শেখ মজিবুর রহমান - একটি নাম, একটি ইতিহাস।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার গন্তব্যে অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পাড়ি দিতে হয়েছিলো দীর্ঘ পথ। মূলতঃ কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায়ই অর্থাৎ ছাত্রাবস্থায় তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। অতঃপর দেশ ভাগের পর চলে এলেন পূর্ব বাংলায়। গঠন করলেন ছাত্রলীগ। আরও পরে আওয়ামী লীগ। ভাষার প্রশ্নে তখন মাঠ উত্তপ্ত। তিনিও জড়িয়ে পড়লেন। দেশ ভাগের পর অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার জন্যে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতির কারণে কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ে ছাত্রত্ব হারালেন। বায়ান্নতে যখন ভাষার জন্যে তুমুল সংগ্রাম চলছে তাকে বন্দী করে রাখা হলো কারাগারে। সেখানে বসেই ভাষা সংগ্রামীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্যে অনশন করলেন। বের হলেন ২১শে ফেব্রæয়ারীরও বেশ কয়েকদিন পর। ১৯৫৪তে এসে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে তার রাজনৈতিক ক্যারিশমায় মহান বিজয়ে রূপদান করলেন। আওয়ামী লীগকে তুলে আনলেন সবার উপরে। আওয়ামী লীগ একাই লাভ করেছিলো ১৪৩টি আসন। তার আগেই ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতাটা খুব একটা সুখকর ছিলো না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দের ভুলে সব মাটি হয়ে যায়। মাত্র ১৫ দিনের মাথায়ই এক অন্যায় আদেশ বলে জারি হয় গভর্ণরের শাসন। অবশ্য তাও যে স্থায়ী হয়েছিলো তা কিন্তু নয়। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় গভর্ণরের শাসন উঠে গেলে আবারও প্রধানমন্ত্রীর শাসন কায়েম হয়। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়েও টিকতে পারেননি হক সাহেব কিন্তু এবারও তার কৃষক-শ্রমিক পার্টিকেই সরকার বানাতে বলা হয়। যেহেতু কেন্দ্র তাকে “দেশদ্রোহী” অ্যাখ্যা দিয়েছিলো তাই তাকে না দিয়ে ক্ষমতা দেওয়া হয় তার প্রতিনিধি মিঃ আবু হোসেন সরকারকে। এখানে বলে রাখতে চাই যুক্তফ্রন্টের শরীকদলগুলোর মধ্যে এককভাবে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যাই বেশী ছিলো (১৪৩)। কিন্তু নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী হক সাহেবেরই নেতা হওয়ার কথা থাকায় তার দল কৃষক-শ্রমিক পার্টির আসন সংখ্যা (৪৮) কম হওয়া সত্তে¡ও তাকেই প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়েছিলো।
আবু হোসেন সরকারও বেশী দিন চালাতে পারেননি। টেনেটুনে বছর খানেক চলেছিলো। তারপরই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে। আতাউর রহমান খনের সরকারও সংসদে আস্থা ভোট হেরে যায়। কারণ কৃষক-শ্রমিক পার্টির সাথে তাদের যে এ্যারেঞ্জমেন্ট হওয়ার কথা ছিলো তা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়। আর আওয়ামী লীগের আর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ন্যাপ ছিল দোটানার মধ্যে। এমতাবস্থায় যে অচলাবস্থা দেখা দেয় তার নিরসনের জন্যে কেন্দ্র উপয়ান্তর না দেখে আবারও আতাউর রহমান খানকে প্রধানমন্ত্রী হতে বলে। এ যাত্রা রাজনীতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। সংসদ অধিবেশন চলাকালে বিবোধীদের আক্রমণে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পরের দিন মারা গেলে পরিস্থিতির সুযোগ নেয় কেন্দ্র। গভর্ণর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারী করেন। আইয়ুব খান হন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এসময় কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ফিরোজ খান নুন। যিনি ১৯৫৯ সালে সাধারণ নির্বাচন হবে এই মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই ১৯৫৮ সালে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। মাত্র ২০ দিনের মাথায় আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে অপসারণ করে নিজে পাকিস্তানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে পাকিস্তান প্রবেশ করে সামরিক ব্যবস্থায়। অজুহাত হিসেবে বলা হয় যেহেতু সামনে নির্বাচন অথচ সংসদে ডেপুটি স্পিকারকে মেরে ফেলা হয়েছে এমতাবস্থায় রাজনীতিবিদদের অধীনে নির্বাচন হলে গন্ডগোল ও প্রাণহানি হবে।
আইয়ুব খান কঠোর হস্তে রাজনীতিবিদদের দমন করেন। ১৯৬২ সালের গণ আন্দোলনের আগ পর্যন্ত কেউ টু-শব্দটি করতে পারলো না। অধিকাংশ নেতাই জেলে পড়ে রইল। যারা বাইরে ছিলো তাদেরও নানা অজুহাতে রাজনীতির অযোগ্য ঘোষণা করা হলো। অবশেষে ’৬২র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪র গণ আন্দোলন, ’৬৬তে এসে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে ’৬৯ এর গণঅভুত্থান আইয়ুব খানের অবস্থানকে নড়বড়ে করে দেয়। অবশ্য ততদিনে স্বৈরশাসক তার তথাকথিত উন্নয়নের দশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান পালন করে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে গেলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেকসুর খালাস পাওয়ায় জাতিও শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু খেতাব দেয়।
এই যে দীর্ঘ পথ চলা এর মধ্যে কত যে চড়াই-উৎরাই এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অধীনে রাজনীতি করা যে কতোটা কঠিন ছিলো তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কিংবদন্তী নেতারা। গতানুগিতক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি বাঙালি জাতিকে তার আসল লক্ষ্য মুক্তি বা স্বাধীনতা এনে দেওয়ার কাজটাই ছিলো সবচেয়ে দুরূহ ব্যাপার।
আর এটা সবচেয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি সমসময়ই চেয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে এমন একটা রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে যার হাত ধরে স্বাধীনতা আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত হয়েছিলোও তাই। কারণ তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে আজীবন রাজনীতি করে গেলে এমনকি মন্ত্রী হয়ে দেশের কিছু খেদমত করতে পারলেও তাতে বাঙালির সত্যিকারের মুক্তি মিলবে না। আর এজন্যেই তার দূরদর্শী ভাবনায় ছিলো বাঙালি জাতির মুক্তির ভাবনা।
দলকে শক্তিশালী করতে গিয়ে মাঝে মাঝে যে একটু আধটু ঝামেলা হয়নি তাও নয়। যেমন আতাউর রহমান খানের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে একদিকে আতাউর রহমান খান চাইতেন প্রশাসনিক শৃঙ্খলা কিন্তু আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী শেখ মুজিবুর রহমান চাইতেন সরকারের উপর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রাধান্য যাতে দল তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করে জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারে। যারা আমলাতন্ত্রের সাথে জড়িত তাদের এরকম কোন ভাবনা থাকে না। কারণ আর কিছু নয়। তারা তো আর মাঠে গিয়ে জনগণের কাছে উন্নয়নের ওয়াদা করে ভোট চেয়ে জনপ্রতিনিধি হয়নি।
শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আলোচনার কমতি নেই। যেটুকু সমালোচনা তার প্রতিপক্ষরাও করেছে তাও করেছে অত্যন্ত সমীহের সাথে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে সেদিন মুজিব যেটা চেয়েছিলো বা করেছিলো তা ভুল না সঠিক তা পরবর্তীকালে ইতিাহাসেই প্রমানিত হবে। হয়েছেও তাই। সমস্ত প্রশ্নের উর্ধ্বে উঠে তিনিই প্রমাণ করেছেন সেদিন বিভিন্ন সমালোচনা হলেও বা তাকে ভুল বুঝলেও তিনি ভুল ছিলেন না। ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে আছে। এ ব্যাপারে একটা কথা বলতে চাই। ধন্যবাদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে। তিনি হীরা চিনতে ভুল করেননি। তার প্রশ্রয়েই মূলত শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদাতা। বাঙালির জাতির জনক। আর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার গল্প অনেক দীর্ঘ আর বিচিত্র। ১৯৪৭-এর দেশভাগকে যদি আমরা তার রাজনৈতিক জীবনের সত্যিকারের শুরু ধরি তাহলে বলবো ১৯৬৯ সালে এসে অর্থাৎ দীর্ঘ ২২ বছরের সংগ্রামী জীবনের মাথায় এসে তিনি নিজেকে বাঙালির মাথার তাজে পরিণত করতে পেরেছিলেন। এই সময়কালের মধ্যে তিনি প্রায় একযুগ সময়ই জেলখানায় কাটিয়েছেন। ব্যাপারটা এতোটা সহজ ছিল না। যতোটা সহজে কলমের এক খোচায় এখনই তা লিখে ফেলা যায়। মনে রাখতে হবে কারাগারের অন্তহীন কষ্ট। হতাশা আর অনিশ্চয়তার জীবনে একজন অমিত সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদ শামসুল হক শেষ পর্যন্ত উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।
Comments
Post a Comment