কোন চেতনা বা বাস্তবতাই ততক্ষণ পর্যন্ত পুরোপুরি সার্থকতা লাভ করে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের অনুভূতিতে পরিনত হয়। কি উন্নয়ন, কি রাজনীতি , কি সামাজিক পরিবর্তনের অঙ্গীকার সব কিছুই ভাসা ভাসা থেকে যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা মুখে যা বলব তা অন্তরে বিশ্বাস করব। জীবনের সর্বত্রও এর ছাপ মেলে । সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীন হলাম অথচ আজ এত বছর পরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আমরা মানসিক ভাবে কতটা তৈরী ছিলাম। এই প্রশ্ন আজ আসত না যদি সে দিনের বাস্তবতায় এই অপ্রিয় সত্যগুলোকে ঝালাই করে নেওয়া হতো।
আমরা ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এমন একজন মহান নেতাকে পেলাম যার উপস্থিতিই বাংলাদেশের জন্যে বিরাট পাওয়া। শেখ মুজিবের তো আমাদের হাতে ধরে কিছু করে দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। তিনি ছিলেন এটাই যথেষ্ট ছিলো। আমরা বাকীটুকু করে নিতে পারলাম না।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে এসে আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে চরম এবং জঘন্যতম কাজটাই করে বসলাম। পিতার রক্তে হস্তপদ রক্তাক্ত করলাম। এটা করেই ক্ষান্ত হলাম না। বিশ্ববাসীকে সেটা সদর্পে জানালামও। অবাক পৃথিবী আরও অবাক হয়ে একটা জাতীর জাতীয় নির্বুদ্ধিতাকে দেখল। ধৃষ্টতাকে অবলোকন করলো। বিশ্ববাসী আমাদের সম্বন্ধে যা ধারণা করার করে নিলো। কলংক লেপন করা মুহূর্তের সিদ্ধান্ত। কলংক মোচনে কখনও কখনও শতাব্দীও যথেষ্ট নয়।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখি আমরা বিস্তর করছি। অতীতে ও বর্তমানে। ভবিষৎতেও হবে। কারণ শেখ মুজিব প্রাসংঙ্গিক। বাংলার রাজনীতিতে কেবল মাত্র ঐ মানুষটাই তার বিশ্বাস এবং বাস্তবতায় এক বিন্দুতে এসে পৌঁছুতে পেরেছিলেন। আর সে জন্যই তিনি রাজনীতির সেনাপতি।
কাউকে মূল্যায়ন করতে হলে তার মতো ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। আমরা কেউই সেই পরিমাপের ব্যক্তিত্ব নই। তবুও আমরা চেষ্টা করি আমাদের মেধায়, মননে, মগজে তাকে ধারণ করার।
বিগত দিনগুলোতে যে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে তার সাথে বর্তমান বাস্তবতার একটা সূক্ষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এটা ভালো লক্ষন। আগে চিন্তা চেতনাগুলো আসতো পেশাদার লেখক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে। এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে কিছু লোক লিখে কাগজের পাতা ভরবে আর বাকীদের কাজ সেগুলো পড়া। এভাবে কোন পরিবর্তন কি আসলেই সম্ভব।
কিন্তু বিগত কয়েক বছরে যে প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে তা হলো এই জাতীয় চিন্তার ¯্রােতধারায় সাধারণ মানুষের অনুভূতি মিশে যাওয়া। গত কয়েক বছরে আমরা এমন লেখালেখি বা অনুভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করেছি যা সমাজের এমন সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে যারা রাজনীতির মূলধারার মানুষ নয়। তবুও তারা এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আবেগ অনুভূতির ছাপ রেখেছেন। এর ফলও ভালো হয়েছে। সরকার তার পজিটিভ ইচ্ছেগুলো বাস্তবায়নে সবসময়ে তার চারপাশে একটা উর্বর ক্ষেত্র অনুভব করেছে। এটাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
এ বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্যে আমাদের একটু কষ্ট করে অতীতে ফিরে যেতে হচ্ছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়টাতে আমাদের দেশপ্রেমের অনুভূতি, চেতনা সবচেয়ে তীব্র এবং আবেগপ্রবণ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমাদের বালখিল্য সুলভ আচরনের কারণে অপশক্তি আমাদের পেয়ে বসল । স্বাধীনতার মতো একটা মহান বিষয়কে আমরা অনেকেই ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে নিয়ে নিলাম। সম্ভবত এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো তারপর রাজনীতির নামে যা কিছু হলো সেটাকে পুতুল খেলা ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। যারা এই খেলা খেলল মূলতঃ তাদের যে কোন সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন ছিলো না সেটা পরবর্তীতে তাদের রাজনীতিহীন আচরনের মধ্যেই স্পষ্ট। কেবল মাত্র উত্তম কিছুই পারে সৃষ্ট শূন্যতাকে পূরণ করতে। কিন্তু তাদের কাছে তেমন কিছু ছিল না।
জিয়াউর রহমান ঠেলে ঠুলে নিয়ে গেলেন সেই ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। যেন প্রতিনিয়ত মৃত পিতার লাশ বুকে নিয়ে বয়ে বেড়ানো। জাতির জন্য এর চেয়ে তীব্র বেদনার কিছুই হতে পারে না।
অতঃপর তার সেই পাপের বোঝা কাঁধ থেকে নামল তারই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আর একজন সামরিক শাসক সেটাকে কাঁধে তুলে নিলেন। তিনিও নানা কায়দায় পুরো দেশটাকে টেনে টুনে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নিয়ে এলেন। অবাক কা-। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র দেখতে দেখতে প্রায় পনের বছর সামরিক শাসকদের দ্বারাই পরিচালিত হলো।
১৯৯০ সালে দেশ গণতান্ত্রিক ভাবধারায় ফিরতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সে পথেও আমাদের জন্য বাস্তবতার বিরাট দায় রয়ে গেল । আমরা কিন্তু মূলধারায় ফিরতে পারলাম না। প্রশ্নটা এখানেই। আমাদের সমস্যাটা কোথায় ছিলো। মূলধারার প্রতি এই যে বিমুখতা এটা কি প্রমাণ করে না যে আমাদের অতীতের অর্জনের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত ছিলাম না। সত্যিকার অর্থে আন্তরিক ও বিশ্বস্ত হতে পারিনি। অনেকেই ওই সূক্ষ্ম দর্শনের যাত্রাপথে ধর্মীয় অনুভূতি দিয়ে রাজনীতির সুষ্ট আলোচনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন। তাতে লাভের লাভ কি কিছু হয়েছে। এরশাদ ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক সর্ম্পক।
এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যে কাজটা অন্ততঃ করতে সক্ষম হয়েছে তা হলো জনগনের বিশ্বাস এবং আবেগের সাথে সময় সুযোগমত পর্যাপ্ত গরল মিশিয়েছে। তাদের আখের হাসিল করেছে। এক এক সময় এক একটা চক্র আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হয়েছে। আমাদের স্থূল চাওয়াগুলোর কাছে এদের সূক্ষ্ম কারচুপিগুলো কখনও ধরা পড়েনি। একটি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক আন্তরিক সরকার পাওয়ার জন্য আমাদের ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
আমি মনে করি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে আবেগঘন সময়টা পেয়েছি ২০০৭ সালের পর থেকে। কিন্তু সে পথও কুসুমাস্তীর্ন ছিলো না। দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র বলতে গেলে এ যাত্রাও আমাদের বিভ্রান্ত করেছিলো। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা এর সঠিক ব্যাখ্যা হতে পারে।
সংকলনটিতে বিগত দু বছরের বেশী সময় বিশেষ করে যে সময়টাতে আমাদের জাতীয় রাজনীতি অনবদ্য কিছু ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে সে সময়ে প্রকাশিত লেখার একটি সংকলন। এগুলোকে তাই সমসাময়িক লেখা হিসাবে বিবেচনার দাবী রাখে।
লেখাগুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত। তবুও সময়ের বাস্তবতায় এবং এর প্রাসঙ্গিক গুরুত্ব বিবেচনায় তাদেরকে কেন জানি একই মলাটের ভেতরে নিয়ে আসার তীব্র তাগিদ অনুভব করলাম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আলোচিত বিষয়ে কেন মুজিবের বিশ্বাস এবং বাস্তবতা আরও প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে তা যে কোন লেখায় চোখ বুলালেই ধরা পড়বে।
হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা বাদ পড়ে গেছে। আমাদের বৃহত্তর জাতীয় প্রকাশনার যে সব সময় আমার নজর কাড়তে পেরেছে এমনটা ধারনা করাও ঠিক নয়। এই সীমাবদ্ধতার দায়ভার একান্ত ব্যক্তিগতভাবেই আমার।
ঘুরেফিরে আবারও একাত্তরে যেতে হচ্ছে। স্বাধীনতার পর প্রায় পয়তাল্লিশটি বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক লড়াই করেছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নদী বিধৌত এই বদ্বীপটি বরাবরই জোয়ার ভাটার টান দ্বারা প্রভাবিত। এখানে নানান মানুষের পদধ্বনি। চাইলেও তাই নৃতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করা যায় না। এখানকার মানুষের মনের ব্যারোমিটার খুব দ্রুত ওঠা নামা করে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দ্বারাই প্রভাবিত হয় বেশি। ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি আফ্রিকার মানুষদের মধ্যে অনেক বৎসরে যে দৃঢ়তা লক্ষ্য করা যায় এখানে তা আপাতঃ জমাট বাঁধলেও দু একটা ঘন বর্ষনে হঠাৎ করেই সবকিছু ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আর তাতে তার পাথর আর কংকরময় অবয়ব বেরিয়ে আসে। একই বাস্তবতা তাই বার বার ফিরে ফিরে আসে। মানুষ অনেক সময় নিজেই জানে না কেন সে এমন সব আচরন করে।
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে। এর ব্যাতিক্রম একজনই। কোথায় যে পেয়েছিলাম তাকে! যিনি তার ক্ষণজন্মা ৫৫ বছরের জীবনেই দেখিয়ে দিয়ে গেছেন দেশের জনগণের জন্য আমাদের অবস্থান কি হওয়া উচিত। মুজিবময় বাংলার আমাদের ঐ এক সবে ধন নীলমনি যার কর্মের মধ্যেই বাংলার রাজনীতি আবর্তিত। বেহাল বাঙ্গালীর হালও ঐ একটাই। মুজিব মূলতঃ অগতির গতি।
দীর্ঘ রাজনীতির পথ পরিক্রমায় তাকে বাদ দিয়ে অনেকেই কিছু একটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। আসলে সবার হয় না। হবেও না হয়ত। চেতনার মূল ¤্রােত থেকে সরে গিয়ে পথ হারা বাঙ্গালি আর কোথায় দাঁড়াতে পারে।
চারিদিকে এখনও বিস্তর ষড়যন্ত্রের জাল। অনেক কিছুরই চেষ্টা । যারা জেলে আছে তাদের সর্বনাশের ভয়ই তাদের অন্তরের ভেতরটাকে কুড়ে কুড়ে খায। তারা জানে তাদের ক্ষত কোথায়। এতো বছরে পাপ এতো সহজে ধুয়ে মুছে যায় না।
নেতা হিসাবে শেখ মুজিব আজও সমান জনপ্রিয়। যার কোন বিদ্যা বুদ্ধি নেই তারও আজ বুঝতে বাকি নেই মুজিব আমাদের নিত্য দিনের সাথী।
সর্বশেষ যে কথা বলে শেষ না করলে এই লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে তা হলো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে দুএকটা কথা। এই ছোট্ট ভূমিকায় তার বিরাট ভূমিকার কথা টানা সম্ভব নয়। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে ১৯৭৫ সালে আমরা মুজিবকে হারিয়েছিলাম। সেই চেতনার মশাল হাতে নিয়ে ১৯৮১ সাল থেকে আজও এই বয়সে আমাদের জাতীয় রাজনীতির হাল ধরে আছেন। মুজিব কন্যা হওয়া সত্ত্বেও এতটা সময় লেগেছে। বাংলাদেশ নামক জাহাজ ২০১৬ সালে এসে যে একটা স্বচ্ছ সুন্দর বন্দরে নোঙ্গর করতে পেরেছে তার অনেকটা কৃতিত্ব তার। বিশেষ করে ২০০৭ সনের পর থেকে এ পর্যন্ত যে ধারাবহিকতা তিনি দিয়েছেন তার তুলনা মেলা ভার। বাংলার রাজনীতির অর্জন তাই তার কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ থাকবে।
মুজিবকে স্মরন করি অসীম শ্রদ্ধায়। সেই সাথে সাথে আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও অভিবাদন।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীন হলাম অথচ আজ এত বছর পরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আমরা মানসিক ভাবে কতটা তৈরী ছিলাম। এই প্রশ্ন আজ আসত না যদি সে দিনের বাস্তবতায় এই অপ্রিয় সত্যগুলোকে ঝালাই করে নেওয়া হতো।
আমরা ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এমন একজন মহান নেতাকে পেলাম যার উপস্থিতিই বাংলাদেশের জন্যে বিরাট পাওয়া। শেখ মুজিবের তো আমাদের হাতে ধরে কিছু করে দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। তিনি ছিলেন এটাই যথেষ্ট ছিলো। আমরা বাকীটুকু করে নিতে পারলাম না।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে এসে আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে চরম এবং জঘন্যতম কাজটাই করে বসলাম। পিতার রক্তে হস্তপদ রক্তাক্ত করলাম। এটা করেই ক্ষান্ত হলাম না। বিশ্ববাসীকে সেটা সদর্পে জানালামও। অবাক পৃথিবী আরও অবাক হয়ে একটা জাতীর জাতীয় নির্বুদ্ধিতাকে দেখল। ধৃষ্টতাকে অবলোকন করলো। বিশ্ববাসী আমাদের সম্বন্ধে যা ধারণা করার করে নিলো। কলংক লেপন করা মুহূর্তের সিদ্ধান্ত। কলংক মোচনে কখনও কখনও শতাব্দীও যথেষ্ট নয়।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখি আমরা বিস্তর করছি। অতীতে ও বর্তমানে। ভবিষৎতেও হবে। কারণ শেখ মুজিব প্রাসংঙ্গিক। বাংলার রাজনীতিতে কেবল মাত্র ঐ মানুষটাই তার বিশ্বাস এবং বাস্তবতায় এক বিন্দুতে এসে পৌঁছুতে পেরেছিলেন। আর সে জন্যই তিনি রাজনীতির সেনাপতি।
কাউকে মূল্যায়ন করতে হলে তার মতো ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। আমরা কেউই সেই পরিমাপের ব্যক্তিত্ব নই। তবুও আমরা চেষ্টা করি আমাদের মেধায়, মননে, মগজে তাকে ধারণ করার।
বিগত দিনগুলোতে যে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে তার সাথে বর্তমান বাস্তবতার একটা সূক্ষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এটা ভালো লক্ষন। আগে চিন্তা চেতনাগুলো আসতো পেশাদার লেখক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে। এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে কিছু লোক লিখে কাগজের পাতা ভরবে আর বাকীদের কাজ সেগুলো পড়া। এভাবে কোন পরিবর্তন কি আসলেই সম্ভব।
কিন্তু বিগত কয়েক বছরে যে প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে তা হলো এই জাতীয় চিন্তার ¯্রােতধারায় সাধারণ মানুষের অনুভূতি মিশে যাওয়া। গত কয়েক বছরে আমরা এমন লেখালেখি বা অনুভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করেছি যা সমাজের এমন সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে যারা রাজনীতির মূলধারার মানুষ নয়। তবুও তারা এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আবেগ অনুভূতির ছাপ রেখেছেন। এর ফলও ভালো হয়েছে। সরকার তার পজিটিভ ইচ্ছেগুলো বাস্তবায়নে সবসময়ে তার চারপাশে একটা উর্বর ক্ষেত্র অনুভব করেছে। এটাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
এ বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্যে আমাদের একটু কষ্ট করে অতীতে ফিরে যেতে হচ্ছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়টাতে আমাদের দেশপ্রেমের অনুভূতি, চেতনা সবচেয়ে তীব্র এবং আবেগপ্রবণ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমাদের বালখিল্য সুলভ আচরনের কারণে অপশক্তি আমাদের পেয়ে বসল । স্বাধীনতার মতো একটা মহান বিষয়কে আমরা অনেকেই ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে নিয়ে নিলাম। সম্ভবত এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো তারপর রাজনীতির নামে যা কিছু হলো সেটাকে পুতুল খেলা ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। যারা এই খেলা খেলল মূলতঃ তাদের যে কোন সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন ছিলো না সেটা পরবর্তীতে তাদের রাজনীতিহীন আচরনের মধ্যেই স্পষ্ট। কেবল মাত্র উত্তম কিছুই পারে সৃষ্ট শূন্যতাকে পূরণ করতে। কিন্তু তাদের কাছে তেমন কিছু ছিল না।
জিয়াউর রহমান ঠেলে ঠুলে নিয়ে গেলেন সেই ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। যেন প্রতিনিয়ত মৃত পিতার লাশ বুকে নিয়ে বয়ে বেড়ানো। জাতির জন্য এর চেয়ে তীব্র বেদনার কিছুই হতে পারে না।
অতঃপর তার সেই পাপের বোঝা কাঁধ থেকে নামল তারই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আর একজন সামরিক শাসক সেটাকে কাঁধে তুলে নিলেন। তিনিও নানা কায়দায় পুরো দেশটাকে টেনে টুনে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নিয়ে এলেন। অবাক কা-। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র দেখতে দেখতে প্রায় পনের বছর সামরিক শাসকদের দ্বারাই পরিচালিত হলো।
১৯৯০ সালে দেশ গণতান্ত্রিক ভাবধারায় ফিরতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সে পথেও আমাদের জন্য বাস্তবতার বিরাট দায় রয়ে গেল । আমরা কিন্তু মূলধারায় ফিরতে পারলাম না। প্রশ্নটা এখানেই। আমাদের সমস্যাটা কোথায় ছিলো। মূলধারার প্রতি এই যে বিমুখতা এটা কি প্রমাণ করে না যে আমাদের অতীতের অর্জনের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত ছিলাম না। সত্যিকার অর্থে আন্তরিক ও বিশ্বস্ত হতে পারিনি। অনেকেই ওই সূক্ষ্ম দর্শনের যাত্রাপথে ধর্মীয় অনুভূতি দিয়ে রাজনীতির সুষ্ট আলোচনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন। তাতে লাভের লাভ কি কিছু হয়েছে। এরশাদ ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক সর্ম্পক।
এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যে কাজটা অন্ততঃ করতে সক্ষম হয়েছে তা হলো জনগনের বিশ্বাস এবং আবেগের সাথে সময় সুযোগমত পর্যাপ্ত গরল মিশিয়েছে। তাদের আখের হাসিল করেছে। এক এক সময় এক একটা চক্র আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হয়েছে। আমাদের স্থূল চাওয়াগুলোর কাছে এদের সূক্ষ্ম কারচুপিগুলো কখনও ধরা পড়েনি। একটি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক আন্তরিক সরকার পাওয়ার জন্য আমাদের ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
আমি মনে করি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে আবেগঘন সময়টা পেয়েছি ২০০৭ সালের পর থেকে। কিন্তু সে পথও কুসুমাস্তীর্ন ছিলো না। দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র বলতে গেলে এ যাত্রাও আমাদের বিভ্রান্ত করেছিলো। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা এর সঠিক ব্যাখ্যা হতে পারে।
সংকলনটিতে বিগত দু বছরের বেশী সময় বিশেষ করে যে সময়টাতে আমাদের জাতীয় রাজনীতি অনবদ্য কিছু ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে সে সময়ে প্রকাশিত লেখার একটি সংকলন। এগুলোকে তাই সমসাময়িক লেখা হিসাবে বিবেচনার দাবী রাখে।
লেখাগুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত। তবুও সময়ের বাস্তবতায় এবং এর প্রাসঙ্গিক গুরুত্ব বিবেচনায় তাদেরকে কেন জানি একই মলাটের ভেতরে নিয়ে আসার তীব্র তাগিদ অনুভব করলাম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আলোচিত বিষয়ে কেন মুজিবের বিশ্বাস এবং বাস্তবতা আরও প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে তা যে কোন লেখায় চোখ বুলালেই ধরা পড়বে।
হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা বাদ পড়ে গেছে। আমাদের বৃহত্তর জাতীয় প্রকাশনার যে সব সময় আমার নজর কাড়তে পেরেছে এমনটা ধারনা করাও ঠিক নয়। এই সীমাবদ্ধতার দায়ভার একান্ত ব্যক্তিগতভাবেই আমার।
ঘুরেফিরে আবারও একাত্তরে যেতে হচ্ছে। স্বাধীনতার পর প্রায় পয়তাল্লিশটি বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক লড়াই করেছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নদী বিধৌত এই বদ্বীপটি বরাবরই জোয়ার ভাটার টান দ্বারা প্রভাবিত। এখানে নানান মানুষের পদধ্বনি। চাইলেও তাই নৃতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করা যায় না। এখানকার মানুষের মনের ব্যারোমিটার খুব দ্রুত ওঠা নামা করে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দ্বারাই প্রভাবিত হয় বেশি। ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি আফ্রিকার মানুষদের মধ্যে অনেক বৎসরে যে দৃঢ়তা লক্ষ্য করা যায় এখানে তা আপাতঃ জমাট বাঁধলেও দু একটা ঘন বর্ষনে হঠাৎ করেই সবকিছু ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আর তাতে তার পাথর আর কংকরময় অবয়ব বেরিয়ে আসে। একই বাস্তবতা তাই বার বার ফিরে ফিরে আসে। মানুষ অনেক সময় নিজেই জানে না কেন সে এমন সব আচরন করে।
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে। এর ব্যাতিক্রম একজনই। কোথায় যে পেয়েছিলাম তাকে! যিনি তার ক্ষণজন্মা ৫৫ বছরের জীবনেই দেখিয়ে দিয়ে গেছেন দেশের জনগণের জন্য আমাদের অবস্থান কি হওয়া উচিত। মুজিবময় বাংলার আমাদের ঐ এক সবে ধন নীলমনি যার কর্মের মধ্যেই বাংলার রাজনীতি আবর্তিত। বেহাল বাঙ্গালীর হালও ঐ একটাই। মুজিব মূলতঃ অগতির গতি।
দীর্ঘ রাজনীতির পথ পরিক্রমায় তাকে বাদ দিয়ে অনেকেই কিছু একটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। আসলে সবার হয় না। হবেও না হয়ত। চেতনার মূল ¤্রােত থেকে সরে গিয়ে পথ হারা বাঙ্গালি আর কোথায় দাঁড়াতে পারে।
চারিদিকে এখনও বিস্তর ষড়যন্ত্রের জাল। অনেক কিছুরই চেষ্টা । যারা জেলে আছে তাদের সর্বনাশের ভয়ই তাদের অন্তরের ভেতরটাকে কুড়ে কুড়ে খায। তারা জানে তাদের ক্ষত কোথায়। এতো বছরে পাপ এতো সহজে ধুয়ে মুছে যায় না।
নেতা হিসাবে শেখ মুজিব আজও সমান জনপ্রিয়। যার কোন বিদ্যা বুদ্ধি নেই তারও আজ বুঝতে বাকি নেই মুজিব আমাদের নিত্য দিনের সাথী।
সর্বশেষ যে কথা বলে শেষ না করলে এই লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে তা হলো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে দুএকটা কথা। এই ছোট্ট ভূমিকায় তার বিরাট ভূমিকার কথা টানা সম্ভব নয়। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে ১৯৭৫ সালে আমরা মুজিবকে হারিয়েছিলাম। সেই চেতনার মশাল হাতে নিয়ে ১৯৮১ সাল থেকে আজও এই বয়সে আমাদের জাতীয় রাজনীতির হাল ধরে আছেন। মুজিব কন্যা হওয়া সত্ত্বেও এতটা সময় লেগেছে। বাংলাদেশ নামক জাহাজ ২০১৬ সালে এসে যে একটা স্বচ্ছ সুন্দর বন্দরে নোঙ্গর করতে পেরেছে তার অনেকটা কৃতিত্ব তার। বিশেষ করে ২০০৭ সনের পর থেকে এ পর্যন্ত যে ধারাবহিকতা তিনি দিয়েছেন তার তুলনা মেলা ভার। বাংলার রাজনীতির অর্জন তাই তার কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ থাকবে।
মুজিবকে স্মরন করি অসীম শ্রদ্ধায়। সেই সাথে সাথে আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও অভিবাদন।
Comments
Post a Comment