Skip to main content

Fabricare receipt 01 08 2024

যে প্রেম স্বর্গের দান


(১)
হাত বাড়াও
আমি দাঁড়িয়ে আছি
তোমাকে ছোঁবো বলে
ওগো সীমাহীন সুন্দর
এতোটা কৃপন হলে চলে
একবার অন্তত তাকাও
ফিরে তাকাও না হয় ভুল করে
আমি তলিয়ে যাচ্ছি অতলে।

সামান্য বৃষ্টি হলেই মহল্লার রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যায়। সেই পানি নীচু ঘরের মেঝেতে ঢুকে পড়ে। তারপর মেঝের উপর রাখা নি¤œমানের যা কিছু মাল সামান তাও ভিজিয়ে ফেলে। টিনের বস্তি ঘরগুলোতে বাস করা মানুষগুলোর প্রতি বছরই বর্ষায় প্রায়শই এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। দেখতে দেখতে সবকিছুই তাদের গা সহা হয়ে গেছে। তাই বলে কষ্ট যে কম কিছু তা কিন্তুু নয়।
করিমের চাকরিটা মাত্র গত মাসেই চলে গেছে। একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরি করত সে। অফিসের একটা পুরনো আলমারি বিক্রির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতো বড় বিপত্তি। কে যেন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে নালিশ করেছে যে করিম এই আলমারি ঠিক যে দামে বিক্রি করেছে তার পুরোটা অফিসের ফান্ডে জমা দেয়নি। বস তার কথা শোনারও প্রয়োজন মনে করেনি। তাকে সরাসরি ডিসমিস করে দিয়েছে। মূলত ঘটনা ছিলো অন্যরকম। অফিসের পিয়ন নয়ন দারুন চতুর টাইপের। আলমারি বেচার জন্যে একটা লোককে ঠিক করেছিল যে সেখান থেকে পাঁচশত টাকা তাদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলে। কিন্তুু করিম রাজী হয়নি। কারণ দুটো। একে তো ঘুষের টাকা সে নেবে না। দ্বিতীয়ত এ লোক ন্যায্য দামের চাইতে অনেক কম দামে মালটা বিক্রি করার জন্য নয়নকে রাজী করিয়েছিলো। নয়নের প্রস্তাব ছিলো এতে উভয় পক্ষ লাভবান হবে। কিন্তুু করিম অফিসের লাভের কথা চিন্তা করায় নয়নের সাথে তার ঝগড়া হয়। বসের ঘনিষ্ট পিয়ন নয়নের কাছে হেরে যায় সে। শেষমেষ তার চাকরিটাই চলে যায়।
করিমের আগের বাসাটাও কম ভাড়ার ছিলো। কিন্তু সেই কম ভাড়াও এখন তার কাছে অনেক বেশি। সে তাই এ বর্ষার মধ্যেই বাসা ছেড়ে দিয়ে এই বস্তিতে এসে উঠে পড়ে। তার ভাগ্য ভাল যে ঐ বাসাটার জন্যে একটা ভাড়াটিয়া পাওয়া গিয়েছিলো। নইলে দুমাস তাকে ঐ বেশি ভাড়ার বাসায় থাকতে হতো। যদিও তার হাতে টাকা পয়সার তেমন কোন যোগান নেই।
যাহোক শেষ পর্যন্ত টেনেটুনে মাত্র পনেরশ টাকায় এই বস্তিঘরের ব্যবস্থা হয়েছে। করিম এখন জানে না এই টাকার ব্যবস্থাও বা কোথা থেকে হবে। কারণ তার হাতে মূলত জমানো তেমন কিছুই নেই। উল্টোধার দেনা আছে বেশ কিছু। করিম তবুও হতাশ হচ্ছে না। হতাশা মুত্তাকীর পরিচয় না। করিম নিজেকে শক্ত ঈমানের অধিকারী মনে করে। তার ধৈর্য্য আর বিশ্বাস তাই অগাধ। কেন জানি তার খুব একটা অস্থির লাগছে না।
আজ দিন ভরই বৃষ্টি হলো বলতে হবে। মাঝে মাঝে যাও একটু থেমেছিলো তাও তেমন উল্লেখ করার মতো কিছু না। এর মধ্যে দিয়ে সে বাসা বদলানোর কাজটা সেরে ফেলল। যদিও মাল জিনিস সামান্য যা কিছু তাও ভিজে একাকার। তবুও কাজটা যে শেষ করা গেছে এতেই তার স্বস্তি। আজ মাসের এক তারিখ। তার পুরনো বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া উঠবে। তাকে তো বাসা ছাড়তেই হবে। বৃষ্টি কিংবা খরা এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় না। প্রয়োজনটাই মূলত আসল। করিমের মতো মানুষর সারাজীবন প্রয়োজনকে সাড়া দিয়েই চলতে হয়। করিমের ঈমান তবুও দিন দিন বাড়ে।
করিম সব সময়ই রেহানার উদ্দেশ্যে মজা করে বলে- এই প্রেম স্বগের দান। রেহানাও হেসে বলে, এই ভাঙ্গা ঘরে তুমি প্রেম দেখলে কোথায়? করিম মাথা নাড়িয়ে বলে তোমার পাকা অন্তরে। বাবা-মার জমানো আলাপে মেয়ে দুটো এখন আর বিরক্ত বোধ করে না। তারাও বুঝে গেছে তাদের বাবা এরকমই। সাদা মনের মানুষ। যা বলবে সরাসরি। মিথ্যার ধারে কাছেও নেই। দারুন মেধাবী মানুষ। কথায় কথায় বানিয়ে বানিয়ে কবিতা বলে। তা সে শীত গ্রীষ্ম যাই হোক। সুখ-দুঃখ যাই হোক। শুধু কবিতা বানানোতেই স্বাদ না করিমের। পৃথিবীর বড় বড় বিখ্যাত কবির অজস্র কবিতা মুখস্থ তার। এটা তার নিজস্ব অর্জন। শিক্ষাগত জীবনে গ্রাজুয়েট করিম ইংরেজিতে দারুন ভালো। শুধুমাত্র অভাবের তাড়নায় জীবনে চেষ্টাও করে দেখতে পারেনি। মেয়েরা পড়াশুনা করার চেষ্টা করছে। কিছু একটা করার। কিন্তুু করিম জানে আমাদের দেশে মেয়েদের  ভবিষৎ কেমন। তার উপর গরীব মেয়ে হলে তো কোন কথাই নেই। নিয়তি তার হাঁটুতে ঝোলানো। যত হাঁটবে ততো আঘাত করবে। যত দিন গড়াবে ততো ভারী হবে। করিম তবুও আশাবাদী। ব্যতিক্রমও তো আছে। মেয়ে দুটো মাদ্রাসায় পড়ছে। একটা ক্লাস ফাইভে। ছোটটা নূরানী পড়ছে। হেফজ করবে। করিমের খুব আশা যেনো কোরআনের হাফেজ হতে পারে। তার নিজের হাফেজ হওয়ার শখ ছিল কিন্তুু শেষমেষ কিছুই হয়নি। কোনোমতে বি.এ পাশ করে অফিসের কেরানী।তাও আজ চাকরি আছে তো কাল নেই। প্রাইভেট কোম্পানরি চাকরি। বিদ্যুতের মতো যায় আর আসে।

করিমের জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয় স্ত্রী রেহানা। রেহান কে মানবী বললে কেমন যেন ছোট করাহয়। সে আসলে ঐশ্বরিক কিছু। করিম তার জীবনে কোনদিন। কল্পনাও করেনি এরকম একটা স্ত্রী সে পাবে। কিন্তুু আল্লাহ তাকে তাই দিয়েছেন। রেহানা চাকরি করে না। ঘরেই থাকে। সংসার সামলায়। করিমের রোজগারের টাকায় চলে। সংসার সামলানোয় কোন আর্থিক অবদানও তার নেই। তবুও করিমের পুরো পৃথিবীটাকেই সে যেন মাথার উপর নিয়ে বসে আছে। দারুন এক মানুষ। তার রসবোধের কোন কমতি নেই। করিমের প্রতি তার সংসার জীবনের শুরু থেকেই অটুট সম্মান। করিমও ভীষন মজা করে তার সাথে। এতো দুঃখ আর দুর্দশার মাঝেও করিমের মনে তাই আনন্দ। সারাদিন কবিতার চরণ আওড়ায়। তাও আবার নিজেইর বানানো। অধ্যায়ের শুরুর কবিতাটা একটু  আগেই মালামাল ওঠাতে ওঠাতে করিমই রেহানাকে বলেছে। রেহানা বরাবরের মতোই মিষ্টি করে হেসেছে। আফসোস কর বলেছে লিখে রাখতে পারলে ভালোই হতো। কিন্তু রেহানা কোন লেখাপড়া জানে না। গ্রাজুয়েটের অশিক্ষিত স্ত্রী সে। কিন্তুু করিম সবসময়ই বলে তুমি বরাবরই স্বশিক্ষিতা। আমার এতেই সুখ। অনেক লোকের শিক্ষিতা বর্বর স্ত্রীর চাইতে অনেক ভালো। আমাকে ভাগ্যবান বলতে হবে।
করিমের বড় মেয়ের নাম মালেকা। সে হুবহু তার মায়ের মতো। দেখতেও যেমন হয়েছে লেখাপড়ায় তেমনি দারুন। মাদ্রাসায় সে খুবই ভালো করছে। মাদ্রাসা থেকে তার বেতন যতোটা সম্ভব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। করিমের আর্থিক সমস্যার কথা তারা কিছুটা হলেও জানে। ছোট মেয়ের নাম মাজেদা। নাম দুটোই করিমের মায়ের রাখা। মায়ের কথার উপর কথা বলেনি সে। যদিও  নাম দুটোর একটাওতার পছন্দ হয়নি। তাদের নানা-নানী বলেছে এই নামেই মেয়েরা ভাগ্যবতী হবে। তাকে এনিয়ে ভাবতে হবে না।

করিম ভাবছেও না। এসব নিয়ে ভাববার সময় তার নেই। বাসা ভাড়া, ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার টাকার জোগান নিয়েই তাকে ভাবতে হয়। যদিও অতোটা হতাশ সে নয়। কারণ একটাই। রেহানা তার পাশে আছে। এই মহিলা তাকে হিমালয়ের চূড়ায় তুলতে পারে। করিমের বিশ্বাস একেবারে অমূলক নয়। বরাবরই রেহানা তাকে মনোবল জুগিয়েছে। এবারও জোগাচ্ছে। তার ধারনা সে তার সময়ের মধ্যেই একটা চাকুরি পেয়েযাবে।

(২)
তুমি হাত বাড়ালেই
আমি যমুনা হবো
তুমি ¯œান করবে গা হাত পা ভিজিয়ে
তুমি চাইলেই আমি বৃক্ষ হবো
তুমি তার ছায়ায় বসবে

রেহানা হেসে কুটি কুটি। এরকম একটা বাজে জায়গার মধ্যেও করিমের মুখে হাসির কমতি নেই। মনেও নেই আনন্দের কমতি। রেহানা জানে। তারপরও বলে আচ্ছা বলোতো এতো আনন্দ আসে কোথা থেকে তোমার মনে। তোমার কাছ থেকে। তোমার শরীর থেকে বাতাসে ভর করে যে সুগন্ধ আসে তা জাভা সাগরের মসলা দ্বীপের সুগন্ধকেও হার মানায়। তোমার কন্ঠস্বর থেকে সে সুর বের হয় তা হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালাকেও হার মানায়। আর তোমর উপস্থিতিতে আমার মনে হয় সারাজীবন আনন্দ সাগরে ভাসছি। কারণ এই তুমিই আসলে তুমি। তুমিই আমার কথা, তুমিই আমার কবিতা, আমার স্বপ্ন। আমার সব কিছু তোমাতেই যুথবদ্ধ। আমি হারিয়ে গেলেও তোমাকে খুঁজি। আবার ফিরে পেলেও তোমার মাঝে হারিয়ে যাই। আমার জীবন যৌবন মেধা মনন সবই তোমার বৃত্তের কেন্দ্রে ঘুরপাক খায়। তোমার কাছেই এই লুকোচুরি। তোমার প্রদীপেই আমার আলো। তুমিই আমার সময়ের সুমেরু-কুমেরু। তুমিই আমার পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ। তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না এই ভালোবাসা যে কি। আমি বায়রন বা শেলী পড়ে যে আনন্দ পাই তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাই তোমার কাছে। তুমি আমার জীবন্ত কবিতা।
থাক। আর কাব্য করতে হবে না। এবার একটু বিশ্রাম নাও। সারাদিন যে খাঁটুনী গেছে। ভাবছি এই জায়গায় তোমার কতো কষ্ট হবে। তুমি বরাবরই  থাকার জন্যে  একটু ভালো জায়গা  পছন্দ করো।
তোমার কষ্ট হবে না। করিম উল্টো জিজ্ঞেস করে। রেহানা চুপ করে থাকে। তার মাথা আরো নীচু হয়ে আসে। দু’ ফোটা অশ্রু টুপ করে মেঝের উপরঝরে পরে। করিম বুঝে উঠতে পারে না কি বলবে। তার চোখও ভিজে আসে।
মালেকা-জবেদার মনেও তেমন কোন কষ্ট নেই। জীবনের সব অবস্থার সাথেই তারা মোটামুটি নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখেছে। আসলে জীবনের প্রয়োজনে  একটা ছোট শিশুকেও অনেক কিছুই শিখে নিতে হয়।

(৩)
চেয়ে দেখ আকাশ কেমন সেজেছে আজ
মনে হয় অনেক মুগ্ধ জ্যোৎ¯œা হবে
মেঘহীন এই মুক্ত আকাশে 
ইচ্ছে করে মেঘ দিয়েই লিখে দেই তোমার আমার প্রেম;

আসলে এসব কিছুই নয়
পৃথিবী ভারী আর বিমুখ
আমি কি তবে অবেলায় ভুল করে এলেম
তোমাকেই প্রিয়তমা বলে ডাক দিলেম।

তুমি কোন ভুল করোনি। আমি আমার বিয়ের আগেই ঠিক করে রেখেছি জীবনে আমার স্বামীর মনে কখনও কষ্ট দেবো না। তার জন্য যা কিছু করতে হয় করব। যা মেনে নিতে হয় নেব। আমার মা আমাকে এই একটা শিক্ষা দিয়েগিয়েছেন। তিনি সবসময়ই বলতেন বিয়ের পর তুমি যতোটা না নিজের তার চেয়ে বেশি স্বামীর হওয়ার চেষ্টা করো। জীবনে সুখী হবে। হয়তো সাময়িক ভাবে অনেক কিছু বেমানান মনে হতে পারে কিন্তু একটা কথা মনে রেখো সংসারে পুরুষ মানুষই শেষমেষ সমাধানটা দেয়।শত ঝড় ঝঞ্ঝায় তারাই শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌছায়। তুমি কখনও এই ভুলটা করো না। স্বামীর মনে কষ্ট দিও না। যদি স্বামীকে ভালবাসতে পারো সংসারে তুমি সুখী হবেই। আমি আমার মাকে কথা দিয়েছিলাম আমি তার কথা রাখবো। কিন্তুু আমাকে ভালোবেসে কি পাবে। একজন সামান্য মানুষ আমি। চাকুরি বাকরি নাই। মাথার উপরে তোমরা তিন জন। মাথার উপরে আল্লাহ আছেন। তুমি ঠিক বলেছ আল্লাহ অবশ্যই আছেন। আমার মনে হয় কিছু একটা ব্যস্থা হয়ে যাবে। তুমি কাল আল্লাহর নাম নিয়ে বের হবে। দেখবে ভালো কিছু নিয়েই ঘরে ফিরবে। মালেকা আর জবেদাও মায়ের কাছে এসে বসে। রেহানা মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। করিমের গলায় তখন গান - উজান গাঙ্গের নাইয়া, আর কতোকাল যাবো আমি ভাঙ্গা তরী বাইয়া।

(৪)
রাতভর জ্যোৎ¯œায় ভিজলাম
তোমার আকাশ কাল
অনেক উদার ছিলো
অনেক তারা উঠেছিল হয়তো ভুল করে
এভাবেও ভালোবাসা যায়;
হঠাৎ এ আর এমন কি
এরকম তো অনেক হয়েছে
তুমি যতোটা না নিয়েছ
তার চেয়ে হাজারগুন বেশি দিয়েছ
তোমার  ছবি তাই চোখ বুজেও আঁকা যায়।
করিম বেরিয়ে যায়। আজ আকাশটা মোটাটুটি পরিচ্ছন্ন। কয়েকদিনের বৃষ্টির পরে বাইরের প্রকৃতি অনেক পরিচ্ছন্ন। রাস্তাঘাট থেকে পানি অনেকটাই নেমে গেছে। বৃষ্টির ঢাকা বরাবরই নোংরা। রাস্তার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটছে সে। মনে মনে একটাই ভাবনা কিছু একটা করতে হবে। তিন তিনটা মানুষের দায়িত্ব তার কাঁধে। তাকে তো একটু দায়িত্বশীল হতেই হবে। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে যায়। তেমন কোন ব্যবস্থা হয় না। আসলে করিম বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় যাবে কার কাছে যাবে। এদিকে ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। পকেটে সামান্য টাকা। রাস্তার পাশে ডেকচিতে খিচুরী বিক্রি করছে এক লোক। সে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ে। মোটা চালের হলুদ রঙের খিচুরী। সাথে ঠিক ঠাক দু’এক টুকরা আলু। করিমের কাছে মনে হয় অমৃতের স্বাদ। সারাদিন রাস্তায় হেঁেট হেঁটে ক্লান্ত করিম অবশেষে বাসায় ফিরে আসে। কোন ব্যবস্থা হয় নাই। রেহানা মন খারাপ করে না। মাত্র তো একটা দিন। প্রথম দিনেই সবকিছু হয়ে যাবে এমন কথা বলা যায় না। আসলে ধৈর্য্যই হচ্ছে আসল।
কথায় কথায় রাত অনেক হয়ে যায়। রেহানা করিমকে শুয়ে পড়তে বলে। মালেকা জবেদাও ঘুমাতে চলে যায়। করিম চিৎ হয়ে শুয়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে। রেহানা তাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। আরাম করে ঘুমাও। একটা বন্দোবস্ত হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ্।
দেখতে দেখতে পনের দিন চলে যায়। কোন ব্যবস্থা হয় না। রেহানার টেনশন বাড়ে। কিন্তুু করিমকে সে কিছুই বুঝতে দেয় না। করিম ঠিকই বুঝতে পারে। রেহানাকে সে মুখে কিছু না বললেও ভেতরের দুশ্চিন্তা তার চোখে মুখে ঠিকই ধরা পড়ে।
প্রতিদিনের মতো আজও করিম সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। দুপুর নাগাদ বরাবরের মতো রাস্তার পাশের একটা দোকানে কিছু একটা খেয়ে নেয়। সে আসলে ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে পড়ছে। ক্ষুধা থাকলেও তার গলা দিয়ে কেন জানি খাবার নামতে চাইছে না। দুঃখের ভারে করিমের হৃদয় যেন ক্লান্ত পাখির ঝুলে আসা কোমল গলার মতো ক্রমশ মাটির দিকে নেমে আসছে। করিমের দু’চোখে জলের ধারা। সে সবার অগোচরে তা মুছে ফেললো। কোনমতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে করিম মনে মনে ঠিক করলো একটা বই কিনবে। কবিতার বই। জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেন। এই লোকের কবিতায় কি যেন একটা কিছু আছে। কেথায় যেন কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছেন তিনি। প্রতিটি শব্দের ভাঁজে ভাঁজে প্রতিটি লাইনের বাঁকে বাঁকে জীবনানন্দের জীবন আর তার দুঃখবোধ কারো সাথে মেলে না। মনে হয় আস্ত একটা জীবন। কবিতায় জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে গেছেন। এতো গভীর আবেগ, তীব্র জীবনবোধ, এতো সুন্দর চিত্রকল্প আর ভাবকল্প বাংলা ভাষার আর কোন কবি কখনও আঁকতে পারেননি। জীবনানন্দ এখানে শুধু অসামান্যই না অমরও। সে তাই বাংলার বিস্ময়। নীলক্ষেতের রাস্তার উপরে অনেক দোকান। বইয়ের ছড়াছড়ি। দু’একটা দোকান দেখতেই জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেন পাওয়া যায়। কিন্তুু অন্য রকম ঘটনা ঘটে যায়। জীবনানন্দ দাস হাজার বছর ধরে পথ হাঁটলেও করিম মাত্র পনের দিনেই তার বনলতা সেনকে পেয়ে যায়। করিম যে দোকান থেকে বই কেনে সেই দোকানের লোকটাই কেন জানি বার বার তার দিকে তাকাচ্ছিল। আসলে কথা হলো অন্য। করিমের এক বন্ধু নাসির। আজ থেকে প্রায় দেড় যুগ আগে তারা একসাথে সুখ-দুঃখে অনেক সময় কাটিয়েছে। এই দোকানদার নাসিরের বন্ধু। ভদ্রলোকের নাম মাসুম।
মাসুম অত্যন্ত আবেগ প্রবন হয়ে পড়ে। এতোদিন পর করিমকে দেখে তার পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। অনেক যতœ করে। সবার কথা জানায়। মাসুম লোকটা আগেও ভাল ছিলো। এখন দাড়ি রেখে পুরো দস্তুর মাওলানার মতো লাগছে।
এই মাসুমের কাছ থেকেই সে জানতে পারে তাদেরই এক বন্ধু জাফর এখন কোটিপতি। বিশেষ একটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে জাফর অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন জাফর বড় ব্যবসায়ী।
মাসুমের সাথে অনেক কথা হয়। সব কথা আসলে লিখে বোঝানো যায় না। করিমের বিষয়ে জানতে পেরে সে বলে কোন চিন্তা নাই। সবকিছু বদলে যাবে। আমি দেখছি কি করা যায়। নাসিরকে আপনার কথা জানাব। মাসুমের কাছে আপনাকে নিয়ে যাবো। সব বদলে যাবে।
অনেক আনন্দ নিয়ে করিম বাসায় ফেরে। কিন্তু রেহানাকে কিছুই বলে না। আগে সব কিছু হোক। পরে বলা যাবে। তবে শুধু একটু অপেক্ষা। একটা বন্দোস্ত হয়ত শ্রীঘ্রই হয়ে যাবে। নাসিরের সাথে যথারীতি দেখা করে করিম। দেখা হয় জাফরের সাথেও। তার জন্য একটা ব্যবস্থার বন্দোবস্ত হয়ে যায়। ছোট একটা দোকান। তাতে থরে থরে সাজানো বই। করিম এতোদিন তার মনের মতো কিছু করতে পারে। এবার তার সময়টা কাজে লাগবে। মাসুম নিজেই একটা লাইসেন্স জোগাড় করে দেয়। অন্যান্য কাজও সে তার নিজ হাতে করে দেয়। করিমের শ্রী বদলাতে থাকে।

রেহানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাঁচে। যাক। অবশেষে তাহলে মানুষটা তার পছন্দের একটা কাজ পেয়েছে। এবার তার সময়টা ভালো কাটবে। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে মালেকা জবেদাও দোকানে গিয়ে বসে। বাপের সাথে সাথে তারাও চেষ্টা করে সামর্থ অনুযায়ী।
করিমের ঘরে নতুন মুখের আগমন হয়। এই সন্তান তারা প্রত্যাশাও করেনি। অতিরিক্ত আবেগের ফল। কোন এক অসতর্ক মুহুর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে যায়। তারা সকলেই মেনে নেয়। আল্লাহ্র হুকুম।
এই প্রথম করিম ছেলে সন্তানের মুখ দেখে। মেয়ে নিয়ে তার কখনও আফসোস ছিলো না। তবুও সে খুশী হয়। সবাই বলে করিম ভাই দোকান চালানোর লোক পাওয়া গেছে। করিম হেসে বলে আমি চাই আমার ছেলে প্লেন চালাবে।
তা ঠিক বলেছেন। বাপের চেয়ে ছেলে বড় হোক এটা সবাই চায়। আশা করি আপনার আশা পূরণ হবে।
এখানে এই ভাঙ্গা ঘরের চালে অনেক ঝুলকালি। আমাদের স্বপ্নের সাথে অনেক গাঢ় অন্ধকার ঢাকা পড়েছে সংসারের জালের ভেতর। তবুও দিনের পর দিন আমরা ভালোবেসেছি হেসেছি কেঁদেছি। তোমার কোমল বুকের ভেতর লুকিয়েছি কতনা অভাবে, আনন্দে, বেলা-অবেলায়-কালবেলায়। তুমি সত্যিই পাশে ছিলে গন্ধমাখা হরিণীর মত কোমল আর মুগ্ধতর বিহ্বলতায়।
রোহানার হাসি এখনও সেই আগের মতোই। যৌবনেও একটুও ভাটা পড়েনি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। জায়নামাজে বসে সারাক্ষণ স্বামীর জন্যে কাঁদে। বাচ্চাদের দেখাশানা করে। ছেলেটা এবার তরতর করে বেড়ে উঠছে। তারা  পুরনো বাসাটা বদলে একটা ভালবাসায় উঠে যায়। আবার সমসময় মন খারাপ হয়। এই বাড়ীতে তাদের অনেক স্মৃতি। এই বাড়ীতেই করিমের সাত রাজার ধন  ছোট ছেলের জন্ম। এখানেই তার ব্যবসার শুরু। স্মৃতি, সার্থকতা।
করিম দিন দিন নামকরা ব্যবসায়ী হয়। বইয়ের ব্যবসাকে রাতারাতি বদলে দেয় করিম। তার আইডিয়া কাজে আসে। নতুন নতুন সব আইডিয়া অবাক করে দেয় সবাইকে। বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্যের সব চমৎকার আইটেম একটার পর একটা বাজারে আনে সে। করিমের দিকে সবাই ঝুঁকে পড়ে। মাসুম তার ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে করিমের সাথে যোগ দেয়। দুজনে মিলে শক্ত করে হাল ধরে। রাতারাতি সবকিছুই বদলে যায়। করিম এই লাইনে নতুন হলেও মাসুদের অভিজ্ঞতা তার কাজে আসে। সে সামনে এগিয়ে যায় তরতর করে। দেখতে দেখতে মার্কেটের অনেকটাই তারা দখল করে নেয়। এখন তার বই মার্কেট মুড়ি মুড়কির মতো চলছে। করিম নতুন গাড়ীর পাদানিতে পা রাখে।
করিমের ছোট ছেলের নাম রবিন। রবিন হুডের নামে নাম। করিমের আশা ছেলে তার বড় হয়ে রবিন হুডের মতো হবে। অবশ্য রবিনের ভালো নাম গোলাম মাওলা। সে আসলে মাওলার গোলাম।
রবিন এবার স্কুলে ভর্তি হয়। তার এখন পাঁচ চলছে। গাড়ীতে করে বাপের সাথে স্কুলে যায়। ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে দেওয়া হয় রবিনকে। করিমের মতো সে-ও ইংরেজিীতে ভালো হবে। এখনি টুকটাক ইংরেজি বলে।

করিমের পেছনে সারাক্ষন লোকের ভীড়। সামনে বসে থাকে কাজের সন্ধানে আসা মানুষগুলো। বেশির ভাগই আসে পান্ডুলিপি নিয়ে। বইয়ের ক্রেতারা তো আছেই। তার হোল সেলের দোকান অন্যত্র। সে যে জায়গাটায় বসে সেটা একটা অভিজাত লাইব্রেরী। এটা তার অফিসও। করিম এখানে বসে রাজ করে। কাজ করে। রেহানা তাকে খুব করে বলে, একটা কবিতার বই ছাপাও। তোমার কবিতা খুব সুন্দর। আমি তো লিখতে পারি না। আমার কবিতা শুধু তোমার জন্য। বই হলে সবাই জেনে যাবে। জানে জানুক। একেবারে মন্দ না। তুমি ছেপে দাও। কথাটা করিমের মন্দ লাগে না। দেখতে দেখতে বয়স তো কম হলো না। এখনও না ছাপালে কবে ছাপাবে। করিম আস্তে করে বলে, আচ্ছা ভেবে দেখব। তোমার প্রস্তাবটা মন্দ না।

(৫)
কোথাও নদী নেই তবুও এতো স্রোত
কোথাও বাতাস নেই তবুও এতো ঢেউ
কোথাও পানি নেই তবুও এতো প্লাবন
চারিদিকে বন্ধ শহর নিস্তব্দ, নিস্তরঙ্গ
তবুও এতো কোলাহল কোথা থেকে আসে
হৃদয়ের জানালায় কান পাতো
ঠিক তোমার হৃদয়ের ছোট্ট ঘুলঘুলিতে
শুনতে কি পাও বাতাসের আলাপন
তুচ্ছ সব আলাপনও কাসা হয়ে কানে বাজে

প্রেম তার প্রনয়ে মোড়ানো একটা জীবন। দেখতে দেখতে দুটো যুগ বেরিয়ে গেছে কখন। করিম আর রেহানা বুঝতেও পারে না। সুখের দিনগুলো দুঃখের দিনগুলোকে কখন যে মুছে দিয়েছে তা তারা খেয়ালই করেনি। মনে হয় না তারা কখনও দুঃখী ছিলো। আসলেই কি তারা দুঃখী ছিলো? টাকা পয়সার অভাব হয়তো ছিলো কিন্তু তা তো কখনও তাকে দুঃখী করেনি। মাটির ঘরে পুরণো জরাজীর্ণ কাঁথার উপর শুয়ে তারা ভীষণ সুখী ছিলো। ঠিক যেমন পশুপাখি সুখী হয় গাছের ডালে।
করিমের বাসায় আজ সবাই জড়ো হয়েছে। নাসির, মাসুদ, জাফর কেউ বাদ নেই। করিমের নতুন বন্ধুরাও এসেছে। উপলক্ষ দুটো। একে তো করিমের প্রথম বই বের হচ্ছে। অবশ্যই কবিতার বই। দ্বিতীয় করিম ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন করছে। সভাপতির পদ। আনন্দের বিষয় হলো তার কোন প্রতিদ্বন্দী নেই। তাই উভয় উপলক্ষকে সেলিব্রেট করার জন্য সবাই জড়ো হয়েছে। করিম হচ্ছে সেই আয়োজনের মধ্যমনি। আজ চা নাস্তার পাশাপাশি কবিতা পাঠও চলবে। করিম সবাইকে অবাক করে দিলো একটা নতুন খবরে। তার সব কবিতার ইংরেজী অনুবাদও সে করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। কবিতার বইটা উভয় ভাষায়ই বের হচ্ছে। জাফর হঠাৎ করেই বলে বসলো প্রথম কবিতা ইংরেজীতেই হয়ে থাক। মাসুম অমনি জাফরকে ধর বসলো, তুই তো লেখাপড়াই জানিস না। ইংরেজীতে তোর কি লাভ।
জানি না। তাতে কি। শিখতে চাই। করিম ভাইয়ের কাছ থেকেই শিখতে চাই। তাছাড়া কবিতার কোন ভাষা নেই। এসবের তুই কি বুঝবি। তোর কাজ শুধু বই বিক্রি করা। আমার কাজ চায়ের মতো করে বইয়ের মজা নেওয়া। তুই ভুলে যাসনা আমি এক সময় চা বেঁচতাম।
সবাই হাসিতে ফেটে পরে। জাফরের কথা রাখতে করিম প্রথম কবিতাটা ইংরেজিতেই পড়ে। তারপর যথারীতি বাংলায় একটার পর একটা কবিতা আবৃত্তি চলে। সাথে গরম চা, নানান ধরনের নাস্তা। বেশির ভাগই রেহানার হাতে বানানো। অবশ্য কাজের বুয়ার পাশাপশি মালেকা জবেদাও হাত লাগিয়ে ছিলো। শুধু রবিন একা মেতে উঠেছে কম্পিউটার নিয়ে। এক মনে গেম খেলছে সে। কবিতার আসরে বসার মত বয়স এখনও তার হয়নি।

(৬)
এ রাত মনোহর জানি
মনোহর এই চাঁদ
জ্যোৎ¯œার বিলাস
অসংখ্য তারার ভেতর
কি সব কানাকানি হয়
কখনও যায় না জানা
তবু তারা ঠিক ঠিক জানে
তাদের ঠিকানা
প্রতি রাতেই খুঁজে নেয় আকাশের গায়
কোনো দিন ভুল হয় না।

করিম সাহেব বসে আছেন সোফায় হেলান দিয়ে। তার হাতে নিউইয়র্ক টাইমসের কড় কড়া কপি। এক মনে পড়ছে সে। গুলশানের এই বাড়িতে গত মাসেই উঠেছে সে। সবকিছু অন্যরকম লাগছে। বাড়ীতে আজ বাড়তি আনন্দ। গতকাল রবিনের জন্মদিন গেছে। ছেলের জন্মদিনে করিম তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নতুন মডেলের গাড়ী দিয়েছে ঠিকই কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এ উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান হবে না। এ সব উদযাপনে তার মন সায় দেয় না। ধর্মের টান তার কাছে নাড়ীর টানের চাইতেও বেশি। ধর্মে এসব বাড়াবাড়ি বলা হয়েছে।
রেহানা আপত্তি করেনি। তার বিদ্যা বুদ্ধি অতো বেশি না। সেই কারনেই করিমের সাথে একমত। মানুষটার প্রতি তার শুধু ভালবাসাই না বিরাট আস্থাও আছে। লোকটাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছে। সে যা বলে তা মেনে নিতে হবে। রবিন প্রথমে কিছুটা মন খারাপ করেছিলো। কিন্তু নতুন মডেলের গাড়ী পেয়ে তার মন ভরে গেছে। করিম অবশ্য বলে দিয়েছে, বন্ধু-বান্ধবদের এমনিতেই দাওয়াত করে খাওয়াও। জন্মদিনের উদ্দেশ্য লাগবে কেন। যে কোন আয়োজন করতে পারো। আমার আপত্তি নেই।

আত্মীয় স্বজন সবাই আসে। সেই সব মানুষের ভীড়ে করিম একজনকে দেখে অবাক হয়। এ তাহলে কে। একে এতো চেনা চেনা লাগছে কেন? করিম যখন এই সব ভাবছে তখন সেই মানুষটাই সামনে এগিয়ে আসে।
আমাকে চিনতে পারছেন? দেখি বলেন তো আমি কে?
করিম অবাক হয়ে যায়। না চেনার কিচু নেই। এতো বছর পর এভাবে দেখা। করিম কিছু একটা বলতে যাবে। তার আগেই ভদ্র মহিলা মুখ খুললো। আমি রেবেকা। আপনার প্রতিবেশী। উত্তরের বাড়ীটা আমাদের।
তুমি কেমন আছো। এতোদিন পর এভাবে দেখা হবে কোনদিন ভাবিনি। আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। রেবেকা করিমের কলেজের সহপাঠী ছিলো। আজ এতোদিন পর এভাবে দেখা হবে কোনদিন ভাবতেও পারেনি। রেবেকা করিমের কবিতার ভীষন ভক্ত ছিলো। সবাইকে বড় গলায় বলতো, একদিন কবিতা লিখেই  এই করিম অনেক বড় হবে। সেদিন তাকে সবাই করিম সাহেব বলবে। তার পর  মজা করে বলে - করিম সাহেব। সেদিন কি আমি আপনার দেখা পাবো।
ভাগ্যে থাকলে পাবেন। করিম মজা করে বলতো। রেবেকা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো। সে এরকমই। করিম দীর্ঘশ্বাস ফেলত। হায়রে জীবন। এতো অভাব তার। নইলে কবিতা লিখেই জীবন পার করতো। রেবেকার কথা ঠিক হয়েছে কিনা জানি না। কবিতা লিখে করিম বড় হতে না পারলেও বড় হয়ে একটা কবিতার বই বের করতে পেরেছে।
রেবেকা বলে ওঠে, তোমার কবিতার বইটা পড়লাম। তুমি এখনও আগের মতোই সুন্দর লেখো। মনে হয় কবিতাগুলো আমাকে নিয়ে লেখা। কিন্তুু আমি জানি এই কবিতার কোথাও আমি নেই। তোমার স্ত্রী রেহানা আছে। সে খুবই ভাগ্যবতী। তোমার মতো স্বামী পেয়েছে। আমি মনে মনে সব সময় তোমার কবিতার দেবী হতে চাইতাম। কিন্তুু আমার অবস্থান তা হতে দেয়নি। আজ দেখলাম তুমি আমাকে অতিক্রম করে অনেক দূর চলে গেছো। তোমার বিজয়ে আমি আনন্দিত।
 আমার স্ত্রী কিছু জানে?
হ্যাঁ জানে। আমি তাকে সব বলেছি। শুধু এইটুকু বলতে পারিনি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো। কারন আমি এখনও জানি না তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না। এই কথাটা জানা আমার আজ ভীষন প্রয়োজন।
এখন তো আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। এখন জেনে কি লাভ। তুমি তো তখন চাইলেও জানতে পারতে। কিন্তু কখনও তো তুমি তা জানতে চাওনি। আমি অজ¯্র বার তোমাকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু তোমার হয়তো তা শোনার সময় ছিলো না। রেহানা পাশে এসে দাঁড়ায়। রেবেকা ভীষন বিব্রত হয়। করিম সেটা বুঝতে পারে। সে পরিষ্কার গলায় বলে, রেহানা সব জানে। রেহানা এ-ও জানে আমার কবিতার দেবী সে নয়। তুমি। তবুও সে আমাকে দেবতার মতো ভালোবাসে। তার প্রেমই আজ আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। এতো ভালোবাসা আর কেউ কাউকে কখনও দিতে পেরেছে কিনা জানি না। আমার কিছুই ছিলো না। তার উপরে আমি তাকে কখনও আমার হৃদয়টাও দিতে পারিনি। কারণ তার পুরোটাই অংশ জুড়ে তুমি বসে আছো। তোমার প্রেম আমাকে জীবনানন্দের প্রেতাত্মা বানিয়েছে। অবশ্য দেবদাস বানাতে পারেনি। কারণ আমি রেহানাকে ভালোবাসতে পেরেছিলাম। তার কারণ একটাই। তার অদ্ভুত গ্রহণ করার ক্ষমতা। এখানে  আমার কোন কৃতিত্ব নেই। এই সংসার সাফল্য সবই তার। সব সে নিজ গুনে  জয় করে নিয়েছে। আমার মতো অন্তসারশূন্য একজন মানুষের মিথ্যে ভালোবাসাকে সত্য জেনে নিয়ে আমাকে ধন্য করেছে। নিজে কতোটা ধন্য হয়েছে জানি না। কিন্তুু  আজ আমার যা পূর্ণতা তার পুরোটাই তার অবদান। আমি তো রাস্তার উপর নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। প্রায় দেড়যুগ অভাবে কাটিয়েছি। তার পর সাফল্যের মুখ দেখেছি। তবুও সে আমাকে কোনদিন সামান্যতম কষ্টও দেয়নি। আমার মান ছিলো না। তেমন কোনো সাফল্যও নাই। নাই টাকা। এমনকি শিক্ষা বলতে বিএ পাশ। তবুও সে আমাকে রাজা জ্ঞান করেছে। আর সে কারনেই হয়ত সে আজ সত্যিকারের রানী হতে পেরেছে। আমার যা কিছু তার সবই তার। তাকে তুমি ছুঁয়ে দেখতে পারো। সত্যিকারের মানুষ ছোঁয়ার আনন্দ পাবে।

রেবেকা তার হাতে রেহানাকে ছুঁতে যায়। রেহানা বলে ওঠে, সর্বনাশ। একি করছেন। আমি অতি সাধারণ। আর যেটুকু আমার দাম তা তার বুকের ভেতর রাখা আছে। ছুঁতে চাইলে তাকে ছুঁয়ে দেখেন। দেবতার কোন ধারনায় বিশ্বাস নেই আমার। তবু আমি জানি সে আমার কাছে দেবতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমি আজ এতোটা ধন্য হয়েছি।
রেহানা চলে যায়। রেবেকা দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। হঠাৎ রবিন দৌঁড়ে আসে। আসে মালেকা জবেদাও। সবার মুখে হাসি। সবাই সব কিছু জেনে ফেলেছে।
পড়ন্ত বেলায় এই দেখা কি না হলেই হতো না।

Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে

NAZRUL ISLAM MAZUMDER : THE CHOICE OF THE TIME (a biography)

NAZRUL ISLAM MAZUMDER The choice of the time “The purpose of a business is to create a customer who creates customers.” -          Shiv Shing # NASSA GROUP # 30,000 employees #EXIM Bank # 3,000 employees And so on……….. A Biography By OMAR KHALED RUMI M. Sc., MBA, LL.B     ...................................................... “Patience, persistence and perspiration make an unbeatable combination for success.”    - Napoleon Hill   ...................................................... Prlogue Like another man Nazrul Islam Mazunder is also a man. But, how he has made some stories of success. Why people consider him as a special. Why he is applaused as Philanthropic in mind, dynamic in thinking, far-sighted in vision. There must some reasons. The reason is what he wanted himself he has been now. Mazumder, a conglomerate icon, in no way, a trifle name. His success, over years, mak