আমার নাম রতন। আমার
বয়স ১৮। আমার
কাছে ঘুম
হচ্ছে সবচেয়ে
প্রিয়।
আমি তাই
সারাক্ষণ তক্তপোষে
উঠে বসে
থাকি।
অপেক্ষায় থাকি
কখন ঘুম
আসবে।
যেটুকু সময়
জেগে থাকি
আমার মুখ
চলে।
মায়ের তবু
আমাকে নিয়ে
দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। সারাক্ষণ
ছেলেটার স্বাস্থ্য
খারাপ হয়ে
গেলো বলে
আফসোস করতে
থাকে।
আমার কাজ
তাই সারাক্ষণ
শুধু খাওয়া
আর ঘুম। মাকে
আমার চিন্তামুক্ত
রাখতে হবে।
আমার অবস্থা এরকম
হতো না। যখন
থেকে আমার
বাবা দ্বিতীয়
বিয়ে করলো
আমার ভাগ্য
বদলে যেতে
লাগলো।
এটাকে দুর্ভাগ্য
বলা যায়
কিনা ঠিক
বুঝে উঠতে
পারছি না। মা
আমার ব্যাপারে
ভীষণ স্পর্শকাতর। আমার
কোন কষ্ট
হোক এটা
মা একদম
সহ্য করতে
পারেন না। মায়ের
আহ্লাদে আর
বাবার প্রশ্রয়ে
আমি এখনই
ছোটখাট একটা
হাতিতে পরিণত
হয়েছি।
ছিয়াশি কেজি
ওজনের ছোট
শরীরটা নিয়ে
তাই আর
নড়াচড়ার একদম
ইচ্ছে জাগে
না।
কখনও জেগে
ঘুমাই।
কখনও ঘুমিয়ে
ঘুমিয়ে জাগি। সব
কিছু মিলিয়ে
একটা অদ্ভূত
আর বিতিকিচ্ছিরি
অবস্থা।
মাঝে মাঝে
মনে হয়
মাঠে নেমে
পড়ি।
মা সহ্য
করতে পারে
না।
আমার সৎ ভাইয়েরও
একই অবস্থা।
আমার সৎমা
এ বাড়িতে
আসার পর
থেকেই যাবতীয়
অশান্তির শুরু। তিনি
আসার পরেই
সবকিছু দুভাগ
হয়ে গেলো। আব্বার
ভালবাসাটা প্রথম ভাগ করা হলো। ও
ঘরে একদিন
তো এ
ঘরে একদিন। তারপর
আস্তে আস্তে
সব।
এখন আমরা
শুধু পরস্পরের
প্রতিপক্ষ।
আমার মা
ইচ্ছে করেই
আহলাদ করতে
করতে আমার
সর্বনাশ করেছে। সৎভাইয়ের আদরের
বহর দেখে
তার গা
জ্বালা করে। তিনিও
পাল্লা দিয়ে
আমাকে আদর
করতে শুরু
করেন।
আমার যা
সর্বনাশ হওয়ার
হতে থাকে। আমি
সরাসরি মাটি
থেকে এই
তক্তপোষে উঠে
পড়ি।
এখানেই আমার
খাওয়া।
এখানেই আমার
ঘুম।
আমার বাবা আমার
ছোট মাকে
এ বাড়ীতে
আনেন তাও
কমসে কম
দশ বছর
তো হবেই। সবাই
বলে বিয়ে
নাকি আগেই
করেছিলেন।
আম্মার ভয়ে
লুকিয়ে রাখেন। তারপর
সবক্ষেত্রে যা হয়। সবকিছু
জানাজানি হয়ে
যায়।
মাও ঝেড়ে
কাশেন।
নিয়ে আসতে
বলেন।
দুরে রেখে
এক্কা দোক্কা
খেলার কি
দরকার।
তার চেয়ে
কাছে এনে
বরং হোলি
খেলা যাক। আম্মারও
নেশা চেপে
বসে প্রতিপক্ষের
সাথে যুদ্ধ
করার।
সে তাই
আব্বাকেও বিপক্ষ
হিসেবে ধরে
নেয়।
তার জোর
ছিলো একটাই। সে
এ বাড়ীতে
আগে এসেছে। আমার
বাবাও তার
সেই দাবীকে
কখনও ছোট
করেননি।
মার সব
কথার বিপরীতেই
চুপ থেকেছেন
বরাবর।
এদিক দিয়ে
বিচার করলে
আমার বাবাকে
একজন ভালো
মানুষই বলতে
হবে।
আমার মাথায় আসে
না এ
ধরনের একজন
ভালো মানুষের
দুটো বিয়ের
কি দরকার। সংসারে
দিনভর অশান্তি
আর ঝগড়াঝাটি
ছাড়া আমার
বাবাকে তো
আর কিছু
পেতে দেখিনি। বলতে
গেলে তাকে
প্রতিদিনই দুই মায়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে
শালিসি করতে
হয়।
কাহাতক এই
সব ভালো
লাগে।
কিন্তু উনি
দিব্যি চালিয়ে
যাচ্ছেন।
ভীষণ ধীর,
স্থির, শান্ত। এই
লোকটাকে জন্মের
পর মনে
হয় ঠান্ডা
পানিতে ভেজানো
হয়েছিল।
নইলে একটা
লোকের পক্ষে
এতটা ধীর,
স্থির, শান্ত
হওয়া কীভাবে
সম্ভব একিলিসের
মতো।
একিলসকে তার
মা মৃত্যু
সঞ্জিবনী অনন্ত
দরিয়ায় গোসল
করিয়েছিলেন। একিলিসের সারা শরীর
তাই আঘাত
প্রতিরোধী হয়েছিল। এটা ছিল
দেবতার বর। কিন্তু
একিলিসের মা
একটা ভুল
করেছিলেন।
যে জায়গাটায়
তার মা
তাকে ধরেছিল
অর্থাৎ
তার গোড়ালিটা
যে ভেজেনি
এটা কিন্তু
তার মা
খেয়াল করেনি। আর
সেটাই ছিল
তার শরীরের
সবচেয়ে দুর্বল
জায়গা।
ট্রয়ের যুদ্ধে
হেক্টরের ছোট
ভাই আগামেমননের
পূর্বের স্ত্রী
হেলেনের স্বামী
প্যারিস এখানে
তীর বিদ্ধ
করেই একিলিসকে
মেরে তার
জেষ্ঠ্য ভ্রাতা
হেক্টরের হত্যার
প্রতিশোধ নিয়েছিলন। এজন্যই
দুর্বল কোন
কিছুর কথা
আসলেই তাকে
একিলিসের হিলের
সাথে তুলনা
করা হয়। এসব
কথা গ্রীক
পুরাণে লেখা
আছে।
আমার বাবা
আমাকে গ্রীক
পুরাণ কিনে
দিয়েছেন বেশ
কিছুদিন হল। আমি
সেখান থেকে
পড়ে পড়ে
এসব শিখেছি।
দুই পরিবারের কলহ-কোন্দল দিনে
দিনে শুধু
বেড়েই চলছে। কিন্তু
তাই বলে
জীবন তো
আর থেমে
নেই।
আমার হাতির
শরীর দিনে
দিনে আরও
সমৃদ্ধ হচ্ছে। সবচেয়ে
বড় কথা
আমি পারি
বা না
পারি আমার
মা টিপে
টিপে আরও
গেলানোর চেষ্টা
করছে।
খাবারটা আমার
প্রয়োজন কিনা
সেটা ভাববার
অবকাশ নেই। পাছে
আমার খাওয়াটা
আমার সৎভাইয়ের চেয়ে
কম হয়
এটাই তার
মাথাব্যাথার কারণ। একদিন তো
সে এসে
বলেই ফেলল
আমার সৎভাই মানিক
নাকি তিন
কেজি চালের
ভাত খায়। কথা
শুনে আমার
এমন অনুভূতি
হয় যে
ভকভক করে
বমি চলে
আসে।
পেটে যা
ছিলো তাও
বেরিয়ে যায়। মা
ভীষণ কষ্ট
পায়।
আফসোস করে
বলতে থাকে
একটায় তিন
কেজি চালের
ভাত একসাথে
সাবাড় করছে
আর এটাকে
এতক্ষণ ধরে
টিপে টিপে
যাও একটু
খাওয়ালাম তাও
বমি করে
ফেলে দিল। আমার
হয়েছে যত
জ্বালা।
গলায় দড়ি
দিয়ে মরতে
পারলে ভাল
হতো।
বমির দমকে আমার
দুচোখে তখন
পানি।
নাকে লাল। মুখে
লালা।
আমার আর
কান্নার দরকার
হয় না। মা
আমার ধরেই
নেন যে
কষ্টে আমি
কাঁদছি।
তিনি দ্বিগুণ
ব্যাকুল হন। আব্বা
ছুটে আসেন
কি হয়েছে,
কি হয়েছে
বলে।
সেই বমির
উপর পা
পিছলে তিনি
মাটিতে পড়ে
যান।
তারপর প্রায়
সপ্তাহখানেক কোমর ব্যাথায় ভুগে অবশেষে
মালিশ টালিশ
লাগিয়ে, কতগুলো
ঔষধপথ্য গিলে
শেষ পর্যন্ত
সুস্থ হন। আমার
ভীষণ মন
খারাপ লাগে। আমার
কারণে আব্বাকে
এমন একটা
দুর্ভোগে পড়তে হলো। অবশ্য
আমার কিছু
করার ছিলো
না।
হাতির বমির
ধরণ এমনই
হয় হয়তো।
সময় আগাতে থাকে। আমি
নিজেকে নিয়ে
শংকিত হতে
থাকি।
এভাবে বাড়তে
থাকলে না
জানি কবে
এই খাটের
উপরেই মরে
পড়ে থাকি। মোটা
মানুষের অনেক
সমস্যা।
স্বাস্থ্যের কাছে বয়স হার মানে। ১৮
বছরেই আমাকে
৮১ বছরের
বুড়োর মতো
হাসফাস করতে
হয়।
আমার অবস্থা
সঙ্গীন।
হঠাৎ করে
সবকিছু বদলে
যায়।
কিযে হয়
জানি না। একদিন
রাতে মানিক
আসে আমার
কাছে।
এসে বলে
ভাইয়া দুই
পরিবারের ঝগড়ায়
আমরা শেষ
পর্যন্ত শেষ
হয়ে যাব। তার
চেয়ে বরং
চল আমরা
বাঁচি।
রাস্তায় গিয়ে
হাঁটি।
মাঠে গিয়ে
খেলি।
দৌঁড়ে অনেক
দুর যাই। নদীতে
সাঁতরাই।
চল।
ওঠ।
আমরা বেঁচে
থাকি।
অথচ এই
মানিকের সাথে
কথা বলা
তো দূরে
থাক ওর
দিকে তাকানো,
ওর ছায়া
মারানোও আমার
নিষেধ।
আমার মনটা কেমন
যেন অস্থির
হয়ে ওঠে। ওর
হাত ধরে
তক্তপোষ থেকে
নামি।
উঠান পেরিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে
বড় রাস্তায়
আসি।
রাত তখন
গভীর।
সবাই ঘুমিয়ে। আমি
আর মানিক। আমরা
নিজেদের নিয়ে
ব্যস্ত হয়ে
উঠি।
আমাদের বাঁচতে
হবে।
কেউ কিছু জানে
না।
যথাসময়ে ফিরে
আসি বিছানায়। চুপচাপ
শুয়ে থাকি। সারাদিনের
কর্মক্লান্ত মা সন্ধ্যার পরপরই ঘুমের
ঘোরে হারিয়ে
যায়।
এসবের কিছুই
তার জানা
হয় না। অবশ্য
সে জানলে
আমার আর
যাওয়া হবে
না।
একদিন মানিককে জিজ্ঞাসা
করি তোকে
এসব কে
বলেছে।
মানিক জবাব
দেয় আমার
মা।
সে তোমাকে
এবং আমাকে
অনেক ভালোবাসে। সে
কখনই চায়
না আমরা
অথর্ব হই। অল্প
বয়সে মারা
পড়ি।
আমাদের বাঁচাতে
চায় সে।
আমি গোপনে ছোট
মায়ের কাছে
যাই।
মানিকও সাথে
থাকে।
মা আমাকে
অনেক আদর
করে।
আমার দুচোখ
বেয়ে ঝর্ণা
ধারা নামে।
ছোট মা কাঁদতে
কাঁদতে বলে
আমি তোমার
মায়ের সারা
জীবনের সুখ
নষ্ট করেছি। কিন্তু
এতে আমার
কোন দোষ
নেই।
আমি নিরূপায়
ছিলাম।
তোমার বাবা
আমাকে বিয়ে
করে উদ্ধার
করেছিলেন।
ওনার এই
ঋণ কোনদিন
শোধ করতে
পারবো না। অসহায়
মানুষের হিতাহিত
জ্ঞান থাকে
না।
আমি ছোট মাকে
ক্ষমা করে
দেই।
কিন্তু হঠাৎ করেই
আতঙ্কে আমার
হাত পা
জমে ওঠে। আমার
মা আমার
পেছনে দাঁড়িয়ে। সর্বনাশ!
আমি আস্তে উঠে
আসি।
মুখ শুকিয়ে
কাঠ।
জীবনে এত
ভয় কোনদিন
পাইনি।
বুকের পাটাতনের
ওঠা নামা
স্পষ্ট ধরা
পরে।
মা আমাকে বুকে
জড়িয়ে ধরেন। কান্না
জড়িত কণ্ঠে
বলেন তোর
ছোট মা
ঠিকই বলেছেন
তোদেরকে বাঁচতে
হবে।
আজ থেকে দুই
ভাই এক
সাথে চলবি। ছোট
মার দুচোখ
বেয়ে আনন্দের
অশ্র“
নামে।
আমার খুব
আফসোস হয়
ইশ! আজ
আব্বা বেঁচে
থাকলে খুব
খুশী হতেন।
Comments
Post a Comment