[you have to let people go
Everyone which in your life
are meant to be in your journey,
but not all of them
are meant to stay till the end.]
প্রত্যেকেই তার সীমানা পেরিয়ে যেতে চায়। কারো কারো সীমানা থাকে ছোট। তারা চাইলেই টুক করে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে। কারো কারো সীমানা থাকে বড়। মন চাইলেও পেরিয়ে যেতে পারে না। তারাও অপেক্ষা করে। মনে মনে ভাবে একদিন ঠিকই পেরিয়ে যাবে। কিন্তু শেষতক আর যাওয়া হয় না। অবশেষে মৃত্যু এসে তাদেরকে পৃথিবীর সীমানা পার করে দেয়। কর্মবীর আব্দুল বাকী এরকমই একজন মানুষ।
তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার আব্দুল বাকী আর দশটা মানুষের মতো নয়। তিনি জীবন দিয়ে জীবনকে শিখেছেন। মানুষের ভেতরটা তিনি কেন জানি দেখতে পান। তাদের ইচ্ছেগুলো বুঝতে পারেন। তাদের হৃদয়ের আকাশের মেঘখন্ড, রংধনু কিংবা গাঢ় গভীর পবিত্র সব অন্ধকার তিনি যেন একদম নিজের মতো করে অনুভব করতে পারেন। আল্লাহ্ তাকে অপূর্ব এই আনন্দঘন বেদনা দান করেছেন। এজন্যে অবশ্য তার কোন মনোবেদনা নেই। তবে মাঝে মাঝে অনর্থক আফসোস করে বলেন, ইস্! একটা শুষ্ক কাষ্ঠ খন্ড হলেই কতো না ভালো হতো। এতোসব অলৌকিক আনন্দের ভার নিতে হতো না। এভাবে বার বার দহন জ্বালা সহ্য না করে তখন শুধু একবার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েই গেলে হতো। কিন্তু না। তিনি তা হননি। মানে আল্লাহ্ তাকে সেরকম কিছু করে সৃষ্টি করেননি। রক্ত মাংসের মানুষ করে বানিয়েছেন। মানুষ হওয়ার জ্বালা অনেক। আব্দুল বাকী কর্মবীর এটা বোঝেন। তার মূল নাম আব্দুল বাকীও ছিলো না। ছিলো রাম, শ্যাম, যদু, মধু, রহিম, করিম, এরকম কিছু একটা। এসব এখন আর কেউ বলতেও পারবে না। অভাবের তাড়নায় দোকান থেকে সব সময় বাকী খেতেন। শেষ পর্যন্ত নাম হয়ে গেলো বাকী ভাই। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা পেলেন। নাম হলো আব্দুল বাকী। তার পর সামাজিক একটা সংগঠন অনুষ্ঠান করে তার নামের সাথে কর্মবীর টাইটেল যোগ করে দিলো। এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হওয়ার জন্যে তাকে অবশ্য বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হয়েছে। অবশ্য তিনি চাননি। সংগঠনের লোকগুলো এমনভাবে ধরলো যে তিনি না করতে পারেননি। তবে পুরো ব্যাপাটার মধ্যে একটা অন্যরকম আন্তরিকতা ছিলো বলেই তিনি রাজী হয়েছিলেন। নইলে টাকা দিয়ে পদবী কেনার মতো লোক তিনি নন। অবশ্য অনুষ্ঠানের ঘোষণা হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিও জানতেন না এরকম কিছু একটা হতে যাচ্ছে। শুধুমাত্র প্রধান অতিথি হয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তুু শেষ মেষ যা ঘটল তা একটা অখন্ড মহাকাব্যোর শেষ অধ্যায় ছাড়া কিছুই নয়। আব্দুল বাকীকে অনুষ্ঠানের সভাপতি দরাজ গলায় কর্মবীর আব্দুল বাকী হিসেবে ঘোষণা াদিলেন এবং জানিয়ে দিলেন এখন থেকে তিনি এই নামেই পরিচিত হবেন। আব্দুল বাকীর দুচোখে তখন পানি। তিনি আবেগাপ্লুত। স্ত্রী, সন্তান, নাতি, নাতনীর সামনে এতোবড় প্রাপ্তি। আব্দুল বাকীর কাছে তার এতোদিনের কষ্টের জীবন সার্থক মনে হলো।
আব্দুল বাকীর জীবন সত্যিই বর্ণাঢ্য। এতো ছোটো কাগজ কলমে তা লেখাও সম্বব নয়। এই লেখায় আমরা শুধু তার মানুষকে বোঝার অপূর্ব ক্ষমতা এবং তার সেই ইচ্ছাপূরনে উদার হস্ত প্রসারণের গল্পগুলোর মধ্যে থেকে সামান্য কয়েকটা গল্প উল্লেখ করতে চাই। আব্দুল বাকীকে জানার বা বোঝার জন্যে এটা মোটেও যথেষ্ট কিছু নয়। তবুও আমরা সামান্য একটু চেষ্টা করবো তার অন্তরের বিশাল প্রান্তরের কোন একটা কর্নারে একটু দৌঁড়ে আসতে। আব্দুল বাকীর ব্যাপরে অন্ততঃ এতোটুকু না জানাটা হবে ভীষন অন্যায়।
আব্দুল বাকীর জীবনে যখন প্রথম স্বচ্ছলতা এলো তিনি ঘরে একজন কাজের বুয়া রাখলেন। বাইরে রাখলেন একটা কাজের লোক। দারুন সুখের সময়। আব্দুল বাকী জীবনে প্রথম আনন্দের মুখ দেখলেন বটে তাবে তা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কাজের লোকটা কাজের বুয়াকে ভালোবাসলো। আব্দুল বাকীরও তখন ভালোবাসর মতো বয়স। কিন্তুু তিনি ভালোবাসা পেলেন না। কাজের বুয়া তাকে তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে বিদায় বললো। শুধু বলেই ক্ষান্ত হলো না। তাদের বিবাহের ব্যবস্থাপূর্বক কিছু একটা বন্দোবস্ত করে দিতেও বললেন। আব্দুল বাকী তাদের হৃদয়ের ভেতরের ভালবাসার মেঘের সেই ওড়াওড়ি ঠিকই দেখতে পেলেন। তিন মেনেও নিলেন। বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। এক জোড়া হালের বলদ দিয়ে কিছু জায়গা জমি বরাদ্দ দিয়ে দিলেন। একটা কোনে ঘর তুলতে বললেন। তারা তখন সুখী দম্পতি। আব্দুল বাকী চেয়ে চেয়ে দেখলেন। অবশ্য বিয়ের পর তারা তার বাড়ীর কাজ ছেড়ে দিলো।
আব্দুল বাকী তখন একা। ওই সময় ঘটল ঘটনাটা। কোথা থেকে এক মেয়ে এসে জুটল। নাম ঠিকানা কিছুই জানা নাই। সরাসরি আব্দুল বাকীর ঘরে এবং ঘাড়ে। গ্রামের সবাই মিলে ধরাধরি করে তার সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিলো। অবশ্য পড়ে জানা গেলো পুরো ব্যাপারটাই ছিল সাজানো। আব্দুল বাকীর দাদাই নাটকটা সাজিয়ে ছিলেন। যা হোক ব্যাবস্থা মন্দ হয়নি। মালেকা মেয়ে হিসেবে মন্দ না। লেখাপড়া তেমন না জানলেও ঘর গেরস্থালির কাজে অনবদ্য। দাদার পছন্দের তারিফ না করে পারা যায় না। আব্দুল বাকী তখন সুখী মানুষ।
ঘরে বাইরে বেশ কয়েকজন কাজের লোক। মালেকার পায়ে লাল আলতার আল্পনা। হাতে মেহেদির কারুকাজ। এর মধ্যে দিয়ে তাদের প্রথম সন্তানের আগমনী বার্তা। আব্দুল বাকী যেন হাওয়ায় ভাসছে। এমন সময় হুট করে পাশের বাড়ীর তালেব আলী একগাদা ছেলেপুলে রেখে হঠাৎ সাপের কামড় খেয়ে মারা গেলো। সবাই এসে ধরলো আব্দুল বাকীকে। আব্দুল বাকীর দয়ার শরীর। তিনি না বলতে পারলেন না। পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিলেন। চাল ডাল আটা থেকে শুরু করে তালেবের স্ত্রীর শাড়ী, চুড়ী সবই তার ঘর থেকে যেতো। তবে এবার কিছুটা ব্যতিক্রম। আগে যে দায়িত্বটা আব্দুল বাকী নিজেই পালন করতেন এখন সেটা পালন করছে মালেকা। আব্দুল বাকী শুধু বরাদ্দ দিয়েই খালাস। আব্দুল বাকী এখন কাজে কর্মে আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী। সময়ও বেশি দিচ্ছেন। আব্দুল বাকীর সংসার ফুলে ফেঁপে উঠছে। রহমত আর বরকত সব যেন উপছে পড়ছে। আব্দুল বাকী সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ এখন অনেকটাই নিশ্চিত। কারো মেয়ের বিয়ে, কারো ছেলের পরীক্ষা, কারো জানাজা, কারো দাফন, কারো কাফন, কারো যৌতুকের টাকা, কারো ঘর পোড়া, কারো নদীতে ডুবে যাওয়া, কারো বাড়ী বানানো, মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা সর্বত্র আব্দুল বাকীর উপস্থিতি। মূলতঃ কোথায় নেই সে। আব্দুল বাকীর তবুও না নেই। তার উৎস আর প্রেরনা দুটোই মালেকা। সংসারের চাবী এখন তার হাতে। আব্দুল বাকীর গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী। পরনে সাদা পাজামা। কাঁধে আচকান। তিনি যেন পুরোনো জমিদার। ব্যাপারটা রূপকথার চেয়ে কম নয়। আব্দুল বাকী গভীর রাতে আল্লাহ্র দরবারে হাত উঠান। দুচোখের পানি ফেলেন সবার অজান্তে। মনে মনে বার বার বলেন, আলহামদুলিল্লাহ্। জীবন এতো সুন্দর।
আব্দুল বাকীর ঝামেলা অনেক। সেই ঝামেলার পুরোটা না হলেও বেশীর ভাগই সামলাতেন তারই ভাইদের একজন। আব্দুল বাকীও তার উপর পুরোপুরিই ভরসা করতেন। সেই নির্ভরতা এতোটাই যে আব্দুল বাকী কোনোদিন ডান বাম চিন্তা করেননি। কিন্তু সেই নির্ভরতাই যে এতোটা কাল হবে তিনি কখনও চিন্তাই করেননি। অবশ্য দোষ তার একার নয়। এতে মালেকার প্রশ্রয়ও ছিলো। মালেকা তাকে কখনও সতর্ক করেননি। অবশ্য করার কথাও নয়। সরলমনা মালেকা সারা জীবন শুধু মানুষকে বিশ্বাস আর ভালোবেসেই এসেছেন। মানুষের ভেতরের নোংরা আর কদর্যতা আছে জানা সত্ত্বেও সে তা নিয়ে কখনওই মাথা ঘামায়নি। ঠিক এই সুযোগটাই নিয়ে নেয় আব্দুল বাকীর ভাই। তিনি নিজের ভাবনাটাই বেশী করে ভাবতে শুরু করেন। আব্দুল বাকীর ভাবনা পেছনে পড়ে থাকে। শেষ মেষ যা হবার তাই হয়। নিজের আখের গুছিয়ে কেটে পড়েন। কিন্তু আব্দুল বাকী সব মাফ করে দেন। ভাইকে বাকীটুকুও নিজের হাতে গুছিয়ে দেন। ভাই এখন অনেক প্রতিষ্ঠিত। যদিও আব্দুল বাকীর মুখোমুখি খুব একটা দাঁড়ান না। সামাজিক কোন অনুষ্টানাদিতেও কোন ভূমিকা নেন না। সব জায়গায় আব্দুল বাকীই মধ্যমনি। ভাই হিসেবে এই সম্মানটুকু অন্ততঃ তাকে করেন। এটাও বা কম কিসে।
আব্দুল বাকী সব সময়ই নিজের চেয়ে অন্যের অন্তরের চাওয়াটাকেই বড় করে দেখেন। মানুষ হিসেবে এটা তার কোন অর্জিত গুনাবলী নয়। তিনি জন্মগতভাবেই এমন। শুধুমাত্র দুঃখের দিনগুলোতে কখনওই এটা প্রকাশ করতে পারেননি। নিজেকে অনেক কষ্টে চেপে রেখেছেন। তবে ব্যাপারটা শুধুমাত্র অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো। অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সবার আগে। শারীরিক পরিশ্রমের ব্যাপারে তাকে কেউ কখনও পেছনে ফেলতে পারেনি। যে কোন কাজে সবার আগেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আব্দুল বাকীর সেই দিনগুলোর কথা সবাই আজও মনে করে। আর এজন্যে দোকান থেকে বাকী খেতেও তার কখনও কষ্ট হয়নি। সবাই হাসিমুখেই যখন যা দরকার বাকীতে দিয়েছে। আবার সুযোগ মতো সে তা পরিশোধও করেছে।
আব্দুল বাকীর ছেলে আব্দুল আলী। বয়স মাত্র উনিশ। বিয়ের জন্য অস্থির। তিনি ছেলের মন বোঝেন। না করেন না। বিয়ে হয়ে যায়। পুত্রবধু পাশের গ্রামের মেয়ে। সম্ভ্রান্ত পরিবার। মেয়েটাও পড়াশোনা করছে। মালেকারও অমত ছিলো না। কিন্তুু ঝামেলা বাঁধে বিয়ের পর। ছেলে আলাদা থাকতে চায়। আব্দুল বাকী ছেলের কথা শুনে থ। বলে কি! মাত্র উনিশ বছরের ছেলে। এখনই মা বাবাকে ছেড়ে আলাদা। আব্দুল বাকী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। টাকা পয়সা দিয়ে শহরে উপযুক্ত বাসা ভাড়া করে তুলে দেয়। মালেকা এসে পাশে বসে। পিঠের উপর হাতে রাখে। আব্দুল বাকী সব কিছুই বুঝতে পারে। মিষ্টি করে হাসে। সেই হাসির ভেতরে যে কতটা গভীর কষ্ট লুকানো তা মালেকার বুঝতে বাকী থাকে না। এজন্যেই তো সে আব্দুল বাকীর সহধর্মিণী।
বছর দুই যেতে না যেতেই মেয়ে এসে হাজির। বিয়ের বায়না তার। ছেলে পছন্দ করাই আছে। শুধু ব্যবস্থা করে দিলেই হয়। আব্দুল বাকী নির্বিকার। তবুও ব্যবস্থা হয়ে যায়। মালেকাই সব আয়োজন করে। ছেলে ঘর জামাই থাকতে চায়। ভালো প্রস্তাব। ছেলেটাকে ভদ্রই মনে হচ্ছে। মালেকা কিছুটা হলেও খুশি। মেয়ে তবুও কাছে থাকছে। আব্দুল বাকীকে সবাই বলে, জামাইকে ছেলের মতো করে নাও। একেবারে মন্দ হবে না। আব্দুল বাকী হাসে। মুখে কিছু বলে না। জীবন হয়তো এরকমই।
Everyone which in your life
are meant to be in your journey,
but not all of them
are meant to stay till the end.]
প্রত্যেকেই তার সীমানা পেরিয়ে যেতে চায়। কারো কারো সীমানা থাকে ছোট। তারা চাইলেই টুক করে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে। কারো কারো সীমানা থাকে বড়। মন চাইলেও পেরিয়ে যেতে পারে না। তারাও অপেক্ষা করে। মনে মনে ভাবে একদিন ঠিকই পেরিয়ে যাবে। কিন্তু শেষতক আর যাওয়া হয় না। অবশেষে মৃত্যু এসে তাদেরকে পৃথিবীর সীমানা পার করে দেয়। কর্মবীর আব্দুল বাকী এরকমই একজন মানুষ।
তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার আব্দুল বাকী আর দশটা মানুষের মতো নয়। তিনি জীবন দিয়ে জীবনকে শিখেছেন। মানুষের ভেতরটা তিনি কেন জানি দেখতে পান। তাদের ইচ্ছেগুলো বুঝতে পারেন। তাদের হৃদয়ের আকাশের মেঘখন্ড, রংধনু কিংবা গাঢ় গভীর পবিত্র সব অন্ধকার তিনি যেন একদম নিজের মতো করে অনুভব করতে পারেন। আল্লাহ্ তাকে অপূর্ব এই আনন্দঘন বেদনা দান করেছেন। এজন্যে অবশ্য তার কোন মনোবেদনা নেই। তবে মাঝে মাঝে অনর্থক আফসোস করে বলেন, ইস্! একটা শুষ্ক কাষ্ঠ খন্ড হলেই কতো না ভালো হতো। এতোসব অলৌকিক আনন্দের ভার নিতে হতো না। এভাবে বার বার দহন জ্বালা সহ্য না করে তখন শুধু একবার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েই গেলে হতো। কিন্তু না। তিনি তা হননি। মানে আল্লাহ্ তাকে সেরকম কিছু করে সৃষ্টি করেননি। রক্ত মাংসের মানুষ করে বানিয়েছেন। মানুষ হওয়ার জ্বালা অনেক। আব্দুল বাকী কর্মবীর এটা বোঝেন। তার মূল নাম আব্দুল বাকীও ছিলো না। ছিলো রাম, শ্যাম, যদু, মধু, রহিম, করিম, এরকম কিছু একটা। এসব এখন আর কেউ বলতেও পারবে না। অভাবের তাড়নায় দোকান থেকে সব সময় বাকী খেতেন। শেষ পর্যন্ত নাম হয়ে গেলো বাকী ভাই। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা পেলেন। নাম হলো আব্দুল বাকী। তার পর সামাজিক একটা সংগঠন অনুষ্ঠান করে তার নামের সাথে কর্মবীর টাইটেল যোগ করে দিলো। এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হওয়ার জন্যে তাকে অবশ্য বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হয়েছে। অবশ্য তিনি চাননি। সংগঠনের লোকগুলো এমনভাবে ধরলো যে তিনি না করতে পারেননি। তবে পুরো ব্যাপাটার মধ্যে একটা অন্যরকম আন্তরিকতা ছিলো বলেই তিনি রাজী হয়েছিলেন। নইলে টাকা দিয়ে পদবী কেনার মতো লোক তিনি নন। অবশ্য অনুষ্ঠানের ঘোষণা হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিও জানতেন না এরকম কিছু একটা হতে যাচ্ছে। শুধুমাত্র প্রধান অতিথি হয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তুু শেষ মেষ যা ঘটল তা একটা অখন্ড মহাকাব্যোর শেষ অধ্যায় ছাড়া কিছুই নয়। আব্দুল বাকীকে অনুষ্ঠানের সভাপতি দরাজ গলায় কর্মবীর আব্দুল বাকী হিসেবে ঘোষণা াদিলেন এবং জানিয়ে দিলেন এখন থেকে তিনি এই নামেই পরিচিত হবেন। আব্দুল বাকীর দুচোখে তখন পানি। তিনি আবেগাপ্লুত। স্ত্রী, সন্তান, নাতি, নাতনীর সামনে এতোবড় প্রাপ্তি। আব্দুল বাকীর কাছে তার এতোদিনের কষ্টের জীবন সার্থক মনে হলো।
আব্দুল বাকীর জীবন সত্যিই বর্ণাঢ্য। এতো ছোটো কাগজ কলমে তা লেখাও সম্বব নয়। এই লেখায় আমরা শুধু তার মানুষকে বোঝার অপূর্ব ক্ষমতা এবং তার সেই ইচ্ছাপূরনে উদার হস্ত প্রসারণের গল্পগুলোর মধ্যে থেকে সামান্য কয়েকটা গল্প উল্লেখ করতে চাই। আব্দুল বাকীকে জানার বা বোঝার জন্যে এটা মোটেও যথেষ্ট কিছু নয়। তবুও আমরা সামান্য একটু চেষ্টা করবো তার অন্তরের বিশাল প্রান্তরের কোন একটা কর্নারে একটু দৌঁড়ে আসতে। আব্দুল বাকীর ব্যাপরে অন্ততঃ এতোটুকু না জানাটা হবে ভীষন অন্যায়।
আব্দুল বাকীর জীবনে যখন প্রথম স্বচ্ছলতা এলো তিনি ঘরে একজন কাজের বুয়া রাখলেন। বাইরে রাখলেন একটা কাজের লোক। দারুন সুখের সময়। আব্দুল বাকী জীবনে প্রথম আনন্দের মুখ দেখলেন বটে তাবে তা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কাজের লোকটা কাজের বুয়াকে ভালোবাসলো। আব্দুল বাকীরও তখন ভালোবাসর মতো বয়স। কিন্তুু তিনি ভালোবাসা পেলেন না। কাজের বুয়া তাকে তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে বিদায় বললো। শুধু বলেই ক্ষান্ত হলো না। তাদের বিবাহের ব্যবস্থাপূর্বক কিছু একটা বন্দোবস্ত করে দিতেও বললেন। আব্দুল বাকী তাদের হৃদয়ের ভেতরের ভালবাসার মেঘের সেই ওড়াওড়ি ঠিকই দেখতে পেলেন। তিন মেনেও নিলেন। বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। এক জোড়া হালের বলদ দিয়ে কিছু জায়গা জমি বরাদ্দ দিয়ে দিলেন। একটা কোনে ঘর তুলতে বললেন। তারা তখন সুখী দম্পতি। আব্দুল বাকী চেয়ে চেয়ে দেখলেন। অবশ্য বিয়ের পর তারা তার বাড়ীর কাজ ছেড়ে দিলো।
আব্দুল বাকী তখন একা। ওই সময় ঘটল ঘটনাটা। কোথা থেকে এক মেয়ে এসে জুটল। নাম ঠিকানা কিছুই জানা নাই। সরাসরি আব্দুল বাকীর ঘরে এবং ঘাড়ে। গ্রামের সবাই মিলে ধরাধরি করে তার সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিলো। অবশ্য পড়ে জানা গেলো পুরো ব্যাপারটাই ছিল সাজানো। আব্দুল বাকীর দাদাই নাটকটা সাজিয়ে ছিলেন। যা হোক ব্যাবস্থা মন্দ হয়নি। মালেকা মেয়ে হিসেবে মন্দ না। লেখাপড়া তেমন না জানলেও ঘর গেরস্থালির কাজে অনবদ্য। দাদার পছন্দের তারিফ না করে পারা যায় না। আব্দুল বাকী তখন সুখী মানুষ।
ঘরে বাইরে বেশ কয়েকজন কাজের লোক। মালেকার পায়ে লাল আলতার আল্পনা। হাতে মেহেদির কারুকাজ। এর মধ্যে দিয়ে তাদের প্রথম সন্তানের আগমনী বার্তা। আব্দুল বাকী যেন হাওয়ায় ভাসছে। এমন সময় হুট করে পাশের বাড়ীর তালেব আলী একগাদা ছেলেপুলে রেখে হঠাৎ সাপের কামড় খেয়ে মারা গেলো। সবাই এসে ধরলো আব্দুল বাকীকে। আব্দুল বাকীর দয়ার শরীর। তিনি না বলতে পারলেন না। পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিলেন। চাল ডাল আটা থেকে শুরু করে তালেবের স্ত্রীর শাড়ী, চুড়ী সবই তার ঘর থেকে যেতো। তবে এবার কিছুটা ব্যতিক্রম। আগে যে দায়িত্বটা আব্দুল বাকী নিজেই পালন করতেন এখন সেটা পালন করছে মালেকা। আব্দুল বাকী শুধু বরাদ্দ দিয়েই খালাস। আব্দুল বাকী এখন কাজে কর্মে আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী। সময়ও বেশি দিচ্ছেন। আব্দুল বাকীর সংসার ফুলে ফেঁপে উঠছে। রহমত আর বরকত সব যেন উপছে পড়ছে। আব্দুল বাকী সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ এখন অনেকটাই নিশ্চিত। কারো মেয়ের বিয়ে, কারো ছেলের পরীক্ষা, কারো জানাজা, কারো দাফন, কারো কাফন, কারো যৌতুকের টাকা, কারো ঘর পোড়া, কারো নদীতে ডুবে যাওয়া, কারো বাড়ী বানানো, মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা সর্বত্র আব্দুল বাকীর উপস্থিতি। মূলতঃ কোথায় নেই সে। আব্দুল বাকীর তবুও না নেই। তার উৎস আর প্রেরনা দুটোই মালেকা। সংসারের চাবী এখন তার হাতে। আব্দুল বাকীর গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী। পরনে সাদা পাজামা। কাঁধে আচকান। তিনি যেন পুরোনো জমিদার। ব্যাপারটা রূপকথার চেয়ে কম নয়। আব্দুল বাকী গভীর রাতে আল্লাহ্র দরবারে হাত উঠান। দুচোখের পানি ফেলেন সবার অজান্তে। মনে মনে বার বার বলেন, আলহামদুলিল্লাহ্। জীবন এতো সুন্দর।
আব্দুল বাকীর ঝামেলা অনেক। সেই ঝামেলার পুরোটা না হলেও বেশীর ভাগই সামলাতেন তারই ভাইদের একজন। আব্দুল বাকীও তার উপর পুরোপুরিই ভরসা করতেন। সেই নির্ভরতা এতোটাই যে আব্দুল বাকী কোনোদিন ডান বাম চিন্তা করেননি। কিন্তু সেই নির্ভরতাই যে এতোটা কাল হবে তিনি কখনও চিন্তাই করেননি। অবশ্য দোষ তার একার নয়। এতে মালেকার প্রশ্রয়ও ছিলো। মালেকা তাকে কখনও সতর্ক করেননি। অবশ্য করার কথাও নয়। সরলমনা মালেকা সারা জীবন শুধু মানুষকে বিশ্বাস আর ভালোবেসেই এসেছেন। মানুষের ভেতরের নোংরা আর কদর্যতা আছে জানা সত্ত্বেও সে তা নিয়ে কখনওই মাথা ঘামায়নি। ঠিক এই সুযোগটাই নিয়ে নেয় আব্দুল বাকীর ভাই। তিনি নিজের ভাবনাটাই বেশী করে ভাবতে শুরু করেন। আব্দুল বাকীর ভাবনা পেছনে পড়ে থাকে। শেষ মেষ যা হবার তাই হয়। নিজের আখের গুছিয়ে কেটে পড়েন। কিন্তু আব্দুল বাকী সব মাফ করে দেন। ভাইকে বাকীটুকুও নিজের হাতে গুছিয়ে দেন। ভাই এখন অনেক প্রতিষ্ঠিত। যদিও আব্দুল বাকীর মুখোমুখি খুব একটা দাঁড়ান না। সামাজিক কোন অনুষ্টানাদিতেও কোন ভূমিকা নেন না। সব জায়গায় আব্দুল বাকীই মধ্যমনি। ভাই হিসেবে এই সম্মানটুকু অন্ততঃ তাকে করেন। এটাও বা কম কিসে।
আব্দুল বাকী সব সময়ই নিজের চেয়ে অন্যের অন্তরের চাওয়াটাকেই বড় করে দেখেন। মানুষ হিসেবে এটা তার কোন অর্জিত গুনাবলী নয়। তিনি জন্মগতভাবেই এমন। শুধুমাত্র দুঃখের দিনগুলোতে কখনওই এটা প্রকাশ করতে পারেননি। নিজেকে অনেক কষ্টে চেপে রেখেছেন। তবে ব্যাপারটা শুধুমাত্র অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো। অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সবার আগে। শারীরিক পরিশ্রমের ব্যাপারে তাকে কেউ কখনও পেছনে ফেলতে পারেনি। যে কোন কাজে সবার আগেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আব্দুল বাকীর সেই দিনগুলোর কথা সবাই আজও মনে করে। আর এজন্যে দোকান থেকে বাকী খেতেও তার কখনও কষ্ট হয়নি। সবাই হাসিমুখেই যখন যা দরকার বাকীতে দিয়েছে। আবার সুযোগ মতো সে তা পরিশোধও করেছে।
আব্দুল বাকীর ছেলে আব্দুল আলী। বয়স মাত্র উনিশ। বিয়ের জন্য অস্থির। তিনি ছেলের মন বোঝেন। না করেন না। বিয়ে হয়ে যায়। পুত্রবধু পাশের গ্রামের মেয়ে। সম্ভ্রান্ত পরিবার। মেয়েটাও পড়াশোনা করছে। মালেকারও অমত ছিলো না। কিন্তুু ঝামেলা বাঁধে বিয়ের পর। ছেলে আলাদা থাকতে চায়। আব্দুল বাকী ছেলের কথা শুনে থ। বলে কি! মাত্র উনিশ বছরের ছেলে। এখনই মা বাবাকে ছেড়ে আলাদা। আব্দুল বাকী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। টাকা পয়সা দিয়ে শহরে উপযুক্ত বাসা ভাড়া করে তুলে দেয়। মালেকা এসে পাশে বসে। পিঠের উপর হাতে রাখে। আব্দুল বাকী সব কিছুই বুঝতে পারে। মিষ্টি করে হাসে। সেই হাসির ভেতরে যে কতটা গভীর কষ্ট লুকানো তা মালেকার বুঝতে বাকী থাকে না। এজন্যেই তো সে আব্দুল বাকীর সহধর্মিণী।
বছর দুই যেতে না যেতেই মেয়ে এসে হাজির। বিয়ের বায়না তার। ছেলে পছন্দ করাই আছে। শুধু ব্যবস্থা করে দিলেই হয়। আব্দুল বাকী নির্বিকার। তবুও ব্যবস্থা হয়ে যায়। মালেকাই সব আয়োজন করে। ছেলে ঘর জামাই থাকতে চায়। ভালো প্রস্তাব। ছেলেটাকে ভদ্রই মনে হচ্ছে। মালেকা কিছুটা হলেও খুশি। মেয়ে তবুও কাছে থাকছে। আব্দুল বাকীকে সবাই বলে, জামাইকে ছেলের মতো করে নাও। একেবারে মন্দ হবে না। আব্দুল বাকী হাসে। মুখে কিছু বলে না। জীবন হয়তো এরকমই।
Comments
Post a Comment