Skip to main content

Fabricare receipt 01 08 2024

কারবালা- ২০১৬

খালের গা ঘেষেই গ্রামের একমাত্র পাকা রাস্তা। এই রাস্তা ধরে উপজেলা শহর থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের পথ গেলেই সুলতানের বাড়ী। ছোট্ট ছিমছাম। সুলতানের রুচি বোধের ছাপ যে তার আর্থিক অসঙ্গতিকে ছাপিয়ে গেছে তা বাড়ীতে ঢুকলেই বোঝা যায়। সাদামাটা ধরনের। কিন্তু সবকিছু পরিপাটি। সুলতানের এখন বয়স হয়েছে। গুনে গুনে এবার সে সত্তরে পা রাখলো। সুলতানের স্ত্রী রাবেয়ারও কম বয়স না। কিন্তুু গাও গেরামের খেঁটে খাওয়া মানুষ। সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করে। তাই শরীর স্বাস্থ্যও ভালো আছে। রাবেয়া নিজের হাতেই সবকিছু গুছিয়ে রাখে।
সুলতান নিঃসন্তান। কিন্তু এই নিয়ে তার তেমন কোনো আফসোস নেই। সবই আল্লাহ্র হুকুম। আল্লাহ্ চাইলে তাদেরও তো হতে পারতো। নিঃসন্তান রাবেয়া অবশ্য মাঝে মাঝে গভীর গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে। তার ভয় ছিলো সন্তান না হওয়ার কারণে সুলতান হয়তো তাকে বিদায় করে দেবে। কিন্তু সুলতান অন্যরকম মানুষ। এ নিয়ে রাবেয়াকে কখনও খোঁটা দেয়নি। 
সুলতানের বয়স যখন পঁচিশ বছর তখন মু্িক্তযুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তুু সুলতানের কাছে এটা নতুন কিছু ছিলো না। কারণ অনেক আগে থেকেই সে কমবেশি রাজনীতির সাথে জড়িত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার জন্যে এলাকা থেকে সামান্য যে কয়জন লোক ঢাকায় গিয়েছিলো সুলতান তাদের অন্যতম। সুলতান তাই মনে মনে প্রস্তুত ছিল। এবার যে একটা কিছু হতে যাচ্ছে তা সুলতান ভালো করেই জানত। রাবেয়াকেও সে সবকিছুই জানিয়ে রেখেছিলো।
বছর দুয়েক আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। তাদের মধুর সম্পর্ক যখন দিনে দিনে বাড়ছিলো তখনই এলো যুদ্ধের ডাক। ২৫শে মার্চের রাতের হামলা সুলতানকে অস্থির করে তুলল। ২৬শে মার্চ বিকালে তারা বাজারের মাঠে জড়ো হলো। প্রাথমিক আলোচনা শেষে সবাই যার যার মতো বিদায় নিলো। রাবেয়া রাতে জিজ্ঞাসা করলো কি কথাবর্তা হলো। সুলতান শুধু বলল, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাকে যুদ্ধ যেতে হবে।
কয়েকটা দিন দেখতে দেখতে কেটে গেলো। ইতোমধ্যে অবশ্য প্রস্তুতিও শেষ। এবার বর্ডার পার হয়ে ওপারে যেতে হবে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধ। সুলতানের চেহারায় প্রেম আর দ্রোহের যুগপৎ ঘাম শেষ বিকেলের পড়ন্ত রৌদ্রে চিকচিক করছিল। আমি কি তবে রাবেয়াকে হারাতে যাচ্ছি। অবশ্য দেশকে ফিরে পেতে গেলে কিছুতো হারাতে হবে।
একদিন বিকেলে রাবেয়া বাপের বাড়ী চলে যায়। গভীর রাতে সুলতান ঘর ছাড়ে। তারপর পুরোটাই ইতিহাস।
বর্ডার পেরিয়ে সুলতান যখন ওপারে পৌঁছায় তখন ওখানেও লোকের ভীড় জমে গেছে। সুলতান অবাক হয় এতো লোক দেশ ছেড়েছে দেখে। যুদ্ধ কি তবে শুধু ঘরেই নয় বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। সুলতান ভেবে উঠতে পারে না দেশের ভবিষ্যত কি হবে।
প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নতুন জীবন শুরু হয় সুলতানের। খেটে খাওয়া ঘর সংসারী মানুষ হঠাৎ করেই নিজেকে দেখতে পায় সৈনিকের বেশে। সুলতান নিজেই যেন নিজেকে চিনতে পারে না। যুদ্ধ আসলে অনেক কিছু বদলে দেয়। মাস দেড়েকের ট্রেনিং শেষে সুলতান তার সঙ্গীদের সাথে নিজ দেশের সীমানার ভেতর ঢুকে পড়ে।
এই প্রথম সম্মুখে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। সুলতানের সাহস তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সবাই জানে মৃত্যু একবারই হবে। কিন্তু তবুও মৃতুর মুখোমুখি হতে ভয় হয়। ভয় কিছুটা সুলতানেরও লাগে। তবুও এগিয়ে যায়। দেশকে মুক্ত করতে হবে। যুদ্ধ হয় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে। প্রায় নয় মাস যুদ্ধের অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর বাড়ী ফেরে সে। বাপের বাড়ী থেকে রাবেয়া ছুটে আসে। সুলতানের মুখের দিতে তাকিয়ে রাবেয়া তার সব কষ্ট ভুলে যায়। এই নয় মাস সে শুধু একটাই দোয় করেছে, হে আল্লাহ, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও সুলতানকে রক্ষা করেন। আমার আয়ু দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখেন।
বিজয়ী সুলতান তখন অনেকের কাছে হিরো। কিন্তু সুলতান আগের মতোই স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করে। যুদ্ধ জয়ের কোন ওদ্ধত্য যেন তার চেহারায় ফুটে না ওঠে। সুলতান বরাবরই এরকম। কিন্তু চারপাশের পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই হিং¯্র হয়ে ওঠে। সুযোগ বুঝে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে রাজাকাররাও। অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা যায় পুরনো বৈরী ভুলে রাজাকারদেরই পুনর্বাসন করছে। সুলতানের স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেতে থাকে। সে সাধারণত কম কথা বলে। সব কিছু দেখে শুনে একদিন রাবেয়াকে ভীষন আফসোস করে শুধু বলে, এসব কি হচ্ছে রাবেয়া?
দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে যায়। হঠাৎ করে রক্ষী বাহিনী আসে সুলতানের বাড়ীতে। তারা জানতে চায় তার কাছে কি কি যন্ত্রপাতি আছে। সুলতান স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তার কাছে কোন যন্ত্রপাতি নেই। তার অস্ত্র সে যথা সময়ে জমা দিয়ে এসেছে।
বাকশাল কায়েম হয়। প্রথম দিকটায় ব্যাপারটা সুলতানের কাছে দুর্বোধ্য লাগে। আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে বাকশাল কেন। আস্তে আস্তে সুলতানের কাছে পরিস্কার হয় ’৭০ এর বাংলাদেশ আর ’৭৪ এর বাংলাদেশে অকেন পার্থক্য। এতদিনে বাংলাদেশ সাবালিকা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসে ১৫ই আগষ্ট। সুলতানের মাথায় ঢোকে না এটা কি হলো। মানুষ এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে। যে জাতি তার জন্মদাতাকে হত্যা করতে পারে তার মন মানসিকতা কতোটা নীচু হতে পারে। সুলতান নির্বাক বসে থাকে। সে বুঝে উঠতে পারে না দেশ কোথায় যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে তার কাছে মনে হয় যুদ্ধ করা এখন একটা অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বিরোধিতা করেছিল আর যারা যুদ্ধের সময় লুটপাট করেছে তারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা আজ যেন দেশ ও জাতির লজ্জা।
তবে এই নিয়েও তার কোনো আফসোস নেই। কষ্ট লাগে যখন বাইরে বেরোলে সবাই এ নিয়ে হাসাহাসি করে। দাত কেলিয়ে বলে, কি ব্যাপার সুলতান ভাই, যুদ্ধ করে কি স্বাধীনতা আনলেন। এখন দেখছি চোর আর পুলিশ এক ঘাটে জল খাচ্ছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটছে। মাঝখান থেকে আপনারাই বাদ পড়লেন।
কষ্টে সুলতানের দম বন্ধ হয়ে আসে। এই কথার কোনো জবাব তার কাছে নেই। সুলতান আর রাবেয়ার জীবনে দেখতে দেখতে অজ¯্র বছর কখন যে কেটে যায় তা যেন তাদের দুজনের কেউই টের পায় না।
হঠাৎ করেই আশার আলো দেখতে শুরু করে সুলতান। তার নিজের জন্যে নয়। দেশের জন্যে। ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে কেন জানি পুরো দেশ স্বাধীনতার ২৫ বছর পর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সুলতানও তাদের একজন।
প্রথম যাত্রায় কিছু আশা বাস্তবায়ন হলেও অনেক কিছুই অধরা থেকে যায়। সুলতানের স্বপ্ন আবার হোঁচট খায়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ হেরে যায়। অনেক অসমাপ্ত কাজ পড়ে থাকে।
স্বপ্ন আবারও ধরা দেয় নতুন করে ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ যখন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যে সরকার গঠন করে। এবার আর ছন্দ পতন হয় না। দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। সুলতানও এই বয়সে এসে কেমন জানি একটা নতুনত্ব অনুভব করতে থাকে।
২০১৪ সালে এসে আওয়ামী লীগ তৃতীয় বারের মতো সরকার গঠন করলে দেশের মানুষ যেন নতুন করে ভাবতে শুরু করে। উন্নয়ন আর রাজনীতি ভিন্ন মাত্রা পায়। আজীবনের নিরপেক্ষ সুলতান এই বয়সেও নতুন উদ্দীপনায় রাজনীতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে থাকে।
দেখতে দেখতে ২০১৬ সাল চলে আসে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নির্বাচন। সুলতানের কাছের মানুষেরা তাকে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে বলে। সুলতান শুরুতে না করলেও পরে সবার অনুরোধে রাজী হয়।
নির্বাচন জমে ওঠে। সুলতানকে ঠেকাতে প্রতিপক্ষ একের পর এক মিথ্যা প্রচারনার আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ যে অভিযোগটি আসে তা সুলতানের জন্যে সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত। সে নাকি মুক্তিযোদ্ধা নয়। প্রতিপক্ষ এই অভিযোগ তুলে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন জানায়। সুলতানের বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। সেই কান্নার দমক আর থামে না। আহত সুলতান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। খবর শুনে রাবেয়াও ছুটে আসে। ততক্ষনে সব শেষ।

Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে

NAZRUL ISLAM MAZUMDER : THE CHOICE OF THE TIME (a biography)

NAZRUL ISLAM MAZUMDER The choice of the time “The purpose of a business is to create a customer who creates customers.” -          Shiv Shing # NASSA GROUP # 30,000 employees #EXIM Bank # 3,000 employees And so on……….. A Biography By OMAR KHALED RUMI M. Sc., MBA, LL.B     ...................................................... “Patience, persistence and perspiration make an unbeatable combination for success.”    - Napoleon Hill   ...................................................... Prlogue Like another man Nazrul Islam Mazunder is also a man. But, how he has made some stories of success. Why people consider him as a special. Why he is applaused as Philanthropic in mind, dynamic in thinking, far-sighted in vision. There must some reasons. The reason is what he wanted himself he has been now. Mazumder, a conglomerate icon, in no way, a trifle name. His success, over years, mak