মোঘলদের বাংলা অধ্যায়ে ঘটনার ভেতরেও রয়েছে অনেক ঘটনা। রহস্যের ভেতরে রহস্য। যারা বাংলায় সুবেদার হয়ে এসেছিলো তারা যে অযোগ্য ছিলো একথা কখনও বলবো না। তবে একথা সত্য এদের প্রত্যেকেরই আগমনের পিছনে কোনো না কোনো জটিল কারণ বর্তমান ছিলো। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা ছিলো শাস্তিমূলক পদায়ন। মোঘল বাদশা যখন যার উপর ক্ষিপ্ত হতেন তখনই তাকে বাংলায় বদলি করতেন। জলা-জংলার এই দূর্গম জনপদ ছিলো অনেক কীর্তিমান শাসকের পানিশমেন্ট ট্রান্সফারের জায়গা। এতো গেলো রাজ কর্মচারীদের কথা। আর শাহজাদা হয়েও যারা সুবেদার হয়ে এসেছিলেন তাদেরও অবস্থা অনেকটা ওরকমই। কেন্দ্র থেকে যাতে সিংহাসন জয়ের ষড়যন্ত্র না করতে পারে তাই দূরত্ব তৈরী করার জন্যেই এই এতো দূরে বাংলায় ট্রান্সফার। শাহসুজা থেকে মুহাম্মদ আযম। ঘটনা ঐ একই। সে যাই হোক যারা এসেছিলো তাদের সবার মধ্যে একটা দারুণ মিল ছিলো। আর তা হলো সবাই-ই বাংলাকে ভালোবেসেছিলো। এই বাংলার জল হাওয়া কাদায় এদের অনেকেই খুঁজে পেয়েছিলো তাদের জীবনের সেরা সাফল্য।
সুবেদার ইসলাম খান চিশ্তির কথা দিয়েই শুরু করা যাক। তার সময়কাল হলো ১৬০৮ থেকে ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়কালে তিনি সমগ্র বাংলাকে মোঘল শাসনাধীনে নিয়ে আসেন। এটা যে তখনকার প্রেক্ষাপটে কতো বড়ো কীর্তি তা বলে বুঝানো যাবে না। আজ যে বাংলাদেশ আমরা দেখি তার কিছুই তখন ছিলো না। চিত্র ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা ছিলো বর্বর মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যু দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত এক ভীতিকর জনপদ। আর হ্যাঁ, রোগ বালাই বলতে যা বোঝায়, তা জগতে যা ছিলো না, তার সবই ছিলো বাংলায়। এক দূষিত পানির কারণে কলেরায় মরে সাফ হয়ে যেতো গ্রামের পর গ্রাম। এছাড়াও আরো যে কতো কি বন্যা, বালা মুসিবত। তবু বাংলা আকর্ষণীয় ছিলো তার নিজস্ব রুপ-মাধুর্য নিয়ে। ষড়ঋতুর বাংলায় বৈচিত্র্যের কোনো কমতি ছিলো না এর প্রকৃতিতে। মা-মাটি-মানুষের মিলেমিশে থাকা এই বাংলায় সব কিছু ছিলো মায়া আর মমতায় জড়াজড়ি করে।
তাইতো পর্তুগীজ আর মগ উপদ্রæত বাংলায় তৎকালীন মুসলিম বাসিন্দারা যাপন করতো এক ভীতিকর জীবন। তারা প্রায়ই লুটপাট চালাতো, নির্বিচারে মানুষ খুন করতো, ধর্ষণ করতো, মানুষ জনকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ত্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করতো। এরকম আরও অনেক সমস্যা ছিলো। সাথে ছিলো অশিক্ষা, চিকিৎসার অভাব, কুসংস্কার আরও অনেক সামাজিক ব্যাধি। অভাবের কারণে দুর্ভিক্ষ লেগে থাকতো। প্রায়ই দেখা দিতো মহামারি। তবে হ্যাঁ। পুরোটা সময়ই যে একইভাবে গেছে তাও নয়। এই যেমন ধরুন ইতিহাস থেকে জানা যায় সুবেদার শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেতো। সময়কালটা হলো ১৬৬৪ হতে ১৬৭৬ এবং ১৬৮০ হতে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ।
শায়েস্তা খানের কথা আলোচনা করবো। তবে তার আগে আলোচনা করতে হবে আসাম জয়ী কীর্তিমান মীর জুমলার কথা। একদার কেরানি, অতঃপর হীরা ব্যবসায়ী এবং সর্বশেষ রাজ কর্মচারী মীর জুমলার জীবন ছিলো বর্ণিল আর সাফল্যে ভরা। এই কীর্তিমান পুরুষ শুধু বাংলায়াই নয় পুরো ভারত জুড়ে একজন সফল রাজ কর্মচারী হিসেবে তার সাফল্য দেখিয়েছেন। দক্ষিণ ভারতের এক বিস্তৃত ব্যাপক অঞ্চল জয়ে মীর জুমলার অবদান ছিলো অসমান্য।
জীবনের অন্তিম সময়ে এসে তিনি বাংলার সুবেদার হন। তখন তার বয়স ৬৯ বছর। ঐ বয়সেই এই অসীম সাহসী মানুষটা আসামের মতো দূর্গম একটা এলাকায় অভিযান চালান। দীর্ঘ অভিযান শেষে ফেরার পথে ৭২ বছর বয়সী মানুষটা মৃত্যুবরণ করেন। তার কবরটা পর্যন্ত হয় মেঘালয়ে। এই সব কীর্তিমান মানুষদের কথা আজ আমরা ভুলতে বসেছি।
মীর জুমলার পর এসেছিলেন শায়েস্তা খান। তারও জীবন ছিলো সাফল্যে ভরা। তবে বাংলায় আসার পর তার জীবনে সম্ভবতঃ সাফল্যের সেরা পালকটি যুক্ত হয়। তিনি চট্টগ্রাম জয় করেন মগদের হাত থেকে এবং এই এলাকাকে মোঘল বাংলার সাথে যুক্ত করেন। চট্টগ্রাম এলাকার নিপীড়িত মুসলমানরা মুক্তি লাভ করে হাফ ছেড়ে বাঁচেন।
এই আলোচনা মূলতঃ সুবেদারদের কীর্তি আলোচনার জন্যে নয়। এটা প্রসঙ্গক্রমে তাদের সেই বিরল কীর্তির সামান্য উল্লেখ মাত্র। মূলতঃ যা বলতে চেয়েছি তা হলো সাজা খাঁটতে আসা মানুষগুলো তাদের আন্তরিকতা ও জীবন দিয়ে এই জলা-জংলার জনপদটাকে আমাদের বসবাসের উপযোগী করে দিয়ে গেছেন।
Comments
Post a Comment