১৯৯২-৯৩ শিক্ষা বর্ষে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ¯œাতক (সম্মান) শ্রেনীতে ভর্তি হলে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। আমি ফজলুল হক হলের ছাত্র ছিলাম। স্বভাবিকভাবেই হল ইউনিটের সাথে সুক্ত হয়ে আমার নূতন রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে জাসদ ছাত্রলীগ সক্রিয় ছিলো। কিছুদিন পুর্বেই বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির সর্বশেষ সাড়া জাগানো ছাত্র নেতা কফিল উদ্দিন কফিল নিহত হন। ঐ সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৮০০/৯০০ ছাত্র এই রাজনীতির সমর্থক ছিলো। বর্তমানে এই সংখ্যা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। কিন্তুু আমার সব সময়ই মনে হয়েছে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে বাম রাজনীতির ছাত্র সংগঠনগুলোর কোন বিকল্প নেই। এটা অবশ্যই আমার ব্যাক্তিগত মতামত। এই মতামত এখানে থাক। তার ফাঁকে আমরা আমার না দেখা অতীত থেকে কিছুটা হলেও ঘুরে আসতে চাই।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির সামনে যে সব চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো জাতি আগামী দিনে কোন গতিধারায় পরিচালিত হবে। প্রথম যে প্রশ্নটা আসে বাংলাদেশ কি সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অর্šÍভূক্ত হবে নাকি গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী পৃথিবীর অধীন হবে। মুসলিম বিশ্বের বলয়ে চলে যাবে নাকি ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে ভারতের ছায়ায় অবস্থান করবে। সবচেয়ে বড় একটা বিষয় বাংলাদেশের জন্মের পূর্বে ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের ঘোষণায় পরিস্কার করা হয়েছিল পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান। কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব। কিন্তু এই জানানোতেও শেষ রক্ষা হয়নি। অভ্যন্তরীন প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপগুলোর পাশাপশি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানও ওঁৎ পেতে থাকে সদ্যোজাত রাষ্ট্রটির সাথে সম্পর্ক কেমন হবে। পাশাপাশি তাকিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুশীলবরা। এর মধ্যে প্রথমেই আসে কূটনৈতিক ভাবে পরাজিত আমেরিকার কথা। পাকিস্তানের সমর্থক মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী শক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীও হাত বাড়ায়। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়া জোগাড়। এই যখন পরিস্থিতি তখন দেশের ভেতরেও নানা মত নানা পথের লোকের অভাব হয় না। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসম্মানবোধ, পাকিস্তান ফেরত বন্দী সৈন্যদের মর্যাদার প্রশ্ন, সাধারন খেঁটে খাওয়া মানুষের দুবেলা দুমুঠো অন্ন, বস্ত্রের চিন্তা। সবকিছুর মাঝখানে মুজিব একা একটা নিঃসঙ্গ চিতা। ভাবলে অবাক লাগে তিনি কিভাবে পুরো পরিস্থিতিটা সামলেছেন। অবশ্য সামলাতে তিনি পারেননি শেষ পর্যন্ত। মরেছেন। অনেকেই বলেছেন মুজিব কে এ মেরেছে ও মেরেছে। আসলে বাস্তবতা আরও জটিল। আমরা কেউ কি বুঝতে চেয়েছি একা একটা মানুষের কাঁধে পুরো জাতির বোঝা। উনি যাবেনটা কোথায়। বাঙ্গালীর মেধা শূন্যতা আবারও প্রমানিত হলো। আমরা শরীরি মুজিবকে সরিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতির উত্তরণ চাইলাম। কিন্তু সেটা যে কতো বড় ভুল ইতহাস তা প্রমান করেছে। আজও মুজিবের বিকল্প নাই। লক্ষ বছরেও হবে না। রাজনীতির মহাকবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অমর রূপকার মুজিব শুধু একজনই। গোটা জাতিকে কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো এতোটা প্রশস্ত কাঁধ যদি আর দ্বিতীয়টি থাকত তাহলে সেই কাঁধে ভর করে জাতি আরও অনেক আগেই স্বাধীনতার মুখ দেখত।
মুজিব নিহত হওয়ার পর চার দশক গড়িয়ে গেছে। বাঙ্গালী জাতির ভাগ্য ভাল দীর্ঘ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ আবার তারা আলোর মুখ দেখছে। উন্নয়নের জোয়ার দেখছে। তাও সেই মুজিবের উত্তরসূরীর কাঁধে ভর করে। শেখ হাসিনা আজ শুধু বাংলাদেশের আশা আলোর প্রতীকই নন। গোটা বিশ্বের জন্য আলোক বর্তিকা। শেখ হাসিনাই পারলেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ সফল করতে। বাকীরা শুধু মুখে বলেই খালাস।
যে আলোচনায় ছিলাম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং তার মোকাবেলায় রাজনীতিতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর একটা ছোট খাট রূপরেখা তুলে ধরতে চাই এজন্যে যে এর মধ্যে কোন ফাঁক গলিয়ে কি যে ঝরে গেল তা কিছুটা হলেও বোঝা যাবে। মুজিবকে যারা সেই ষাটের দশক থেকে বিদ্যা বুদ্ধি সঙ্গ দিয়ে ঘিরে রেখেছিল তার মধ্যে রাজ্জাক, তোফায়েল, সিরাজুল ইসলাম, রব, তাজউদ্দিন, কামাল হোসেন প্রমুখরা উল্লেখযোগ্য। কিন্তুু ভেঝাল হলো যুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলোতে। মুজিব সব দিক বিবেচনায় তাদের প্রত্যাশার হাতে দেশকে ছেড়ে দিতে পারলেন না। তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের উপর তিনি ভরসা রাখতে পারলেন না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ২রা মার্চ যারা তার হাতে বাংলাদেশের পাতাকা তুলে দিয়েছিলেন তারা দিশেহারা হয়ে গেলেন। কেউ কেউ খেই হারিয়ে মুজিবকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। আর যায় কোথায়। সিরাজ সিকদার তো রাতারাতি হিরো বনে গেলেন। কিন্তু ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র বড়। তাকে সরে যেতে হলো। পরিস্থিতি ঘোলাটে হলো। কিন্তুু সমাধান হলো না। ১৯৭২ এ এসে যখন জাসদের জন্ম হয় তখনও কিন্তু কোনো অসুস্থ মনোভাব ছিলো না। সমাজতান্ত্রিক দলগুলো সব সময়ই তাদের ঘরানায় আগাতে পছন্দ করে। বিপ্লবের উদ্দেশ্য তাদের ছিলো। তবে তা নিঃসন্দেহে অগোছালো বা কাঁচা কোনো পরিকল্পনা নিশ্চিত নয়। আমার কাছে তাদেরকে সবসময়ই লাতিন আমেরিকার ফুটবল খেলার মতো মনে হয়। ম্যাচ হেরে গেলেও তারা তাদের স্টাইল বদলাবে না। একটা ম্যাচ হারলে তাদের কিছু আসে যায় না। তাই বলে ইউরোপের ফুটবলের মতো এক ম্যাচে বার বার কৌশল পরিবর্তন লতিনদের পছন্দ নয়। আর মাথায় রাখতে হবে বিপ্লব রাশিয়ায় হলেও বড় বড় বিপ্লবী যেমন চে গেভেরা, সিমন বলিভার কিন্তুু লতিন আমেরিকারই মানুষ। নেতার সাথে স্টাইলের একটা মিল বরাবরই পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষও কিন্তুু ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত শেখ মুজিবের মতো করে ভাবতো। আর এ জন্যেই আমাদের পক্ষে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হয়েছিল। আমরা মূলতঃ ধরতে চেয়েছিলাম এর ফাঁক দিয়ে সমাজতন্ত্রীরা কখন ঝরে গেলো সেই সংকট কালকে।
১৯৭৩ সালে এসে নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা পেলেও জনপ্রিয়তায় যে ভাটার টান ছিলো তা সবাই বুঝতে পারছিল। দেশ বিদেশের নানা জরিপেও তার প্রতিফলন ছিলো। যদিও ইতোমধ্যে জাসদ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা জাতীয় রাজনীতির ব্যারোমিটারে তেমন কোন প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে হয় না। সমস্যা ছিলো অন্যত্র। মুজিবও সেটা জানতেন। তিনি স্টাইলের পরিবর্তন করলেন। ১৯৭৪ এ এসে বুঝলেন হাড় হাভাতে বাঙ্গালীর জন্যে আব্রাহাম লিংকনের “গভর্ণমেন্ট অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল” কাজ করবে না। এদেরকে সামলানোর জন্য খোয়াড়ে ঢোকাতে হবে। সেই খোয়াড়ের নাম বাকশাল। কিন্তু বাঙ্গালী খোয়াড়ে ঢুকতে চাইল না। তারা বিকল্প চিন্তুা করতে শুরু করলো। তারা ওঁৎ পেতে রইল কি হয় দেখার জন্যে। শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হলো। ইতিহাস সাক্ষী সমাজতন্ত্রীদের জন্যে বাংলাদেশের মাটিতে মুজিবের পর তার চেয়ে আর কোনো ভালো বন্ধু পাওয়া যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিব নিহত হলো। তখনও তারা পুরোপুরি বুঝতে পারেনি তাদের কতো বড়ো সর্বনাশ হয়ে গেছে। পরবর্র্তিতে যখন ৭ই নভেম্বরের আবির্ভাব হলো তারা আবারও নির্বোধের মতো ভূমিকা গ্রহণ করলো। এদিনে এসে তারা আবারও প্রমান করল যুদ্ধের কৌশল আর রাজনীতি এক জিনিস নয়। যুদ্ধের ময়দানে সামনের শত্রুকে মারতে হয়। রাজনীতিতে মারতে হয় ভবিষ্যতের শত্রুকে। তারা খালেদ মোশাররফকেই হজম করে ফেলল। শেষ আশ্রয়। খাঁচা ভেঙ্গে বাঘ বের করে আনল। সেই বাঘ তাদের সদল বলে খেয়ে ফেলল। নির্বুদ্ধিতার ফলাফল এমনই হয়। রাজনীতি দেখে দেখে শেখা যায় না। রাজনীতিতে প্রত্যেকে সিদ্ধান্তই নতুন। এখানে মাথা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সামরিক সদস্যরা বরাবরই সেই ভুলটাই করে। কতিপয় মাথা গরম সামরিক অফিসার জাতির জনককে হত্যার মতো একটা নারকীয় সিদ্ধান্ত নেয়। কতিপয় সামরিক সদস্য সেই ঘোলাজলে মাছ শিকারের সিদ্ধান্ত নেয়। শেষমেষ সবাই ব্যর্থ হয়। মাঝখান দিয়ে একটা স্বাধীন সোনার বাংলার স্বপ্ন বেহাত হয়ে যায়। প্রায় পনেরোটি বছর জাতি হাবুডুবু খায়। অতঃপর একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল যা নতুন আলোচনার দাবী রাখে। কিন্তু আমরা সেই পথে না গিয়ে বামদের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির সামনে যে সব চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো জাতি আগামী দিনে কোন গতিধারায় পরিচালিত হবে। প্রথম যে প্রশ্নটা আসে বাংলাদেশ কি সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অর্šÍভূক্ত হবে নাকি গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী পৃথিবীর অধীন হবে। মুসলিম বিশ্বের বলয়ে চলে যাবে নাকি ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে ভারতের ছায়ায় অবস্থান করবে। সবচেয়ে বড় একটা বিষয় বাংলাদেশের জন্মের পূর্বে ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের ঘোষণায় পরিস্কার করা হয়েছিল পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান। কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব। কিন্তু এই জানানোতেও শেষ রক্ষা হয়নি। অভ্যন্তরীন প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপগুলোর পাশাপশি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানও ওঁৎ পেতে থাকে সদ্যোজাত রাষ্ট্রটির সাথে সম্পর্ক কেমন হবে। পাশাপাশি তাকিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুশীলবরা। এর মধ্যে প্রথমেই আসে কূটনৈতিক ভাবে পরাজিত আমেরিকার কথা। পাকিস্তানের সমর্থক মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী শক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীও হাত বাড়ায়। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়া জোগাড়। এই যখন পরিস্থিতি তখন দেশের ভেতরেও নানা মত নানা পথের লোকের অভাব হয় না। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসম্মানবোধ, পাকিস্তান ফেরত বন্দী সৈন্যদের মর্যাদার প্রশ্ন, সাধারন খেঁটে খাওয়া মানুষের দুবেলা দুমুঠো অন্ন, বস্ত্রের চিন্তা। সবকিছুর মাঝখানে মুজিব একা একটা নিঃসঙ্গ চিতা। ভাবলে অবাক লাগে তিনি কিভাবে পুরো পরিস্থিতিটা সামলেছেন। অবশ্য সামলাতে তিনি পারেননি শেষ পর্যন্ত। মরেছেন। অনেকেই বলেছেন মুজিব কে এ মেরেছে ও মেরেছে। আসলে বাস্তবতা আরও জটিল। আমরা কেউ কি বুঝতে চেয়েছি একা একটা মানুষের কাঁধে পুরো জাতির বোঝা। উনি যাবেনটা কোথায়। বাঙ্গালীর মেধা শূন্যতা আবারও প্রমানিত হলো। আমরা শরীরি মুজিবকে সরিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতির উত্তরণ চাইলাম। কিন্তু সেটা যে কতো বড় ভুল ইতহাস তা প্রমান করেছে। আজও মুজিবের বিকল্প নাই। লক্ষ বছরেও হবে না। রাজনীতির মহাকবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অমর রূপকার মুজিব শুধু একজনই। গোটা জাতিকে কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো এতোটা প্রশস্ত কাঁধ যদি আর দ্বিতীয়টি থাকত তাহলে সেই কাঁধে ভর করে জাতি আরও অনেক আগেই স্বাধীনতার মুখ দেখত।
মুজিব নিহত হওয়ার পর চার দশক গড়িয়ে গেছে। বাঙ্গালী জাতির ভাগ্য ভাল দীর্ঘ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ আবার তারা আলোর মুখ দেখছে। উন্নয়নের জোয়ার দেখছে। তাও সেই মুজিবের উত্তরসূরীর কাঁধে ভর করে। শেখ হাসিনা আজ শুধু বাংলাদেশের আশা আলোর প্রতীকই নন। গোটা বিশ্বের জন্য আলোক বর্তিকা। শেখ হাসিনাই পারলেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ সফল করতে। বাকীরা শুধু মুখে বলেই খালাস।
যে আলোচনায় ছিলাম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং তার মোকাবেলায় রাজনীতিতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর একটা ছোট খাট রূপরেখা তুলে ধরতে চাই এজন্যে যে এর মধ্যে কোন ফাঁক গলিয়ে কি যে ঝরে গেল তা কিছুটা হলেও বোঝা যাবে। মুজিবকে যারা সেই ষাটের দশক থেকে বিদ্যা বুদ্ধি সঙ্গ দিয়ে ঘিরে রেখেছিল তার মধ্যে রাজ্জাক, তোফায়েল, সিরাজুল ইসলাম, রব, তাজউদ্দিন, কামাল হোসেন প্রমুখরা উল্লেখযোগ্য। কিন্তুু ভেঝাল হলো যুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলোতে। মুজিব সব দিক বিবেচনায় তাদের প্রত্যাশার হাতে দেশকে ছেড়ে দিতে পারলেন না। তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের উপর তিনি ভরসা রাখতে পারলেন না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ২রা মার্চ যারা তার হাতে বাংলাদেশের পাতাকা তুলে দিয়েছিলেন তারা দিশেহারা হয়ে গেলেন। কেউ কেউ খেই হারিয়ে মুজিবকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। আর যায় কোথায়। সিরাজ সিকদার তো রাতারাতি হিরো বনে গেলেন। কিন্তু ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র বড়। তাকে সরে যেতে হলো। পরিস্থিতি ঘোলাটে হলো। কিন্তুু সমাধান হলো না। ১৯৭২ এ এসে যখন জাসদের জন্ম হয় তখনও কিন্তু কোনো অসুস্থ মনোভাব ছিলো না। সমাজতান্ত্রিক দলগুলো সব সময়ই তাদের ঘরানায় আগাতে পছন্দ করে। বিপ্লবের উদ্দেশ্য তাদের ছিলো। তবে তা নিঃসন্দেহে অগোছালো বা কাঁচা কোনো পরিকল্পনা নিশ্চিত নয়। আমার কাছে তাদেরকে সবসময়ই লাতিন আমেরিকার ফুটবল খেলার মতো মনে হয়। ম্যাচ হেরে গেলেও তারা তাদের স্টাইল বদলাবে না। একটা ম্যাচ হারলে তাদের কিছু আসে যায় না। তাই বলে ইউরোপের ফুটবলের মতো এক ম্যাচে বার বার কৌশল পরিবর্তন লতিনদের পছন্দ নয়। আর মাথায় রাখতে হবে বিপ্লব রাশিয়ায় হলেও বড় বড় বিপ্লবী যেমন চে গেভেরা, সিমন বলিভার কিন্তুু লতিন আমেরিকারই মানুষ। নেতার সাথে স্টাইলের একটা মিল বরাবরই পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষও কিন্তুু ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত শেখ মুজিবের মতো করে ভাবতো। আর এ জন্যেই আমাদের পক্ষে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হয়েছিল। আমরা মূলতঃ ধরতে চেয়েছিলাম এর ফাঁক দিয়ে সমাজতন্ত্রীরা কখন ঝরে গেলো সেই সংকট কালকে।
১৯৭৩ সালে এসে নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা পেলেও জনপ্রিয়তায় যে ভাটার টান ছিলো তা সবাই বুঝতে পারছিল। দেশ বিদেশের নানা জরিপেও তার প্রতিফলন ছিলো। যদিও ইতোমধ্যে জাসদ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা জাতীয় রাজনীতির ব্যারোমিটারে তেমন কোন প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে হয় না। সমস্যা ছিলো অন্যত্র। মুজিবও সেটা জানতেন। তিনি স্টাইলের পরিবর্তন করলেন। ১৯৭৪ এ এসে বুঝলেন হাড় হাভাতে বাঙ্গালীর জন্যে আব্রাহাম লিংকনের “গভর্ণমেন্ট অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল” কাজ করবে না। এদেরকে সামলানোর জন্য খোয়াড়ে ঢোকাতে হবে। সেই খোয়াড়ের নাম বাকশাল। কিন্তু বাঙ্গালী খোয়াড়ে ঢুকতে চাইল না। তারা বিকল্প চিন্তুা করতে শুরু করলো। তারা ওঁৎ পেতে রইল কি হয় দেখার জন্যে। শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হলো। ইতিহাস সাক্ষী সমাজতন্ত্রীদের জন্যে বাংলাদেশের মাটিতে মুজিবের পর তার চেয়ে আর কোনো ভালো বন্ধু পাওয়া যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিব নিহত হলো। তখনও তারা পুরোপুরি বুঝতে পারেনি তাদের কতো বড়ো সর্বনাশ হয়ে গেছে। পরবর্র্তিতে যখন ৭ই নভেম্বরের আবির্ভাব হলো তারা আবারও নির্বোধের মতো ভূমিকা গ্রহণ করলো। এদিনে এসে তারা আবারও প্রমান করল যুদ্ধের কৌশল আর রাজনীতি এক জিনিস নয়। যুদ্ধের ময়দানে সামনের শত্রুকে মারতে হয়। রাজনীতিতে মারতে হয় ভবিষ্যতের শত্রুকে। তারা খালেদ মোশাররফকেই হজম করে ফেলল। শেষ আশ্রয়। খাঁচা ভেঙ্গে বাঘ বের করে আনল। সেই বাঘ তাদের সদল বলে খেয়ে ফেলল। নির্বুদ্ধিতার ফলাফল এমনই হয়। রাজনীতি দেখে দেখে শেখা যায় না। রাজনীতিতে প্রত্যেকে সিদ্ধান্তই নতুন। এখানে মাথা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সামরিক সদস্যরা বরাবরই সেই ভুলটাই করে। কতিপয় মাথা গরম সামরিক অফিসার জাতির জনককে হত্যার মতো একটা নারকীয় সিদ্ধান্ত নেয়। কতিপয় সামরিক সদস্য সেই ঘোলাজলে মাছ শিকারের সিদ্ধান্ত নেয়। শেষমেষ সবাই ব্যর্থ হয়। মাঝখান দিয়ে একটা স্বাধীন সোনার বাংলার স্বপ্ন বেহাত হয়ে যায়। প্রায় পনেরোটি বছর জাতি হাবুডুবু খায়। অতঃপর একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল যা নতুন আলোচনার দাবী রাখে। কিন্তু আমরা সেই পথে না গিয়ে বামদের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
Comments
Post a Comment