অবশেষে সময় বদলালো সুজনের । তার চাকরীর একটা বন্দোবস্ত হয়ে গেল। খুশীতে রাস্তার পাশের ফুটপাথ ধরে দৌঁড়াচ্ছে সে। সামান্য পরিচিতি একজন তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল - কি ব্যাপার সুজন। এভাবে দৌঁড়াচ্ছ কেন? কি হয়েছে?
আমার চাকরি হয়েছে । একটি অফিসে পিয়নের চাকরি। খবর শুনে আনন্দে দৌঁড়াচ্ছি।
তা দৌঁড়ে কোথায় যাচ্ছ?
জানি না কোথায়। এমনিই দৌঁড়াচ্ছি। আনন্দে। অনেক দিন কোন খুশীর খবর পাইনি। আব্বা মারা যাওয়ার পরে মা বাড়ী বাড়ী কাজ করে আমাকে খাইয়েছে। এভাবে অনেক বছর । কোন ভূমিকা ছাড়াই আমার মা মরে গেলো। সেই থেকে আমি ভীষন একা। অসহায়। হঠাৎ চাকরিটা হয়ে গেলো। ভীষন খুশী লাগছে।
কিন্তু পিয়নের চাকরিতো খুব একটা ভালো চাকরী না। এতো খুমী হওয়ার কিছু নেই।
আছে। খুশী হওয়ার অনেক কিছু আছে। জীবনের প্রথম চাকরি। আমি অনেক দূর যাবো।
চেষ্টা করে গেলে যেতে পারো। অনেকেই তো যায়। তোমার দোষ কি? চেষ্টা করে দেখো।
সুজন দৌঁড়াচ্ছে। ভাঙ্গা ফুটপাথ। প্রতিদিন বার বার হোচট খায়। আজ এসবের কিছুই ঘটছে না। সুজনের পায়ে ঘোড়ার বেগ। সুজন দেখতে দেখতে অনেক পথ চলে গেলো।
এখানে সুজনকে তেমন কেউ চেনে না। চেনার দরকারও নেই। সুজনের মনে অনেক আনন্দ। সে রাস্তার পাশে একটা পার্কের ভিতর ঢুকে পড়ে। পার্কের ভিতর অনেক সুন্দর সুন্দর গাছ। চারদিকে বিছানো চমৎকার রাস্তা। ছড়ানো ছিটানো বেঞ্চি। সুজন একটা বেঞ্চি দেখে বসে পড়ে। তারপর ঘন ঘন দম নিতে থাকে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।
সুজনের বয়স ১৯ বছর । এবছরই সে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। সুজন ছাত্র হিসাবে মাঝারী ধরনের। তবে সব সময় তার মনে হয় ভাল করে পড়াশুনা করতে পারলে সেও হয়তো আরও ভালো করতে পারতো। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না। ভীষন অভাবের জীবন। এর চেয়ে বেশী আর কতো। ক্ষুধার কষ্ট মাথা এলোমেলো করে দেয়। তার জন্যে পাশ করাই অনেক কিছু।
সুমনের উচ্চতা ভালো । টান টান সোজা হয়ে দাঁড়ালে ৫ ফিট ৮ ইঞ্চি। একেবারে মন্দ বলা যাবে না। তার উপরে এ্যাথলেটিক বিল্ড বডি। সব মিলিয়ে ভালোই। কিন্তু গরীবের সৌন্দর্য্যরে মূল্য কোথায়। এই শহরে কে কাকে দেখে।
সুজনের হাঁপানো কিছুটা কমেছে। সুজন আবারও উঠে পড়ল। অনেক পথ হাঁটতে হবে তাকে। আজকের দিনটাই আলাদা। মা থাকলে ভালো হতো। তাকে জড়িয়ে ধরে ভীষন কাঁদতে পারতো। মা তার জন্যে অনেক কষ্ট করেছিলো। কিন্তু আজকের এই আনন্দ দেখার জন্যে সে কেন জানি অপেক্ষা করলো না। তার ধারনা তার মায়ের জান্নাতে যাওযার খুব তাড়া ছিলো। নইলে এতো তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কোন মানে হয় না। ঠিক যেন মড়হব ঃড়ড় ংড়ড়হ. বাবার কথা সুজনের আবছা আবছা মনে পড়ে। বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলো। তাকে অনেক আদর করত।
সুজন একাই হাঁটছে। রাস্তার পাশে অগুনাতি বাড়ি। দেখতে দেখতে সুজন সামনে আগাতে থাকে। দুপুর হয়ে আসছে। রৌদ্রের উত্তাপ বাড়তে বাড়তে এতক্ষনে তা অসহ্য হয়ে উঠেছে। সুজনের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সুজন যেন আজ পথের আনন্দেই দিশেহারা হচ্ছে। সে যেন ” বোহেমিয়ান র্যাপসোডি”. ফ্রেডি মার্কারি বেঁচে থাকলে ভালো হত। দুজন মিলে পাগলামী করা যেতো।
রাস্তার পাশের একটা দোকান দাঁড়িয়ে সে একটা কলা আর একটা পাউরুটি খেয়ে নেয়। তারপর এক গ্লাস পানি চেয়ে নেয়। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে। ক্ষুধা আর ক্লান্তি কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। এখন আরো খানিকক্ষন হাঁটা যাবে। সুজনের হাঁটা প্রয়োজন।
সে মূলতঃ কোথায় যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। রাজধানীর রাস্তাগুলো প্রত্যেকটাই দীর্ঘ। সে জানে এক জীবন হাঁটলেও তা ফুরোবে না। সুজন অতোটা হাঁটতে পারবে না। পথ চলার ব্যাপারে আজ তার কোন ক্লান্তি নেই। সে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে একটা ডাকে ফিরে তাকালো। না। তাকে নয়। একটা ভীষন সুন্দর মেয়ে তার বন্ধুকে ডাকছে। তার নামও হয়তো সুজন। সুজন হতাশ হলো না। না হওয়াটাই স্বভাবিক। তবে সে সর্বদাই কান খাড়া করে রাখে এরকম একটা ডাক শোনার জন্যে। সুজনও ভালোলাগা চায়। যুক্তি তর্ক দিয়ে তার প্রেম হবে না । কারন প্রেমের সামনে দাঁড়ানোর মতো তেমন কোন অবলম্বন তার নেই। সে মূলতঃ নিঃস্ব। ঐব রং ঃযব ষধংঃ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়ষবঃধৎরধঃ. তাদের জন্যে চেষ্টায় মহাদেশে মহাদেশে ঘুরেছে সিমন বলিভার। একটা মহাদেশ স্বাধীন করার ঝুঁকি নিয়েছে। কাল মার্কস উধং কধঢ়রঃধষ লিখেছেন। ভিক্টর হুগো পাশে দাঁড়িয়েছেন লা মিজারেবল লিখে। অন্ততঃ একটা ফরাসী বিপ্লব হয়েছে এই সব সুজনদের জন্যে। লেনিনের কি প্রয়োজন ছিল সুজনরা না থাকলে। হো চি মিন বলো, মাও সে তুং বলো, কিংবা প্রিয় ম্যান্ডেলা - সবারই কাজের বিষয়বস্তুই তো এই সব সুজনেরা। বিষয়বস্তু হিসাবে সুজন বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতোকিছুর পরও সুজনেরা সেই পুরনো পথ ধরেই ছুটছে। পথ যতোই দীর্ঘ হোক তাকে তা পাড়ি দিতে হবে। সুজনকে এখন অন্ততঃ পথিক বলা যায়।
হঠাৎ করে সুজনের মনে হয় তার পিতা তাকে পিছন থেকে ডাকলো। সুজন ফিরে তাকালো। কিন্তু না। পেছনে কেউ নেই। এখানে সে মূলতঃ একাই। সুজন সামনে আগাতে থাকে। আবারও সেই ডাক। সুজন থামে। তবে অর্থহীন। পেছনে কেউ নেই। সুজন খানিকক্ষণ দাঁড়ায়। তারপর পা ফেলে। আবারও সেই ডাক। কে যেন পেছন থেকে ডাকে। এবার আর কেউ না। অবিকল তার মায়ের কন্ঠ। সেই চিরচেনা কন্ঠ। সুজনের ভুল করার কথা নয়। সে থমকে দাঁড়ায়। পেছনে তাকায়। না, কেউ নেই। তার অন্তরটা কেমন যেন করে ওঠে। মনের অজান্তেই বলে ওঠে মা! মা!। তুমি কোথায় মা! আমার মনে আজ অনেক আনন্দ। আমার চাকরি হয়েছে মা। একটা ভালো অফিসে। পিয়নের চাকরি। আমি খুব খুশী হয়েছি। তুমি আমার জন্যে অনেক দোয়া কর।
সুজন এতক্ষনে একা একাই কথা বলে চলে । নিজের সাথে নিজের এই কথোপকথন তার কাছে মন্দ লাগে না। সে সোজা সামনে এগিয়ে যায়। চোখের সামনে মায়ের ক্লান্ত মলিন কমনীয় মুখটা ভেসে ওঠে। সুজনের দু চোখের কোনায় জলের ফোঁটা। ভালোবাসায় মায়ের কাছে কেউ না। মা মানেই একটা পুরো পৃথিবী। সে একাই একটা আকাশ, এক টুকরো বাতাস, জল, হাওয়া, কাদা, ঘাস, ঘুমন্ত মাঠ, বহমান নদী, সমুদ্রের হাওয়া, ঝিরি ঝিরি বাতাস। মা মানে মায়া। হঠাৎ করেই ঘটনাটা ঘটে। একজন ভদ্র মহিলা সুজনকে ডাক দেয়। তবে নাম ধরে নয়। সুজন অবাক হয়ে তাকায় । এই মহিলা তার চেনা নয়।
এই ছেলে শোনো। তুমি কি বলতে পারবে এখানে শমসেরদের বাড়ী কোনটা। আমি নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি। মোবাইলের চার্জও শেষ। কলও করতে পারছি না। আমাকে একটু সাহায্য কর।
কিন্তু আমি তো খালাম্মা এই এলাকায় নতুন। এলাকার আমি কিছুই চিনি না। আমাকে ক্ষমা করুন।
কাউকে ডেকে একটু জিজ্ঞেস করো না। ওদেরকে সবাই চেনে। কেউ না কেউ কিছু না কিছু বলেতে পারবে।
ভাই এখানে শমসের ভাইদের বাসা কোনটা?
আংকেলদের বাসা ? বলে ওঠেন বেশ সিনিয়র এক ভাই। সামনে এগিয়ে গেলে পুরাতন চারটা বাড়ীর পরই ওনাদের বাড়ি । গেটে দারোয়ান আছ্।ে
আসুন খালা। আমি আপনাকে এগিয়ে দিই।
কি নাম তোমার বাবা।
সুজন।
কি করো।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে একটা চাকরি হয়েছে। অফিস পিয়ন।
এটা তো খুব একটা ভালো চাকুরি না ।
আমার জন্যে ভালো চাকুরি। আমার মা বাবা কেউ নেই। পড়াশুনা করছি অনেক কষ্টে। এখন চাকরি হওয়াতে ভালো হয়েছে। খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারবো। আস্তে আস্তে সামনে আগাতে থাকবো।
বল কি! পিওনের চাকুরি করে সামনে আগাবে কেমন করে। তাছাড়া পড়াশুনা। এভাবে পড়াশুনা হয় নাকি?
হবে খালাম্মা । গরীবের সব ভাবেই হয়। আমার হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আমাকে আগাতে হবে।
আমার সাথে ভিতরে চলো।
না খালাম্মা। আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। আমি আসি খালাম্মা ।
একটু দাঁড়াও।
সুজন হাঁটতে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আস্তে আস্তে রাত্র। সুজন বাসার দিকে ফিরছে। বাসা বলতে তেমন কিছু না। বস্তিতে একটা ছোট রুম। কোন মতে কষ্ট করে বেঁচে থাকা। এমন কি খারাপ। খাওয়া দাওয়ার খরচ মিটানোর পরে রুমের ভাড়া দিতেই ভীষন কষ্ঠ হয়। তবুও ভালো লাগে।। একার একটা পৃথিবী । সুজন নিজেই নিজের পৃথিবীর রাজা।
সুজন এখন কাঁচে ঘেরা একটা ঘরের মধ্যে বসে আছে। দামী স্যুট টাই পড়া। দিনে দিনে তার অর্জন শুধু বেড়েছেই। যদিও মাঝখানে কেটে গেছে দশটা বছর। অনার্স করে তারপর মাষ্টার্স। তারপর চাকরি। সেই খালাম্মার অবদান। দুহাতে অনেক টাকা । গাড়িতে পাশের সিটে রাজকন্যা। সুজনের হাতে স্টিয়ারিং।
রাতুলের দুচোখে অনেক ভালোলাগা। যোগ্য একটা মানুষ পেয়ে তার জীবন ধন্য। গরীবের ছেলে। মা-বাপ নেই। আছে শুধু রুচি আর অর্জনের ঝলকানি। কিন্তু অহংকার নেই। মা তার জন্যে সাগর সেঁচে মুক্তো নিয়ে এসেছেন। সুজনের মা বাবার জন্যে রাতুলের বড় মমতা হয়। মনে মনে বলে ধন্য সেই মা যার গর্ভে সুজন জন্মেছে। ধন্য সে যার ঔরশজাত সে। এরকম সুজন দু-একটা পাওয়া যায়।
সবচেয়ে বড় কথা রাতুল তার মায়ের মতো। সাধারণ মেয়েরা বাপের মতো হলেই ভালো। কিন্তু রাতুল ব্যাতিক্রম। ছেলেরা মায়ের মতো হলেই ভালো হয়। কিন্তু সুজন ঠিক তার বাপের মতো। রাতুল যখনই সুজনের দিকে গভীর ভাবে তাকায় সুজন শুধু একটা কথাই বলে - লাভ, বাই চান্স।
Comments
Post a Comment