Skip to main content

Fabricare receipt 01 08 2024

কবিতা দিদি




কবিতা দিদি এবার সত্তরে পা রাখলেন। আমরা ঘটা করে সত্তরতম জম্মদিন পালন করলাম। যুদ্ধের বছর কবিতা দিদির বয়স ছিলো পঁচিশ। কবিতা দিদি আমাকে একটু বেশীই ¯েœহ করেন। করাটাই স্বাভাবিক। আমিই তাকে সবচেয়ে বেশি সময় দেই। এই বয়সের মানুষকে  কেউ সময় দিতে চায় না। কবিতা দিদির যুদ্ধের স্মৃতি আর দশটা হিন্দুু মেয়ের মতোই। ঘর বাড়ী পুড়ে ছাই, শারীরিক অত্যাচার অবশেষে মৃত্যু। না মৃত্যু শেষ পর্যন্ত কবিতা দিদিকে নেয়নি। সে নিজেও জানতো না যে সে বেঁচে আছে। যখন জ্ঞান ফিরলো ভীষন অবাক হলো বেঁচে আছে দেখে। লাশের স্তুপের ভিতর শরীরের কয়েক জায়গায় ক্ষত নিয়ে শেষ পর্যন্ত কবিতা দিদি নিজেকে জীবিত দেখতে পায়। ততক্ষনে গ্রামের পরে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে পাক সেনারা অনেক দূর চলে গেছে।

কবিতা দিদি নিজেই একদিন আমাকে বলেছিলো, এতোকিছুর পরও ওপারে যাইনি কেন জানিস?
কেন?
ওরা নাকি এপার থেকে ওপারে যারা যায় তাদেরকে বাঙ্গাল বলে।
আমি বললাম, হুঁ। জানি। সরাসরি শুনিনি। তবে একটা বইয়ে পড়েছি। এপারের একটা মেয়ে এপার থেকে যুদ্ধের সময় ওপার গিয়েছিলো। তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে কথাটা লিখেছিলো। কথাটা বইয়ে লেখা থাকলেও আমার কানের কাছে আজও বাজে। সুজাতা বাঙ্গাল। মনে হয় যেন তার কণ্ঠেই শুনেছি। অনেকটা হ্যালুসিনেশনের মতোই।
মাঝে মাঝে এরকম হয়। কোন কথা খুব হৃদয়ে প্রবেশ করলে মনে হয় এই কথাটা হয়তো আমি কারো মুখ থেকেই শুনেছি।
তুমি ঠিকই বলেছো। আমি সুজাতার কন্ঠ শোনাতো দূরে থাক ওকে কখনো দেখেনি। এমনকি জানিও না কে এই সুজাতা। অথচ মনে হয় সে আমার কাছে জীবন্ত। সুজাতার কথা মনে পড়লেই আমি একটা দুঃখী মেয়ের মুখ দেখতে পাই। তোমার জন্য আমার যেমন মায়া তার জন্যেও আমার ঐরকম মায়া লাগে।
শুধু তার জন্যেই না। পৃথিবীর তাব দুঃখী মানুষের জন্যেই তোর সমান মায়া লাগে। আমি সেটা জানি। আর কেউ না বুঝলেও আমি সেটা বুঝি। অথচ তোকে দেখলে বেশীর ভাগ মানুষই ধারনা করবে তুই একটা গোঁড়ামানুষ। কিন্তুু আমি তো জানি তোর ভেতর মানুষকে গ্রহণ করার অদ্ভুত একটা গুন আছে। এই গুনটা মানুষের মধ্যে খুব বিরল। আমরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষকে গ্রহণ করতে পারি না।

তুমি আসলে সবসময়ই আমার প্রশংসা করো। হয়তো ভালো জানো বলেই। আমি কিন্তু আসলে অতোটা ভাল মানুষ নই। আমারও অনেক দোষ আছে। আসলে আমরা যাকে একটু বেশী ভালোবাসি তার অনেক গুন খুঁজে পাই। এটা এক ধরনের  পক্ষপাতিত্ব। তুমিও মনে হয় সেই দোষে দুষ্ট।
তোর সাথে কথায় পারবো না। তবে আমি যা বলি তা সত্যি। মিথ্যে বলা আমার দ্বারা হবে না।
কবিতা দিদি একটু থামে। তারপর আবার নিজেই কথা বলতে শুরু করে।
আচ্ছা বলতো। শহরের খবর কি? কার কার যেন রায় বাকি ছিলো।
আমি বললাম, এখনও বেশ কয়েকজনের রায় বাকি। তবে তোমাকে তো বলাই হয়নি, আগামীকাল একজনের রায় ঘোষণা হবে। আপিলের রায়। ফাইনাল বলতে পারো। অপেক্ষা করতে হবে। দেখা যাক কি হয়।
কি আর হবে। ফাঁসি। আগের সবারতো তাই হয়েছে।
তুমি নিশ্চিত হলে কেমন করে। ছেড়েও তো দিতে পারে। যদি এমনটা রায় হয় যে আসামী বেকসুর খালাশ।
তাই কি হয়। একজনেরও কি হয়েছে। পৃথিবীতে এখনও যে আইন আছে তার প্রমান এই বিচার। নইলে পয়তাল্লিশ বছরে সবকিছু মুছে যাওয়ার কথা। তাছাড়া মুছে ফেলার জন্যও তো কম চেষ্টা হয়নি। তুই জানিস  যে জায়গাটায় পাক সেনারা আত্মসমর্পন করেছিলো, রেসকোর্স ময়দানের সেই জায়গাটায় এখন শিশুপার্ক। এটা যে কতো বড় একটা ষড়যন্ত্র তা কি বুঝিস।
বুঝি। বুঝব না কেন। যতবার ঐ জায়গাটায় যাই মনটা কেঁদে ওঠে। আমার আর একটুও দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না।
এতোটা আবেগপ্রবন হওয়ার কিছু নেই। এসবই বাস্তবতা। এক মেনে নিতে শিখো।
কিন্তু চাইলেও যে পারি না। যে সময়কে দেখিনি তার জন্যে এখনও আবেগপ্রবণ হই। তুমি তো জানোই, আমার জন্ম যুদ্ধের অনেক পরে। আচ্ছা একটা কথা বলতে পারিস, ১৯৭১ সালে হিন্দুদের কেন এভাবে মরতে হলো।
না। কখনও ভাবিনি।
তোর বয়স কতো। তুই এসব জানবিই বা কেমন করে। এটা ১৯৪৭ এর দেশভাগের পাপ। ওপারের হিন্দুুরা ভারতের সাথে থাকার  পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এপারের মুসলমানরা পাকিস্তানে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলো। সেদিন যদি ওপারের হিন্দুুরা এপার-ওপার এক সাথে থাকার পক্ষে রায় দিতো বাংলা তখনি আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যেতো। জিন্নারতো আপত্তি ছিলো না।
তা হয়তো ঠিক।
সেই শেষ পর্যন্ত আলাদা হতে হলো। মাঝখানে দু দুবার রক্তগঙ্গা। কি লাভ হলো। অথচ এই হিন্দুরাই বঙ্গভঙ্গের পর কি মায়াকান্নাটাই না কাঁদল। আমার তো মনে হয় হিন্দুরা হিন্দুদের যতোটা না রক্ষা করতে চেয়েছিলো জিন্না তার চেয়ে বেশি চেয়েছিলেন। লোকটা প্রায় ২০ বছর কংগ্রেস করেছে। ভালো অবস্থানে ছিলো। এই মানুষটাকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ঠিক হয়নি।
কিন্তু উনিই তো সর্বপ্রথম বাংলার উপর অ¯্র ধরেছিলেন। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
চাওয়াটাই স্বাভাবিক। অখ- পাকিস্তানের কথা চিন্তা করেই তিনি এটা বলেছিলেন। এমনিতেই দু প্রান্তে দু ভাগ। মাঝখানে নয়শ মাইলের দূরত্ব। এপার-ওপার তেমন কোন বিষয়েই মিল নেই। ভাষার ঐক্যটুকুও যদি না থাকে ওনার এতো স্বাদের পাকিস্তান টিকবে কেমন করে।
তুমি বলছো জিন্নাহ এটা চাইতেই পারেন।
হ্যাঁ পারে। কিন্তুু  ভুল ছিলো অন্য জায়গায়।
কোথায়?
আর একটু নরম হওয়া উচিত ছিলো। একমাত্র না বলে শুরুতেই বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করে দিতো পারতো। শত হলেও পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ট লোকের ভাষা বাংলা। তারা শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা মানবে কেন? তুই কি মানতি?
মোটেও না।
তাহলে তো ঠিকই আছে। পূর্ব বাংলার মানুষ বিদ্রোহ করলো। মারাত্মক বিদ্রোহ। পাকিস্তানের ভাঙ্গন মূলত ওখান থেকেই শুরু।
কথাটা ঠিকই বলেছো। আমরা মূলত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম।
পুরোপুরি ঠিক না। কেন? শোন তাহলে-
ভাষার ব্যাপারটা ছিলো একটা ইস্যু। ভারতের কথাটা ধর। বাংলা তাদেরও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হিন্দী। কলকাতার বাঙ্গালিরা বাংলার চেয়ে হিন্দীতে কথা বলতে গর্ববোধ করে। অথচ হিন্দী হলো মূলত দিল্লী এবং তার পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকার ভাষা। সংস্কৃতির রয়ে যাওয়া রেশটুকু। কিন্তুু সারা ভারত এই মাইনর ভাষার প্রেমে মাতোয়ারা। আমার তো মনে হয় ওরা একযোগে ঝাপিয়ে পড়েছে। না হলে হিন্দী ভারতে এতোদিন টিকত কিনা সন্দেহ। যেখানে বাংলা, তামিল, তেলেগু, মালয়লাম, কানাড়ী ইত্যাদি ভাষাভাষী লোক তো অনেক। কেন তারপরও হিন্দী টিকে গেলো। দিল্লীর অভিজাতদের ভাষা তাই। কোন কিছুই এক্ষেত্রে ব্যাপার হয়নি। তাহলে পাকিস্তানীরা তো মাইনর হয়েও এটা আশা করতে পারে। আমাদের রাজধানীও তো ওখানেই ছিলো।
কিন্তুু বাঙালী এটা মানবে কেন?
মানেনি তো। মানলে কি আর এত লোক মরত। এতো বছর ধরে আন্দোলন চলে। দুটো কে একসাথে রাষ্ট্রভাষা করে দিলেই মানত। বাঙ্গালীর উর্দু প্রীতি বেড়ে যেত।  কিন্তুু তুমি তো বলেছো ভাষার ব্যাপারটাই একমাত্র ব্যাপার না।
বলেছি তো। ঠিকই বলেছি। শুধুমাত্র ভাষার ব্যাপারটাই একমাত্র ব্যাপার না। একথা এখনও বলছি। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিলো। ভৌগোলিক ব্যবধান নিয়ে ভাববারও অবকাশ ছিলো না। দু এলাকার মানুষের কালচার কৃষ্টিতে কোন মিল ছিলো না। কোন কালে মিল হয়েছিলো বলেও জানা নেই। তাহলে এভাবে একটা রাষ্ট্র টেকে।
তুমি ঠিকই বলেছ।
আর তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে স্বাধীনতার যে হিড়িক লেগেছিল ১৯৭১ এ এসেও তার ভূত পৃথিবী ছেড়ে যে চলে যায়নি তার প্রমান বাংলাদেশের জন্ম। বাঙালির সার্থকতা এই যে তারা ১৯৪৭ এর চেতনাকে ১৯৭১পর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসতে পেরেছিলো। অবশ্য প্রেক্ষাপট ছিলো ভিন্ন। তখন যাদেরকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করেছিলো এবার তাদের বিরুদ্ধেই আন্দোলন সংগ্রাম করতে হলো।
আমার তো মনে হয় বাঙ্গালি নেতারা সেদিনও পাকিস্তানী শাসকদের ভালোভাবে নিতে পারেনি। নইলে ১৯৪৭ এর আগষ্টে জন্মানো পাকিস্তানে সেপ্টেম্বরেই ঢাকায় তমদ্দুন মজলিসের সৃষ্টি হবে কেন। বাঙালি তার নিজের ব্যাপারে শুরুতেই সচেতন ছিলো। ১৯৭১ এর স্বাধীনতার চেতনা নতুন কিছু ছিলো না। এটা যুগ যুগ ধরে রক্তে বয়ে বেড়ানো স্বাধীনতার আর স্বাধিকারের নেশা। পলাশীর যুদ্ধ কিন্তু হয়েছিলো প্রায় ২১৩ বছর আগে।
তুই ঠিকই বলেছিস। সেই যে মীর কাসিম  ইংরেজদের বিরুদ্ধে লাগল। পাশাপাশি ছিলো ফকির মজুন শাহ। তারপর তো জল কম গড়ায়নি। কিন্তুু স্বাধীনতা যেন কিছুতেই আসছিলো না। শেষমেষ ১৯০ বছরের পরে যাও এলো তাও যেন অসম্পূর্ণ, পঙ্গু আর অসহায়। তারপর আবার ২৩ বছর লাগল। স্বাধীনতা যে এতোটা কঠিন তা বাঙালীর চেয়ে ভালো আর কে বোঝে।
কথাটা মন্দ বলোনি। বাঙালিকে ২০০ বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো একটা পতাকার জন্য।
আসলে ব্যাপারটা অনেক জটিল। বাংলার রাজনীতি কখনও অতোটা সহজ সরল ছিলো না। তবে সে অনেক কথা। ইতিহাস ভালো করে পড়লে জানতে পারবি। তোকে বলেছি না ইতিহাসের কিছু  ভালোমন্দ বই কিনে পড়িস। তোরা এ যুগের ছেলে-মেয়ে। তোদের এসবে মন নেই। যতোসব ফাজলামী। আমাদের সময়ের ছেলে-মেয়েরা অনেক আন্তরিক ছিলো। ছিলো অনেক গভীর চিন্তার অধিকারী। ভাগ্যিস যুদ্ধটা হয়েছিলো ১৯৭১এ। এখন হলে তোরা দেশটা স্বাধীন করতে পারতি কি না সন্দেহ। এতো রক্ত কি তোদের বুকে জমা আছে।
আছে দিদি। আছে। তাইতো এতো বছর পড়ও সম্ভব হচ্ছে ঘাতকদের বিচার  করা।
এতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। বিচার করছে সরকার। এটা তার নীতি নির্ধারণী ব্যাপার। সিদ্বান্তের ব্যাপার। তুই এর মধ্যে এই প্রজম্মের চেতনা কোথায় দেখলি। আমার তো মনে হয় তরুন সমাজের মাঝে আর আগের মতো দেশপ্রেম নেই।
ও তুমি বুঝবে না। এই প্রজন্মকে তুমি কতোটুকু চেনো। প্রয়োজনে সবাই ঝাপিয়ে পড়বে।
পড়লেই ভালো। যে কোন সময় প্রয়োজন পড়তে পারে। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন। যেভাবে দলে দলে লোকজন ভাগ হয়ে গেছে তাতে ভরসা রাখা কঠিন। তখন তো সবাই এক আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করেছিল।
কথাটা একেবারে মন্দ বলোনি। তবে দল যার যাই হোক দেশপ্রেমের চেতনার জায়গায় সবাই এক। এই জায়গায় কোন ভাগ বাটোয়ারা নেই। দেশ সবার। মাটি সবার।
কিন্তুু সবাই কি তা মনে করে। অবশ্য করলে তো ভালোই।
করবে না কেন? করে, অবশ্যই করে।
তোর আত্মবিশ্বাস দেখে ভালো লাগছে। শোন, তুই আজকে যা। আজ আর কথা বলবো না। কোথায় কি হয় আমাকে খরব দিস। আমি কিন্তু তোকে ছাড়া কাউকে কাছে পাইনা। একটু খবরাখবরও পাওয়ার সুযোগ থাকে না।

আমি চলে আসি। পথে আসতে আসতে ভাবি কবিতা দিদির লেখাপড়ার দৌঁড় সামান্যই। কোনমতে পড়ার কাজটা চালিয়ে যেতে পারেন। অথচ প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে কতো স্পষ্ট ধারনা। অবশ্য একটা ব্যাপার খেয়াল করার মতো। একাডেমিক সার্টিফিকেট না থাকলেও জীবনে উনি অনেক বই পড়েছেন। এখনও হাতের কাছে বই পেলে পড়ে ফেলেন। তা সে যে বই-ই হোক।

কবিতা দিদি একা একটা পুরনো বাড়িতে থাকেন। ওনার বাপ দাদার বাড়ী। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। তবুও তার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। পলেস্তরা খসা দেওয়াল। হাড্ডি বেরিয়ে আসা কঙ্কালসার মানুষের মতো ইটগুলো বেরিয়ে এসেছে। মেকে বিভিন্ন জায়গা উঠে গেছে। তবুও তা ঝেড়ে ধুয়ে মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সামনে ছোট উঠান। সারা বাড়ি ফুল আর ফলের গাছে ভরা। বারোমাস কোন না কোন গাছে কোন না কোন ফুল বা ফল থাকবেই।

কবিতা দিদির বাড়ীটা এভাবে রাখা সক্ষম হতো না। কারণ একটাই। এই বাড়ীতে আমি যাওয়া আসা করি। আমার সামনে দাঁড়ানোর মতো কেউ এই এলাকায় নেই। কবিতার দিদিদের বাড়ীটা এতোদিনে হাওয়া হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তুু তা হয়নি। কখনো কখনো ক্ষমতা কাজে দেয়। আমি সেটা প্রয়োগ না করলেও এমনি এমনি  প্রয়োগ হয়েছে। যেহেতু ও বাড়ীতে আমার আসা যাওয়া আছে তাই আজ পর্যন্ত কেউ চোখ তুলে তাকায়নি।

পরদিন দুপুরেই আমি কবিতা দিদির কাছে যাই। বাড়ীতে ঢোকা মাত্রই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, খবর কি? রায় কি হলো। ফাঁসি বহাল আছে?
আছে?
যাক। তাহলে তো হলো।
কোথায় আর হলো।
কেন?
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ভিক্ষার সুযোগ আছে কিন্তু।
মনে হয় হবে না।
হতেও তো পারে। তার স্বজনরা আপ্রান চেষ্টা করছেন। কিছু একটা হয়েও যেতে পারে। এই লোকের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক খুব ভাল।
কিন্তু মনে হয় না সরকার খুব একটা নড়েচড়ে বসবে। হাসিনা শক্ত আছে।
তা হয়তো আছে। একা আর কতক্ষণ কিংবা কতোটা শক্ত হবেন। চারদিকে যেভাবে চাপ উনিও বা কতক্ষণ ঠিক থাকতে পারবেন কে জানে।
পারবেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা যে।
এটুকুই ভরসা। বঙ্গবন্ধু অনেক বড় রাজাকেও পাত্তা দেননি। আগে বঙ্গবন্ধু কথা বলেছেন। তারপর ওনাদের কথা বলার সুযোগ দিয়েছেন। বাঙ্গালীরা তখনই কাউকে গুনে কথা বলেনি। তা সে হোক না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কিংবা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। আর এখনতো প্রশ্নই আসে না। ১৬ কোটি বাঙ্গালীর দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বের কাছে এখন জীবন্ত বিস্ময়। এ যাত্রা যাকে সে ধরবে তার আর কোথাও জায়গা হবে না। হাসিনা ছেড়ে কথা বলার লোক না। গায়ে কার রক্ত দেখতে হবে না। বংশের ধারায় কথা বলে।
তোর কথা মানলাম। কিন্তুু তুই কি জানিস ১৯৭৩ সালেও যে হিরো ছিলো, নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় পেয়েছিল, তাকেই তো  ১৯৭৫ সালে কতিপয় নি¤œশ্রেণীর মানুষের হাতে মরতে হলো। ইতিহাস কেন আমাদের দৈনন্দিন এবং সামাজিক জীবনেও তাদের কোন স্থান নেই। সম্পূর্ণ অনুল্লেখ্য তারা । তুই কি জানিস না সব যুগে সব কালে সামরিক বাহিনী হলো রাষ্ট্র আর জনগণের সেবাদাস। গ্রীসের আর রোমের সেই সব গ্ল্যাডিয়েটরদের কথা কি তোর মনে আছে। তারা খাঁচার ভেতর হিংস্র সিংহ আর বাঘের সাথে লড়াই করে বাঁচতে পারলে বাঁচত। নইলে মরত। এটাই তাদের জীবন। সেই সব গ্ল্যাডিয়েটররাই আজকের সৈনিক। তা সে জেনারেলই হোক আর কনস্টেবলই হোক। এরা রাজনীতির কি বুঝবে। রাজরক্ত ছাড়া রাজনীতি হয় না। অতো সহজ নয়। 
তোমার কথাগুলো মিথ্যে নয়। এজন্যেই তো যুগে যুগে সামরিক শাসকরা সমাজ এবং সভ্যতাকে নষ্ট করে দিয়েছে। খন্দকার মোশতাকের মতো ঘৃণিত লোকও এদেরকে তার কূট কৌশল দ্বারা প্রায় একঘরে করেছিল। তার  পর একেবারে দেশ ছাড়া। তার একার বুদ্ধির কাছে সব মাথা মোটারা হেরে গিয়েছিলো। ঘৃনিত হলেও তাকে সাধুবাদ। তিনি অন্তত এরকম কিছু কিছু কাজ করেছিলেন যার মধ্যে আমরা রাজনীতিক জটিল খেলাগুলো শিখতে পারি। মুজিব এই লাইনে ভীষণ দূর্বল ছিলেন। আর এ কারনেই তিনি শেষ পর্যন্ত হেরে যান। আবেগ আর উদারতা দিয়ে দেশ স্বাধীন করা যায় কিন্তুু রাষ্ট্রপরিচালনা করার জন্য কূটকৌশল জানতে হয়। বঙ্গবন্ধু বিরাট আত্মার ছিলেন। সবাইকে ক্ষমা করে দিতেন। সবাই এসে তার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। আর তিনি কাউকে না বলতে পারতেন না। এভাবে বাংলাদেশের মতো একটা জটিল রাষ্ট্র, যেখানে স্বাধীনতার পর অজস্র সমস্যা সামলানোই একটা কঠিন ব্যাপার ছিলো, সেখানে শুধু দয়া আর উদারতা দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু চিন্তা করতেন তার মতো করে। তার কাছে মনে হতো বাংলাদেশ সবার বাংলাদেশ। সবাই মিলে বাংলাদেশকে নিজের মতো করে আগলে রাখবে। কিন্তুু বাংলাদেশ যে সবার দেশ না এটা বঙ্গবন্ধু কল্পনাও করতে পারতেন না। পারবার কথাও না। সিংহের হৃদয় যার, হিমালয়ের উচ্চতা, সাগরের মতো গভীরতা, নীল আকাশের মতো উদারতা, অকৃত্রিম দেশপ্রেম, ত্যাগ তিতীক্ষায় যার জীবন, তার পক্ষে নোংরা, জীর্ণ চিন্তা করা কঠিন। আর এজন্যই তিনি মূলত ব্যর্থ হয়ে গেলেন। আমাদের স্বার্থপরতার কাছে। ক্ষমতালিপ্সার কাছে, অস্থিরতার কাছে। মুজিব চাইলেও নিজেকে বদলাতে পারতেন না। আর তাই একনায়ক না হয়ে উল্টো অধিকতর গণতান্ত্রিক বাকশাল করলেন। বাকশাল বোঝার মতো জনগণ বাংলাদেশে তখনও ছিলো না। এখনও নেই। রাশেকুর রহমান ভাইয়ের মুখে শুনেছিলাম বাকশালের চাইতে উদার গণতন্ত্রের উদাহরণ পৃথিবীতে কটা আছে। দেশপ্রেম বাদ দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হওয়াই কি গনতন্ত্র। গণতন্ত্র মানে জনগণের সাম্য। আমরা এদেশের মাটিতে সেই সাম্যের ভূল ব্যাখ্যা হতে দেখেছি। কারণ আর কিছু নয়। রাজনীতির নামে ওসব ছিলো এক ধরনের শোষণ। পৃথিবীর সবগুলো মত ঘেঁটে দেখলে কোথাও আমাদের দেশের মতো রাজনৈতিক দর্শন এর ছায়াও খুঁজে পাবে না।
তুমি ঠিকই বলেছ। মুজিব পরবর্তী সময়টাই এলোমেলো। হনুমানের হাতে মশাল যাওয়ায় যেমন লঙ্কাপুরী পুড়ে ছাই হয়েছিলো এটাও তেমন একটি ঘটনা। আমার তো মনে হয় আজকের ঢাকাও সেরকমই। শুধু সময়টা বদলেছে।
কথাটা মন্দ বলিসনি। অনেক বড় বড় গবেষক এই বাংলা জনপদকে তকালীন লঙ্কা বলে সন্দেহ করেছেন। আমরাই নাকি রাবণ ছিলাম আর্য্যদের চোখে। আমার তো মনে হয় রাবণ কোন কাল্পনিক চরিত্র না। কোনও রাক্ষসও না। সে এই গেঁয়ো জনপদেরি কোন এক ভয়ংকর দস্যু যে তার চোখে-মুখে কালি-ঝুলি মেখে থাকত। আর তার দশ মাথা হলো দশদিক। তখনতো আবার সংখ্যার ধারণায় দশই ছিলো বেশী।
মন্দ বলোনি। আজও এদেশের বেশীর ভাগ মানুুষকেই আমার রাবণ কিংবা তার বংশধর মনে হয়। হাজার বছর পর যাদের এই অবস্থা না জানি পুরাকালে তাদের কি অবস্থা ছিলো।
অবস্থা যে খুব একটা ভালো ছিলো না তাতো পরবর্তীতেও বোঝা যায়। ১৯২৮ সালে ইংরেজরা ওপেন চ্যালেঞ্জ দিলো ভারতীয়দের তাদের নিজেদের সংবিধান তৈরি করে আনতে। কিন্তুু ভারতীয়রা কি তা পেরেছিল। পারে নি। তাহলে সাইমন কমিশন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কি লাভ হলো। অবশেষে ইংরেজরাই আমাদের সংবিধান করে দিলো। আমাদের সংবিধান আমরা নিজেরা বানাতে পারলাম না। একমত হতে পারলাম না নিজেদের সাথে। ইংরেজদের দোষ দিয়ে কি লাভ। অবশেষে তারাই আমাদের ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন করে দিলো। এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ আইন। অবশ্য একটা কৃতিত্ব আছে। জিন্নাহর ১৪ দফা। এই ১৪ দফাই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মূল ভিত্তি। ইংরেজরা অন্তত এই একটা লোককে দাম দিত। সবচেয়ে বড় কথা ব্রিটিশ জাঁদরেল রাজনীতিবীদ উইনস্টন চার্চিলের ব্যক্তিগত ফোনে ভারত থেকে এই একজনেরই সরাসরি কথা বলার সুযোগ ছিল। তিনি আর কেউ নন। মি. জিন্নাহ। একজন রিকগ্নাইজড পারসন হিসেবে ব্রিটিশ সম্রাটের কাছে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিলো। জিন্নাহ রাজনীতি জানতেন।
কথাগুলো অমৃতের মত লাগছে। কিন্তু জিন্নাহ তো আমাদের কাছে ঘৃনিত। পাকিস্তান আমাদের শত্রু।
সেটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট। অন্য বাস্তবতা।
কিন্তুু আমাদের নেতারাই পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল। শেখ মুজিব নিজেও পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক।
সে দিনের বাস্তবতায় পাকিস্তানই ছিল মুসলমানদের গন্তব্য। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই । জিন্নাহ আর কি করতে পারতেন। (চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে

NAZRUL ISLAM MAZUMDER : THE CHOICE OF THE TIME (a biography)

NAZRUL ISLAM MAZUMDER The choice of the time “The purpose of a business is to create a customer who creates customers.” -          Shiv Shing # NASSA GROUP # 30,000 employees #EXIM Bank # 3,000 employees And so on……….. A Biography By OMAR KHALED RUMI M. Sc., MBA, LL.B     ...................................................... “Patience, persistence and perspiration make an unbeatable combination for success.”    - Napoleon Hill   ...................................................... Prlogue Like another man Nazrul Islam Mazunder is also a man. But, how he has made some stories of success. Why people consider him as a special. Why he is applaused as Philanthropic in mind, dynamic in thinking, far-sighted in vision. There must some reasons. The reason is what he wanted himself he has been now. Mazumder, a conglomerate icon, in no way, a trifle name. His success, over years, mak