‘গীতাঞ্জলি’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :“এই গ্রন্থের প্রথম কয়েকটি গান পূর্বে অন্য দুটি-একটি পুস্তকে প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে যে-সমস্ত গান পরে পরে রচিত হইয়াছে তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটি ভাবের ঐক্য থাকা সম্ভবপর মনে করিয়া তাহাদের সকলগুলিই এই পুস্তকে একত্র বাহির করা হইল।
(৩১ শ্রাবণ, ১৩১৭)
যে ভাবের ঐকের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সে ভাব কবির ঈশ্বরচেতনার। নৈবেদ্য (১৩০৮) থেকে গীতাঞ্জলি (১৩২১) পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ব্রহ্মানুভূতি, ঈশ্বরভাবনা ও ভক্তির এক পথরেখা নির্মিত হয়েছে। তবে তা একরৈখিক নয় কখনোই। নৈবেদ্য-র কবিতায় কবির একাত্মতা সর্বমানবের সঙ্গে, যে দুঃখের সংক্ষোভ. সেখানে তা-ও সর্বমানবের। এই মানবমুখিতা, যা অতি নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রকবিতারই একটি ধারা, গীতাঞ্জলি পর্বে এসে পথ হারিয়েছে কবির ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঈশ্বরবোধের কাছে। স্বদেশপ্রেম, ঔপনিষদিক ঈশ্বরভক্তি ও সর্বমানবের মঙ্গলচিন্তাÑনৈবদ্যে-র ভক্তিরসকে উজ্জীবিত রেখেছে। সেখানে ব্রহ্মাসংগীতের সমস্ত লক্ষণ নিয়েই ঈশ্বর জীবনস্বামী, প্রভু, জীবননাথ, অন্তর্যামী ইত্যাদি শব্দে সম্বোধিত হয়েছেন। এই ঈশ্বর তখনও ‘পরাণসখা বন্ধু’ হয়ে ওঠেননি।
গীতাঞ্জলি (১৩১৭) গীতিমাল্য (১৩২১) ও গীতালি (১৩২১) এই তিনটি কাব্য একসঙ্গে গ্রথিত হয়েছে তাদের অন্তর্নিহিত আত্মোপলব্ধির আনন্দসূত্রে। এই অন্তরউপলব্ধি নির্গত হয়েছে সংগীতের সুরে। অরুণকুমার বসু সংগতভাবেই বলেছেন, “খেয়ার যুগ থেকে বহু সাংসারিক ক্ষয়ক্ষতি, দুঃখবেদনা, প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত শোকঘাত কবিকে রিক্ত নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল। কবি ক্রমেই বহির্জগতের কলকোলাহল থেকে সরিয়ে এনে আপনাকে বিশ্বেশ্বরের নিভৃত বিশাল প্রাঙ্গনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিলেন। কন্ঠে কেবল উদ্গত সুর নিয়ে তার আরতি, সেই আরতির প্রথম বিল্বদল গীতাঞ্জলি কাব্য।” (বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত)
কবিকেও বলতে শুনি-জানি আমি এই গানেরই বলে
বসি গিয়ে তোমারি সস্মুখে।
মন দিয়ে যার নাগাল নাহি পাই,
গান দিয়ে সেই চরণ ছুঁয়ে যাই,
সুরের ঘোরে আপনাকে যাই ভুলে,
বন্ধু ব’লে ডাকি মোর প্রভুকে।
অবশ্য এ সংগীতও তো ঈশ্বরের কাছ থেকেই পাওয়া :
ফুলের মতন আপনি আপনি ফুটাও গান,
হে আমার নাথ, এই তো তোমার দান।
ইংরাজি ‘গীতাঞ্জলি’র ভূমিকায় ডব্লিউ-বি-ইয়েট্স গানগুলির ( Song offerings) সংগীতময়তায় মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন : When there was but one mind in England, Chaucer wrote his Troilus and Cressida, and thought he had written to be read, or to be read-out for our time was coming on apace-he was sung by minstrels for a while Rabindranath Tagore, like Chaucer`s forerunner, writes music for his words, and one understands, at every moment that he is so abundant, so spontaneous, so daring in his passion, so full of surprise....... দূরদর্শী কবি ইয়েট্স-এর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে যুগ যুগ ধরে এই গান গীত হবে জীবনের সঙ্গে অন্বিষ্ট হয়ে, পথিক এই গান গেয়ে পথপরিক্রমা করবে, ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমের অনুভবকে ঈশ্বরভক্তির গানই প্রেমিক-প্রেমিকার বাণী হয়ে উঠবে। এই প্রসঙ্গে আমাদের একথাও মনে রাখতে হবে যে গীতাঞ্জলি-র ১৫৭টি কবিতার মধ্যে ৭২টি কবিতায় সুর সংযোজিত হয়নি, ৮৫টি কবিতা রবীন্দ্রসংগীত হয়েছে, বাকিগুলো হয়নি। তবু সমস্ত গ্রন্থখানিই গীতের অঞ্জলি (Song offerings) হয়ে উঠেছে।
আমরা আগেই দেখেছি, নৈবেদ্য ও খেয়া-র ভক্তিরস, তা বাংলা গীতাঞ্জলি-র নয়। ঈশ্বর এখানে শুধু স্তবের বিষয় নন, তিনি কবির বন্ধু, সখা, প্রিয়া, দয়িত, স্বামী। সম্পর্ক এখানে দ্বি-মুখী। কবি যেমন আভিসারিকার মতো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন তাঁর ঈশ্বরের জন্য, ঈশ্বরও তেমনি ভক্তের প্রেমের টানে তার কাছে আসেন। উভয়েরই আছে বিরহব্যথা, ক্ষণমিলনের আনন্দ। আনন্দ থেকেই সৃষ্টি, বিশ্বের উদ্ভব ঘটে। এই সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই সৃষ্টিকর্তা বহুধা হন, বহুরূপ ঘটে তাঁর তাই তিনি অপরূপ। আর কবি এই বিশ্বাত্মাকে প্রেম ও আনন্দের নানা বিচিত্র অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত করে চলেন।
কবির সঙ্গে ঈশ্বরের যে বহু ব্যঞ্জনাময় সম্পর্ক, তার চারটি লক্ষণসূত্র উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রকাব্যের আলোচক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। (রবি-রশ্মি, দ্বিতীয় খন্ড)
এগুলি হল এইরকম ১। ‘অহংকার মিলনের বাধা। তাহাকে ধ্বংস করার সাধনা প্রথমেই অবলম্বনীয়। অহংকারে বিশ্ব প্রতিহত, আনন্দ সংকীর্ণ, প্রেম সংকুচিত হয়।’ ২। ‘সংসারে দুঃখ আঘাত বেদনার একটা বিশেষ সার্থকতা আছে। ইহারা প্রেমময়ের দূতি।’ ৩। ‘বিশ্বপ্রকৃতির ও নরসমাজের সর্বত্র ভগবানের সত্তা ও লীলা সাধক-কবি সর্ন্দশন করিতেছেন।’ ৪। ‘অতএব সবার পিছে সবার নীচে সব-হারাদের মাঝে স্থান লইয়া মৃত্যু-মাঝে হতে হবে চিতাভস্মে সবার সমান!’ এই চারটি সংকেতসূত্রের মধ্যে ‘দুঃখ’ ও ‘অমঙ্গল’-কে যেভাবে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি পর্বে গ্রহণ করেছেন, তাকে এই পর্বে কবিতার বিশেস বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। (আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ)
দুঃখের বেশে এসেছ বলে
তোমারে নাহি ডরাব হে।
যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা
নিবিড় করে ধরিব হে।
এই দুঃখ জননীর সোনার থালায় সাজিয়ে দিতে চান কবি :
তোমার বুকে শোভা পাবে আমার
দুঃখের অলংকার।
দুঃখ তো শুধু অলংকার নয়, গান হয়ে বেজে উঠবে ঈশ্বরের প্রাণে :
এই অকুল সংসারে
দুঃখ আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে।
তাই অনেক অনেক আঘাত এই সংসারের সহ্য করার জন্য কবির প্রস্তুতি চলে মনে মনে :
চিরজনমের বেদনা,
ওহে টিরজীবনের সাধনা।
কিংবা
আরো আঘাত সইবে আমার
সইবে আমারো,
আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো।
এই আঘাত যেন ঈশ্বরের স্পর্শের মতো, এই আঘাতরূপ স্পর্শ দিয়েই তো
কবির অচেতন চিত্ত জেগে উঠবে।
যখন থাকে অচেতনে
এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরম তব
সেই তো পুরস্কার।
সম্পর্কটা এমন হলে যোগাযোগ তীব্র হতো কিন্তু তা তো হবার নয়, ঈশ্বর দূরেই সরে থাকেন, তাকে না পাওয়ার দুঃখ কবিকে বয়ে নিয়ে বেড়াতেই হয়। তাই অনুযোগ :
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
কিংবা
দূরের পানে মেলে আঁখি
কেবল আমি চেয়ে থাকি
পরাণ আমার কেঁদে বেড়ায়
দুরন্ত বাতাসে।
এই দুঃখবোধই তো গানগুলিকে এমন ‘সুমধুর’ করে তুলেছে। জীবনদেবতার সঙ্গে এই যে মধুর সম্পর্ক, যা বিরহ-মিলনের টানাপোড়েনে সুগভীর হয়ে ওঠে, তা কবির ব্যক্তিমনের একান্ত নিভৃতি থেকে উৎসারিত। রবীন্দ্রনাথ কবি, দেবতা মহাকবি :
তোমার কাছে খাটে না মোর
কবির গরম করা,
মহাকবি, তোমার পায়ে
দিতে চাই যে ধরা।
মহাকবির কন্ঠ নিঃসৃত গান একারণেই কবিকে অবাক হয়ে শুনতে হয়-
সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে,
সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,
পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে
বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।
বিশ্বপিতার গানে সাধকবি তার সুর হারিয়ে ফেললেও তাকে গান গেয়েই যেতে হবে। এই গানই দুজনের যোগসূত্রের মতো। গানের অঞ্জলি দিয়ে তার পূজা সমাপ্ত হয় :
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি
বাহির মনে
চিরদিবস মোর জীবনে।
অন্য এক কবিতাতেও একই কথা বলেছেন কবি :
মন দিয়ে যে নাগাল নাহি পাই,
গান দিয়ে তাই চরণ ছুঁয়ে যাই।
গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর বিষয়ে নানা অনুভুতির মালা। এইসব অনুভুতি উৎসারিত হয়েছে মূলত গানের সুরে। আর যেখানে সুরের আরোপ নেই, সেখানেও তাঁর অনুভুতিকে গ্রহণ করতে হয়। কেননা এই অনুভুতির প্রকাশ কাব্যিক। স্পষ্টতই, এইসব কবিতা-গানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈশ্বরচেতনা সম্পর্কে কোনো তত্ত্বকথা শোনাতে বসেননি। তবুও এ গান ভক্তির, আর ঈশ্বর ও ভক্তের সম্পর্কজাত। নানা টানাপোড়েনের অনুভুতির। এখানেই একটা মোক্ষম প্রশ্ন উঠে আসে। ঈশ্বরভক্তিরহিত কোনো হৃদয়ে তবু কেন ঈশ্বরপ্রেমের অনুরঞ্জিত কাব্যকে স্থান দিতে বাধে না? কেন আপ্লুত হই গীতাঞ্জলি-র গানে? এ প্রশ্ন তুলছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব একটি ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে। ইংরেজি গীতাঞ্জলি পাঠ করে যে মানুষটি মনে সংকল্প তৈরি হয়েছিল মূল ভাষায় গীতাঞ্জলি পড়বার, তিনি তো ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না, “যে ঈশ্বরকে আমি কায়মনোবাক্যে অলীক বলে জানি সেই ঈশ্বরভাবে ভরপুর কাব্যে মন কেন সাড়া দেয়?” এই সমস্যাটিকে আইয়ূব নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা যে ব্যাখ্যায় যাবো না। কেননা তা সবাই জানেন। এখানে যে কথাটা বলার, তা হল সাহিত্যে, বিশেষত কাব্যে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন আধুনিকতার স্পষ্ট লক্ষণ হিসেবে স্বীকৃত। গীতাঞ্জলি-র ‘তুমি’ কখনও প্রিয়তমা, জননী, প্রভু, স্বামী, নাথ হিসেবে সন্বোধিত হলেও ভক্তিভাবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে প্রেমের ভাব ও প্রকৃততির রূপ সন্দর্শন যা কাব্য হিসেবে অনন্য হয়ে উঠেছে। শুধু ভক্তিরসের কাব্য হলে এই গানগুলো ব্রহ্ম সংগীতের ভক্তির চৌহদ্দিতেই ঘোরফেরা করত, এভাবে আমাদের অভিভূত করত না। সম্পর্কের মধ্যে যে অধরা অংশ, যে ভিন্ন ব্যঞ্জনা, যে অস্পষ্টতা, তা প্রভু ও ভক্তের সরল সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। গীতাঞ্জলি একজন আধুনিক কবির জীবন সম্পর্কে অপার প্রশ্নবোধ ও মানুষের অস্তিত্ব ঘিরে রহস্যময়তার চিহ্নগুলোকে নিজের মতো করে খুঁজে নেওয়ার কাব্যিক রূপ হিসেবেই আমাদের কাছে গ্রহণীয় হয়েছে।
(৩১ শ্রাবণ, ১৩১৭)
যে ভাবের ঐকের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সে ভাব কবির ঈশ্বরচেতনার। নৈবেদ্য (১৩০৮) থেকে গীতাঞ্জলি (১৩২১) পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ব্রহ্মানুভূতি, ঈশ্বরভাবনা ও ভক্তির এক পথরেখা নির্মিত হয়েছে। তবে তা একরৈখিক নয় কখনোই। নৈবেদ্য-র কবিতায় কবির একাত্মতা সর্বমানবের সঙ্গে, যে দুঃখের সংক্ষোভ. সেখানে তা-ও সর্বমানবের। এই মানবমুখিতা, যা অতি নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রকবিতারই একটি ধারা, গীতাঞ্জলি পর্বে এসে পথ হারিয়েছে কবির ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঈশ্বরবোধের কাছে। স্বদেশপ্রেম, ঔপনিষদিক ঈশ্বরভক্তি ও সর্বমানবের মঙ্গলচিন্তাÑনৈবদ্যে-র ভক্তিরসকে উজ্জীবিত রেখেছে। সেখানে ব্রহ্মাসংগীতের সমস্ত লক্ষণ নিয়েই ঈশ্বর জীবনস্বামী, প্রভু, জীবননাথ, অন্তর্যামী ইত্যাদি শব্দে সম্বোধিত হয়েছেন। এই ঈশ্বর তখনও ‘পরাণসখা বন্ধু’ হয়ে ওঠেননি।
গীতাঞ্জলি (১৩১৭) গীতিমাল্য (১৩২১) ও গীতালি (১৩২১) এই তিনটি কাব্য একসঙ্গে গ্রথিত হয়েছে তাদের অন্তর্নিহিত আত্মোপলব্ধির আনন্দসূত্রে। এই অন্তরউপলব্ধি নির্গত হয়েছে সংগীতের সুরে। অরুণকুমার বসু সংগতভাবেই বলেছেন, “খেয়ার যুগ থেকে বহু সাংসারিক ক্ষয়ক্ষতি, দুঃখবেদনা, প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত শোকঘাত কবিকে রিক্ত নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল। কবি ক্রমেই বহির্জগতের কলকোলাহল থেকে সরিয়ে এনে আপনাকে বিশ্বেশ্বরের নিভৃত বিশাল প্রাঙ্গনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিলেন। কন্ঠে কেবল উদ্গত সুর নিয়ে তার আরতি, সেই আরতির প্রথম বিল্বদল গীতাঞ্জলি কাব্য।” (বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত)
কবিকেও বলতে শুনি-জানি আমি এই গানেরই বলে
বসি গিয়ে তোমারি সস্মুখে।
মন দিয়ে যার নাগাল নাহি পাই,
গান দিয়ে সেই চরণ ছুঁয়ে যাই,
সুরের ঘোরে আপনাকে যাই ভুলে,
বন্ধু ব’লে ডাকি মোর প্রভুকে।
অবশ্য এ সংগীতও তো ঈশ্বরের কাছ থেকেই পাওয়া :
ফুলের মতন আপনি আপনি ফুটাও গান,
হে আমার নাথ, এই তো তোমার দান।
ইংরাজি ‘গীতাঞ্জলি’র ভূমিকায় ডব্লিউ-বি-ইয়েট্স গানগুলির ( Song offerings) সংগীতময়তায় মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন : When there was but one mind in England, Chaucer wrote his Troilus and Cressida, and thought he had written to be read, or to be read-out for our time was coming on apace-he was sung by minstrels for a while Rabindranath Tagore, like Chaucer`s forerunner, writes music for his words, and one understands, at every moment that he is so abundant, so spontaneous, so daring in his passion, so full of surprise....... দূরদর্শী কবি ইয়েট্স-এর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে যুগ যুগ ধরে এই গান গীত হবে জীবনের সঙ্গে অন্বিষ্ট হয়ে, পথিক এই গান গেয়ে পথপরিক্রমা করবে, ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমের অনুভবকে ঈশ্বরভক্তির গানই প্রেমিক-প্রেমিকার বাণী হয়ে উঠবে। এই প্রসঙ্গে আমাদের একথাও মনে রাখতে হবে যে গীতাঞ্জলি-র ১৫৭টি কবিতার মধ্যে ৭২টি কবিতায় সুর সংযোজিত হয়নি, ৮৫টি কবিতা রবীন্দ্রসংগীত হয়েছে, বাকিগুলো হয়নি। তবু সমস্ত গ্রন্থখানিই গীতের অঞ্জলি (Song offerings) হয়ে উঠেছে।
আমরা আগেই দেখেছি, নৈবেদ্য ও খেয়া-র ভক্তিরস, তা বাংলা গীতাঞ্জলি-র নয়। ঈশ্বর এখানে শুধু স্তবের বিষয় নন, তিনি কবির বন্ধু, সখা, প্রিয়া, দয়িত, স্বামী। সম্পর্ক এখানে দ্বি-মুখী। কবি যেমন আভিসারিকার মতো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন তাঁর ঈশ্বরের জন্য, ঈশ্বরও তেমনি ভক্তের প্রেমের টানে তার কাছে আসেন। উভয়েরই আছে বিরহব্যথা, ক্ষণমিলনের আনন্দ। আনন্দ থেকেই সৃষ্টি, বিশ্বের উদ্ভব ঘটে। এই সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই সৃষ্টিকর্তা বহুধা হন, বহুরূপ ঘটে তাঁর তাই তিনি অপরূপ। আর কবি এই বিশ্বাত্মাকে প্রেম ও আনন্দের নানা বিচিত্র অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত করে চলেন।
কবির সঙ্গে ঈশ্বরের যে বহু ব্যঞ্জনাময় সম্পর্ক, তার চারটি লক্ষণসূত্র উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রকাব্যের আলোচক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। (রবি-রশ্মি, দ্বিতীয় খন্ড)
এগুলি হল এইরকম ১। ‘অহংকার মিলনের বাধা। তাহাকে ধ্বংস করার সাধনা প্রথমেই অবলম্বনীয়। অহংকারে বিশ্ব প্রতিহত, আনন্দ সংকীর্ণ, প্রেম সংকুচিত হয়।’ ২। ‘সংসারে দুঃখ আঘাত বেদনার একটা বিশেষ সার্থকতা আছে। ইহারা প্রেমময়ের দূতি।’ ৩। ‘বিশ্বপ্রকৃতির ও নরসমাজের সর্বত্র ভগবানের সত্তা ও লীলা সাধক-কবি সর্ন্দশন করিতেছেন।’ ৪। ‘অতএব সবার পিছে সবার নীচে সব-হারাদের মাঝে স্থান লইয়া মৃত্যু-মাঝে হতে হবে চিতাভস্মে সবার সমান!’ এই চারটি সংকেতসূত্রের মধ্যে ‘দুঃখ’ ও ‘অমঙ্গল’-কে যেভাবে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি পর্বে গ্রহণ করেছেন, তাকে এই পর্বে কবিতার বিশেস বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। (আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ)
দুঃখের বেশে এসেছ বলে
তোমারে নাহি ডরাব হে।
যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা
নিবিড় করে ধরিব হে।
এই দুঃখ জননীর সোনার থালায় সাজিয়ে দিতে চান কবি :
তোমার বুকে শোভা পাবে আমার
দুঃখের অলংকার।
দুঃখ তো শুধু অলংকার নয়, গান হয়ে বেজে উঠবে ঈশ্বরের প্রাণে :
এই অকুল সংসারে
দুঃখ আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে।
তাই অনেক অনেক আঘাত এই সংসারের সহ্য করার জন্য কবির প্রস্তুতি চলে মনে মনে :
চিরজনমের বেদনা,
ওহে টিরজীবনের সাধনা।
কিংবা
আরো আঘাত সইবে আমার
সইবে আমারো,
আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো।
এই আঘাত যেন ঈশ্বরের স্পর্শের মতো, এই আঘাতরূপ স্পর্শ দিয়েই তো
কবির অচেতন চিত্ত জেগে উঠবে।
যখন থাকে অচেতনে
এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরম তব
সেই তো পুরস্কার।
সম্পর্কটা এমন হলে যোগাযোগ তীব্র হতো কিন্তু তা তো হবার নয়, ঈশ্বর দূরেই সরে থাকেন, তাকে না পাওয়ার দুঃখ কবিকে বয়ে নিয়ে বেড়াতেই হয়। তাই অনুযোগ :
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
কিংবা
দূরের পানে মেলে আঁখি
কেবল আমি চেয়ে থাকি
পরাণ আমার কেঁদে বেড়ায়
দুরন্ত বাতাসে।
এই দুঃখবোধই তো গানগুলিকে এমন ‘সুমধুর’ করে তুলেছে। জীবনদেবতার সঙ্গে এই যে মধুর সম্পর্ক, যা বিরহ-মিলনের টানাপোড়েনে সুগভীর হয়ে ওঠে, তা কবির ব্যক্তিমনের একান্ত নিভৃতি থেকে উৎসারিত। রবীন্দ্রনাথ কবি, দেবতা মহাকবি :
তোমার কাছে খাটে না মোর
কবির গরম করা,
মহাকবি, তোমার পায়ে
দিতে চাই যে ধরা।
মহাকবির কন্ঠ নিঃসৃত গান একারণেই কবিকে অবাক হয়ে শুনতে হয়-
সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে,
সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,
পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে
বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।
বিশ্বপিতার গানে সাধকবি তার সুর হারিয়ে ফেললেও তাকে গান গেয়েই যেতে হবে। এই গানই দুজনের যোগসূত্রের মতো। গানের অঞ্জলি দিয়ে তার পূজা সমাপ্ত হয় :
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি
বাহির মনে
চিরদিবস মোর জীবনে।
অন্য এক কবিতাতেও একই কথা বলেছেন কবি :
মন দিয়ে যে নাগাল নাহি পাই,
গান দিয়ে তাই চরণ ছুঁয়ে যাই।
গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর বিষয়ে নানা অনুভুতির মালা। এইসব অনুভুতি উৎসারিত হয়েছে মূলত গানের সুরে। আর যেখানে সুরের আরোপ নেই, সেখানেও তাঁর অনুভুতিকে গ্রহণ করতে হয়। কেননা এই অনুভুতির প্রকাশ কাব্যিক। স্পষ্টতই, এইসব কবিতা-গানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈশ্বরচেতনা সম্পর্কে কোনো তত্ত্বকথা শোনাতে বসেননি। তবুও এ গান ভক্তির, আর ঈশ্বর ও ভক্তের সম্পর্কজাত। নানা টানাপোড়েনের অনুভুতির। এখানেই একটা মোক্ষম প্রশ্ন উঠে আসে। ঈশ্বরভক্তিরহিত কোনো হৃদয়ে তবু কেন ঈশ্বরপ্রেমের অনুরঞ্জিত কাব্যকে স্থান দিতে বাধে না? কেন আপ্লুত হই গীতাঞ্জলি-র গানে? এ প্রশ্ন তুলছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব একটি ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে। ইংরেজি গীতাঞ্জলি পাঠ করে যে মানুষটি মনে সংকল্প তৈরি হয়েছিল মূল ভাষায় গীতাঞ্জলি পড়বার, তিনি তো ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না, “যে ঈশ্বরকে আমি কায়মনোবাক্যে অলীক বলে জানি সেই ঈশ্বরভাবে ভরপুর কাব্যে মন কেন সাড়া দেয়?” এই সমস্যাটিকে আইয়ূব নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা যে ব্যাখ্যায় যাবো না। কেননা তা সবাই জানেন। এখানে যে কথাটা বলার, তা হল সাহিত্যে, বিশেষত কাব্যে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন আধুনিকতার স্পষ্ট লক্ষণ হিসেবে স্বীকৃত। গীতাঞ্জলি-র ‘তুমি’ কখনও প্রিয়তমা, জননী, প্রভু, স্বামী, নাথ হিসেবে সন্বোধিত হলেও ভক্তিভাবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে প্রেমের ভাব ও প্রকৃততির রূপ সন্দর্শন যা কাব্য হিসেবে অনন্য হয়ে উঠেছে। শুধু ভক্তিরসের কাব্য হলে এই গানগুলো ব্রহ্ম সংগীতের ভক্তির চৌহদ্দিতেই ঘোরফেরা করত, এভাবে আমাদের অভিভূত করত না। সম্পর্কের মধ্যে যে অধরা অংশ, যে ভিন্ন ব্যঞ্জনা, যে অস্পষ্টতা, তা প্রভু ও ভক্তের সরল সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। গীতাঞ্জলি একজন আধুনিক কবির জীবন সম্পর্কে অপার প্রশ্নবোধ ও মানুষের অস্তিত্ব ঘিরে রহস্যময়তার চিহ্নগুলোকে নিজের মতো করে খুঁজে নেওয়ার কাব্যিক রূপ হিসেবেই আমাদের কাছে গ্রহণীয় হয়েছে।
Comments
Post a Comment