Skip to main content

Fabricare receipt 01 08 2024

সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় সময়চিহ্ন / সৈয়দ কওসর জামাল

১.
তাঁর বিষয়ে অনেকেই ব‘লে থাকেন যে তিনি বাংলা কবিতায় ‘ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক’। ওই কথার প্রতিবাদ ক’রে আমি এই মুহুর্তেই বলতে চাই যে সুধীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে রোমান্টিক কবি, এবং একজন শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহের (১৯৬০) ভূমিকায় একথা লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু। এমন সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় সময়শাসন লক্ষ করে তার চিহ্নগুলো নির্ণয় করা দুরুহ মনে হতে পারে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুকে পুনরায় উদ্ধৃত করে বলতে হয় রোমান্টিক বলেই “তিনি ছিলেন না যাকে বলে মিনারবাসী’, স্বকালের জগৎ ও জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে লিপ্ত হ’য়ে আছে তাঁর কবিতা।”
সমসাময়িক বিষয় অবলম্বন করে কবিতা শুধু নজরুল লেখেন নি, কবিতার ধ্রুপদি মানে বিশ্বাসী ও ক্লাসিকাল-মনস্ক সুধীন্দ্রনাথও লিখেছেন। কেন এমন হলো, জানতে আমাদের তিনটি বিষয় লক্ষ করতে হবে।
প্রথমত, যুদ্ধের নান্দীরোলের ভিতর ত্রিশের কবিদের বাল্যকাল কাটলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সংকটের আগ্রাসন সুধীন্দ্রনাথকে এবং অংশত জীবনানন্দকে বেশি বিদীর্ণ করেছিল। ক্লান্তি ও মৃত্যুর কথা এই দুটি সমভাবে কবির মধ্যেই বিদ্যমান। সুধীন্দ্রনাথ তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন এইভাবে-
আমি বিংশ শতাব্দীর
সমান বয়সী; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে; বীর
নই, তবু জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে বিপ্লবে বিপ্লবে
বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনুষ্যধর্মের স্তবে
নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে
যত না পশ্চাৎপদ, ততোধিক বিমুখ অতীতে।
(যযাতি)
দ্বিতীয়ত, সুধীন্দ্রনাথের কবিমানসে ছিল নিখিলনিবিড় নৈরাশ্যের গাঢ় অবস্থান, যা আরোপিত মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই, কেননা সত্যিসত্যি কোনো অন্তঃপ্রেরণা না থাকলে এই মানসিক অবস্থানটিকে চিরকাল ধরে রাখা সম্ভব হতো না।
তৃতীয়ত, সুধীন্দ্রনাথের আজীবন নৈরাশ্যকে রসদ যুগিয়েছে মালার্মের নেতিবাচক জীবনাদর্শন। কবিতার ব্যঞ্জনাধর্মিতা, প্রতীকীকরণ ও শব্দের অভিধানগত অর্থের পরিবর্তন, দুরুহতা ছাড়াও মৃত্যু, শব, নরক, ভগ্নতরী, মরুভূমি ইত্যাদি যেন মালার্মের কাছ থেকেই গ্রহণ করা। মালার্মের বহহঁর প্রকাশ করেছে জীবনের অবসাদ, ক্লান্তি ও গ্লানি; আর সুধীন্দ্রনাথের ‘নির্বেদ’ ‘বিবিক্তি’ ও সমধর্মী।
মৃত্যু কেবল মৃত্যুই ধ্রুব সখা
যাতনা শুধুই যাতনা সুচিরসাথী। (অর্কেস্ট্রা)
কোথায় লুকবে? ধূ ধূ করে মরুভূমি
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ (উটপাখী)
চতুর্থত, সুধীন্দ্রনাথই প্রথম কবি যিনি টি এস এলিয়টকে বাংলাভাষীর কাছে উপস্থাপিত করেছেন। এর কারণ হল, দেশ ও কালের যে ব্যাপ্তি ও ধারণা এলিয়টের কবিতায় প্রতিভাত হয়েছিল, তা সুধীন্দ্রনাথের আধুনিক মনকে স্পর্শ করেছিল। তিনি জানতেন- ‘কাব্যের মুক্তি পরিগ্রহণে’, আর ‘এখন সারা ব্রহ্নান্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে, কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না’। সমান ও সময়ের যে নিরাসক্ত ও নৈব্যক্তিক চিত্র এলিয়ট নির্মাণ করেছেন তাতে ধরা পড়েছে মানুষের নিঃসঙ্গতার এক মর্মন্তুদ বিবরণ- প্রুফক থেকে ফাঁপা মানুষের কাহিনিতে ও ‘পোড়ো জমি’র সার্বিক ধ্বংসস্তুপে যা বিধৃত। বিশৃঙ্খলাপূর্ণ সামাজিক প্রেক্ষাপট, হৃতপ্রায় পারিবারিক ঐতিহ্য ও ছিন্নমূল রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের আত্মসচেতনতা, কেদ ও গ্লানি যুক্ত হয়ে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে এলিয়টের কবিতায়, আধুনিক কবি সুধীন্দ্রনাথ তা থেকে মুখ ফেরাবেন কী করে!
‘অতীত ও বর্তমানের সমুদ্রমন্থন করে উপযুক্ত উপায় সুসংগত অবৈকল্য-নির্মাণ এর শিক্ষা তিনি যেন গ্রহণ করলেন এলিয়টের কাছ থেকে।
পঞ্চমত, আরও একটি সচেতন প্রসায় কাজ করেছিল সুধীন্দ্রনাথের কাব্যভাবনায়- যা হল রবীন্দ্রনাথ প্রদর্শিত পথের প্রত্যাখ্যান। সুধীন্দ্রনাথের কথায়- “রবীন্দ্রসাহিত্যে যে দেশ ও কালের প্রতিবিম্ব পড়ে তার সঙ্গে আজকালকার পরিচয় এত অল্প যে তাকে পরীর দেশ বললেও, বিষ্ময় প্রকাশ করা অনুচিত।” (সূর্যাবর্ত)। সুতরাং ধরে নেওয়া যাবে যে সুধীন্দ্রনাথ যে দেশ ও কালের কথা বলবেন, তা হবে বাস্তবানুগত ও অভিজ্ঞতালব্ধ।
২.
সুধীন্দ্রনাথের জীবনভাবনা যে শুধু ইউরোপীয় কাব্য ও চিন্তার ফসল, এমন নয়। ‘সংবর্ত’ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে তাঁকে বলতে শুনি- “ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর যথাশক্তি অনুশীলনের ফলে আজ আমি যে-দার্শনিক মতে উপনীত, তা প্রাচীন ক্ষণবাদেরই সাম্প্রতিক সংস্করণ।” সমসাময়িক টানাপোড়েন একদিকে যেমন ছিল, অন্যদিকে তেমনি ছিল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিজাত প্রবণতা। ১৯৩০-এ প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্বী’র নামকবিতায় তিনি লিখেছেন-
অনিত্যা মৃণ¥য়ী অল্পা, তবু তার রূপ মরীচিকা
নিñায় অমিয় শূন্য মরুভূমি মাঝে......
আর ‘অর্কেস্ট্রায়’ এসে লিখেছেন-
নন্দনের প্রতিশ্রুতি মম
ফণিমনসায় ঘেরা উপহাস্য মরুমায়া সম।
(অনুষঙ্গ)
সময় ও যুগের বন্ধ্যাত্ব-ই প্রকাশ করেছেন সুধীন্দ্রনাথ। এলিয়টের ‘ফাঁপা মানুষ’কে তিনি দেখেছেন উটপাখির চিত্রকল্পের সাহায্যে। ফাঁপা মানুষ যেন উটপাখির মতোই বালিতে মুখ গুঁজে চেষ্টা করছে আত্মরক্ষার। এ সময় শুধু বন্ধ্যা নয়, মানুষের চেতনাও বন্ধ্যাত্ব পেয়েছে। এ সময়ে-
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবেনা আগাগোড়া।
(উটপাখী)
এ যদি সময়চেতনায় বার্তাবহন করে, তবে আমাদের মেনে নিতে হবে সুধীন্দ্রনাথের নিজস্ব দাবি- “অনন্তপক্ষে আমার লেখায় আধুনিক যুগের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট” (সংবর্ত-র মুখবন্ধ)। আর এই দাবি থেকে এও স্পষ্ট যে দেশ ও কালের চিহ্ন নির্ণয়ে তাঁর কী সজাগ সৃষ্টি ছিল। তিনিই বলেছেন- “এলিয়ট কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছেন; এবং আমিও মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয়মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের চরম সার্থকতা।” শুধু জাতীয় মানস নয়, বিশ্বমানস যেন কথা বলেছে সুধীন্দ্রনাথের কবিতায়।
ক। বুঝি উদ্ঘাট দ্বার নরকের;
যত তৃষিত পিশাচ মড়কের,
তারা মেতেছে গাজনে চড়কের;
সারা বিশ্বের স্থিতি টুটেছে। (অর্কেস্ট্রা)
খ। ভগবান, ভগবান, য়িহুদির হিং¯্র ভগবান
ভুলেছ কি আজি দুঃশাসনে?
ধেয়ে এসো রুদ্র রোষে, ধেয়ে এসো উন্মত্ত হুংকারে। (প্রত্যাখান)
গ। সভ্যতার রক্তলিপ্সা হয়ে গেছে আজ কানাকানি;
আদর্শের দৈববাণী প্রতিধ্বনি প্রবৃত্তিগুহার। (প্রতীক)
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের তীব্র শাসন সুধীন্দ্রনাথ মেনে নিয়েছেন, দুষ্ট সময়ের ক্ষতগুলিতে ধরে রেখেছেন তাঁর কবিতায়, আর এক নিরীশ্বর, অবিশ্বাসী মন দিয়ে নির্ণয় করতে চেয়েছেন গভীরতা। সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় বিষাদ ও নৈরাজ্য শুধু কবিমানসজাত নয়, তীব্রভাবে তা সমকালের।
৩.
দেশ ও কালের চৈতন্য একদিকে, আর অন্যদিকে আত্মঅনুসরণ। একদিকে নাস্তি দর্শন, অন্যদিকে স্বপ্নচারণ। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে মৃত্যু, শুধুই মৃত্যুর কথা। বস্তুত, সমমিলিয়েই কবিমনীষার সত্যনুসন্ধানের ইতিকথা। আর এটাই সুধীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিকৃতি।
‘সংবর্ত’-র নন্দীমুখ শুরু হয়েছে এইভাবে-
তোমার যোগ্য গান বিরচিব ব’লে
বসেছি বিজনে, নব নীপবনে
পুষ্পিত তৃণদলে।
অথচ তপ্ত, সংক্ষুব্ধ সময়কাল তাঁর কাব্যনায়িকাকে প্রতিস্থাপন করছে যেন তারই সবসময়ের অস্থির প্রেক্ষাপটে। একাকার হয়ে যায় প্রেম, প্রকৃতি ও সমকাল। প্রকৃতির হিং¯্রতার মতোই ইতিহাসের হিংস্রতা দুর্যোগের মতো ধেয়ে আসে। তখন ‘কী নাম শুধাই উত্তর নাই, ঝরে শুধু বারিধারা।’
আসন্ন প্রলয় :
মৃত্যুভয়
নিতান্তই তুচ্ছ তার কাছে
সর্বস্ব ঘুচিয়ে যারা ব্যবচ্ছিন্ন দেহে আজও বাঁচে
একমাত্র মুমুর্ষাই তাদের নির্ভর। (উজ্জীবন)
যুদ্ধ, রাজনৈতিক বিদ্বেষ ‘যে-ব্যাপক মাৎসন্যায়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম’, তার সঙ্গে অকাট্য সম্পর্কে বাঁধা পড়েছেন ‘সংবর্তে’র কবি। ফলস্বরূপ ‘বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি’, ‘তরণী, শতচ্ছিদ্র,’ ‘চাঁদ কাস্তে হল,’ ‘অশনি,’ ‘বিমানের ব্যুহ,’ ‘জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত অতীন্দ্রিয় ভাবনানিচয়’ ও ‘যুদ্ধগামী বর্বর’। সমকালের স্বাক্ষর মুদ্রিত হতে লাগল প্রতিটি কবিতায়।
১. মুখে একবার তাকায়ে নির্ণিমেষে,
শূণ্যোদ্ভব দেব, না দানব,
আবার শূন্যে মেশে।
বুঝি তারা শুধু কুজ্বাটিকার চাতুরী:
তবু তুলনায় ধন্দ জাগায় মাথুরই;
প্রতীকপ্রতিম তাদের কাস্তে, হাতুড়ি
ফসল মুড়ায়, মানমন্দির পেষে।
মূর্ত নিষেধ, মূক নির্বেদ
তাকায় নির্ণিমেষে।” (নান্দীমুখ)
২. অবসৃত ভগবান; অস্তাচলে রক্তাক্ত অঙ্গার;
অরাজক চরাচরে প্রত্ন প্রতিহিংসায় প্রতুল:
অতিদৈব বিবর্তনে মনুষ্যই যেহেতু অতুল,
তাই সে আত্মহা আজ, তার ধর্ম আত্মীয়সংহার।। (জাতক ১)
৩. অথচ প্রত্যহ শুনি চার্চিলের স্বেচ্ছাচার বিনা
অসাধ্য সা্ম্রাজ্যরক্ষা, অব্যর্থ প্রলয়
এবং যে-ব্যক্তিস্বত্ব সভ্যতার সম্মত আশ্রয়,
তারও অব্যাহতি নেই অপঘাত থেকে:
একা হিটলারের নিন্দা সাধে আজ বাধে কি বিবেক? (সংবর্ত)
সর্বব্যাপী বিনাশের সামনে মানুষের সবরকম আস্থাই দুর্বল হয়ে পড়ে, অবলুপ্ত হয়ে যায়। টি এস এলিয়টকে অবশ্য শেষের দিকে ধর্ম ও রাজতন্ত্রের মহিমায় ডুবে যেতে দেখি। অথচ অনড় সুধীন্দ্রনাথ সুতীব্র অথচ সংহত আক্রমণ শাণিত করেন রাজনৈতিক লিপ্সা, ফ্যাসিবাদ, সাম্যবাদসহ যে কোনো একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে।
আশ্রুত তারক
অন্যত্রও অনাগত, জাতিভেদে বিবিক্ত মানুষ
নিরঙ্কুশ একমাত্র একনায়কেরা। কিন্তু তারা
প্রাচীর, পরিখা, রক্ষী, গুপ্তচরঘেরা প্রাসাদেও
উন্নিদ্র যেহেতু, তাই ভগ্ন সেতু নদীতে নদীতে
মরু নগরে নগরে। (যযাতি)
সংবর্ত বা প্রলয়ের মেঘ চারদিকে, বিভ্রান্ত মানুষ, বিভ্রান্ত মানবাত্মা। উত্তরণের কোনো পথ মানুষের সামনে নেই। ‘সংবর্ত’র কবিকে তাই লিখতে হয়-
অন্তর্হিত আজ অন্তর্যামী:
রুষের রহস্যে লুপ্ত লেনিনের মামি,
হাতুড়ি নিষ্পিষ্ট ট্রটস্কি, হিটলারের সুহৃদ স্টালিন,
মৃত স্পেন, ম্রিয়মান চীন,
কবন্ধ পরাসীদেশ।
অথচ এর মধ্যেই নিভৃতে ছিল কবির এক স্বপ্নের বাসভূমি, যেখানে তাঁর-
যৌবরাজ্য- ব্যোমযান, কামান পদাতি
যে রাষ্ট্রের অঙ্গ নয়; ন্যায়, ক্ষমা, মিতালী, মনীষা
যার মুখ্য অবলম্বন, জিজীবিষা
সামান্য লক্ষণ।
এই সব কিছু ঘটে, কারণ কবি জানেন ‘মানবেতিহাসে মাঝে মাঝে আসে মলমাস, কর্মচ্যুত পৃথিবী যখন উন্মার্গ ঘুমের ঘোরে......’। কিন্তু যুদ্ধ যে গভীর ছাপ রেখে যায় তার কী হবে? বেদনাকীর্ণ কণ্ঠে কবিকে বলতে হয়-
শূন্যে ঠেকেছে লাভে লোকসানে মিলে,
ক্লান্তির মতো শান্তিও অনিকাম।
এরই আয়োজন অর্ধশতক ধরে,
দু’দুটো যুদ্ধে, একাধিক বিপ্লবে;
কোটি কোটি শব পচে অগভীর গোরে,
মেদিনী মুখর এক নায়কের স্তবে! (১৯৪৫)

৪.
কোনো কবিই দেশ ও কালের পরিধির বাইরের অধিবাসী হতে পারেন না। সুধীন্দ্রনাথও মেনে নিয়েছেন এই সময়সীমা ও পরিধিকে। যে নৈরাশ্যের ভাবনা ছিল তাঁর কাব্যমানসজাত, সমকালের অবিশ্বাস ও সংবর্তের ছায়া তাকে আরো দৃঢ় ও সংহত করেছে। কবিমানসের এই বিভেদের জন্যই সমসাময়িক কবি বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, এমনকি জীবনানন্দ দাশও এতবেশি সময়তাড়িত হননি। তাই বুদ্ধদেব রাবীন্দ্রিক মুগ্ধতায় নান্দনিক থেকেছেন, বিষ্ণু দে আবদ্ধ থেকেছেন বিশ্বাসের নিগড়ে, আর অমিয় চক্রবর্তী খুঁজতে চেয়েছেন দ্বন্দ্বপূর্ণ হলেও এক অধ্যাত্মবোধের জগৎ। ‘অদ্ভুদ আঁধার,’ ‘মৃত্যু, আর চির ক্লান্তির কথা বললেও জীবনানন্দ স্বপ্ন ও প্রত্যাশার কাছে ঋণী থেকেছেন, আর সুধীন্দ্রনাথ এস্ত হয়েছেন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন এই অদ্ভুদ সময়ের কাছে, ঝরে পড়েছে ‘অগ্রজের অটল বিশ্বাস’। অথচ এই ভগ্নবিশ্বাসের পটভূমিতে দাঁড়িয়েও কবি সুধীন্দ্রনাথ তাঁর উপলব্ধির প্রকাশভঙ্গিতে অব্যর্থ-কবিতার সযতœ নির্মাণে তৎপর ও নিষ্ঠাবান। চারপাশের পৃথিবী ভেঙে পড়ার শব্দকে শিল্পের অভিনিবেশে শব্দে ধারণ করেছেন। তাই সমসাময়িক ঘড়ির কাঁটার দিকে তাঁর সজাগ লক্ষ্য তাঁকে মহাকালের শিল্পীসত্তা থেকে বঞ্চিত করেনি। নিজের দেশ ও সময়েই শুধু বাঁধা পড়েননি বলেই আজও সুধীন্দ্রনাথ এত অমোঘ ও প্রাসঙ্গিক।

Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে

NAZRUL ISLAM MAZUMDER : THE CHOICE OF THE TIME (a biography)

NAZRUL ISLAM MAZUMDER The choice of the time “The purpose of a business is to create a customer who creates customers.” -          Shiv Shing # NASSA GROUP # 30,000 employees #EXIM Bank # 3,000 employees And so on……….. A Biography By OMAR KHALED RUMI M. Sc., MBA, LL.B     ...................................................... “Patience, persistence and perspiration make an unbeatable combination for success.”    - Napoleon Hill   ...................................................... Prlogue Like another man Nazrul Islam Mazunder is also a man. But, how he has made some stories of success. Why people consider him as a special. Why he is applaused as Philanthropic in mind, dynamic in thinking, far-sighted in vision. There must some reasons. The reason is what he wanted himself he has been now. Mazumder, a conglomerate icon, in no way, a trifle name. His success, over years, mak