চৌধুরী
সাহেব অবশেষে মরেই বাঁচলেন।
কারণ তার জীবনের শেষের দিনগুলো
খুব একটা সুখের ছিল না। শরীরে
এখনো ভরা যৌবন নিয়ে তার শেষ
বয়সে সংগ্রহ করা শেষ স্ত্রী-টি
বেশিরভাগ সময় সামাজিক কর্মকাণ্ডের
নামে বেহায়াপনা আর ঘোরাঘুরি
আর কেনাকাটা নিয়েই ব্যস্ত।
তার চেয়েও কষ্টের কথাগুলো
হলো তার সন্তানদের বদলে যাওয়া।
নাতী-নাতনীগুলো
এক একটা বদের হাড্ডি। কেউ লং
ড্রাইভে যাচ্ছে তো কেউ কেউ
আবার ঘরের মধ্যে বন্ধু-বান্ধব
এনে রাতভর মাতামাতি করছে।
ছেয়ে মেয়েগুলো আগে ভাগেই
উচ্ছনে গিয়েছিল। তাদের কারো
কারো বিদেশী কুকুরের পিছনে
ব্যয় করার জন্যে ঘণ্টার পর
ঘণ্ট সময় হয় কিন্তু চৌধুরী
সাহেবের শয্যাপাশে এসে বসার
মতো একটু ফুরসৎ হয় না। তিনি
রাতারাতি বিরক্ত ছিলেন। আর
উইল টাও তিনি উকিল এনে মনের
মতো করে করিয়েছেন। তার মৃত্যুর
পর সমস্ত বিষয় সম্পত্তির মালিক
হবেন তারই প্রয়াত গৃহভৃত্য
করিম বখশের ছেলে রহিম বখশ।
এই রহিম বখশই তাকে দেখাশুনা
করেন। অবশ্য রহিম বখশ ইচ্ছে
করলেও সবকিছু সবার মধ্যে
ভাগবাটোয়ারা করে দিতে পারেন।
সেটা একান্ত তার ইচ্ছার ব্যাপার।
তবে কোন কারণে রহিম বখশের
অপমৃত্যু হলে এবং সেই ঘটনায়
পরিবারের কেউ জড়িত এটা প্রমাণিত
হলে তারা চিরদিনের জন্য সবকিছু
থেকে বঞ্চিত হবে। সে ক্ষেত্রে
সব সম্পত্তি চলে যাবে এতিমখানায়।
এটা তাদের জন্য শাস্তি। অবশ্য
রহিম বখশের স্বাভাবিক মৃত্যু
হলে কোন সমস্যা নেই। তারাই
সবকিছু লাভ করবে। তবে রহিম
বখশ যেন তাদের সাথে বেঈমানী
না করতে পারে সেক্ষেত্রে দশ
বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয়
সম্পত্তি আবার তার উত্তরাধিকারীদের
নিকট ফিরে আসবে। বেশ জটিল উইল।
তবে এতো কিছুর দরকার বোধ হয়
ছিল না। রহিম বখশ ভালো মানুষ।
তার বাবা করিম বখশ চৌধুরী
সাহেবের জীবন বাঁচাতেই জীবন
দিয়েছিল। রহিম বখশও সেইরকমই
একজন মানুষ। বাপ কা বেটা।
চৌধুরী
সাহেবের মৃত্যুর পর দাফন কাফন
যথা নিয়মেই হলো। অতঃপর সবার
অপেক্ষা উইলের বিষয় বস্তু
শোনার জন্যে। কিন্তু কেউ সে
কথা বলতে পারছিল না। এই নিরবতা
ভাঙলেন ভাঙ্গা চোয়ালের অধিকারী
পাথরের মতো কঠিন মুখের এক ভীষণ
নিরস উকিল সাহেব। আইন ব্যবসায়
নাকি তার বেশ নাম ডাক। তিনি
এসে সবাইকে কাঠখোট্টা ভাষায়
জানালেন যে উনি সবাইকে চৌধুরী
সাহেবের উইলের বিষয় বস্তু
পড়ে শুনাতে চান। সবাই ভীষণ
উৎসুক হয়ে জন্মের পর থেকে
অদ্যবধি প্রায় একবারও না হাসা
এই মানুষটার কুতকুতে চোখের
দিকে তাকালেন। উকিল সাহেব
চোখদুটো সামান্য নামিয়ে উইলের
বিষয়বস্তু পড়া শুরু করলেন।
তার মুখ দেখে মনে হলো তিনি
অত্যন্ত যতœসহকারে
প্রতিদিন দাড়ি গোফ কাটেন।
নতুবা এই জিনিসটা তার একদম
উঠেইনি। উকিল সাহেবের পড়া
শেষ হলে সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি
করতে লাগলো। সবচেয়ে বিব্রতকর
অবস্থায় পরল রহিম বখশ। তার
অবস্থা দুর্ঘটনা কবলিত
ভাঙ্গাচোরা বাসের চাইতেও
সামান্য একটু খারাপই বলা চলে।
রাতারাতি মালিকদেরও মালিক।
সে এতোটা আশা করেনি। স্বর্গ
থেকে তার বাপ তাকে অদৃশ্য
স্বরে বলল,
দোয়া
করি বাপ,
তুমি
তোমার দায়িত্ব পালনে সক্ষম
হও। তোমার বাপ তার মালিকের
জীবন রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন।
চৌধুরী সাহেব তোমাকে তার সমস্ত
উত্তরাধিকারীর উপর সম্মান
দিয়েছেন। তুমি যেন তার মর্যাদা
রাখতে পার। রহিম বখশ শক্ত হয়ে
বসলেন। তাকে এই গুরু দায়িত্ব
পালন করতে পারতেই হবে। চৌধুরী
সাহেব অবশ্য কৌশলে সবকিছু
শিখিয়ে রেখে গেছেন। খুব একটা
অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ছেলেমেয়েরা
সাইজে না আসা পর্যন্ত একটু
একটু করে শিক্ষা দিতে হবে।
এটা চৌধুরী সাহেবের নির্দেশ।
তবে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এতো
বড় মোক্ষম অস্ত্র তিনি দিয়ে
যাবেন তা রহিম বখশও কখনো আন্দাজ
করতে পারেনি। পারবে কি করে।
শত হলেও সে এই বাড়ির কাজের
লোকের ছেলে।
সবাই
উঠে চলে গেল। শুধু পড়ে রইল
রহিম বখশ একা। উকিল সাহেব এখনো
বসে। শুধু বললেন,
মনোযোগ
দিয়ে দায়িত্ব পালন করো। চৌধুরী
সাহেব স্বর্গে বসে দেখছেন।
রহিম বখশ ফস করে বলে বসলো,
আপনি
কেমন করে নিশ্চিত হলেন উনি
স্বর্গে গেছেন। ঝানু উকিল
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল এই
প্রশ্নে। কোন উত্তর দিতে পারলো
না। রহিম বখশ বলল,
উনি
খারাপ না। আমিও আশাবাদী উনি
জান্নাতবাসি হয়েছেন। বড় ভালো
মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাকে
বেহেস্ত নসিব করুন। আর আপনি
তো বুড়ো হয়েছেন। এবার দাড়িটা
রাখুন। আর হিন্দুদের মতো
স্বর্গ বলবেন না। ইসলামে এই
জিনিসটার চমৎকার একটা নাম
আছে। জান্নাত। উচ্চারণ করলেই
কেমন একটা শীতল বাতাস বয়ে যায়।
- ধন্যবাদ
আপনাকে। আমাকে জ্ঞান দেওয়ার
জন্যে।
-
আপনাকেও
ধন্যবাদ। আমার মতো একটা
অপদার্থের কথা ধৈর্য ধরে শোনার
জন্যে। এবার তাহলে আসি।
সেই
রাতে রহিম বখশের ঘরে প্রথম
যে মানুষটি কড়া নাড়ল সে আর কেউ
নয়। চৌধুরী সাহেবের শেষ বয়সে
সেবা যতেœর
জন্য সংগ্রহ করা প্রায় তরুনী
স্ত্রীটি। সে খুব ভালো করেই
বুঝে গেছে আগামী দশ বছর এই
বিশাল সম্রাজ্যের চাবিকাঠি
এই দাস মানুষটির কাছেই থাকবে।
অবএব তার সাথে লাগতে না গিয়ে
বরং লাগাতে পারলেই মঙ্গল।
তিনি তাই মধ্যরাত পর্যন্ত
নির্ঘুম কাটিয়ে অতঃপর রহিম
বখশের রুমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
নিয়ে নিলেন। দুরু দুরু বুকে
সরু সরু পায়ে নিঃশব্দে এসে
দাঁড়ালেন রহিম বখশের রুমের
সামনে। ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটল।
রুমের দরজায় আস্তে টোকা দিলেন।
রহিম বখশ জেগেই ছিলো। অবশ্য
অন্য কারণে। তিনি নফল নামাজ
পড়ছিলেন। দরজা খুলতেই দেখলেন
প্রাক্তন মালকিন দাঁড়িয়ে।
অবশ্য এখন তিনিই মালিক। উইল
তো তাই বলছে।
তার
মালিকিন মিসেস ফারিয়া রুমের
ভিতর ঢুকে পড়লেন। তারপর তার
বিছানায় বসে রহিম বখশকে কাছে
ডাকলেন। রহিম বখশ বলল,
এতো
রাত্রে আপনি আমার ঘরে। কেউ
টের পেলে মান ইজ্জত কিছু থাকবে
না।
মালকিন
বললো,
সবাই
ঘুমাচ্ছে। কেউ টের পাবে না।
-
কেউ
ঘুমাচ্ছে না। সবাই জেগে আছে।
টেনশন খুব খারাপ জিনিস। আপনি
ঘুমাতে পেরেছেন?
সে
বললো,
না
পারিনি। পারিনি বলেই তো চলে
এলাম। তোমার সাথে একটা চুক্তি
করতে চাই ।
-
কি
চুক্তি?
রহিম
বখশ আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা
করলো। এতো রাতে কি চুক্তি?
মালকিনের
জবাব,
চৌধুরী
সাহেব বুড়ো মানুষ ছিলেন। ওকে
তো অবহেলা করেছি তোমাকে তা
করবো না। জীবন যৌবন সব দেব।
সেবা যতœ
করবো।
বাধ্যগত হয়ে থাকবো। আমাকে
বঞ্চিত করো না।
রহিম
বখশ অত্যন্ত কাঠখোট্টা গলায়
বললো,
নোংরা
জিনিস আমি খাই না। তবে ভয় নেই।
কেউ বঞ্চিত হবে না। আমি কোন
বে-ইনসাফী
করবো না। এটা আমার নীতিতে নাই।
আপনি আসতে পারেন।
-
তোমার
ঘরে একটু থাকি। মালকিনের কণ্ঠে
একটু আগ্রহ।
-
আমি
নফল আদায় করছি। রহিম বখশের
সোজা জবাব।
-
আমাকে
শেখাবে?
মালকিন
জানতে চায়।
-
দিনের
বেলায়। রহিম বখশ সময় নির্ধারণ
করে দেয়।
মিসেস
ফারিয়া চলে গেলে রহিম বখশ
আবারও নামাজের বিছানায় বসে।
তার বাবাও রাত জেগে নফল নামাজ
আদায় করতো। করিম বখশের মৃত্যুর
মধ্যে কিছুটা হলেও মাহাতœ্য
আছে। তাই সে ঘটনা না বললেই নয়।
সেটা ছিলো আসলে এক রাতের ঘটনা।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল তখন।
হঠাৎ এক রাতে মিলিটারী এলো।
চৌধুরী সাহেব দেশপ্রেমিক
ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের
গোপনে গোপনে সাহায্য করতেন।
মিলিটারীরা জানতে পেরে তার
খোঁজে আসে তাকে মার্ডার করতে।
করিম বখশ সাথেই ছিলো। নিশ্চিত
মৃত্যু জেনেও করিম বখশ প্রথম
জবাব দেয়,
ম্যায়
হু চৌধুরী ।
-
কেয়া
বাত হ্যায়।
মিলিটারীরা
কোন প্রকার বাতচিত করার প্রয়োজন
মনে করেনি। তারা সোজা অস্ত্রের
ভাষায় কথা বলেছিল। করিম বখশ
পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন।
রহিম বখশ তখন পাঁচ বছরের শিশু।
মিলিটারীদের সন্দেহ করার কোন
কারণ ছিল না। কারণ কাজের লোক
হলেও চৌধুরী সাহেব তার আর করিম
বখশের পোশাকে খুব একটা পার্থক্য
করতেন না। বন্ধুর মতোই মিশতেন।
করিম বখশ সেই বন্ধুর প্রতিদান
দিয়েছিলেন জীবন দিয়ে।
এই
গল্পকে টেনে টেনে অনেক লম্বা
করা যাবে। কিন্তু সে রকম কোন
ইচ্ছেই আমার নাই। আমি শুধু
চৌধুরী সাহেবের মৃত্যু পরবর্তী
ঘটনা এবং উইলের মধ্যেই গল্পটা
সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। যাহোক
পরদিন পরিবারের সদস্যরা যখন
প্রাতঃভ্রমনে বেড়োলো তখন
তারা কেউই বুঝে উঠতে পারলো
না আসলে কিভাবে কথাটা শুরু
করবে। একই কারণে তাদের বিকেলটাও
ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে কেটেছিল।
রাতে অবশ্য তারা বিষয়টা নিয়ে
ভাববার জন্য আরও নিরবিচ্ছিন্ন
অবকাশ পেলো। কিন্তু ভেবে কি
লাভ। উইলে যা লেখা তাতো বদলানো
যাবে না। আর রহিম বখশকে মেরে
ফেললে সব দিক দিয়েই বিপদ। বরং
তাকে দেখে শুনেই রাখতে হবে।
কেউ যাতে গাঁধার মতো রাগের
মাথায় এই কাজটা করে না বসে।
Comments
Post a Comment