দেখতে দেখতে রিক্সা রূপাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাসায় ঢুকতে যাব এমন সময় রূপার ভাইয়ের সাথে দেখা। এই লোকটাকে শুরু থেকে আমার অপছন্দ। অবশ্য সেও যে আমাকে পছন্দ করে এমনটা বলা যাবে না। ঘরের ভিতর ঢুকতেই রূপার মায়ের সাথে দেখা। আমাকে দেখেই বলল, কেমন আছ বাবা? অনেক দিন পর এলে, বস। শরীর ভাল আছে। চারদিকের খবরাখবর কি।
আমার একটা চাকরি হয়েছে আন্টি। তা বেশ ভাল। কোথায়? একটা মাল্টিনেশনাল কোম্পানিতে। সাউথ আফ্রিকা পোস্টিং। পনের দিনের মধ্যেই চলে যেতে হবে। রূপার সাথে কথা বলা দরকার। ওকে কি একটু ডেকে দিবেন। তুমি বস বাবা। রূপাকে ডেকে দিচ্ছি।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছি। চারিদিকে নিবিড় নিস্তব্ধতা। হাজার কল্পনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ করে রূপা এসে ঢুকল। সেই নিরাভরণ সৌন্দর্য। øিগ্ধ মুখ। সকালের শিশির ভেজা শিউলি ফুলের মত। ঠোঁটের কোনায় সারাক্ষণ লেগে থাকা মিষ্টি হাসি। ঠিক পাঁচ বছর আগে রূপাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম।
এই দীর্ঘ সময়ে একটুও বদলায় নি। রূপাকে আমি ভালবাসি বললে কম বলা হবে। মূলত: তাকে আমি বিশ্বাস করি। আমার পৃথিবী তাকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তাকে নিয়েই আমার দিনরাত। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বাদল। ষড় ঋতুর চিরন্তন প্রবাহ। রূপাতেই আমার বাঁচা। রূপাতেই আমার মরা।
রূপার সাথে যখন আমার প্রথম পরিচয় তখন সে মেডিক্যাল এর ১ম বর্ষের ছাত্রী। আমি অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র। কিছুটা বড় ভাইয়ের মত অবস্থা। তবুও প্রেম হয়ে যায়। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সুযোগ ছিল তাই প্রথম দেখাতেই হাতে হাত, কপালে কপাল, নাকে নাক। আর আগানো সম্ভব হয়নি। মন চাইলেও ভদ্রতা বলতে একটা কথা আছে তো।
তারপর দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর। ততদিনে যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। ভালবাসার বোঝাই নৌকা জল ছুইছুই করে পাড়ি দিয়েছে অনেক পথ। হাজার দু:খ। সহস্র বেদনা। মরতে মরতে বেঁচে গেছি বহুবার। ভালবাসা কত কষ্টের তিলে তিলে বুঝেছি। ভালবাসা কত সুখের একটু একটু করে শিখেছি। সমস্ত কথা লিখে বোঝানো যায় না। সমস্ত গল্প বলে শেষ করা যায় না। সব অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না। এই দীর্ঘ সময়ে আমার মধ্যে শুধু একটা বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে, মানুষ শুধু ভালবাসায় বাঁচে।
প্রেম ছাড়া আর কোন কিছু তাকে এতটা দাস বানাতে পারে না। রূপার কথায় কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে এলাম। রূপা বরাবর এমনই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর আবার শুরু করবে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি সিদ্ধান্তে নিলে। আমি বিয়ের কথা ভাবছি। রূপা বলল, আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না।
সদ্য ডাক্তারি শেষ করেছি। সামনে ইন্টার্নি। আমার ইচ্ছা বড় ডাক্তার হওয়ার। তুমি সাউথ আফ্রিকা থেকে ঘুরে আস। তারপর বিয়ে করব। আমি জানতাম, রূপা এমনটাই বলবে। কারণ কিছুদিন আগে সে একবার আমাকে বলেছিল, যাকে ভালবাসবে তাকে বিয়ে করতে নাই। সংসারের যাতাকলে ভালবাসা নষ্ট হয়ে যায়। আমি আমার ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
আমার বুকের ভেতর তখনই গির্জার ঘন্টা বেজে উঠেছিল। ঈশান কোণে কালো মেঘ। আশাহত পাখির মত সব কিছু জেনে শুনেও মেনে নিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু রূপাকে কিছুই বলিনি। তারপর একদিন জানলাম, এক ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলের সাথে তার সম্পর্ক হয়েছে। ব্যাপারটা রূপার বাবা মায়ের পছন্দ। রূপার তেমন আপত্তি নাই। ছেলেটি সুদর্শন। বাপের টাকা পয়সা আছে।
রূপার বাবা নিজেও ব্যবসায়ী। সব কিছু মিলে সোনায় সোহাগা। এরকম প্রস্তাব কোন বাবা-মা হাতছাড়া করবে না। রূপার বাবা-মা ও তা করে নি। রূপাও তার বাবা মায়ের ইচ্ছা মেনে নিয়েছে। এসব কথা আমার সবই জানা। কিন্তু রূপাকে কোন দিন কিছু বলিনি। অবশ্য বলার মত কোন সুযোগও আসেনি। আমাদের ভালবাসার মধ্যে এরকম প্রসঙ্গের কোন স্থান ছিলনা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রসঙ্গ আসেনি। প্রেমের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমাদের নৌকা আজ এই গন্তব্যে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। আমাকে তাই ব্যাপারটা তুলতেই হলো।
দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে গেল। একদিন হঠাৎ কি একটা কারণে আমার হাসপাতালে যেতে হল। ব্যাপারটা ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল না। আমি যে কামরায় বসে ছিলাম হঠাৎ করে সেখানে একজন ভদ্র মহিলা প্রবেশ করল। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কার কাছে এসেছেন? আমি তার কন্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালাম। রূপাকে দেখে অবাক হলাম। অনেকদিন পরে দেখা। দশ দশটি বছর। এই দশ বছরে পৃথিবী সূর্যকে দশবার প্রদক্ষিণ করেছে। আমার জীবনের হিসাব থেকে চলে গেছে দশটি বছর। আকাশের বুকে খসে গেছে কত তাঁরা। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মিলিত প্রবাহের কত সহস্র টন জলধারা সাগরের বুকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তার হিসাব কে দেবে।
দশ বছর আগে যে বৃক্ষ লাগানো হয়েছিল তা আজ ফলভারে নত। দশ বছর আগে যে ফুলের গাছ লাগানো হয়েছিল ঋতুতে ঋতুতে ফুল ফুটতে ফুটতে তা আজ বয়সের ভারে ক্লান্ত। আমার সারা মুখ দাঁড়ি গোফে ছেয়ে গেছে। দেখতে অনেকটা রবীনহুডের মতো । আমাকে রূপার চেনার কথা নয়। কিন্তু আমার কন্ঠস্বর শুনে সে ঠিকই চিনতে পারল। আমাকে বলল, কেমন আছ? এতদিন পর কি মনে করে? আমি শুধু বললাম, আমি জানতাম না তুমি এখানে।
রূপা কি বুঝল জানি না। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। আমাকে বলল, তোমাকে ঠকিয়ে আমি সুখী হতে পারিনি। তুমি কি আমার সম্পর্কে কিছু জান? আমি বললাম, না, কিছুই জানি না। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এতদিন কোথায় ছিলে? ছিলাম বনে জঙ্গলে। পশুপাখির সাথে। সাধু সন্যাসী সেজে। বাগের হাটের খানজাহান আলীর মাজারে। বগুড়ার মহাস্থান গড়, কুমিল্লার ময়নামতি, চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারে। বরিশালের নেছারাবাদ হয়ে চরমোনাই, শাহজালাল, শাহ পরাণ, জৌনপুর, ফুরফুরা অবধি। শেষমেষ কামরূপ-কামাক্ষ্যা। কোথায় ছিলাম না। এই দীর্ঘ সময়। তারপর না চাইতেই তোমার এখানে।
আমি মূলত: এখানে এক ভদ্র লোকের সাথে দেখা করতে এসেছি। তার এক আত্মীয় ভারতে থাকে। ওখানেই তার সাথে আমার পরিচয়। তিনি আমার কাছে একটা উপহার পাঠিয়েছেন। আমি সেটা পৌছে দিতে এসেছিলাম।
রূপা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বিয়ে করেছ? একটা নয়, অনেকগুলো। আমি জবাব দিলাম। আমার প্রতিটি রাতই বাসর রাত। কারণ সবগুলো রাতই আমার সাথে নতুন এক তোমাকে আমি খুঁজে নিতে চেষ্টা করি। পথে-ঘাটে যেখানে যে আমার বউ হতে চেয়েছে, তাকে শুধু একটা কথাই বলেছি, পশুপাখির বিয়ের কোন রীতি নেই। তুমি কি আমাকে আঘাত করার জন্য কথাগুলো বলছ। রূপা অত্যন্ত ভারী গলায় কথাটা বলল। আমি উল্টা জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি কোনদিন তোমাকে আঘাত করার জন্য কোন কিছু বলেছি। তুমি নিজের ব্যাপারে কি যেন বলছিলে? বলছিলাম আমি তোমাকে ঠকিয়ে সুখী হতে পারি নি। আমাদের একটা মাত্র সন্তান। সেও প্রতিবন্ধী। একজন সহজ সরল মনুষকে হাসতে খেলতে ঠকানোর প্রতিদান আমি হাতেনাতে পেয়েছি। আল্লাহ্ কিছু কিছু পাপের প্রতিদান সরাসরি জগতেই দেন। আর পরকালের অনন্ত দুর্ভোগতো রয়েছেই।
আচ্ছা বলতো, তুমি কি আমার জন্য বদ্বোয়া করেছিলে। কখনও নিজের অজান্তে মনের ভুলে অভিষাপ দিয়েছিলে? তুমি কেন, আমি আমার জীবনে কারো অশুভ কামনা করিনি। তাহলে এটাই আমার জন্য অভিশাপ হয়েছে। নিতান্ত ভাল মানুষকে কষ্ট দেওয়ার ফল কখনোই ভাল হয় না। তুমি খারাপ মানুষ হলে আমার পাপ এতটা গভীর হতো না। তুমি ভাল মানুষ বলেই আজ আমাকে নিজের আগুনে নিজেকেই জ্বলে পুড়ে ছাই হতে হচ্ছে। একজন ডাক্তার হয়েও আজ আমি ভীষণ অসহায়। আল্লাহ্ আমাকে চোখের সামনে দেখিয়ে দিলেন অনেক কিছুই আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমি নির্বোধ। তাই সেদিন তোমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ছিলাম। তোমাকে খালি হাতে বিদায় করেছিলাম। আর আজ আমাকে সারাজীবনের জন্য খালি হাতে বিদায় হতে হল।
তোমারতো চাকুরীতে যোগ দিয়ে বিদেশে চলে যাওযার কথা ছিল। চাকুরিটা আমি তোমার জন্য করতে চেয়েছিলাম। এসব কথাগুলো বলার জন্যই সেদিন তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কথা শোনার সময় তোমার কোথায়।
আমি যে তোমাকে বলেছিলাম, সাউথ আফ্রিকা থেকে ফিরে এলে বিয়েটা হবে।
এটা ছিল কথার কথা। আসলে আমি সবই জানতাম। আমি শুধু তোমাকে আমার দায়ভার থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার সেই চাওয়া তেমন কোন কাজে আসেনি। আল্লাহর যা হুকুম তাই হয়েছে। ভাল থেক।
Comments
Post a Comment