প্রতিবছরের মতো এবছরও শীতের মাত্রায় খুব একটা হেরফের হয়নি। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যেরকম থাকে আবহাওয়া সেরকমই। সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্যত্র। চারিদিকে অস্থিরতা। রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ঢাকা ক্রমশঃ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই শীতেও নাকি ঢাকার তাপমাত্রা এখন ঊর্ধ্বমুখী। একটু একটু করে মিছিল জনসভায় লোক বাড়ছে। পরিস্থিতি ভালো ঠেকছে না।
একজন শাসক, যিনি মূলত সামরিক, নয় বছর ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রে জোর করে চেপে বসে আছেন। তাকে অবশ্য পুরোপুরি দোষ দেওয়াও যাচ্ছে না। কারণ আমাদের মতো অজস্র লোক এতোদিন তার কুরসি ধরে বসেছিলাম। এখন আবহাওয়া বদলে যাওয়ায় সবাই নড়েচড়ে বসায় হঠাৎ করেই সবকিছু নড়েচড়ে উঠেছে। যারা তার বিরুদ্ধে জড়ো হয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই অতীত ত্রুটিপূর্ণ। তবু তারা একট্টা হয়েছে সুদর্শন এবং রোমান্টিক হিসেবে খ্যাতি আছে এরকম একজন শাসকের বিরুদ্ধে। তার নয় বছরের শাসনামল একেবারে হেলাফেলার নয়। তিনি জনগণকে আশার আলো দেখিয়েছেন। উন্নয়নের প্রতিশ্র“তি দিয়ে তার অনেকটাই পুরো করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি অনেক কিছুরই উদ্যোক্তা। বেশ কিছু জিনিসের রূপকার। অনেক স্বপ্নের দ্রষ্টা। কিন্তুু এসব কথা নিয়ে এখন আর ভাববার মতো অবকাশ কারো হাতে নেই। বর্তমানে মূল ইস্যু হচ্ছে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তার আগমনটা যেমন বিতর্কিত তেমনি বিগত নয় বছর তার অবস্থানও অযৌক্তিক। তিনি গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের মতো করে প্রশাসন যন্ত্রকে সাজিয়েছেন। কোন ফর্মুলা ছাড়াই বহাল তবিয়তে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আলাদা আলাদা কায়দায় সন্তুষ্ট করে টিকে থেকেছেন। জনগণকে গণতন্ত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা নো ম্যানস ল্যান্ডে ফেলে দিয়েছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। দরকার এজন্যে যে ইতোমধ্যেই তারা পেট পুরে মধু পান করেছে। এখন পরিবর্তনের হাওয়ায় গা ভাসানোই ভালো।
আমার কাছে শীতকালটা আর শীতকাল মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এটা স্রেফ একটা বসন্ত কাল। বাংলা বসন্ত। এই ব্যাটাকে নামানো দরকার। বিষয়টা দারুন আনন্দের। কলেজে পড়াশুনায় তেমন গতি নেই। প্রতিদিন সকাল নয়টা দশটা নাগাদ সবাই একত্রিত হয়ে মিছিল মিটিং। শহর প্রদক্ষিণ। অতঃপর সরকারের বশংবদপুলিশ কর্তৃক বাঁধা প্রদান। ব্যারিকেড। আমাদের সেটা ভাঙ্গার মিথ্যে প্রচেষ্টা। অতঃপর জ্বালাময়ী বক্তৃতা। আবার ফিরে আসা। আগামী কালের জন্যে পরিকল্পনা তৈরী। সবাই একযোগে কলেজ মাঠে বসে টিভিতে খবর দেখা। তারপর ঘরে ফেরা আগামীকালের জন্যে। কাল সকালে আবার উঠতে হবে। নতুন দিন। নতুন কর্মসূচী। ঘুমিয়ে চাঙ্গা হয়ে নিতে হবে। নইলে আন্দোলন জমবে কেমন করে।
এতোদিন শুধু পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। এবার বাড়তি একটা কাজ পাওয়া গেল। কলেজের ক্যাম্পাসের গাছগুলোতে শীতকালীন ফুল ফুটেছে। সেই ফুলগলো রাতের শেষে শিশিরে ভিজে আসে। ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি একটা চাঁদর পেচিয়ে হোস্টেলের বাইরে বেরিয়ে আসি। সামনের ছোট্ট খালি জায়গাটা পেরোলেই স্যারদের বাংলো। তার সামনে শ্বেত শুভ্র সুগন্ধী ফুলের গাছ। কেউ কেউ বলে চেরী। আমি জানি না এটা কি গাছ। তবে এটুকু দেখেছি বাগেরহাট এলাকাটা ফুলে ফলে অনেক সমৃদ্ধ। মানুষগুলো জীবন্ত। জীবন বোধে সমৃদ্ধ। বিশেষ করে এই এলাকার হিন্দুু জনগোষ্ঠীর একটা সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। আর মুসলিম ঐতিহ্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। হযরত খাজা খানজাহান আলীর পদধূলি সমৃদ্ধ বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং তার ঐতিহাসিক মাজার শরীফ জাতিসংঘের হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে। ঘোড়াদীঘি, কোদালদিঘীরমত সব বৃহদাকার দীঘির নাম জনগণের মুখে মুখে। সবকিছু মিলিয়ে ঐতিহ্যবাহী বাগেরহাটে কাটানো আমার যৌবনের ঊষালগ্ন আর কলেজ জীবনের নিবিড় অধ্যয়নের সুযোগ আমাকে অনাগত আগামীর জন্যে তৈরী করেছিল। আমি তখন বাগেরহাট পিসি কলেজের ছাত্র। আমার গ্রামের বাড়ী পিরোজপুরের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। ওখান থেকে এসে কলেজে পড়া সম্ভব ছিলো না। তাই পিসি কলেজের হোস্টেলে থাকতাম। মুসলিম হোস্টেলে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ। কলেজ ক্যম্পাসের এক পার্শ্বে থাকায় পড়াশুনার জন্যে উপযুক্ত ছিলো। এই হোস্টেলের অনেকেই পরবর্তী জীবনের জন্যে নিজেকে তৈরী করেছে। আমি সেই অজস্র উৎসুক প্রাণের অধিকারী মানুষদের একজন হতে চেষ্টা করেছি।
মাঝে মাঝে বিকেল বেলায় মন খারাপ হলে কয়েকজন মিলে পায়ে হেঁটে মাজার শরীফে চলে যেতাম। দীঘির পাড় ধরে হাঁটতাম। একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়তাম। বন্ধুদের মধ্যে নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো। পরবর্তীতে রাজনীতিতে সুনাম কুড়ানো মোস্তফা রশিদী সুজা তখন তার অবস্থানের জন্যে তার ভাইয়ের সাথে জুটি গড়ে সমান খ্যাতিমান। দারা-সুজা নামে সবাই তাদের চিনত। কলেজ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লাম। এর প্রয়োজন ছিল। জীবনের এক একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষ পরিণত হয়। আমার জীবনে এটা ছিলো প্রথম পরিণত ধাক্কা। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাকে আমূল বদলে দিলো।
বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি এর জন্ম বিকাশ এবং বৃদ্ধি নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। অন্ততঃ যে সব পাঠক রাজনীতির উপরে অনেক ভারী বই পড়তে অভ্যস্ত নয় তাদেরকে অন্তত গল্পচ্ছলে দুচারটা ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা বলা দরকার। কিন্তুু সত্যি কথা বলতে কি আমি এই বইয়ে এই সুদীর্ঘ আলোচনার হয়তো সবটুকু তুলে আনতে পারব না। এর চেয়ে বেশী সম্ভবও নয়। কারণ আর কিছু না। আমার লক্ষ্য ১৯৯০ এর ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির প্রথম দিকের কিছুটা সময়। এই বইয়ের লক্ষ্য ১৯৯০ এর গণ আন্দোলনে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি এবং মূল্যায়ন। এখানে অন্য আলোচনার সময় কম।
১৯৪৭ সালে যখন দেশবিভাগ হয় তখনই বাঙ্গালীরা মর্মাহত হয়েছিল। অতীতের শুদ্ধাচারী এবং সাম্প্রতিক কালের অস্থির বাঙালী সব সময়ই নিজস্বতা খুঁজেছে তার পৃথক পরিচয়ের মধ্য দিয়ে। তাইতো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ তাকে ব্যথিত করলেও উপকৃতও করেছিল। সাহায্য করেছিল একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে নিজের জন্যে একটা জায়গা খুঁজে পেতে। একটা ক্ষেত্র তৈরী করতে। যদিও বঙ্গভঙ্গের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ১৯১১ সালে এসেই কিন্তু ততদিনে বাংলার মুসলমানরা বুঝে গিয়েছিল তাদের কর্তব্য কি। আর এজন্যই ১৯৪৭ সালে অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলো ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। পাকিস্তানের নয়শ মাইল দূরবর্তী একটা খন্ডাংশ হতে রাজী হয়েছিল তবু বিশাল ভারতের গ্রাসের মধ্যে গিয়ে চিরদিনের জন্য অস্তিত্ব হারাতে চায়নি। বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীদের দূরবস্থা দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আইডেনটিটি হারানো একটা জনগোষ্ঠী তারা। না তারা পৃথক কোন দেশ না তারা ভারতের আত্মার আত্মীয়। এর চেয়ে একটা দুর্বল রাষ্ট্র হয়ে বেঁচে থাকা তাদের জন্যে অনেক উত্তম ছিলো।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। কিন্তুু এই দীর্ঘ পথে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ পার করে এসেছি। সবার প্রথম যার কথা আসে সে আমাদের ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ তে রক্ত দিলেও ১৯৫৫ তে এসে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছিলো। ১৯৫৬ তে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান পাওয়া গেল। যদিও পাকিস্তান জন্মের পর থেকে কখনওই এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে পারেনি। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় যুক্তফন্ট্র নির্বাচন হলো। এটাই ছিল পাকিস্তান জন্মের পর প্রথম গণপরিষদ নির্বাচন। কিন্তুু সেই নির্বাচনের সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। আমাদের ব্যর্থতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বাইরের শত্র“র ষড়যন্ত্র আমাদের এলোমেলো করে দিলো। তবে পরবর্তীতে বাঙালীরা এর থেকে শিক্ষা নিয়েছিলো।
১৯৫৫ সালে পূর্ব বাংলার নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। আমাদের অস্তিত্বের জন্য এটা একটা ধাক্কা ছিল। শেখ মুজিব প্রতিবাদ করলেন। তাতে কাজ হয়নি। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এই অঞ্চল এই নামেই পরিচিত ছিলো। কি নিদারুণ পরিহাস।
১৯৬২ সালে এসে শিক্ষা আন্দোলন জমে উঠল। শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে সবাই উঠে পড়ে লাগল। বিশেষ করে ছাত্ররা দারুণ সোচ্চার হলো। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই আন্দোলনে তার ভূমিকা রেখেছিলেন। বলা যেতে পারে এখান থেকেই তার প্রত্যক্ষ রাজনীতির হাতেখড়ি। তিনি তখন বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী।
১৯৬৬ তে এসে সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করলেন। পুরো দেশ একযোগে ছয় দফা মেনে নিল। ছয় দফা হয়ে গেল বাংগালীর বাঁচার দাবী। ছয়দফার সাফল্যে ভীত সামরিক শাসক শেখ মুজিব এবং তার সহযোগীদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসালেন। কিন্তুু লাভের লাভ কিছুই হলোনা। উভয় পাকিস্তানেরবিরোধীরা একত্র হলো। অবশেষে ১৯৬৯ সালে আইউব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিলেন। গোল টেবিল বৈঠক ডাকলেন। সময়ের ¯্রােত সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেলো। সামরিক শাসনের অবসান হলো তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। এই সময়ই শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। জনাব তোফায়েল আহমেদ সম্বধর্না কমিটির পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পুরো পৃথিবী তাকে এই নামেই জেনেছে। আজো জানে। আগামীতেও জানবে।
এই সব ঘটনা প্রবাহের মধ্যে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। বাংলার রাজনীতিরপ্রবাদ পুরুষ কিংবদন্তিতুল্য রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুতে বাংলার রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত যে আন্দোলন সংঘটিত হয়, সেইআন্দোলনইস্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। এই গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালী মূলত রাজনীতির মাঠে নিজেকে গুঁছিয়ে নিয়েছিলো। এই প্রস্তুুতিই তাকে ১৯৭০ সালের যুগান্তকারী নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় এনে দিয়েছিলো যা পরবর্তীতে স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তার বিস্তার আর ব্যাপকতা শুধু ঐ নয় মাস দুশো ছেষট্টি দিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৭২-১৯৭৫ পর্যন্ত আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পেয়েছিলাম। কিন্তু অবাক ব্যাপার আমরা তাকে ন্যূনতম সহযোগিতা করতে পারিনি। দীর্ঘ তেইশ বছর আমরা যখন বঞ্চিত ছিলাম তখন যতোটা গোছালো ছিলাম ততটুকুওআমরা প্রদর্শন করতে পারি নি। চূড়ান্ত অস্থিরতা প্রদর্শন করা হলো। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনককে হত্যা করা হলো। বাঙালীর রাজনীতি স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পরিক্রমার সেই উত্তাল দিনগুলির চাইতে বেশী উত্তাল আর এলোমেলো হল। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেই পাকিস্তানের ঐতিহ্যকে ধারণ করে সামরিক শাসনে রূপ নিলো। অনেক অঘটনের নায়ক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় বসলেন।
জিয়াউর রহমান খোলস থেকে বেরিয়ে এলেন। আসাটাই স্বাভাবিক। পরিস্থিতির কারণেই তাকে এটা করতে হয়েছিলো। কারণ তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোন জনগণের শাসক ছিলেন না। তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সব প্রক্রিয়াই অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তুু কোন কৌশলই তাকে শেষমেষ বাঁচাতে পারেনি। তার আমলে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো কর্ণেল তাহের এর ফাঁসি। সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারে তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো। অথচ ৩রা নভেম্বর যে বিপ্লব হয়েছিলো এবং তার বিপরীতে ৭ই নভেম্বর যে প্রতিবিপ্লব হয়েছিলো তার নায়ক ছিলো এই তাহের। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরে ৩রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ড আমাদের জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা।
১৯৮১ সালের ৩১শে মার্চ জিয়া অতীতের আর দশ জন সামরিক শাসকের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হন। মঞ্জুরকে দায়ী করা হয়। মূলত মঞ্জুর ছিলো তাহেরের সহকর্মী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা দুজনই পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সর্বোচ্চ খেতাব বীর উত্তম পেয়েছিলেন দুজনই। প্রত্যেক্ষ যুদ্ধে কর্ণেল তাহের তার বাম পা হারান। তিনি নকল পা লাগিয়ে ক্রাচে ভর দিয়ে চলতেন। সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তার হৃদয়স্পর্শী কলমে তাকে ক্রাচের কর্ণেল বলে অভিহিত করেছেন। এই শিরোনামে তার বইটিও তথ্যসমৃদ্ধ এবং হৃদয়স্পর্শী।
জিয়ার মৃত্যু মঞ্জুরকে লাভবান করেনি। বরং তিনি মৃত্যুর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। খুব দ্রুত তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে এরশাদই এসবের পিছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন। সেই যে এরশাদ রাজনীতিতে চেপে বসেন তাকে হঁটানোর জন্যে এই তীব্র শীতেও জনগণ রাস্তায় নেমে ভিন্ন এক বসন্ত তৈরী করেছে। আমরা সেই বসন্তের কথা শুরু করেছিলোম। মাঝখানে কিছু কথা না চাইতেই এসে গেলো। আমরা আমাদের তথাকথিত বসন্ত অতিক্রম করছিলাম। যতই দিন যাচ্ছিল আন্দোলন জমে উঠছিল। ঢাকার পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। ডা. শামসুল ইসলাম মিলন গুলিতে মারা গেলেন। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলো।
বাগেরহাটে আন্দোলন পরিচালনার মূল দায়িত্ব ছিলো জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমানের উপর। মাঠে উপস্থিত ছিলেন বাগেরহাটের কৃতি সন্তান ছাত্র রাজনীতির স্বনামধম্য ব্যক্তিত্ব রফিকুল ইসলাম জগলু। তিনি সরাসরি আমাদের সাথে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
বাগেরহাটে আন্দোলন খুব জমে উঠেছিল। যতই দিন যাচ্ছিল ততই আমরা আশাবাদী হচ্ছিলাম। কিন্তুু সেই মহেন্দ্রক্ষণ কিছুতেই আসছিল না।
অবশেষে একজন এগিয়ে এলেন। তার নাম নূর হোসেন। বুকেÑপিঠে গণতন্ত্র মুক্তিপাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক স্লোগান লিখে তিনি রাজপথে নামলেন। অতপর পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিলেন। আন্দোলন চূড়ান্ত মাত্রা পরিগ্রহ করল। অবশেষে ১০ই জানুয়ারী এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ঘোষনা দিলেন।
একজন শাসক, যিনি মূলত সামরিক, নয় বছর ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রে জোর করে চেপে বসে আছেন। তাকে অবশ্য পুরোপুরি দোষ দেওয়াও যাচ্ছে না। কারণ আমাদের মতো অজস্র লোক এতোদিন তার কুরসি ধরে বসেছিলাম। এখন আবহাওয়া বদলে যাওয়ায় সবাই নড়েচড়ে বসায় হঠাৎ করেই সবকিছু নড়েচড়ে উঠেছে। যারা তার বিরুদ্ধে জড়ো হয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই অতীত ত্রুটিপূর্ণ। তবু তারা একট্টা হয়েছে সুদর্শন এবং রোমান্টিক হিসেবে খ্যাতি আছে এরকম একজন শাসকের বিরুদ্ধে। তার নয় বছরের শাসনামল একেবারে হেলাফেলার নয়। তিনি জনগণকে আশার আলো দেখিয়েছেন। উন্নয়নের প্রতিশ্র“তি দিয়ে তার অনেকটাই পুরো করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি অনেক কিছুরই উদ্যোক্তা। বেশ কিছু জিনিসের রূপকার। অনেক স্বপ্নের দ্রষ্টা। কিন্তুু এসব কথা নিয়ে এখন আর ভাববার মতো অবকাশ কারো হাতে নেই। বর্তমানে মূল ইস্যু হচ্ছে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তার আগমনটা যেমন বিতর্কিত তেমনি বিগত নয় বছর তার অবস্থানও অযৌক্তিক। তিনি গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের মতো করে প্রশাসন যন্ত্রকে সাজিয়েছেন। কোন ফর্মুলা ছাড়াই বহাল তবিয়তে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আলাদা আলাদা কায়দায় সন্তুষ্ট করে টিকে থেকেছেন। জনগণকে গণতন্ত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা নো ম্যানস ল্যান্ডে ফেলে দিয়েছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। দরকার এজন্যে যে ইতোমধ্যেই তারা পেট পুরে মধু পান করেছে। এখন পরিবর্তনের হাওয়ায় গা ভাসানোই ভালো।
আমার কাছে শীতকালটা আর শীতকাল মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এটা স্রেফ একটা বসন্ত কাল। বাংলা বসন্ত। এই ব্যাটাকে নামানো দরকার। বিষয়টা দারুন আনন্দের। কলেজে পড়াশুনায় তেমন গতি নেই। প্রতিদিন সকাল নয়টা দশটা নাগাদ সবাই একত্রিত হয়ে মিছিল মিটিং। শহর প্রদক্ষিণ। অতঃপর সরকারের বশংবদপুলিশ কর্তৃক বাঁধা প্রদান। ব্যারিকেড। আমাদের সেটা ভাঙ্গার মিথ্যে প্রচেষ্টা। অতঃপর জ্বালাময়ী বক্তৃতা। আবার ফিরে আসা। আগামী কালের জন্যে পরিকল্পনা তৈরী। সবাই একযোগে কলেজ মাঠে বসে টিভিতে খবর দেখা। তারপর ঘরে ফেরা আগামীকালের জন্যে। কাল সকালে আবার উঠতে হবে। নতুন দিন। নতুন কর্মসূচী। ঘুমিয়ে চাঙ্গা হয়ে নিতে হবে। নইলে আন্দোলন জমবে কেমন করে।
এতোদিন শুধু পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। এবার বাড়তি একটা কাজ পাওয়া গেল। কলেজের ক্যাম্পাসের গাছগুলোতে শীতকালীন ফুল ফুটেছে। সেই ফুলগলো রাতের শেষে শিশিরে ভিজে আসে। ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি একটা চাঁদর পেচিয়ে হোস্টেলের বাইরে বেরিয়ে আসি। সামনের ছোট্ট খালি জায়গাটা পেরোলেই স্যারদের বাংলো। তার সামনে শ্বেত শুভ্র সুগন্ধী ফুলের গাছ। কেউ কেউ বলে চেরী। আমি জানি না এটা কি গাছ। তবে এটুকু দেখেছি বাগেরহাট এলাকাটা ফুলে ফলে অনেক সমৃদ্ধ। মানুষগুলো জীবন্ত। জীবন বোধে সমৃদ্ধ। বিশেষ করে এই এলাকার হিন্দুু জনগোষ্ঠীর একটা সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। আর মুসলিম ঐতিহ্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। হযরত খাজা খানজাহান আলীর পদধূলি সমৃদ্ধ বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং তার ঐতিহাসিক মাজার শরীফ জাতিসংঘের হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে। ঘোড়াদীঘি, কোদালদিঘীরমত সব বৃহদাকার দীঘির নাম জনগণের মুখে মুখে। সবকিছু মিলিয়ে ঐতিহ্যবাহী বাগেরহাটে কাটানো আমার যৌবনের ঊষালগ্ন আর কলেজ জীবনের নিবিড় অধ্যয়নের সুযোগ আমাকে অনাগত আগামীর জন্যে তৈরী করেছিল। আমি তখন বাগেরহাট পিসি কলেজের ছাত্র। আমার গ্রামের বাড়ী পিরোজপুরের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। ওখান থেকে এসে কলেজে পড়া সম্ভব ছিলো না। তাই পিসি কলেজের হোস্টেলে থাকতাম। মুসলিম হোস্টেলে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ। কলেজ ক্যম্পাসের এক পার্শ্বে থাকায় পড়াশুনার জন্যে উপযুক্ত ছিলো। এই হোস্টেলের অনেকেই পরবর্তী জীবনের জন্যে নিজেকে তৈরী করেছে। আমি সেই অজস্র উৎসুক প্রাণের অধিকারী মানুষদের একজন হতে চেষ্টা করেছি।
মাঝে মাঝে বিকেল বেলায় মন খারাপ হলে কয়েকজন মিলে পায়ে হেঁটে মাজার শরীফে চলে যেতাম। দীঘির পাড় ধরে হাঁটতাম। একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়তাম। বন্ধুদের মধ্যে নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো। পরবর্তীতে রাজনীতিতে সুনাম কুড়ানো মোস্তফা রশিদী সুজা তখন তার অবস্থানের জন্যে তার ভাইয়ের সাথে জুটি গড়ে সমান খ্যাতিমান। দারা-সুজা নামে সবাই তাদের চিনত। কলেজ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লাম। এর প্রয়োজন ছিল। জীবনের এক একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষ পরিণত হয়। আমার জীবনে এটা ছিলো প্রথম পরিণত ধাক্কা। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাকে আমূল বদলে দিলো।
বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি এর জন্ম বিকাশ এবং বৃদ্ধি নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। অন্ততঃ যে সব পাঠক রাজনীতির উপরে অনেক ভারী বই পড়তে অভ্যস্ত নয় তাদেরকে অন্তত গল্পচ্ছলে দুচারটা ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা বলা দরকার। কিন্তুু সত্যি কথা বলতে কি আমি এই বইয়ে এই সুদীর্ঘ আলোচনার হয়তো সবটুকু তুলে আনতে পারব না। এর চেয়ে বেশী সম্ভবও নয়। কারণ আর কিছু না। আমার লক্ষ্য ১৯৯০ এর ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির প্রথম দিকের কিছুটা সময়। এই বইয়ের লক্ষ্য ১৯৯০ এর গণ আন্দোলনে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি এবং মূল্যায়ন। এখানে অন্য আলোচনার সময় কম।
১৯৪৭ সালে যখন দেশবিভাগ হয় তখনই বাঙ্গালীরা মর্মাহত হয়েছিল। অতীতের শুদ্ধাচারী এবং সাম্প্রতিক কালের অস্থির বাঙালী সব সময়ই নিজস্বতা খুঁজেছে তার পৃথক পরিচয়ের মধ্য দিয়ে। তাইতো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ তাকে ব্যথিত করলেও উপকৃতও করেছিল। সাহায্য করেছিল একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে নিজের জন্যে একটা জায়গা খুঁজে পেতে। একটা ক্ষেত্র তৈরী করতে। যদিও বঙ্গভঙ্গের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ১৯১১ সালে এসেই কিন্তু ততদিনে বাংলার মুসলমানরা বুঝে গিয়েছিল তাদের কর্তব্য কি। আর এজন্যই ১৯৪৭ সালে অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলো ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। পাকিস্তানের নয়শ মাইল দূরবর্তী একটা খন্ডাংশ হতে রাজী হয়েছিল তবু বিশাল ভারতের গ্রাসের মধ্যে গিয়ে চিরদিনের জন্য অস্তিত্ব হারাতে চায়নি। বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীদের দূরবস্থা দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আইডেনটিটি হারানো একটা জনগোষ্ঠী তারা। না তারা পৃথক কোন দেশ না তারা ভারতের আত্মার আত্মীয়। এর চেয়ে একটা দুর্বল রাষ্ট্র হয়ে বেঁচে থাকা তাদের জন্যে অনেক উত্তম ছিলো।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। কিন্তুু এই দীর্ঘ পথে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ পার করে এসেছি। সবার প্রথম যার কথা আসে সে আমাদের ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ তে রক্ত দিলেও ১৯৫৫ তে এসে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছিলো। ১৯৫৬ তে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান পাওয়া গেল। যদিও পাকিস্তান জন্মের পর থেকে কখনওই এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে পারেনি। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় যুক্তফন্ট্র নির্বাচন হলো। এটাই ছিল পাকিস্তান জন্মের পর প্রথম গণপরিষদ নির্বাচন। কিন্তুু সেই নির্বাচনের সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। আমাদের ব্যর্থতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বাইরের শত্র“র ষড়যন্ত্র আমাদের এলোমেলো করে দিলো। তবে পরবর্তীতে বাঙালীরা এর থেকে শিক্ষা নিয়েছিলো।
১৯৫৫ সালে পূর্ব বাংলার নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। আমাদের অস্তিত্বের জন্য এটা একটা ধাক্কা ছিল। শেখ মুজিব প্রতিবাদ করলেন। তাতে কাজ হয়নি। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এই অঞ্চল এই নামেই পরিচিত ছিলো। কি নিদারুণ পরিহাস।
১৯৬২ সালে এসে শিক্ষা আন্দোলন জমে উঠল। শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে সবাই উঠে পড়ে লাগল। বিশেষ করে ছাত্ররা দারুণ সোচ্চার হলো। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই আন্দোলনে তার ভূমিকা রেখেছিলেন। বলা যেতে পারে এখান থেকেই তার প্রত্যক্ষ রাজনীতির হাতেখড়ি। তিনি তখন বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী।
১৯৬৬ তে এসে সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করলেন। পুরো দেশ একযোগে ছয় দফা মেনে নিল। ছয় দফা হয়ে গেল বাংগালীর বাঁচার দাবী। ছয়দফার সাফল্যে ভীত সামরিক শাসক শেখ মুজিব এবং তার সহযোগীদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসালেন। কিন্তুু লাভের লাভ কিছুই হলোনা। উভয় পাকিস্তানেরবিরোধীরা একত্র হলো। অবশেষে ১৯৬৯ সালে আইউব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিলেন। গোল টেবিল বৈঠক ডাকলেন। সময়ের ¯্রােত সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেলো। সামরিক শাসনের অবসান হলো তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। এই সময়ই শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। জনাব তোফায়েল আহমেদ সম্বধর্না কমিটির পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পুরো পৃথিবী তাকে এই নামেই জেনেছে। আজো জানে। আগামীতেও জানবে।
এই সব ঘটনা প্রবাহের মধ্যে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। বাংলার রাজনীতিরপ্রবাদ পুরুষ কিংবদন্তিতুল্য রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুতে বাংলার রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত যে আন্দোলন সংঘটিত হয়, সেইআন্দোলনইস্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। এই গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালী মূলত রাজনীতির মাঠে নিজেকে গুঁছিয়ে নিয়েছিলো। এই প্রস্তুুতিই তাকে ১৯৭০ সালের যুগান্তকারী নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় এনে দিয়েছিলো যা পরবর্তীতে স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তার বিস্তার আর ব্যাপকতা শুধু ঐ নয় মাস দুশো ছেষট্টি দিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৭২-১৯৭৫ পর্যন্ত আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পেয়েছিলাম। কিন্তু অবাক ব্যাপার আমরা তাকে ন্যূনতম সহযোগিতা করতে পারিনি। দীর্ঘ তেইশ বছর আমরা যখন বঞ্চিত ছিলাম তখন যতোটা গোছালো ছিলাম ততটুকুওআমরা প্রদর্শন করতে পারি নি। চূড়ান্ত অস্থিরতা প্রদর্শন করা হলো। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনককে হত্যা করা হলো। বাঙালীর রাজনীতি স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পরিক্রমার সেই উত্তাল দিনগুলির চাইতে বেশী উত্তাল আর এলোমেলো হল। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেই পাকিস্তানের ঐতিহ্যকে ধারণ করে সামরিক শাসনে রূপ নিলো। অনেক অঘটনের নায়ক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় বসলেন।
জিয়াউর রহমান খোলস থেকে বেরিয়ে এলেন। আসাটাই স্বাভাবিক। পরিস্থিতির কারণেই তাকে এটা করতে হয়েছিলো। কারণ তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোন জনগণের শাসক ছিলেন না। তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সব প্রক্রিয়াই অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তুু কোন কৌশলই তাকে শেষমেষ বাঁচাতে পারেনি। তার আমলে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো কর্ণেল তাহের এর ফাঁসি। সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারে তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো। অথচ ৩রা নভেম্বর যে বিপ্লব হয়েছিলো এবং তার বিপরীতে ৭ই নভেম্বর যে প্রতিবিপ্লব হয়েছিলো তার নায়ক ছিলো এই তাহের। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরে ৩রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ড আমাদের জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা।
১৯৮১ সালের ৩১শে মার্চ জিয়া অতীতের আর দশ জন সামরিক শাসকের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হন। মঞ্জুরকে দায়ী করা হয়। মূলত মঞ্জুর ছিলো তাহেরের সহকর্মী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা দুজনই পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সর্বোচ্চ খেতাব বীর উত্তম পেয়েছিলেন দুজনই। প্রত্যেক্ষ যুদ্ধে কর্ণেল তাহের তার বাম পা হারান। তিনি নকল পা লাগিয়ে ক্রাচে ভর দিয়ে চলতেন। সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তার হৃদয়স্পর্শী কলমে তাকে ক্রাচের কর্ণেল বলে অভিহিত করেছেন। এই শিরোনামে তার বইটিও তথ্যসমৃদ্ধ এবং হৃদয়স্পর্শী।
জিয়ার মৃত্যু মঞ্জুরকে লাভবান করেনি। বরং তিনি মৃত্যুর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। খুব দ্রুত তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে এরশাদই এসবের পিছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন। সেই যে এরশাদ রাজনীতিতে চেপে বসেন তাকে হঁটানোর জন্যে এই তীব্র শীতেও জনগণ রাস্তায় নেমে ভিন্ন এক বসন্ত তৈরী করেছে। আমরা সেই বসন্তের কথা শুরু করেছিলোম। মাঝখানে কিছু কথা না চাইতেই এসে গেলো। আমরা আমাদের তথাকথিত বসন্ত অতিক্রম করছিলাম। যতই দিন যাচ্ছিল আন্দোলন জমে উঠছিল। ঢাকার পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। ডা. শামসুল ইসলাম মিলন গুলিতে মারা গেলেন। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলো।
বাগেরহাটে আন্দোলন পরিচালনার মূল দায়িত্ব ছিলো জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমানের উপর। মাঠে উপস্থিত ছিলেন বাগেরহাটের কৃতি সন্তান ছাত্র রাজনীতির স্বনামধম্য ব্যক্তিত্ব রফিকুল ইসলাম জগলু। তিনি সরাসরি আমাদের সাথে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
বাগেরহাটে আন্দোলন খুব জমে উঠেছিল। যতই দিন যাচ্ছিল ততই আমরা আশাবাদী হচ্ছিলাম। কিন্তুু সেই মহেন্দ্রক্ষণ কিছুতেই আসছিল না।
অবশেষে একজন এগিয়ে এলেন। তার নাম নূর হোসেন। বুকেÑপিঠে গণতন্ত্র মুক্তিপাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক স্লোগান লিখে তিনি রাজপথে নামলেন। অতপর পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিলেন। আন্দোলন চূড়ান্ত মাত্রা পরিগ্রহ করল। অবশেষে ১০ই জানুয়ারী এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ঘোষনা দিলেন।
Comments
Post a Comment