রুমানা তার পুরো
জীবনটাই আবেগ
দিয়ে সাজিয়েছে। কারণ
আর কিছুই
নয়।
সে এমনটাই
পছন্দ করে। ধনী
বাপের একমাত্র
মেয়ে রুমানার
জীবনে অভাব
কি জিনিস
তা কখনও
বুঝতে হয়নি। তবুও
সে কিন্তু
বসে ছিলো
না।
অভাব, ক্ষুধা,
কষ্ট, যন্ত্রণা
বোঝার জন্যে
বার বার
দুঃখী মানুষদের
কাছে ছুটে
গেছে।
আর সেখানেই
ধরাটা খেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের
টগবগে তরুণী
থাকা অবস্থায়
বস্তি পরিদর্শনকালে
চতুর সত্তকতের
সাথে তার
পরিচয়।
সওকত একজন
কবি।
নিদারুন ধুরন্ধর
গোছের একটা
মানুষ সে। মুখে
সারাক্ষণ গাঁজার
গন্ধ লেগে
থাকে।
বস্তির নোংরা
ঘরে বাস
করে সে। কিন্তু
তাকে দেখলে
মনে হয়
তার অবস্থা
এতোটা খারাপ
নয়।
সওকতের কাব্যিক
আর যাদুকরী
কথার জালে
ফেঁসে যায়
রুমানা।
ধরে খেয়ে
ডাঙ্গায় তোলা
মাছের মতো
ছটফট করতে
থাকে।
প্রথম প্রেম। কাঁচা
আবেগ।
সওকত সেই
সুযোগটা নেয়
পুরোপুরি।
বস্তির ঘরে
দুজনের রোমান্স
জমে ওঠে
যখন তখন। রুমানার
টাকায় সওকত
বস্তির লোকজনকে
মিষ্টি মন্ডা
খাইয়ে ম্যানেজ
করে ফেলে। সওকত
রুমানা জুটি
রাজ্জাক কবরী
জুটিকেও হার
মানায়।
সওকতের কাব্য
আর রুমানার
যৌবন সবকিছু
মিলেমিশে একাকার
হয়ে যায়। এই
দুইয়ের মাঝে
জ্বালানী হিসেবে
থাকে রুমানার
বাপের দুহাতে
ছড়ানো কাঁচা
টাকা।
প্রেমের আগুন
দাউ দাউ
করে জ্বলে।
কিন্তু কথায় বলে
মাতাল ধুইলেও
তা শুদ্ধ
হয় না। সওকতের
ক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটে।
রুমানার হাজার
চেষ্টাও তাকে
শুদ্ধ করে
তুলতে পারে
না।
বস্তির নোংরা
মেয়েদের সাথে
মেলামেশা থেকে
শুরু করে
মদ, গাঁজা,
আফিম, ভাং
সবকিছুই দিনে
দিনে তীব্র
মাত্রায় বাড়তে
থাকে।
টাকার জোগান
রুমানকেই দিতে
হয়।
না দিলে
কিংবা দিতে
দেরী হলে
ভীষণ মারধর
শুরু হয়ে
যায়।
শুকনো কাঠের
চেলার দু’ তিন
ঘা পরার
পরই রুমানার
প্রতিবাদ আর
আবেগ দুটো
গলে পানি
হয়ে যায়। সওকত
পেয়ে যায়
তার কাক্সিক্ষত
জিনিসটি।
এতোদিনে সওকত
বুঝতে পেরেছে
মাইরের কাছে
রুমানা একটু
হলেও দুর্বল।
সওকতকে ভাগ্যবান বলতেই
হবে।
আমাদের চারপাশে
অজস্র সওকত
আছে।
আছে অগুনতি
রুমানা।
কিন্তু তাতে
কি হবে। এই
দুজনের মিলন
সবসময় হয়
না।
সওকতের জীবনে
রুমানা এসে
পরাজিত সওকতকে
বিজয়ী করেছে। একটু
একটু করে
প্রতিদিন হেরে
যাচ্ছিল যে
সওকত সেই
বিজয়ী হয়ে
যায় রুমানার
কল্যানেই।
বস্তির মানুষের
কাছে সওকত-রুমানার গল্প
তাই রূপকথার
কাহিনীর চেয়েও
শিহরণ জাগানো। সওকতের
সাফল্যের পর
বস্তির সব
ছেলেরাই এক
একজন রুমানার
স্বপ্ন দেখতে
শুরু করে। কিন্তু
মাহাকাব্য বার বার লেখা হয়
না।
সওকত ছেলেটা ভীষণ
পাজিও।
বিয়ের পর
রুমানাকে সে
বস্তিতেই থাকতে
বাধ্য করে। রুমানাও
আপত্তি করেনি। শত
হলেও স্বামীর
ঘর।
বাঙ্গালী নারীর
কাছে স্বামী
ধন মহামূল্যবান। সে
তাই তার
বাবার বিলাসী
প্রাসাদ ছেড়ে
সওকতের ঘরে
উঠে আসে। তবে
অন্য সবার
মতো এতে
কোন চ্যালেঞ্জ
ছিলো না। বরং
পিতাকে রাজী
করিয়েই সে
আসে।
সওকত এখানেও
বিজয়ী হয়। শ্বশুরের
আর্থিক সমর্থনটা
অব্যাহত থাকে।
বিয়ের বছর ঘুরতে
না ঘুরতেই
রুমানার কোলে
আসে চাঁদের
মতো ফুটফুটে
একটা কন্যা
সন্তান।
সন্তান জন্মানোর
পর সওকতের
বেহায়াপনা আরও বেড়ে যায়।
রুমানার শারীরিক
সামর্থ্যরে ফাঁক ফোকর গলিয়ে সে
অন্যত্র আরও
বেশী সুযোগ
নিতে থাকে। আসলে
স্বভাবজাত পশুদের অজুহাতের অভাব হয়
না।
মানুষ বাঁচে
মূলত এই
পশুত্বের মধ্য
দিয়েই।
তা সে
মহামানবই হোক
আর কসাই-ই হোক। এই
একটা জায়গায়
সবাই এক
কাতারে।
সওকতকে ভিন্নভাবে দেখার
কিছু নেই। তবুও
মানুষ তার
উপর দেবত্ব
আরোপ করে। এই
দেবত্ব তার
অর্জিত গুণাবলী
নয়।
দেবী জয়
করার কারনে
সে দেবতা। বস্তির
মানুষের কাছে
সে অঘোষিত
সম্রাট।
বস্তির উঠতি
তরুণ সাহিত্যিক
মাসুদ তাকে
নিয়ে একটা
অমর উপন্যাস
লিখেছে।
উপন্যাসের নাম আবেগের গল্প।
মাসুদ আসলেই
ভালো লেখে।
উপন্যাসের প্রথম কপিটার
মোড়ক সওকত
উন্মোচন করে। রুমানা
খুশী হয়। তার
সমস্ত দুঃখের
মধ্যে এটা
একটা প্রাপ্তি
বটে।
মাসুদের কলম
তাকে অমরত্ব
দান করেছে। তার
ভালোবাসাকে মর্যাদা দান করেছে।
সওকত যদিও
তাকে দিনে
দিনে ধ্বংসের
শেষ সীমানায়
এনে দাঁড়
করিয়েছে।
মাসুদ ছেলেটা আসলেই
ভালো।
লেখালেখিতে দারুন। তাই বলে
কোন প্রকার
বদঅভ্যাস তার
নেই।
মদ, গাঁজার
কাছে যাওয়া
তো দূরে
থাক একটা
সিগারেট পর্যন্ত
টানে না। গা
থেকে সুগগ্ধ
বের হয়। মাসুদের
সবচেয়ে বড়
গুণ সে
পাঁচ ওয়াক্ত
নামাজ পড়ে। সবাই
তার প্রশংসায়
পঞ্চমুখ।
বই লেখার
জন্যে রুমানা
তাকে দামী
একটা উপহার
দেয়।
যা দেখে
মাসুদ যারপরনাই
খুশী।
জীবনে এই
প্রথম সে
তার কাজের
স্বীকৃতি পেল।
মাসুদের আরও একটা
ভালো গুণ
হলো তার
মধ্যে বাড়াবাড়িটা
একদম নেই। আবেগের
গল্প লিখতে
নিয়ে রুমানার
সাথে তার
অনেক একান্ত
আলাপ হয়েছে। মনের
অজান্তেই হোক
অথবা ইচ্ছের
ফলেই হোক
রুমানাও চেষ্টা
করেছে মাসুদকে
খানিকটা হলেও
মুগ্ধ করার। কিন্তু
মাসুদ ফিরেও
তাকায়নি।
তার লেখাই
হচ্ছে তার
প্রধান নেশা। মেয়ে
মানুষ কিংবা
অন্য কিছু
তার কাছে
অনেক দূরের
বিষয়।
মাসুদের এই
সব গুনের
কারনেই রুমানার
মুগ্ধতা দিনে
দিনে তার
প্রতি বাড়তেই
থাকে।
সওকতের অমানবিক
অত্যাচারও অবশ্য এর জন্যে কম
দায়ী নয়। এমন
অত্যাচারের পর কারো প্রতি ভালোবাসা
ধরে রাখা
কঠিন।
অবশেষে রুমানা মুখ
খোলে।
মাসুদ সব
কিছু শুনে
চুপ করে
থাকে।
মাতাল হলেও
সওকতকে সে
শ্রদ্ধা করে। কারণ
সওকতের হাতেই
তার লেখালেখির
হাতে খড়ি। সওকত
কবি হিসেবে
মন্দ না। যদিও
তার কোন
কবিতার বই
আজও বের
হয়নি।
বিয়ের পর
রুমানা অবশ্য
বার বার
বলেছিল।
কিন্তু সওকত
মত করেনি। নিতান্তই
অবহেলায় বলেছে
ওসব আমার
দ্বারা হবে
না।
আমি স্বভাব
কবি।
শেষ পর্যন্ত মাসুদ
রাজী হয়। গুরুমারা
বিদ্যাই সে
ব্যবহার করে। সওকত
ধরা খেয়ে
যায়।
বস্তিবাসীর কাছে সওকত এখন ভিলেন। জনমত
মাসুদের পক্ষে। মাসুদ
সেটা বুঝতে
পারে।
বুঝতে পারে
রুমানাও।
মহাকাব্যের নতুন অধ্যায় লেখা শুরু
হয়ে যায়।
অবশেষে একদিন ভোর
রাতে মাসুদ
আর রুমানা
উধাও হয়ে
যায়।
বস্তিবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
মাসুদ-রুমানা
কোথায় গেছে
কেউ জানে
না।
সওকত খানিকটা
চুপ হয়ে
গেছে।
ঘটনার বাস্তবতা
তাকে কিছুটা
হলেও স্তম্ভিত
করেছে।
অবশ্য চতুর সওকত
বসে নেই। সে
ঠিকই খোঁজ
খবর করছে। বস্তির
কেউ না
কেউ তো
জানেই।
কিন্তু কে
যে জানে
সে ঠিক
বুঝে উঠতে
পারছে না। সে
ঠিকই লেগে
আছে।
একদিন না
একদন বের
করে ছাড়বেই। তার
খাঁচার পাখি
তার হাত
থেকে পালিয়ে
বাঁচতে পারবে
না।
এটা তার
জীবন মরণের
প্রশ্ন।
মান ইজ্জতের
প্রশ্ন।
সে ঘাপটি
মেরে আছে।
ঘাপটি মেরে আছে
মাসুদ-রুমানাও। তবে
অন্য কোথাও। অন্য
কোন স্থানে। সওকতের
ধরা ছোঁয়ার
বাইরে।
সওকত খুব
ভালো করে
জানে এতে
রুমানার বাপের
মদদ আছে। ওরা
হয়ত বিদেশেও
চলে যেতে
পারে।
দেখতে দেখতে এক
যুগ পেরিয়ে
যায়।
মাসুদ-রুমানার
আর খোঁজ
মেলে না। সওকত
তখন মৃত্যু
সজ্জায়।
তার অন্তিম
সময় সমাগত। মাসুদ
আর রুমানা
খবরটা পেয়ে
যায়।
সওকতকে বঞ্চিত
করে না। মৃত্যুর
দরোজায় দাঁড়ানো
সওকত তার
মেয়ের মুখটা
দেখে দারুন
খুশি হয়। মেয়ে
দেখতে ঠিক
তার মতোই
হয়েছে।
Comments
Post a Comment