আমরা ছয় ভাই-বোন। বলতে গেলে পিঠাপিঠি। মাঝখানে তিন চার বছরের ব্যবধান। বলতে গেলে ছোট খাটো একটা দল। বাবা, মা আমাদের দল বেঁধে মাজারে নিয়ে যাচ্ছে। বাগের হাটের খান জাহান আলীর মাঝার। আমরা যাচ্ছি নৌকায় করে। মঝি দিন ক্ষণ, জোয়ার ভাটা সব ঠিকঠাক করে নিলো। আমরা যথাসময়ে রওয়ানা হলাম। কয়েকদিন নৌকাতে থাকতে হবে। ভালোই লাগছে বলতে হবে।
জোয়ার আর ভাটার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে নৌকা চলছে। এছাড়া উপায় নেই। খরস্রোতা নদী। স্রোতের বিপরীতে চলা প্রায় অসম্ভভ। নদীতে মাঝে মাঝে তুফান, জলের ঘোলা, মাঝি শক্ত হাতে বৈঠা ধরছে। তবুও একবার নৌকা ডোবার উপক্রম হলো। মা আয়াতুল কুরসী পড়ে সবার গায়ে ফুঁক দিলেন। বিপদ কেটে গেলে আমরা হাসলাম। মাঝির নামে তোফাজ্জল। সে এলাকার সেরা মাঝি। তবুও তাকে বেগ পেতে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে স্রোত আর তুফানের কাছে তাকে অসহায় লাগছিল।
মাঝারে পৌঁছে প্রথমে দোয়া করা হলো। আমরা বলতে গেলে সবাই ছোট। বাবা মা দোয়া করলেন। আমরা হাত তুল যোগ দিলাম। অতঃপর বিরাট দিঘীতে গোসল করা জন্যে। তারপর শখের জিনিসের কেনাকাটা। সময় খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। মাঝখানে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। বাগেরহাট ছোট শহর। সেই ছোট শহরেই আমরা তিন ভাই বোনের একটা ছোট দল ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাকীদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। হারিয়ে গিয়ে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলাম। অবশ্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাবা মা আমাদের খুঁজে বের করে ফেললো। অতঃপর মৃদু বকাঝকা। এসবে তখন খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। ঘোরার মজাই আলাদা।
পরের বছর বাবার সাথে একাই রওয়ানা হলাম। গন্তব্যস্থল বরিশাল। শীতের ঘন কুয়াশা ঢাকা ভোরে প্রয় চার মাইল হেঁেেট গিয়ে তারপর কাঠের এক তলা লঞ্চ। লঞ্চের নাম চরদোয়ানী। সেই লঞ্চ অবিরাম আওয়াজ তুলে সারাটা দিন চলল। মাঝখানে কিছু কিছু ঘাটে ভিড়ল। তারপর সন্ধ্যা গড়িযে রাত। চোখ যখন ঘুম ঘুম ভাব তখনই আলোকজ্জল বরিশাল শহর দৃষ্টিগোচর হলো। আমার বড় ভাইয়ের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় নয়টা। ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। জীবনে এই প্রথম কোন বড় শহরে এলাম।
এখানে এসে অনেক কিছু দেখলাম। রেডিওর সাথে পরিচয় হলো। নতুন জামা কাপড় পেলাম। বড় ভাই বাড়ীর জন্য একটা রেডিও কিনে দিলেন। ন্যাশনাল রেডিও। সার্ভিস ভালো। সবকিছু স্পষ্ট শোনা যায়।
কয়েক দিন শহরে বেরিয়ে আবারও সেই লঞ্চ যোগে বাড়ী ফেরা। একটা ভ্রমন যেন আমাকে অনেকটা বড় করে দিলো। আট বছরের একটা শিশুর জন্যে এটা সত্যিই দারুন একটা বিজয়। জীবনের জন্যে এর প্রভাব অনেক অনেক বেশী।
পরের বছর পরীক্ষা শেষ করে আবারও ভ্রমন। এবার গেলাম নানা বাড়ী। সন্ধ্যার পর পরই রওয়ানা হলাম। আমার জন্যে দীর্ঘ পথই বলতে হবে। টানা নয় মাইল। নয় বছর বয়সের একটা বাচ্চার জন্যে এই পথ হাঁটা কষ্টসাধ্য নয়। তবুও এই পথ পাড়ি দেওয়া খুব বেশি কঠিন মনে হচ্ছে না। কারণ আর কিছু নয়। বাবার সাথে যাচ্ছি। এই যাওয়ার আনন্দই আলাদা।
সন্ধ্যার পর হাল্কা একটু অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তারপর যত পথ পড়ি দিচ্ছিলাম জ্যোৎ¯œা ততই প্রবল হচ্ছিল। এক সময় চারিদিক ধব ধবে সাদা মনে হচ্ছিল। আমি কিছুটা পথ হাঁটছিলাম। কিছুটা পথ বাবার কাঁধে চড়ছিলাম।
গ্রাম পেরিয়ে খোলা মাঠ। সেই মাঠের মাঝখান চিড়ে সাপের শরীরের মতো আঁকা, বাঁকা রাস্তা। যতদৃর চোখ যায় ধূধূূ মাঠ। এখানে উন্মুক্ত মাঠ আর খোলা আকাশের নিচে জ্যোৎ¯œার প্লাবনে সব কিছু মিলেমিশে একাকার।
বলার অপেক্ষা রাখে না এখন শীতকাল। মাঠের ফসল উঠে গেছে। মাঠ শুষ্ক। সেই মাঠে রবি শস্য চাষ করার আয়োজন চলছে। এই দৃশ্য আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেদিনের জ্যোৎ¯œা ভেজা ভ্রমনে এই সব চিরচেনা দৃশ্যেরও ভিন্ন একটা গভীর তাৎপর্যপূর্ন অর্থ দাঁড়িয়ে গেলো। নয় বছর বয়সের একটা শিশুর কাছে পুরো পরিবেশটা একটা অন্যতম আবেগ নিয়ে ধরা দিলো। আমরা এভাবেই বেড়ে উঠি।
নানা বাড়ীতে শীতকালীন বেড়ানোর পাশাপাশি সার্কাস দেখা যাবে। টানা সাত দিন ব্যাপী আয়োজন। সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা আরও কত কি? সেই সাথে হাতি দেখার আনন্দ। পরদিন থেকেই শুরু হবে। মনের ভেতর অন্যরকম একটা অস্থিরতা। আমি যেন ভেতরে ভেতরে আনন্দে ভেসে যাই।
নানা বাড়িতে দিনভর আনন্দ। সন্ধ্যার পর পরই চলে যাই সার্কাসের মাঠে। বিখ্যাত লক্ষণ দাসের সার্কাস। বিরাট বিরাট হাতি বাঁধা রয়েছে প্যান্ডেলের থেকে কিছুটা দূরে। সেই হাতি বড় বড় কলাগাছ শুর দিয়ে ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে খাচ্ছে। কলাগাছের মতো অর্থহীন একটা জিনিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার দেখলাম। একরাতে সার্কাস দেখি তো অন্যরাতে পুতুল নাচ। পরের রাতে আবার যাত্রাপালা। তারপর একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোটর সাইকেলের খেলা। দেখতে দেখতে সাতটা দিন কেটে যায়। আকাশের বুকে জ্যো¯œা ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসে। আমারও অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অন্য রকম অস্থিরতা। বাড়ী ফেরার তাড়া। মায়ের কোলে ফেরার অধীরতা। সার্কাসের বিনোদনও এক সময় ফিকে হয়ে আসে।
পরের শীতে আবারও বাবার সাথে ভ্রমনের আয়োজন। এবার মংলা বন্দর। সেখানে বন্দরের কাছাকাছি ছোট্ট শহরতলীতে আমার এক ফুফু বসবাস করে। তার বাসায় উঠলাম। জীবনে প্রথম এতো বড় জাহাজ দেখলাম। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আনন্দে বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। এখানে এসে একটা অদ্ভুত জিনিস খেলাম। ফুফুর হাতের করল্লা ভাজি। করল্লা যে তিতা এটা প্রমান করাই কষ্ট।
বাবা মার সাথে এমনি অজ¯্র ভ্রমনে জ্যোৎ¯œা দেখার ভাগ্য আমার হয়েছে। আমার বাবা মা আজও বেঁচে আছেন। এখনও গ্রামের বাড়ীতে গেলে তাদের সাথে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যখন জ্যোৎ¯œা দেখি মনে হয় জীবনের চুয়াল্লিশটি বছর মাত্র একটা ছোট্ট স্বপ্ন।
জোয়ার আর ভাটার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে নৌকা চলছে। এছাড়া উপায় নেই। খরস্রোতা নদী। স্রোতের বিপরীতে চলা প্রায় অসম্ভভ। নদীতে মাঝে মাঝে তুফান, জলের ঘোলা, মাঝি শক্ত হাতে বৈঠা ধরছে। তবুও একবার নৌকা ডোবার উপক্রম হলো। মা আয়াতুল কুরসী পড়ে সবার গায়ে ফুঁক দিলেন। বিপদ কেটে গেলে আমরা হাসলাম। মাঝির নামে তোফাজ্জল। সে এলাকার সেরা মাঝি। তবুও তাকে বেগ পেতে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে স্রোত আর তুফানের কাছে তাকে অসহায় লাগছিল।
মাঝারে পৌঁছে প্রথমে দোয়া করা হলো। আমরা বলতে গেলে সবাই ছোট। বাবা মা দোয়া করলেন। আমরা হাত তুল যোগ দিলাম। অতঃপর বিরাট দিঘীতে গোসল করা জন্যে। তারপর শখের জিনিসের কেনাকাটা। সময় খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। মাঝখানে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। বাগেরহাট ছোট শহর। সেই ছোট শহরেই আমরা তিন ভাই বোনের একটা ছোট দল ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাকীদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। হারিয়ে গিয়ে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলাম। অবশ্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাবা মা আমাদের খুঁজে বের করে ফেললো। অতঃপর মৃদু বকাঝকা। এসবে তখন খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। ঘোরার মজাই আলাদা।
পরের বছর বাবার সাথে একাই রওয়ানা হলাম। গন্তব্যস্থল বরিশাল। শীতের ঘন কুয়াশা ঢাকা ভোরে প্রয় চার মাইল হেঁেেট গিয়ে তারপর কাঠের এক তলা লঞ্চ। লঞ্চের নাম চরদোয়ানী। সেই লঞ্চ অবিরাম আওয়াজ তুলে সারাটা দিন চলল। মাঝখানে কিছু কিছু ঘাটে ভিড়ল। তারপর সন্ধ্যা গড়িযে রাত। চোখ যখন ঘুম ঘুম ভাব তখনই আলোকজ্জল বরিশাল শহর দৃষ্টিগোচর হলো। আমার বড় ভাইয়ের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় নয়টা। ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। জীবনে এই প্রথম কোন বড় শহরে এলাম।
এখানে এসে অনেক কিছু দেখলাম। রেডিওর সাথে পরিচয় হলো। নতুন জামা কাপড় পেলাম। বড় ভাই বাড়ীর জন্য একটা রেডিও কিনে দিলেন। ন্যাশনাল রেডিও। সার্ভিস ভালো। সবকিছু স্পষ্ট শোনা যায়।
কয়েক দিন শহরে বেরিয়ে আবারও সেই লঞ্চ যোগে বাড়ী ফেরা। একটা ভ্রমন যেন আমাকে অনেকটা বড় করে দিলো। আট বছরের একটা শিশুর জন্যে এটা সত্যিই দারুন একটা বিজয়। জীবনের জন্যে এর প্রভাব অনেক অনেক বেশী।
পরের বছর পরীক্ষা শেষ করে আবারও ভ্রমন। এবার গেলাম নানা বাড়ী। সন্ধ্যার পর পরই রওয়ানা হলাম। আমার জন্যে দীর্ঘ পথই বলতে হবে। টানা নয় মাইল। নয় বছর বয়সের একটা বাচ্চার জন্যে এই পথ হাঁটা কষ্টসাধ্য নয়। তবুও এই পথ পাড়ি দেওয়া খুব বেশি কঠিন মনে হচ্ছে না। কারণ আর কিছু নয়। বাবার সাথে যাচ্ছি। এই যাওয়ার আনন্দই আলাদা।
সন্ধ্যার পর হাল্কা একটু অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তারপর যত পথ পড়ি দিচ্ছিলাম জ্যোৎ¯œা ততই প্রবল হচ্ছিল। এক সময় চারিদিক ধব ধবে সাদা মনে হচ্ছিল। আমি কিছুটা পথ হাঁটছিলাম। কিছুটা পথ বাবার কাঁধে চড়ছিলাম।
গ্রাম পেরিয়ে খোলা মাঠ। সেই মাঠের মাঝখান চিড়ে সাপের শরীরের মতো আঁকা, বাঁকা রাস্তা। যতদৃর চোখ যায় ধূধূূ মাঠ। এখানে উন্মুক্ত মাঠ আর খোলা আকাশের নিচে জ্যোৎ¯œার প্লাবনে সব কিছু মিলেমিশে একাকার।
বলার অপেক্ষা রাখে না এখন শীতকাল। মাঠের ফসল উঠে গেছে। মাঠ শুষ্ক। সেই মাঠে রবি শস্য চাষ করার আয়োজন চলছে। এই দৃশ্য আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেদিনের জ্যোৎ¯œা ভেজা ভ্রমনে এই সব চিরচেনা দৃশ্যেরও ভিন্ন একটা গভীর তাৎপর্যপূর্ন অর্থ দাঁড়িয়ে গেলো। নয় বছর বয়সের একটা শিশুর কাছে পুরো পরিবেশটা একটা অন্যতম আবেগ নিয়ে ধরা দিলো। আমরা এভাবেই বেড়ে উঠি।
নানা বাড়ীতে শীতকালীন বেড়ানোর পাশাপাশি সার্কাস দেখা যাবে। টানা সাত দিন ব্যাপী আয়োজন। সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা আরও কত কি? সেই সাথে হাতি দেখার আনন্দ। পরদিন থেকেই শুরু হবে। মনের ভেতর অন্যরকম একটা অস্থিরতা। আমি যেন ভেতরে ভেতরে আনন্দে ভেসে যাই।
নানা বাড়িতে দিনভর আনন্দ। সন্ধ্যার পর পরই চলে যাই সার্কাসের মাঠে। বিখ্যাত লক্ষণ দাসের সার্কাস। বিরাট বিরাট হাতি বাঁধা রয়েছে প্যান্ডেলের থেকে কিছুটা দূরে। সেই হাতি বড় বড় কলাগাছ শুর দিয়ে ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে খাচ্ছে। কলাগাছের মতো অর্থহীন একটা জিনিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার দেখলাম। একরাতে সার্কাস দেখি তো অন্যরাতে পুতুল নাচ। পরের রাতে আবার যাত্রাপালা। তারপর একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোটর সাইকেলের খেলা। দেখতে দেখতে সাতটা দিন কেটে যায়। আকাশের বুকে জ্যো¯œা ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসে। আমারও অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অন্য রকম অস্থিরতা। বাড়ী ফেরার তাড়া। মায়ের কোলে ফেরার অধীরতা। সার্কাসের বিনোদনও এক সময় ফিকে হয়ে আসে।
পরের শীতে আবারও বাবার সাথে ভ্রমনের আয়োজন। এবার মংলা বন্দর। সেখানে বন্দরের কাছাকাছি ছোট্ট শহরতলীতে আমার এক ফুফু বসবাস করে। তার বাসায় উঠলাম। জীবনে প্রথম এতো বড় জাহাজ দেখলাম। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আনন্দে বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। এখানে এসে একটা অদ্ভুত জিনিস খেলাম। ফুফুর হাতের করল্লা ভাজি। করল্লা যে তিতা এটা প্রমান করাই কষ্ট।
বাবা মার সাথে এমনি অজ¯্র ভ্রমনে জ্যোৎ¯œা দেখার ভাগ্য আমার হয়েছে। আমার বাবা মা আজও বেঁচে আছেন। এখনও গ্রামের বাড়ীতে গেলে তাদের সাথে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যখন জ্যোৎ¯œা দেখি মনে হয় জীবনের চুয়াল্লিশটি বছর মাত্র একটা ছোট্ট স্বপ্ন।
Comments
Post a Comment