশ, চৈত্র জানালা দিয়ে বয়ে আসা মেঘলা দুরবগাহ ছড়িয়ে যায়, ভারি হয়ে ওঠে আচ্ছনান বিকেল।
আরো অনেক বাঙালি কবির মতোই, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বহু কবিতাতেই এই দর্শনস্মিত স্বর টের পাওয়া যায়। এমনিতে, তাঁর কবিতায় স্মৃতির রোমঞ্চ ও রহস্যময়তা, ফুলের সুবর্ণরেখা গন্ধ, বুকের মধ্যে চাপা হাওয়া, কথা না রাখার অভিমানী তেত্রিশ বছর, ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ, চন্দনকাঠের হারানো বোতাম, জানালার পর্দাটা দুলছে কখনো আস্তে বা জোরে-এই ছবি, মাথার খুব কাছে আকাশ, হাঁটুর ওপরে থুতনি রেখে বসে থাকা-সবই তৃতীয় আহ্লাদে ভরে থাকে। তাঁর উচ্চারণে সাধারণভাবে, একরকম সংবেদী দ্বিধাহীনতা টলটল করে, যে-কোনো পাঠক যে-আয়ত থেকে এক আঁজলা সহমর্মি পেয়ে খুশি হয়ে উঠতে পারেন।
এ পৃথিবী চেয়েছে চোখের জল, পায়নিও ক,
যেটুকু দেবার দিয়ে যে যার নিজের পথে চলে যায়
মাঝে মাঝে এমন উদাস করা আলো আসে,
অনেক দেখে না, কেউ দেখে
তখন সে কার ভাই, বন্ধু? কার আর্যপুত্র, সে কারুর নয়
বড় মায়া, বুক ছেঁড়া দীর্ঘশ্বাস, আবাল্যের এত ¯েœহ, ঋণ
বিষণœতা পায়ে হেঁটে চলে যায় সূর্যাস্তের দিগন্ত কিনারে
রেলের কামড়ায় পিঁপড়ে যে-রকম যায় দেশান্তরে
‘রেলের কামরায় পিঁপড়ে’ সুনীলের খুব সমাদৃত কবিতার মধ্যে পড়েনা, বোধহয় কিন্তু একাধিক কারণে এই কবিতাটি তাৎপর্যপূর্ণ। একদিক থেকে, তাাঁর কবিতার যে প্রবণতাগুলির কথা ওপরে কণা হয়েছে, এই কবিতাটিও তা ধারণ করে আছে,বিচ্ছিন্ন ও সামগ্রিক দুদিক থেকেই। ‘যেটুকু দেবার দিয়ে যে-যার নিজার পথে চলে যায়’-এই লাইনে এক দীর্ঘশ্বাসের ধারাবাহিকতা রয়েছে। প্রথম লাইনটির সঙ্গে এর যোগ খুব একটা নেই বলেই মনে হয়। পৃথিবীকে চোখের জল উপহার দিয়ে কেউ নিজের মতো একটা নেই বলেই মনে হয়। পৃথিবীকে চোখের জল উপহার দিয়ে কেউ নিজের মতো চলে যাচ্ছে-এটা কোনো বক্তব্য হতে পারে না। নিজের পথে চলে যাবার কথায় যে দার্শনিক উদাসীনতা আছে, তার সঙ্গে পৃথিবীকে কাঁদিয়ে যাবার ব্যাপারটা যে অর্থে বাহুল্যময়, এখানে তা ঘটাতে চাওয়া হয়নি। বলেই অনুমান করা যায়। কারণ , প্রথম লাইনটির মধ্যে যে-দ্রুততার ধাক্কা াাছে, তা একেবারে অন্য গোত্রের। হয়তো, তাড়াহুড়োয় লাইনটিতে যথেষ্ট রক্তসঞ্চার ঘটানোও যায়নি। সুনীল যেমন বলেছিলেন একবার, কবিতার প্রতিটি শব্দেরই মানে নাও থাকতে পারে দেশ-বিদেশের একাধিক সারস্বতজনেরও এই রকম মন্তব্য মনে পড়ছে), অকারণেই ব্যবহৃত হতে পারে তা-এই কবিতাটির প্রথম লাইনটি সম্পর্কেই হয়তো বা একথাই বলা যায়।
তারপর, পুরো কবিতাতেই ‘উদাস করা আলো’ ছড়িয়ে পড়ে, সে-আলোয় সম্পর্কের নিজস্ব পরিচয় অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং তা-ও ‘অনেকে দেখেনা, কেউ দেখে’ সে জন্যই, ‘সকল লোকের মাঝে বসে’ থেকেও , নিজের মুদ্রাদোষে’ই কেউ কেউ ‘আলাদা’ হয়ে ওঠেন, কবিতাতেও বেজে ওঠে ধূসর দার্শনিকতার আওয়াজ। ‘তখন সে কার ভাই, বন্ধু? কার আর্যপুত্র? সে কারুর নয়।’
এই কবিতার এখানেই ভর, অনাসক্ত বিশ্বাসবোধ, ভেতরে ভেতরে ঘটে যাওয়া তুমুল জলপ্রপাত দুটি-একটি পরিচিত শব্দের দাক্ষিণ্যে কথা পেয়েছে।
যে একলাইন উপমায় এই অনুভব ভরে দেওয়া আছে, তা অবশ্য তুলনায় অনেকটাই নিস্প্রভ, কবিতাটির তেমন সমাদর না হওযার করণ হয়ত এই রিক্ত উপমা; তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য এই কবিতায় পুরোপুরি মাখানো রয়েছে, রয়েছে তাঁর শমিত বিষণœতাবোধ, নিস্পৃহ দার্শনিকতা, তড়িৎ স্বরলাবণ্য এবং ছুঁতে না-পারা আরো অনেক প্রকাশ্য অন্ধকার।
এই দার্শনিক ঘরানাটি সুনীলের কবিতাকে নানাভাবে সাজিয়ে তুলেছে। কোনো মানুষীকে নিয়ে লেখা কবিতায় এই ভঙ্গি যেভাবে আকা রপেয়েছে, সেভাবে নিশ্চয়ই কোনো দৃশ্যের বর্ণনায় নয়। ‘নেই’কবিতায় কয়েকটি নিরীহ দৃশ্যেয় বর্ণনায় সেভাবে কোনো প্রকাশ্য দার্শনিকতা নেই:
রান্নাঘটিতে ছিল কিছু ক্ষুধা, কিছু ¯েœহ, কিছু দুর্দিনের ক্ষুদকুঁড়ো
উঠোনে কয়েকটি পায়ে দাপাদাপি, দু’খুটিতে টান করা ছেঁড়া ডুরে শাড়ি
পাশেই গোয়ালঘর, ঠিক ঠাকুমার মতো সহ্যশীলা নীরব গাভীটি
যাকে ছায়া দিত এক প্রাচীন জামরলবক্ষ, যার ফল খেয়ে যেতে পোকা
বর্ণনার প্রতিটি বিন্দু একটি বড়ো বাস্তবতার দিকে আকার নিচ্ছে, সেটা ঠিক, আর বিশেষ করে প্রথম লাইনটির সহজ অনুভব কবিতাটির মধ্যে এক মায়া ঘনিয়ে দিয়েছো তবে এই জন্যেই কবিতাটি ভেতরে ভেতরে আরো উদামসীন হয়ে উঠেছে।
সোজাসাটপা ধরনে বলা দার্শনিক উচ্চরণের একটি সম্পর্ণ উদাহরণ সুনীলের নিজের আড়ালে কবিতাটি। প্রথম লাইনেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে পরের কয়েকটা লাইনে তাকেদত খুলে বোঝানো হয়েছে। সমর্থন জোগানো হয়েছে একধিক দৃশ্য আর ঘটনা দিয়ে। এমনকি ব্যাখ্যা আর সমর্থনের অতিরিস্ত একটি সুসমাচারও যেন বলে দেয় কবিতাটি, আবর্জনা আর আসবাবে বন্দী হয়ে থাকার যাতনা থেকে কবিতাটি মুক্তি চায় ভেতরের লুকিয়ে থাকা সুগাদ্ধের আহ্বানে।
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
মানুষ দেখে না
সে খেঁজে ভ্রমর কিংবা
দিগন্তের মেষের সংসার
আবার বিরক্ত হয়
...
অসম্ভব অভিমানে খুন করে পরমা নারীকে
...
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
প্রায় একইরকমভাবে যেন হয়ে উঠেছে, ‘দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি’ কবিতাটি। এখানে মুল সিদ্ধান্তটি আছে কবিতার একেবারে শেষের দিকে।
যে তোমাকে দেখে, সে-ই তোমাকে সুন্দর করে
দুষ্টা যে, ঈশ্বরও সে।
এই সিদ্ধান্তের অন্তর্গত অব্যবহিতটি আছে কবিতার দ্বিতীয় আর দশম লাইনে; অহঙ্কার তোমাকে মানায় না
কিন্তু এই কবিতার আসল ভরটি রয়েছে প্রেমিকাকে ঈশ্বর করে তোলার সুসমাচারে। ‘নিজের আড়ালে’ কবিতার আবর্জনা আর আসবারের মতোই অহঙ্কারকে এখানে মনে হতে পারতো, কিন্তু এখানে লক্ষ্য যেহেতু নারী, তাই অতিরিক্ত একটু আলো এসে লেগেছে।
একেবারে অন্য ঘরানার কবিতা ‘কৃত্তিবাস’। একটি নির্দিষ্ট আর চেনা প্রসঙ্গ কবিতাটির অবলম্বন। বাংলায় ‘কৃত্তিবাস’ -সংস্কৃতি নিয়ে কোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ হতে পারে না এই কবিতাটির উল্লেখ উহ্য রেখে। প্রেসের মালিকের কথাটিকে যেভাবে অনায়াসে ধরে রেখেছেন সুনীল এই কবিতায়, তা তাঁর দার্শনিক মননের একটি প্রসিদ্ধ নির্মাণ। অথবা উল্টোটাও বলা যায়, কোনটা আগে, কোনটা পরে, বোঝা মুশকিল।
মনে আছে মোহনবাগান
লেনের টিনের চালের ছাপাখানায় প্রুফ নিয়ে বসে থাকা ঘন্টার পর
ঘন্টা, প্রেসের মালিক বলতেন, খোকা ভাই, অত চার্মিনার খেও না,
গা দিয়ে মরা পোড়ার গন্ধ বেরোয়, তখন আমরা প্রায়ই যেতাম
শ্মশানে, শরতের কৌতুক ও শক্তির দুর্দান্তপনা, সন্দীপনের চোখ মচকানো
আর কি দুরন্ত নাচ
সমরেন্দ্র, তারাপদ আর উৎপলের লুকোচুরি
চেনা কয়েকটি নামের উল্লেখ কবিতাটিকে বাস্তবের রক্তমাংস দিয়ে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
‘অচেনা’ কবিতাটি বাইরে যতটা মিতবাক, ভেতরে ভেতরে ততটাই হাহাকারময়।
একঝলক একটি মেয়ের কাছে ন¤্র ঋণ স্বীকার করে নিয়ে কবিতাটি মুখর উদাসীনতার দিকে ঝুঁকে রইল:
বাসের অমন ভিড়ের মধ্যে মেয়েটা
আমাকে এক লাইন কবিতা দিয়ে হঠাৎ ন¤্র নেত্রপাতে
বেলগাছিয়ায় নেমে গেল রক্তগোলাপ হাতে
বাকিটা পথ রইল শুধু ঘামের গন্ধ, ব্রিজের ধুলো
তোমার কাছে গোলাপ, তুমি আমার কাছে ঋণী রইলে
সুনীলের বিখ্যাত ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’ কবিতাটিকেও তাঁর নিজস্ব ধরনের উদাসীন অথচ শমিত দার্শনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। গোটা কবিতাটিতে চিরকালীন প্রেমিকার যোগ্য হয়ে ওঠার সরল রসায়নটিকে ধরে রেখেছে একটি নির্দোষ আশ্বাস :
এক হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ-হাতে কোনো পাপ করতে পারি?
কিংবা:
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসিÑ
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যা কি মানায়?
প্রেমিকের এই স্পর্শ দিয়ে কবিতাকেও গ্রহণ করেছিলেন সুনীল, তাই সারাজীবন ধরে কবিতার কাছে আমর্ম বিশ্বস্ত থেকে গেছেন, সৎ থেকে গেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই ভঙ্গিমাটির মধ্যে যে দাপট আছে, রাখঢাক না রেখে প্রায় কলার তুলে কথা বলার এই যে ভঙ্গি, তার সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আদলের মিল আছে। শীক্তর কবিতাও দরাজ, খোলামেলা, উদাত্ত আর সাবলীল। সুনীলের মতোই। তবে শক্তির কবিতায় এক জটিল বনান্ধকার আছে, আলোছায়াময় রহস্যের সম্ভাবনা নিয়ে নির্মম মজা করতে ভালোবাসতেন তিনি, শব্দের নিজস্ব সৌন্দর্যের দিকেও তাঁর সুনীলের চেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল। আবার সুনীলের কবিতা দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায়, শক্তি সেখানে ভেতরে ভেতরে ঘূর্ণীর জটিলতা তৈরি করতে ভালাবাসেন।
শেকস পিয়রের নাটক সম্পর্কে আলোচনায়,বার্নাড শ একবার জানিয়েছিলেন যে, সাহিত্যের উৎকর্ষের এক নির্দিষ্ট সীমা আছে, এবং, সময় কখনো-না-কখনো সেই সীমা স্পর্শ করে। এখন, এই নির্ধারিত উৎকর্ষবিন্দুটি কখন এবং কীভাবে টের পাওয়া যায় তা নিয়ে, নানা স্তরে মতান্তর আছেই। বাংলায়, অন্তত ঔপনিবেশিক পর্বে, উনিশ শতকের শেষ থেকে এই শতকের প্রথমাংশ সেই উৎকর্ষের স্পর্শ পেয়েছে-একথা বোধ হয়, কম-বেশি মেনে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে রেখেই একথা বললাম, কিন্তু তার পরেও, বাংলা সাহিত্য অন্যরকম ভাবে ফলবান হয়ে উঠেছে, এবং যদিও আরো বেশি কিছুকাল না গেলে এই সময় সম্পর্কে সেভাবে কিছু বলা ঠিক হবে না, তবু,হয়ত টের পাওয়া যাচ্ছে কোথাও কোথাও অস্ফুট ফসলরেখা, কখনো পর্যাপ্ত খামারবাড়ি, শস্যচিহ্ন, নবান্নের ওম-সব মিলিয়ে, রবীন্দ্রনাথের পরে আবার যে সেজে উঠছে বাংলা সাহিত্য, হয়তো সেই উৎকর্ষের ভারেই, তা বোঝা যাচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, এই বিচিত্র উৎসব সজ্জার সুরম্য ও আলোচিত বৈদূর্য।
যে-কোনো লেখক, তাঁর পরের পর্বের তরুণ লিখিয়েদের গ্রহণে আলোড়নে পুনর্জীবন পান। ‘পূনর্জীবন’ শব্দটির দুটো ইশারা আছে। এক, নতুনভাবে আলোচিত হওয়া-আলোচনার শেষ বাক্যটিতে তিনি নিহত হতে পারেন। অথবা, দুই, তাঁকে প্রবাদে উত্তীর্ণ করাও হতে পারে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অব্যবহিত পরে এবং এই মুহূর্থে যাঁরা লিখতে এসেছেন, লিখছেন, তাঁদের মধ্যে পুনর্জীবিত সুনীল শব্দটির দ্বিতীয় ইশারাই স্পষ্ট করে তুলছেন, ক্রমশ।
এর অনেকগুলি কারণ আছে। প্রতিষ্ঠান ও তার নানা অনুষঙ্গ, রচনা সংখ্যা, জীবনযাপন, চারিত্র্য, এক ধরনের তড়িৎ দার্শনিকতা-সব জড়িয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামটির এক প্রবা তৈরি হয়েছে। এই কারণগুলির প্রায় সবকটিই বাইরের ব্যাপার, রচনার মৌলিক কোনো ধরন নয় এগুলো। এটাই হয়। সমসময়ের কোনো লেকক সম্পর্কে ভাবতে গেলে তাঁর ভেতরের ঘূর্ণীর চেয়ে প্রকাশ্য ব্যবহারই গুরুত্ব পেয়ে যায়। সময়ের নিরাসক্ত ব্যবধান তৈরি না হলে লেখকের আসল অবয়বের পুরোটা চোখে পড়েনা।
কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুধু ঐ ক’টি ব্যবহার ভঙ্গিমার জন্যই শিরোধার্য হয়ে ওঠেননি, বলা বাহুল্য। তাঁর সামগ্রিক লেখালেখির কিছু অবধারিত ধক নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন এই সময়ের পাঠক। গল্পে, কবিতায়, উপন্যাসে, গদ্য রচনায় আলাদা আলাদ ভাবে, কখনো মিশ্র বিন্যাসে নানা ঝলক নানাভাবে ঝকঝকে করে উঠেছে। এগুলি তাঁর লেখক সত্তারই কিছু মৌলিক লক্ষণ, ফলে তাঁর গল্প উপন্যাসেও এর ছায়া পড়েছে নিঃসন্দেহে। মাঝেই মাঝেই মনে হয়, যেন বিষয়ের নিরীহ ছায়া হয়ে নেমে আসে অন্য এক মেঘস্বভাব, ক্রমশ, চৈত্র জানালা দিয়ে বয়ে আসা মেঘলা দুরবগাহ ছড়িয়ে যায়, ভারি হয়ে ওঠে আচ্ছনান বিকেল।
আরো অনেক বাঙালি কবির মতোই, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বহু কবিতাতেই এই দর্শনস্মিত স্বর টের পাওয়া যায়। এমনিতে, তাঁর কবিতায় স্মৃতির রোমঞ্চ ও রহস্যময়তা, ফুলের সুবর্ণরেখা গন্ধ, বুকের মধ্যে চাপা হাওয়া, কথা না রাখার অভিমানী তেত্রিশ বছর, ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ, চন্দনকাঠের হারানো বোতাম, জানালার পর্দাটা দুলছে কখনো আস্তে বা জোরে-এই ছবি, মাথার খুব কাছে আকাশ, হাঁটুর ওপরে থুতনি রেখে বসে থাকা-সবই তৃতীয় আহ্লাদে ভরে থাকে। তাঁর উচ্চারণে সাধারণভাবে, একরকম সংবেদী দ্বিধাহীনতা টলটল করে, যে-কোনো পাঠক যে-আয়ত থেকে এক আঁজলা সহমর্মি পেয়ে খুশি হয়ে উঠতে পারেন।
এ পৃথিবী চেয়েছে চোখের জল, পায়নিও ক,
যেটুকু দেবার দিয়ে যে যার নিজের পথে চলে যায়
মাঝে মাঝে এমন উদাস করা আলো আসে,
অনেক দেখে না, কেউ দেখে
তখন সে কার ভাই, বন্ধু? কার আর্যপুত্র, সে কারুর নয়
বড় মায়া, বুক ছেঁড়া দীর্ঘশ্বাস, আবাল্যের এত ¯েœহ, ঋণ
বিষণœতা পায়ে হেঁটে চলে যায় সূর্যাস্তের দিগন্ত কিনারে
রেলের কামড়ায় পিঁপড়ে যে-রকম যায় দেশান্তরে
‘রেলের কামরায় পিঁপড়ে’ সুনীলের খুব সমাদৃত কবিতার মধ্যে পড়েনা, বোধহয় কিন্তু একাধিক কারণে এই কবিতাটি তাৎপর্যপূর্ণ। একদিক থেকে, তাাঁর কবিতার যে প্রবণতাগুলির কথা ওপরে কণা হয়েছে, এই কবিতাটিও তা ধারণ করে আছে,বিচ্ছিন্ন ও সামগ্রিক দুদিক থেকেই। ‘যেটুকু দেবার দিয়ে যে-যার নিজার পথে চলে যায়’-এই লাইনে এক দীর্ঘশ্বাসের ধারাবাহিকতা রয়েছে। প্রথম লাইনটির সঙ্গে এর যোগ খুব একটা নেই বলেই মনে হয়। পৃথিবীকে চোখের জল উপহার দিয়ে কেউ নিজের মতো একটা নেই বলেই মনে হয়। পৃথিবীকে চোখের জল উপহার দিয়ে কেউ নিজের মতো চলে যাচ্ছে-এটা কোনো বক্তব্য হতে পারে না। নিজের পথে চলে যাবার কথায় যে দার্শনিক উদাসীনতা আছে, তার সঙ্গে পৃথিবীকে কাঁদিয়ে যাবার ব্যাপারটা যে অর্থে বাহুল্যময়, এখানে তা ঘটাতে চাওয়া হয়নি। বলেই অনুমান করা যায়। কারণ , প্রথম লাইনটির মধ্যে যে-দ্রুততার ধাক্কা াাছে, তা একেবারে অন্য গোত্রের। হয়তো, তাড়াহুড়োয় লাইনটিতে যথেষ্ট রক্তসঞ্চার ঘটানোও যায়নি। সুনীল যেমন বলেছিলেন একবার, কবিতার প্রতিটি শব্দেরই মানে নাও থাকতে পারে দেশ-বিদেশের একাধিক সারস্বতজনেরও এই রকম মন্তব্য মনে পড়ছে), অকারণেই ব্যবহৃত হতে পারে তা-এই কবিতাটির প্রথম লাইনটি সম্পর্কেই হয়তো বা একথাই বলা যায়।
তারপর, পুরো কবিতাতেই ‘উদাস করা আলো’ ছড়িয়ে পড়ে, সে-আলোয় সম্পর্কের নিজস্ব পরিচয় অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং তা-ও ‘অনেকে দেখেনা, কেউ দেখে’ সে জন্যই, ‘সকল লোকের মাঝে বসে’ থেকেও , নিজের মুদ্রাদোষে’ই কেউ কেউ ‘আলাদা’ হয়ে ওঠেন, কবিতাতেও বেজে ওঠে ধূসর দার্শনিকতার আওয়াজ। ‘তখন সে কার ভাই, বন্ধু? কার আর্যপুত্র? সে কারুর নয়।’
এই কবিতার এখানেই ভর, অনাসক্ত বিশ্বাসবোধ, ভেতরে ভেতরে ঘটে যাওয়া তুমুল জলপ্রপাত দুটি-একটি পরিচিত শব্দের দাক্ষিণ্যে কথা পেয়েছে।
যে একলাইন উপমায় এই অনুভব ভরে দেওয়া আছে, তা অবশ্য তুলনায় অনেকটাই নিস্প্রভ, কবিতাটির তেমন সমাদর না হওযার করণ হয়ত এই রিক্ত উপমা; তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য এই কবিতায় পুরোপুরি মাখানো রয়েছে, রয়েছে তাঁর শমিত বিষণœতাবোধ, নিস্পৃহ দার্শনিকতা, তড়িৎ স্বরলাবণ্য এবং ছুঁতে না-পারা আরো অনেক প্রকাশ্য অন্ধকার।
এই দার্শনিক ঘরানাটি সুনীলের কবিতাকে নানাভাবে সাজিয়ে তুলেছে। কোনো মানুষীকে নিয়ে লেখা কবিতায় এই ভঙ্গি যেভাবে আকা রপেয়েছে, সেভাবে নিশ্চয়ই কোনো দৃশ্যের বর্ণনায় নয়। ‘নেই’কবিতায় কয়েকটি নিরীহ দৃশ্যেয় বর্ণনায় সেভাবে কোনো প্রকাশ্য দার্শনিকতা নেই:
রান্নাঘটিতে ছিল কিছু ক্ষুধা, কিছু ¯েœহ, কিছু দুর্দিনের ক্ষুদকুঁড়ো
উঠোনে কয়েকটি পায়ে দাপাদাপি, দু’খুটিতে টান করা ছেঁড়া ডুরে শাড়ি
পাশেই গোয়ালঘর, ঠিক ঠাকুমার মতো সহ্যশীলা নীরব গাভীটি
যাকে ছায়া দিত এক প্রাচীন জামরলবক্ষ, যার ফল খেয়ে যেতে পোকা
বর্ণনার প্রতিটি বিন্দু একটি বড়ো বাস্তবতার দিকে আকার নিচ্ছে, সেটা ঠিক, আর বিশেষ করে প্রথম লাইনটির সহজ অনুভব কবিতাটির মধ্যে এক মায়া ঘনিয়ে দিয়েছো তবে এই জন্যেই কবিতাটি ভেতরে ভেতরে আরো উদামসীন হয়ে উঠেছে।
সোজাসাটপা ধরনে বলা দার্শনিক উচ্চরণের একটি সম্পর্ণ উদাহরণ সুনীলের নিজের আড়ালে কবিতাটি। প্রথম লাইনেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে পরের কয়েকটা লাইনে তাকেদত খুলে বোঝানো হয়েছে। সমর্থন জোগানো হয়েছে একধিক দৃশ্য আর ঘটনা দিয়ে। এমনকি ব্যাখ্যা আর সমর্থনের অতিরিস্ত একটি সুসমাচারও যেন বলে দেয় কবিতাটি, আবর্জনা আর আসবাবে বন্দী হয়ে থাকার যাতনা থেকে কবিতাটি মুক্তি চায় ভেতরের লুকিয়ে থাকা সুগাদ্ধের আহ্বানে।
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
মানুষ দেখে না
সে খেঁজে ভ্রমর কিংবা
দিগন্তের মেষের সংসার
আবার বিরক্ত হয়
...
অসম্ভব অভিমানে খুন করে পরমা নারীকে
...
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
প্রায় একইরকমভাবে যেন হয়ে উঠেছে, ‘দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি’ কবিতাটি। এখানে মুল সিদ্ধান্তটি আছে কবিতার একেবারে শেষের দিকে।
যে তোমাকে দেখে, সে-ই তোমাকে সুন্দর করে
দুষ্টা যে, ঈশ্বরও সে।
এই সিদ্ধান্তের অন্তর্গত অব্যবহিতটি আছে কবিতার দ্বিতীয় আর দশম লাইনে; অহঙ্কার তোমাকে মানায় না
কিন্তু এই কবিতার আসল ভরটি রয়েছে প্রেমিকাকে ঈশ্বর করে তোলার সুসমাচারে। ‘নিজের আড়ালে’ কবিতার আবর্জনা আর আসবারের মতোই অহঙ্কারকে এখানে মনে হতে পারতো, কিন্তু এখানে লক্ষ্য যেহেতু নারী, তাই অতিরিক্ত একটু আলো এসে লেগেছে।
একেবারে অন্য ঘরানার কবিতা ‘কৃত্তিবাস’। একটি নির্দিষ্ট আর চেনা প্রসঙ্গ কবিতাটির অবলম্বন। বাংলায় ‘কৃত্তিবাস’ -সংস্কৃতি নিয়ে কোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ হতে পারে না এই কবিতাটির উল্লেখ উহ্য রেখে। প্রেসের মালিকের কথাটিকে যেভাবে অনায়াসে ধরে রেখেছেন সুনীল এই কবিতায়, তা তাঁর দার্শনিক মননের একটি প্রসিদ্ধ নির্মাণ। অথবা উল্টোটাও বলা যায়, কোনটা আগে, কোনটা পরে, বোঝা মুশকিল।
মনে আছে মোহনবাগান
লেনের টিনের চালের ছাপাখানায় প্রুফ নিয়ে বসে থাকা ঘন্টার পর
ঘন্টা, প্রেসের মালিক বলতেন, খোকা ভাই, অত চার্মিনার খেও না,
গা দিয়ে মরা পোড়ার গন্ধ বেরোয়, তখন আমরা প্রায়ই যেতাম
শ্মশানে, শরতের কৌতুক ও শক্তির দুর্দান্তপনা, সন্দীপনের চোখ মচকানো
আর কি দুরন্ত নাচ
সমরেন্দ্র, তারাপদ আর উৎপলের লুকোচুরি
চেনা কয়েকটি নামের উল্লেখ কবিতাটিকে বাস্তবের রক্তমাংস দিয়ে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
‘অচেনা’ কবিতাটি বাইরে যতটা মিতবাক, ভেতরে ভেতরে ততটাই হাহাকারময়।
একঝলক একটি মেয়ের কাছে ন¤্র ঋণ স্বীকার করে নিয়ে কবিতাটি মুখর উদাসীনতার দিকে ঝুঁকে রইল:
বাসের অমন ভিড়ের মধ্যে মেয়েটা
আমাকে এক লাইন কবিতা দিয়ে হঠাৎ ন¤্র নেত্রপাতে
বেলগাছিয়ায় নেমে গেল রক্তগোলাপ হাতে
বাকিটা পথ রইল শুধু ঘামের গন্ধ, ব্রিজের ধুলো
তোমার কাছে গোলাপ, তুমি আমার কাছে ঋণী রইলে
সুনীলের বিখ্যাত ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’ কবিতাটিকেও তাঁর নিজস্ব ধরনের উদাসীন অথচ শমিত দার্শনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। গোটা কবিতাটিতে চিরকালীন প্রেমিকার যোগ্য হয়ে ওঠার সরল রসায়নটিকে ধরে রেখেছে একটি নির্দোষ আশ্বাস :
এক হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ-হাতে কোনো পাপ করতে পারি?
কিংবা:
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসিÑ
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যা কি মানায়?
প্রেমিকের এই স্পর্শ দিয়ে কবিতাকেও গ্রহণ করেছিলেন সুনীল, তাই সারাজীবন ধরে কবিতার কাছে আমর্ম বিশ্বস্ত থেকে গেছেন, সৎ থেকে গেছেন।
Comments
Post a Comment