প্রতিবার মাওয়া ঘাট
পেরিয়ে কাওড়াকান্দি
হয়ে সরাসরি
চলে যাই। কোথাও
দাঁড়ানোর অবকাশ
থাকে না। দীর্ঘ
নদী পেরিয়ে
ওপার উঠলেই
গাড়ী ধরার
তাঁড়া।
দাঁড়ানোর ফুরসৎ কই। কর্মচঞ্চল
মানুষদের ভিড়ে
ধাক্কাধাক্কি করে কোনমতে গিয়ে বাস
কিংবা মাইক্রোবাসে
একটা সিট
বুঝে নিয়ে
উঠে পড়ি। এভাবেই
ছাব্বিশটা বছর পেরিয়ে গেছে।
কোনদিন ঘাটের
চেহারাটাও ভালো করে দেখার সুযোগ
হয়নি।
নিতান্ত প্রয়োজনের
তাগিদে শুধু
জেনেছি কোথায়
মসজিদ আর
কোথায় গণপ্রক্ষালণ। এখন
আর মাঝে
মাঝে তারও
প্রয়োজন পড়ে
না।
সময়ের চাপে
নামাজটা প্রায়ই
তায়াম্মুম করে গাড়ীতে পড়ে নেই। বাথররুমটা
চেপে রাখি
কোনমতে।
জীবন আমাদেরকে
এরকম অনেক
কিছুই চেপে
রাখতে শিখিয়েছে। ক্ষুধা,
তৃষ্ণা, কামনা
বাসনার পাশাপাশি
অনেক প্রয়োজন
অপ্রয়োজনের কথা চেপে রেখেই বাঁচতে
শিখেছি আমরা। বিশেষ
করে আমাদের
মতো যারা
তাদের জীবনের
গল্প বলতে
গেলে প্রায়
একই রকম। আমরা
বেঁচে থেকেই
আস্তে আস্তে
মরি।
অথবা মরতে
মরতে কোন
মতে বেঁচে
থাকি।
আমাদের জন্যে
সবই সমান।
এবার কেন জানি
মনটা বাগড়া
দিলো।
ইচ্ছে করেই
নড়লাম না। ঢাকা
থেকে যাচ্ছিলাম। নদী
পেরিয়ে ওপার
উঠেই বসে
পড়লাম।
সাধারণত চা
খাইনা।
তাও খেলাম। ঘাটের
গরম দুধ
চা।
অন্য রকম
একটা স্বাদ। আমার
কাছে হয়ত
বেশিই সুস্বাদু
লাগল।
কারণ আর
কিছুই নয়। মন
চাইছিল না। তাই
দ্রুত নড়লাম
না।
এদিক ওদিক
তাকাচ্ছিলাম। তেতাল্লিশ বছর বয়সের
মানুষ।
পোর খাওয়া
জীবন।
অনেক জোড়া
তালি দেওয়া
জামার মতন
জীর্ণ।
অনেক টুকরা
টাকরা লাগানো
নৌকার মতো
বিমর্ষ।
জীবনে পরাজিত
হতে হতে
এখন আমি
বেতাল বৃক্ষ। অপমান
সইতে সইতে
এখন আমার
শরীরের চামড়া
তালগাছের মতো
পুরু হয়ে
গেছে।
মাথার চুলগুলো
রূক্ষ।
চোখের নীচে
কালি।
ভাঙ্গা চোয়াল। ঝুলে
আসা পেটে
দারুন হাস্যকর
লাগে।
সুন্দর মানুষদের
সামনে গেলে
আমার এই
অসুন্দর দারুন
প্রকট হয়ে
ওঠে।
তবু আমি
বেঁচে আছি। আমাদের
এভাবেই বাঁচতে
হয়।
সেদিন কেন জানি
মনটা খুব
ফুরফুরে লাগছিল। বেঞ্চের
পাশে রাখা
পুরনো জীর্ণ
ব্যাগের দিকে
একটু পর
পর নজর
রাখছিলাম।
ঘাট জায়গাটা
মোটেই সুবিধার
নয়।
আমার মতো
নিঃস্বের এই
আরও নিঃস্ব
ব্যাগটা নেওয়ার
মতো কাঙ্গালেরও
অভাব নেই। আসলে
সময় এখন
এমন যে
মরা মানুষের
লাশ নেওয়ার
মতো লোকেরও
অভাব হয়
না।
আজকাল মানুষগুলো হয়ে
গেছে হায়েনার
মতো।
একজন একেক
ধরনের হায়েনা। এদের
কেউ শহরের
বিলাসী মানুষ। কেউ
আবার নিতান্ত
হত দরিদ্র। কিন্তু
সবার মধ্যে
যথেষ্ট মিল। সবার
হাতেই নখর
আছে।
তা দিয়ে
ইচ্ছে করলে
আঁচড়ে দেওয়া
যায়।
আবার ইচ্ছে
করলে গুটিয়ে
নিয়ে আদরও
করা যায়। ইদানিং
সেগুলো ভীষণ
স্পষ্ট হয়ে
উঠছে।
আমাদের পরাজয়ের
জন্যে অন্য
কোন দোষ
দিয়ে লাভ
নেই।
মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দেওয়ার জন্যে কোন
অজুহাতের প্রয়োজন
হয় না। মানুষ
ইচ্ছে করলেই
তা পারে।
হঠাৎ করেই
একটা লোক
এসে পাশে
বসল।
পাশের লোকদের
সাথে কথা
বলতে শুরু
করল।
কথাবার্তা শুনে মনে হলো লোকটা
ভীষণ ত্যাঁড়া। আমিও
যোগ দিলাম। এই
লোকের সাথে
পারা কষ্ট। আমি
তার সাথে
সুর মেলালাম। একেই
বলে ঝোপ
বুঝে কোপ
মারা।
আমরা জিতে
গেলোম।
এই জয়ে
তিনি খুশি
হলেন।
আমাকে বললেন,
ঘন করে
দুধ দিয়ে
এক কাপ
চা খাবেন। বিলটা
আমিই দেবো।
চা একদম খাইনা। তারপরও
রাজি হলাম। বন্ধুত্বের
প্রথম অফার। ফিরিয়ে
দিলে জমবে
না।
উনি খুশি
হলেন।
মনে হলো
এই লোক
সারা জীবন
স্বীকৃতির জন্যে সংগ্রাম করেছে।
হয়তো কিছুটা
পেয়েছে।
কিন্তু তা
যে তাকে
খুব একটা
তৃপ্ত করতে
পেরেছ তেমনটা
মনে হয়
না।
উনি আমার
সম্পর্কে জানতে
চাইলেন।
অবশ্যই গতানুগতিক
কায়দায়।
ছেলেমেয়ে কয়টা
কিংবা কোথায়
থাকি।
মূল বাড়ী
কোথায়।
বউ কিছু
করে কিনা
ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও
জবাব দিয়ে
দিলাম।
কিছুক্ষন চুপ থেকে
একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেললেন।
আমি বললাম,
কি হলো
হঠাৎ
নিঃশ্বাস ফেললেন
যে এমন
করে।
উনি বললেন,
কিছুই হয়নি। আমি
মূলত জীবনের
কাছে হেরে
গেছি।
আমার আগ্রহ
জাগলো।
কেন এমনটা
মনে হলো
আপনার কাছে।
মনে হবার কি
আছে।
যা সত্য
তা বলছি।
আমি বললাম সত্যটা
তাহলে কি?
উনি বললেন, যাবেন
আমার সাথে। আপনাকে
সত্যটা দেখাব।
আমি বললাম, যাবো।
তাহলে চলেন।
দুজনে রওয়ানা দিলাম। বাসে
উঠলাম না। স্থানীয়
একটা সাধারণ
পরিবহনে করে
ভাঙ্গার পথে
রওয়ানা দিলাম। আড়িয়াল
খাঁর কাছে
যেতে থামলাম। আমিও
নামলাম।
উনি নদীর
তীরের দিকে
হাঁটতে লাগলেন।
আমি বললাম, এখানে
কেন।
কিছু একটা
দেখাতে চেয়েছিলেন।
উনি বললেন, ঐ
নদীর ভেতর
কিছু দেখতে
পান।
আমি বললাম, হ্যাঁ
পাই।
কি দেখতে পান?
আমি বললাম, পানি।
আমার চোখের জল। উনি
বললেন।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
পানি ছাড়া
আর কিছু
দেখেন।
আমি বললাম, না।
আমি দেখি।
আমার প্রেমিকার
মুখ।
এই নদীর
পানির ভেতর
সবসময় মুখটা
ভেসে থাকে।
ঘটনাটা কি?
আমার স্ত্রী।
আমার ভালোবাসার
মানুষ।
সড়ক দুর্ঘটনায়
এই নদীতেই
ডুবে মারা
গেছে।
এখানে তখন
ব্রিজ ছিল
না।
ফেরী ছিল। ফেরী
পারাপারের সময় ও হঠাৎ
মাথা ঘুরে
নদীতে পরে
যায়।
আর খুঁজে
পাইনি।
পরের অবশ্য
পেয়েছিলাম।
লাশ।
শরীরের কোথাও
কোনো আঘাতের
চিহ্ন ছিল
না।
অবশ্য সাঁতার
জানতো না। উনি
থামলেন।
তাছাড়া জানলেও লাভ
হতো না। সম্ভবতঃ
ফেরীর তলায়
চলে গিয়েছিল। পরে
মরে ভেসে
উঠেছে।
সেই মুখ
ভোলা কঠিন।
আমি কি বলব
বুঝে উঠতে
পারলাম না। সে
বসে রইল। আমি
হাঁটতে শুরু
করলাম।
সন্ধ্যা নামছে। আমাকে
খুলনা যেতে
হবে।
এখনও দুঘন্টার
পথ।
রাত বেশী
হলে এই
পথে যানবাহন
থাকে না।
Comments
Post a Comment