গ্রামের
এই স্কুলটিতে আমার হঠাৎ করেই
আসা। কেন যে আসা আমি নিজেই তা
জানি। আর জানাটাও সহজ। শহরে
আমি নাকি বখে গিয়েছিলাম। ক্লাস
সেভেনের ছাত্ররাও যে বখে যেতে
পারে সেটা আমাকে না দেখলে বোঝা
যাবে না। ভালো স্কুলের ব্রিলিয়ান্ট
ছাত্র। কিন্তু পড়াশুনায় একদম
মন নেই। হাতে সিগারেট। সাথে
বন্ধু-বান্ধব
পার্কে গিয়ে মেয়েদের সাথে
ইয়ার্কি ফাজলামো। বিকালটা
খেলার মাঠে। রাতটা টিভি রুমে।
বাসায় ফিরে আশে-পাশের
মেয়েদের দিকে নজর। ইদানীং
মহিলারাও দৃষ্টি কাড়ছে। সবকিছু
মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটাই লেজে
গোবরে। যাহোক অবশেষে পরিস্থিতি
থেকে পরিত্রাণের সিদ্ধান্ত।
আমার পর,
অভিভাবকদের।
উপায় একটাই জায়গা বদল। সোজা
গ্রাম। যাকে বলে অজো পাড়াগা।
যেখানে এসবের কিছুটি নেই। এ
যাত্রায় ভালো না হয়ে আর কোন
উপায় দেখছি না।
আমার
হাইস্কুলে আমি ভর্তি হলাম
ক্লাস এইটে। গ্রামের স্কুল।
প্রকৃতির নিবিড় কোলে এর অবস্থান।
কবির ভাষায় ছায়া সুনিবিড়,
শান্তির
নীড়। শহর থেকে হঠাৎ করে গ্রামে
এসেছি। তবু কেন জানি মন্দ
লাগছে না। হয়তো নতুনত্বের
স্বাদ। সবচেয়ে বড় কথা আমার
ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য। যে কোন
পরিবেশে আমি খুব দ্রুত মানিয়ে
নিতে পারি। এখানে এসেও ব্যাপারটা
ঠিক তেমনই। দেখতে দেখতে মানিয়ে
গেল।
ক্লাসে
বেশ কিছু ছেলে মেয়ে ছিলো।
তাদের মধ্যে কেবল মাত্র একজনই
আমার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হলো।
তার নাম বিকাশ। সে দেখতেও
যেমন,
তার
ব্যক্তিত্বও তেমনি নজর কাড়া।
পোশাক আশাকেও ক্রেতাদুরস্ত।
গ্রামের ভিতর এমন ছেলে সাধারণত
চোখে পড়ে না। আর যাহোক তাকে
আর দশটি ছেলে মেয়ের সাথে অতো
সহজে মেলানো যায় না। সবার মাঝে
থেকেও সে আলাদা। সবার চোখেও
সে আলাদা। কেউ তাকে মানে। কেউ
কেউ মানতে চায় না। উভয়ের কাছেই
সে গুরুত্বপূর্ণ হতেই হবে।
বিকাশ বলে কথা।
শহর
থেকে আসা ভালো একটা স্কুলের
ভালো ছাত্র হওয়া সত্বেও বিকাশ
যে আমাকে খুব একটা পাত্তা দিলো
তা কিন্তু নয়। বরং অন্যরা
যেখানে হুমাড়ি খেয়ে পড়ল,
সেখানে
সে তার জায়গায় খানিকটা অনড়ই
রইল। অবশ্য স্বাভাবিক কথাবার্তা
বা আলাপচারিতা যে হলো না তা
নয় কিন্তু। একেই বলে ব্যক্তিত্ব।
আমার বিকাশকে পছন্দ হলো।
বিকাশের
মধ্যে অনেক কিছুই ছিল। তবে
তার সাহসের কথা জেনে অবাক
হলাম। হঠাৎ খবর এলো বিকাশ একা
কাবাডি খেলবে সাত জনের সাথে।
সে বাজী ধরে বসেছে। বাজী ধরা
বড় কথা নয়। তার বিশ্বাস সে
জিতবে। আমি ভীষণ অবাক হলাম।
একা সাত জনের বিরুদ্ধে। বিকাশের
কি মাথা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু
না। তার দৃঢ়তা দেখে বুঝলাম।
এটা সম্ভব। সে পারবে।
নির্দিষ্ট
দিনে নির্দিষ্ট সময়ে খেলা
শুরু হলো। বিকাশকে ভীষণ উৎফুল্ল
লাগছিলো। সে একাই খেলে চলল।
আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম।
বিকাশ জিতল। জীবন ও যৌবনের
উভয় বাজী। আমরা সেই আনন্দে
খেলাম। অনেক মজা হলো। প্রিয়
পাঠক,
বিকাশ
আসলে সামান্য একটুর জন্যে
হেরে গিয়েছিল। তবুও সে যা
করেছিলো তা ছিল রাতারাতি
বিস্ময়কর। আমরা সবাই তাকেই
জয়ী ঘোষনা করলাম। যারা তার
বিরোদ্ধে খেলছিলো তারাও তাকে
জয়ী ঘোষণা করেছিল। একা যে ছয়
জনকে আউট করে দিয়েছিলো। মাত্র
একজন ছিলো। কিন্তু ভুল বশত
একটা মুভমেন্টের সময় পা পিছলে
পড়ে যাওয়ায় প্রতিপক্ষের
খেলোয়ারটি তাকে সহজেই ধরে
ফেলে। বিকাশ তবু প্রায় দাগ
ছুঁতে পেরেছিলো। কেউ কেউ বলল
সে দম ফেলেছিল। কেউ কেউ বলল
না। অমীমাংসিত খেলায় বিকাশকেই
আমরা জয়ী করেছিলাম। কারণ জয়
তার প্রাপ্য ছিল। জীবনে সব
বিকাশদের জয় হোক,
এই
কামনাই করি। আর মনে মনে বলি,
এক
জীবনে আমরা সবাই যেন এক একটা
বিকাশ হতে পারি। এই গল্প তাই
বিকাশের জন্যেই নিবেদিত।
Comments
Post a Comment