তখন এক্সিম ব্যাংকের খুলনা শাখায় ছিলাম। কি দায়িত্বে ছিলাম সেটা বলা জরুরী না। হবে হয়তো ম্যানেজার অথবা অপারেশন ম্যানেজার বা তথাকথিত সেকেন্ড অফিসার। সে যাই হোক জাকিলুর ছেলেটা আমার নজর কাড়লো। সুন্দর প্রশস্ত মুখ, নিষ্পাপ হাসি। কথাবার্তায়ও চমৎকার। সে জানালো তার বাড়ী গোপালগঞ্জে। এটা খুলনার পাশ্ববর্তী একটা জেলা।
ছেলেটা কাজেও বেশ মনোযোগী। কাজ করতো ক্যাশে। তাই বাইরে যে খুব একটা আসতে পারত তাও নয়। ব্যাংকে ক্যাশে কাজ করা ছেলে মেয়েদের মাথা নিচু করে কাজ করতে হয়। শত হোক টাকা পয়সার মামলা। একটু এদিক-ওদিক হলেই পকেট থেকে জরিমানা গুণতে হয়।
জাকিলুরের বউয়ের নাম জাহান বুড়ি। আমার ধারণা জাহান মেয়েটার ভালো নাম। বুড়ি তার আদরের বা ডাক নাম। তবে সব ধারণা যাচাই করা হয় না। কর্মব্যস্ত জীবনে আমাদের অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করার সময় সুযোগ কখনোই হয় ওঠে না। বিশেষ করে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতে পাশাপাশি বসে কাজ করা মানুষগুলোর কারোরই দুঃখ কষ্টের খোঁজ নেওয়ার সময় থাকে না।
সময় গড়ায়। আমারও জাকিলুরের সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানা হয় না। তবে একুটু জানি যে একটা মোটর সাইকেলে কওে সে অফিসে আসে।
একদিন অফিসে আসার সময় জাকিলুর তার মোটর সাইকেল নিয়ে একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পতিত হয়। তার পা ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়ে যায়। তার অফিসে আসাও বন্ধ হয়ে যায়।
আমিও বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাই। জাকিলুরের পা তখনো মোটেই ভালো হয়নি। ততদিনে প্রায় বছর ঘুরতে চললো।
একদিন হঠাৎ করেই তুহিন নামের এক সহকর্মীর ফোন পাই। সে আবেগ জড়িত কন্ঠে জানায়, জাকিলুর আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
বুকের খাঁচার ভেতরে হৃদয় নামের যে একটা যন্ত্র থাকে তার কথা আমরা প্রায়শঃই ভুলে থাকি। কারণ আমাদের তো হৃদয়ের খুব একটা দরকার পড়ে না। আমাদের প্রয়োজন হয় শুধু হাত, পা আর পেটের। ইদানিং মাথার ব্যবহারও কম। তবে খবরটা শুনে সেই হৃদয়টা যেন খানিকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
সময় আরও গড়ায়। সামনে আগাই। অবশ্য কতোটা আগাই জানি না। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত এই তিন ঋতুতে প্রকৃতি ঘুরপাক খায়। জাকিলুরের স্মৃতি ক্রমশঃ মলিন হতে থাকে।
দু’একজন থাকে যারা মনে রাখে কিছু কিছু স্মৃতি, কিছু কিছু কথা। চয়ন, যার ভালো নাম জাকির, যে জাকিলুরের একজন সহকর্মী, প্রতি বছর জাকিলুরের মৃত্যুদিনে একটা কালো ব্যানার শেয়ার করে তার টাইম লাইনে। আমরা যে আজও তাকে ভালোবাসি তার এটা একটা প্রমাণ।
জাকিলুরের চাকরি খুব বেশী দিনের ছিলো না। তাই সার্ভিস বেনিফিট তেমন কিছু পায়নি। জাকিলুরের একটা ছোট্ট ছেলে আছে। তার স্ত্রী বুড়ি কেমন আছে তা আমাদের খোঁজ নেওয়া হয় না। জীবনের ব্যস্ততা বাড়ে।
আমরা অনেকেই আহত সিংহের মতো ভেতরে ভেতরে গর্জাই। নদীর ¯্রােত, তার ঢেউ, বহুমুখী বাতাস, আইফোনের নতুন মডেল, ল্যাপটপের নিউ ভার্সন ইত্যাদি ইত্যাদি আমাদের অবলীলায় অবজ্ঞা করে সামনে আগায়। আমরা মরুভূমির মতো নিঃসঙ্গ থেকে আরও নিঃসঙ্গ হই।
একজন আমাকে বলেছিলো, আমি এতোটাই নিঃসঙ্গ যে কথা বলার মতো কেউ নেই। তাই শহরের সব সুন্দরী মহিলা ডাক্তারদের কয়েকদিন পর পর ভিজিট দিয়ে দেখাই। একবার ভুল করে একজন গাইনি ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম। তারপর সে কি হাস্যকর কান্ড।
আমাদের আজকাল আর ঘুমের বড়িতে কাজ হয় না। হিরো আলম. রাণু মন্ডল, বাদাম কাকু কিংবা জায়েদ খান অথবা অনন্ত জলিলের মতো ডোজ নিতে হয়। মাঝে মাঝে বাড়তি হিসেবে থাকে স্যার মাহফুজের সঙ্গীতের হৃদয় হরণ করা বিনোদন। আমরা যে বেঁচে আছি এটা তার প্রমাণ।
যারা একটু স্মার্ট তারা অবশ্য খারাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমেডি দেখে। আরও যারা এগিয়ে তারা মি. বিন, চার্লি চ্যাপলিন অথবা হলিউডের আরও অনেক হাসির কারুকাজ অথবা কারসাজি দেখে। এই যেমন ধরুন থ্রি স্টুজেস ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ লেখা সারারাত লিখলেও ফুরোবে না। তবে থামতে হয়ই কোথাও না কোথাও। এ লেখা কিন্তু জাকিলুরের স্মরণে। জাকিলুর, আল্লাহ্ তোমাকে ভালো রাখুন এই দোয়া করি।
Comments
Post a Comment