Skip to main content

Fabricare receipt 01 08 2024

যৌতুকের ধূলো


চিঠি শেষ করে একটা তৃপ্তির হাসি হাসলেন দরবার আলী। ভালো লাগা বলতে একটা কথা আছে না। চল্লিশ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছেন শেখ দরবার আলী বি,এ। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন স্বনামধন্য করণিক। টাকা-পয়সায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন বেশ কিছুদিন হলো। তারপর থেকেই বিয়ের ভাবনাটা মাথায় আসে। আনন্দের ব্যাপার এটাই যে দরবার আলীর এই অর্জন কারো দয়া বা করুণায় নয়, তার উপার্জনও অবৈধ নয়। চাকরির পাশাপাশি ছোট খাট ব্যবসা চালিয়েছে সে বরাবরই। শেষ মেষ শেয়ার ব্যবসায় টাকা খাঁটিয়ে আলোর মুখ দেখেছেন। এখন তার কাছে প্রতিটি রাতই পূর্ণিমার রাত।
চিঠিটা আবার পড়লেন দরবার আলী। প্রতিটি কথাই নিজের মন থেকে লেখা। একটা ঝকঝকে দাওয়াত কার্ডে কথাগুলো ছাপা হবে সোনালী অক্ষরে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে একটা আমন্ত্রণ পত্র। সবাই বলতে দরবার আলীর আপনজনরাই। আসলে দরবার আলীর মন চাইছে সারা দেশের লোকজনকে দাওয়াত দেবে। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো কই। যা বাজেট করা হয়েছে তাতেই মনে হয় অর্ধ কোটি টাকা নেমে যাবে। তবুও মন বলে কথা। দরবার আলী বরাবরই বড় মনের মানুষ। সাধ্য সীমিত হলেও সাধ তার অবারিত। প্রত্যাশা করতে তো দোষ কিছু নেই। যদি পূরণ হয়েই যায় ক্ষতি কোথায়। দরবার আলী মজার মানুষ। ছোট বেলায় বাড়ী ছেড়েছেন। আসলে ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অভাবের সংসার। বার বোন, তের ভাই। অবশ্যই দুই মায়ের ঘরে। কিন্তু দরবার আলী আলাদা ঘর বলতে কিছু বোঝেন না। তার কাছে সবাই একই সংসারের মানুষ। সৎ বলতে তার কাছে কিছু নেই।
সংসারের অভাবটা এমন পর্যায়ের ছিলো যে দরবার যখন বাড়ী ছাড়েন এই ব্যাপারটাই কেউ লক্ষ্য করেননি। আসলে লক্ষ্য না করারই কথা। অভাবের সংসারে যা হয়। কে কার কথা ভাবে। তিন বেলা খাবার জোটানো যেখানে কষ্টসাধ্য সেখানে মায়া মমতার বালাই কোথায়। দরবার তবুও স্পর্শ কাতর। জীবনের হাজারো ঘষা-মাঝার ভেতরেও শামুকের মত শক্ত খোলসের আড়ালে কোমল মনটাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখনও সবার জন্যই ভাবেন। যারা তার ক্ষতি করেছেন তাদেরকে ভালোবাসায় দরবার বরাবরই এগিয়ে রাখেন। দরবার আলীর মাহাত্ম্য এখানেই। তিনি অন্যদের থেকে আলাদা।
দরবার আলী ব্যক্তি জীবনেও হাজারো বৈচিত্র্যের অধিকারী। প্রথম জীবনে বাধ্য হয়েই সাদামাটা চলতেন। হাতে পয়সা ছিলো না। তারপর টাকার মুখ দেখলেন। ইচ্ছে করলে নিজেকে বদলাতে পারতেন। দরবার পরিবারের দিকে মনোযোগ দিলেন। সবার দুঃখ কষ্ট নিয়ে ভাবনা যেন তার একার। বাবা-মার দোয়া সব সময়ই তার সাথে ছিলো।
দরবার এখনও শীতে উলের মোটা সোয়েটার পড়েন। গলায় উলের ভারী মাফলার। সবই হাতে বোনা। তার এসব বুনে দেয় তারই এক আপা। এই আপার হাত ধরেই দরবার আজকের দরবার আলী। ঢাকায় এসে পথে বসেই তার সাথে পরিচয়। সেই যে কাছে টেনে নিয়েছেন আজও পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষের মতো আগলে রেখেছেন। দরবারও তার মূল্য দিয়েছেন। রক্তের সম্পর্কহীন এই মানুষটাই দরবারের জীবনের নীতি নির্ধারক। তার মতেই দরবারের চলাফেরা, ওঠাবসা। দরবারের জীবনের অংক তার কাছে এলেই দুই যোগ দুই সমান চার হয়। দরবারের হবু স্ত্রী ফুলবানু তারই পছন্দ। দরবারের না নেই। ফুলবানু দেখতে ফুলের মতো। কিছু দিন আগে কলেজ পাস করেছে। আগামীর কথা কেউ জানে না।
দরবার সবই বোঝেন। কোন ব্রান্ডের জুতা ভালো। কোন ব্রান্ডের পারফিউম। কোন ব্রান্ডের বেল্ট চমৎকার, কাদের কাপড়-চোপড় অতি সুন্দর সবই তার জানা। পড়তে মনও চায়। কিন্তু শরম লাগে। অভাবী ঘরের ছেলে। হোক না তার অনেক টাকা। তাই বলে এতো বিলাসিতা। মার্সিডিজ গাড়ী তার আওতার মধ্যে। কিন্তু দরবার এখনও তার পুরানো সাইকেলেই অভ্যস্ত। তাই বলে ভালো কাজে সে পিছিয়ে নেই। প্রয়োজনে অপরিচিত কোন ব্যক্তির যে কোন অসুখের চিকিৎসার পুরো টাকাটাই দিতে সে তৈরী। এ ব্যাপারে দরবার সবচেয়ে এগিয়ে।
দরবার মনে মনে ঠিক করল সে কোন যৌতুক নিবে না। কথাটা মাথায় আসতেই সে তার আপাকে কথটা বললো। তার আপা দরবারের কথা শুনে যারপরনাই খুশী হলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন আমন্ত্রন পত্রে কথাটা লিখে দিতে। দরবার আমন্ত্রণ পত্রের শেষে যোগ করলেন বিঃ দ্রঃ দয়া করে কোন উপহার আনবেন না। শুধু দোয়া চাই।
কিন্তু বললেই তো আর হবে না। দরবার আলী বিয়ে করছেন। অনেকেই ওঁৎ পেতে আছেন এই সুযোগে অনেক দিনের জমে থাকা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। সবাই যে যার মত প্রস্তুতি নিতে লাগল। কি হয় দেখা যাক। আমরা না হয় বিয়ের দিন তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকি। আর এই ফাঁকে দরবার আলীর অতীতটা ঘুরে আসা যাক।
দরবার আলীর জন্ম ১৯৭২ সালের মে মাসে। তার নাম রাখেন তার বড় বোন। যদিও সে সৎ বোন কিন্তু দরবারের জন্যে ভালোবাসায় কমতি ছিলো না। কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। সেই বোনই তাকে তার এই তথ্য দিয়েছেন। যদিও কোথাও কোন রেকর্ড নাই। তার মা ও তার জন্মের দিন তারিখ ঠিকমতো বলতে পারেন না। তবে তার বোনের দেওয়া অন্যান্য তথ্যের সাথে মিলালে তারিখটা ২ রা মে মনে হয়। হতেও পারে। নাও হতে পারে। আজ এতোদিন পর এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। জন্ম তারিখ যাই হোক না কেন বিগত চল্লিশ বছরে কখনই কখনোই তার জন্মদিন পালন করা হয়নি। দরবারের এই প্রচলিত প্রথাটার উপর খুব একটা আস্থাও নেই। পৃথিবীতে আসতে পেরে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন। সব সময়ই শুকরিয়া আদায় করেন আল্লাহর দরবারে। আসলে দরবারের এটাই আকর্ষণ। তিনি চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। কিন্তু করেন না। অবশ্য নিজের ক্ষেত্রেই তার এই নিয়ম। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে সে দরাজ। সবার জন্যে তার ভালোটাই চাই। যেন দরবার আলী বি, এ বলে কথা। তার বিকল্প মেলা ভার।
দরবারের শৈশবটা ছিলো পুরো হুলস্থুলে ভরা। দুই সংসারে পাল্লা দিয়ে পঁচিশ ভাই বোন। দরবারের তবু যেন শূন্য শূন্য লাগে। দরবার বরাবরই মিশুক মনের মানুষ। তার বিরক্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু অভাব যেন আর পিঁছু ছাড়ে না। একবেলা আহার জোটে তো আর এক বেলা অনাহারে। দরবারের মুখে তবু হাসি। বাপের জন্যে তার অনেক মায়া। বাপের প্রতিটি কাজেই সে সহায়তা করার চেষ্টা করে। বাপও তাকে ভালোবাসে। দরবারের কাছে পৃথিবীতে এর চেয়ে মধুর কিছু নেই। ছোট বেলা থেকে পিতার স্বপ্নগুলোই যেন তার নিজের স্বপ্ন। আজও সে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে।
দরবারকে মেধাবী বলতেই হবে। সংসারের কাজে সারাদিন খেঁটেখুঁটেও সন্ধ্যায় পড়তে বসতো সে। পরীক্ষায় বরাবরই ভাল ফলাফল তার। অবশেষে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পেল সে। এলাকায় তার সুনাম দেখে কে। দরবার দরবারেই বাজিমাত করলো। সবাই বলতে লাগলো Ñ এ ছেলে একদিন ঠিকই কাঁপাবে। দরবারের অবস্থা দেখে কে। সামনা সামনি এইভাবে প্রশংসা। কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর।
আসলে ভালোই লাগত দরবারের। সবার মধ্যে থেকে যেন সবার থেকে আলাদা। সবার কাছেই প্রিয়। দরবার হাই স্কুলেও তুমুল জনপ্রিয়। অষ্টম শ্রেণীতেও বৃত্তি পেল। আর যায় কোথায়। দরবার এবার উঠে পড়ে লাগল। মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হবে। সবাই উৎসাহ দিতে লাগলো। তার বাপও তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতে লাগলো। অবশেষে দরবার মেট্রিক পরীক্ষায় তার কেন্দ্রে প্রথম বিভাগে প্রথম হলো। মজারই ব্যাপার। দরবার এবার মূল দরবারে নামার পরিকল্পনা করলো।
কলেজ জীবনে দরবার আলী ছিলো সবার নয়নের মনি। বিজ্ঞান বিভাগের সেরা ছাত্র সে। প্র্যাকটিক্যালে নিখুঁত হাত। অন্যদের কাছেও সে প্রিয়। দু বছরের কলেজ জীবনে দরবার আলীর সর্বোচ্চ অর্জন নব্বই এর গন আন্দোলনে সামিল হওয়া; বরাবরই রাজনীতি সচেতন দরবার জীবনের প্রথম চান্সেই মাঠে নেমে পড়েন। প্রথম সারিতে থেকে আন্দোলনে যোগ দেন। অবশেষে সরকারের পতন ঘটিয়েই মাঠ ত্যাগ করেন। তারপর পরীক্ষা দিয়েও ভালো ফলাফল লাভ হয় তার। পড়াশুনার জন্যে স্থানীয় কলেজে ভর্তি না হয়ে ঢাকায় চলে আসেন।
ঢাকায় এসেই তার আপার সাথে তার পরিচয়। এখানে মূলত: তার জীবনের শুরু। সত্যি কথা বলতে কি ঢাকার জীবনটা তার কাছে মনে হলো যেন কুয়ো থেকে বেরিয়ে এক ঝলকে পুরো পৃথিবীটা দেখলেন। এখানেই তার আপার সাথে তার পরিচয়। তারপর তার স্নেহের ছোঁয়া ও সহযোগিতার হাতে দরবার আলী বি.এ শ্রেণীতে ভর্তি হয়। ভাল ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সে অনার্স পড়ার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে। কারণ এত দীর্ঘ সময় তার পোষাবে না। তাকে পাস করে বের হয়ে চাকরিতে ঢুকতে হবে।
দরবার আলী এবারেও আটকালো না। বি, এ তে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলো সে। পাস করার পরপরই চাকরি হয়ে গেলো ভূমি মন্ত্রণালয়ে। জীবনের প্রথম বেতন হাতে পেলো সে। প্রথম উপার্জন। তার ভালোলাগা দেখে কে। দরবার আলী নিজের টাকায় প্রথম কোরবানী দিল।
চাকুরী জীবনে তাকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। ছোট চাকরী হলেও সে হিসেবী মানুষ। কষ্টে সৃষ্টে জীবন পার করলেও মনে তার অনেক আশা। সে প্রতি মাসে কিছু কিছু টাকা জমাতে শুরু করলো। আপার সহযোগিতায় সেই টাকার সে একটা ব্যবসা খুলল। আপাই বসল দোকানে। ব্যবসা ক্রমেই দেখতে দেখতে জমে উঠল। দরবার আলী বাজিমাত করলো। দু এক বছরের মধ্যেই তার হাতে টাকা জমে উঠল। সে শেয়ার বাজারে টাকা খাঁটাতে শুরু করলো। যখনই হাতে লাভের টাকা এলো সে কম দামী জমি কিনতে শুরু করলো। জমি কিনে কিনে কিছুদিন পর আবার তা বিক্রি করে দিতো লাভ সহ। এভাবে টাকার কুমীর হয়ে উঠল সে। আর যায় কোথায়। তার হাতে ধরা দিল আজন্মের অধরা মাধুরী।
টাকায় সব হয়। দরবার মানুষের কল্যাণে উঠে পড়ে লাগল। যেখানে যার কষ্টের খবর পেতো সেখানেই ছুটে যেত। হাত বাড়িয়ে দিতো। দরবারের মুখে হাসি। মনে শান্তি। কিন্তু ব্যাপার ঘটল অন্য জায়গায়। এতে দরবারের অর্থ কিন্তু কমলো তো নাই। উল্টো তা বেড়ে উঠতে লাগলো আরও অধিক মাত্রায়। দেখতে দেখতে দরবার আলী কোথায় গিয়ে পৌঁছল তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু তার সেই চাকরি আর ছোট মুদি দোকান আজও আছে। দরবারও আছ আগের মতোই। শুধু বদলেছে ব্যাংকের টাকার পরিমাণ। আসলে মানুষকে ভালোবাসতে পারলে আখেরে এমনই হয়। দরবার আলীর ইমান যেন দিনে দিনে আরও পরিপক্ক। আল্লাহ্র রহমত বলতে গেলে সে নিজ চক্ষে দেখেছে। তার মনের আস্থা বাড়তে বাড়তে আজ যেন তা হিমালয় পর্যন্ত।
দরবার আলী ১৯৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনেও রাজ পথে ছিলো। দাবী আদায় করেই ঘরে ফিরেছে। তার সেই উচ্ছ্বাস দেখে সেদিন অনেকেই তাকে বলেছিলেন, আচ্ছা দরবার ভাই, আপনি তো কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য না, চাকরি-বাকরি করেন, এসব আন্দোলনে মাঠে গিয়ে কি লাভ? মাঝখান থেকে যদি কোন ক্ষতি হয়ে যায়। তাহলে কেউ তো ফিরেও তাকাবে না। রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদেরই খবর থাকে না। দরবারের মুখে মিষ্টি হাসি। লাভ-লোকসানের হিসাব নেতারা করতে পাওে, জনগণ করে না। যা কিছু ন্যায্য দাবী তার সাথে থাকা উচিত। আমার কাছে দাবীটা যৌক্তিক মনে হয়েছে। তাই মাঠে নেমেছিলাম। আর ক্ষতি করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্র। অত বেশী ভাবলে চলে না।
দরবার আলীর হবু স্ত্রী ফুলবানু বেগম। দেখতে শুনতে সাক্ষাত পরী। তার আপা অনেক দেখে শুনে ঠিক করেছেন। ফুলবানু মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। নামাজী, পর্দা করেন, কথাবার্তায় আন্তরিক। সংসারে আসার পর কেমন হবে এটা আগে ভাগে বলা যায় না। তবে আপাতত: মন্দ মনে হচ্ছে না। ভরসা করা যায়। কিছু কিছু ব্যাপারে আগামীার উপর ভরসা করতেই হয়। বিয়ে সেরকমই একটা বিষয়। সবকিছু দেখে বোঝা যায় না। যেটুকু দেখার তা তার আপাই দেখেছেন।
দরবার আলীর মনটা বেশ ফুরফুরে। সবাই বলছে - দরবার ভাই, এই চান্সে একটা গাড়ী কিনেন। বিয়ে বলে কথা। দরবার বলল, রেন্ট-এ-কার থেকে ড্রাইভারসহ এক মাসের জন্যে একটা ভাড়া নিয়ে নিলেই হবে। কেনার দরকার নেই। বিয়ের পর বৌয়ের সুবিধার জন্যে দরবার তার সাদা মাটা সংসার মোটামুটি গুঁছিয়ে নিয়েছে। একেবারে আহামরি না হলেও মোটামুটি মন্দ না। চলনসই আর কি? দরবারের এক কথা। দুই দিনের দুনিয়া। অত সাজগোজের কি আছে। আজ মরলে কাল দুদিন। মাথার নিচে ইট দিয়ে কোন মতে দুনিয়ার জীবন পার করতে পারলেই হলো। দরবার অতো প্যাঁচঘোচ বোঝে না। তার দর্শন সহজ সরল।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন তারিখ ঘনিয়ে এলো। দরবারের মনের চাঞ্চল্য এতোটাই বেড়ে গেলো যে তার পক্ষে স্থির থাকা কঠিন। এই প্রথম সে নিজের দিকে মনোযোগ দিলো। সত্যি কথা বলতে কি যে কাজটা সে কোনদিন করেনি সেই কাজটাই সে করে বসল। কাউকে না বলে সেলুনে ঢুকে পড়ল। তারপর ভালো করে চুল কাটাল। ফেসিয়াল করাল। মেনিকিউর, পেডিকিউর, মাথার চুল ওয়াশ করানো সব কিছু করে একেবারে তেল তেলে।
কিন্তু সমস্যা বাঁধালো তার পান খাওয়া কালো দাঁত। এতোদিন এসবে তাকে ভালোই মানিয়েছিলো। কিন্তু এখণ আর কেন জানি খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। বড্ড বেমানান লাগছে। সেলুন ওয়ালাদের সে ব্যাপারটা জানালো। সেলুন ওয়ালা তাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যেতে বললো। সেও দাঁতের ডাক্তারের কাছে গেলো। ডাক্তার তার দাঁত দেখে বলল - এ কি করেছেন পান খেয়ে। এ যুগের কেউ এভাবে পান খায়। তবে ভাবনা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি আমাকে কিছুক্ষণ সময় দেন।
দরবার আলী এখন একেবারে ঝকঝকা। মনে হচ্ছে তার বয়স দশ বছর কমে গেছে। তার আপা তার জন্যে কিছু ভালো কাপড় চোপড় কিনছে। সেগুলোতে তাকে মানিয়েছেও বেশ। আসলে দরবার আলী দেখতে মন্দ না। কিন্তু এতোকাল তার সৌন্দর্য কোথায় যেন চাপা পড়ে ছিলো। হঠাৎ করে দরবার আলীর সৌন্দর্য সবার চোখে পড়ে গেল। কে যেন বলে উঠল - সত্যি সত্যি দরবার ভাইয়ের বিয়ের ফুল ফুটেছে। নইলে হঠাৎ করে সবকিছু এভাবে বদলে গেলো কেন?
ফুলবানুদের বাড়ীতেও আনন্দের ঝর্ণাধারা বইছে। প্রথমটায় মনে একটু কষ্ট ছিলো। ছেলের বয়স বেশী। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল এই ইস্যুটা আর যেন থাকলো না।
দরবারের হাজারো গুনের মাঝে এসব ব্যাপার কোথায় যে মিলিযে গেল তা কেউ মনেও রাখলো না। দরবার আলী এখন যাত্রাপালার নায়ক। মঞ্চের মধ্যমনি। তার জীবনে এখন পূর্ণ বসন্ত। তার সূর্য এখন মাঝ গগনে পরিপূর্ণ রূপে দীপ্যমান। তার আকাশে এখন রাতভর শুধু পূর্ণিমা। এমন জীবনই সে চেয়েছিলো। এই দিনের আপেক্ষায়ই হয়তো সে এতোদিন ছিলো। ভালোবাসার মুকুল তার প্রণয়ের বৃক্ষে উঁকি দিতে শুরু করলো। দরবারের কেন জানি মনে হতে লাগলো, সেও ভালোবাসা জানে। তাহলে দেরী কেন। ফুলবানুর সাথে একটু আধটু কথা বলা যাক। তাকে আশস্ত করা দরকার।
অবশেষে সুযোগ এলো। তার আপাই সুযোগ করে দিলেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের দেখা। দুজনেরই লজ্জাবনত মুখ। হঠাৎ করেই পুরো পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে গেলো। দরবারের অনেক কথা বলার ছিলো। কিন্তু কেন জানি কিছুই বলা হলো না। সবচেয়ে মজার কথা সবকিছুর পরও সে একটা কথা বলতে ঠিকই সক্ষম হলো। সে যা বললো, তার মানে অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, ভালো মন্দ কি হবে জানি না। সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি মানুষটা মন্দ না। দরবারের কথায় ফুলবানু হাসল। পূর্ণিমার চাঁদের মতো পূর্ণ বিকশিত হাসি। এই প্রথম দরবার দেখল, তার হবু স্ত্রীর মুখটা কতো সুন্দর। দরবার সজোরে বলে উঠল - সুবহানাল্লাহ্, আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহু আকবর। ফুলবানু কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। বুঝে উঠতে পারল না কি বলবে। অগত্যা আবারও মিষ্টি করে হাসল।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। দরবারের আয়োজন ছিল সত্যিই ব্যতিক্রম। সে কাউকেই নিরাশ করেনি। অজস্র পছন্দের খাবারের পাশাপাশি আয়োজনেও ছিল নতুনত্ব। সত্যি কথা বলতে কি সবার কাছেই বিয়েটা যেন স্মৃতি হয়ে থাকে। সেই চেষ্টাই সে করল। আয়োজন দেখে মনে হলো তার তৃপ্তি হয়েছে।
সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু একটা ব্যাপার দরবারকে রাতারাতি অস্থিরতায় ফেলে দিলো। তার ইচ্ছে ছিলো সে কোন উপহার নেবে না। কিন্তু কার কথা কে শোনে। তার পক্ষের লোকজনও অনেক উপহার দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কান্ডটা ঘটিয়েছে তার পরিচিতজনরা। একবার একজনের একটা দামী জমির ঝামেলা মিটাতে সে তাকে অনেক সাহায্য করেছিল। ঐ লোক তখন তাকে অনেক টাকাও উপহার দিতে চেয়েছিল। কিন্তু উল্টো তাকে চা খাইয়ে বিদায় করেছিল সে। সেই লোক আজ সুযোগ পেয়ে আস্ত একটা নতুন গাড়ী নিয়ে হাজির। বিয়ের অনুষ্ঠানে দরবার সেরকম কঠিন হতে পারেনি। সবকিছু যেমন তেমন ফুলবানুর বাপ করেছে সবচেয়ে কঠিন কাজটি। মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দিতে গিয়ে সে যেন নিজেকে নিঃস্ব করে বসে আছে। এমন কিছু নেই যা মেয়েকে দেয়নি। দরবার বুঝতে পারলো এই টাকা জোগাড় করতে তাকে না জানি কি কি করতে হয়েছে। দরবার রাতারাতি অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালীন সে চুপ থাকল।
যথারীতি বাসর রাত হয়ে গেল। দরবার এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ। তাকে দেখলে মনে হবে সে যেন বাদশা আকবর। দিল্লীশ্বর। আর দিল্লীশ্বর মানেই তো জগদ্বীশ্বর। দরবারের নিজেকে বাদশা বাদশা মনে হতে লাগল। বিয়ের ধকল কেটে যেতেই সে তার শ্বশুরকে ডেকে পাঠাল। বেশ কিছু কঠিন কথা তাকে বলতে হলো ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। কথাবার্তার সমাপ্তিতে যা দাঁড়াল, তাহলো, দরবার জানতে চাইলো টাকা পয়সা কার কার থেকে ধার করা হযেছে। দরবারের শ্বশুর পুরো ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইল। কিন্তু দরবারের কাছে অবশেষে হারতে বাধ্য হলো। দরবার নিজ হাতে সব টাকা পরিশোধ করে দিলো। শ্বশুরকে বললো, এই নিয়ে সে যেন আর কোন কথা না বলে।
ফুলবানুকে নিয়ে দরবারের সুখের সংসার। দেখতে দেখতে পনেরটি বছর পেরিয়ে গেছে। দরবার তার বাড়ীতেই একটা ঘরে সব যৌতুকের মাল বন্দী করে রেখেছে। একদিন কি যেন মনে পড়তেই ফুলবানুকে নিয়ে সেই রুমটা খুলল। দুজনে মিলে ভিতরে প্রবেশ করল। ¯তূপ ¯তূপ করে মালামাল রাখা। দীর্ঘদিন ভেতরে কেউ না ঢোকাতে ভেতরে ঢোকাটাই যেন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দরবার কি যেন একটা হাত দিয়ে স্পর্শ করতে গেলো। কিন্তু তার হাত ভরে গেলো জমে থাকে ধূলোতে। দরবার ফুলবানুকে তার ধূলো ভরা হাত দেখিয়ে বলল - দেখেছো বউ, এর জন্যে মানুষ ভালোবাসা নষ্ট করে। স্ত্রীকে খুন করে। আলাদা হয়ে যায়। আরও কত অশান্তি। আমি সবসময়ই চেয়েছি আমার জীবনটা যেন এই যৌতুকের ধূলো থেকে মুক্ত থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে

NAZRUL ISLAM MAZUMDER : THE CHOICE OF THE TIME (a biography)

NAZRUL ISLAM MAZUMDER The choice of the time “The purpose of a business is to create a customer who creates customers.” -          Shiv Shing # NASSA GROUP # 30,000 employees #EXIM Bank # 3,000 employees And so on……….. A Biography By OMAR KHALED RUMI M. Sc., MBA, LL.B     ...................................................... “Patience, persistence and perspiration make an unbeatable combination for success.”    - Napoleon Hill   ...................................................... Prlogue Like another man Nazrul Islam Mazunder is also a man. But, how he has made some stories of success. Why people consider him as a special. Why he is applaused as Philanthropic in mind, dynamic in thinking, far-sighted in vision. There must some reasons. The reason is what he wanted himself he has been now. Mazumder, a conglomerate icon, in no way, a trifle name. His success, over years, mak