Skip to main content

Setara bibi under the lamp post - Literature - observerbd.com

Setara bibi under the lamp post - Literature - observerbd.com : The glittering city aroundLife is rich with red, blue light of neonWide sky over the headPieces of moonlight, scatteredAnd in that splashed pieces of meteorThose are taken by the scientists of NASASo height the civilization reachesThis city is the flow of happiness nowSome men like us pass the wayWith frustration

বলেশ্বরের তীরে

পটভূমি

    বলেশ্বরের পাশ ঘেঁষে ছোট্ট একটি গ্রাম। বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামের মতই এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শোভা। এর মানুষগুলোও একই বৈশিষ্ট্যের। একই ধরনের জটিলতার আবর্তে আবর্তিত এখানকার মানুষের জীবন। চিরচেনা গ্রামীন জীবনের নোংরা রাজনৈতিক আবহের মধ্য দিয়েই তাদের বেড়ে ওঠা। এই গ্রামেরই একটি ছেলে আর একটি মেয়ে সমস্ত ব্যবধাকে তুচ্ছ করে ভালোবেসে ফেলে দুজন দুজনকে। কিন্তু প্রেমের পথ সব সময়ই বন্ধুর। এ পথে চলতে গেলে তাই প্রায়শঃই হোঁচট খেতে হয়। জড়িয়ে পড়তে হয় অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনায়। হয়তবা শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েই দিতে হয় প্রেমের দাম। এমনি একটি হৃদয় বিদারক সত্যি ঘটনা অবলম্বনে এই কাহিনী যার প্রতিটি অংশই মর্মস্পর্শী।



 ....................................................................
 

যে কথা না বললেই নয়

ঊনিশশো সাতাশি সালে আমি যখন নবম শ্রেনীর ছাত্র তখন একটা অচেনা লোককে আমাদের এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। তার মুখ এতটাই শুকনো ছিল যে সে যে বেঁচে আছে তা বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। অদ্ভুত লোকটি তাই আমার মনোযোগ কেড়েছিল। কিন্তু সে আমাকে তষনও লক্ষ্য করেনি। সে যে এ এলাকায় বেড়াতে এসেছে এবং সেটা যে আশেপাশের কোন বাড়ীতেই তা তার সাথে ঘন ঘন মুখোমুখি হওয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। আমার সময়গুলো পড়াশুনার ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই কেটে যেত। তবু বিকেল বেলাটায় চেষ্টা করতাম খানিকটা সময়ের জন্যে হলেও বের হওয়ার। আর তখনি লোকটার সাথে দেখা হয়ে যেত। তাকে যার সাথে প্রায়ই দেখতাম তার সাথে আমার সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও চেনা জানা ছিল। একদিন বিকেল বেলা ঘুরতে ঘুরতে আমরা  আবারও মুখোমুখি হলাম। সেদিন এতটাই কাছকাছি হয়ে গিয়েছিলাম যে ভদ্রতার খাতিরেই হোক আর নিতান্ত দায়ে পরেই হোক কথা হওয়াটাই স্বাভাবিক। অচেনা মানুষটির সাথের চেনা মানুষটিই প্রথম কথা বলল। অচেনা লোকটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত মুঠোর মধ্যে টেনে নিলাম। শুকনো কাঠের মত প্রাণহীন সেই হাত আমার হাতের মুঠোয় এতটাই নি®প্রান মনে হয়েছিল যে জীবনে ওরকম অনুভূতি আমার ঐ প্রথম।

এই প্রথম তার মুখে হাসি দেখলাম। সামান্য কথাবার্তা হল। এক পর্যায়ে আমি তাকে জানালাম যে যেহেতু এখন জ্যোৎস্না রাত এবং বেশ গরমও পড়ছে সেহেতু সন্ধ্যার পর আমরা কোন একটা খোলামেলা জায়গায় বসে গল্প করতে পারি। সে রাজি হল ।আমি খুশী হলাম। কারণ ঐ সামান্য সময়ের আলাপেই তার প্রতি আমার আগ্রহ বহু গুন বেড়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে আসলেই এমন কিছু ছিল যা অন্যকে আগ্রহী করে তুলতে পারে। আমার আগ্রহও তাই ছিল স্বাভাবিক। আসলে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কথা বললেই তাদের হৃদয়ের ঐশ্বর্য প্রকাশ পেয়ে যায়। তাতে তারা যতই বিনয়ী হতে চেষ্টা করুক সেটা যেন তাদের মহৎ হৃদয়কে আরও বেশী প্রকাশ করে। সেই লোকটিও ছিল ঐসব বিরল মানুষদের একজন।

সন্ধ্যার বেশ খানিকটা পরেই সে চলে এল। সাথে চেনা মানুষটিও । আমি রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে নির্ধারিত জায়গায় ফিরে এলাম। তারা জানাল যে তারাও এই মাত্র এসে পৌঁছেছে। আমরা তিনজন গোল হয়ে বসলাম। আমাদের কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলে। সাধারণ সব প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। এই যেমন সে আমাকে বলল যে সন্ধ্যার পর আড্ডা দেওয়ায় আমার পড়াশুনা ক্ষতি হবে কি-না কিংবা বাড়ীর কেউ মন্দ বলবে কি-না ইত্যাদি। আমি তাকে জানালাম যে মাঝে মাঝে এমনটা হতেই পারে আর এটা কোন ব্যাপারই না । এভাবে নানা কথার মধ্য দিয়ে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল আস্তে আস্তে। হঠাং করেই আমার পূর্ব পরিচিত মানুষটি বলে উঠল-
- তোমরা আড্ডা দাও। আমার একটু উঠতে হবে। একটা জরুরী কাজ আছে। কিছু মনে করো না।
আমি তাকে ভদ্রতার খাতিরেই আরও খানিকটা সময় বসার অনুরোধ জানালাম। সে বলল-
-  কাজ সেরে এসে ওনাকে নিয়ে যাবো। তখন আরও কিছুক্ষন বসা যাবে।

     আমরা তাকে বিদায় জানালাম। সে চলে যেতেই আমরা দুজন নড়ে চড়ে বসলাম।আসলে মনে মনে আমি এই অচেনা মানুষটি, যে অল্প সময়ের মধ্যেই ভীষন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তার সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে চাইছিলাম। এবার দু’জন হওয়ায় আড্ডা জমে উঠল। সে জ্যোৎস্নালোকিত আকাশের বুকে ঝলমলে রূপালী চাঁদের পানে তাকালে পেছনের দিকে দুহাতের উপর ভর রেখে অনেকটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসার ভঙ্গিতে। তারপর মাথা নামিয়ে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার শীর্ণকায় শরীরের পাতলা বুকটা যেন কেঁপে উঠে সংকুচিত হয়ে আরও শীর্ণকায় হয়ে গেল। আমি গভীর মনোযোগে তাকে লক্ষ্য করছিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় জানতে চাইল - পড়াশুনার পাশাপাশি আপনি কি অন্য কিছু করেন অর্থাৎ খেলাধূলা কিংবা অন্য কিছু। আসলে আপনি আপনার অবসরটা কিভাবে কাটান?

সে বয়সে আমার খানিকটা বড়ই হবে। হয়ত বা বছর চারেক। যদিও বিশেষ কোন কারণে তাকে ভীষণ রোগা আর বেশ খানিকটা বেশী বয়সীই মনে হচ্ছিল। আমি তাই অত্যন্ত বিণয়ের সাথেই বললাম-
- দয়া করে আমাকে তুমি করে বলবেন। আমি বয়সে আপনার ছোট।
- এটা কোন ব্যাপার না। প্রথম প্রথম আপনি সম্বোধনটায় খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা যায়। তাতে সে ছোটই হোক আর বড়ই হোক।
- পড়াশুনার পাশাপাশি আমি মাঝে মাঝে সামান্য খেলাধূলা করি। বাকি সময়টা লেখালেখি করি।
- আপনি লেখালেখি করেন। সত্যিই?
- হ্যাঁ। টুকটাক লেখালেখি করি।
- কি কি লেখেন?
- কবিতা লিখতেই ভালো লাগে। তবে গল্প বা উপন্যাস লেখারও চেষ্টা করি।
- এই বয়সে আপনি যখন এতটা এগিয়ে গেছেন তাতে আশা করা যায় আপনি একদিন ভালো লেখক হবেন।
- দোয়া করবেন। যেন তাই হতে পারি। লেখালেখির প্রতি আমার ভীষণ দুর্বলতা। অনেকটা রক্তে মেশানো নেশার মত। আমি ভালো লেখক হতে চাই।
- দোয়া তো করবোই। তবে আপনাকেও চেষ্টা করতে হবে। জীবন থেকে শিখতে হবে অনেক কিছু। সব কিছু বইয়ের পাতায় পাওয়া যায় না। কারন সবকিছু লেখা হয় না। তাই যা যা লেখা হয় তা-ই শুধু বইয়ের পাতায় পাওয়া যায়। এটা সীমিত ব্যাপর। তাছাড়া সবকিছু কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়।
তা হয়ত যায় না। আপনি ঠিকই বলেছেন।
- আপানার আপত্তি না থাকলে আমি আপনাকে একটি ঘটনা বলতে পারি যা হয়ত আপনার কাজে আসতে পারে। আসলে আমিও চাই কাহিনীটা কেউ একজন যদি লিখত তাহলে হয়ত মনে মনে কিছুটা শান্তি পেতাম ।
- আপনি বলতে পারেন। আমার আগ্রহ আছে।
- বেশী রাত হলে আপনার সমস্যা হবে না তো ?
- এটা আমার এলাকা । তাছাড়া এখান থেকে সামান্য দূরেই আমার বাড়ী। সমস্যা হওয়ার কোন কারণ নেই।
- ঠিক আছে। আমি তাহলে ঘটনাটা আপনাকে বলতে পারি।
- অবশ্যই পারেন।
         তিনি খানিকটা ইতস্ততঃ করলেন। তারপর কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মেশানো কন্ঠে বললেন -
- কিভাবে যে শুরু করি। একটা কাহিনী যা আসলে দীর্ঘ সময়ের তাকে হঠাৎ গুছিয়ে বলাটা বেশ কষ্টের। তবুও শুরু করছি। আমি আসলে এরকম ছিলাম না। এই মানে এতটা রোগা। খুব সুদর্শন না হলেও মোটামুটি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলাম। কিন্তু একটা বিশেষ ঘটনার পর সবকিছু অন্য রকম হয়ে যায়।
- কি সেই ঘটনা ? আমি অধীর আগ্রহে জানতে চাইলাম।
- আমার এক বন্ধু ছিলো। তার নাম নিয়াজ।..........
সে কাহিনী বলতে শুরু করল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে লাগলাম। প্রিয় পাঠক, আমি এই গল্প কথকের কোন পরিচয় এখানে তুলে ধরিনি। আশাকরি মূল গল্পে প্রবেশ করে আপনারাই তা অনুধাবন করতে পারবেন।
                                                                                             

 
.........................................................................



দিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু মাঠ। মাঠের শেষে গ্রাম। সবুজ বনানী যেন এখানে নিবিড়তর। এরই মাঝে গ্রামবাসীদের সাদা মাটা ঘর-বাড়ী। অতি সাধারণ তাদের জীবন। অনেকটা গতিহীন, গতানুতিক। এ যেন শাশ্বত বাংলার এক খন্ড চিত্র। আবহমান পল্লীর প্রতিনিধি । একদিন এসব গ্রাম ছিল ঐশ্বর্যশালী। এখন অবশ্য ভিন্ন চিত্র। অভাব-অনটন এখন এখানে নিত্যসঙ্গী। আধুনিকতা বিবর্জিত এই সব অবহেলিত পল্লীর মানুষগুলো যে খুব একটা সহজ-সরল তা কিন্তু নয়। বরং ক্ষুধা আর দারিদ্র তাদেও জীবনকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে প্রতিদিন। তুচ্ছ কারণেই তারা হিংসা আর হানাহানিতে মেতে ওঠে। সামান্য স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই তারা একে অন্যের উপর হাতিয়ার ধরে। স্বপ্নের সেই পল্লী আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
 
সব কিছুকে ছাপিয়ে এদের মাথার উপর রয়েছে কিছু কিছু প্রভাবশালী মানুষ। সাধারন মানুষের কাছে এরা যেন অঘোষিত স্বৈরশাসক। এদের মধ্যে কেউ চেয়ারম্যান, কেউ মেম্বার, কেউ মহাজন। কেউবা আবার স্রেফ লাঠিয়াল। মোজাহের চেয়ারম্যান এদেরই একজন প্রতিনিধি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই ইউনিয়নটির চেয়ারম্যান। ক্ষমতাশালী এই ব্যক্তিটি মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধার নন। তার মেয়ে নীতু। অত্যন্ত সহজ-সরল, সাদা-মাটা মনের মেয়ে। তার ভাসা ভাসা চোখ দুটোতে ভালোবাসার ভাষা সারাক্ষনই যেন আলো ছড়ায়। সেই আলোতে আলোকিত হয় একটি যুবকের হৃদয়।তার নাম নিয়াজ। পাশপাশি বাড়ী হওয়ায় তারা দুজন আশৈশব বন্ধু। সেই বন্ধুত্বের বৃক্ষে যৌবনের ঊষালগ্নে ভালোবাসার রঙিন ফুল ফোটে। তার সুবাস দুজনকেই করে মাতোয়ারা। আসমানের চাঁদ আর সূর্যকে সাক্ষী রেখে হাতে হাত রাখে তারা। কথা দেয় দুজন দুজনকে। বুকের ভিতরের গোপন চাওয়া ভালোবাসার ভাষায় হয়ে ওঠে বাঙময়। নদীর স্রোতের মত তাদের আবেগ যেন  সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। এ অনুভূতি অবশ্য তাদের নিজস্ব। অন্য কেউ এসবের বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারে না। ভালোবাসা জানাজানি হলে তা পথ হারাবেই। আসবে নানা সমস্যা। স্বাভাবিক গতিপথ ছেড়ে তা তখন প্রবাহিত হবে ভিন্ন খাতে, ভিন্ন পথে। তারাও এটা বোঝা । তাই তারা সাবধান। অত্যন্ত সাবধান। কিন্তু এর পরও কিছু কিছু প্রিয়জন সবারই থাকে যাদেরকে হৃদয়ের গোপন কথা জানাতে হয় সংগত কারনেই। আসলে তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু জানাজানির মধ্যেই নয়। তারা মিশে যায় ঘটনার মূল স্রোতে। কেউ কেউ বাড়িয়ে দেয় সহযোগিতার হাত। আবার কেউ কেউ করে প্রতারণাপূর্ণ আচরণ।

নিয়াজের কাছে নান্টু যেমন তেমনি নীতুর কাছে সুজাতা। নান্টু নিয়াজের বন্ধু। শুধু বন্ধু বললে কম বলা হয়। নান্টু তার চেয়েও বেশি কিছু। দুটিতে যেন মানিক জোড়। সুজাতাও তেমনি নীতুর বান্ধবী। ওরাও ভীষণ ঘনিষ্ঠ। প্রাথমিক বিদ্যালয়েও নিয়াজ আর নীতু এক সঙ্গেই পড়াশুনা করেছে। কিন্তু হাইস্কুলে এসে নিয়াজ যেমন খুঁজে পেয়েছে নান্টুকে নীতু তেমনি সুজাতাকে । তারা কেউ কাউকে ছাড়া একটা মুহুর্তও ভাবতে পারে না। তারা সবাই সবার হৃদয়ের অনেক কথাই জানে। পড়াশুনার পাশাপাশি নির্মল বন্ধুত্ব তাদেরকে অনাবিল আনন্দ দেয়। সময়ের স্রোতে এগিয়ে যেতে থাকে ঘটনা প্রবাহ । হাইস্কুলে পড়–য়া কয়েকটি কিশোর-কিশোরীর আনন্দঘন প্রতিটি দিনই যেন এক একটি স্বর্ণকনা।

কোলাহল মুখর স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে নীতু আর সুজাতা। আসলে তারা অপেক্ষা করছে নিয়াজ আর নান্টুর জন্য। ওরা এখনও আসেনি। কারো আসতে একটু দেরী হলেই ছটফট করে অন্যরা। পাশাপাশি বাড়ী হওয়ায় নিয়াজ আর নীতু প্রায়ই একত্রে আসে। নান্টু আর সুজাতাও আসে একত্রে। কারণ ওরা দুজনও একই এলাকার। কিন্তু আজ নীতু যেমন একা এসেছে তেমনি সুজাতাকেও একা আসতে হয়েছে। নিয়াজ বা নান্টু কারোরই পাত্তা পাওয়া যায়নি। দুই বান্ধবী পরস্পরকে ব্যাপারটা জানালো। খানিকটা ভাবনায় পড়ল তারা। ওরা দুজন তাহলে গেল কোথায়। দুই বান্ধবী যখন নানা কথা ভাবছিল তখনই মানিক জোড়ের উদয় হলো। হাসতে হাসতে নিয়াজ আর নান্টু এসে দাঁড়ালো নীতু আর সুজাতার সামনে। দুই বান্ধবী অভিযোগের সুরে একটি কথাই বলল - কোথায় গিয়েছিলি!

দুই বন্ধুর মুখেই রহস্যময় হাসি। ওদের হাসতে দেখে নীতু আর  সুজাতা খানিকটা বিরক্ত হলো। এদিকে তারা ওদের নিয়ে ভাবনায় অস্থির আর ওদিকে ওদের মুখে হাসি। শেষ পর্যন্ত নিয়াজই মুখ খুলল-
- শোন্। আমরা দুজন ঠিক করেছিলাম আজ তোদের সাথে স্কুলে আসব না।
- কেন? নীতু জিজ্ঞেস করল।
- কোন কারণ নেই। নান্টু বলল।
- তাহলে! সুজাতার কন্ঠে বিরক্তি।
- তাহলে আবার কি। তোদের অমন সুন্দর মুখ দুটো যাতে বাংলা পাঁচের মত হয় তার জন্য। নিয়াজের মুখে দুষ্টু হাসি।
- ইস্! কি আমার নাগর। তার জন্য আবার আমাদের মন খারাপ হবে। মোটেই না। নীতু স্পষ্ট জানিয়ে দিল।
- ওহ্। বুঝেছি তাহলে। আমরা ছাড়াও তোদের আরও নাগর আছে।
- বাজে কথা বলিস না নিয়াজ। একটা চড় খাবি। নীতুর মুখটা হঠাৎই ভারী হয়ে আসে। সবাই বুঝতে পারে নীতু কষ্ট পেয়েছে।
- সরি নীতু। আর কখনও এমন হবে না। নিয়াজ আশ্বস্ত করে।
- তোরা একটু দাঁড়া। আমরা একটু আসছি।
- আবার কোথায় যাচ্ছিস। সুজাতা বলে।
- বললাম তো আসছি। একটু দাঁড়া। নান্টুর কন্ঠে দৃঢ়তা।
- রাগ করিস না। যাবো আর আসবো। নিয়াজ যোগ করে।

দুই বন্ধু হাঁটতে শুরু করে। স্কুল গেটের বাইরে বের হয়ে বাজারের দিকে এগিয়ে যায়। একটা কনফেকশনারী দোকান থেকে চানাচুর আর বিস্কুট কেনে। তারপর দুই বন্ধু স্কুলের দিকে হাঁটতে শুরু করে। দুই বান্ধবী তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তারা তাদের দুই বন্ধুর মতিগতি বুঝে উঠতে পারে না। দুজন দুজনকে বলে-

- আজ ওদের হয়েছেটা কি? মনে হয় ভূতে পেয়েছে। কথা বার্তা যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন আবার কোথায় গেল।

ওরা যখন এসব ভাবছিল তখনই নিয়াজ আর নান্টু এসে হাজির। ওদের দুজনের হাতে দুটো প্যাকেট। দুজন দুটো প্যাকেট দুই বান্ধবীর হাতে দিল। খুব খুশী হলো নীতু আর সুজাতা। তাদের মুখে হাসি ফুটল। সবাই মিলে একত্রে চানাচুর আর বিস্কুট খেতে শুরু করল। স্কুল ছুটি হলে চারজন একত্রে বের হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর নান্টু আর সুজাতা আলাদা হয়ে যায়। নীতু আর নিয়াজ পাশাপাশি হাঁটতে থাকে বাড়ীর উদ্দেশ্যে। নিয়াজ বরাবরই ভীষণ দুষ্ট। নীতুকে মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্ত করে। নীতু বিরুক্ত হয় না। সে জানে নিয়াজ এমনই। মুখ টিপে হাসে। তাতে নিয়াজ আরও মজা পায়। সে আরও বেশী বেশী দুষ্টুমী করে। নীতু ভারী গলায় বলে-

- নিয়াজ। থাম তো। এখন বড় হয়েছিস। এত দুষ্টুমী করিস কেন?
- নিশ্চয়ই বুড়ো হয়ে যাইনি।
- তাই বলে কি অমন বাঁদরের মত নাচানাচি করতে হবে।
- তুই আমাকে বাঁদর বললি।
- ঠিকই বলেছি। তুই অমন লাফালাফি করলে আমি ঠিক তাই বলব।
- তোর সাথে কথা নেই।

নিয়াজ নীতুকে ফেলে সোজা হাঁটতে থাকে। নীতু বার বার নিয়াজকে ডাকে। কিন্তু নিয়াজ ফিরে তাকায় না। পথের বাঁকে হারিয়ে যায়। নীতুর তখন কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করে। মনে মনে ভাবে নিয়াজটা এমন কেন? এত পাগল হয় কোন মানুষ। ওকে নিয়েই তার যত জ্বালা। সে হাঁটতে থাকে একা একা। পথটাকে তার মনে হয় অত্যন্ত দীর্ঘ আর প্রশস্ত। নিজেকে মনে হয় ভীষণ ভারী একটা পদার্থ। তার মুখ যেন বিবর্ণ আর ফ্যাকাশে। কেবল মৃত মাছের মুখের সাথেই যার তুলনা চলে।

নিয়াজ লুকিয়ে থাকে একটা গাছের আড়ালে। হঠাৎ করে বের হয়ে নীতুকে চমকে দেয়। নীতু খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু খুশী হয় ভীষন। নিয়াজ হাসতে হাসতে বলে-
- কি রে, রাগ করেছিস ?
- হুঁ ! তুই আমাকে ফেলে আসলি কেন ?
- আর কখনও আসব না। নিয়াজ হেসে বলে।
- তুই কথা রাখিস না। দেখিস একদিন তোর এই পাগলামীর জন্যই আমাকে মরতে হবে। সত্যিই মরতে হবে।
- আমি তোকে মরতে দিলে তো।
- সত্যি বলছিস ?
- হ্যাঁ। সত্যিই। দুজন আবারও পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। একটু দূরেই তাদের বাড়ী।

নীতুর ফুফাত ভাই মালেক। নীতু তাকে মালেক ভাই বলে ডাকে। তার একমাত্র ফুফুর একমাত্র ছেলে। বয়সে সে নীতুর চেয়ে অনেক বড়। তবুও তার ফুফুর ইচ্ছে তার ছেলে মালেকের সাথেই নীতুর বিয়ে দেবে। ফুফু যখন একথা বলে তখন নীতুর বাবা মোজাহের হাসি হাসি মুখ করে বলেন-

নীতুর তখন সারাটা শরীর জ্বলে উঠে। রাগে, ক্ষোভে সে ঐ জায়গা ছেড়ে আস্তে উঠে যায়। তখন মোজাহের সাহেব বোনকে বলেন-

তোর কথায় মা আমার লজ্জা পেয়ে উঠে গেছেরে বকুল। তুই কেন যে ওর সামনে এসব কথা বলিস । ছোট মেয়ে । লজ্জা পায়।

      সবাই হেসে উঠে। মোজাহের সাহেবের স্ত্রী আমেনা বেগম হাসতে হাসতে বলেন-
- মেয়ে মানুষের ভাগ্য হলো গিয়ে স্রোতে ভাসা শ্যাওলার মত। পরের ঘরে তাকে যেতেই হবে। সে ঘর যে কোন ঘর হবে তা আল্লাহ্ই জানে। যদি ভাগ্যে থাকে তো সে তোমার ঘরে বউ হয়ে যেতেও পারে।
- তোমার কি আপত্তি আছে ভাবী ? বকুল ব্যাকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে।
- আমি কি বলেছি যে আমার আপত্তি আছে। আল্লাহ্র হুকুমও তো থাকতে হবে। তার হুকুম থাকলে ঠিক ঠিক হবে। হুকুম না থাকলে চাইলেও হয় না। সব কিছু নির্ভর করে তার উপর।
- তুমি দোয়া করো ভাবী যেন আমাদের ইচ্ছা পূরণ হয়। আমরা চাই ওরা সুখী হোক।
- সবই আল্লাহ্র ইচ্ছা।

- পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে নীতুকে কেমন যেন একটু ভারী মনে হয়। নিয়াজ বুঝে উঠতে পারে না হঠাৎ করে নীতুর আবার কি হলো। তাই সে নীতুকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে-
- তোর কি মন খারাপ নীতু ?
- হ্যাঁ। নীতুর সংক্ষিপ্ত জবাব।
- কেন ? কি হয়েছে ?
ফুপু খুব বাড়াবাড়ি করছে। তার ছেলে মালেক ভাইয়ের জন্য আমাকে বউ করে নেবেই। কথাবার্তা শুনে মনে হল আব্বা-আম্মাও শেষ পর্যন্ত তাই করবে। আব্বার যেহেতু পূর্ণ সম্মতি আছে সেহেতু আম্মার খানিকটা অমত থাকলেও আব্বার ভয়ে সে মুখ খুলে কিছু বলতেও সাহস পাবে না। মালেক ভাইকে আমি একটুও পছন্দ করি না। পুরোদস্তুর একটা লম্পট। তুই জানিস না এ পর্যন্ত কত মেয়ের সাথে যে কত কি করেছে। সবার মুখে তার বদনাম। আর ফুফুকে কেউ কিছু বললে বলে-
- পুরুষ মানুষ। ওরকম একটু-আধটু হতেই পারে। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
- তা হয়তো হবে কিন্তু সেই ঠিকটা যে তোকেই করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই।
- আমিও তো তাই বলি। দেশে এত মেয়ে থাকতে ফুফুর বেছে বেছে আমাকেই তার ছেলের বউ করে নিতে হবে কেন? আমি তো এমনিতেই তার ভাইঝি। এ সম্পর্ক কি কম। আমার এসব কথাবার্তা একদম পছন্দ নয়।
- তুই চিন্তুা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
- ঘোড়ার ডিম হবে।
- বললাম তো হবে। অত চিন্তা করিস না।
- কে ঠিক করবে। তোর তো পাগলামীটাই এখনও গেল না । কবে যে একটু ভার ভারিক্কি হবি। আমার হয়েছে যত জ্বালা। নির্ভর করার মত কেউ নেই। একটা ভাই থাকলেও কাজ হতো। সুখ দুঃখের কথা তাকে অন্ততঃ খুলে বলা যেত।
- কেন, আমি কি কেউ না ?
- তুই ? তুই তো এখনও ছেলে মানুষ। তোরই তো কোন পাত্তা নেই। তুই আমাকে কিভাবে রক্ষা করবি।
- ভালোবাসা থাকলে সব পারা যায়।
- তুই আমাকে ভালোবাসিস।
- হ্যাঁ, বাসি। কেন, তোর আপত্তি আছে।
- আছে।
- কিসের আপত্তি আছে ? বল, কিসের আপত্তি ?
- আমাকে বিশ্বাস করাতে হবে। আমার কাছে প্রমান করতে হবে যে তুই আমাকে সত্যিই ভালোবাসিস।
- কি প্রমান চাস।
- আজ রাতে হিন্দু বাড়ীর শ্মাশানে আসবি। ঠিক রাত একটায়। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব। যদি ঠিক ঠিক আসিস বুঝব তুই আমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসিস।
- আচ্ছা, ঠিক আছে।

গভীর রাত। একটা বাজতে এখনও পনের মিনিট বাকী। নিয়াজ বেরিয়ে পরে। গ্রামের এলাকায় এত রাতে কোথাও টু শব্দটি পর্যন্ত নেই। রাস্তাঘাটে লোকজন তো দূরে থাক কোন প্রাণীর অস্তিত্ব মেলাই ভার। তার উপরে শ্মাশান ঘাটের কথা তো সম্পূর্ণ আলাদা। ভয়ে ওদিকটায় দিনের বেলায়ই কেউ যেতে সাহস পায় না। কিন্তু নিয়াজকে এই মধ্যরাতেই ওখানে যেতে হবে। নীতুকে তার ভালবাসার প্রমান দিতে হবে। নিয়াজ জানে নীতু ভীষণ সাহসী মেয়ে। সে আসবেই।

নীতু ঠিক ঠিক আসে। ভালোবাসার জন্য এই প্রথম সদ্য যৌবনে পা রাখা মেয়েটির কাছে সমস্ত ভয়ভীতি তুচ্ছ হয়ে যায়। নিয়াজ নীতুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। নীতু সজোরে কেঁদে ফেলে। নিয়াজ তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু কান্না যেন কিছুতেই থামতে চায় না । ভালোবাসার এই দুর্বার আবেগ মধ্যরাতে প্রেতিপুরীর আতংকে ভরা শ্মশান ঘাটকেও যেন স্বর্গের উদ্যানে পরিনত করে। দুজন দুজনের হাতে হাত রাখে। কথা দেয় অস্তিত্বের গভীর মর্মমূল থেকে। নীতু এটাই চেয়েছিল। ভালোবাসার শুরুতেই সে দেখে নিল তার নিয়াজ আসলেই কতটা সাহসী। সে যাচাই করে নিল ভালোবাসার তীব্র ঝড়ের মুখে সদ্য যৌবনে পা রাখা এই অপরিণত যুবক কতটা প্রতিরোধ গড়তে পারবে। নাকি ভয়ে তাকে ফেলে পালিয়ে যাবে। নীতু ছোট বেলা থেকেই জানত নিয়াজ তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসাকে সার্থক করার জন্য যেটুকু সাহসের দরকার তা নিয়াজের আছে কি-না সেটা জানা নীতুর জন্য প্রয়োজন ছিল। তাই সে তার পরীক্ষার কাজ সেরে নেয়। এবার নীতু আশ্বস্ত। সে এখন আর কাউকে ভয় পায় না। সে অন্তত: এটুকু জেনেছে যে তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে যতদূর চোখ যায় চলে যেতে পারবে। আর যাই হোক তার প্রেমিক অন্তত: ভয়ে পালিয়ে যাবে না।

    দিন যায়। রাত যায়। ভালোবাসার বৃক্ষে একের পর এক ফুল ফোটে। অনেক অনুভূতি, অনেক আকাঙ্খা। অনুভবের হাজার ফুলে হাজার রকমের সুগন্ধ। সব মিলিয়ে দুজনে একাকার হয়ে যায় হৃদয়ের গহীন ভেতরে। নান্টুকে একে একে সব জানায় নিয়াজ। নীতুও বান্ধবীর কাছে বুকের ভার কিছুটা হাল্কা করে। সুজাতাও ভীষণ খুশী হয়। ওদের ভালোবাসা ভেতরে ভেতরে তাকেও শিহরিত করে। মনে মনে ভাবে Ñ ইস্! ওকেও যদি কেউ এভাবে ভালোবাসত, বিশেষ করে নান্টুকে তো ওর খুবই পছন্দ। কিন্তু নান্টুটা যে কি? একদম লাজুক আর ভোলাভালা মানুষ। ভালোবাসার কিছুই বোঝে না। অবশ্য কিইবা এমন বয়স ওদের। এই বয়সে মেয়েরা তবু যা একটু বোঝে ছেলেরা তো একেবারেই অবুঝ। প্রেমের চাইতে তাদের কাছে বন্ধুত্বটাই বড়। সে নান্টুর উপর রাগ করে না। সিদ্ধান্ত নেয় নীতু যেমন নিয়াজকে সব কিছু শিখিয়ে তৈরী করে নিয়েছে সে-ও তেমনি নান্টুকে তালিম দেবে। আর নিয়াজ আর নীতুর ভালোবাসার কাছ থেকেই হয়ত নান্টু ভালোবাসার মূলমন্ত্র পেয়ে যাবে। তখন ওরা দুজনও প্রেম করতে পারবে। নান্টুর মুখটা বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায় ভালোবাসার এই নতুন অনুভূতিতে। নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে।

সুজাতা নিয়াজ আর নীতুর ভালোবাসার সূত্র ধরে নান্টুর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু নান্টুর যেন এসবে কোন আগ্রহ নেই। সুজাতা বুঝে উঠতে পারে না নান্টু তাকে আদৌ পছন্দ করে কি-না নাকি তার ভালোবাসায় কোন আগ্রহই নেই। নান্টু কি তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসে? কিন্তু সেরকম কিছুও তো মনে হয় না। নান্টুর এই এড়িয়ে যাওয়া সুজাতা মেনে নিতে পারে না কিছুতেই। তার কষ্ট আরও বেড়ে যায়। নীতুটা চুটিয়ে প্রেম করছে নিয়াজের সাথে। ওরা দুজন দুজনকে কি ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু নান্টু! কি ভীষণ বেরসিক। তার এতটা গভীর ভালবাসার কোন মূল্যই দিচ্ছ না। অবশেষে সে একদিন নান্টুকে হাত ধরেই ভালোবাসা ভিক্ষা চায়। নান্টু তখন বলে-

Ñ সুজাতা। তুই আমাকে ভালোবেসে ভুল করেছিস। অবশ্য আমিও তোর মত অন্য একজনকে ভালোবেসে ভুল করেছি। কিন্তু সে যাকে ভালোবাসে আমিও তাকে কম ভালোবাসি না। আমার সেই ভালোবাসা তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাই আমি কোন দিনও তার শত্র“ হতে পারব না। বরং যদি পারি তার ভালোবাসা সার্থক করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করব। আমি চাই সে সুখী হোক।
Ñ কে সে?
- নীতু।
তুই নীতুকে ভালোবাসিস।
হ্যাঁ, বাসি।
- কিন্তু কই ! কোনদিন তো বলিসনি।
- সব কথা বলা যায় না। যখন জানলাম নীতু নিয়াজকে ভীষণ ভালোবাসে এবং নিয়াজও নীতুকে ভালোবাসে এবং ওদের এই ভালোবাসা আশৈশব তখন আমার ভালোবাসা নিজের কাছেই তুচ্ছ হয়ে গেল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই জীবনে আর কোনদিন কাউকে ভালোবাসব না বরং ওদের ভালবাসাকে সার্থক করার জন্য সব ধরণের সহযোগিতা করব। নিয়াজ আমার হাত ধরে ওদের ভালোবাসা সার্ধক করার জন্য আমার কাছ থেকে সব ধরনের সহযোহিতা কামনা করেছে। আমিও ওকে কথা দিয়েছি । আমার জীবন দিয়ে হলেও ওদের ভালোবাসা সার্থক করব।  তুই যদি পারিস আমাকে মাফ করে দিস সুজাতা। তুই খুব ভালো মেয়ে। আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি দোয়া করি তুই সুখী হবি।

- দেখতে দেখতে সুজাতার বিয়ে হয়ে যায়। সে ভীষণ কাঁদে। নান্টু সব বুঝতে পারে। বুঝতে পারে সুজাতার কষ্টের কারণ। কিন্তু তার আর কিইবা করার আছে। তার যে বয়স তাতে কেউই তাকে সুজাতর সাথে বিয়ে দিবে না । সে যদি যোগ্য হতো তাহলে ভালো না বাসলেও স্রেফ সুজাতার কষ্ট ভেজা কান্নার জন্যই সে সুজাতাকে বিয়ে করত। কিন্তু এখন সেটা কোনমতেই সম্ভব নয়। স্কুল পড়–য়া কোন ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার মত আহাম্মক কোন পিতা খুঁেজ পাওয়া মুস্কিল। নিয়াজ আর নীতুরও ভীষণ খারাপ লাগে। তারা সুজাতাকে সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না।

কোথা দিয়ে যে দুটো বছর পেরিয়ে যায় টের পায় না কেউই । দু’জনের মনের কথা এতদিন যা শুধু মুখে বললেই হয়ে যেত এখন তাকে যথার্থ মনে হয় না কারো কাছে। মনে হয় আরও অনেক কথা রয়ে যায় হৃদয়ের গভীরে যা মুখে বলা যায় না অথচ বলতে মন চায়। দুজনেই তাই চিঠির দ্বারস্থ হয়। প্রতিদিনের সাক্ষাতের বাইরেও গড়ে ওঠে একটা ভিন্ন রকম যোগাযোগ। নীতুই প্রথম নিয়াজকে চিঠি লিখে। সেই চিঠির সমস্ত শরীর জুড়ে কেবল আকুলতা। সেই আকুলতা হৃদয়ের  গভীরে লালিত গোপন চাওয়ারই বহিঃপ্রকাশ। চিঠির ভাষায় সরাসরি সে কথা বলা না হলেও তা বুঝতে নিয়াজের বাকী থাকে না। নিয়াজের অবস্থাও নীতুর মতই বেহাল। নীতুর চিঠির জবাবে সে তা প্রকাশ করে নীতুর কাছে ।  দুজনে দুজনের মনের কথা জানতে পেরে আরও আকুল হয়ে ওঠে কাছে পাওয়ার জন্য। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই তো আর সবকিছু করা যায় না। সমাজ, সংসার, লোকলজ্জা সবকিছু তাদের জন্য পদে পদে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বিবেকের কাছে কোথায় যেন বাধা পড়ে থাকে অতৃপ্ত কামনার নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি। ভেতরে ভেতরে তারা শুধু অপেক্ষা করতে থাকে।

নীতুর সামনে মেট্রিক পরীক্ষা। সে তাই পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত মনে হয় নিজেকে তখন নিয়াজের চিঠিগুলো বের  করে পড়ে। প্রতিটি চিঠি যে কত হাজার বার পড়েছে তা সে নিজেই জানে না। তবুও আবার পড়ে। ভীষন ভালো লাগে প্রিয় মানুষের ভালোবাসার কথাগুলো। সে পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। পূর্ণোদ্যমে পড়াশুনা শুরু করে। নিয়াজের প্রতিটি অক্ষর যেন তাকে শাসন করে। প্রতিটি উচ্চারণ যেন নীতুর কাছে মৃত্যু সঞ্জীবনী সুরার মত।

একদিন পড়ার ফাঁকে নীতু নিয়াজের নতুন চিঠিটা বের করে পড়ছিল। পড়তে পড়তে সে যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। ইতোমধ্যে যে ঘরের মধ্যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ প্রবেশ করে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা সে টেরই পায়নি। মুখ তুলে তাকাতেই নীতুর মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। তার পিতা মোজাহের সাহেব দাঁড়ানো। নীতু মুখ নামিয়ে নিল। তখনও তার হাতে ধরা নিয়াজের চিঠি। মোজাহের সাহেব কোন কথা বললেন না। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। নীতু ভয়ে চুপসে চেয়ারের সাথে মিশে রইল। তিনি কোন কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ভয়ে নীতুর মুখ থেকে কোন কথাই বের হলো না।

- চিঠিটায় কোন লুকোচুরি ছিল না। নিয়াজ কোথাও কোন রাখ ঢাক করেনি। হৃদয়ের সব গোপন কথা নীতুকে অকপট খুলে লিখেছে। নীতুকে সে আদরিনী, সোহাগিনী বলে সম্বোধন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা চিঠিতে দুজনের নামই বহুবার এসেছে। তাই নীতুর আর লুকানোর কোন উপায় নেই । আতœপক্ষ সমর্থনেরও কোন পথ খোলা নেই। কোন নাম না থাকলে হয়ত মিথ্যে করে অন্য কোন বান্ধবীর চিঠি বলে চালিয়ে দেয়া যেত । কিন্তু সে ধরনের কোন সুযোগ নেই।

- মোজাহের সাহেব চিঠি পড়েই বুঝতে পারলেন শরীরে না হলেও মনের দিক দিয়ে তার মেয়ে যতটা এগিয়ে গেছে সেখানে থেকে তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এখন সুযোগ পেলেই সে ছেলেটির হাত ধরে পালাবে। কারণ তার মেয়ে খুব ভালো করেই জানে যে তার বাবা কখনই এই বিয়েতে রাজী হবেন না। তিনি তাই নীতুর যখন তখন বাড়ীর বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন। আর যদি তাকে একান্ত কোথাও যেতেই হয় তাহলে সাথে লোক নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তিনি তার স্ত্রী আমেনা বেগমের হাতে চিঠিটা দিয়ে সব কিছু খুলে বলেন। আমেনা বেগমের মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। যেন তা মৃত মাছের মত রক্তশূন্য। তিনি ভেবে কোন কূল কিনারা করতে পারেন না। নীতুকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নীতু কিছুতেই রাজী হতে চায় না।তার মুখে ঐ একই কথা। সে নিয়াজকে ভালোবাসে। বিয়ে যদি করতেই হয় তাকেই করবে। নিয়াজ ছাড়া অন্য কারো সাথে বিয়ে দিলে সে আতœহত্যা করবে।

মোজাহের সাহেব মেয়ের কথা শুনে শংকিত হয়ে ওঠেন। নীতুকে কড়া প্রহরায় রাখার নির্দেশ দেন। বোনকে ডেকে সব খুলে বলে বিয়ের আয়োজন করতে বলেন। কিন্তু সব কিছুই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার । নীতু নান্টুর মাধ্যমে নিয়াজকে খবর পাঠায় । নিয়াজ ও নান্টুর মাধ্যমে নীতুকে জানিয়ে দেয় কোথায়, কখন কিভবে তার  সাথে নীতুর দেখা হতে পারে।

পৌষের রাত্রী। প্রচন্ড শীত। চারিদিক ঘন কুয়াশায় মাখামাখি। এ বছর শীতটা একটু তাড়াতাড়ি এসে গেছে। রেডিওতে ইতোমধ্যে ভারতে শীতের প্রকোপে লোক মরার কথা শোনা গেছে। কোন কোন বছর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেও শীতের প্রকোপে লোক মরার কথা শোনা যায়। এ বছর অবশ্য এখনও তেমন কোন দুঃসংবাদ পাওয়া যায়নি।  তবে অল্প দিনের মধ্যেই হয়তো এ জাতীয় একটা খবর বাংলা সংবাদের শিরোনাম হয়ে আসবে। যেভাবে শীত পড়তে শুরু করেছে তাতে ময়েজ চাচার মত নব্বই বছরের বুড়ো মানুষদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিতান্তই কম।
ময়েজ চাচার কথা মনে পড়তেই নিয়াজ নড়েচড়ে বসল। শীতকালে সাধারণত মশার উৎপাত একটু কম থাকে কিন্তু এই জায়গায় দেখছি বেশ মশা। অনেক ক্ষণ ধরে বিরক্ত করে নিয়াজের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। নিয়াজ বসে আছে একটা ঝোপের আড়ালে। পাছে তার উপস্থিতি কেউ না কেউ টের পেয়ে যায় এ জন্য সে সামান্য শব্দ করার চেষ্টা থেকেও বিরত। মশাগুলোও এই সুযোগটা সমানে কাজে লাগাচ্ছে। এ জন্য অবশ্য তার কোন দুঃখ নেই। তার জীবনের প্রতিটি দুর্বল মুহুর্তের সুযোগইতো কেউ না কেউ পুরোপুরিই কাজে লাগিয়েছে। মশাগুলোরই বা দোষ কি।
নিয়াজের চোখের সামনে একটা অসহায় পান্ডুর মুখ ভেসে উঠে। সে মুখ ময়েজ চাচার মুখ। ময়েজ উদ্দিন নামের এই নব্বই বছরের বুড়ো নিয়াজকে এত ভালবাসে  কেন তা সে নিজেও জানেনা। আপন চাচা হলেও না হয় কথা ছিল। আপন তো দুরে থাক তিনি নিয়াজের দূরসম্পর্কের চাচাও নন। তারপরও এই বুড়ো মানুষটার জন্য নিয়াজের দরদের কোন শেষ নেই। বুড়োর জন্য সে পারে না এমন কোন কাজ নেই। পারবেই তো । এই বুড়ো মানুষটা নিয়াজকে তার নিজের ছেলের মতই জানে।
নিয়াজ আর ভাবতে পারলো না। খুট করে একটা আওয়াজ হতেই সে পিছনে ফিরে তাকালো। আবছা অন্ধকার আর ঘন কুয়াশার বুক চিরে সে দেখল দুটো ছায়ামূর্তি তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে আস্তে উঠে দাঁড়ালো।
ছায়ামূর্তি দুটো তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। সে পুরুষ ছায়ামূর্তিকে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো - পথে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?
- না।  কেউ টের পায়নি। পুরুষ ছায়ামূর্তিটা চাপা গলায় উত্তর দিল।
এই পুরুষ ছায়ামূর্তিটা আর কেউ নয়। নিয়াজের বন্ধু নান্টু। সাধারন অর্থে বন্ধু বলতে যা বোঝায় নান্টু তার চেয়ে একধাপ উপরে। নিয়াজের জন্য সে পারে না এমন কোন কাজ নেই। আর সে জন্যই এই গভীর রাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নিয়াজের কাছে নীতুকে নিয়ে এসেছে। নীতু জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নান্টুর পাশে।
নান্টু ফিসফিস করে বললো- তোরা থাক। আমি ওখানে আম গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছি। কেউ আসলে সাড়া দেব। অমনি ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়বি।
- ঠিক আছে। নিয়াজ মাথা নেড়ে বলল। সে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড একটা উত্তেজনা বোধ করছে। নান্টু চলে যেতেই নিয়াজ নীতুর দিকে তাকালো। নীতু এখনও গুঁটিসুঁটি মেরে আছে। ভয়ে না-কি প্রচন্ড শীতে তাকে এমন লাগছে নিয়াজ তা বুঝতে পারলো না। সে নীতুর দু’কাধে হাত রাখল। নীতুর গায়ে পাতলা একটা কম্বল জড়ানো। শুধু শীতের জন্যই নয় পথে তাকে কেউ দেখে খুব সহজেই যাতে মেয়ে বলে সনাক্ত করতে না পারে তার জন্যই সে কম্বল দিয়ে মাথা পর্যন্ত জড়িয়ে রেখেছে। নীতু যে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড একটা উত্তেজনা বোধ করেছে নিয়াজ তা সহজেই বুঝতে পারলো। কারন এখনও সে আগের মতই গায়ে মাথায় কম্বল জড়িয়ে রেখেছে।
নিয়াজ নীতুর হাত ধরে বললো - বসো।
নীতু আস্তে বসে পড়লো। নিয়াজ ও বসলো তার পশে। তার পর মাথা থেকে কম্বলটা নামিয়ে দিলো। আবছা আঁধারের মধ্যে হঠাৎ চাঁদ ওঠার মত ঝলমল করে উঠলো নীতুর অপরূপ মুখশ্রী। তার রূপের ছটায় যেন পূর্ণিমা নামলো নিয়াজের পৃথিবীতে। নিয়াজের মনটা অজানা এক আনন্দে ভরে উঠলো। সে আলতো করে নীতুর দু’গালে হাত রাখলো। প্রচন্ড শীতেও ঘেমে নেয়ে গেছে নীতু। তার মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
নিয়াজ নীতুকে টেনে কোলের মধ্যে নিল। তারপর কম্বলটা খুলে ফেলে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। নীতুও দু’হাতে শক্ত করে নিয়াজকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি আর পারছি না নিয়াজ। তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাসো তাহলে আমাকে এখান থেকে উদ্ধার কর। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আর কিছু দিন এখানে থাকলে আমি মরে যাবো। সত্যিই মরে যাবো।
এতক্ষণ ধরে ঘেমে ওঠা শীতল বরফের মত নিশ্চুপ নীতু এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অবুঝ শিশুর মতো অঝোর ধারায় উত্তেজনার সবটুকু উত্তাপকে দু’চোখের জলে ভাসিয়ে দিতে লাগলো। নিয়াজ তাকে অনেক কষ্টে শান্ত করল। এখনও ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছে নীতু। তাকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। নিয়াজের ভীষণ মায়া লাগছে নীতুর জন্য। সে তাকে আরো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আলতো করে পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল- শান্ত হও নীতু। অস্থির হলে চলবে না। আমার উপর আস্থা রাখ। আমার জীবন থাকতে আমি অন্য কারো সাথে তোমার বিয়ে হতে দেব না। কিছুতেই না।
নীতু মুখ তুলে তাকালো। আবছা অন্ধকার ফুঁড়ে সে চোখ রাখলো নিয়াজের চোখে। তার এই চাহনির অর্থ নিয়াজ বুঝতে পাড়লো। সে নীতুকে আশ্বস্ত করে বললো- তুমি বাড়ীতে গিয়ে সবার সাথে খুব স্বাভাবিক আচরণ করবে। যাতে সবাই বুঝতে পারে সব কিছুতে তোমার মত আছে। তাহলে তোমাকে ওরা বাইরে বেরোতে দেবে। তোমার উপর নজর রাখছে যে লোকটা সে-ও আর এখনকার মত সারাক্ষণ তোমার পিছু লেগে থাকবে না। এর মধ্যে আমি টাকা পয়সা যোগাড় করে নিজেই তোমাকে সব জানাবো।
নিয়াজের কথা শেষ হতে না হতেই নীতু নড়ে চড়ে উঠলো। নিয়াজ বুঝতে পারলো নীতু কিছু একটা বলবে। সে নীতুকে জিজ্ঞেস করলো - কি কোন আপত্তি আছে?
নীতু এবার কিছুটা ব্যস্ত হয়ে উঠলো। সে নিয়াজের দু’কাঁধে হাত রাখলো। হঠাৎ করেই স্পষ্ট  কন্ঠে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো-
- নাহ্ নিয়াজ এতটা দেরি করা যাবেনা। আব্বার মতিগতি ভাল না। যে কোন মুহুর্তে ঐ লম্পট মাতালের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিতে পারে। আমাকে হয়তো কোন কিছু আঁচ করতেই দেবেনা। কাল যেভাবেই হোক আমি স্কুলে আসব। ঠিক দশটার সময় তুমি স্কুলের পিছনের দেওয়ালের পাশে অপেক্ষা করবে। আমি সুযোগ বুঝে দেওয়াল টপকে তোমার কাছে আসবো। তারপর দুজনে মিলে সাঁতরে খালটা পেরিয়ে মাঠের  মধ্যে দিয়ে পালিয়ে যাবো। আমি অবশ্য সাঁতার জানিনা। তাতে কি। তুামি আমাকে নিয়ে সাঁতরে ওপার যেতে পারবে না? নিয়াজ মন্ত্রমুগ্ধের মত নিবেদিত কন্ঠে উচ্চারণ করল- হ্যাঁ, পারবো। একটু থেমে নীতু আবার বলতে শুরু করলো- আর শোনো, টাকা পয়সার কথা  নিয়ে ভেবো না। আমার গায়ে যে সোনার অলংকার আছে তার  দামও অনেক। এগুলো বিক্রি করলে যে টাকা আসবে তাতেই অনেক দিন চলে যাবে। তাছাড়া আমার কাছে কিছু জমানো টাকা আছে ওটাও সাথে নিয়ে আসবো। তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে। যদি না আস আমি ঐ খালের পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করবো।
- ছিঃ! এমন কথা মুখেও এনো না। - বলেই নিয়াজ নীতুর মুখ চেপে ধরলো। নীতুর কিছু হলে নিয়াজ বাঁচবে না। নীতু ছাড়া পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। সে বাঁচতে চায়ও না। আর সেজন্যই এই এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি যার ভয়ে গ্রামবাসী সর্বদা অস্থির থাকে তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পালাতে তার দ্বিধা নেই। নেই কোন দ্বন্দ্বও। সে চিন্তিতও নয়। তার নীতুকে সে নিজের কাছে নিয়ে আসবেই। সারা জীবনের জন্য সে তাকে হারাতে চায় না।
এত রাতে অনেক কষ্টে পালিয়ে দেখা করতে এসেছে নীতু। বাড়ীর রাখালটাকে টাকা দিয়ে নীতু নিয়াজকে আগেই সব কিছু জানিয়ে দিয়েছিল। তাদেরকে নিরাপত্তা দিচ্ছে তাদের বন্ধু নান্টু। নান্টু একা দূরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। সে চারিদিকে কড়া নজর রাখছে। নীতু চলে যেতেই নান্টু এসে বলল- কিরে দোস্ত, কি সিদ্ধান্ত নিলি?
নান্টুকে সব কথা খুলে বলল নিয়াজ। একটু চিন্তা করে নান্টু বলল- ভাবিস না দোস্ত। আল্লাহ তোদের সাথে আছে। তোদের প্রেম পবিত্র। তোরা সফল হবি। তবে তোকে কিন্তু অস্থির হলে চলবে না। মাথা ঠিক রাখতে হবে। আমি দূর থেকে তোদের ফলো করব।
নীতু খুব স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর একটু হেসে বলল- মা আমার স্কুলে যেতে হবে। কিছূ সাজেশন আর টেষ্ট পরীক্ষার সব খবরাখবর নিয়ে আসব। আমার  সাথে শুকুর ভাইও যাবে। তারপরও যদি তোমার দুশ্চিন্তা না যায় তো ছোট কাকাকেও সাথে দাও। তবুও আমাকে স্কুলে  যেতে দাও। আমার লেখা-পড়া কি গোল্লায় যাবে। আগেই তো বলেছি বিয়ে হোক আর নাই হোক আমি লেখা-পড়া করব। তোমরা দেখছি এখনই আমার লেখা-পড়া বন্ধ করে দিচ্ছ।
মোজাহের সাহেব এলাকার চেয়ারম্যান। গত রাতে পশ্চিম পাড়ায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছে এক যুবতী। এখনও নাকি তার লাশ পড়ে আছে। রাস্তার পাশের নর্দমায়। লোকজন দলবেঁধে ছুটছে সেদিকে। খুব সকালে কয়েকজন লোক এসে মোজাহের সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেছেন ঘটনাস্থলে। নীতুর ছোট চাচাও তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে রওনা দিয়েছে সেখানে। ছোট কাকা যে এখন তার সাথে স্কুলে না গিয়ে ওখানে যাবেন এটা নীতু স্পষ্ট বুঝতে পারছে। আর মায়ের কাছে নিজের কথা বিশ্বাস করানোর জন্য সে এ সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে। নীতুর মা আমেনা বেগম নিজেই বলে উঠলেন- দুলাল নাকি ঐ দিকে যাবে। তুই শুকুরকে সাথে  নিয়ে যাবি। আর শোন, তাড়াতাড়ি ফিরবি। তোর বাপ ফিরে আসার আগেই। উনি এসে শুনলে রাগ করতে পারেন।
-ঠিক আছে মা, আমি শুধু যাব আর আসব। খুব বেশী দেরী হবে না।
শুকুর স্কুল গেটের একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। নীতু স্কুলে ঢোকার সময় খেয়াল করল শুকুর বাজারের দিকে যাচ্ছে। সে ভীষণ বিড়ি খায়। তার বোধহয় বিড়ির নেশা পেয়েছে। যাক ভালই হল। বিড়ি পেলে শুকুর আলীর আর দুনিয়ার কথা মনে থাকে না। স্কুলে ঢুকেই নীতু পরিচিত সাবাইকে বলল- একটু দাঁড়া, আমার বাথরুম পেয়েছে। আগে বাথরুম থেকে আসি। তারপর কথা বলব। বাথরুমের কথা বলে দেয়ালের কাছে চলে এল নীতু। ঘড়ি দেখল। এখন সময় সাড়ে নয়টা। একটু পরেই ক্লাসে যাবে সবাই। নীতু বাথরুমে ইচ্ছে করেই দেরী করল। সে যখন কমন রুমে ফিরে আসল তখন সবাই ক্লাস রুমে চলে গেছে। সে চারিদিকে তাকিয়ে সতর্ক হল। তারপর যখন দেখল আশে পাশে কেউ নেই চুপি চুপি দেয়ালের কাছে চলে গেল। অনেক কষ্টে দেয়াল টপকালো সে। কি যেন একটা গড়িয়ে পড়ল। খুট্ করে একটা আওয়াজ হল। পিছনে ফিরে তাকাল নীতু। নাহ! কেউ টের পায়নি। সে এদিক ওদিক তাকাল। ঐ তো নিয়াজ। চুপ করে বসে আছে একটা গাছের আড়ালে। নীতু তাকে দেখেই কথা বলে উঠতে চাইল। নিয়াজ ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে তাকে চুপ থাকতে বলল। নীতুর কন্ঠস্বর ফুলে উঠেও চুপসে গেল। এখন কথা বললেই সর্বনাশ হবে। দেওয়ালের ওপাশেই স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। কেউ না কেউ তাদের কথার আওয়াজ টের পাবে। নিঃশব্দে খালের পানিতে নেমে পড়ল নিয়াজ। তারপর নীতুর হাত ধরে তাকেও নামাল। যখন ওপারে পৌঁছল তখন ভীষণ নিস্তেজ লাগছে নিয়াজের। তারা কিছু সময় পানির মধ্যে অপেক্ষা করল। একটু জিরিয়ে নিয়ে একটা নর্দমার মধ্যে দিয়ে উঠে এলো বাগানের মধ্যে। খালের এপারের দিকটায় বড় বাগান। তারপর দিগন্ত বি¯তৃত মাঠ। সেই মাঠে এখন সোনালী ধানের সমারোহ। মনে মনে ঠিক করলো বেশ কয়েকদিন ফসলের ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা যাবে। অতি সন্তর্পণে তারা বাগান পেড়িয়ে মাঠের মধ্যে নামল। তারপর ক্ষেতের আল ধরে ছুটলো ভিতরের দিকে, মাঠের মধ্যে দিয়ে একসময় মাঠের একদম মাঝখানটায় চলে গেল।
এখান থেকে ধুঁ-ধুঁ গ্রাম দেখা যায়। এখন পৌষ মাস। সমস্ত মাঠ জুড়ে পাকা ধানের বন্যা। মাঠের মাঝের দিকটায় অবশ্য কারো আসার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া কেউ ধারনাই করতে পারবে না তারা এভাবে ফসলের ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে আছে। সবাই পালিয়ে বাড়ী থেকে অনেক দূরে কোন বন্ধু বা আত্মীয়দের বাড়ীতে চলে যায়। চলে যায় দূরের কোন শহরে।  কিন্তু তারা চলে এসেছে ফসলের ক্ষেতে। তাছাড়া আর কোন পথ নেই এ মূহুর্তে। গভীর রাত ছাড়া এখান থেকে বেরোনো ঠিক হবে না । আপাততঃ অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন কিছুই করার নেই।
দু’জনের কাপড় চোপড়ই ভিজে সপসপ করছে। পৌষের প্রচন্ড শীতে ভেজা কাপড় চোপড় গায়ে ঠকঠক করে কাঁপছে দু’জনেই। হালকা রৌদ্র উঠেছে চারিদিকে। নিয়াজ শার্ট খুলে আলের উপর বিছিয়ে দিয়ে পাশে বসল। ধানের গাছের উপর মেলে দিতে পারলে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত। কিন্তু সেটা কারো চোখে পড়ে যেতে পারে বলেই সে সাবধান হল। এই মুহুর্তে কোন ভুল করা চলবে না।
নীতু, এভাবে ভিজে জামা গায়ে রাখলে তোমার জ্বর এসে যাবে। লজ্জা  করো না। জামা খুলে ফেলো। তারপর শুকিয়ে গেলে পরে নিয়ো। নিয়াজ নীতুকে বলল।
নীতু মিষ্টি হাসলো। সে খুব লজ্জা পাচ্ছে জামা খুলতে। নিয়াজ সেটা বুঝতে পেরে বলল- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি অন্য দিকে তাকাই। তুমি খুলে আলের উপর বিছিয়ে দাও। নীতু তাই করল। নিয়াজ তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছে। নীতু আস্তে করে তার বুকের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। মনে মনে বলল- নিয়াজ তুমি এত ভাল কেন? মানুষের এত ভাল হতে নেই। কষ্ট পেতে হয়। নীতু আস্তে গিয়ে নিয়াজের পিছনে বসল। তারপর দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিয়াজকে। থতমত খেয়ে গেল নিয়াজ। আহ্! ছাড়। বলে নীতুর হাত ছাড়াতে চাইল। নীতু আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর কানের কাছে মুখ রেখে গভীরভাবে বলল- ও ষড়াব ুড়ঁ ঘরধল. ও ষড়াব ুড়ঁ.
ভীষণ ঠান্ডা বাতাস বইছে । কনকনে শীত লাগছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। লোমগুলো একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। নীতুর গা বেশ গরম লাগছে। ওর আবার জ্বর আসছে না তো।
নিয়াজ নীতুকে কোলের উপর এনে বসালো। নীতু দু’হাতে নিয়াজের গলা জড়িয়ে ধরল। নিয়াজ নীতুর কপালে হাত রাখল। নীতু বলল- কি দেখছ? জ্বর?
-হু্ ঁ..
-ভয় নেই। আমার জ্বর আসেনি। এমনিতেই গা গরম হয়েছে। নিয়াজ গভীর ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরল নীতুকে। নীতুও আরও শক্ত করল তার হাতের বাঁধন। সে কিছুতেই নিয়াজকে তার পৃথিবী থেকে আলাদা হতে দেবে না।
ক্লাস শেষে মেয়েরা ফিরে দেখল নীতুর বই খাতা পড়ে আছে। কিন্তু নীতু কই? তারা বাথরুমসহ স্কুলের পিছনটায় খোঁজাখুঁজি শুরু করল। দারোয়ানের কাছে গিয়ে ইতোমধ্যে জেনে এসেছে এক মেয়ে। নাহ্। নীতু স্কুলের বাইরে যায়নি। তাহলে গেলো কই? দেয়ালের পাশে কি যেন একটা পায়ে ঠেকল। এক মেয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখল একটা চ্যাপ্টা টিনের বাটা। সে বাটাটা হাতে তুলল। তারপর খুলতেই অবাক হল। পলিথিন কাগজ দিয়ে মোড়ানো টাকা। সে সবাইকে ডাকল। সব মেয়েরা দৌঁড়ে এল। দেয়ালের দিকে চোখ পড়ল একজনের। সে চিৎকার করে উঠল। শ্যাওলা পড়া দেয়ালে ছাপ পড়ে আছে। একটু আগেই যে অনেক কষ্টে কেউ দেয়াল টপকে ওপারে গেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। দৌঁড়ে গিয়ে একজন স্যারকে ডাকল। স্যাররা ছুটে  এলো তড়িৎ গতিতে। তারা সব শুনে বুঝতে পারল। নীতুর ব্যাপারটা তারা আগেই একটু-আধটু জানত। এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হল। তাহলে নীতু পালিয়েছে। টাকাগুলো গুনে দেখা গেল ছ’টা পাঁচশত টাকার নোট। বোধহয় কোমরে গোঁজা ছিল। দেয়াল টপকানোর সময় পড়ে গেছে। দারোয়ান শুকুরকে ডাকল। শুকুর সব শুনে থ হয়ে গেল। সে ভয়ে ভয়ে ছুটল বাড়ীর দিকে। তারপর আমেনা বেগমকে ডেকে ফিসফিসিয়ে সব ঘটনা বর্ণনা করল। আমেনা বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।
হেড মাষ্টার সাহেব নীতুদের বাড়ীর দিকেই আসছিলেন। পথে দেখা হল মোজাহের সাহেবের সাথে। খুন খারাবীর ব্যাপার দেখে ফিরছেন মোজাহের সাহেব। তার মুখ একদম তেতো হয়ে আছে। হেডমাষ্টারকে দেখেই সালাম দিলেন। হেডমাষ্টার সাহেব কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন- কিছু টের পেয়েছেন। মোজাহের সাহেব অবাক হয়ে বললেন- কি? খুনের কথা? হেডমাষ্টার বললেন- আরে না। নীতু স্কুলের পিছনের দেয়াল টপকে পালিয়ে গেছে। দেয়াল টপকানোর সময় সে এই কৌটা ফেলে গেছে। এর মধ্যে তিন হাজার টাকা আছে। ও বোধ হয় সাথে নিতে চেয়েছিল।
- কখন পালিয়েছে?
- সম্ভবত দশটার দিকে। মেয়েরা প্রথম ক্লাস শেষ করে এসে দেখে নীতু নেই। তাপরই হৈ চৈ শুরু হয় গেছে। হৈ চৈ শুনে আমি গেলে দেয়াল টপকানোর ছাপ দেখালো। আমি তখনই পুরো ব্যাপারটা ধরে ফেলি। মোজাহের সাহেব সব শুনে থ হয়ে গেলেন। তার মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না। তিনি ঢোক গিল্লেন। চারদিক থেকে বিপদ তাকে এভাবে ঝাপটে ধরছে কেন? লজ্জায়, রাগে, ক্ষোভে তিনি হেডমাষ্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ীতে চলে এলেন। আমেনা বেগম ধরেই নিয়েছিলেন মোজাহের সাহেব বাড়ীতে এসে সব শুনে তুলকালাম কান্ড বাঁধাবেন। কিন্তু তিনি চুপ করে রইলেন। তার এই চুপ করে থাকা আরও ভয়ংকর। সে যে একটা কিছু ঘটাবে এটা তরই ইঙ্গিত। তিনি গোসল সেরে ভাত খেতে গেলেন। তার গলা আটকে আসছে। শত চেষ্টা করেও তিনি ভাত খেতে পারলেন না। সামান্য ক’টা মুখে দিয়েই উঠে পড়লেন। দুলাল ও ইতোমধ্যে ফিরেছে। সে সব শুনে রাগে, ক্ষোভে জ্বলতে লাগল। শালা নিয়াজ, তোকে হাতের কাছে পেলে একদম জানে মেরে ফেলব। সে বিছানার তলে রাখা তার ধারলো ছুরিটা একবার দেখল। নাহ্, ঠিকই আছে। দুলাল আবারও মনে মনে বলল-
- শালা নিয়াজ। আমার ভাইঝিকে নিয়ে মজা করছো। তোকে আমি মজা বুঝিয়ে ছাড়ব। সে উঠে খেতে গেল। আমেনা বেগম তার পাশে বসা। তিনি ভাল করেই জানেন দুলালের খবর। দুলাল ভীষণ বখাটে। সে করতে পারেনা এমন কোন কাজ নেই। সে দুলালকে ঠান্ডা গলায় বলল- দুলাল, মাথা গরম করিস না। ভাল করে খুঁজে দেখ। ওরা বোধ হয় আশে পাশে কোথাও আছে। নিশ্চয়ই খুব বেশী দূরে যেতে পারেনি। ওদের খোঁজ পেলে মাথা ঠান্ডা রেখে আমাকে জানাবি। প্রয়োজন হলে আমি নিজে যাব। নীতুকে সবকিছু বুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসব।
- তুমি চুপ করোতো। ও শালাকে আমি জানে মেরে ফেলবো। শালা, পালানোর মজা আমি তোকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেব।
আমেনা বেগম কথা বাড়ালেন না। দুলাল আর কোন কথা না বলে খাওয়া শেষ করল। সামনের বারান্দা থেকে মোজাহের সাহেব ধরা গলায় দুলালকে ডাকলেন। দুলাল খাটের পাশে রাখা হাতাওয়ালা চেয়ারে বসলো। মোজাহের সাহেব জানালার দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। থানায় গিয়ে একটা জি ডি করে আয়। আর দারোগা সাহেবকে আমার সালাম দিবি। চারদিকে লোক পাঠিয়ে সারা এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে ওদের বের করে আনতে চেষ্টা কর। যে খুঁজে বের করতে পারবে তাকে বড় বকশিস দেওয়া হবে। না পারলেও অসুবিধা নেই। পারিশ্রমিক পাবে।
চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ী থেকে থানা বেশী দূরে নয়। দারোগা প্রায়ই এ বাড়ীতে আসেন। খাওয়া দাওয়া করেন। চেয়ারম্যান বাড়ীর যে কোন অনুষ্ঠানেই দারোগা সাহেব দাওয়াত পান। দারোগা সাহেব আগেই প্রায় সবটুকু শুনে ছিলেন।
দুলালের কাছ থেকে বাকীটা শুনলেন। দুলাল জিডি করে লোক লাগানোর জন্য উঠে পরে লেগে গেল। আজ রাতেই ওরা পালানোর চেষ্টা করবে। দিনের বেলায় নিশ্চয়ই কোথাও পালাতে পারেনি। সে কয়েকজন বিশ্বস্ত লোক লাগিয়ে দিয়ে নান্টুদের বাড়ীর দিকে গেল। নান্টু বাড়ীতেই আছে। সে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলল দুলালের সাথে। দুলাল কথা না বাড়িয়ে চলে এল। নান্টুর উপর নজর রাখার জন্যও সে একজন লোক নিয়োগ করল। নান্টু নিয়াজের বন্ধু। এ সময় তার গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখা জরুরী।
দারোগা সাহেব  একাই এসেছেন। তিনি সব শুনে মোজাহের সাহেবকে বললেন- চিন্তা করবেন না। আমি ব্যাপারটাকে নিজের মত করেই কাজ শুরু করছি। দু’একদিনের মধ্যেই ওদের ধরে ফেলব। ওরা নিশ্চয়ই বেশীদূরে যেতে পারেনি। আশে পাশে কোথাও লুকিয়ে আছে। পুলিশের পাশাপশি গ্রামবাসীদেরও রাতে কড়া পাহাড়া দিতে বলবেন।
দারোগা সাহেব সম্ভবতঃ অবিবাহিত। নীতুর প্রতি তার বোধহয় একটু দুর্বলতা আছে। নইলে কারণে অকারণে এ বাড়ীতে আসেন কেন? এসেই নীতুর কথা জিজ্ঞেস করেন। নীতুর সাথে হেসে হেসে কথা বলেন। বেশ কিছু উপহার দিয়েছেন ইতোমধ্যে। বাইরে যত মেজাজ নিয়ে থাকেন না কেন এ বাড়ীতে এলে তিনি কেমন যেন হয়ে যান। তাকে দেখে মনে হয় না ইনিই অত্যন্ত প্রভাবশালী দারোগা কুদ্দুছ মিয়া যার ভয়ে বদমাশেরা সব সময় থাকে ভীত সন্ত্রস্ত। মোজাহের সাহেব মনে মনে ভরসা পেলেন। দারোগা যেভাবেই হোক ওদের বের করে ফেলবেনই। রাগ তারও কম নয়। মুখে সেটা না বললেও তার ভাব-ভঙ্গি দেখে মোজাহের সাহেব সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারেন।
দেখতে দেখতে দু‘দিন কেটে গেল। এ দু‘দিন পানি ছাড়া আর কিছুই পেটে পরেনি। নান্টু একবারও আসেনি এ দু‘দিন। নীতুও ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এই দীর্ঘ সময়ের সবটাই নীতুকে সে কোলের উপর রেখেছে। দুটো রাতই নীতু তার কোলের উপর ঘুমিয়েছে। তবুও নিয়াজের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নিজের জন্য সে ভাবছে না। ভাবছে নীতুর জন্য। নীতু কোন দিন সামন্য কষ্টও করেনি। শেষ পর্যন্ত সে এতটা কষ্ট সহ্য করতে পারবে তো। নাকি নিয়াজকে ফেলে চলে যাবে। নীতুকে দেখে তেমন মনে হয় না। সে নিয়াজকে মুহুর্তের জন্য দূরে যেতে দিতে রাজী নয়। অবশেষে অনেক বুঝিয়ে খাবার আনার জন্য নিয়াজ মাঠের বাইরে রওনা হল। মাঠ থেকে যখনই রাস্তায় উঠবে তখন তার সামনে পুলিশ পড়ল। সে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল।
সূর্যের আলো ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। শীতের সকাল বলে এতক্ষণ ভালই লাগছিল। কিন্তু যতই বেলা বাড়ছে সরাসরি আসা সূর্যালোকের নীচে একটানা বসে থাকা অসহ্যের হয়ে উঠছে। কিন্তু  এছাড়া কোন বিকল্পও নেই এই মুহুর্তে। এ অবস্থায় কোথায় যাবে তারা। মাঠের বাইরে বের হলেই ধরা পড়ে যাবে। তাই বসে থাকাটাই একমাত্র সিদ্ধান্ত। তারা বসে আছে ধানক্ষেতের মধ্যে লুকানো একটা আলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু একটা ঢিবির উপর। দূর থেকে তাদেরকে দেখার কোন উপায় নেই। ধান পাকতে আরও কিছু দিন দেরী হবে। মাঠে এখনও পানি জমে আছে। ফসল কাটার সময় না হলে এসব মাঠে সাধারনত কেউ আসেনা। তাছাড়া তারা যে মাঠের ভেতর লুকিয়ে আছে এটা কারও মাথায়ই আসবে না। মানুষ সাধারনত দূরে কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু তারা যে এত কাছাকাছি এরকম একটা  অস্বাভাবিক জায়গায় লুকিয়ে আছে তা কারোর মাথায় আসার কথা নয়।
নিয়াজ বসে আছে নীতুকে কোলে নিয়ে। নীতুর শরীরটা ক্রমশঃ ভারী হয়ে আসে তার কাছে। একটা পরিপূর্ণ যুবতী মেয়েকে কতক্ষণ এভাবে কোলের উপর নিয়ে বসে থাকা যায়। নীতু সেটা বুঝতে পেরে নেমে বসতে চায়। কিন্তু তবুও সে নীতুকে কোল থেকে নামতে দিতে চায় না। নীতু শেষ পর্যন্ত অনেকটা জোর করেই নেমে বসে। উঁচু ঢিবিটা ঘণ ঘাসে আচ্ছাদিত। বেশ শুকনো আর পরিচ্ছন্ন। তাই বসার জন্য একেবারে মন্দ নয়। নীতু একহাতে জামাটা টেনে নেয়। তারপর আলগোছে পরে নেয় নিয়াজের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসা অবস্থায়। তারপর নিয়াজের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে ঈষৎ হাসে। নিয়াজও ঠোঁটের কোনায় মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করে। নীতু আলগোছে নিয়াজের কোলে মাথা রেখে ঘাসের উপর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। নিয়াজ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। দেখতে দেখতে নীতু একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। নিয়াজ হারিয়ে যায় তার ভাবনার রাজ্যে। তার চোখের সমানে ভেসে ওঠে অতীতের স্মৃতির জলছবি। 
স্কুলের দীর্ঘ পথটাই যে আমরা কত দ্রুত পারি দিতাম আজ তা ভাবতে অবাক লাগে। সেই সব দিনের স্মৃতি মনে পড়লে আজও বুক কেঁপে ওঠে। মনে হয় সমস্ত রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ফেটে যাবে হৃৎপিন্ডটা। সারা শরীর ঘেমে ওঠে। ভুতে পাওয়া মানুষের মত অপ্রকৃতস্থ মনে হয়। ভীষণ একটা অস্বস্থি এসে মৌমাছির ঝাঁকের মত ঘিরে ধরে সত্তার সবচেয়ে অনুভূতিপ্রবন কোনটি। তবুও ভাল লাগে সেইসব মৃত স্মৃতির রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে যেমন ঘুরে বেড়ায় ওর চঞ্চল হাত দুটো আমার ছোট ছোট কালো চুলে আচ্ছাদিত মস্তকাবরণে। আমরা ভালবেসে ফেলেছিলাম আমাদের স্কুল, পথ-ঘাট, রাস্তার পাশের গাছ-গাছালী। ছোট্ট বাজারটি আর অবশ্যই দু’জন দু’জনকে। না বেসেও হয়তো উপায় ছিলনা।
ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তৈরী হতাম। গরমের দিন তাই স্কুল বসতো খুব সকালে। তার পরে অতটা পথ। আমার তবু দেরি হয়ে যেত। নীতু ছুটে আসতো। ছোট্ট মেয়ে তবুও কি কাজের। সামান্য সাজগোজও করত। তাকে মানতও বেশ। উঠানে দাঁড়িয়ে ডাক দিত না। সোজা চলে আসত ঘরে। আমার মা হয়ত তখন আমার শার্টের হাতা গলানোতে ব্যস্ত নয়তো কানের ময়লা ঘষে তুলে দিচ্ছেন। ও তখন হেসে কুটিকুটি। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলত-
- নিয়াজ তোর কানে ময়লা, তুই খাস কয়লা;
তোর দাঁত তাই কালা, তোকে নিয়ে যত জ্বালা।
মা শুনে আঁড় চোখে নীতুকে দেখত। ওর মুখে তখনও হাসি। সে হাসি ছড়িয়ে পড়ত মায়ের মুখেও । আর আমিতো সারাক্ষণই হাসি হাসি।
প্রস্তুতি পর্বের শেষটা বেশ দ্রুততার সাথেই সারতেন মা। তারও অনেক কাজের তাড়া ছিল। ছেলে-মেয়ে বলতে তো আর আমি একা নই। বাকীদের ও তো দেখতে হবে। তার সাথে আছে সংসারের ঝামেলা। আমার মনে পড়ে একেবারে শেষ মুহুর্তে তিনি পুরো চোখে- মুখে হাত বুলিয়ে মুছিয়ে দিতেন কিছুটা শক্ত হাতেই যাতে কোন ময়লা না থাকে। ঘাড়ে হাত রেখে যখন একাজটা করতেন আমি তখন কেঁপে উঠে দু’চোখে ঝাপসা দেখতাম মুহুর্তের জন্য। ব্যাপারটা যেন হঠাৎ ঝাকি খাওয়ার মত। তবু ভাল লাগতো মায়ের এই আদর। এই আদর টুকু ছাড়া যেন আমার পুরুষালী প্রসাধন শেষ হত না। মা যদি কোনদিন তাড়াহুড়ো করে দিতে ভুলে যেতেন আমি চেয়ে নিতাম। নীতু আবারও হাসতো।
পথে নেমেই শুরু হত দুষ্টুমী। চার পাশের পরিবেশের পাশাপাশি দু’জন দু’জনের পেছনে লেগে থাকতাম চোখের পাতার মত। ঘন সবুজ গাঁয়ের নিবিড় প্রকৃতি অর্থবহ হয়ে উঠত কৈশোরের উচ্ছলতায় ভরা দুরন্ত সময়ে। দিনের আলো তখন ময়ুরের পাখার মত মেলতে শুরু করছে। গাছ-পালার মাঝ দিয়ে তা উঁকি মারত চিরন্তনী বিরহী সৌন্দর্যে। কেন জানি কি এক অনুভব তার মায়াবী হাতে আমাদের দু’জনকে ছুঁয়ে যেত। ভালাবাসার নামও তখন শুনিনি।

মজাটা বেশী হত ফেরার পথে। সমস্ত ক্লাসের শেষে যখন ছুটি হত তখন খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করতো। কিন্তু তাতে কি! আনন্দ তখন যেন বান ডাকত। নীতুর  পাগলামী তখন নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলত। উল্লাসে সে আমার উপর আছড়ে পড়ত। আলগোছে নয় একটুও, শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটত। শরীরের সমস্ত ভার যেন ও আমার উপর ছেড়ে দিত। আর আমিও আমার সেই ক্ষীণ তনুতে তার মত কোমলতায় ভরা একটি স্বাস্থ্যবতী কিশোরীর সমস্ত ভার বহন করতে সক্ষম হতাম।
আমরা মজা করতাম আমাদের উদ্ভট ধরনের শিক্ষকদের নিয়ে। আর তাদের অসংলগ্ন কার্যকলাপ নিয়েও কম রসিকতা হত না। যেমন- অংকের শিক্ষক জামাল স্যার নিয়মিতই অংক করতে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন এবং ক্লাসের ঘন্টা পড়া মাত্র ধড়ফড় করে উঠে বসে প্রতিদিনের মতই বলতেন- এই যাহ্ ! গত রাতে একটুও ঘুম হয়নি। ঠিক আছে, তোরা অংকগুলো বাড়ীতে করিস।
আমরা বাধ্য হয়েই বলতাম- কোন গুলো স্যার? স্যার তখন আবারও ধাতস্থ হবার চেষ্টা করতেন এবং টকটকে লাল চোখে ঘুমে ঢুলু ঢুলু ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতেন-পরের পাঁচটা। এ নিয়ে হাসাহাসি আমাদের নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল।
বাড়ী ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে সোজা মাঠে। তখন বেলা হয়তো বেশী থাকত না। তবুও ঐ সময়টুকু ছিল সবচেয়ে দামী। রোদ তখন কাঁচা সোনার মত শেষ ঝিলিক দিত। পশ্চিমের সূর্য যেন তেতে ওঠা লোহার থালা। খেলার মাঠে তখন ছেলে-মেয়েদের ছড়াছড়ি। আনন্দের বানে ভাসতে ভাসতে ঘেমে নেয়ে উঠতাম। সন্ধ্যা যে কখন হত তা নিয়ে ভাবার মত সুযোগ কোনদিনও হয়নি। প্রতিদিনই খেলা শেষ হতে হতে সূর্য তলিয়ে যেত। আকাশের বুক থেকে রক্তিম আভার শেষ প্রলেপটুকু মুছে গিয়ে পায়ে পায়ে নেমে আসত অন্ধকার। ঘন গাছ-পালায় ঘেরা বাড়ীগুলো যেন অতিরিক্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন এক একটা ঝোপঝাড় মনে হত। দু’জনে হাত ধরে ফিরে আসতাম যে যার ঘরে। তখন সন্ধ্যার পড়াশুনার তাড়া হাতছানি দিয়ে ডাকত। আর নাকের ডগায় ঝুলতে থাকত বদরাগী স্যারদের বেতের লকলকে শরীর। না পড়ে তুমি কোথায় যাবে বাছাধন।
জ্যোৎøার রাতগুলো ছিল সবচেয়ে মাতোয়ারা। এই সব রাতে কি যে মজা হত তা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে যখন বাড়ীতে বাড়ীতে ফসল উঠত আর খড়ের গাদা দাঁড়িয়ে থাকত নতুন একটা হৈমন্তী বিলাস নিয়ে। তখন সারা বাড়ীময় খড়ের ছড়াছড়ি। স্কুল ছুটির সময়গুলো হত সবচেয়ে বেপরোয়া। তখন আমাদের মায়েরা আমাদের আর খুঁজে পেতেন না এবং অজানা শংকায় তাদের মন ভরে উঠত। আমরা আনন্দের পাশাপশি মায়েদের এই সব শংকাও উপভোগ করতাম। আমরা চাঁদের আলোর নিচে কয়েকজন কিশোর-কিশোরী লুকোচুরি খেলতাম। খেলতাম বৌছি। আরো কতকি দারুন দারুন বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন খেলা, তাদের নামেরও যেন কোন শেষ নেই।
সেইসব রাতগুলোতে আমরা সন্ধ্যাবেলায়ই ভাত খেয়ে নিতাম। এতে আমাদের কর্মক্লান্ত মায়েরা দায়িত্ব মুক্ত হত। আমাদের সাবধানে খেলতে বলে তারা বিশ্রাম নিত। আমাদের পিতাদের সাথে সাথে গল্পে মেতে উঠত। সময়টা তাদের জন্য ছিল সামান্য স্বস্তির  জীবনের যে ভার তাদের নুয়ে ফেলেছিল তারা তা থেকে ক্ষনিকের জন্যে হলেও মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করত। শীত তখন আসি আসি। প্রকৃতিতে অন্যরকম এক গাম্ভীর্য। কেমন যেন একটা বিষন্ন বিষন্ন ভাব। কিন্তু এই সব নিয়ে ভাববার মত অবকাশ তখন ছিলনা। কৈশোরের উচ্ছলতা ভাসিয়ে নিয়ে যেত বানের জলের মত। সন্ধ্যার আকাশে কুয়াশার সামান্য আবরণ লেগে থাকত। রাত্রির গভীরতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ঝড়ে পড়ত রূপালী চাঁদের আলো। সব কিছু হেসে উঠত। চাঁদের সেই আলোতে আমাদের মনে হত ভ্রাম্যমান জ্বীন-পরী। থৈ থৈ জ্যোৎøায় অপূর্ব স্বপ্নীল এক আবেশ। পাগলামী তার চুড়ান্ত সীমারেখা অতিক্রম করত। ভাললাগা যে কি চরম শিহরণে তনুমনকে শিহরিত করতে পারে তা যেন অনুভব করতাম মর্মে মর্মে। সব আনন্দকে ছাপিয়ে যেত নীতুর উপস্থিতি। রূপালী ইলিশের মত ওর শরীর চাঁদের আলোতে যেন অসাধারণ এক উজ্জলতা নিয়ে জ্বলে উঠত। গল্পে শোনা রাজকুমারী মনে হত ওকে। মায়াবী মুখখানা যেন প্রশান্ত কোন আশ্রয়। আমি ওর মাঝে নিজেকে হারিয়ে খুঁজতাম। ও সবই বুঝত। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে সেসব ছেলেমানুষীকে উপভোগ করত সঘন বিহবলতায়।
    অজস্র জ্যোৎøা রাত এসেছিল আমাদের জীবনে। সেই শৈশব থেকে কৈশোরের সূচনা লগ্নে। কিন্তু এর মধ্যে একটি রাত এসেছিল নিজস্ব অবয়ব নিয়ে। সেই রাত তাই আজও হৃদয়ের রাজ্যে একটা উজ্জ্বল দীপ শিখা। সেই রাত তাই স্মৃতির মিনারে সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভ। তাকে ভোলা যায় না।
কি এমন ঘটেছিল সেই রাতে? হয়ত কিছু নয়। আবার হয়ত অনেক কিছু। খেলা তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল। সবাই ফিরে গেছে যে যার ঘরে। আমরা ঠিক করলাম আজ আর ঘরে ফেরা নয়। চাঁদের আলোর নিচে দু’জন রাত কাটাব। রাত ভর দেখব জ্যোৎøার রূপালী ধারার পতন। প্রকৃতির বুকে জেগে থাকব অপার বিস্ময় নিয়ে। সে যে কি এক দুর্বার আকাঙ্খা। সে আহ্বান এসেছিল আমাদের আদিম অস্তিত্ব থেকে। আমাদের তা বোঝার কথা নয়। আমাদের কাছে তাই তা ছিল কেবল এক উদ্দাম কৌতূহল। আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম কোন কিছু না ভেবেই। কারণ আমাদের তখন তেমনি বয়স। সবাই তখন ঘরে ফিরছিল। আমরাও তখন ঘরে ফেরার ভান করলাম। যাতে কেউ আমাদের উদ্দেশ্য জানতে না পারে। আমরা চাইনি কেউ আমাদের সঙ্গী হোক। এ ধরনের আয়োজনে দু’জনের বাইরের কারো উপস্থিতি কাম্য নয়। সবাই চলে গেলে সাবধানে বেরিয়ে এলাম আড়াল থেকে। দু’জনে মিলে একটা খড়ের গাদার উপর বসলাম। নীতু ওর দীর্ঘ ওড়নাটা বিছিয়ে দিল। শুয়ে পড়লাম দু’জনে পাশাপাশি। ও আমার দিকে পাশ ফিরে শুলো। হাত রাখল আমার মাথায়। আস্তে আস্তে সেই হাত খেলা করতে লাগল চুলের অরণ্যে। পাশ ফিরে তাকাতেই ও হাসল। রূপালী চাঁদের নীচে ও যেন নক্ষত্রের সহোদরা। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে উজ্জ্বল মুখশ্রীতে। ভেসে যাচ্ছি আনন্দের বন্যায় যেন দু’টি কোমল পদ্ম। নিস্পাপ সেই অভিব্যক্তিকে মুহুর্তের জন্য ঢেকে দিল হেমন্তের আকাশে অনর্থক ভেসে আসা একখন্ড উদ্দেশ্যহীন মেঘ। পরক্ষণেই আবার আগের সেই শুভ্রতা। আমি জানতাম না এর কি পরিণতি। জানলে অবশ্য এ জীবন হয়ত অন্যরকম হত। আজও আমি তার প্রেমে বাধা পরে থাকতাম কিনা তাতে সন্দেহ ছিল। যা কিছু সৃষ্টি তার জন্য এক পলকই যথেষ্ট।
কথা ছিল জেগে থাকার। কিন্তু কখন যে ক্লান্ত শরীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে টের পাইনি। আকাশের চাঁদ হয়ত অলক্ষ্যে হেসেছে। বার বার ডেকে ডেকে বলেছে- হয় জেগে থাকো, নয়তো ঘরে ফিরে যাও। এভাবে অনর্থক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সব পন্ড করোনা  বেরসিক। কিন্তু ঘুমন্ত মানুষ কি কারো আহবান শুনতে পায়?
ঘুম ভাঙ্গে ধাক্কা খেয়ে। ধড়ফড় করে উঠে বসি। চোখ ডলতে ডলতে দেখি নীতু আমার পাশে উঠে বসেছে। অগ্নিমূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীতুর মা। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। নীতুও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নীতুর মা এক হাতে ওর চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে ফেলে। আমি অবশ হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকি। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে শুধু এটুক্ ুবলেন-
- তোমার মাকে আমি সব খুলে বলব। যা করার তিনিই করবেন।
আমি বসে থাকি পাথরের মূর্তির মত। নিজেকে কেন জানি ভীষণ অপরাধী মনে হয়। কিন্তু আমার সেই অপরাধটা যে কি, তা বুঝে উঠতে পারি না শত চেষ্টায়ও।
নালিশ আসে মায়ের কাছে। শাস্তিও হয় যথার্থ। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। বই খাতা তুলে রাখেন। স্কুলে যেতে হবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন। আমি আরও অবাক হই। ঘরে গিয়ে না ঘুমালেই শাস্তি। এ যে দেখছি লঘু পাপে গুরু দন্ড।
মাকে কিছু বলতে সাহস হয় না। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরি। নীতুর কাছে যেতে সাহস হয়না। পাছে ওরা মা দেখে ফেলে। তাহলে হয়ত খবর আছে। তার যে মূর্তি দেখেছি তা ভূত দেখার চেয়ে হাজার গুন মারত্মক। এই জীবনে সেই দৃশ্য ভোলার সম্ভাবনা অত্যন্ত নগণ্য।
আস্তে আস্তে সবকিছূ স্বাভাবিক হয়ে আসে। মায়ের রাগ কমে যায়। খেয়ে দেয়ে স্কুলে যাই। নীতুও যায়। তবে আলাদা ভাবে। তার সাথে আমার আর কোন কথা হয় না। আমি বুঝতে পারি না কেন সে আমার সাথে কথা বলে না। এ আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আমার বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। বার বার শুধূ জানতে ইচ্ছা করে এমন কি অপরাধ আমি করেছি যার জন্য এই শাস্তি? কিন্তু কার কাছে আমি আমার নালিশ জানাব। সবাই আমাদের দেখে মুখ টিপে হাসে। একদিন ছুটির পর ফাঁকা রাস্তায় আমরা দু’জন বাড়িতে ফিরছিলাম। হঠাৎ করেই নীতু আমাকে ছোট্ট করে নিচু গলায় ডাকল। আমি হয়ত তার এই আহ্বানের অপেক্ষাই করছিলাম। ওর ডাক শুনে দাঁড়ালাম। মিষ্টি করে হাসলাম। নীতুও হাসল। কাছে এসে বলল- একটু বস্। তোর সাথে কথা আছে। দু’জন রাস্তার পাশে বসলাম। ওর মুখের দিকে তাকালাম রাজ্যের তৃষ্ণা নিয়ে। আমার মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কেন যে এমন হয়েছিল তা বুঝতে পারছি। সে দিন পারলে হয়ত আরো ভালো হত। নীতু ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ছোট্ট বুকটা কেঁপে উঠল। তারপর আমার দিকে চোখ মেলে কি যেন দেখল। মুহুর্তের সেই চাহনী আমাকে এলোমেলো করে দিল। সেই প্রথম বুঝলাম নীতুর জন্য আমার ভীষণ মায়া। কিন্তু ওই প্রথম কথা বলল-
- খুব বদনাম হয়ে গেল নিয়াজ। সবাই কি সব বলাবলি করছে। আমরা নাকি কি সব খারাপ কাজ করেছি। তোকে কি কেউ কিছু বলেছে?
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। একি বলছে নীতু। আমরা কি এমন খারাপ কাজ করেছি যা সবাই বলাবলি করতে পারে? - কই না তো! আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।    - তুই মন খারাপ করবি না। যে যা বলে বলুক গায়ে মাখবি না। সবগুলো খারাপ। মনের মধ্যে শুধু শয়তানি। নিজেরা যেমন অন্যকেও তাই ভাবে। - তোকে কিছু বলেছে? - না, তেমন কিছু বলেনি। এ নিয়ে তুই ভাবিস না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমরা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। পাশাপাশি হেঁটেই বাড়িতে ফিরলাম। তবে আগের সেই দিন গুলোর মত আর নয়।
বিকেলে আর মাঠে আসেনা নীতু। ও যেন এখন অন্তঃপুর বাসিনী। স্কুলে যাওয়া-আসা পর্যন্ত। তাও হাত, পা, মাথা সব ঢেকে। তবে এই নতুন সাজে ওকে দারুণ লাগে।
দু’জন আলাদা হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ওকে ফিসফিস করে বললাম- তোর ওড়নাটা আমার কাছে রেখে দিয়েছি। সারা জীবন রেখে দিস। মাকে বলেছি হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে ফেরৎ দিতে হবে না। ওর কথা শেষ হতে না হতেই দেখলাম মালেক ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বিশ্রী ভাবে হাসছে। সে হাসি যে অর্থপূর্ণ তা বোঝার মত বয়স তখন হয়ে গেছে। পরিস্থিতি একটি শিশুকেও বলে দেয় তার সিদ্ধান্ত। আর আমি তো একটি কিশোর।
সন্ধ্যার পরক্ষণেই ঘরে ফিরছিলাম। আমাদের গরু গুলোর মধ্যে একটা পাওয়া যাচ্ছিল না। খুজঁতে বের হলাম। নীতুদের বাড়িতেও খুজঁতে হল। থাকতে তো পারেই। ওদের বাড়ির পিছনের দিকটায় কি জঙ্গল রে বাবা! দিনের বেলায়ও তাতে গরু কেন আস্ত একটা চিতাবাঘ লুকিয়ে থাকতে পারে। আর রাতে তো কথাই নেই। খুঁজতে খুঁজতে যখন হয়রান হয়ে গেছি তখনই ফিসফিস করে কে যেন ডাক দিল। ফিরে তাকাতেই দেখি নীতু। ছুটে এল আমার কাছে। এতটা মুখোমুখি যে ওর তপ্ত নিঃশ্বাস লাগছিল আমার চোখে মুখে। প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থায় বলল-
- জানিস, মালেক ভাই কি ভীষণ বদ। আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল একা ঘরে পেয়ে। বলে কিনা, নীতু, তুমি তো বেশ বড় হয়েছ। সব বোঝ। কাছে আস। তোমাকে আদর করি। আমি ধাক্কা মেরে দৌঁড়ে পালিয়েছি। তুই কাউকে বলিস না। আবার যে বদনাম হবে।
বিস্ময়ে হা হয়ে যাই। এসব কি হচ্ছে? আমার ভীষণ রাগ হয়। নীতু হাত ধরে বলে- রাগ করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ওর ধারে কাছেও যাচ্ছি না। এরপর কাছে এলে মুখে থুতু দেব। নইলে জুতা খুলে গালের উপর ছুড়ে মারব। তখন মজা বুঝবে।
আমাকে চলে যেতে বলে নীতু। আমি চলে আসি। সুমধুর কন্ঠের গান ভেসে আসে কানে। আনন্দের গান। তার মনটা হয়তো খানিকটা হালকা হয়েছে।
সব কিছু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে। দুপুরের যে খরতাপ সূর্য সে-ও বিকেলে স্তিমিত। সময় এমনই এক মাত্রা যে সব কিছুকে ম্লান করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। আমরা বেড়ে উঠতে থাকি আমাদের মতই। সবকিছু বদলে যেতে থাকে আস্তে আস্তে। অত্যন্ত ধীর গতির সে পরিবর্তন ঘটে যায় সবার অলক্ষ্যে। প্রকৃতি কাজ করে যায় তার নিজেরমত করে।
যখন কোন পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন হয় তখন তার তাপমাত্রা স্থির থাকে। পরিবর্তনটা শুরু হয় অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে। মানুষের জীবনেও এর কোন ব্যত্যয় ঘটে না। সেইদিনের সেই সহজ সরল অস্পষ্ট কৈশোরের অপরিণত বুদ্ধি বৃত্তির সময়গুলো জীবনের মেধা আর মনিষাকে নীরবে নিভৃতে কতটা সমৃদ্ধ করেছিল আজ তা তিলে তিলে উপলব্ধি করছি। আজকের যে পরিণত সত্তা তার বীজ রোপিত হয়েছিল সেই নাবালক সময়ে। সমস্ত প্রকৃতিই তার হাতকে উদার করে দিয়েছিল দান। সেই দানই আজ সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য। তাকে প্রেমই বলি আর প্রতিভাই বলি এই প্রাপ্তি সে দিনের ফসল। সে দিন অস্তিত্বের সমস্ত ফাঁক ফোকর ভরে দিয়েছিল প্রকৃতি দেবী। আজ তা শত গুনে বৃদ্ধি পেয়ে উপছে পরছে সত্তার বাইরে। আজ যেন আরো নিবিড়ভাবে অনুভব করছি সেই সদ্য কাটা খালে প্রথম জলের আগমন, পানির উপরে ভাসমান মিহি স্বচ্ছ কুসুমের মত আবরণ, জোয়ার আর ভাটার মাঝে প্রশান্ত সেই জলের ধারা। আজ আরও নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করছে সুপারী গাছের ঘন নিবিড় আচ্ছাদন, জামের পাতার আড়ালে লুকানো জামের ঝুড়ি আজ যেন চোখের সামনে ভাসছে। বেতের ফলের মত নীতুর সেই চোখ আজ সাগরের গভীরতা নিয়ে ডাগর ডাগর হয়ে ধরা দেয়। এখনও মনে হয় ওর সদ্য সুগন্ধী নারিকেল তেল মাখা চুলগুলো খেলা করছে পিঠময় আর তার মোহনীয় সুবাস আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সমস্ত স্মৃতির রাজ্যে। আমি যেন একটি তিতির হয়ে সেই চির চেনা ভূখন্ডে ঘুড়ে বেড়াই। পলিমাটির উর্বরতায় ভরা প্রিয় ভুখন্ড আমার। তোমার সাথে আমি আজও একাত্ম।
ঘুমের ঘোরে হঠাৎ নীতু নড়েচড়ে উঠলে নিয়াজের সম্বিত ফিরে আসে। সে ধাতস্ত হওয়ার চেষ্টা করে। ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। নিঃশ্বাসটা যেন এতক্ষণ বুকের মধ্যে আটকা পড়ে ছিল। তাহলে কি সে নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিল। অতীতের হারানো স্মৃতির ভার তাকে যেন আরো ক্লান্ত আর অসহায় করে তোলে । কি একটা অজানা দুঃখে তার ভিতরটা চিন চিন করে ওঠে। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা এই অজানা দুঃখের কারণ। তার নীতু তো তার কাছেই আছে। তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এর পরও তার কষ্ট হচ্ছে কেন। আসলে অন্তরের এই জটিল রহস্যের কোন কুল কিনারা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অস্থিরতায় তার নাকের নীচে ঘাম জমেছে। সে আঙুল দিয়ে তা মুছে ফেলে আলগোছে।
এক সময় নীতুর ঘুম ভেঙ্গে যায় । টুকটাক দু’চারটা কথা বলে দু’জনে। চুপচাপ বসে থেকে অন্তহীন অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহুর্তে তাদের আর তেমন কিছু করার নেই। সারাটা দিন অলস অপেক্ষার মধ্যে দিয়েই কাটে।
দিনটা তবু ভালই কেটেছিল ক্ষুধা আর অপেক্ষার মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই তার সাথে নতুন এক উপদ্রব যুক্ত হতে শুরু করেছে। পৌষের তীব্র শীত। খোলা মাঠে প্রকোপটা তাই আরও বেশী। শীত যতই বাড়ছে তীব্রতাও ততই বাড়ছে। নিয়াজ শংকিত হয়ে উঠল নীতুর জন্য। এই ভয়ংকর শীত নীতু কিভাবে সহ্য করবে। আবার ঠান্ডায় জমে মরে যাবে না তো। সে নীতুকে শক্ত করে তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। নীতু দু’হাতে নিয়াজকে আকড়ে ধরে। তার শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে।
শীতের সাথে সাথে কুয়াশাও পড়ছে। তাতে তারা ক্রমশঃ ভিজে যাচ্ছে। দু’জন দু’জনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজেদেরকে সমস্ত প্রতিকূলতার হাত থেকে রক্ষা করতে চাইছে। এই মুহুর্তে এ ছাড়া তাদের আর কোন পথ নেই।
এভাবে জড়িয়ে থাকতে এক সময় কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে। তাদের মনটা যেন কেমন-কেমন করে। কি জানি কি একটা পেতে চায়। খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত প্রান্তরে ঘনিষ্ট বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুয়ে থাকা যুগল সত্তা তাদের অস্তিত্বের গভীরে নিবিড় হয়ে মিশে যাওয়ার বাসনায় উদ্বেল হয়ে ওঠে। নীতু হঠাৎ করে নিয়াজের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। নিয়াজের সমস্ত অস্তিত্ব যেন কেঁপে ওঠে। নিয়াজও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় নীতুর ঠোঁট, নাক, কান, গাল, গলা সারাটা মুখশ্রী। দুজন দু’জনের তপ্ত অধরের মধু পান করতে থাকে নিমগ্ন ভ্রমরের সহজাত সৌন্দর্যে।
নীতু ধীরে ধীরে ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। নিয়াজের কানের কাছে মুখ রেখে বলে-
- আমাকে আদর করো, আরো বেশী আদর করো।
- আদর তো করছিই। এটা কি আদর নয়?
- আরো বেশী, অনেক। আমাকে তুমি পাগল করে ফেলো নিয়াজ।
-তুমি তো পাগল হয়েই আছ। এত পাগলামী এর আগে কখনও করেছ, আমার তো মনে পড়ে না।
-কেমন করে করব। এতটা নিবিড় করে আগে যে তোমাকে কখনও কাছে পাইনি। পেলে হয়ত করতে পারতাম। সেই জ্যোৎøা ভেজা রাতের কথা তোমার মনে পড়ে। সে রাতে যদি এখনকার মত বড় থাকতাম আর এতকিছু বুঝতাম তাহলে ভীষণ মজা হত। তোমাকে অনেক আদর দিতে পারতাম। অনেক আদর নিয়াজ, অনেক সুখ।
নীতু নিয়াজের মাথাটা তার বুকের ভেতর টেনে নেয়। সেই নরম কোমল রাজ্যে নিয়াজের সমস্ত দুঃখ যেন কোথায় হারিয়ে যায়। সে পাগলের মত মুখ ঘষতে থাকে। নীতুর সারাটা শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। মুখ বুজে সে নিয়াজের মিষ্টি উৎপাত সহ্য করে। অনভ্যস্ত বলে তার কেমন যেন একটা সুড়সুড়ি লাগে। তবে তা মধুর।
নিয়াজের আদরে নীতু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। হাত পা ছেড়ে দিয়ে ঘাষের উপর গা এলিয়ে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। নিয়াজ বুঝতে পারে নীতু এখন আবেগের শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করছে। তাই এমন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। সে আস্তে আস্তে নীতুর শরীরের উপর উঠে আসে। নীতুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে আঁখি পল্লব নিমীলিত। আলো আধাঁরের মাঝে নীতুর কামাতুরা মুখ যেন পুরাণের রাধার কথা মনে করিয়ে দেয়। যামিনীর কামিনীর এই কামরাঙা মুখ যে কত পুরুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে সে কথা ভাববার মত সময় নিয়াজের নেই। নিয়াজের দুর্বার ভালোবাসার কাছে নীতুর সব কষ্ট আর যন্ত্রনা ফুল হয়ে ফুটে ওঠে মধ্যরাত্রির আবছা অন্ধকারে ছাওয়া সবুজ ঘাসের বিছানায়।
দেখতে দেখতে দু‘দিন কেটে গেল। এ দু‘দিন পানি ছাড়া আর কিছুই পেটে পরেনি। নান্টু একবারও আসেনি এ দু‘দিন। নীতুও ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এই দীর্ঘ সময়ের সবটাই নীতুকে সে কোলের উপর রেখেছে। দুটো রাতই নীতু তার কোলের উপর ঘুমিয়েছে। তবুও নিয়াজের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নিজের জন্য সে ভাবছে না। ভাবছে নীতুর জন্য। নীতু কোন দিন সামন্য কষ্টও করেনি। শেষ পর্যন্ত সে এতটা কষ্ট সহ্য করতে পারবে তো। নাকি নিয়াজকে ফেলে চলে যাবে। নীতুকে দেখে তেমন মনে হয় না। সে নিয়াজকে মুহুর্তের জন্য দূরে যেতে দিতে রাজী নয়। অবশেষে অনেক বুঝিয়ে খাবার আনার জন্য নিয়াজ মাঠের বাইরে রওনা হল। মাঠ থেকে যখনই রাস্তায় উঠবে তখন তার সামনে পুলিশ পড়ল। সে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল।
-আপনি তো ভাই মাঠের মধ্য থেকে আসলেন। শুনলাম এদিকে মাঠের মধ্যে একটা ছেলে একটা মেয়েকে নিয়ে লুকিয়ে আছে। আপনি ওদের দেখেছেন নাকি?
- কই নাতো। আমি গিয়েছিলাম ধান ক্ষেত দেখতে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যান। শালারা যে কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে।
পুলিশ দু’জন চলে যেতেই নিয়াজ আবার মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পুলিশ তাহলে তাদের অবস্থান জেনে গেছে। অনেক কষ্টে সে নীতুকে নিয়ে এমন জায়গায় চলে এল যেখানে আসা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ ধারনাও করতে পারবেনা এখানে কোন মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। একটা ঢিবির উপর নীতুকে কোলে নিয়ে বসে রইল সে।
- খাবার আনলে না। নীতু কোন রকমে শুকনো গলায় কথাগুলো বলল।
নিয়াজ এখনও হাপাচ্ছে। সে থেমে থেমে সব কথা নীতুকে বলল। নীতু বলল- প্রয়োজনে না খেয়ে মরব তবু ধরা পরতে রাজী নই। নীতু চুপ করে রইল। নিয়াজ বলল- আজ রাতে যে ভাবেই হোক আমি তোমাকে নিয়ে নান্টুদের বাড়ীতে যাব।  ওদের বাড়ীর মাচায় দু’জনে লুকিয়ে থাকব। তারপর যখন সবকিছু একটু স্বাভাবিক হবে তখন বাইরে বেরোবো।
গভীর রাতে নান্টু ঠিক ঠিক এসে হাজির হল। এখন লোক তো দূরে থাক একটা কাক পক্ষীও জেগে নেই। নান্টু নিয়াজের নাম ধরে ডাকতেই নিয়াজ কেঁপে উঠল। তারপর ফিরে তাকাতেই বলে উঠল - ভয় নেই। আমি নান্টু। তোর বন্ধু। তোরা কেমন আছিস?            
- ভাল আছি। তুই কেমন?
- কেমন টেমন পরে। ওরা আমার উপরেও লোক লাগিয়েছে। কিন্তু আজ আর তাতে কোন লাভ হবে না। আজ অমাবশ্যা। ও শালা নিজেই ঘরে ঢুকে তালা লাগিয়ে বসে আছে। কিছু খেয়েছিস?
না। খবার পাব কই। খাবার আনার জন্য বাইরে বেরিয়েই পুলিশের মুখোমুখি। যেন সাক্ষাত যমদূত। অবশ্য চিনতে পারেনি।
- এই নে। আমি তোদের জন্য কিছু খাবার এনেছি। আগে খেয়ে নে। তার পর একটু জিরিয়ে নিয়ে রওনা হব।
- ওদিকের অবস্থা কেমন?
- ভাল। আর ক’টা দিন গেলে আমার মনে হয় সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুই খুব বেশি চিন্তা করিস না। শোন, আমি থাকবো সামনে সামনে। তোরা একটু পিছনে। যদি কারো মুখোমুখি হই তাহলে তো বুঝতেই পারবি। আস্তে রাস্তার পাশে নেমে চুপচাপ বসে পড়বি। নীতু শোন। ভয়ের কিছু নেই। তবে কোন শব্দ করবেনা।
নান্টু সামনে। নিয়াজ আর নীতু দু’জন দু’জনকে জড়াজড়ি করে ধরে হাঁটছে। তারা নান্টুর একটু পিছনে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের শরীর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। পাকা ধানের ছড়ার সাথে বারবার ঘষা লাগছে। হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই পা পড়ছে আলের বাইরে। পানির মধ্যে ঝুপ ঝুপ শব্দ হচ্ছে। অবশ্য শব্দ হলেও কোন অসুবিধা নেই। অমাবশ্যার রাত্রে এই নির্জণ মাঠে মানুষ তো দূরে থাক ভূত পেতœীও বোধ হয় লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।
- উহ্। নীতু কঁকিয়ে উঠল।
- কি ব্যপার? পা কেটেছে নাকি?
- হ্যাঁ। শামুক ঢুকে গেছে পায়ের মধ্যে।
গাঢ় অন্ধকারে নীতুর বেদনা বিধ্বস্ত মুখ দেখতে পেল নিয়াজ। নীতু নিজেই ভাংগা শামুকের টুকরোটা টেনে বের করে ফেলল। নীতু আবারও কঁকিয়ে উঠল। রক্ত ঝড়ছে বোধ হয়।
- কি হয়েছে? নান্টু পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করল।
- তেমন কিছু না। নীতুর পা কেটেছে শামুকে। চল।
হোঁচট খেতে খেতে তারা এক সময় নান্টুদের বাড়ীতে এসে পৌঁছল। ভাগ্যিস কেউ সামনে পড়েনি। নান্টুর মা জেগেই ছিলেন। দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে দিলেন। নান্টুদের বাড়ীটায় ওরাই একমাত্র গৃহস্থ। ওর বাবা ঝামেলা পছন্দ করতেন না। তাই বাপ-দাদার বাড়িতে ভাইদের সাথে জড়াজড়ি করে না থেকে আলাদা এক বাড়িতে শান্তিতেই ছিলেন। তার অন্যান্য ভাইয়েরা বাপ-দাদার ভিটেয় থেকে গেছে। তাদের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই আছে। নান্টুর বাবা কারো সাতেও ছিলেন না কারো পাঁচেও ছিলেন না। তার সাথে সবার সাথেই ভাল সম্পর্ক ছিল। মাত্র দু’বছর হয় তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার পর এই বিশাল বাড়ীতে মাত্র দু’টি প্রানী। নান্টু আর তার মা। সহায় সম্পত্তি যা আছে তাতে ভালোভাবেই চলে যায় দু’জনের। অনেক প্রয়োজন মিটে যায় বাড়ী থেকেই।
নান্টুর মার চোখে মুখে আনন্দ চকচক করছে। যেন তার নিজের ছেলেই বউ নিয়ে ঘরে এসেছে। নিয়াজকে সে নিজের ছেলের মতই জানে।
নান্টু একটা পাটি আর দু’টো বালিশ নিয়ে লেপ হাতে উপরে গেল। তার পর পাটিটা বিছিয়ে বালিশ দু’টো পাশাপাশি রেখে সিঁড়ির কাছে গিয়ে হাত ইশারায় ওদেরকে ডাকল। নান্টুর মা ফিস ফিস করে বললেন- যাও বাবা, বিশ্রাম নাও। এই দু’দিন তো মনে হয় ঘুমাতেও পারনি। সকাল হওয়ার সাথে সাথেই তোমাদের জাগিয়ে দেব। একটা কাঠের বাক্স আছে। দিনের বেলায় ওটার মধ্যে লুকিয়ে থাকবে। নিয়াজ নীতুকে নিয়ে অতি সন্তর্পণে উপরে উঠল। তারপর চুপচাপ দু’জনে গিয়ে শুয়ে পড়ল পাশাপাশি। ঘুমে নিয়াজের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। শোয়ার সাথে সাথেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
একটা বুনো মোষ নিয়াজকে তাড়াচ্ছে। সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এক পাও নড়তে পারছে না। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। অথচ নিজের কানেই সে চিৎকার পৌঁছাচ্ছেনা। এক সময় সে বুনো মোষ তাকে দু’শিংয়ের মাথায় তুলে শূন্যে ছুঁড়ে মারল। সে ধপাস করে নিচে পড়ল। ধরফড়িয়ে উঠল নিয়াজ। তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভয়ে তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নীতু তার বুকের উপর শুয়ে আছে। সে উঠতে চেয়েও উঠল না। নীতুর ঘুম ভেঙ্গে যাবে। নিয়াজ নীতুর মাথায় হাত বুলোতে লাগলো।
দারোগা সাহেব অস্থির হয়ে উঠছেন। শালারা করে কি? একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে খুঁজে বের করতে পারে না। ওরা কি এই এলাকায়ই আছে না কি অন্য কোথাও পালিয়ে গেছে তারই বা ঠিক কি? তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। দুলালের ডাকে ধাতস্ত হতেই বললেন- এসো দুলাল। বসো। বাড়ীর খবর কি? সবাই ভাল।
- ভাইজান ভালই। তবে ভাবী ভেঙ্গে পরেছেন। সারা দিন শুধু কান্নাকাটি করেন।
- বাড়ীতে যাও। বেশী ঘোরাঘুরি করো না। এ দু’দিনেই তো তোমার অবস্থা কাহিল। অসুস্থ্য হয়ে পড়লে আরো সমস্যা।
দুলাল বাড়ীর দিকে রওনা হল। দারোগা সাহেব ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত । এক দিকে খুন অন্য দিকে কিডন্যাপ। অথচ কোন রহস্যেরই জট খুলতে পারছেন না। অবশ্য খুনের জট এত তাড়াতাড়ি খুলবে না। কিন্তু নীতুকে তো যে ভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। নীতু কি এখনও অক্ষত আছে! তিন তিনটে রাত পেরিয়ে গেল। ছেলেটা ওকে নিয়ে চটকা চটকি করেনি তো! এসব করার জন্য কয়েক মুহুর্ত যথেষ্ট। সেখানে তিনটে রাত তো অনেক কিছু। ওরা কি এত দিনে বিয়েও করে ফেলেছে? ছেলেটা যদি নীতুকে স্রেফ ভোগ করার জন্য নিয়ে যায়? তার পর মনের সাধ মিটে গেলে যদি তাড়িয়ে দেয়। নীতু কি তাহলে আতœহত্যা করবে? নাকি নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখে কষ্টে পাগল হয়ে যাবে? যদি নীতু একা ফিরে আসে আর শোনে লম্পটটা তাকে একা ফেলে রেখে পালিয়েছে তাহলে কে তাকে বিয়ে করবে? মোজাহের সাহেব কি তখন দারোগা সাহেবকে নীতুকে বিয়ে করতে বলবেন? তিনি নিজেই বা কি করবেন। দারোগা সাহেব আর ভাবতে পারছেন না। তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন। তার মাথায় এখন কিছুই ঢুকছে না।
দেখতে দেখতে আরো দুটো দিন কেটে গেল। এখন পরিস্থিতি বেশ শান্ত। সবাই ধরেই নিয়েছে নিয়াজ নীতুকে নিয়ে পালিয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবও অনেকটা নরম হয়ে গেছেন। আমেনা বেগমও কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত। এভাবে বন্দী হয়ে থাকতে নিয়াজেরও আর ভাল লাগছেনা। কিন্তু বাইরে বেরোলেই পুলিশ ধরে ফেলবে। তার উপরে গ্রামবাসীরাতো আছেই। গ্রাম পুলিশরাও রয়েছে আশে-পাশে । রাতের অন্ধকার একটু বাড়তেই নিয়াজ নান্টুকে বলল- চল। বাজারের দিকে যাই। আমি ভাঙ্গা ব্রিজটার উপড় দাঁড়াব। তুই বাজারে গিয়ে খবরাখবর জেনে আসবি। বাজারে গেলেই সব কিছু আঁচ করতে পারবি। বাজার করা ভীষণ প্রয়োজন। এই দু’দিন নান্টুও ওদের সাথে লুকিয়ে থেকেছে। কেউ এলে নান্টুর মা বলেছে নান্টু তার নানা বাড়ী বেড়াতে গেছে। নান্টুর নানা বাড়ী বেশ দূর। সেখানে গিয়ে কারো খোঁজ নেওয়া সম্ভব নয়। নিয়াজের কথায় নান্টুও রাজি হল। এখন রাস্তাঘাটে লোকজন একদম নাই বললেই চলে। দু’একজন যদি দেখেও ফেলে অসুবিধা নেই। বেশ কিছু দিন হয়ে গেছে। নীতুদের আর মেনে নেওয়া ছাড়া কোন পথ নেই। নীতুর খোঁজ পেলে তারাই হয়ত এসে সব কিছু মেনে নেবেন। এ খবর আর কারো জানতে বাকি নেই। চেয়ারম্যান সাহেব আর তাদের ভালবাসাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। পুলিশ আসার কোন সম্ভাবনা নেই এ মুহুর্তে । থানা এখান থেকে অনেক দূরে। কেউ দেখলেও সে থানায় না গিয়ে আগে যাবে চেয়ারম্যান বাড়ীতে। বকশিসের আশায়। পুলিশী ঝামেলায় জড়ানোর ইচ্ছা কারো নেই। ভাঙ্গা ব্রীজের এদিকটা একদম নির্জণ। নিয়াজ আবছা অন্ধকারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। নান্টু বাজারে গেছে। তার ফিরতে একটু দেরী তো হবেই। নিয়াজের নীতুর কথা মনে পড়ল। নীতু ঘুম থেকে উঠে চেঁচামেচি শুরু করবে না তো। নীতু জেগে থাকলে নিয়াজকে নিশ্চয়ই আসতে দিতনা। যেভাবেই হোক আটকে রাখতো। কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ঝাপসা অন্ধকারে পা টিপে টিপে এদিকে আসছে কে যেন। নিয়াজ কান খাড়া করল। বিপদগ্রস্ত মানুষের øায়ুতন্ত্র থাকে প্রচন্ড উত্তজিত। সব কিছুই তাদের স্পর্শ করে ভীষণ ভাবে। একটুতেই অনেক বেশি সতর্ক হয়ে যায়। নিয়াজের চিন্তায় ছেদ পড়ল। সে মুখ তুলে তাকাতেই তাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরল কে যেন। তার পর শক্ত হাতে মুখ চেপে ধরল। একটা ধারালো ছুরি তল পেটে ডান কিডনি বরাবর আমূল গেঁথে দিল। এক টানে সেই রক্তাক্ত ছুরি টেনে বের করে আবারও বসিয়ে দিল বাম কিডনি বরাবর। নিয়াজ কোন শব্দই করতে পারল না। তার দেহ লাফাতে লাফাতে এক সময় নিস্তেজ হয়ে গেল। দুলাল নিয়াজের আধমরা দেহটাকে টেনে খালের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করছিল। এমন সময় নান্টু ছুটতে ছুটতে এল। বাজারের সবাই খুন খুন বলে চেঁচাচ্ছে। নান্টুর কানে সে খবর পৌঁছাতেই নান্ট ছুটল নিয়াজের কাছে। এসেই সে এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠল। ঝাপসা অন্ধকারের মধ্যে সে একটা মানুষকে দৌড়ে পালাতে দেখল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল এ আর কেউ নয়। দুলালই তার বন্ধুকে খুন করে পালাচ্ছে। সে নিয়াজের কাছে দৌড়ে গেল। ভাঙ্গা ব্রীজের সাথে কোন রকমে বেঁধে আছে নিয়াজের দেহ। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আর একটু হলে খালের মধ্যে পড়ে যেত। তার পর ভেসে কোথায় চলে যেত কে জানে। একটু দূরেই বিশাল নদী। সেই নদীতে চলে গেলে এ লাশ আর হয়ত কোন দিনই পাওয়া যেত না। হয়ত হাঙ্গর কিংবা কুমিরে খেয়ে ফেলত। মাছেরা খুবলে খুবলে খেত তার বন্ধুর লাশ, নয়ত বঙ্গোপসাগরে ভেসে যেত চির তরে। নান্টু পাঁজা কোলা করে নিয়াজকে ব্রিজের উপর থেকে রাস্তায় নিয়ে এল। এখনও বেঁচে আছে নিয়াজ। সে নিয়াজ নিয়াজ করে জোরে জোরে ডাকল। নিয়াজ শুধু একবার বলল- নীতু। তারপরই তার দেহ ঢলে পড়ল। চির তরে স্তব্ধ হয়ে গেল তার হৃদস্পন্দন।
দুলাল রক্ত মাখা ছুরি হাতেই বাজারের উপর দিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছিল। সে যেন পাগল হয়ে গেছে। চিৎকার শুনে চারদিক থেকে লোকজন দৌড়ে এসে তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলল। দুলাল ফ্যাল ফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখ থেকে একটা কথাও বেরোল না।
নীতু ঘুম থেকে উঠেই নিয়াজকে ডাকল। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে সিঁড়ির কাছে এসে নিচে উঁকি মারল। নাহ্। নীচেও কেউ নেই। তার নামা কি ঠিক। সে সিঁড়ির কাছে বসে রইল। ব্রীজের কাছে লোকজন থৈ থৈ করছে। দুলালকে বাজারের মধ্যে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। দুলালের উপর গ্রামবাসীরাও ক্ষ্যাপা। আজ তাকে বাগে পেয়ে সবাই যেন খুশী হয়েছে। তবে নিয়াজের কথা মনে করে সবার চোখই জলে ভাসছে। এত সুন্দর ছেলেটা শেষ পর্যন্ত ভালবাসার জন্য জীবন দিল।
নান্টু তার পরিচিত কয়েক জনকে লাশ পাহারা দিতে বলে বাড়ীর দিকে ছুটল। এতক্ষণে যদি নিয়াজের মৃত্যু সংবাদ নীতুর কানে পৌঁছে থাকে তা হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। নিয়াজের মৃত্যু সংবাদ নীতুর কাছে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত মনে হবে। সে নিজেও হয়ত আত্মহত্যা করে বসতে পারে। তাহলে ভীষণ সর্বনাশ হয়ে যাবে। নান্টু একদৌড়ে বাড়ী চলে এলো। নান্টুর মা নামাজের বিছানায় মোনাজাত ধরে কাঁদছেন। নান্টু আলো হাতে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে গিয়ে সিঁড়ির মাথায় নীতুর মুখোমুখি হল। নীতু তাকে দেখে চমকে উঠল। নান্টুর সারা গায়ে রক্ত। নীতু আতংকিত গলায় বলে উঠল- নিয়াজ কোথায় নান্টু ভাই? নিয়াজ কোথায়? ওর কোন বিপদ হয়নি তো। নান্টু নীতুকে বলল- আগে নীচে আস। তার পর সব বলছি। নীতু নান্টুর হাত ধরে প্রচন্ড গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামল। নান্টু শক্ত করে নীতুর দু’হাত ধরে বলল- নীতু, তোমার নিয়াজকে আর বাঁচাতে পারলাম না। দুলাল তাকে নিজের হাতেই মেরে ফেলেছে। দুলালকে সবাই হাতে নাতে ধরে ফেলেছে। চল নিয়াজকে শেষ বারের মত দেখবে। এতক্ষণে হয়ত পুলিশও এসে পড়বে। ওরা এলে অন্য ঝামেলা হবে। তাড়াতাড়ি চল। নীতু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল। নিয়াজ তারপর নান্টুর সাথে ছুটল ব্রীজের দিকে। এতক্ষণে মোজাহের সাহেবের কানেও পৌঁছে গেছে খবরটা। তিনি লোকজনসহ রওয়ানা হলেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রথমেই গেলেন নিয়াজের মৃত দেহের কাছে। সেখানে লোকজনের প্রচন্ড ভীড়। চেয়ারম্যান সাহেব ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। নীতু নিয়াজকে জড়িয়ে ধরে পড়ে আছে। তার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান সাহেব মেয়ের পাশে বসলেন। তারপর মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। নীতু লাফিয়ে উঠে বলল- কে তুই! আমাকে ছুঁবি না! তোরা আমার নিয়াজকে মেরেছিস। আমি তোদের কাউকে ছাড়ব না। কাউকে না। চেয়ারম্যান সাহেব নীতুকে শক্ত হাতে ধরলেন। তার আদরের মেয়ের একি অবস্থা হয়েছে। নীতু চিৎকার করে নিয়াজকে ডাকল। তার পর বলল- ওঠ নিয়াজ। আর কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবে। ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাও। মোজাহের সাহেব বুঝলেন তার মেয়ে পাগল হয়ে গেছে। এতক্ষণে পুলিশ এসে হাজির। তারা সন্দেহজনক সবাইকে গ্রেফতার  করে থানায নিয়ে গেল।
কিছুদিন পর নীতু ও নান্টু জামিনে ছাড়া পেল। হাজতে থাকা অবস্থায় তার পাগলামী আরও বেড়েছে। বলতে গেলে সে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। তাকে বাড়ীতে নিয়ে এসে শক্ত করে বেঁধে রাখা হল। নীতু কোন কথা না বলে চুপ করে রইল। আগে সে চিৎকার চেঁচামেচি করলেও এখন সে একদম শান্ত হয়ে গেছে। সে হয়ত বোবা হয়ে গেছে। হয়ত আর কোন দিন কথা বলতে পারবে না। আমেনা বেগম দুঃখে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসান। তিনি বারবার বিধাতার কাছে জানতে চান এটা কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কি এমন অপরাধ করেছে সে আল্লাহর দরবারে যার জন্য তাকে এমন সাজা পেতে হচ্ছে। তার চোখ ফুলে গেছে। ঝাপসা দেখছে সব কিছু।
কয়েকদিন পরে মোজাহের সাহেবও জামিনে ছাড়া পেলেন। দুলালই রয়ে গেল হাজতে। তার জামিন হওয়ার কোন আশংকা নেই। তার বিরুদ্ধে স্বচক্ষে দেখা খুনের মামলা। পুলিশ তাকে কিছুতেই জামিন দেবেন না।
মোজাহের সাহেব দুলালের সাথে দেখা করলেন। দুলাল কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল- মিয়া ভাই, আপনি আমাকে বাঁচান। আমার যত সম্পত্তি আছে প্রয়োজনে সব বিক্রি করে হলেও বাঁচান। চেয়ারম্যানের মাথায় নতুন এক দূরভিসন্ধি ভর করল। দুলাল তার আপন ভাই নয়। সৎ ভাই । তার বাবার দ্বিতীয় ঘরের একমাত্র ছেলে। দুলাল ছাড়া তার আর আপন বা সৎ কোন ভাই বোন নেই।এই বিশাল সম্পতির অংশীদার দুলাল আর তিনি। দুলাল না থাকলে সব সম্পত্তি তার । আল্লাহ তার সহায়। তিনি তার প্রতি অসীম রহমত করেছেন। দুলাল আর নিয়াজ দুজনেই তার শত্র“। নিয়াজকে শেষ করেছে দুলাল। এবার দুলালকে শেষ করবে আইন। মাঝখান থেকে এই পুরো সম্পত্তি চলে আসবে তার হাতে। মেয়েকে তিনি চিকিৎসা করিয়ে ভাল করে আবার ভাল ঘর দেখে বিয়ে দিবেন। আল্লাহ্ চাহে তো তার মনোবাঞ্চা পূর্ণ হতে আর বেশী দেরী নেই। দুলাল ছিল তার জন্য বড় বাধা। ইচ্ছে করলে এত দিনে লোক দিয়ে খতম করে দিতে পারতেন। শত হোক ভাই তো। চেয়ারম্যান সাহেব এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেননি।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হয়েছে। মনে মনে নীতুর উপর থেকে তার সব রাগ উঠে গেল। তিনি নীতুকে একবার দেখার জন্য ছুটে গেলেন। নীতু মুখ নিচু করে বসে আছে। মোজাহের সাহেব নীতুকে ডাকলেন। নীতু মুখ তুলে তাকালোও না। সে নখ দিয়ে মাটি খুঁটছে। মোজাহের সাহেবের ভীষণ ইচ্ছে হল নীতুকে মুক্ত করে দিতে। কিন্তু পাগলী মেয়ে। ছেড়ে দিলেই সাথে সাথে অঘটন ঘটাবে। তিনি তার মনের ইচ্ছা মনের মধ্যে চেপে রেখেই চলে এলেন। অনেক দিন নীতুর মুখ দেখেন না। আজও ব্যর্থ হলেন। তার মনটা এবার খারাপ হয়ে গেল। আগে মন খারাপ হলে ময়নার কথা মনে পরত। আজও পড়ল। মনে মনে ময়নার জন্য আফসোস করে উঠলেন। মনের অজান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসল। - আহ! ময়না বেঁচে থাকলে এই সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারত। ময়না পশ্চিম পাড়ার গরীব দিন মজুর জয়নালের মেয়ে। ময়নাকে দেখার সাথে সাথেই চেয়ারম্যান সাহেবের মনে ধরে। তিনি ময়নাকে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেন। আর হবেনই বা না কেন? গরীবের ঘরে জন্মালেও ময়নার ছিল দেহ ভরা রূপ আর যৌবন। সেই রূপ আর যৌবন না খেয়ে খেয়ে শুধু শুকিয়েই যাচ্ছিল। কাপড়ের অভাবে সেই অপূর্ব দেহ ছিল প্রায় নগ্ন। চেয়ারম্যান সাহেব কিনা করেছেন ময়নার জন্য। যত টাকা চেয়েছে দিয়েছেন। কাপড়-চোপড়, শাড়ী, গহনা , জামা , জুতো সব দিয়েছেন। বিনিময়ে শুধু ময়নার সাথে আনন্দ করেছেন। এক দিন ওসব করার পর চেযারম্যান সাহেব যখন ঘেমে নেয়ে গিয়ে হাঁপাচ্ছিলেন তখই ময়না তাকে বলল- অ্যাই শোন! আমার না এ মাসে ওসব হয়নি। মনে হয় একটা কিছু হয়েছে। তুমি না বলে ছিলে আমি তোমার সোনা বৌ, রূপা বৌ। তুমি আমাকে বিয়ে করবে, নতুন বৌ করে ঘরে নেবে। কবে নেবে ? এখনও যদি বিয়ে না কর তাহলে কিছু দিন পর যখন আমার সন্তান জন্মাবে তখন অবস্থাটা কি হবে ?
চেয়ারম্যান সাহেবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কিন্তু তিনি মোটেও ঘাবড়ালেন না। তার মেজাজ এতটাই খারাপ হয়েছে যে পারলে তিনি এই নচ্ছার মেয়েটাকে গলা টিপে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেন। তিনি তো ঔষধ-পত্র সব ঠিকই দিয়েছিলেন। তারপরও এসব হলো কি করে ? তা হলে কি ময়না তাকে ফাঁসানোর জন্য ঔষধ না খেয়ে ফেলে দিয়েছে ? তার মেজাজ আরো বিগড়ে গেল। কিন্তু তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন। মেয়েলোকের আর এক নাম কাল নাগিনী। ওদের ক্ষেপালে ওরা ফনা তুলে ছোবল মারবেই । পঁচা শামুকে পা কাটতে চেয়ারম্যান সাহেব রাজী নন। ময়নাকে তিনি বিয়ে করবেন না একথা তিনি বললেন না। তিনি চুপ করে আছেন বলে ময়না আবারও বলল- কি, কিছু বলছনা যে। তখন তো কত কথা বলেছিলে। এখন চুপ কেন ? উত্তেজনার মাথায় কখন কি বলেছেন তা কে জানে।
মোজাহের সাহেব এই মেয়ের দুঃসাহস দেখে অবাক হলেন। এই ফকিরনীর বাচ্চা ভাবল কেমন করে যে সত্যি সত্যি চেয়ারম্যান তাকে বিয়ে করবেন। চেয়ারম্যান তার রাগ পুরোপুরি চেপে কৃত্রিম হাসি হাসলেন। তার পর দু’গালে হাতের তালু স্পর্শ করে আদর করতে করতে বললেন- আর ক’টা দিন অপেক্ষা কর ময়না। আমি তোকে কথা দিচ্ছি সত্যি সত্যিই আমি তোকে বিয়ে করব। তোর গর্ভে যে আমারই সন্তান। ময়না খুশি হল। মেয়েরা অল্পতেই গলে যায়। চেয়ারম্যান সাহেবের এক কথায়ই কাজ হল। তবুও তিনি আরও নিশ্চিত করার জন্য বললেন- ঘরে আমার সেয়ানা মেয়ে নীতু। ওকে বিয়ে না দিয়ে যদি আমি নিজেই আর একটা বিয়ে করে ফেলি তাহলে লোকে বা কি বলবে। আর ওই মেয়েটাকে তো কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। আমি অল্পদিনের মধ্যেই নীতুর বিয়ের ব্যবস্থা করছি। তার পর আমি তোকে রাজরানী করে ঘরে নেবো।
এরপর আর চেয়ারম্যান সাহেব এদিকে পা বাড়াননি। তার খায়েশ মিটে গেছে। তিনি এখন এই আপদটাকে দূর করতে চাইছেন। ময়নার হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কিছুতেই তার গর্ভের সন্তান নষ্ট করবে না। ময়না ভীষণ জেদি মেয়ে। চেযারম্যান সাহেব হাড়ে হাড়ে চেনেন। এখন ময়নাকে শেষ করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। তাছাড়া ইতোমধ্যে ময়না নাকি দুলালকে তার জালে জড়িয়ে ফেলেছে। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দুলালের সাথে তার এই ঘনিষ্টতা গড়ে উঠেছে। তবে তাদের এই সম্পর্ক শুধুই মুখের। চেয়ারম্যান বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছেন এখন ও তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক হয়নি। একবার হলে মন্দ হতনা। দুলালের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দেয়া যেত। চেয়ারম্যান থেকে যেতেন ধোয়া তুলসি পাতা। ময়নাকে দুলালের বউ বানানোর লোভ দেখিয়ে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই ময়না দুলালকেই ফাঁসিয়ে দিত। একবার দুলালের কথা বলে পরে চেয়ারম্যানের কথা বললে কেউ বিশ্বাস করত না। সবাই হেসেই উড়িয়ে দিত। তাছাড়া কেউ বিশ্বাস করতে চইতো না যে চেয়ারম্যানের মত একজন পুরোদস্তুর মুসল্লী মানুষ এমন একটা অপকর্ম করতে পারে।  তিনি অবশ্য ময়নাকে দুলালের বৌ করতেন না। গ্রামের অন্যান্য গন্যমান্য ব্যক্তিদের বুঝিয়ে শুনিয়ে শেষমেষ চাপ দিয়ে ময়নাকে রাজী করাতেন গর্ভ নষ্ট করে ফেলতে। ময়নার বাবা গরীব দিন মজুর। জীবনে টাকার গন্ধ পাননি। টাকা পেলে নিজেই মেয়েকে ডাক্তার খানায় নিয়ে গিয়ে খালাস করে আনতেন। কিন্তু মোজাহের সাহেব যে ভাবে ভেবে ছিলেন ঘটনা সে ভাবে না ঘটে ঘটল অন্যভাবে। এক দিন ময়না  এসে হাজির তার বাড়ীতে। চেয়ারম্যান সাহেবের তো চক্ষু চড়ক গাছ। তিনি ময়নাকে কাছে ডেকে বাড়ী চলে যেতে বললেন। কিন্তু ময়নার এক কথা- তাকে বিয়ে না করলে সে সমস্ত গ্রামবাসীকে সব কথা খুলে বলে দিবে। চেয়ারম্যান সাহেব মহা বিপদে পড়লেন। অবশেষে কসম করে বললেন- রাতে আসব। তুই জেগে থাকিস। সেই রাতেই খুন হয় ময়না। ময়না দুলালের সাথে অনেক কথা বললেও এই ব্যপারে কোন কথা বলেনি। চেয়ারম্যান সাহেব বুঝতে পারলেন এই বাড়ীর বৌ হওয়ার জন্য হয়ত তার এক মাত্র হবু দেবর দুলালকে হাত করতে চেয়েছিল। তাহলে কি ময়না সত্যিই চেয়ারম্যান সহেবকে ভালবাসত ? চেয়ারম্যান সাহেবের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। তিনি ঢোক গিলতে পারছেন না। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য। রাস্তার পাশে নর্দমায় অর্ধেক কাঁদা আর অর্ধেক পানির মধ্যে উপুর হয়ে থাকা ময়নার দেহ। তিনি দু’হাতে মুখ চেপে ধরলেন। চিৎকার করে আমেনা বিবিকে ডাকলেন। আমেনা বিবি তার পাশে এসে দাঁড়াতেই তিনি কাঁপা গলায় বললেন- পানি। ঘামে তার সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। তিনি গামছা দিয়ে মুখ মুছলেন।
দুলালের সাথে দেখা করার জন্য জেলা শহরে ছুটলেন মোজাহের সাহেব। আজ একটু ঝামেলাই হল। নিত্যদিনের মত এত সহজে সাক্ষাৎ করতে পারলেন না। দুলাল তার সামনে এসে দাঁড়াতেই বললেন- কেমন আছিস ভাই আমার, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে না তো।
- মিয়া ভাই, তুমি আমাকে এখান থেকে বের করে নাও। প্রয়োজনে আমার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দাও। আমি না হয় বের হয়ে ভিক্ষা করব। না হয় অন্য কোথাও চলে যাব। তবুও তুমি আমাকে বের কর।
- একটু শান্ত হ দুলাল। তোর জামিনের জন্য দু’লাখ টাকা দিয়েছি। টাকাটা বোধ হয় গচ্ছা গেছে। যাক আবার চেষ্টা করব। তুই অত চিন্তা করিস না তো। একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। যে ভাবেই হোক আমি তোর জামিনের ব্যবস্থা করেই ছাড়ব। আর একবার বেরোতে পারলে তোকে আর কেউ এখানে আনতে পারবে না।
-ঠিক আছে মিয়া ভাই। তুমি চেষ্টা কর।
- চেষ্টা কি আর কম করছি। জানিস তো খুনের মামলা চালাতে খরচ অনেক। টাকা না ঢাললে ওরা তোর ফাঁসির ব্যবস্থা করে দেবে। আমি ভাই হয়ে কেমন করে এটা মেনে নেব। যত টাকাই লাগুক আমি তোকে বের করেই ছাড়ব। ইতোমধ্যে তোর ভাগের বেশ কিছু জমি আমি বিক্রি করেছি। তুইতো জানিস নগদ টাকা যা ছিল সব অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন জমি বিক্রি করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। চেয়ারম্যান সাহেব মিথ্যা করেই কথাগুলো বললেন। দুলালের জন্য তিনি নামমাত্র তদবির করে যাচ্ছেন। অথচ দুলালকে লক্ষ লক্ষ টাকার হিসেব দেখিয়ে তার সম্পত্তি একের পর এক আত্মসাৎ করে চলেছেন। ফাঁসির কথা শুনে দুলালের সমস্ত শরীর বরফে শীতল হয়ে গেল। সে মরতে চায় না। সে বাঁচতে চায়। কেন যে সে শুধু শুধু নিয়াজকে খুন করতে গেল। নইলে কি আর আজ এখানে এভাবে পস্তাতে হত। নিতু তার আপন ভাইঝিও না। নীতুকে নিয়ে যার খুশি পালিয়ে যাক না জাহান্নামে যাক তাতে তার কি? কার জন্য সে এমন বোকামিটা করল। মেরেছিল যখন পায়ে বা হাতে মারলেই হত। যেন না মরে ভোগে। কিন্তু এভাবে জানে মেরে ফেলল কেন? এখন যদি তার ফাঁসি হয়? দেখতে দেখতে আরো কিছু দিন গেল। দুলালের কেস চলছে পুরোদমে। চেয়ারম্যান সাহেব জামিনের জন্য নাম মাত্র চেষ্টা করে দিন নষ্ট করছেন। যতটা না চেষ্টা করেছেন, তার চেয়ে বেশি চেষ্টা করেছেন জামিন যেন না হয়। চেয়ারম্যান সাহেবের চ্যালা বশির পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল- আপনার-ই-তো কপাল। ময়না, ঘুঘু, টিয়া সব ফাঁদে ফেলে দিয়েছেন। এখন জাল গুটালেই সব হাতের মুঠোয়।
- ঠিক বলেছ। ময়না খতম। ময়নার বাবা-মাকে যে টাকা দেওয়া হয়েছে তাতে তারা কোনদিন মুখ খুলবে না। নিয়াজ শালাও খতম। দুলাল বোধহয় জামিনে ছাড়া পাবে না। ওর জামিনের জন্য সর্বশেষ আবেদনও বাতিল হয়ে গেছে। দুলালের সব সম্পত্তি আমারই। এখন শুধু মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা। মেয়েটা বোধ হয় কোন দিন ভাল হবেনা। -ভাল ডাক্তার দেখালে ও ঠিকই ভাল হয়ে যাবে। বশির বিজ্ঞের মত জবাব দেয়।
- নীতু ভাল হলেও আপনার আর ভাল হবার মত সময় নেই। দরজার আড়াল থেকে দারোগা কুদ্দুস একথা বলতে বলতে চেয়ারম্যান সাহেবের সামনে গিয়ে হাজির। চেয়ারম্যান সাহেব থ হয়ে দারোগার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দারোগা একঝটকায় কোমর থেকে তার ছোট্ট যন্ত্রটা হাতে তুলে নিলেন। তারপর চেয়ারম্যানের বুক বরাবর তাক করে বললেন- ‘‘ইউ আর আন্ডার আ্যারেষ্ট’’। পশ্চিম পাড়ার মেয়ে ময়নার খুনের অপরাধে আপনাকে গ্রেফতার করা হল। বশির দারোগার চোখ ফাঁকি দিয়ে সরে পড়ছিল । কিন্তু দারোগা সাহেব বশিরের জামার কলার ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। সাথে সাথে দু’জন সেপাই ঘরের মধ্যে ঢুকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে ফেলল চেয়ারম্যান ও বশিরের হাতে। চেয়ারম্যান কি যেন বলতে গেলেন। দারোগা বলল- এখানে কোন কথা নয়। যা বলার কোর্টে বলবেন। সেপাই দু’জন চেয়ারম্যান সাহেব ও বশিরকে নিয়ে ততক্ষণে বাড়ির সামনের রাস্তায় চলে গেছেন। দারোগা সাহেবের কানে একটা অট্টহাসি ভেসে এল। এ কন্ঠ তার চেনা। তিনি নীতুকে একবার দেখার জন্য ফিরে তাকালেন। নীতু তার শিকল ছিঁড়ে ফেলে তার দিকে ছুটে আসছে। তার হাতে একটা ধারালো লম্বা দা। দারোগা সাহেব ভয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নীতু তার দিকে ওভাবে ছুটে আসছে কেন? ততক্ষণে নীতু দারোগা সাহেবের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার গগণ বিদারী হাসিতে দারোগা সাহেব চমকে গেলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে নীতুকে ধরতে চেষ্টা করলেন। নীতুর হাতের ধারালো দা শুন্যে উঠে গেছে। দারোগা সাহেবের রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নীতুও ক্লান্ত হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল দারোগার নিস্তেজ দেহের উপর।

Comments

Popular posts from this blog

মিথ-পুরাণ ও বিষ্ণু দে-র কবিতা / সৈয়দ কওসর জামাল

মিথ কী ও কেন মিথ বিষয়টিকে জানা ও বোঝার জন্য বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিদ, এমনকি সাহিত্য সাহিত্য সমালোচকের মধ্যে উৎসাহের অন্ত নেই। অজ¯্র গ্রন্ত এ বিষয়ে রচিত হয়েছে। বিচিত্র এসবের বিষয়, বিচিত্র এইসব গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রেক্ষিতে মিথের কোনো  সৃনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ দুরুহ। কোনো পক্ষ থেকে নৃতত্বের পাঠকদের জানানো হয়েছে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যে তারা যে মিথের ব্যবহার দেখে থাকেন, তা আসলে মিথ-ই নয়। কেননা তাদের কোনো ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ নেই। কেউ আবার আধুনিক লেখদের ‘মিথোম্যানিয়া’ সম্পর্কেও পাঠকদের সতর্ক করেছেন, কারণ এ হল ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপসারণ। এ সব সত্ত্বেও সাহিত্য মিথের ব্যবহার সক্রিয় আর বুদ্ধিবৃত্তি বা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা মিথের আছে। বরং নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান মিথ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও জটিল হয়েছে। প্রত্যেকটি শাখার গবেষকরাই তাদের নিজস্ব তত্ত্বের আলোকে মিথকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের বলার কথা এই যে মানবসমাজের গোড়ায় আদিম ধর্মীয় স্তর থেকে অবচেতন  মনের আধুনিক অ

UCPDC - 600 Bangla

ইউসিপিডিসি-৬০০ ধারা-১ঃ ইউসিপিডিসি-এর প্রয়োগঃ ইউসিপিডিসি এর ২০০৭ সালের সংশোধনী আইসিসি পাবলিকেশন ৬০০ এর বিধি বা ধারাসমূহ (স্ট্যাণ্ড বাই লেটার অব ক্রেডিট সহ) সকল এলসিতে প্রয়োগ হবে। এলসিতে নির্দিষ্ট কোন স্থানে উল্লেখ না করলে তা সকল পক্ষের উপরই কার্যকর হবে। ধারা-২ঃ সংজ্ঞা ঃ অন্য কোন অর্থে ব্যবহার না করলে এই বিধিতে এ্যাডাভাইজিং ব্যাংক বলতে সেই ব্যাংককে বোঝাবে যে ইস্যুইং ব্যাংক এর অনুরোধে ঋণপত্র সুবিধা প্রদান করে। গ্রাহক বলতে সেই পক্ষকে বোঝাবে যার অনুরোধে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়। ব্যাংকিং কর্ম দিবস বলতে সেই দিনকেই বুঝাবে যেদিন ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট স্থানে উক্ত বিধি অনুযায়ী নিয়মিতভাবে তার প্রত্যাহিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বেনিফিসিয়ারী বলতে সেই পক্ষকে বুঝাবে যার পক্ষে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। কমপ্লাইং প্রেজেণ্টেশন বলতে সেই প্রেজেণ্টেশনকে বুঝাবে যা ঋণের সকল শর্তানুযায়ী করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আদর্শ ব্যাংকিং চর্চার আওতাধীন। কনফার্মেশন বলতে কনফার্মিং ব্যাংক এর পাশাপাশি ইস্যুইং ব্যাংক কর্তৃক সুনির্দিষ্টভাবে একটি কমপ্লাইং প্রেজেণ্টেশনকে অনুমোদন ঝুঝায়। কনফার্মিং ব্যাংক বলতে সেই ব্যাংককে ঝুঝা

ইতিহাসের কবি, কবির ইতিহাস : জীবনানন্দ দাশ / সৈয়দ কওসর জামাল

What thou lov`st is thy true heritage! উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যা কিছু পাই, তার মধ্যেকার ভালোটুকু এবং ইতিহাসের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের এই পংক্তিটি প্রবাদ হয়ে আছে। এই হেরিটেজ-এর প্রতি মমত্ব যেমন সমাজবদ্ধ মানুষের সহজাত, কবিও তেমনি এখানে খুঁজে পান তাঁর ইতিহাসচেতনার আধারটিকে। হেরিটেজ যেমন ইতিহাস হয়ে ওঠে, এই ইতিহাসও তেমনি কবিতার হেরিটেজ হয়ে যায়। ইতিহাস বিচ্ছুরিত আলো কবির মুখে পড়ে, আর কবিতাও সেই আলোর স্পর্শ পায়।     ইতিহাসে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের এক ব্যাপক বিস্তার। এই বিস্তারের দিকে কবিকেও চোখ রাখতে হয়। তবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের জন্য নয়, ইতিহাসের ভিতরের সারসত্যটুকু ও ইতিহাসের মর্মকথাটিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অলোকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। কবির চেতনার আলোকে ইতিহাসের দুএকটি মর্মকথা বা সত্যসূত্র শুধু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একেই আমরা কবির ইতিহাসচেতনার বলি, যা বহুস্তরীয়, আর তাকে প্রকাশিত হতে দেখি কবিতায় কতো বিচিত্র ভঙ্গিতে। কাব্যপ্রক্রিয়ার এই চেতনা অতি সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে দেয়। অন্য সে কবিতা ইতিহাস নয় ইতিহাসের সারমর্মটুকু বুকে ধরে রাখে। ইতিহাসপাঠে