Skip to main content

Fabricare receipt 01 08 2024

বঙ্গবন্ধু ছয় দফার আগে ও পরে ওমর খালেদ রুমি

 


বঙ্গবন্ধু ছয় দফার আগে ও পরে

ওমর খালেদ রুমি

 

জাতির জনককে নিয়ে লিখতে গেলে পঞ্চান্ন বছরের একটা বর্ণাঢ্য জীবন চোখের সামনে নিমেষেই ভেসে ওঠে। তার রাজনীতিতে যোগদান, একটু একটু করে সামনে আগানো, গোপালগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখা, তারপর কোলকাতায় গমন, সেখানে সর্ব-ভারতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতির অমসৃণ পথে পথ চলা, সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে গান্ধীজির সংস্পর্শে আসা, দেশভাগ, ঢাকায় ফিরে আসা, আইন বিভাগে ভর্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলনে যোগদান, ছাত্রত্ব হারানো, ছাত্রলীগ গড়ে তোলা, আওয়ামী লীগে যোগদান, কারাবরণ, ভাষার জন্যে কারাগারে অনশন, মুক্তি, আবার কারাবরণ, আবার মুুক্তি, যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী, মন্ত্রীত্ব হারানো, আবার মন্ত্রী হওয়া, মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়া, রাজনীতিকে তৃণমূল মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া, আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন, পরাজয়, অবশেষে ছয় দফা।

 

ঠিক এখানটায় এসেই যেন ইতিহাস তার গতিপথ বদলে ফেললো। বদলানো ছাড়া আর কি কোন পথ ছিলো? ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট ইংরেজদের দয়া আর হিন্দুদের স্বার্থপরতার যুগপৎ ফসল যে পোকায় কাটা পাকিস্তান পাওয়া গেলো তার পশ্চিমে যেমন একটা ছোট্ট টুকরা পূর্বে তার চেয়েও ক্ষুদ্র আরও একটা টুকরা। মাঝখানে হাজার মাইলেরও অধিক ভৌগোলিক দূরত্ব। তাও না হয় মানলাম কারণ ভৌগোলিক দূরত্ব যানবাহনের মাধ্যমে ঘোঁচানো যায় কিন্তু মনের যে দূরত্ব তা আপনি কেমন করে ঘোঁচাবেন। একদিকে পাঞ্জাবী আভিজাত্য অন্যদিকে গাও-গেরামের মাছে-ভাতে বড় হওয়া অশিক্ষিত বাঙালি। এ দুয়ের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক তা  কি আর অতো সহজে যায়।

 

কিন্তু একজন মানুষ এর সব কিছুকেই উপেক্ষা করলেন। তিনি সত্য আর ন্যায়ের জন্যে বরাবরই আপোষহীন। তার জীবনের যে আলেখ্য তার প্রতিটি পরতে পরতে প্রতিবাদের ভাষায় মুখর মহাকাব্যের খন্ডাংশ। তিনি অতো কিছু বোঝেন না। ব্যবধান, বৈষম্য বোঝেন না। শুধু বোঝেন মানুষ আর মানবতা। মানুষের অধিকারের জন্যে তিনি তার জীবনকে তুচ্ছ করার জন্যে তৈরী। প্রস্তুত জীবন দেওয়ার জন্যে। বাংলার জল-হাওয়া-কাদায় বেড়ে ওঠা এই মানুষটি বরাবরই দাবীর ব্যাপারে অনমনীয়, একরেখা। তিনি এক দলের উপর অন্য দলের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করেন। বাঙালির নায্য হিস্যা তাই তার প্রথম ও প্রধান চাওয়া। বৈষম্যের যে ঘৃণ্য চর্চা পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই চলছিলো তিনি তার বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন।

 

দেশ যখন ভাগ হলো তখন তার বয়স ২৭ বছর। একজন টগবগে তরুণ। পড়েন কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। থাকেন বেকার হোস্টেলে। এই বেকার হোস্টেলই তখন কোলকাতায় মুসলমান মধ্যবিত্ত ছাত্রদের ঠিকানা। শেখ মুজিব তার জীবনের অনেক কিছুই শিখেছেন এই কোলকাতা থেকে। দেশভাগের পর তিনি যখন ঢাকায় ফিরলেন শুরু থেকেই সোচ্চার হলেন একজন প্রতিবাদী মানুষের ন্যায়। নিজেকে আরও যোগ্য করে তুলতে ভর্তি হলেন আইন বিষয়ে। কিন্তু স্বভাব যার অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তার পক্ষে চুপ থাকাটা কঠিন। তিনিও পারলেন না। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নায্য দাবীতে মাঠে নামলেন। প্রতিবাদের খেসারত দিতে হলো ছাত্রত্ব হারানোর মাধ্যমে। এর আগেই অবশ্য ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। এবার ছাত্রত্ব হারানোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ গঠিত হলে তারও সদস্য হলেন। পদ পেলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন আনুষ্ঠানিকভাবে।

 

তখন রাজনীতি করা অতোটা সহজ ছিলো না। শত বছরের পুরনো হিন্দু-মুসলমানের অবিশ্বাসের সংকট থেকেই জন্ম নিয়েছিলো পাকিস্তান। মুসলমানদের একটি পৃথক ভূ-খন্ড। চৌধুরী রহমত আলীর দেওয়া নাম আর মহান কবি যুগশ্রেষ্ঠ দার্শনিক স্বপ্নদ্রষ্টা ইকবালের স্বপ্নের বাস্তবায়নকারী এম এ জিন্নাহর হাতে গড়া এই জাতি-রাষ্ট্রটি শুধু একটি রাষ্ট্রই ছিলো না। ছিলো ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে সর্বশেষ আশ্রয়টুকু হারানো উপমহাদের অসহায় মুসলমান সমাজের একমাত্র আশ্রয়। এর বিরুদ্ধে তখন কোন ভূমিকা গ্রহণ মানেই মুসলমানদের বিরুদ্ধেই হাতিয়ার উঠানো। কিন্তু বাঙালী চিরকালই স্বাধীনচেতা। তাই মুক্তি তার রক্তে মাংসে মেশানো।

 

প্রথম ধাক্কাটা আসলো ভাষার প্রশ্নে। তৎকালীন সময়ের কুলীন মুসলমানদের সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসই হয়ে দাঁড়ালো প্রথম সংগঠন যারা উর্দ্দুর প্রতি দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলা ভাষাকে অবহেলার ব্যাপারে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করলো। পরিস্থিতি ঘোলাটে হলো যখন জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় এলেন আর নাজিমুদ্দিনকে সাথে নিয়ে ঘোষনা দিলেন, “উর্দ্দু একমাত্র উর্দ্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।আর অমনি আগুন জ্বলে উঠলো। বক্তৃতা চলাকালীন সময়েই প্রতিবাদ হলো নো, নো।

 

পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিলো পাকিস্তানের ঐক্যের জন্যে ভাষার ঐক্যটা বেশ জরুরী। কিন্তু এটা তারা ভুলে গেলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি এটা মানবে না কেন? তারা তাদের মায়ের ভাষা ছাড়বেই বা কেনো? মাঝখানে ভারতকে রেখে একটা একক বা ইউনিটারী পদ্ধতির পাকিস্তান রাষ্ট্র যে কখনও সম্ভব নয় তা তাদের শুরুতেই বোঝা উচিত ছিলো। তাই একটি শক্তিশালী ফেডারেল রাষ্ট্রের কাঠামো ছিলো যুৎসই। কিন্তু তারা সেসবের ধার ধারলো না। শঠতা, ধূর্ততা আর এগুয়েমির মাধ্যমে সম্পূর্ণ অগনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তারা শোষন ও বঞ্চনার মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে নিতে চাইলো।

 

কিন্তু এভাবে কি হয়? হয় না। ১৯৫২ তে ভাষার জন্যে তাই সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক সহ আরও অনেককে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হলো। সংবিধান প্রণীত হতে হতে লেগে গেলো আট বছর। তারও আগে নির্বাচনের নামে যুক্তফ্রন্টের সাথ যা করা হলো তা যে কতো বড় তামাশা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্র তিনমাসের মাথায় ভেঙ্গে দেওয়া হলো সরকার। তারপর আবার গভর্ণরের শাসন। তারপর আবারও যুক্তফ্রন্টই সরকার গঠন করলো। তবে তা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। সেই সরকারও বেশীদিন টিকলো না। শেখ মুজিবের কাছে মনে হলো এভাবে মন্ত্রীত্ব করার চাইতে সংগঠনকে মজবুত করার কাজে উঠে পড়ে লাগা অনেক ভালো।

 

যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে মানুষের জন্যে রাজনীতির কাজকে বেছে নিলেন। চষে বেড়ালেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। আর এভাবেই আওয়ামী লীগকে বাঙলার আপামর জনসাধারণের প্রাণের সংগঠনে পরিণত করলেন। ১৯৫৫ সালে সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তি বাঙালিকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছিলো। কিন্তু দিন দিন পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ আর নির্যাতন এতোটাই বেড়ে গেলো যে বাঙালির নাভিশ্বাস উঠে গেলো। পূর্ব  পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। সর্বক্ষেত্রে বাঙালিরা পিছিয়ে পড়তে লাগলো। স্কুল-কলেজের সংখ্যা যেখানে বাড়ার কথা উল্টো দিনে দিনে কমতে লাগলো। চাকুরী ক্ষেত্রে নির্লজ্জ বৈষম্যের শিকার হলো বাঙালিরা। উঁচু পদগুলোতে বলতে গেলে তাদের কোন জায়গাই হলো না। অফিস আদালতগুলোতে মূলত তারা হলে পাকিস্তানীদের গোলাম। মধ্যযুগীয় দাসপ্রথা যেন ভিন্ন আঙ্গিকে ফিরে এলো।

 

এমনিতেই ইংরেজদের ১৯০ বছরের শোষণে বাঙালির নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিলো। কারণ ইংরেজদের শুরুটা হয়েছিলো এই বাংলা থেকেই। ব্রিটিশ ইস্ট- ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলাকে চুষে খেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছিলো। নিয়তির এমন খেলা ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি যাও মিললো পাকিস্তানীরা তাদের চেয়েও জঘন্য আচরণ করতে শুরু করলো। অর্থনৈতিক অবস্থা ব্রিটিশদের সময়ের চাইতে আরও খারাপ হতে লাগলো। বাঙালির যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো। এরকম অবস্থায় একটি উৎকৃষ্ট ফেডারেল কাঠামোই পাকিস্তানের উভয় প্রান্তের জন্য সমীচিন ছিলো। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা যেহেতু ছিলো ড্রাইভিং সিটে  তাই তারা মানবে কেন? শোষনের মাধ্যমে তাদের নিজেদের ভাগ্য গড়ার যে অভূতপূর্ব সুযোগ তারা পেয়েছিলো তা তারা হাতছাড়া করতে চায়নি। কিন্তু তাদের এই হীন আচরণই ধীরে ধীরে পাকিস্তানের ভাঙ্গনের বীজ বপন করেছিলো।

 

শেখ মুজিব তবু চাইলেন মুসলমানরা একসাথে থাকুক। তাই বঞ্চনা এড়াতে তিনি একটি উৎকৃষ্ট ফেডারেল রাষ্ট্রের কাঠামো তুলে ধরলেন। যাতে উভয় পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে এটাকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র বৈ অন্য কিছু মনে হলো না। মুসলমানদের ঐক্যের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানীরা সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা বছরের পর বছর যেভাবে শোষিত হয়েছিলো তা তাদের বিবেককে কখনও প্রশ্নবিদ্ধ করেনি। উল্টো শেখ মুজিবকে তারা পাকিস্তানের শত্রুর তকমা এঁটে দিয়েছিলো। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো রাজনীতিবিদরাও পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জন্যে কোন পরিচ্ছন্ন সিদ্ধান্ত কখনও নিতে পারেননি। উল্টো ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মারা গেলে শেখ মুজিব একেবারেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ দায়ভার এসে পড়ে তার কাঁধে। কারণ ভাসানী তো সেই কবেই কাগমারি সম্মেলনেই পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম বলে বিদায় নিয়েছিলেন।

 

যা হোক দলের হাল ধরেছিলেন মুজিব। ১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী যখন তিনি ছয় দফা পেশ করেছিলেন তার মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ গ্রহণ করেছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি আর দেরী করেননি। বাঙালির প্রাণের দাবী ছয় দফা উপস্থাপন করে হৈ চৈ ফেলে দেন। তারপর রাজনীতির নদীতে অনেক জল গড়িয়েছিলো। সে আলোচনাও আমরা ধীরে ধীরে করবো। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় পশ্চিম পাকিস্তানের এতগুলো মাথা থাকতে তারা এটাই বুঝতে ব্যর্থ হলো যে পাকিস্তানকে বাঁচাতে একটি শক্তিশালী ফেডারেল রাষ্ট্রের বিকল্প নেই। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে কুখ্যাত অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করার আগ পর্যন্ত যদি একবারও তাদের বোধোদয় হতে যে শেখ মুজিবই পাকিস্তানের প্রকৃত বন্ধু এবং তার দেওয়া ফমুর্লা ছয় দফাই পাকিস্তানের বাঁচার মূল মন্ত্র তাহলে একটা শক্তিশালী পাকিস্তান যেমন গঠিত হতে পারতো তেমনি সবাই সবার নায্য পাওনাও বুঝে পেতে পারতো। ২৩ বছর বাঙালি যে ছাড় দিয়েছিলো, নিজেদেরকে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের জন্য যে প্রাসাদ তৈরী করেছিলো তার বিনিময়ে তারা পেয়েছিলো বুলেট আর বেয়নেট। কথায় কথায় জেল, জুলুম, মামলা, হামলা, হয়রানি। এই দীর্ঘ ২৩ বছরে আমাদের জাতীয় নেতাদের জেল খাটার চিত্র যদি তুলে ধরা হয় তাহলে তা এতোটাই করুণ আর হৃদয়বিদারক যে হৃদয়বান মানুষ মাত্রই ভীষণভাবে ব্যথিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাঙালি তবু চেয়েছিল তাদের মুসলিম ভ্রাতৃগণকে সাথে নিয়ে একত্রে পথ চলতে। কিন্তু শেষমেস তা আর হলো কই। ক্রমাগত বঞ্চনা। শেষমেস ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আর ধর্মীয় ঐক্যকেও তুচ্ছ করলো। ছয় দফার ভেতরে বাঙালি তাই আশার আলো দেখেছিলো। দেশ ভাগের আগে ভাগেই মুজিব যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা চিন্তা করেছিলেন তার জন্যেই আজীবন তাকে লড়তে হলো মূলত বাঙালির জন্যেই বেঁচে থাকার লড়াইটাই হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের লড়াই। আর তার এই বেঁচে থাকাটা পুরোপুরিভাবেই যেন নির্ভর করছিলো তার অর্থনৈতিক মুক্তির উপর।

 

সংকট শুরু থেকেই তীব্র ছিলো। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত যে সময়কাল তার বৃত্তান্ত শুধু দুঃখ-কষ্ট-নির্যাতনের গল্পগাঁথা। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবগতভাবেই ছিলেন একজন যৌক্তিক ও শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি কখনওই বিচ্ছিন্নতাবাদ বিশ্বাস করতেন না। ৫৫ বছরের জীবনে ১২ বছরেরও বেশী সময় জেলে কাটানো মানুষটা চাইলেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে অস্থির, উতালা করে তুলতে পারতেন। কিন্তু তিনি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আলোচনার টেবিলের সমাধান খুঁজেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যুগান্তকারী সাফল্য লাভের পরও তিনি কোনো প্রকার ঔদ্ধত্য প্রদর্শন না করে বরং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজেছেন। কিন্তু তার বিনিময়ে তিনি কি পেয়েছিলেন - মিথ্যাচার, প্রতারণা, জালিয়াতি, ধোকাবাজি সর্বোপরি বিশ্বাসঘাতকের খেতাব। জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কালে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আলোচনার নামে কালক্ষেপন করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদেরকে ধ্বংস করার জন্যে যে আয়োজন করেছিলো তা বিশ্ববাসীর নজর না এড়ালেও পরাশক্তিগুলোর কেউ কেউ নিশ্চুপ ছিলো। কায়েমী স্বার্থবাদী পৃথিবীতে অতীতেও বার বার মানবতার বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধ তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। স্বাধীনতার জন্যে তাদের দীর্ঘ ২০টি বছর একটি অসম লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিলো। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চলা এই লড়াইয়ে উভয় ভিয়েতনামের কতো মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে তার সঠিক সংখ্যা মেলানো ভার। এই দিক দিয়ে বাংলাদেশকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। মাত্র নয় মাসের যুুদ্ধে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে বুঝে পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি যেভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে মরণপণ এই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার।

 

যে প্রসঙ্গে ছিলাম। সমাধানের শেষ চেষ্টাটুকুও যখন শেষ হয়ে গিয়েছিলো বাঙালি তখনই বুঝতে পেরেছিলো হয়তো হিং¯্র হায়েনার দল যখন তখন তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। বাস্তবে হয়েছিলোও তাই। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রে পাক হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র বাঙালির উপর। রাতের অন্ধকারে পশু শিকারের চাইতেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিদের। তারা ভেবেছিলো এভাবে আতংক ছড়িয়ে বাঙালিকে দমন করা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ঘুমন্ত বাঙালি শত্রুর গুলির শব্দে ভীত না হয়ে বরং জেগে উঠেছিলো। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে জবাব দেওয়ার জন্যে তৈরী হয়েছিলো। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বন্ধুৃত্বের হাত বাড়ালো। প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের উপযোগী করে তৈরী করার কাজে হাত বাড়িয়েছিলো। শুধু তাই নয় ডিসেম্বরের দিনগুলোতে তাদের সর্বাত্মক আক্রমণের ফলেই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো ১৬ই ডিসেম্বরে স্বাধীনতার ফসল ঘরে তোলা। বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের এই ঋণ কোনদিন শোধ করার মতো নয়। মহামতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাঙালি ও বাংলাদেশ তাই চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

 

এই বইয়ে আমরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে দুটো প্রধান পর্বে বিভক্ত করার প্রয়াস পেয়েছি। একটি পর্ব বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষনার পূর্বের সময়কাল। অপর পর্বটি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষনার পরবর্তী সময়কাল। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে। মূলত ছয় দফাই এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের রাজনীতির গতিধারায় একটা সুস্পষ্ট পার্থক্যমূলক সীমারেখা টানতে সক্ষম হয়েছিলো। একটু সূক্ষ্মভাবে নজর দিলেই ৬ দফা পূববর্তী ও ৬ দফা পরবর্তী সময়কালীন রাজনীতির গতি প্রকৃতিতে যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

 

৬ দফার পূর্ববর্তী সময়ের রাজনৈতিক কার্যকলাপে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিদের টিকে থাকার লড়াই। অন্যায়ের প্রতিবাদ, বঞ্চনার প্রতিকার, জেল জুলুমের প্রতিবাদের পাশাপাশি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। কিন্তু ৬ দফার ঘোষনা বাঙালিকে তার স্বাধীকার তথা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে যায়। আর এ জন্যেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণার পর বাঙালির প্রতি সর্বোচ্চ রূঢ়তা প্রদর্শন করে যার নজীর অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। জাতির জনকের প্রতি জেল-জুলুম-অত্যাচার এতোটাই বেড়ে যায় যে তার জীবনটাই সংশয়ের মধ্যে পড়ে যায়। তাকে হত্যা করার জন্যেও সূক্ষ্ম সব ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। কিন্তু নিপীড়িত বাঙালির মাথার তাজ, জনগণের নয়নের মনি, বাঙালির বুকের ধন কোটি মায়ের সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আল্লাহ্র অশেষ কৃপায় সব ধরনের অত্যাচার নির্যাতনের মধ্যে দিয়েই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সোনালী সূর্য ছিনিয়ে নিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

 

আলোচ্য গ্রন্থে আমরা সূক্ষ্ম আলোচনার মাধ্যমে ৬ দফার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন গাঁথা পর্যালোচনার মাধ্যমে আমাদের শিরোণামকে স্বার্থকভাবে প্রমাণিত করার চেষ্টা করবো। পাশাপাশি এই প্রতিপাদ্য বিষয়টির যথাযথ উপস্থাপনের জন্যে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ধারাবাহিক উপস্থাপনাও থাকবে প্রাসঙ্গিকভাবে। ১৯৪০ সালে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সময়কাল থেকে ৬ দফা পর্যন্ত সময়কালে তার রাজনৈতিক জীবনের গতিধারা এবং ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পরবর্তী সময়কালে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে আমাদের স্বাধীনতাকে বুঝে পাওয়ার সময়কাল পর্যন্ত যে মহাকাব্যিক আখ্যানভাগ রচিত হয়েছিল তার জীবনে তার যথাযথ উপস্থাপনই স্পষ্ট করে দেবে এই উভয় সময়কালের মধ্যের গুণগত ও মৌলিক পার্থক্য। ৬ দফার ঘোষণা জাতির জনকের জীবনের পাশাপাশি বাঙালির দৈনন্দিন ও রাজনৈতিক জীবনধারাকে কিভাবে এবং কতোটা প্রভাবিত করেছিলো তার সমৃদ্ধ বর্ণনা থাকবে এই বইয়ে। পাশাপাশি স্বাভাবিক ভাবেই জাতির জনকের জীবনের অজ¯্র ঘটনাবলী, তার আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল জীবন এবং তার ও বাঙালির ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত অজ¯্র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তাদের ভূমিকা এবং সর্বোপরি স্বপ্নের তরীকে তীরে ভেড়ানোর যে ঐতিহাসিক গল্প গাঁথা তার সাবলীল বর্ণনা থাকবে। আশা করি দেশপ্রেমিক পাঠকদের কাছে ইতিহাসের এই ভিন্ন স্বাদের গ্রন্থটি আশানুরূপই উপজীব্য হবে। পাশাপাশি আগামী দিনে যারা এ নিয়ে ভাববে, লিখবে কিংবা আরও এক ধাপ এগিয়ে কিছুটা গভীরে গিয়ে গবেষণা করবে তাদের জন্যে এটি একটি আকর গ্রন্থ বলেই বিবেচিত হবে। সবাইকে ধন্যবাদ।

 

Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে

NAZRUL ISLAM MAZUMDER : THE CHOICE OF THE TIME (a biography)

NAZRUL ISLAM MAZUMDER The choice of the time “The purpose of a business is to create a customer who creates customers.” -          Shiv Shing # NASSA GROUP # 30,000 employees #EXIM Bank # 3,000 employees And so on……….. A Biography By OMAR KHALED RUMI M. Sc., MBA, LL.B     ...................................................... “Patience, persistence and perspiration make an unbeatable combination for success.”    - Napoleon Hill   ...................................................... Prlogue Like another man Nazrul Islam Mazunder is also a man. But, how he has made some stories of success. Why people consider him as a special. Why he is applaused as Philanthropic in mind, dynamic in thinking, far-sighted in vision. There must some reasons. The reason is what he wanted himself he has been now. Mazumder, a conglomerate icon, in no way, a trifle name. His success, over years, mak