১৯৭২ সালের ২রা
মে তার
জন্ম হয়। গরীব
শিক্ষক পিতার
নবম সন্তান। অভাবের
সংসার।
আজন্ম অপুষ্টিতে
ভুগতে থাকা
মায়ের গর্ভে
পুষ্টিহীনতায় বেড়ে ওঠা রোগা পাতলা
শরীর।
জন্মানোর পর
থেকেই তাই
একটার পর
একটা অসুখ
লেগেই থাকে
ছেলেটার।
ভালো কোনো খাবারও
জোটেনা তার। জোটে
না চিকিৎসা।
তাই বারবার
মৃত্যুর ঝুঁকি
তার জীবনটাকেই
অনিশ্চিত করে
তোলে।
তবুও বেঁচে
থাকে সে। কারণ
একটাই।
আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর
হুকুম না
থাকলে এইসব
মানুষদের বেঁচে
থাকার অন্য
কোন ব্যাখ্যা
নেই।
প্রত্যেক জিনিসের
জন্যই একটা
সময়কাল নির্ধারিত
করা আছে। তাকে
সেই সময়কাল
অতিক্রম করতে
হবে।
অন্য কোনো
কারনে বা
অন্য কারো
চেষ্টায় তার
মৃত্যু হবে
না।
এটাই অমোঘ
বিধান।
রোগা পাতলা শরীরে
পেটটা বাদ
দিলে আর
কিইবা থাকে
শিশুটির।
বারোমাস গুড়া
ক্রিমিতে ভুগে
পেটটা যেন
ছোটখাট একটা
হাড়ি।
আমাশয় আর
পাতলা পায়খানা
লেগেই থাকে। মাঝে
মাঝে মলদ্বার
বাইরে বেরিয়ে
এসে মাটিতে
ঘসা খায়। তবুও
শিশুটি বেঁচে
থাকে।
এর মধ্যে
দিয়েই আবার
টাইফয়েড জ্বরের
আক্রমণ।
মাসখানেক বিনা
চিকিৎসায়
ভোগার পর
একটা পা
বেশ খানিকটা
খাঁটো হয়ে
যায়।
শিশুটা আগে
যাও একটু
দৌঁড়াতে পারত
এখন তাও
কষ্টসাধ্য।
এক পায়ে
তার দাঁড়ানোই
কঠিন।
কিছু একটা
ধরে তবে
দাঁড়াতে হয়।
গ্রামের বাড়ী।
চারিদিকে পঁচা
পুকুর আর
নর্দমা।
তার উপরে
মশার ভয়ঙ্কর
উৎপাত। সব
মিলিয়ে একটা
বিভৎস
পরিবেশ।
শীতকাল আসলে
কলেরার উৎপাত।
ঘরে ঘরে
মৃত্যুর হিড়িক। মনে
হয় যেন
সারাটা অঞ্চল
জুড়ে মড়ক
লেগেছে।
মৃত্যুর নীরব
মিছিল ভয়াবহ
আতংক ছড়ায়। গ্রামজুড়ে
সহস্র বছরের
নিঃসঙ্গতা নেমে আসে। ভয়ে
গা ছম
ছম করতে
থাকে।
এই বুঝি
কেউ আক্রান্ত
হলো।
কয়েক বার
পাতলা পায়খানা
হওয়ার পরই
দুনিয়া থেকে
বিদায়।
মহামারিতে ঈমানের পরীক্ষা
আছে।
যারা পালাবে
তারা দুর্বল
ঈমানের অধিকারী। এরকম
পরিবেশে পাঁচ
বছর অতিক্রম
করাও একটা
শিশুর জন্য
অনেক বড়
বিষয়।
কিন্তু রাখে
আল্লাহ মারে
কে।
এর মধ্যেও
কিছু কিছু
শিশু ঠিকই
টিকে থাকে।
দেখতে দেখতে হঠাৎ শুরু
হয় গুঁটি
বসন্তের আক্রমণ। শিশুটির
সারাটা শরীরেও
ঘা হয়ে
যায়।
শরীরের মাংস
যেন খুলে
খুলে মাটিতে
পড়তে চায়। যেখানেই
ছোঁয়া লাগে
সেখানেই গলিত
মাংসের টুকরো
লেগে যায়। বিছানা
বাদ দিয়ে
কলার পাতার
উপর শুইয়ে
রাখা হয়
শিশুটিকে।
এই শিশু তারপরও
বেঁচে থাকে। একটা
শিশুর জন্যে
এটা আজব
কিছু নয়। আবহমান
বাংলার প্রতিটি
শিশুর জীবনে
এমনি হাজারো
পরিস্থিতির উপস্থিতি যেন বাংলার চিরন্তনী
চিত্রকেই মনে
করিয়ে দেয়।
অবশেষে হাজম আসে। বাঁশের
বিশেষ কঞ্চির
ফাঁকে চাপ
দিয়ে শিশু
থেকে কিশোর
বানিয়ে দেওয়া
হয় তাকে। কিন্তু
তাতেও বিপত্তি। সেবার
অনেকগুলো শিশু
নোংরা রোগ
জীবানু থেকে
সৃষ্ট ক্ষতের
কারণে মারা
যায়।
তাকেও ভুগতে
হয় প্রায়
ছয় মাস। ঘা
যেন আর
কিছুতেই শুকায়
না।
ঘরের চারপাশে
মৃত্যু ঘোরাঘুরি
করে।
শিশুটি বেঁচে
যায়।
তবে পড়াশুনার
বেশ খানিকটা
ক্ষতি হয়ে
যায়।
এসব কোনো ব্যাপার
না।
সমস্যা দেখা
দেয় লেখাপড়া
নিয়ে।
শিশুটি মাদ্রাসায়
পড়তে চায়। কোরআন
মুখস্ত করতে
চায়।
তার ইচ্ছা
সে হাফেজ
হবে।
কিন্তু তার
বড় ভাই
মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে বিগড়ে যাওয়ার
কারণে তাকে
আর মাদ্রাসায়
দিতে রাজী
হয় না
তার বাবা-মা।
শুভ কাজে বাধা
অনেক।
জীবনের প্রথম
বাধাটাই সে
পার হতে
পারে না। তাকে
একটা বাংলা
শেখানোর পাঠশালায়
ভর্তি করে
দেওয়া হয়। তার
জীবনটা শুরুতেই
জগাখিচুড়ী হয়ে যায়। পাঠশালায়
না বাংলা
না ইংরেজী;
কোন কিছুই
তার ভালোভাবে
শেখা হয়
না।
আসলে জীবনে
যাই শেখো
ভালোভাবে শেখো। নইলে
শিক্ষা তোমার
জন্যে পূন্যের
বদলে পাপ
হয়ে ধরা
দেবে।
তুমি পথ
হারাবে।
দেখতে দেখতে প্রায়
আট বছর
চলে যায়। শিশুটির
একাডেমিক শিক্ষা
তেমন কিছু
হয় না। ওদিকে
আরবীও শেখা
হয় না
ঠিকমতো।
এক ধরণের
এলোমেলোমির মধ্যেই বেড়ে ওঠা আর
কি! শিশুটির
জীবনটা একটা
রকমারী বাজারের
মতো।
যেখানে সবকিছুই
পাওয়া যায়
কিন্তু কোন
কিছুই মূল্যবান
নয়।
অর্থহীন কিছু
পণ্যের সমাহার
নিম্নশ্রেণীর গ্রাহকের ভিড়ই শুধু বাড়ায়। বাংলার
অজস্র শিশুর
জীবনটাই এরকম
ঘেরা টোপে
বন্দী।
অবশেষে আট বছর
বয়সে সরাসরি
তৃতীয় শ্রেণীর
সমাপনী পরীক্ষায়
বসে পড়ে
সে।
প্রথম স্থান
পেয়ে যায়। তারপর
ভালো স্কুলের
সন্ধানে বাড়ী
থেকে বহুদূর। সেখানেও
অন্য এক
জীবন।
শেষ পর্যন্ত
সাফল্য আসে। দারুন
সাফল্য।
পঞ্চম শ্রেণীতে
তার অঞ্চলে
মেধা তালিকায়
প্রথম স্থান
নিয়ে বৃত্তি
পায় শিশুটি। জীবনের
প্রথম সাফল্যে
কিছুটা হলেও
পরিবর্তন আসে
জীবনে।
সেই পরিবর্তন খুব
একটা স্থায়ী
হয় না। বরাবরের
মতোই গতানুগতিক
জীবন।
ধুকে ধুকে
সামনে আগাতে
থাকে।
নিতান্ত হতভাগাদের
জীবন আসলে
এতো সহজে
বদলায় না। সাফল্য
যা কিছু
আসে তাও
দুর্ভাগ্যের স্রোতে খড়কুটার মতো ধুয়ে
মুছে সাফ
হয়ে যায়। আবারও
সেই হাড্ডিসার
জীবন।
ভালোলাগা ভালোবাসা
না হয়
বাদই দিলাম। বেঁচে
থাকাটাই যেন
গ্লানি।
Comments
Post a Comment