কলকাতার বনেদী সাহিত্যপত্রিকা ‘রূপান্বয়’ এবারের শারদীয় সংখ্যাটিকে “শতবর্ষে জসীম উদ্দীন ” সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ বলে তাঁর ওপর একটা লেখা চাওয়াতে বেশি ভালো লাগল এ জন্যে যে সেখানেই তো তাঁর বিকাশ ঘটেছিল। এছাড়াও রূপান্বয়ের এ উদ্যোগটি দেখে মনে হচ্ছে যে স্বতন্ত্র শ্রেণীর এই কবি সমানে স্মরণে আছেন পশ্চিমবঙ্গেরও।
বাংলাদেশে তো বছরটি শুরু থেকেই এঁর শতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে, বলা যায়, যথাযোগ্য মর্যাদায়-সভা-সেমিনারের সমারোহ এবং স্মারকগ্রন্থের সহযোগেও। জসীম উদ্দীনকে নিয়ে তাঁর মৃত্যুর সাতাশ বছর পরেও সর্বন্তরে এবং সর্বত্র এতসব তৎপরতা দেখে আমার মনে পড়ে গেল বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি উক্তি :
‘একদিন আমি মোহিতবাবুরে চ্যালেঞ্জ কইরা বইলাম। কইলাম, আপনে জসীমুদ্দীনের এত ঠাট্টা করেন ক্যান। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যদি জসীমুদ্দীনের উপর এক অধ্যায় লেখা অয়, আপনেরে নিয়া লেখব মাত্র চাইর লাইন।’ (পৃ ২৩, যদ্যিপি আমার গুরু, তৃতীয় মুদ্রণ, আহমদ ছফা, প্রকাশক, মাওলা ব্রাদার্স)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন দুই অধ্যাপক সম্পর্কে সেকালের ছাত্র আবদুর রাজ্জাকের ষাট বছর আগের ধারণাটা তো আজ সত্যই প্রমাণিত হচ্ছে, পরোক্ষে হলেও। কবি জসীম উদ্দীনের আজকের স্মৃতিকে একটি অধ্যায় ধরলে, কবি মোহিতলাল মজুমদারের একালীন স্মৃতির পরিমাপ চার লাইন বলেই তো মনে হয়। কারণটাও সাদামাটা-পল্লীকবির মৌলিকতা।
এই কবির পল্লীমুখিতা যে বাংলা কাব্যের প্রবাহে একটা নতুন ধারা সেটা পাঠমাত্রই উপলব্ধি করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মনীষীগণ। পল্লীর নিসর্গকে জসীম উদ্দীন জননীরূপে দেখতেন। তাই পল্লীর নিবাসীদের তিনি আপন ভাইবোন জ্ঞান করতেন। তাঁর বানানে, জসীম উদ্দীন নামে, আরেকজন লেখকের আগমন দেখে কবি তাঁর ‘স্মৃতির পট’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে লিখেছেন :
‘বর্তমানে আমার নামে তিন চার জন লেখক উদয় হইয়াছেন। তাঁহাদের একজন আমার মতোই বানান করিয়া নাম লেখেন। কয়েকজন জসীম উদ্দীনের মধ্যে আমার প্রিয় পাঠকগণ যাহাতে আমাকে চিনিতে পারেন সেইজন্যে এখন হইতে আমার নামের সঙ্গে ‘পল্লীকবি’ এই কথাটি যুক্ত থাকিবে। বিশ্ববিদ্যালয় হইতে আমি আরও পদবী পাইয়াছি। কিন্তু আমার দেশবাসী আমাকে ‘পল্লীকবি’ এই পদবী দিয়াছেন। ইহাকেই আমি সবচাইতে গৌরবের বলিয়া মনে করি।’
কবির একনিষ্ঠ পল্লীপ্রীতিই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে নক্সী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রাখালী, বেদের মেয়ে, পল্লীবধূ, গ্রামের মায়া, যমুনাবতী, পদ্মার পার, গাঙ্গের পার, সকিনা, মাটির কান্না, মা যে জননী কান্দে, মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো, বালুচর, ধানখেত, প্রভৃতি কালজয়ী রচনা। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক লেখক আহমদ ছফাকে বলেছেন :
‘কবি জসীম উদ্দীনের একটি কবিতার বইয়ের নাম ছিল ধানখেত। মোহিতবাবু ব্যঙ্গ করে বলতেন জসীমুদ্দীন ধান খেতো। মোহিতলালের জিভের মধ্যে বিষ আছিল। তাঁর ঠাট্টা রসিকতা এমনভাবে ছড়াইয়া পড়ল জসীমুদ্দীন বেচারার জান যাওনের দশা।’ (প্রাগুক্ত)।
শিক্ষক মোহিতলালের মাত্রা ছাড়ানো তুচ্ছতাচ্ছিল্যেরই প্রতিক্রিয়া ছিল ছাত্র রাজ্জাকের ওই মর্মোদ্ভে ভবিষ্যদ্বাণী। পল্লীকবিকে চিনতে পারেননি নাগরিক অধ্যাপক। চিনতে পারেননি তাঁকে সরকারি পন্ডিতমহলও। জাতীয় অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেব বলেন:
‘দ্যাহেন বাংলাদেশ সরকার জসীমুদ্দীনরে কিছু করল না। আমারে আর জয়নুল আবেদিন সাহেবেরে মুশকিলে ফেলাইয়া দিছে। আমগো দুইজনেরে ন্যাশনাল প্রফেসর বানাইছে, আর জসীমুদ্দীনরে কিছু বানায় নাই।’ (তদেব)।
চিনতে পারেন না তাঁকে সদ্য-সাবালক পাঠক-লেখকও। বর্ণিত বইটি থেকেই আরেকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
‘চা শেষ করার পর বললেন (রাজ্জাক স্যার), আপনে জসীমুদ্দীনের লেখাটেখা পড়েন? আমি (আহমদ ছফা) জবাব দিলাম, এক সময়ে জসীমুদ্দীন সাহেবের লেখা পড়তাম। এখন আর কোনো আগ্রহ বোধ করিনে।’
রাজ্জাক স্যার বললেন, আমি জসীমুদ্দীনের লেখা খুব পছন্দ করি। আপনি কি তাঁর আত্মজীবনী পড়েছেন? (পৃ ২২)
আমি বললাম, ‘জীবন কথা’র কথা বলছেন স্যার? পড়েছি।’
‘গদ্যটি কেমন?’
‘খুব সুন্দর।’
রাজ্জাক সাহেব বললেন, এরকম রচনা সচরাচর দেখা যায় না। তারপর তিনি হুঁকো টানতে টানতে জসীমুদ্দীনের গল্প বলতে আরম্ভ করলেন। একসময় কলকাতায় আমি এবং জসীমুদ্দীন এক বাড়িতে থাকতাম। একদিন জসীমুদ্দীন আমাকে কাপড়চোপড় পইর্যা তাড়াতাড়ি তৈয়ার অইবার তাগাদা দিতে লাগলেন। আমি জিগাইলাম, কই যাইবার চান। জসীমুদ্দীন কইলেন, এক জায়গায় যাওন লাগব।
কাপড় চোপড় পইর্যা তার লগে হাঁইট্যা হাঁইট্যা যখন অ্যাসপ্ল্যানেডে আইলাম, জসীমুদ্দীন ঘাড় চুলকাইয়া কইলেন, কও দেখি এখন কই যাওন যায়? এই রকম কান্ড অনেকবার অইছে। একটুখানি হাসলেন’ (পৃ ২৩)।
উদ্ধৃত শেষ প্যারাটির অপ্রাসঙ্গিক অংশটা বাদ দিলাম না-ওখানটায় ব্যক্তি-জসীম উদ্দীনের ওপর ভালো আলো পড়েছে বলে। কম-প্রাসঙ্গিক হলেও এখানে আরেকটি উদ্ধৃতি দেব পল্লীকবির মৌলিক গদ্যশৈলীকে রাজ্জাকসাহেবের অসাধারণ বলার সমর্থনে। এদেশের ঐতিহ্যবাদী সিনেমা-সময় পত্রিকাটিকে ধন্যবাদপত্র দিয়ে জনৈক পাঠক জানিয়েছিলেন :
‘ জসীম উদ্দীনের জীবনকথা পড়িতেছি না মায়ের হাতে পিঠা খাইতেছি।’ (কবির মুখবন্ধ, ১৩৭১ সাল)। পাঠক-বর্ণিত এই মা কোনো ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায়ের মা নন, ধূলিমলিন-কিন্তু-অকৃত্রিম বঙ্গজননী।
পুস্তকটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁদের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে যাঁরা সেই একই মায়ের গর্ভজাত ঊনজন সম্প্রদায়ের রক্ষাব্রতে নিজেদের জানমাল বিপন্ন করে দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা দূর করেছেন।
জগতের সেরা রাঁধুনীর হাতে তৈরী ওই পিঠাটির মৌলিক স্বাদটুকু ভুলে যান যৌগিক স্বাদের বনোয়াট আবেদনে দিশাহারা নব্য খদ্দের। যেমন মৌলিক লেখক আহমদ ছফা বলেছেন, তিনি এখন আর ওই পিঠা খেতে আগ্রহ বোধ করেন না। তাঁর উক্তিটির সূত্র ধরে আমার নিজের স্বীকারোক্তিটিও করে ফেলি। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেনের শ্রীচরণাবিন্দে উৎসর্গীকৃত রাখালী-কাব্যগ্রন্থের কবর-কবিতার মুগ্ধ পাঠক বালক শাকুরও যুবক হবার পর ছফার মতোই জসীম উদ্দীনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল।
অতঃপর তার অপরিণত মনের পন্ডিতম্মন্যতাকৃত অপরাধটা প্রসঙ্গক্রমে আজ এখানে প্রকাশ করে দিতে পারলে আমার কিঞ্চিৎ প্রায়শ্চিত্ত হবে এবং এ সূত্রেই রূপান্বয়-প্রদত্ত সুযোগটিরও এই একটি সদ্ব্যবহার অন্তত হবে (আর কোনো সদ্ব্যবহার আমার ক্ষমতারই বাইরে, কারণ পল্লীকবির কোনো বিষয়েই কিছু লেখার মতো কোনো অধিকার আমি এখনো অর্জন করিনি)।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অকালপ্রয়াত অধ্যাপক, ফরিদপুর জেলার কৃতী সন্তান, ডক্টর সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের (১৯২৭-১৯৮৪) সঙ্গে এক আটপৌরে আসরে একদিন একটা খাট্টা তামাশা করে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, জসীম উদ্দীনের ওপর পিএইচডি করার সিদ্ধান্তে কি, অজ্ঞাতে হলেও, কিছু ‘জেলাবাদে’র মিশেল ছিল? (তাঁর ডক্টরাল ডিসার্টেশন : ‘কবি জসীম উদ্দীনের জীবন ও সাহিত্যকর্ম’)।
বিশেষ ¯েœহভাজন ছিলাম বলেই হয়তো তিনি রাজ্জাক সাহেবের মতো বলে ওঠেননি : পল্লীকবির লেখা তো ছাপামাত্রই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, আপনার লেখা কি এত কাল পরেও, কোনো বাড়িরই নজরে পড়েছে?
মাস্টার্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণী এবং গবেষণাকর্মে বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে পুরস্কার পাওয়া মিতভাষী স্মিত হেসে বলেছিলেন : তাঁর ভক্ত আমি শিক্ষার্থী থাকার কাল থেকেই, ডিগ্রিপ্রার্থী হবার কাল থেকে নয়।
তার প্রায় দুই দশক পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘আবহমান বাংলা’-নামক বাংলার ঐতিহ্যসন্ধানী এক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে অতিথিবক্তা হিসাবে রাখালিয়া বাঁশি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে গ্রামবাংলার প্রাণবস্তুর সুলুকসন্ধানে নেমে আমি জসীম উদ্দীনের পদ্যের সঙ্গে এবার গদ্যও পড়ি এবং পরিণত বয়েসের অন্তর্দৃষ্টিতে তাঁর সঠিক পরিচয় পাই-কেবল মৌলিক কবি হিসেবেই নয় অকৃত্রিম মানুষ হিসেবেও।
আমার উপস্থিত উপজীব্য পল্লীর বংশীটিকে তো তাঁর রচনার প্রায় সর্বত্রই অভিক্ষিপ্ত পাই, প্রতিবেশের অবিচ্ছেদ্য প্রতীকরূপে। যথাসময়ে ঘরে বসে অনুষ্ঠানটি দেখার সময় শুনতে পাই, আমি বলছি : জসীম উদ্দীন পল্লীর বিশ্বকবি। কথাটা ছিল আমার অজান্তে উক্ত কিন্তু গভীর বিশ্বাসজনিত, কথার পিঠের কথাটি হয়ে মুখ থেকে অজ্ঞাতে স্খলিত নয়।
বৈদ্যুতিক মাধ্যমে ইথারে ছড়ানো আমার আবেগ-জড়ানো কথাটা কোনো বিশ্বে বসে শুনে থাকলে ডক্টর মুখার্জি এদিন নিশ্চয় মজা পেয়েছেন। আর আমি স্বস্তি পেয়েছি, তিনি নিশ্চয় শুনেছেন ভেবে। কুমুদরঞ্জন মল্লিককে মনে রেখেও বলতে হয় পল্লীর একনিষ্ঠ কবি হিসেবে বাংলা ভাষায় জসীম উদ্দীনের জায়গাটা অবিভাজ্য।
যাহোক, পল্লীর ওই একচ্ছত্র কবির হাতটি ধরেই আমি রাখাল বাঁশির আপন ভুবনে প্রবেশ পেয়েছিলাম-বাংলার লোকালয়ে, লোকসংগীতির মঞ্চে, লোকসুরের আসরে, যে-আসরের প্রধান লোকবাদ্যটি হল বাঁশি, বাঁশের বাঁশি (এর আগে যেন বাঁশিটির কেবল ছবিটিই দেখা হয়েছিল ‘রাখালী’ কাব্যের প্রচ্ছদপটে, শ্রীনন্দলাল বসুর অঙ্কনে)। জসীম উদ্দীনের প্রথম জীবনে এই বাঁশিটির দাম ছিল এক পয়সা। সংবাদটা কবিই দিয়েছেন তাঁর ‘এক পয়সার বাঁশি’-শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটি মারফত।
বাঁশিটিকে তিনি তুলে দিয়েছেন নিঃস্ব রিক্ত বঞ্চিত বিশ্বের নবজাতকের হাতে, যেটা বাজিয়ে সে আভিজাত্যের বেড়া ডিঙিয়ে জনসাধারণ্যে মিশে যাবে। বাঁশের বাঁশি কারা বাজায় তাও তিনি সবিস্তারে বলেছেন ওই নাম-কবিতাটিতে-এক কথায় গ্রামবাংলার কৃষিকর্মীরা। আরো চিহ্নিত করে বলা যায়, রাখাল ছেলেরা।
কিন্তু এত শত জাঁকজমকের বাদ্য থাকতে তুচ্ছ বাঁশিটি কী করে হয়ে গেল জনপ্রিয়তম লোকবাদ্য? রামসুন্দর বসাক প্রণীত ক্ল্যাসিক সেই ‘বাল্যশিক্ষা’তেই তো চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে বাঁশি ছাড়াও বিশটি বাদ্যযন্ত্র : তবলা বেহালা বাঁশি বীণা পখোয়াজ /করতাল তানপুুরা সেতার এ¯্রাজ/ সানাই সারঙ্গ শঙ্খ কাঁসি ঢাক ঢোল/ নাকারা টিকারা কাড়া জগঝম্পা খোল।
বাঁশির লোকপ্রিয়তার কারণ, বাঁশ এদেশের লোকালয়ের প্রকৃতিজ বৃক্ষ এবং সর্বত্রই দৃষ্ট। বাঁশের বাঁশি সহজে বানানো যায়, সস্তায় কেনা যায়। সরল বাঁশিতে ধুন বাজানোও সহজে শেখা যায়, হাতে নিয়ে যত্র-তত্র চলাফেরা করা যায়, যেখানে সেখানে একটু সুরও ভাঁজা যায়, যখন তখন ফুঁ দিয়ে একটু মনও ভোলানো যায়-এমনকি মনের অব্যক্ত বেদনাটিও নাকি লেখা যায়, যেমন জসীম উদ্দীন বলেছেন : ‘আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা পড়িলেই বোঝা যায়।/ যে লেখে বেদনা বেবুঝ বাঁশিতে কেমনে দেখাব তায়।’
এবার বাঁশির অন্যান্য দিক নিয়ে কিছু কথা। আগে বাঁশি-নিকটতম শব্দটি ছিল সুর, বাঁশির সুর। এখন এদেশে বাঁশি-শব্দটির সঙ্গে যে-শব্দটি বেশি শোনা যায় সে হল লাঠি, যেমন বাঁশি-লাঠি সমিতি। ব্যাপারটা কী? এও যাতনা ঠেকানোরই ব্যাপার। তোলাবাজ-চাঁদাবাজের জ্বালাতনে ব্যবসায়ীমহল ওই দুষ্কৃতী দেখলেই বাঁশি বাজিয়ে দ্যায়, শুনেই প্রতিবেশী পসারী-দোকানী লাঠি নিয়ে ঘের দেয় দুষ্কৃতীদের। এটা অবশ্য হুইসিল বাঁশি।
তবে বাঁশের বাঁশি আর লাঠির কথাও এক নিঃশ্বাসেই উল্লেখ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মশক্তি-শীর্ষক রচনায়, যুগলসিম্মনিটিকে স্বাগত জানিয়েই : যে লোকদের ব্যবসা বাঁশি বাজানো, সহসা সর্পাঘাতের উপক্রম হইলে সে বাঁশিকে লাঠির মতো ব্যবহার করিয়া থাকে। (স্বদেশী মর্মকথা : পুনশ্চ)। বোঝাই যায়, সুরের যন্ত্রের এই বেসুরো ব্যবহার নেহাত ইমার্জিন্সি মিট করা বা জরুরীভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়ারই তাড়নায়।
তবে গ্রামবাংলর জীবনে ও কাব্যে বাঁশি আর লাঠি প্রসঙ্গ পরস্পরে প্রায় অবিচ্ছিন্ন। যেমন পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অমর কাহিনীকাব্য ‘নক্সী কাঁথার মাঠে’র নায়ক রূপাই তার নায়িকা সাজুর মন ভোলায় বাঁশি দিয়ে। সে-ই আবার লাঠি চালিয়ে জমি সামলায় এবং সে-সূত্রেই হয়ে ওঠে ট্র্যাজিক হিরো।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যের শেষ অঙ্কে নায়ক সোজন বাঁশির সুরে বার্তা পাঠায় নায়িকা দুলির উদ্দেশে, যে-বাঁশির সুর অনুসরণ করে সে চলে আসে নদীর ঘাটে, দুজনের স্বেচ্ছামৃত্যুর পটে।
তবে বাঁশি যে প্রেমেরই দূত সে বড় মর্মস্পর্শীরূপে দৃষ্ট হয় জসীম উদ্দীনের লোকনাট্য ধরনের একাঙ্কিকা ‘বদল বাঁশি’তে। গ্রামের ছেলে বছির আর গ্রামের মেয়ে বড়–র প্রেম মিলানাত্মক না হওয়াতে প্রেমিক রাতভর বাঁশির সুরে প্রাণের জ্বালা জুড়াতে চায়।
আবার তাতেই জ্বালা বেড়ে চলে পরস্ত্রী বড়–র-এতখানি যে বাঁশিটি তাকে দিয়ে দিতে আকুতি জানায় সে। অকৃত্রিম প্রেমের প্রতিমূর্তি, ছেলেটি প্রেমাস্পদার হাতে তার প্রাণের বাঁশিটি সমর্পন করে দিয়ে নিতান্তই নিঃস্ব হয়ে গিয়ে চলে যায়
(কোথায় কে জানে!)।
অভিন্ন বাণীই যেন পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রপর্বের পঁচাশি নম্বর গানে। সেখানে ‘দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে’র সুরে যে পাগল হয়েছে সে ‘কী তোমারে দিব আনি’ বলাতে জবাবে ছেলেটি বলেছে ‘তোমার গলার মালাখানি’। মেয়েটি যখন বলে ‘দিই যদি তো কী দাম দেবে’। ছেলেটি তখন জবাবে ‘বাঁশিটি তার গেছে ফেলে’।
কী আর করতে পারত রাখাল ছেলে, বাঁশিই যে তার সব কিছু। আমি আসলে কলেকৌশলে রবীন্দ্রনাথে পৌঁছেতেই চেয়েছিলাম। কেননা বাঙালি হিসেবে যে-কোনো রচনা লিখতে তাঁর ঋণের পরিমাণ আরেকটি কিস্তি বাড়াব, না, তা তো হতে পারে না।
কী আছে বাঁশিতে? যা-ই থাকুক, সেটি অনির্বচনীয়। সেদিকে একেবারে ‘আদিরহস্য’ই বলেছেন কবিগুরু তাঁর কণিকা কাব্যে : বাঁশি বলে, মোর কিছু নাইকো গৌরব, / কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব। / ফুঁ কহিল আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি-/ যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানে।
লিপিকায় বাঁশি-শীর্ষক রচনায় তিনি লিখেছেন, বাঁশির বাণী চিরদিনের বাণী। বাঁশির গানের সুর সংসারের উপর থেকে গোপন অতৃপ্তি, গভীর নৈরাশ্য, অবহেলা, অপমান, অবসাদ, কামনার কার্পন্য, নীরসতার কলহ, ক্ষুদ্রতার সংঘাত, ধূলিলিপ্ত দারিদ্র্য ইত্যাদির পর্দা একটানে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। বাঁশির সুর চেনা মর্ত্যকে অচেনা স্বর্গে রূপান্তরিত করে।
জরাজীর্ণ মর্ত্যকে পলকে স্বর্গ করে তোলার এক জীবন্ত চিত্র এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ‘পুনশ্চ’র বাঁশি কবিতাটিতে। দীর্ঘ কবিতাটি জুড়ে আছে কিনু গোয়ালার গলির কুশ্রিতার সানুপুঙ্খ বর্ণনা (দিন রাত মনে হয়, কোন্ আধ্মরা / জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি)। কিন্তু এই বিশ্রী গলিরই মোড়ের বাসিন্দা কান্তবাবুর কর্নেটের, মানে পিতলের বাঁশির, পিলু-বারোয়াঁর তানে মুহূর্তে ধরা পড়ে :
‘এ গলিটা ঘোর মিছে, / দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো। / হঠাৎ খবর পাই মনে / আকবর বাদশার সঙ্গে / হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই। / বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে / ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে / এক বৈকুন্ঠের দিকে। / এ গান যেখানে সত্য / অনন্ত গোধূলিলগ্নে / সেইখানে / বহি চলে ধলেশ্বরী; / তীরে তমালের ঘন ছায়; / আঙিনাতে / যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার / পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এসব অমর রচনায় বাঁশির যে-সুরবাণীর কথা বলেন, সে যেন রাগসুরের কথা। কিন্তু পল্লীকবি জসীম উদ্দীন বলেন বাঁশির লোকসুরের কথাই। তাঁর বাঁশিটি কর্নেটের মতো শহুরে ধাতুরও নয়, গ্রামীণ বাঁশের-যার দাম মাত্র এক পয়সা। যেমন আগেও বলেছি, বাঁশিটি তিনি কিনে দেবেন তিমিরাচ্ছন্ন এ দরিদ্র দেশের জনগণের ভবিষ্যত-নামক নবজাতকটিকে। কবি বলেন :
‘হরেক রকম অনেক জিনিস পাবে, তুমি, / মনেক খানেক অনেক টনেক করে; / আমি তোমায় কি দেব ধন! সোনামানিক! / এক পয়সার বাঁশি কিনে দেব তোমার করে।’
কী জন্যে পল্লীকবি এই অকিঞ্চিৎকর অথচ অমূল্য উপহারটি দিচ্ছেন নবাগত শিশুটিকে, সেসব তাঁর কবিতাটি থেকে সরাসরি জেনে নেওয়াই ভালো :
‘এই বাঁশিটি বাজিয়ে তুমি / ফিরবে যখন একলা গৃহ-কোণে; / এই বাঁশিটি বাজায় যারা / তাদের কথা জাগে যেন / তোমার রঙিন মনে। /
এই বাঁশিটি বাজায় কারা? /অন্ধগলির মধ্যে যারা, / ভোগ করছে বন্ধ-কারা, / ধূলায় ধূঁয়ায় অন্ধকারা, / এই বাঁশিটি বাজায় শুধু / তাদের ছেলে-মেয়ে; / তোমার মুখে তাদের কথা বাজবে নিতুই / এই বাঁশিটির সুর-সায়রে নেয়ে। /
এই বাঁশিটি বাজায় কারা-/ শহর ছাড়া, নগর ছাড়া; / সভ্যতার এই আলোকহারা / চোখ থাকিতে অন্ধ যারা; / অজ্ঞানতায় অন্ধকারা, / জ্যান্ত-মৃতের মতন যারা, / ঘুমিয়ে আছে দেশটি জোড়া; এই বাঁশীটি বাজায় সদা / তাদের ছেলে-মেয়ে। / তোমার মুখে তাদের কথা / জ্বলবে নিতুই এই বাঁশীটির / অগ্নিশিখায় বাঁশি; অন্ধকারার ধূ¤্ররাশি, / ফুঁয়ে ফুঁয়ে উঠবে জ্বালায় জ্বলে।
অত্যাচারীর টুটবে কুঠার, / টুটবে দুয়ার অজ্ঞানতার; / নাগ-নাগিনী আসবে ছুটে / বিষের জ্বালায় জ্বলে; / লক্ষ যুগের অত্যাচারের / শোধ লইতে সকল মারের / তোমার মুখে বাজবে বাঁশী / অগ্নি-জ্বালায় জ্বলে; / হয়ত সেদিন থাকব নাকো, / তাহার আগেই হয়ত যাব; / আমরা সবে অন্য কোথাও চলে’।’
কবিতাটির জন্মকালে পল্লীকবির এই উপলব্ধি-এক শব্দে বলতে গেলে-বিস্ময়কর! পল্লীর কান্নাকে বাঁশির প্রতীক সম্যক ধরতে সক্ষম হয়েছেন গ্রামবাংলার প্রাণের কবি জসীম উদ্দীন। প্রতীকটি সঠিক হয়েছে যেহেতু বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে বাঁশির প্রকৃতির মিলটি শুধু হার্দিকই নয়, আত্মিকও।
বাঁশির সঙ্গে হাসির কেবল শব্দেরই মিল। বাঁশির সুরে পাই তো খালি কান্নাই। এবং কান্না যে গ্রামবাংলার নিকটতর আত্মীয় সে সত্যের উপলব্ধিই পল্লীকবিকে এমনি গণমুখী করে তুলেছে।
Comments
Post a Comment