মোঘলদের সাথে আসামের সংঘর্ষ চলেছিলো ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সংঘর্ষে উভয় পক্ষেরই ছিলো জয় পরাজয়ের গল্প। যদিও অবশেষে মোঘলদেরই ত্যাগ করতে হয়েছিলো আসাম তবুও আসামের দুর্গম এলাকায় অনেক দুঃখ-কষ্ট-ভোগান্তির মধ্যেও অনেক মোঘল সেনাপতি যেমন কাসিম খান চিশ্তি, দ্বিতীয় মীর জুমলারা যে ইতিহাস রচনা করেছিলো তাও কম সাফল্যের আর গৌরবের নয়।
আসামের সাথে মোঘলদের সংঘর্ষ আলোচনা করতে গেলে শুরুতেই একটা ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার। বর্তমানে যা কুচ বিহার তার সাথে আসামের ইতিহাস ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। এই কোচ বিহার যা এখন কুচ বিহার নামে পরিচিত ছিলো তারও ছিলো দুটো ভাগ। একটা কোচ বিহার আর একটা কোচ হাজো।
তিক্ততার সূত্রপাত হয়েছিলো যখন মোঘলরা রাজা নর নারায়নের পুত্র লক্ষী নারায়নকে সমর্থন দান করেন। তখনই কোচ হাজোর রাজা দাবী করা রঘুদেব যিনি চিলা রায়ের পুত্র তার মেয়েকে বিয়ে করেন আসামের রাজা সুখাম্ফা। তারা এই সম্পর্ক আরও গভীর করেন পরবর্তীতে কোচ হাজোর আরেক রাজা পরিক্ষিতের মেয়েকে আসামের আরেক রাজা সুসেংফার সাথে বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
তবে মূল সংঘাত শুরু হয় ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে। যখন মোঘল সুবাদার কাসিম খান চিশ্তির নির্দেশে আবু বকর ও ভুষণার রাজা সত্রজিতের অধীনে মোঘল বাহিনী কোচ হাজো এলাকায় অগ্রসর হয়। ধীরে ধীরে তারা আসামের সীমানায় পৌঁছে যায়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে এই প্রথম মোঘল-আসাম শক্তিদ্বয় মুখোমুখি অবস্থান নেয়। মোঘলদের সামলাতে আসামীরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অভিযানে মোঘলদের প্রাথমিক সাফল্য থাকলেও আসামীদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে মোঘলরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়। মোঘলদের প্রথম যাত্রার আসাম অভিযান এরূপভাবেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
আবারও সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় তখনই যখন আসাম অভিযানে মোঘলদের এই ব্যর্থতা কোচ হাজো এলাকায় অবস্থানরত মোঘলদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের বিদ্রোহী করে তোলে। এই সুযোগ নিতে আসামের রাজা প্রতাপ সিংহ ক্ষমতাচ্যুত রাজা পরিক্ষিতের পুত্র বলিনারায়নকে রাজা ঘোষণা দেন এবং সাহায্য পাঠান কিন্তু কার্যত বলি নারায়ন ব্যর্থ হন।
১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে ধানিকলের পাহাড়ি প্রধানগণ মোঘলদের বিরূদ্ধে বিদ্রোহী হলে এবারও আসামের রাজা এগিয়ে আসেন তাদের সাহায্য করতে। প্রথম পর্যায়ে মোঘলরা বাধ্য হন পিছু হটতে কিন্তু অনতিবিলম্বে তারা শক্তি সঞ্চয় করেন এবং পাহাড়ি প্রধানগণকে সরিয়ে দিয়ে ধানিকল দখল করতে সক্ষম হন। পাহাড়ি প্রধানগণ আসামে আশ্রয় নেন।
একদিকে আসামে আশ্রয় নেওয়া পাহাড়ি প্রধানগণের আশ্রয়দান এবং অন্যদিকে বিশ্বঘাতক সত্রজিতের মোঘলদেরকে আক্রমণ করার ধারণা উস্কে দেয়ায় তিক্ততা বেড়ে যায়। তখনি বলিনারায়ন কোচ হাজো অভিযান শুরু করেন। একটা সময় ধরে সংঘর্ষ চলার পর উভয় পক্ষ ক্ষান্ত দেয়।
১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। মোঘলরা অগ্রসর হলেও সমধারা দূর্গের সাথে সংঘর্ষে মোঘলদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। উভয় পক্ষ শান্তি চুক্তি করে। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের এই চুক্তি “আসুরার আলী চুক্তি” নামে পরিচিত।
এই চুক্তির ফলে মোঘলরা আসামীদেরকে স্বীকার করে নেয়। আসামীরাও মোঘলদেরকে কোচ বিহার ও কোচ হাজোর শাসক হিসেবে মেনে নেয়। কিছুটা অসন্তুষ্টি থাকলেও উভয় পক্ষ চুক্তি মেনে নিয়ে নতুন করে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলে।
১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহানের অসুস্থতাকালীন সময়ে পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের সময়কালীন দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আসামের রাজা জয়ধ্বজ গৌহাঁটি থেকে মোঘলদের বিতাড়িত করে মানস নদী পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে আসেন। তার এই আক্রমণ ঢাকার কাছাকাছি এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তিনি বিপুল সংখ্যক মোঘল প্রজাকে বন্দী করে নিয়ে যান।
আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় স্থির হলে তিনি মীর জুমলাকে নির্দেশ দেন আসাম অভিযানের। মীর জুমলা অগ্রসর হন কোন বাধা ছাড়াই। আর এভাবেই তিনি গৌহাঁটি পৌঁছাতে সক্ষম হন। বলা হয়ে থাকে আসামীদের মধ্যকার আন্তঃ বিরোধের কারণে তিনি বলতে গেলে কোনো প্রকার প্রতিরোধের সম্মুখীন হননি। আরও অগ্রসর হলে তিনি প্রতিরোধের মুখোমুখি হন। তবে তা তাকে প্রতিহত করতে পারেনি। তিনি সীমালুগড় ও সমধারা দূর্গ জয় করে রাজধানী গড়গাঁও জয় করেন। আসামের রাজা জঙ্গলে আশ্রয় নেন।
বর্ষাকাল আসে। আসামের বৃষ্টিপ্লাবিত আবহাওয়ায় মোঘলরা বসে থাকতে বাধ্য হয়। বর্ষকালের সুযোগ নিয়ে আসামীরা রাজধানী গড়গাঁও ও মথুরাপুর বাদে সমস্ত এলাকাটাই জয় করে নেয়। বর্ষা শেষ হলে চাঙ্গা হওয়া মোঘল বাহিনী পুনরায় আক্রমণ শুরু করে। রাজা আবারও পাহাড়ে পলায়ন করেন। অবশেষে উভয় পক্ষের সম্মতিতে কোচ হাজো পুনরায় মোঘলদের অধীনস্ত হয়। আসামের রাজা জয়ধ্বজ ব্যাপক ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন।
জয়ধ্বজের ছেলে চক্রধ্বজ (১৬৬২-১৬৭০) ক্ষমতায় বসলে তিনি চুক্তি অস্বীকার করেন। এদিকে মীর জুমলা ক্ষমতায় বসান সৈয়দ ফিরোজ খানকে। মীর জুমলার মৃত্যুর পর আসামে মোঘল অবস্থান দুর্বল হতে থাকে। প্রথমে সরাইঘাটের যুদ্ধ (১৬৭১) ও পরে ইটাখুলির যুদ্ধে (১৬৮২) মোঘলরা পরাজিত হলে তারা বর্তমান বাংলাদেশের যে সীমানা সেই পর্যন্ত সরে আসতে বাধ্য হয়। আর এভাবে আসাম পর্ব শেষ হয়।
OMAR KHALED RUMI_mughal-ahom_assam
Comments
Post a Comment