Skip to main content

Fabricare receipt 01 08 2024

জ্যোৎ¯œা ও জনকের গল্প

আমরা ছয় ভাই-বোন। বলতে গেলে পিঠাপিঠি। মাঝখানে তিন চার বছরের ব্যবধান। বলতে গেলে ছোট খাটো একটা দল। বাবা, মা আমাদের দল বেঁধে মাজারে নিয়ে যাচ্ছে। বাগের হাটের খান জাহান আলীর মাঝার। আমরা যাচ্ছি নৌকায় করে। মঝি দিন ক্ষণ, জোয়ার ভাটা সব ঠিকঠাক করে নিলো। আমরা যথাসময়ে রওয়ানা হলাম। কয়েকদিন নৌকাতে থাকতে হবে। ভালোই লাগছে বলতে হবে।
জোয়ার আর ভাটার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে নৌকা চলছে। এছাড়া উপায় নেই। খরস্রোতা নদী। স্রোতের বিপরীতে চলা প্রায় অসম্ভভ। নদীতে মাঝে মাঝে তুফান, জলের ঘোলা, মাঝি শক্ত হাতে বৈঠা ধরছে। তবুও একবার নৌকা ডোবার উপক্রম হলো। মা আয়াতুল কুরসী পড়ে সবার গায়ে ফুঁক দিলেন। বিপদ কেটে গেলে আমরা হাসলাম। মাঝির নামে তোফাজ্জল। সে এলাকার সেরা মাঝি। তবুও তাকে বেগ পেতে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে স্রোত আর তুফানের কাছে তাকে অসহায় লাগছিল।
মাঝারে পৌঁছে প্রথমে দোয়া করা হলো। আমরা বলতে গেলে সবাই ছোট। বাবা মা দোয়া করলেন। আমরা হাত তুল যোগ দিলাম। অতঃপর বিরাট দিঘীতে গোসল করা জন্যে। তারপর শখের জিনিসের কেনাকাটা। সময় খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। মাঝখানে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। বাগেরহাট ছোট শহর। সেই ছোট শহরেই আমরা তিন ভাই বোনের একটা ছোট দল ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাকীদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। হারিয়ে গিয়ে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলাম। অবশ্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাবা মা আমাদের খুঁজে বের করে ফেললো। অতঃপর মৃদু বকাঝকা। এসবে তখন খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। ঘোরার মজাই আলাদা।
পরের বছর বাবার সাথে একাই রওয়ানা হলাম। গন্তব্যস্থল বরিশাল। শীতের ঘন কুয়াশা ঢাকা ভোরে প্রয় চার মাইল হেঁেেট গিয়ে তারপর কাঠের এক তলা লঞ্চ। লঞ্চের নাম চরদোয়ানী। সেই লঞ্চ অবিরাম আওয়াজ তুলে সারাটা দিন চলল। মাঝখানে কিছু কিছু ঘাটে ভিড়ল। তারপর সন্ধ্যা গড়িযে রাত। চোখ যখন ঘুম ঘুম ভাব তখনই আলোকজ্জল বরিশাল শহর দৃষ্টিগোচর হলো। আমার বড় ভাইয়ের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় নয়টা। ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। জীবনে এই প্রথম কোন বড় শহরে এলাম।
এখানে এসে অনেক কিছু দেখলাম। রেডিওর সাথে পরিচয় হলো। নতুন জামা কাপড় পেলাম। বড় ভাই বাড়ীর জন্য একটা রেডিও কিনে দিলেন। ন্যাশনাল রেডিও। সার্ভিস ভালো। সবকিছু স্পষ্ট শোনা যায়।
কয়েক দিন শহরে বেরিয়ে আবারও সেই লঞ্চ যোগে বাড়ী ফেরা। একটা ভ্রমন যেন আমাকে অনেকটা বড় করে দিলো। আট বছরের একটা শিশুর জন্যে এটা সত্যিই দারুন একটা বিজয়। জীবনের জন্যে এর প্রভাব অনেক অনেক বেশী।
পরের বছর পরীক্ষা শেষ করে আবারও ভ্রমন। এবার গেলাম নানা বাড়ী। সন্ধ্যার পর পরই রওয়ানা হলাম। আমার জন্যে দীর্ঘ পথই বলতে হবে। টানা নয় মাইল। নয় বছর বয়সের একটা বাচ্চার জন্যে এই পথ হাঁটা কষ্টসাধ্য নয়। তবুও এই পথ পাড়ি দেওয়া খুব বেশি কঠিন মনে হচ্ছে না। কারণ আর কিছু নয়। বাবার সাথে যাচ্ছি। এই যাওয়ার আনন্দই আলাদা।
সন্ধ্যার পর হাল্কা একটু অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তারপর যত পথ পড়ি দিচ্ছিলাম জ্যোৎ¯œা ততই প্রবল হচ্ছিল। এক সময় চারিদিক ধব ধবে সাদা মনে হচ্ছিল। আমি কিছুটা পথ হাঁটছিলাম। কিছুটা পথ বাবার কাঁধে চড়ছিলাম।
গ্রাম পেরিয়ে খোলা মাঠ। সেই মাঠের মাঝখান চিড়ে সাপের শরীরের মতো আঁকা, বাঁকা রাস্তা। যতদৃর চোখ যায় ধূধূূ মাঠ। এখানে উন্মুক্ত মাঠ আর খোলা আকাশের নিচে জ্যোৎ¯œার প্লাবনে সব কিছু মিলেমিশে একাকার।
বলার অপেক্ষা রাখে না এখন শীতকাল। মাঠের ফসল উঠে গেছে। মাঠ শুষ্ক। সেই মাঠে রবি শস্য চাষ করার আয়োজন চলছে। এই দৃশ্য আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেদিনের জ্যোৎ¯œা ভেজা ভ্রমনে এই সব চিরচেনা দৃশ্যেরও ভিন্ন একটা গভীর তাৎপর্যপূর্ন অর্থ দাঁড়িয়ে গেলো। নয় বছর বয়সের একটা শিশুর কাছে পুরো পরিবেশটা একটা অন্যতম আবেগ নিয়ে ধরা দিলো। আমরা এভাবেই বেড়ে উঠি।
নানা বাড়ীতে শীতকালীন বেড়ানোর পাশাপাশি সার্কাস দেখা যাবে। টানা সাত দিন ব্যাপী আয়োজন। সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা আরও কত কি? সেই সাথে হাতি দেখার আনন্দ। পরদিন থেকেই শুরু হবে। মনের ভেতর অন্যরকম একটা অস্থিরতা। আমি যেন ভেতরে ভেতরে আনন্দে ভেসে যাই।
নানা বাড়িতে দিনভর আনন্দ। সন্ধ্যার পর পরই চলে যাই সার্কাসের মাঠে। বিখ্যাত লক্ষণ দাসের সার্কাস। বিরাট বিরাট হাতি বাঁধা রয়েছে প্যান্ডেলের থেকে কিছুটা দূরে। সেই হাতি বড় বড় কলাগাছ শুর দিয়ে ভেঙ্গেচুরে  চুরমার করে খাচ্ছে। কলাগাছের মতো অর্থহীন একটা জিনিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার দেখলাম। একরাতে সার্কাস দেখি তো অন্যরাতে পুতুল নাচ। পরের রাতে আবার যাত্রাপালা। তারপর একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোটর সাইকেলের খেলা। দেখতে দেখতে সাতটা দিন কেটে যায়। আকাশের বুকে জ্যো¯œা ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসে। আমারও অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অন্য রকম অস্থিরতা। বাড়ী ফেরার তাড়া। মায়ের কোলে ফেরার অধীরতা। সার্কাসের বিনোদনও এক সময় ফিকে হয়ে আসে।
পরের শীতে আবারও বাবার সাথে ভ্রমনের আয়োজন। এবার মংলা বন্দর। সেখানে বন্দরের কাছাকাছি ছোট্ট শহরতলীতে আমার এক ফুফু বসবাস করে। তার বাসায় উঠলাম। জীবনে প্রথম এতো বড় জাহাজ দেখলাম। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আনন্দে বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। এখানে এসে  একটা অদ্ভুত জিনিস খেলাম। ফুফুর হাতের করল্লা ভাজি। করল্লা যে তিতা এটা প্রমান করাই কষ্ট।
বাবা মার সাথে এমনি অজ¯্র ভ্রমনে জ্যোৎ¯œা দেখার ভাগ্য আমার হয়েছে। আমার বাবা মা আজও বেঁচে আছেন। এখনও গ্রামের বাড়ীতে গেলে তাদের সাথে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যখন জ্যোৎ¯œা দেখি মনে হয় জীবনের চুয়াল্লিশটি বছর মাত্র একটা ছোট্ট স্বপ্ন।


Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে

NAZRUL ISLAM MAZUMDER : THE CHOICE OF THE TIME (a biography)

NAZRUL ISLAM MAZUMDER The choice of the time “The purpose of a business is to create a customer who creates customers.” -          Shiv Shing # NASSA GROUP # 30,000 employees #EXIM Bank # 3,000 employees And so on……….. A Biography By OMAR KHALED RUMI M. Sc., MBA, LL.B     ...................................................... “Patience, persistence and perspiration make an unbeatable combination for success.”    - Napoleon Hill   ...................................................... Prlogue Like another man Nazrul Islam Mazunder is also a man. But, how he has made some stories of success. Why people consider him as a special. Why he is applaused as Philanthropic in mind, dynamic in thinking, far-sighted in vision. There must some reasons. The reason is what he wanted himself he has been now. Mazumder, a conglomerate icon, in no way, a trifle name. His success, over years, mak