১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর সবাই প্রতীক্ষায় ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখন দেশে ফিরবেন। যাহোক বাঙ্গালীকে খুব বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনের হাইড পার্কে জনসভা শেষে মুজিব সরাসরি ঢাকায় অবতরণ করেন ১০ই জানুয়ারী। ফুলেল শুভেচ্ছায় মুজিবকে বরণ করে নেয় দেশবাসী। বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের মুজিবের বাড়ী। সর্বত্রই লোকে লোকারণ্য। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে কর্মী মুজিব তার স্বরূপে ফিরে আসেন। কিশোর বয়স থেকে রাজনীতির সাথে যুক্ত এই মানুষটি অতি সহজেই মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারতেন। মুজিব বুঝতে পারলেন তার করণীয় কী। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটাকে দাঁড় করাতে হবে। তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানালেন। এগিয়েও এলো সবাই। কিন্তু সর্বত্রই একটা কিন্তু থেকে যায়। এখানেও থাকল। সবাই যে অতি সহজে অতীত ভুলে একাকার হতে পারলো তা কিন্তু নয়। যাদের অন্তরে রোগ ছিল তারা আরও বেশী ব্যাধিগ্রস্থ হলো। আচার-আচরণে না করলেও মুখায়বে তার অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে লাগলো। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়কালটা সংক্ষিপ্ত হলেও আমাদের পরবর্তী রাজনীতির গতিধারা মূলতঃ তখন ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসকে অস্বীকার করার উপায় নেই। মুজিব যখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত তখন ব্যাধিগ্রস্থরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেই ষড়যন্ত্রের মদদ আসছিল তাদেরই অতীতের মিত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। গোপনে গোপনে তারা তাদের গন্তব্যের দিকে হাঁটছিল। আর এই সমস্ত বিছানো জালের মূলসূত্র গাঁথা ছিলো লন্ডনের সাথে। ইতিহাস সাক্ষী ব্রিটিশরা বরাবরই মুসলিম বিশ্ব নিয়ে রাজনীতি করেছে এবং তা অত্যন্ত সুকৌশলে। আমরা মনে করতে পারি সেই লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার কথা। একজন লরেন্স পুরো আরব বিশ্বকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন। যাহোক আমরা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসতে চাই।
ভেতরের ক্ষোভ বেশীদিন চাপা রাখতে পারলো না। বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধীদের পাশাপাশি উদ্ধত সামরিক বাহিনীকে সামলানো মুজিবের জন্য সত্যিই বেশ কঠিন হলো। সেই সাথে পরাজিত কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক চাল। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করার জন্যে মনে হয় না এর চেয়ে বেশী উপাদানের প্রয়োজন আছে। যদিও আরও অজ¯্র উপাদান মজুদ ছিলো। আমরা এই লেখায় এতো সংক্ষিপ্ত পরিসরে এতো বিস্তৃত আলোচনা করার সুযোগ পাবো না। এই প্রবন্ধে আমরা শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা করব। যদি এ প্রসঙ্গে তেমন কিছু এসেই যায় তার উপর হয়তো সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টে সপরিবারে মুজিব নিহত হলে আমাদের রাজনীতির প্রথম অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে। মুজিব যাদের গলার কাটা হয়ে উঠেছিলেন তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কিন্তু বাঁচলে কি হবে। দেশপ্রেমিক মুজিবের ছায়া বারবার ফিরে ফিরে আসে। ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ কি মনে করে একটা অপরিকল্পিত বিদ্রোহ করে বসে। সেই দাবানলে পেট্রোল যোগান দেয় কর্ণেল তাহের। তিনি খাল কেটে কুমির নিয়ে আসেন। যদিও সেই কুমিরই তাকে শেষ পর্যন্ত সাবাড় করে। ধর্মভীরু জিয়ার কাছে উদাসীন তাহের যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বন্ধু এটা তাহেরও জানতেন। তবুও তিনি সামনে আগালেন। তার কাছে আর কোন বিকল্পও ছিলো না। তিনি সমাজতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টাটা করলেন নিজের জীবন দিয়ে। কিন্তু বাংলার রাজনীতির বিচিত্রতা আর বৈচিত্র্য তাহেরের দর্শনকে নেয়নি। তারা বরং ধর্মের মিশেলে গড়া জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে সান্ত¡না খোঁজার চেষ্টা করলো। লাভের লাভ কিছুই হলো না। বাঙ্গালী ঘেরাটোপের আবর্তে বাঁধা পড়ল। ১৯৮১ সালের ৩১শে মে জিয়ার মৃত্যু হলে রাজনীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়। এরশাদের মধ্যে কাব্যময়তা ছিলো। ভালো বক্তৃতা লিখতে পারতেন। জিয়া এরশাদকে টেনে তুললেন। ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে আসলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ সরাসরি দৃশ্যপটে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাই কিছুদিন নিজেকে আড়াল করে রাখলেন। অবশেষে শারীরিকভাবে কাবু সাত্তারকে এক ধমকে আরও কাবু করে দিয়ে তিনি ক্ষমতায় বসে পড়লেন। একজন রোমান্টিক কবি যিনি একাধারে একজন সামরিক সদস্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে পড়লেন। তবে তার একটা গুণের প্রশংসা না করে পারছি না। তিনি বাঙ্গালীকে নতুন কোন দর্শন গলাধঃকরণের চেষ্টা করলেন না। তিনি উন্নয়নকে মন্ত্র হিসেবে নিলেন। ব্যাপারটা মন্দ না। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর চেষ্টা করলেন। গ্রামে গঞ্জেও রাস্তাঘাট নির্মাণে উৎসাহী হলেন। বাংলাদেশের মানুষ নতুন একটা আঙ্গিকে ভাবতে শুরু করলো। তিনি জানিয়ে দিলেন, ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। গ্রামের সংখ্যা সঠিক কতো তা তিনিই ভালো জানেন।
দেখতে দেখতে ন’টা বছর কেটে গেলো। শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন সেই ১৯৮১ সালের ১৭ই মে। ইতোমধ্যে তিনি এরশাদ সরকারের রাজসভার বিরোধীর ভূমিকাও পালন করেছিলেন। কিন্তু তাতে কি হবে। স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি আওয়ামী লীগও কিছুতেই তার বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারলো না। অবশেষে তাকে একজন বিধবার হাত ধরতে হলো। দুজনে মিলে রশি ধরে শক্ত হাতে টান লাগালেন। তাতে কিছুটা হলেও শক্তি যোগান দিলো বামপন্থীরা। যাহোক শেষ পর্যন্ত ডাঃ মিলন আর নূর হোসেন তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদকে গদি থেকে নামালেন। রাজনীতির তৃতীয় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হলো। আওয়ামী লীগ আশাবাদী ছিলো তারাই সরকার গঠন করবে। হলোও তাই। কারণ পপুলার ভোটে তারাই এগিয়ে ছিলো। পিছিয়ে পড়লো সংসদীয় পদ্ধতির আসন বিন্যাসের কারণে। বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলো। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের এই সময়টাতে আমাদের রাজনীতির চতুর্থ অধ্যায় রচিত হলো।
অবশেষে এলো ১৯৯৬ সালের নির্বাচন। আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পেল। বিশ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কারের দায়িত্ব এসে পড়ল ঘাড়ে। কোনটায় যে হাত দেবে বোঝা দায়। সর্বত্রই সমস্যা। তার উপরে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র। আবারও জনগণের সেই পাহাড় সমান প্রত্যাশার চাপ। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে কেন জানি সবার প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আওয়ামী লীগের কাছে কেন জানি মানুষ বরাবরই কিছু একটা আশা করে। অজ¯্র পূর্ণ-অপূর্ণ আশা-আকাঙ্খার মধ্য দিয়ে রাজনীতির পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত হলো।
আবারও ছন্দ পতন ঘটলো। অনেক প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসে অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি পড়লো। বিএনপি-জামাত জোট সরকার গঠন করলো। রাজনীতির ষষ্ঠ অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটলো অজ¯্র নতুনত্বের সংযোগের মধ্যে দিয়ে। তবে এই সব নতুনত্বের কোনটাই যে ইতিবাচক নয় তা সহজেই অনুমেয়। সঙ্গদোষে লোহা ভাসের মতো বিএনপি জামাতের যৌথ সম্পর্ক যাবতীয় অপদার্থকে রাজনীতির উপাদান করে নিলো। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই ক্ষয়িষ্ণু ধারাবাহিকতার অবসান ঘটালো দুই বছর ক্ষমতায় থেকে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই অন্তর্বতী সরকার রাজত্ব করলো। এভাবে রাজনীতির ৭ম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করলো।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিনের জমে থাকা জঞ্জালের অনেকটাই পরিষ্কার করলো। অসমাপ্ত মুজিব হত্যাকারীদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পাশাপাশি ধ্বংস প্রাপ্ত বিদ্যুৎ খাতের পূনর্গঠন এমনই অজ¯্র বড় বড় কাজ প্রায় সমাপ্ত করে আনলো। পাশাপাশি উন্নয়নও চলছিল। বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো একটি অকার্যকর রাষ্ট্র কিভাবে কার্যকর হলো মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে।
এতোক্ষণের এই সামান্য আলোচনায় আমরা মূলতঃ আমাদের মূল প্রসঙ্গে আসতে পারিনি। আমরা মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা খুঁজতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদের সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত আমরা আমাদের এই সূর্য সন্তানদের কোন ভূমিকাই দেখতে পাইনি। হতে পারে এটা তাদের অভিমান। হতে পারে অবহেলার ভার সইতে না পারার মনোবেদনা। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি কখনও একসাথে যায় যায় না। এটা তাদের মেনে নেয়া উচিত ছিলো। দেশের জন্যে তারা যা করেছে তার বিনিময় প্রত্যাশা না করাই তাদের জন্যে শ্রেয়। দেশ যদি তাদের মূল্যবান করে সেটা দেশের মহানুভবতা। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সেই কথা স্মরণযোগ্য, “যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া চাহিতে গেলে কেবল বিড়ম্বনাই বাড়িবে।” আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মসম্মানবোধ নিয়েই বাঁচুক। যে মহান ত্যাগ তারা করেছে, কোন বিনিময় যেন তাকে খাটো না করে।
অতি সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা এবং বয়স নির্ধারণ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারী হয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জার। আমরা এতটুকু সৎ হতে পারলাম না। আমাদেরকে শর্ত দিতে হলো কাউকে মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে এই এই শর্ত পূরণ করতে হবে। তার বয়স ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ১৩ বছর হতে হবে। কি নিদারুন লজ্জা। আমরা প্রত্যেকেই তো জানি আমরা মুক্তিযোদ্ধা কিনা। বিবেকের কাছে এই প্রশ্ন রেখে এই লেখা এখানেই শেষ করলাম।
ভেতরের ক্ষোভ বেশীদিন চাপা রাখতে পারলো না। বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধীদের পাশাপাশি উদ্ধত সামরিক বাহিনীকে সামলানো মুজিবের জন্য সত্যিই বেশ কঠিন হলো। সেই সাথে পরাজিত কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক চাল। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করার জন্যে মনে হয় না এর চেয়ে বেশী উপাদানের প্রয়োজন আছে। যদিও আরও অজ¯্র উপাদান মজুদ ছিলো। আমরা এই লেখায় এতো সংক্ষিপ্ত পরিসরে এতো বিস্তৃত আলোচনা করার সুযোগ পাবো না। এই প্রবন্ধে আমরা শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা করব। যদি এ প্রসঙ্গে তেমন কিছু এসেই যায় তার উপর হয়তো সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টে সপরিবারে মুজিব নিহত হলে আমাদের রাজনীতির প্রথম অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে। মুজিব যাদের গলার কাটা হয়ে উঠেছিলেন তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কিন্তু বাঁচলে কি হবে। দেশপ্রেমিক মুজিবের ছায়া বারবার ফিরে ফিরে আসে। ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ কি মনে করে একটা অপরিকল্পিত বিদ্রোহ করে বসে। সেই দাবানলে পেট্রোল যোগান দেয় কর্ণেল তাহের। তিনি খাল কেটে কুমির নিয়ে আসেন। যদিও সেই কুমিরই তাকে শেষ পর্যন্ত সাবাড় করে। ধর্মভীরু জিয়ার কাছে উদাসীন তাহের যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বন্ধু এটা তাহেরও জানতেন। তবুও তিনি সামনে আগালেন। তার কাছে আর কোন বিকল্পও ছিলো না। তিনি সমাজতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টাটা করলেন নিজের জীবন দিয়ে। কিন্তু বাংলার রাজনীতির বিচিত্রতা আর বৈচিত্র্য তাহেরের দর্শনকে নেয়নি। তারা বরং ধর্মের মিশেলে গড়া জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে সান্ত¡না খোঁজার চেষ্টা করলো। লাভের লাভ কিছুই হলো না। বাঙ্গালী ঘেরাটোপের আবর্তে বাঁধা পড়ল। ১৯৮১ সালের ৩১শে মে জিয়ার মৃত্যু হলে রাজনীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়। এরশাদের মধ্যে কাব্যময়তা ছিলো। ভালো বক্তৃতা লিখতে পারতেন। জিয়া এরশাদকে টেনে তুললেন। ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে আসলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ সরাসরি দৃশ্যপটে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাই কিছুদিন নিজেকে আড়াল করে রাখলেন। অবশেষে শারীরিকভাবে কাবু সাত্তারকে এক ধমকে আরও কাবু করে দিয়ে তিনি ক্ষমতায় বসে পড়লেন। একজন রোমান্টিক কবি যিনি একাধারে একজন সামরিক সদস্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে পড়লেন। তবে তার একটা গুণের প্রশংসা না করে পারছি না। তিনি বাঙ্গালীকে নতুন কোন দর্শন গলাধঃকরণের চেষ্টা করলেন না। তিনি উন্নয়নকে মন্ত্র হিসেবে নিলেন। ব্যাপারটা মন্দ না। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর চেষ্টা করলেন। গ্রামে গঞ্জেও রাস্তাঘাট নির্মাণে উৎসাহী হলেন। বাংলাদেশের মানুষ নতুন একটা আঙ্গিকে ভাবতে শুরু করলো। তিনি জানিয়ে দিলেন, ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। গ্রামের সংখ্যা সঠিক কতো তা তিনিই ভালো জানেন।
দেখতে দেখতে ন’টা বছর কেটে গেলো। শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন সেই ১৯৮১ সালের ১৭ই মে। ইতোমধ্যে তিনি এরশাদ সরকারের রাজসভার বিরোধীর ভূমিকাও পালন করেছিলেন। কিন্তু তাতে কি হবে। স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি আওয়ামী লীগও কিছুতেই তার বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারলো না। অবশেষে তাকে একজন বিধবার হাত ধরতে হলো। দুজনে মিলে রশি ধরে শক্ত হাতে টান লাগালেন। তাতে কিছুটা হলেও শক্তি যোগান দিলো বামপন্থীরা। যাহোক শেষ পর্যন্ত ডাঃ মিলন আর নূর হোসেন তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদকে গদি থেকে নামালেন। রাজনীতির তৃতীয় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হলো। আওয়ামী লীগ আশাবাদী ছিলো তারাই সরকার গঠন করবে। হলোও তাই। কারণ পপুলার ভোটে তারাই এগিয়ে ছিলো। পিছিয়ে পড়লো সংসদীয় পদ্ধতির আসন বিন্যাসের কারণে। বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলো। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের এই সময়টাতে আমাদের রাজনীতির চতুর্থ অধ্যায় রচিত হলো।
অবশেষে এলো ১৯৯৬ সালের নির্বাচন। আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পেল। বিশ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কারের দায়িত্ব এসে পড়ল ঘাড়ে। কোনটায় যে হাত দেবে বোঝা দায়। সর্বত্রই সমস্যা। তার উপরে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র। আবারও জনগণের সেই পাহাড় সমান প্রত্যাশার চাপ। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে কেন জানি সবার প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আওয়ামী লীগের কাছে কেন জানি মানুষ বরাবরই কিছু একটা আশা করে। অজ¯্র পূর্ণ-অপূর্ণ আশা-আকাঙ্খার মধ্য দিয়ে রাজনীতির পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত হলো।
আবারও ছন্দ পতন ঘটলো। অনেক প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসে অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি পড়লো। বিএনপি-জামাত জোট সরকার গঠন করলো। রাজনীতির ষষ্ঠ অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটলো অজ¯্র নতুনত্বের সংযোগের মধ্যে দিয়ে। তবে এই সব নতুনত্বের কোনটাই যে ইতিবাচক নয় তা সহজেই অনুমেয়। সঙ্গদোষে লোহা ভাসের মতো বিএনপি জামাতের যৌথ সম্পর্ক যাবতীয় অপদার্থকে রাজনীতির উপাদান করে নিলো। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই ক্ষয়িষ্ণু ধারাবাহিকতার অবসান ঘটালো দুই বছর ক্ষমতায় থেকে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই অন্তর্বতী সরকার রাজত্ব করলো। এভাবে রাজনীতির ৭ম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করলো।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিনের জমে থাকা জঞ্জালের অনেকটাই পরিষ্কার করলো। অসমাপ্ত মুজিব হত্যাকারীদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পাশাপাশি ধ্বংস প্রাপ্ত বিদ্যুৎ খাতের পূনর্গঠন এমনই অজ¯্র বড় বড় কাজ প্রায় সমাপ্ত করে আনলো। পাশাপাশি উন্নয়নও চলছিল। বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো একটি অকার্যকর রাষ্ট্র কিভাবে কার্যকর হলো মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে।
এতোক্ষণের এই সামান্য আলোচনায় আমরা মূলতঃ আমাদের মূল প্রসঙ্গে আসতে পারিনি। আমরা মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা খুঁজতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদের সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত আমরা আমাদের এই সূর্য সন্তানদের কোন ভূমিকাই দেখতে পাইনি। হতে পারে এটা তাদের অভিমান। হতে পারে অবহেলার ভার সইতে না পারার মনোবেদনা। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি কখনও একসাথে যায় যায় না। এটা তাদের মেনে নেয়া উচিত ছিলো। দেশের জন্যে তারা যা করেছে তার বিনিময় প্রত্যাশা না করাই তাদের জন্যে শ্রেয়। দেশ যদি তাদের মূল্যবান করে সেটা দেশের মহানুভবতা। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সেই কথা স্মরণযোগ্য, “যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া চাহিতে গেলে কেবল বিড়ম্বনাই বাড়িবে।” আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মসম্মানবোধ নিয়েই বাঁচুক। যে মহান ত্যাগ তারা করেছে, কোন বিনিময় যেন তাকে খাটো না করে।
অতি সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা এবং বয়স নির্ধারণ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারী হয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জার। আমরা এতটুকু সৎ হতে পারলাম না। আমাদেরকে শর্ত দিতে হলো কাউকে মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে এই এই শর্ত পূরণ করতে হবে। তার বয়স ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ১৩ বছর হতে হবে। কি নিদারুন লজ্জা। আমরা প্রত্যেকেই তো জানি আমরা মুক্তিযোদ্ধা কিনা। বিবেকের কাছে এই প্রশ্ন রেখে এই লেখা এখানেই শেষ করলাম।
Comments
Post a Comment